আশাপূর্ণা দেবী
দেশটা প্রগতিশীল হয়ে গেছে দেখেই বোধহয় দেশের মধ্যে কার সেই প্রাণ ভোমরাটুকু একেবারে পুরণো চেহারাখানা নিয়ে বসে আছে এটা অপ্রত্যাশিত লাগলো। আর যা অপ্রত্যাশিত তাই তো আহ্লাদের।
শশীতারা ঊর্ধ্বমুখে তাকিয়ে দেখে বললেন, পঞ্চাশ ষাট বছরের মধ্যে বোধহয় বাড়িতে মিস্তিরি মজুর লাগেনি?
কথাটা ফট করে গায়ে লাগলো প্রৌঢ়া মহিলাটির।
তিনি বেজার গলায় বললেন, লাগাবার মতো আছে কে, যে লাগাবে?
শশীতারা অবশ্য ওর ওই বেজারে বিশেষ আনন্দ অনুভব করেন। বললেন, যারা ভোগ করছে তারা ছাড়া আর কে করতে আসবে? জমি জলা বাগান পুকুর বিষয় আশয় তো কম ছিল না আমাদের শ্বশুর ঠাকুরের!
এই—আমাদের শ্বশুর ঠাকুরের শব্দটি উচ্চারণ করায় রীতিমত পলিটিকস আছে। প্রৌঢ়া যাতে জ্বলে যান।
তা তিনি গেলেনও। ভাবলেন, তার মানে ইনি কোমর বেঁধেই এসেছেন। ইনিও যে সমান অংশীদার তা শোনালেন। একে উচ্ছেদ করতে না পারলে ওই আলসের অশ্বত্থের চারার মতই হবে।
মহিলা বেজার গলায় বললেন, সেই আশাতেই বোধহয় ছুটে এসেছেন শাশুড়ী যেতে না যেতে। তবে যে মানুষ চিরজন্ম ভুগে মলো, তার সঙ্গে যে—মানুষ কোনো কালে তাকিয়ে দেখলো না, তার তুলনা চলেনা।
ওমা, এ বৌটা তো দেখছি আচ্ছা কুঁদুলী। শশীতারা অবলীলায় বলেন, তা আমার অবিশ্যি কুকুরের কামড় হাঁটুর নীচে। তবে দ্যাওরের আমার পরিবার ভাগ্যি ভালো নয় মনে হচ্ছে। মানুষকে যে আদর আপ্যায়ন করতে হয়, সে জ্ঞানও নেই। তা কর্তাটি কোথায়? যা বলবার তাকেই বলবো ছুঁচো মেরে হাত গন্ধ করি না আমি। তবে শিক্ষা সহবত তোমার ভালো নয়, একথা একশোবার বলবো। মরুক গে, যার যা বুদ্ধি! ওই যে ছেলেমেয়ে দুটোকে দেখলাম, ওরা কে?
মহিলাটি দেওয়ালের দিকে মুখ করে ভারী গলায় বলেন, আমার নাতি নাত্নি।
ছেলের ঘরের?
না। অনিচ্ছুক কণ্ঠ ঘোষণা করে, মেয়ের ঘরের। জামাই নেই।
হায় কপাল। এই দ্যাখো, ফোঁকটে অন্যের সম্পত্তি নেবো খাবো বললেই কি আর ভগবান রাজী হন? অমনি অন্য ভার চাপান। তা মেয়ে কটি?
ওই একটিই। বলে মহিলাটি উঠানের তারে শুকোতে দেওয়া কাপড় চোপড়গুলি তুলতে নেমে যান।
শশীতারা বলেন, কপাল আর কি! এক তরকারি আলুনি! আর ছেলে কটি?
মহিলা যত বেজারই হোন—কথার উত্তরগুলো দিতে বাধ্য হন। ছেলে ষেটের দুটি।
ওমা! তবে তো তুমি রাজা গো! একটা ছেলে বিনেই তো সব শূন্য। ছেলেরা কই?
ছেলেরা এখানে থাকে না। কলকাতায় কাজ করে।
ও! তা মেয়ে?
মহিলাটি সংক্ষেপে বলেন, আছে ঘরে। এসেছেন যখন দেখতেই পাবেন।
শশীতারা গম্ভীর হন। বলেন, সেতো সত্যি! দেখতেই তো এসেছি। তবে জন্ম বিধবার সামনে মুখ দেখাতে লজ্জার কিছু ছিল না মেয়ের। আর সদ্য জ্যেঠিই হই যখন। দেখা সাক্ষাৎ নেই বলে তো আর সম্পর্কটা মুছে যায়নি। তা তোমার নাম কি?
মহিলাটি আরো বেজার গলায় বলেন, আমার আবার নাম!
তা মা বাপ তো দিয়েছিল একটা—
সে কবেকার কথা ভুলে গেছি।
তবে আর কি। ছোট বৌই ভাল। নাকি মেজ? কয় ভাই এরা? মানে সৎশাশুড়ীর ছেলে কটি?
ওই একজনই—
শশীতারা বলেন, হায় কপাল। তা তিনি কই?
ইস্কুলে পড়ায়, চারটেয় ফিরবে।
শশীতারা চোখ কপালে তুলে বলেন, ও কপাল! বুড়োকে এখনো ছেলে ঠেঙিয়ে খেতে হচ্ছে? কেন তোমাদের ছেলেরা টাকা পাঠায় না?
ছোট বৌ গম্ভীর ভাবে বলেন, একদণ্ডেই কি সব জেনে ফেলা ভালো দিদি?
শশীতারা এ অপমান গায়ে মাখেন না। অম্লান বদনে বলেন, তা অ, আ, ক, খ না চিনলে কি বই পড়া যায়? তোমাদের নাম পরিচয় আচার আচরণ কিছুই তো জানি না, সেগুলো জানবো, তবে তো আপন বলে বুঝবো। এই জানাটাই অ, আ, ক, খ। মনে থাকার মধ্যে মনে আছে, সেই বৌ বেলায় সৎশাশুড়ীর একটা সোন্দর ফুটফুটে ছেলে দেখেছিলাম, আমার বয়সী। তোমার কর্তা যে সেইটিই কি না তাও তা জানি না। নামও ভুলে গেছি। ছেলে তো ওই একটি শাশুড়ীর মেয়ে?
চার ননদ ছিল, সবই মরে হেজে গেছে।
পুণ্যির বংশ। তা আগের আর কেউ ছিল টিল?
আমার নিজের শাশুড়ীর আর ছিল না। আগের শাশুড়ীর শুধু একটি ছেলে—তা’ তিনিই তো।
তা আর আমায় বোঝাতে হবে না ছোট গিন্নী! আগের শাশুড়ীর সে ছেলের জাজ্জল্যমান সাক্ষী তো এই সামনেই। তা বাড়িতে টিপকল আছে না কুয়ো?
ছোট গিন্নী মাথা নেড়ে বললেন, কিছুই না। পুকুর ভরসা। কুয়ো ছিল পড়ে গেছে।
শশীতারা গালে হাত দেন। বলেন, ওমা আমি কোথা যাবো! একালে এমন গেঁয়ো ভূত হয়ে থাকে নাকি কেউ? তাও তো তোমাদের এখানটা দিব্যি শহর বাজার। বলি খাবার জল?
পাশের বাড়ির টিউবওয়েল থেকে আসে।
ছোট গিন্নীর মনে হচ্ছিল, বুড়ির কোনো কথার উত্তর দেবে না। কিন্তু এমন আশ্চর্য, না দিয়েও পারছে না। বুড়ি যেন মনিবের মতো প্রশ্ন করছে।
শশীতারা ওর মনের ভাব হাড়ে হাড়ে বুঝছেন, আর মনে মনে হাসছেন।
এখনই হয়েছে কি? যখন বিষয়ের অর্ধেক অংশ চাইবো, তখন কী করবে দেখা যাক।
ছোটলোকের মতন হালচাল!
কেন, দু’বিঘে জমি বেচে সব সামলে নেনা! বাড়িটা মেরামত কর, টিপকল বসা, নাইবার ঘর বানা। তা নয়, ধান চাল খাচ্ছেন আর বসে আছেন। ছেলেদের গুণেও বলিহারী! কলকাতায় গিয়ে বসে আছিস, দেখছিস না বুড়ো মা বাপ কোনদিন ছাত চাপা পড়ে মরে। তার ওপর আবার একটা বিধবা বোন। গুচ্ছের অপোগণ্ড ভাগনা ভাগনী? একটা কেউ পুকুরে ডুবে মরলে?
তা এতো সব আর বললেন না এখন। শুধু বললেন, তবে এইবেলা রোদে রোদে পুকুর থেকেই চানটা সেরে আসি।
ছোটগিন্নী আবারও কথা বলেই ফেলেন, এই অবহেলায় চান করবেন?
ওমা, চান করবো না তো কি রেলগাড়ির শরীরে থাকবো? তা কাছে পিঠে কোথায় একটা কালী মন্দির ছিল না?
আশ্চর্য, এটাও মনে পড়ে গেল শশীতারার। নতুন বর—কনেকে নিয়ে মন্দির ঘুরিয়ে নিয়ে আসা হয়েছিল।
ছোটগিন্নী বলেন, কালী মন্দির নয়, সিংহবাহিনীর মন্দির।
তা হবে! আছে তো?
মন্দির আর কোথায় যাবে? চিরকালের জিনিস ছিল আছে।
বাঃ ছোটগিন্নীর কথা কী মিষ্টি! যেন ঢিল ছুঁড়ে মারছে। দ্যাওরের আমার ভাগ্যি ভালো।
শশীতারা গামছা নিয়ে পুকুরের উদ্দেশে যান।
অসুবিধে অনেক হবে।
তবু চেপে বসে থাকতে হবে।
ভাগের জমিটা দখল করে নিয়ে বেচবার খদ্দের জোগাড় করা, সময় লাগবে। সহজে কি দেবে?
রাজবালা ছটফট করছিলেন। রাজবালা শশীতারাকে চানের ঘাট দেখিয়ে দিয়েই ঘরে এসে ছোট নাতিকে ইস্কুলে পাঠালেন, যা ছুটে গিয়ে দাদুকে ডেকে আনগে। বলবি ফুলপুর থেকে তোমার বৌদি এসেছে।
মেয়ে ঘরে আছে বললেও, আসলে নেই।
মেয়ের ঘরে মন টেঁকে না, ও কেবল পাড়া বেড়িয়ে বেড়ায়।
ভবেশ বাঁড়ুয্যের দ্বিতীয় পক্ষের অবদান রমেশ সত্যিই একদা ফুটফুটে ছেলে ছিলো, কিন্তু এখন তাকে দেখলে মনে হবে যেন একটা আটফাটা হ্যারিকেনের চিমনি।
যেন ভিতরে যে প্রাণ শিখাটুকু জ্বলছে, তার আলোটা ধোঁয়ায় আড়ালে অদৃশ্য।
তামাটে রং, পাকসিটে গড়ন, ঝুলে পড়া মুখ, চুলগুলো সাদা ধবধবে।
খবরটা শুনে প্রথমটা অবিশ্বাস্য বিস্ময়ে পাথর হয়ে গেলেন রমেশ মাষ্টার।
আমার বৌদি এসেছেন! কোথা থেকে?
ফুলপুর থেকে।
রমেশের হাত পা কেঁপে উঠলো। আর সন্দেহের কিছু নেই। ভাগীদার ভাগ নিতে এসেছেন। অথচ এই ভয়ে তিনি মা মরতে একটা খবরও দেননি। অবিশ্যি একবার ছোট্ট করে তুলেছিলেন কথাটা কর্তব্যবোধে, কিন্তু যে ছেলেরা দেশের এই জমিজমাকে জিনিস বলে মনেই করে না, সেই ছেলেরাই আপত্তি তুলে বললো, কোনো দরকার নেই। এলেই দেখবেন শুনবেন, বিষয়ের ভাগ চাইবেন। জীবনে তো কখনো দেখলাম না।
তা আমিও তো বলিনি। তোদের বিয়ে টিয়ের সময় বললে আসতেন কিনা কে জানে।
বাঃ শুনেছি তো তোমার বিয়ের সময় কে যেন নেমন্তন্ন করতে গিয়েছিল, ওনার বাবা না ঠাকুর্দা তাকে বাইরে থেকেই ভাগিয়ে দিয়েছিলো।
হ্যাঁ, ওই রকমই একটা ঘটেছিল বটে।
তবে আবার কী? ওসব কর্তব্যের আর দরকার নেই।
রাজবালাও বলেছিলেন, খাল কেটে কুমীর আনা বুদ্ধিমানের কাজ নয়, বুদ্ধিহীনের কাজ।
অতএব বুদ্ধিমানই হয়ে বসে ছিলেন রমেশ মাষ্টার।
খবরটা শুনে কিছুক্ষণ নিথর হয়ে থেকেই হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন রমেশ মাষ্টার।
রাজবালা দরজাতেই দাঁড়িয়ে ছিলেন।
রমেশ ইসারায় জিজ্ঞেস করলেন, কোথায়?
চান করে এসে লক্ষ্মীর ঘরে ঢুকেছেন।
এটাও প্রায় ইসারাতেই বললেন রাজবালা।
রমেশ এদিক ওদিক তাকিয়ে আস্তে বললেন, তা কি রকম দেখলে?
কি করে বোঝাবো?
না, মানে আগের মতই আছেন কি না?
আগে তো আমি দেখিনি।
তা বটে।
রমেশ নিজের ঘরের মধ্যে ঢুকে এসে জানলা দিয়ে বরাবর লক্ষ্মীর ঘরের দরজার দিকে চোরা চাহনি নিক্ষেপ করেন। আর মনে মনে চোটপাট করবার শক্তি—সংগ্রহ করতে চেষ্টা করেন।
রাজবালা কাছাকাছি বসে বলেন, আমার তো মনে হলো একখানি জাঁহাবাজ মেয়ে মানুষ!
তাই নাকি?
রমেশ মাষ্টারের মুখটা শুকিয়ে যায়। বলেন, কি করে বুঝলে?
কথাবার্তা ধরনধারণ দেখলাম তো সবই। যেন মনিব গিন্নী এসেছেন প্রজার বাড়ি, এমনি ভাব!
রমেশ বলে, কেন? কেন? তেমন ভাব হবার কারণ?
কারণ তুমিই বুঝো। আমি যা দেখলাম তাই বলছি।
কি বললেন টললেন?
অতো কথা বলবার এখন সময় নেই। তবে যা বললেন, তাতে মনে হলো আমাকে মশা মাছির মতন জ্ঞান করছেন।
রমেশ থতমত খেয়ে বলেন, তার মানে?
ওই তো বলছি—মানে, কারণ, সে সব তুমি বোঝ এবার।
বাঃ যত দোষ, নন্দ ঘোষ! আমি কি চোর দায়ে ধরা পড়েছি। আমি নেমতন্ন করে নিয়ে এসেছি?
কে এনেছে কে জানে। বিছানা বালিশ বাক্স বাসন গুছিয়ে এসে তো বসলেন।
রমেশ মাষ্টার হাতপাখা নিয়ে নাড়ছিলেন, সেটা হাত থেকে ফেলে দিয়ে ভীত গলায় বলেন, হঠাৎ কি ভেবে, তাই ভাবছি।
কি ভেবে সেটা আর বুঝতে পারছো না?
রাজবালা মুখ বাঁকান, মা গেছেন শুনে টনক নড়েছে। নাও এখন বিষয়ের চুল চেরো, সমান হিস্যের ভাগীদার তো!
রমেশ দুর্বল গলায় বলেন, বাঃ ওঁর তো ছেলেপুলে নেই।
নেই বলে যে ভাগ ছাড়বেন তা মনে হয় না।
রমেশ ভীতভাবে বলেন, বললেন না কি সে কথা?
বলবেন। আসল লোকের কাছে বলবেন। কেঁচো কেন্নোর সঙ্গে বলবেন না। বলে মুখ ঘুরিয়ে চলে যান ছোটগিন্নি।
এবার তাঁর ছুটি।
এখন বুঝুক দ্যাওর ভাজে।
লক্ষ্মীর ঘর থেকে বেরিয়েই মুখোমুখি! কারণ রমেশ ততক্ষণে ছটফটিয়ে ওই দরজা পর্যন্তই গিয়ে পড়েছেন।
দুজনেই চমকে বললেন, কে?
রমেশ আস্তে একটা প্রণাম করে বললেন, আমি বড়বৌ!
শশীতারা আশীর্বাদ করে বললেন, ঠাকুরপো!
তারপরই প্রথম কথা বললেন, তোমার সেই রংটা কোথায় গেল ঠাকুরপো?
রমেশ চমকে বলেন, কোন রংটা?
শশীতারা হেসে উঠে বলেন, ওমা অমন চমকে উঠলে কেন? বলছি সেই যে বৌ হয়ে এসে দেখেছিলাম ছোট্ট ফুটফুটে চাঁদের মতো একটি ছেলে—সে তো শুনছি তুমিই। আর যখন ভাই নেই। তাই বলছি সেই রংটা কোথায় গেল?
এবার রমেশ হেসে ওঠেন। হা হা করে হাসি।
পাশের ঘর থেকে ছোট গিন্নীও চমকে ওঠেন।
এরকম হাসি রমেশ কতোকাল আগে হাসতেন।
হাসি থামিয়ে রমেশ বললেন, সেই ফুটফুটে ছেলেটাকে এখন খুঁজছো বড় বৌ? তাহলে আমিও বলি—সেই রূপকথার রাজকন্যের মতো রূপসী বৌটিকে কোথায় ফেলে রেখে এলে বড়বৌ? আমরা ছোটরা চুপি চুপি যার নাম দিয়েছিলাম পরীবৌ।
শশীতারা হঠাৎ কেমন অবসন্নতা বোধ করেন।
একাদশী বলেই কী? কিন্তু উপোস আবার কবে শশীতারাকে কাবু করতে পেরেছে?
শশীতারা তবু জোর দিয়ে বলার চেষ্টা করেন, আহা! আর কিছু না?
রমেশ কেমন অন্যমনস্কের মতো খোলা দরজা দিয়ে উঠোনের মাঝখানটায় তাকিয়ে বলেন, সত্যিই বড়বৌ! সেদিন সকাল থেকে ওই উঠোনে আলপনা আঁকা হয়েছে, কনে বৌ এসে দাঁড়াবে। আমরা ছোট ছেলেরা কী দারুণ উত্তেজনা নিয়েই ঘুরছি, হঠাৎ এক সময় শাঁখ বেজে উঠলো। ছুটে চলে এলাম। আর দেখে সত্যি বলছি যেন হাঁ হয়ে গেলাম।
যেন সত্যিই রূপকথার গল্পের কুঁচবরণ কন্যে মেঘবরণ চুল! মাথায় শোলার মুকুট, তবু তাতেই কী শোভা! যেন মহারাণী!
বীরনগর হাই স্কুলের ঝুলে পড়া হেড পণ্ডিত রমেশ বাঁডুয্যে হঠাৎ যেন স্বপ্নাচ্ছন্নের গলায় বলেন, আর মাথা ছাড়া আগাগোড়াই তো সোনা দিয়ে মোড়া।…পরে তোমার কাছ ঘেসে আমি আর আমার ছোট বোন পুনি দুজনে চুপিচুপি গহণাগুলোর নাম জিগ্যেস করেছিলাম। মনে আছে তোমার?
শশীতারা হেসে ফেলে বলেন, তা অবিশ্যি মনে নেই, তবে ছেলেটাকে মনে পড়ছে। কাঁচের মতন চকচকে চোখ, পশমের মতন চুল।
রমেশ তেমনি স্বপ্নাচ্ছন্নের মত বলেন, আমার একটা নাম মনে আছে। একটাকে বলেছিলে বাজুবন্ধ। আর একটা বোধহয় সাতনরী।
পাশের ঘরের বন্ধ দরজায় কান পেতে দাঁড়িয়ে রাজবালা মুখ কোঁচকায়, দ্যাওর ভাজে খুব যে রসের কথা হচ্ছে। গোড়াতেই অমন আদিখ্যেতা করতে বসলে আর তুমি শক্ত হতে পারবে? হঠাৎ বৌদিকে দেখে ভাব উথলে উঠলো দেখছি। পেটের মেয়েটা দুঃখী হয়ে এসে পড়ে আছে, তার সঙ্গে তো একবার ভাল মুখে কথা কইতে শুনি না। কেবল শাসন, কোথায় গিয়েছিলি? এতো এতো পাড়া বেড়াস কেন? তাসের আড্ডায় বসার দরকার কি? ভগবান যেমন কপাল করে দিয়েছে তেমনি থাকো—
এই সব!
আর এখন ভাজ দেখে মিষ্টি কথা ফুটছে! বাবাঃ উনি যে কী ঘুঘু তা আমি বুঝে নিয়েছি। মনে কোরো না মিষ্টি কথায় তুষ্ট করে ফেলবে ওঁকে। কানটা আবার চেপে ধরেন রাজবালা।
শুনতে পান রমেশ মাষ্টার বিহ্বল গলায় বলছেন, বৌ এসে দুধে আলতার পাথরে দাঁড়ালো। আমরা ছোটরা বলাবলি করে ঠিক করে নিলাম আমরা ওঁকে পরীবৌ বলে ডাকবো।…মানুষের কতোবারই জন্মান্তর ঘটে বড়বৌ। আজ কে বলবে তুমিই সেই মানুষ। সেই পরীবৌ!
রাজবালা জানলার গোড়ায় চলে আসেন, দেখেন বড় গিন্নী এসে দাওয়ার সিঁড়িতে বসলেন, তাঁর দ্যাওরও। টানা টানা বেশ কয়েকটা সিঁড়ি নেমে তবে উঠোনে নামতে হয়। শশীতারাও বিহ্বলের মতো দাওয়ায় সিঁড়িতে বসে পড়ে তাকিয়ে দেখেন সেই উঠোন। যেন আলপনার রেশগুলো খোঁজেন। খোঁজেন তার উপর বসানো দুধে আলতার পাথরটা।
যার উপরে টোপর পরা বরের পিছু পিছু এসে দাঁড়াবে এক রূপকথার রাজকন্যে।
যার গলায় সাতনরী হার, কপালে ঝাঁপটা, হাতে বাউটি বালা বাজুবন্ধ তাবিজ। আঙুলে আঙুলে আংটি বসানো রতনচুড়, পায়ে চরণ পদ্ম।
এইখানে এই উঠোনের ইতিহাসে সেই অলৌকিক লাবণ্যের টুকরোটুকু সংরক্ষিত। আর সংরক্ষিত আছে ওই ফাটা ভাঙা মানুষটার মধ্যে।
* * *
শশীতারা বহুদিনের ভুলে যাওয়া হারানো একটা সম্পত্তির সন্ধানে এসেছিলেন, সেটাই পেয়ে গেলেন নাকি?
তা নইলে শশীতারার মুখের চেহারায় অমন উজ্জ্বল গভীর প্রশান্তি কিসের?
শশীতারা রমেশ মাষ্টারের পেশীবহুল শীর্ণ মুখটার দিকে তাকিয়ে বলেন, সে জন্মের কথা এখন আর কেউ মনে রাখেনি, কি বল?
রমেশ মাষ্টার বললেন, নাঃ। সবাই জানে রমেশ মাষ্টারও এমনি আটফাটা। যেমন তার বাড়ির ছিরি তেমনি তার নিজের ছিরি।
শশীতারার মনে হলো, রমেশ যেন শশীতারার বলবার কথাটাই বলে নিলো।
শশীতারা অন্যমনস্ক গলায় বলেন, সত্যি, বাড়িখানারও আমাদেরই মতন অবস্থা হয়েছে। বলে চুপ করে যান।
কথার জাহাজ শশীতারার এই মৌনতা বিস্ময়কর। আর শশীতারা নিজেই নিজের মনোভাবে বিস্মিত হন।
বাড়িখানার এই অবস্থার জন্যে তিনি যেন বেশ একটু বেদনা অনুভব করছেন, আর যেন অপরাধ বোধও।
কিন্তু কেন?
তাঁর কিসের অপরাধ?
তাঁর কেন বেদনাবোধ?
শশীতারা এ বাড়ীর কে?
ওই আটফাটা চেহারা ইস্কুল মাষ্টারটার সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ‘আমাদের’ বললেন কী করে?
* * *
তাসের আসর থেকে হাতের তাস ফেলে উঠে এলো অন্ন।
পিছন দরজা দিয়ে আস্তে ঢুকে মার সন্ধানে উঁকি ঝুঁকি দিয়ে দেখলো মা চৌকিতে শুয়ে আছে চুপ করে। কাছে গিয়ে বললো, মা কী ব্যাপার? কি ঘটনা শুনছি?
রাজবালা পাশ ফিরে বললেন, ভালই ব্যাপার, ভালই ঘটনা। এ বাড়ির বড় গিন্নী। এক রাজা গেলেন আর এক রাজা এলেন! দাসী বাঁদী দাসী বাঁদীই রয়ে গেল।
অন্ন মুখ বাঁকিয়ে বললো, ইল্লি! অমনি তিনি এসে রাজা হবেন? তাঁর কি রাইট শুনি?
রাইট তো সমান সমান।
তা বেশ—মামলা মোকদ্দমা করে আদায় করতে পারেন তখন বোঝা যাবে। তা তুমি এখন শুয়ে?
রাজবালা এই আসন্ন সন্ধ্যায় বিছানায় পড়ে থাকারূপ গর্হিত কর্ম করেও অনুতপ্ত না হয়ে বলেন, মাথায় বাড়ি পড়লেই মানুষ শুয়ে পড়ে। মামলা মোকদ্দমার আর ফাঁক নেই অনি! তোর বাপ একেবারে এক মিনিটেই বড় বৌয়ের পাদপদ্মে ফুল চন্দন দিয়ে বসে আছেন।
তার মানে?
তার মানে সেই কোন জন্মের পুরনো কাহিনী, একজনের বয়েস যখন সাত আর অন্য জনের নয় কি আট। তখনকার গল্পে মসগুল একেবারে।
তাতে কি?
কি তা বুঝবি ক্রমশঃ। ও লোক আর মামলার দিকে গেছে! অথচ তিনি উকিল ভাইপো সঙ্গে করে এসেছেন।
উকিল!
তবে আর বলছি কি। দেখলেই বুঝবে কি বস্তু।
আমার দায় পড়ছে দেখতে যেতে।
তোমার পড়েনি, তোমার বাপের পড়েছে। তিনবার খবর নিয়ে যাওয়া হয়েছে অন্ন ফিরেছে কিনা।
তা তিনি কি থাকবেন নাকি?
থাকবেন বলেই তো এসেছেন। একেবারে বাক্স বিছানা নিয়ে।
অন্নর ভারী বিরক্তি লাগে।
এ কী গেরো রে বাবা।
একে তো আজন্ম পাহাড়ে মেয়ে মানুষ ঠাকুমার জ্বালায় মাথা তোলবার উপায় ছিল না বেচারী মার। আবার হঠাৎ একী উৎপাত!
অন্ন বলে, ওসব মতলব ফলবে না। এই বেলা উৎখাত করে বিদেয় করো।
তুই পারিস কর। তোদের বাপ যদি ওঁর দলে হয়ে বসেন?
ধ্যেৎ! কী যে বাজে কথা বল। তাই কখনো হয়? যতোই হোক বাবার চিরকাল একটু চক্ষুলজ্জা বেশী জানো তো? তা দাদা ছোড়দাকে খবর দিলে হয় না?
দেখা যাক। রাজবালা বিরক্ত গলায় বলেন, তাঁরাই বা আমায় কী ছাতা দিয়ে মাথা রক্ষে করছেন। এখানের জমি জমাকে তো তাঁরা জিনিস বলে গণ্যই করেন না।
অন্ন বিজ্ঞের গলায় বলে বসে, ঠাকুমার দুর্বুদ্ধিতে। যে বলতো, এক ছটাক জমিও বেচা চলবে না। না বেচলে আর ওই ইষ্টিশানের ধারের গরু চরার মাঠটার কী মূল্য বলো। এইবার ঠাকুমা গেছে, আর ভয়টা কাকে? বেচলে—
ভয় এনাকে।
রাজবালা বলেন, ইনি যদি এখন ভাগ ভেন্নর ধুয়ো তোলেন, বলেন বেচাকেনা চলবে না? তার মানে আমার জীবদ্দশা শেষ।
তোর বাপের থেকে বোধহয় দু বছরের বড়ো। অবিশ্যি দেখলে তা বোঝায় না। তাঁকেই ছোট দেখায়, এঁকেই বুড়ো! বড়লোকের মেয়ে, যত্ন আত্মির শরীর।
তা এখন তাহলে এই গরীব শ্বশুর বাড়িতে আসা কেন বাবা? অন্ন বেজার মুখে বলে, গরীবের অন্নে ভাগ বসাতে?
তা বললে কী হবে? উকিল ভাইপো বোধহয় বুঝিয়েছে হকের ধন মদনমোহন।
অন্নর ছেলে মেয়ে দুটো খিদে পেয়েছে, খিদে পেয়েছে করে ঘুরছিলো। সেই সময় রমেশ মাষ্টার ঢুকলেন হাতে এক হাঁড়ি ছানার জিলিপি নিয়ে।
উৎসাহিত গলায় বললেন, তোদের বড় দিদিমা আনালেন তোদের জন্যে। খা।
রাজবালা উঠে বসলেন। বললেন, এসেই হাত করার ফন্দীটি বার করেছেন ভাল। খা ভাই খা, বড় মানুষ বড়দিদিমার দয়ার দান বড় বড় মিষ্টি খা। গরীব দিদিমার কাছে তো বোঁদে রসমুণ্ডির ওপর ওঠে না।
রমেশ মাষ্টার বললেন, ছোট ছেলেপুলের সামনে মনের বিষ ওগরাচ্ছো কেন? দেখইনা মানুষটা কেমন?
অন্ন মা’র হয়ে বলে, কেমন, তা তো ওঁর আসার ব্যবস্থা দেখেই বোঝা গেছে বাবা! একটা চিঠিতে জানান না দিয়ে একেবারে থাকবো বলে চলে আসা—
রমেশ অপ্রতিভ ভাবে বলেন, হয়তো হঠাৎ মন হয়েছে।
এতোকালে মন হলো না, এখন যেই ঠাকুমা মারা গেলেন অমনি মন হলো।
অন্নর যুক্তি অকাট্য।
তবু রমেশের যেন মনে হয়, বাড়িতে একটা মানুষের মত মানুষ এসে দাঁড়িয়েছে। যেন রমেশ তার কাছে একটা আশ্রয় পাবে। এই বুড়ো বয়েস পর্যন্ত মায়ের আওতায় থেকে অভ্যস্ত রমেশ মাষ্টার কি মাথা তুলে মুক্তির নিশ্বাস না ফেলে আর একটা আওতার আশ্বাস পেয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে বসতে চায়।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন