আশাপূর্ণা দেবী
তুলসী বিড়িটা ধরিয়ে নিয়ে একটা টানের পর হাতে রেখে বলে, ‘তাহলে ওই কথাই রইল। ভাব বসে বসে। তিন শেয়ালের যুক্তির শেষে কী হয় দেখি।’ তুলসী চলে যায়।
আর ওরা তিনজন নিজেদের বিষয়ে কথাটি না কয়ে বলে ওঠে, ‘আচ্ছা ওই ডাক্তার শালা কে বল দেখি? কোন শয়তানটা?’
ননীর দোকানে লোহার শিকে হারিকেন লণ্ঠন ঝুলছিল, চৌকিতে মাদুর পাতা ছিল, এবং ননী একা বসে তাসটা ভাঁজছিল।
আশ্চর্য! পরপর দুটো দিন চলে গেছে, আজ তিনদিন, ননীর দোকান নিঃঝুম। ননীর দোকানে তাসের আড্ডা নেই। তিনটে ছেলের একটাও এই তিনদিনে এল না, এর মানে কী?
অথচ ননী দোকান থেকে নড়তে পারছে না। সকালবেলা হিমসিম খেয়ে যাচ্ছে ননী।
একফোঁটা ছেলেটাকেই ডেকে ডেকে একটু সাহায্য চেয়েছে।
এ রকম কখনো হয় না।
এদিকে দিদিও তো জবাব দিয়েছে।
তিনজনের একসঙ্গে অসুখ করবে, এটাও তো সম্ভব কথা নয়।
ননী ভাবতে থাকে সেই শেষ দিন কী ঘটেছিল। খেলার সময় তুলসী এসে পড়ে খেলাটা ভেস্তে গিয়েছিল বটে, কিন্তু এরকম তো হয়ই। তুলসী মুখপুড়ী এসে উদয় হলেই খেলার জমাটিটা ভেঙে যায়।
এসেই হয় কারুর হাত থেকে খপ করে হাততাসটা টেনে নিয়ে ‘সরে বোস, আমি একটু খেলি’, বলে খেলতে বসে যায়, এক জনকে বেকার বসে থাকতে হয়, নয়তো গাল—গল্প করে বিড়ি—সিগারেট উড়িয়ে খেলার বাঁধুনীটা নষ্ট করে দেয়।
সেদিনও তাই করেছিল, তার বেশী কিছু নয়। ননী তো কাউকেই কিছু বলেনি।
ভারি চিন্তায় পড়ে যায় ননী।
ওই বাচাল মেয়েটা যেন মায়াবিনী জাদুকরী! তিনটে ছোঁড়াই ওর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে আছে চিরটা কাল। বিয়ে—থা ঘরকন্না পর্যন্ত করছে না। এক একটা বিয়ে করে ফেললেই বৌ ওই জাদুমন্তর ফর্সা করে দিতো। ননী এবার ওদের জোর করবে। ননীকে ওরা বড়ভাইয়ের মতই ভাবে, ননীর একটা দায়িত্ব আছে।
ননী তাস নিয়ে পেসেন্স খেলে চলে।
হঠাৎ ননীর সামনে একটা ছায়া পড়লো।
চমকে তাকালো ননী।
ছায়ামূর্তি বলে উঠলো, ‘কী ননীদা, আজ এমন দুরবস্থা যে তোমার? এক্ষুনি রাজ্যপাট গুটিয়ে গেছে?’
ননী গম্ভীর ভাবে বলে, ‘আয় বোস। রাজ্যপাট আজ তিনদিন বন্ধ।’
‘তাই নাকি? কেন?’
‘কেন সেটা তো তোকেই জিজ্ঞেস করবো ভাবছি।’
‘আমি কী বলবো? কেন? ওরা আর আসছে না?’
‘না?’
‘তার মানে তাসের আড্ডা বন্ধ?’
‘হুঁ।’
‘না আর হুঁ! তোমার আজ কী হল?’
‘কী আর হবে। ভাল লাগছে না—বসে আছি। ওদের সঙ্গে দেখা—টেখা হয়েছে এর মধ্যে?’
তুলসী একটু কেঁপে ওঠে।
ডাহা মিছেকথাটা বলবে কী করে?
কী করে বলবে, রোজই দেখা হয়েছে, হচ্ছে। সকালে সন্ধ্যেয়। আমি চেয়েছিলাম ওদের মধ্যে কোনো একটাকে বিয়ে করে একটু নিশ্চিন্ত হয়ে বসি, আর সত্যি বলতে কি, মনে ঠিকই করা ছিল। সুখেনটাই ঝাঁপিয়ে পড়বে। ওটাই চিরকাল যেন আমার গার্জেনের পোস্ট নিয়ে আছে। যেন আমার ওপর ওর কিসের এক দাবি দাওয়া। কিন্তু এখন দেখছি তিনটেতেই আমার জন্যে—
ননী বললো, ‘ভাবছিস কী? ওদের সঙ্গে দেখা হয়েছিল কিনা জিজ্ঞেস করলাম, শুনে যেন দারুণ চিন্তায় পড়ে গেলি। অসুখ বিসুখ হয়নি তো কারুর?’
‘অসুখ—বিসুখ শত্রুর হোক। ভাবছি এই তো কখন যেন দেখা হলো—’
‘তুই যেন কী চাপছিস মনে হচ্ছে তুলসী!’
তুলসী চৌকীর একটা কোণে বসে পড়ে তাসগুলো টেনে নিয়ে ভাঁজতে ভাঁজতে বলে, ‘তোমার চোখে কিছু এড়ানোর জো নেই। তা হলে খুলেই বলি। একটা সিগ্রেট ধরাবো ননীদা?’
ননী বেজার গলায় বলে, ‘কেন, দু’দণ্ড আর ওই ধোঁয়া না গিললে চলে না? এমন ছোটলোকের মতন অভ্যেসটা কী করে করে ফেললি?’
‘ছোটলোকের মত?’
তুলসী হেসে ওঠে, ‘কী বল গো ননীদা? ভালো ভালো ভদ্দরলোকের মেয়েছেলেরা খাচ্ছে না?’ বলে, ‘ওটাই হলো মডার্ন ফ্যাশান। আমাদের বড় সার্জেনের শালী এসেছিলেন, তিনি নাকি কোন মস্ত অফিসারের বৌ, হাসপাতাল দেখতে এসেছিলেন, তার মধ্যে বোধ হয় এক প্যাকেট সিগ্রেট ধ্বংসালেন।’
‘বেশ করলেন। অফিসারের পরিবারের যা শোভা পায়, তা দীন—দুঃখীদের পায় না তুলসী! ওরা যেটাই করুক, সেটা হচ্ছে ফ্যাশান, আর গরীবগুরবোরা করলেই ছোটলোকমি।’
‘বাবা বাবা! সামান্য নিয়েও এতো লেকচার ঝাড়তে পারো তুমি ননীদা! তাহলে আর কী হবে, বিনি মৌতাতেই বলি—নানান জ্বালায় জ্বলে ঠিক করে ফেলেছি, আর এমন বেওয়ারিশ হয়ে থাকব না। একটা ওয়ারিশান জোগাড় করে ফেলে একটু নিশ্বাস ফেলে ঘুমিয়ে বাঁচি।
ননী তীক্ষ্ন গলায় বলে, ‘অত’ কায়দা করে বলার কী আছে? এতোদিনে তাহলে বিয়ের মন হয়েছে? তা নানান জ্বালাটা কী?’
তুলসী ননীর দিকে একবার চোখ তুলে তাকায়। তারপর মাথা নীচু করে ছেঁড়া মাদুরের ভাঙা কাঠি ভেঙে নিয়ে টুকরো করতে করতে বলে, ‘সে আর তোমায় কী বলব ননীদা! দাদা বলি, গুরুজন বলে মনে করি। পৃথিবীতে জন্তু—জানোয়ারের উপদ্রব তো কম নয়।’
‘হুঁ, তা বিয়েটা কি ঠিক হয়ে গেছে। পাত্তর কোথাকার? সরকারী হাসপাতালের দাইকে বিয়ে করতে রাজী তো?’
তুলসীর চোখের তারায় ফস করে যেন আগুন জ্বলে ওঠে।
তুলসী আত্মস্থ গলায় ঠোঁটের কোণে একটু বাঁকা হাসি হেসে বলে, ‘রাজী কি গো? শুনে অবধি পায়ে পড়ছে।’
‘পায়ে পড়ছে!’
ননীও ব্যঙ্গের গলায় বলে, ‘এমন একটা হতভাগাকে জোটালি কোথা থেকে?’
তুলসী হেসে উঠে ছুরিকাটা গলায় বলে, ‘একটা কী গো ননীদা, একসঙ্গে তিনটে জুটেছে। তিনটেই ওই শুনে অবধি আমার বাড়ির মাটি নিয়েছে। তা আমি ওদের বলছি, হ্যাঁরে আমি কী দ্রৌপদী হব?’
‘হুঁ’।
ননী হঠাৎ তুলসীর হাতের কাছ থেকে তাস কটা সরিয়ে প্যাকেটে পুরে ফেলতে ফেলতে গম্ভীর গলায় বলে, ‘তা হতে বাধাই বা কী? তিনটেকেই যখন নাচিয়েছিস—’
তুলসীও গম্ভীর হয়ে বলে, ‘আমি মোটেই কাউকে নাচাতে যাইনি ননীদা, শুধু বলেছিলাম, এ ভাবে আর রাক্ষসের ভয়ে কাঁটা হয়ে রাতে না ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে পেরে উঠছি না। সেই এতটুকুন বয়েস থেকে যুদ্ধ করে যেন ফুরিয়ে যাচ্ছি। তাই তোদের শরণ নিচ্ছি, যে পারিস আমায় একটু আশ্রয় দে। কী করে জানবো তিনজনেই দরজা খুলে বসেছিল!’
‘ওঃ!’
ননী তুলসীর মুখের দিকে তাকায়!
অহঙ্কারে ধরাকে সরা দেখছেন বোধহয় শ্রীমতী তুলসী মঞ্জরী। ওই হ্যাংলা হতভাগা তিনটে হামড়ে গিয়ে পড়ে মাথা ঘুরিয়ে দিয়েছে আর কী!
কিন্তু তাই কি?
তুলসীর মুখে দর্প—অহঙ্কারের উগ্রতা কোথায়?
যেন বেশ বিপন্ন বিপন্ন মুখ।
যেন সত্যিই বেচারী কিংকর্তব্যবিমূঢ়!
দেখল, তা বলে ননী নরম হল না।
ননী বেশ বিদ্রূপের গলায় বলে, ‘ওঃ তাহলে একেবারে রাজকন্যার স্বয়ংবর—সভা বসে গেছে বল? তা’ ভাবনার কী আছে? যে দরজাটা সবচেয়ে বড় সেটাতেই ঢুকে পড়। তারপর শুম্ভ নিশুম্ভর পালা চলুক।
তুলসী উঠে দাঁড়ায়। আহত গলায় বলে, ‘তুমি আমায় চিরকাল ঠাট্টা—ব্যঙ্গই করলে ননীদা, আমার দুঃখু জ্বালাটা কখনো দেখলে না। ছোটবেলায় যখন এর দোরে ওর দোরে ঘুরে বেড়িয়েছি, তখন যদি একটু দয়া—ঘেন্না করে আশ্রয় দিতে, তাহলে হয়তো আজ সরকারি হাসপাতালে দাই হতে হত না’।
‘আমি?’
ননী আকাশ থেকে পড়ে বলে, ‘আমি তোকে কী সুবাদে আশ্রয় দিতাম?’
‘সুবাদ কি শুধু সম্বন্ধ দিয়েই হয় ননীদা? তুমি একটা মানুষ, আর আমিও একটা মানুষ—এই সুবাদে!’
‘এই সুবাদে?’
ননী প্রায় খিঁচিয়ে ওঠে, ‘আহা! তুলসী, তুই যেন এইমাত্তর সগগো থেকে খসে পড়লি, নরলোকের কিছু জানিস না। মানুষের ওপর ‘মানুষে’র ব্যবহার করাটি যত সহজ মেয়েমানুষের ওপর তা নয়, বুঝলি?’
‘বুঝলাম।’ বলে একটু হাসে তুলসী, ‘এই যে একটু সুখ—দুঃখের কথা কইছি, তাতেই বুক ছমছম করছে, এক্ষুনি দরজার আড়ালে পদ্মদির ছায়া পড়বে।’
পদ্মদি!
ননী উদাস গলায় বলে, ‘দিদি নেই।’
‘নেই! নেই মানে?’
‘মানে চলে গেছে?’
‘কোথায় গেছে?’
ননী হঠাৎ দাঁড়িয়ে উঠে তিক্ত গলায় বলে, ‘শ্বশুরবাড়ি।
‘ও বাবা! বল কি? পদ্মদির আবার যাবার মতন একটা শ্বশুরবাড়ি ছিল নাকি ননীদা?’
‘ছিল না! গজালো। ভাসুর না অসুর কে যে ছিল, সে বুঝি মরেছে, তাই ইনি তার সদ্যবিধবা পরিবারের সঙ্গে মামলা লড়ে বিষয়ের ভাগ আদায় করতে গেলেন।’
তুলসী ননীর ওই তিক্ত মুখের দিকে তাকায়।
তুলসী অবাক হয়ে বলে, ‘এ—সব কখন হল? এই তো সেদিনও—’
‘হয়েছে কাল। খবর পাওয়া মাত্তর দড়ি—ছেঁড়া হয়ে চলে গেল। দুটো বাচ্ছা যে ওর মুখোপেক্ষী হয়ে পড়ে আছে তাও ভাবল না একবার। বলল কি জানিস? জীব দিয়েছেন যিনি, আহার দেবেন তিনি। পিসি বিহনে কি আর ওদের খাওয়া আটকে থাকবে? মেয়েমানুষ জাতটা ভারী লুভিষ্টে, বুঝলি তুলসী! কী ছাইয়ের বিষয় সম্পত্তি আছে ভগবান জানে, তবু লোভে পড়ে লড়ালড়ি করতে ছুটল। এখানে তোর অভাবটা কী ছিল? খেতে পাচ্ছিলি না? পরতে পাচ্ছিলি না? গিন্নিত্বর অভাব ছিল? রাতদিন তো ভাইটা আর ভাইপো—ভাইঝি দুটোর মাথা হাতে কাটত। তবু ওই বললাম তো, মেয়েমানুষ জাতটা লোভেই মরে—’
তুলসী তীক্ষ্ন গলায় বলে, ‘জাতটাকে তো ভালই চিনে ফেলেছ দেখছি ননীদা! তবে কনক বৌদিও মেয়েমানুষ জাতেরই ছিল।’
ননী চমকে উঠল যেন।
ননী বোধহয় এ কথাটার জন্যে প্রস্তুত ছিল না।
ননী গুম হয়ে গেল।
তারপর নিশ্বাস ফেলে আস্তে বলল, ‘এক—আধজন দেবী অংশে জন্মায় তুলসী!’
‘তা বটে!’
তুলসী মনে মনে বলে, সময়কালে মরতে পারলেই দেবী হওয়া যায়। যার মরণ নেই তার দেবী হওয়ার উপায় নেই।
যাক, তুলসী তো আর দেবী অংশে জন্মায় নি। তুলসী কীটপতঙ্গের সামিল। তুলসী অতএব ওই সব বড় বড় কথা ছেড়ে ফট করে একটা কীটস্য কীটের মত কথা বলে। বলে, ‘সরকারী হাসপাতালের দাইয়ের হাতে খেলে তোমার না হয় জাত যেতে পারে, শিশু দুটোর কী সে ভয় আছে?’
ননী হঠাৎ প্রায় ধমকে উঠে বলে, ‘জাত যাওয়ার কথা বলেছি তোকে আমি? একবার একটা কথা বলে ফেলেছি বলে খালি খালি সেই খোঁটা দেওয়া হচ্ছে। জাত যাবে! বলেছি আমি জাত যাবে?’
কোনদিন কারুর ধমকেই ভয় খায় না তুলসী।
তাই বেশ সতেজেই বলে, ‘বলনি তা সত্যি! তবে এ কথাও বলনি, তুলসী ওদের পিসি চলে গেছে, দুটো ভাত সেদ্ধ করে দিয়ে যাস।’
‘দিদি সবে কাল গেছে।’
‘কাল গেছে, তারপর তিন চারটে বেলাও গেছে।’
‘তোর বড্ড সময় তাই তাকে বলতে যাবো!’
‘সময় আছে কি নেই সেকথা আমি বুঝতাম।’
‘বেশ বাবা ঠিক আছে। এই গলায় বস্তর দিয়ে বলছি—তুলসী—মঞ্জরী, তুমি এসে দুটি রান্না করে দিয়ে যেও। তবে এও বলব তুলসী, এটা চালালে লোকনিন্দে হতে ছাড়বে না।’
‘উঃ ননীদা!’
তুলসী কপালে হাত থাবড়ে বলে, ‘চিরটাকাল ওই ভাবনাতেই মলে ননীদা! যাকগে তুমি না হয় আমায় কিছু মাইনেই ধরে দিও তার বদলে। তাতে তো আর দোষ নেই? ঝি—চাকরানীর হাতে খেতে তো আর নিন্দে নেই, আর কে না খাচ্ছে এখন?’
তুলসী দোকান থেকে নামে।
ননী একটু এগিয়ে আসে।
বলে, ‘আচ্ছা তুলসী, এত কটু কথা শিখলি কোথায় বল তো? এই করণপুর শহরে বোধহয় তোর মতন মুখরা আর দুর্বাক্য বলিয়ে মেয়ে দুটো নেই।’
তুলসী চলে যাচ্ছিল, ফিরে দাঁড়ায়।
তুলসীর মুখে ওই ঝুলন্ত লণ্ঠনের আলোটা যেন একটা আলোছায়ার নক্সা কাটে।
তুলসী একটু গভীর রহস্যময় হাসি হেসে বলে, ‘কোথা থেকে এত কটুকথা শিখলাম তাই জিগ্যেস করছ ননীদা? যদি বলি ভাগ্যের কাছে।’
‘ভাগ্যের কাছে মানে?’
‘মানে বুঝিয়ে বলতে বসি, এত সময় আর এখন নেই ননীদা, আজ আবার ডিউটি। তবে এইটুকুই বলে যাই, এই মুখই আমার অস্তর! এরই জোরেই এযাবৎ শত্রু তাড়িয়ে আসছি। তুলসীর এই মুখটা না থাকলে আজ তুলসীর অস্তিত্ব বলে কিছু থাকত না, কোথায় তলিয়ে যেত। যাকগে ওসব কথা, বলি ভোরের বেলা রাঁধব তেমন রসদ আছে ভাঁড়ারে? নাকি এসে দেখব ভাঁড়ার ঢনঢন।’
‘জানি না! দেখিনি।’
‘ওঃ জানো না, দেখোনি! তা আজ বাপ—বেটা—বেটিতে কী খাওয়া হয়েছিল? হরিমটর?’
‘আজ হোটেলে খেয়ে এসেছি সবাই মিলে।’
‘বাঃ চমৎকার! এই তো চাই। ঠিক আছে, আসছি।’
তুলসী এবার দ্রুতপায়ে এগিয়ে যায়।
কিন্তু ননী যে কেন চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে সেইদিকে তাকিয়ে?
তুলসীই বা মোড়ে বাঁক নেবার সময় ঘুরে তাকিয়ে দেখে কেন?
তুলসী এখন ননীকে আলোর আড়ালে দেখতে পায়। ননীর কপালে আলোছায়ার নক্সা নেই, ননীর সবটাই অন্ধকার, শুধু মাথার পিছনে একটা আলোর আভাস।
সামান্য রেখায়।
ওই চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকা ননীকে যেন কেমন বেচারী বেচারী দেখতে লাগে। যেন খোলা মাঠের মাঝখানে একলা একটা গাছ দাঁড়িয়ে আছে।
পথের মাঝখানে পিছু ধরল একজন। তাড়াতাড়ি হেঁটে কাছাকাছি পৌঁছে আস্তে ডাকল, ‘তুলসী!’
তুলসী চমকালো না, কারণ ওই সঙ্গ নেওয়াটা তুলসীর চোখ এড়ায়নি।
তুলসী গম্ভীরভাবে বলে, ‘রাস্তায় সঙ্গে সঙ্গে যাওয়া ভাল দেখায় না জগাই!’ জগাইও গম্ভীর হতে জানে।
বলে, ‘তা বাড়িতেও তো যেতে দিস না তুলসী!’
‘তা রাত—বিয়েতে বাড়িতেই বা যেতে দেব কেন?’
‘আমায় তুই অবিশ্বাস করিস তুলসী?’
জগাইয়ের গলায় আহত অভিমান।
তুলসী চলতে চলতে বলে, ‘অবিশ্বাসের কথা হচ্ছে না, লোকনিন্দের কথা হচ্ছে।’
‘দুদিন বাদে তো তোর সঙ্গে আমার বিয়েই হবে।’
‘একেবারে হবেই ধরে নিয়েছিস?’
জগাই কাতরভাবে বলে, ‘ধরে নেব না? তুই আমায় সে আশ্বাস দিসনি? বলিসনি, তা তোকে বিয়ে করা বরং ভালো। একটু বোকা—সোকা ভালো—মানুষ আছিস, আমাকে এঁটে উঠতে পারবি না—বলিসনি?’
তুলসী হেসে ফেলে বলে, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ বলেছিলাম বটে। তুই যে সেটা একেবারে বেদবাক্য বলে ধরে নিবি তা বাবা বুঝতে পারিনি।’
‘বুঝতে পারিসনি? তা পারবি কেন? কোনোদিনই তো জগাই হতভাগার দিকে ভাল করে তাকিয়েও দেখিসনি। অথচ আমি চিরকাল তোকে—’
তুলসী হতাশভাবে বলে, ‘আমার কী অবস্থা হয়েছে জানিস জগাই, তেষ্টা পেয়ে একঘটি জল চাইলাম, ভগবান ডুবিয়ে মারতে এক—পুকুর জল দিল। মনে করেছিলাম ছেলেবেলা থেকে চেনা জানা, আড্ডা—ইয়ার্কি দিই, এই পর্যন্ত। সত্যি কি আর তোদের কারুর এই হাসপাতালের দাইটাকে বৌ করে ঘরে নিয়ে যাবার হিম্মত হবে? প্রথমটা যদিও বা আগ্রহ দেখাস, শেষটা সাত পাঁচ ভেবে পিছিয়ে যাবি। তা আমার সে হিসেব তো ভুলই হয়েছে দেখছি… কে? কে ওখানে?…ওঃ রাজেন? এই দেখ জগাই, আমার আর এক খদ্দের।…রাজেন, তোদের বলেছিলাম মন স্থির করতে দুটো দিন সময় নে, এখন দেখছি উল্টো হচ্ছে। আমারই এখন মনঃস্থির করতে সময়ের দরকার।’
রাজেন ক্ষুব্ধ গলায় বলে, ‘তা জানি, এখন ভাবছিস, একটা বড়গাছে নৌকো বাঁধলেই হত।’
‘বড়গাছে মানে? কী বলতে চাস তুই?’ তুলসী পলকে ফিরে দাঁড়ায়।
রাজেন বলে, ‘বলতে কিছুই চাই না তুলসী! আক্ষেপের মাথায় কথার কথা বলেছি। তবে এই যদি তোর মনে ছিল, তবে সেদিন অকারণ একটা সুখের ছবি দেখালি কেন? এখন গাছে তুলে দিয়ে মই কেড়ে নিচ্ছিস? আমি ইত্যবসরে জগাকে নোটিস দিয়েছি ঘর খুঁজে নিগে যা।’
‘নোটিস দিয়ে দিয়েছিস?’
তুলসী রুক্ষ গলায় বলে, ‘নোটিস দেওয়ার কী ছিল?’
‘বাঃ আমার বাসায় তো মোটে দেড়খানা ঘর। ওর চালচুলো নেই বলে একসঙ্গে থাকি। এরপর কী করে চলবে?’
‘কেন, ওই আধখানা ঘরেই থাকত ও।’
তুলসী ঘাড় ফিরিয়ে বলে, ‘কী রে জগাই, পারতিস না?’
কেউ সাড়া দেয় না।
কখন নিঃশব্দে চলে গেছে সে।
তুলসী ক্ষুব্ধ গলায় বলে, ‘চিরকালের বন্ধুকে বিতাড়িত করে বৌ এনে প্রতিষ্ঠে করবি রাজেন? ভেবে লজ্জা হল না?’
রাজেন অম্লান মুখে বলে, ‘কিছু না। ভাইবন্ধু আত্মকুটুম্বু সব্বাইকে বিতাড়িত করে বৌকে প্রতিষ্ঠে করা যায়। তাতে লজ্জার কিছু নেই, জগৎ সংসার তাই করছে। বৌয়ের তুল্য বস্তু পৃথিবীতে আর আছে নাকি তুলসী?’
‘উচ্ছন্ন যাও তুমি!’
বলে তুলসী হনহনিয়ে পা চালায়।
কিন্তু রাজেন কি আর হতাশ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়বে?
রাজেনও এগিয়ে গিয়ে ধরে।
বলে, ‘খুব তো মহত্ত্ব দেখাচ্ছিস! বলি ওর চোখের সামনে তোকে নিয়ে সংসার করব, এটা ও ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে দেখবে, সেটাই বুঝি খুব আহ্লাদের হবে জগাইয়ের? যা বলেছি ‘ভালর জন্যেই বলেছি রে তুলসী!’
তুলসী ক্লান্ত একটা নিশ্বাস ফেলে।
তুলসী অনেকটা পথ জোরে জোরে এসেছে। আর ননীর দোকান থেকে তার নিজের বাসা তো কম দূর নয়। হাসপাতালের কোয়ার্টারগুলোর কাছাকাছিই বাসা নিয়েছিল ও। শুধু মাঝখানে একটা মাঠের ব্যবধান।
নিশ্বাসটা ফেলে তুলসী বলে, ‘তুই আমায় নিয়ে সুখে সংসার করছিস এ কথাটা কী পাকা হয়ে গেছে?’
‘পাকা কাঁচা তোর হাতে’, রাজেন তীব্র উত্তর দেয়, ‘তবে আমাকে না করলে রইল ওই হাবা জগাই। সুখেনকে তুমি পাচ্ছ না। সুখেনের পিসি বলেছে খ্যাংরা নিয়ে বৌ বরণ করতে আসবে।’
তুলসী বলে, ‘সুখেন বলেছে, ওসব ভয় দেখানোকে ও কেয়ার করে না।’
‘এখন তাই বলছে, কার্যক্ষেত্রে দেখিস, পিসি ঠিকই থাকবে আর দুবেলা খ্যাংরা মেরে তবে কথা কইবে। আমার বাবা নাঙ্গার নেই বাটপাড়ের ভয়। কেউ কোথাও নেই।’
‘তেমনি বৌ যত্ন করতেও কেউ নেই।’
রাজেন পরিতৃপ্তির হাসি হেসে বলে, ‘কেউ—য়ের দরকার কী? আমিই করব, দেখিয়ে দেব যত্ন কাকে বলে! আমি সেই কবে থেকে—বলতে গেলে জ্ঞানাবধিই—’
‘রাজেন একটু চুপ কর। আমার মাথাটা যেন ঝিম ঝিম করছে।’
অগত্যাই চুপ করে যেতে হয় রাজেনকে।
তুলসীর মাথা ঝিম ঝিম?
সে তো সোজা কথা নয়।
কে জানে এক একজন কোন লগ্নে জন্মায় তাদের অকারণ সবাই সমীহ করে, ভয় করে।
ভিখিরীর ঘরের মেয়েও রাজেন্দ্রাণীর ভূমিকা নেয়।
‘যাচ্ছিস তো চল আমার সঙ্গে,’ তুলসী বলে, ‘দেখিগে আবার কোন শয়তান এসে বাড়ি পাহারা দিচ্ছে কি না।’
অনুমান ভুল নয় তুলসীর। বেড়ার দরজা থেকেই দেখতে পাওয়া যাচ্ছে দাওয়ার ওপর একটা দীর্ঘাকৃতি কালো ছায়া।
‘রাজেন, চলে যাসনে।’
তুলসী হুকুমের স্বরেই বলে, ‘এখন যাসনে। ওই ইঁটখানা দে।’
কিন্তু ছায়ামূর্তি ততক্ষণে বলে ওঠে, ‘এই, এই, আমি আমি।’
‘তুই! তুই এত রাত্তিরে যে?’
‘কেন আর? তোর কাছে পাকা কথা নিতে।’
তুলসী সেই দাওয়ার সিঁড়ির ওপরই বসে পড়ে বলে, ‘তোরা কী চাস বলত? ‘আমি দ্রৌপদী হই?’
আটটার সময় গিয়ে পৌঁছনোর কথা, প্রায় রোজই সাড়ে আটটা বেজে যাবেই।
নার্স মনোরমা মণ্ডল ভুরু কুঁচকে বলে, ‘এভাবে প্রতিদিন দেরী করলে তো চলবে না তুলসী! কী হচ্ছে আজকাল? ঘুম কী তোমার এত বেড়েছে?’
তুলসী দ্রুত ভঙ্গীতে ওষুধের জলে হাত ধুতে ধুতে বলে, ‘ঘুম বাড়তে যাবে কেন? ঘুম শত্রুর বাড়ুক। আপনাকে তো বলেই ছিলাম একটা পার্ট টাইমের চাকরী নিয়েছি।’
মনোরমা মণ্ডল বড় গলায় বলে, ‘তোমার পার্ট টাইমের কাজ বজায় রেখে ডিউটি দিতে এলে তো আর ওপরওয়ালারা শুনবে না।’
তুলসী হেসে বলে, ‘আমার ওপরওলা তো আপনি। আপনি শুনলেই হল।’
ডাক্তার ঘোষের একদার অনুগৃহীতা, এবং এখন পরিত্যক্তা নার্স মনোরমা মণ্ডল স্বভাবতই তুলসীর উপর দারুণ ক্ষিপ্ত।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন