সোনার কৌটো – ১

আশাপূর্ণা দেবী

খবরটা জবর বটে।

কানাকানি করবার মতই।

ফুলপুরের পাড়ায় পাড়ায় রটে গেল খবরটা বেশ একখানি বিস্ময়ের বাহন হয়ে।

চাটুয্যে বাড়ির শশীতারা শ্বশুর বাড়ি যাচ্ছেন!

একজনের মুখ থেকে অনেক জনের কানে। আর কান থেকেই কানাকানি।

ব্যাপারটা কী?

হঠাৎ শ্বশুর বাড়ি?

শ্বশুর বাড়ি মানেটাই বা কী?

শশীতারার যে একটা শ্বশুর বাড়ি ছিল, তাই তো ভুলে গিয়েছিল লোকে। কম বয়সীরা তো জানেই না শশীতারার কোনো দিন বিয়ে হয়েছিল। নেহাৎ বুড়োরা ছাড়া ফুলপুরের সব্বাই এই একই মূর্তিতে দেখছে শশীতারাকে! বুড়িটুড়িরা বলে শশীতারার নাকি কাঁচা সোনার মতো রং ছিল, একতাল মেঘের মত চুল ছিল। তা’ চুলগুলো কবে যেন প্রয়াগে গিয়ে ত্রিবেণী সঙ্গমে বিসর্জন দিয়ে এসেছিলেন শশীতারা। আর রংটাকে বিসর্জন দিয়েছেন, আচার আমসত্ব, বড়ি আমসি, আর ডাহা ডাহা নির্জলা উপোসের বিচিত্র সঙ্গমে।

দীর্ঘকালাবধি যে মূর্তি সবাই দেখেছে, সে হচ্ছে ঠকঠকে চ্যাঙা গড়নের চেহারা। মাথার চুল ছোট করে ছাঁটা, রোদে জ্বলা তামাটে রং, আর তীক্ষ্নধার একখানি মুখ। ওই ধারালো ভঙ্গীটা শুধু মুখের কাটুনিতেই নয়, মুখের ভাষাতেও।

চাটুয্যে বাড়ির বড়কর্তার বড় মেয়ে এই শশীতারাকে এখন আর দিদি ঠাকরুণ বলবার লোকও নেই, সবাই বলে শশীঠাকরুণ। ওতে সম্পর্কের হিসেব কসাটা বাঁচে। বয়স্করা কেউ কেউ সামনা সামনি কথা বলতে পিসিমা বলে, কিন্তু আড়ালে ওই শশীঠাকরুণ।

শশীঠাকরুণকে কেউ নাকি মটকা তসর গরদ ছাড়া সুতি থান পরতে দেখেনি। উদয়াস্ত ওই তাঁর সাজ। তা’ছাড়া গামছা আছে। রাত্রে যে ঘণ্টা কয়েক তিনি বিছানায় দেহ পাতেন, সে নাকি নিজেকে ওই গামছার আবরণেই মুড়ে।

বিধবা হলেই যে একেবারে সর্বহারা মূর্তিতে সংসারে চরে বেড়াতে হবে, এমন ব্যবস্থা এ যুগে আর নেই, কিন্তু শশীতারার বৈধব্যের আমলে ছিল। কারণ সেই আমলটা ছিল ষাট বছর আগে।

বিয়েটাও সেই একই সনে।

ন’বছর বয়সেই বিয়ে এবং বৈধব্য দুই সেরে শশীতারা তাঁর জন্মভিটেয় সেই যে শেকড় গেড়ে বসেছিলেন, তীর্থটীর্থ ব্যতীত আর কোথাও নড়েননি।

শশীতারার সেই বিয়ে এবং বৈধব্যের কালে তাঁর ঠাকুর্দা অঘোর চাটুয্যে বেঁচে ছিলেন, যাঁর প্রতাপে প্রজাবর্গ নাকি বাপের নাম ভুলে যেত। আর যাঁর দাপটে নাকি সেই বাঘে গরুতে এক ঘাটে জল যাওয়ার প্রবাদটা সর্বদা উল্লেখ করা হতো।

প্রথম পৌত্রী শশীতারাকে ন’ বছরেই কায়দা করে ফেলেছিলেন অঘোর চাটুয্যে, যাতে মেয়েটা কোনো ক্রমেই না চৌদ্দপুরুষকে নরকস্থ করে বসে।

তা’ মেয়েটা উল্টো দিকে ক্ষমতা দেখালো।

বিয়ের বছর না ঘুরতেই বরটাকে স্বর্গে পাঠিয়ে দিলো। তখনো শশীতারা ফুলপুরেই খোসমেজাজে পাড়া বেড়িয়ে বেড়াচ্ছে, ঠাকুমার কুলের আচার চুরি করে এনে বান্ধবীদের বিলোচ্ছে, সাঁতরে দীঘির এপার ওপার করছে। আর গিন্নীদের কাছে বকুনি খাচ্ছে, এতো দস্যি মেয়ে! পরের ঘরে গিয়ে কী হবে তোমার?

শশীতারা গাছে চড়ে কাঁচা আম ঠেঙাচ্ছিল, সেই সময় নাকি খবরটা এসেছিল। কিম্বদন্তী আছে—শশীতারার পিসী শশীতারাকে ঠেঙিয়ে গাছ থেকে পেড়ে আনতে অক্ষম হয়েছিলেন। পিসী তাকে নামিয়ে তার কপাল এবং নিজের কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে ঘাটে গিয়ে পড়ে যখন ভাইঝির বৈধব্যকৃত্য সম্পাদন করছিলেন, তখন নাকি শশীতারা পিসিকে বেশ জোর গলায় বলেছিল, বেশ হয়েছে, খুব হয়েছে, পরের ঘরে গিয়ে তোর কী দশা হবে রে—বলে খিঁচোতে এসো এবার? আর তো যেতে হবে না পরের ঘরে! লবডঙ্কা!

তা’ শশীতারার সেই শৈশবটা তো এখন ইতিহাসের কোঠায়। এ কিম্বদন্তীও তো শোনা যায়, শশীতারার উনত্রিশ বছরের বাবা অভয় চাটুয্যে জামাইয়ের মৃত্যু সংবাদে এতো বিচলিত হয়ে গিয়েছিল যে বলে বসেছিল, ও বিয়ে বিয়েই নয়, আমি তো সম্প্রদান পর্যন্ত করিনি। শশীর আবার বিয়ে দেব।

অঘোর চাটুয্যে বলেছিলেন, আর কটা দিন অপেক্ষা করো, আমি মরলে একেবারে দুটি পাত্র দেখো। একটি মেয়ের জন্যে। আর একটি গর্ভধারিণীর জন্যে। বিধবা বিয়েটা এই ফুলপুরে রেওয়াজ করিয়ে দিয়ে কীর্তিরাখা কাজ কোরো।

এসব অবশ্য সবই শোনা কথা, এখন যারা আছে, তারা শশীঠাকরুণকে ওই একই অবস্থায় দেখেছে। ঠাকুর্দার মতই প্রতাপ, ঠাকুর্দার মতোই দাপট। জ্ঞাতি গোত্রে পল্লবে বিরাট চাটুয্যে গোষ্ঠীর তিনিই গার্জেন।

শুধু তাই বা কেন, সমগ্র ফুলপুরেই গার্জেন তিনি।

সুখে দুঃখে, বিপদে, সম্পদে, রোগে শোকে, সবাই ছুটে আসে শশীঠাকরুণের কাছে। তিনিও ছুটে যান সবাইয়ের কাছে। ফেরার পথে একটা ডুব দেবার ওয়াস্তা বৈ তো নয়।

শশীতারা ফুলপুরের হৃদযন্ত্র।

এই শশীতারা কিনা হঠাৎ শ্বশুরবাড়ি যাবার বন্দোবস্ত করছেন।

যুগীগিন্নী ননীবালা কেঁদে এসে পড়লো, আমার নাতনীটা এই এখন তখন, আর এই সময় তুমি গাঁ ছেড়ে চলে যাচ্ছো ঠাকরুণ?

শশীতারা বললেন, আমি তো বাপু ডাক্তার বদ্যি নই। তোর নাতনীর যদি পরমায়ু ফুরিয়ে থাকে, স্বয়ং ভগবান মাথার শেওরে বসে থাকলেও রাখতে পারবে না, আর যদি পরমায়ু থাকে, যমের বাবা এসেও নিয়ে যেতে পারবে না। তবে রোগে ব্যাধিতে টাকাকড়ির দরকার, এটা রাখ।

আলগোছে ননীবালার হাতে তিনখানা দশটাকার নোট ফেলে দিলেন শশীতারা। ও প্রণাম করে চোখ মুছতে মুছতে চলে গেল।

আবার ঘোষালদের সত্যচরণও চোখ মুছতে মুছতে চলে গেল, শশীতারা সত্যচরণের নাতির বিয়ের সময়টাতেই চলে যাবেন বলে।

আপনিই আমার বলবুদ্ধি ভরসা পিসিমা, আর এই মোক্ষম সময় আপনি—

শশীতারা ওর নাতনীর আইবুড়ো ভাতের জন্যে একখানা ডুরে শাড়ি, আর আশীর্বাদী হিসেবে একজোড়া হালকা কান ফুল ধরে দিয়ে বললেন, মানুষ আবার কিসের বলবুদ্ধি ভরসা রে? ভগবানকে ধরে বসে থাক, নির্বিঘ্নে কন্যে দায়ে উদ্ধার হয়ে যাবি।

শোভার মা ছুটতে ছুটতে এলো এক বাটি তেল নিয়ে, মা গো, এই তেল পড়াটা করে দে’ যাও, কে জানে আপনির অবর্তমানে মেজ খোকাটার কখন পেট গুলোয়।

শশীতারা হেসে বললেন, তোরা এমন করছিস, আমি যেন চিরকালের জন্যে মরছি। তোর তেল পড়াটা হরিদাসীকে দিয়ে করিয়ে নে না। ওর অনেক ক্ষ্যামতা আছে। নানান তন্ত্র মন্ত্র শিখেছে। আমি তো শুধু ইষ্ট নাম স্মরণ করে ফুঁপাঁড়ি।

শোভার মা আকুল ভাবে বলে, আপনার থেকে কেউ নয় মা। হরিদাসী পিসিকে আমার মন লাগে না।

অগত্যাই তেলটা পড়ে দিতে হয় শশীতারাকে। বৃন্দাবনের ভাইপোটার জন্যেও একটা টোটকা দিয়ে গেলেন শশীতারা তার মাথা ঘুরুণীর ব্যামোর জন্যে। কি দিয়ে কি করতে হয় সেটা উচ্চারণ করলে না কি ফল পাওয়া যায় না, তাই নিজে হাতেই ওটা করে দেন শশীতারা।

চাটুয্যে গুষ্ঠির দায় অদায়, করণ কারণ, ঘর সংসারের ব্যবস্থা সুব্যবস্থা, সেও চলছে আজ পাঁচ সাত দিন ধরে।

গিন্নী গিন্নী ভাইপো বৌদের কচুকাটা করে শিক্ষা দিতে থাকেন শশীতারা, বামুন গেল ঘর তো লাঙল তুলে ধর, এটি করো না বাছারা! আমি যেমনটি করি, ঠিক তেমনটি করবে। মা সিদ্ধেশ্বরীর শনি মঙ্গলবারে ভোগটি যেন ঠিকমত পাঠানো হয়। এসে যেন শুনি না কিছু ত্রুটি হয়েছিল। আমার ছেলেদের পাত থেকে মাছের মুড়ো উড়ে গিয়ে যেন তোমাদের ছেলেদের পাতে গিয়ে না পড়ে, এই বলে দিচ্ছি। দই পাততে ভুলে বসো না, ছেলেপেলেগুলোর চিরেতার জল আর আদা ছোলা যেন ভুল না হয়। জায়ে জায়ে অজ্ঞান হয়ে গাল গল্প না করে সংসারের চারদিক তাকিয়ে দেখবে। আচার আমসত্বগুলো রোদে দেবে, খবরদার অনাচার কাপড়ে ভাঁড়ারে ঢুকবে না। তুলসীতলায় পিদিপ দিতে ভর সন্ধ্যেটি না উৎরে যায়। বিকেলবেলা থাকতেই শাঁখে ফুঁ দিয়ে যেন সন্ধ্যে জ্বালা সেরে চায়ের গেলাসটি নিয়ে বসো না।…

চলতে ফিরতে উঠতে বসতে উপদেশ—তোলা বিছানা মাদুরগুলো যেন ছাতা পড়িয়ে রেখো না, রোদ বেরোলেই টেনে বার করে দিও।.. বছরের মুগকড়াই কেনা আছে জালায় জালায়, এসে যেন দেখি না সব ঢন ঢনিয়ে রেখেছো।…চিঁড়েগুলো কুটিয়ে রেখে যেতে পারলাম না—একটু শুকনো খরা হলেই জগুরমাকে ডেকে কুটিয়ে নিও। তোমাদের নিজের নিজের শরীর স্বাস্থ্যগুলোও দেখো, রোগে পড়ে আমার ছেলেদের ভুগিও না। পরীর যে সম্বন্ধটা এসেছিল, তাদের সঙ্গে পত্রালাপটা যেন ঠিক মতো চলে। অঘ্রাণের আগে তো বিয়ে হচ্ছে না। মেয়েটাকে রোদে রোদে ঘুরতে দিও না, মেঘ ভাঙা রোদে রংটা কালো ঝুল না হয়ে যায়।

ভাইপোর ছেলের বৌ দুটোকেও অনেক উপদেশ পরামর্শ দেন।

কচির মা, তোমরা সেই রাত দুপুরে আর বেলা তিনটেয় ভাত খেওনা বাছা। আসলে কুড়ের রাজ তো সব, ছেলের কন্না করতেই বেলা পুইয়ে যায়। বুড়ি বিদেয় হলো, বালাই গেলো, বলে যেন কেষ্টধনের তেল মাখাটা বন্ধ করে দিও না।

এমনি অজস্র উপদেশ।

অজস্র বাক্যবাণ।

ছোট নাতবৌ একবার হেসে বলেছিল, এতো কথা বলছেন কেন ঠাকুমা? কতোদিনের জন্যে যাচ্ছেন শুনি? এ যে সেই সেকালের তীর্থ যাত্রার মতো। শুনেছি সেকালে নাকি তীর্থে যাবার সময় উইল করে তবে যেতো।

শশীতারাও ঠাট্টা তামাশার কম যান না, ভাইপো বৌদের কাছে তিনি দেবী চামুণ্ডা সদৃশ হলেও ভাইপোদের ছেলেদের বৌয়েদের কাছে হাস্যবদনী। বকেন ঝকেন, উপদেশ দেন ঠিকই, তবে হেসে মেতে।

এখনও হাসলেন, বললেন, তা তীর্থেই তো যাচ্ছিরে! মহাতীর্থ পতিতীর্থ!

নাতবৌ বললো, আহা, তবু যদি পতিকে একবারও চোখে দেখতেন। শুভ দৃষ্টিই তো হয়নি।

কথাটা সত্যি।

এ গল্প শশীতারা নিজেই নাত বৌদের কাছে করেছেন।

শুভদৃষ্টির সময় না একদম একটা ছেলেমানুষী জেদের বশে চোখটা খোলেননি, বুজে বসেছিলেন। সবাই মিলে যতো বলছে, চোখ তাকা, চোখ তাকা—শশীতারার ততোই একটা উটকো জেদ চেপে গেছে, তাকাব না। দেখি তোমরা আমায় কেমন জোর করে চোখ খোলাতে পারো।

ঠাকুর্দা অঘোর চাটুয্যের ধমকেও কাজ হলো না।

আর কী উপায়?

পাঁড়ি ঘোরানো অবস্থায় তো আর মেয়েকে চড় বসানো যায় না?

শশীতারা সেই কথার উল্লেখে হেসে উঠলেন, চোখে না দেখি তবু ভগবানের গড়া শরীর তো? না দেখে খেলেও কি আর সাপের বিষে মৃত্যু ঘটে না?

আহারে, ঠাকুমার কি তুলনার বাহার! সাপের বিষ!

তা তাই!

শশীতারা বলেন, সেই ছোবলের ঘায়েই আজন্ম ভুগছি। মনে হয় যেন বিধবা হয়েই জন্মেছিলাম।

আচ্ছা ঠাকুমা, আপনার বাবা নাকি আপনার আবার বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন? আপনার ঠাকুর্দা মত দেননি।

শশীতারা ঠোঁট উল্টে বলেন, আর ঠাকুর্দা মত দিলেই আমি করতাম যে?

আহা আপনি তো তখন মোটে ন বছরের।

তা সে য বছরেরই, হিঁদুর মেয়ে তো? নাকি বেম্ম খিস্টান?

ওসব বুদ্ধি তখন হয়েছিল আপনার?

শোনো কথা! মানুষ বুঝি খানিকটা বুদ্ধিসুদ্ধি নিয়ে জন্মায় না?

তার মানে আপনি এই বুদ্ধি নিয়ে জন্মেছিলেন, আপনি হিঁদুর মেয়ে?

কি করেছিলাম না করেছিলাম জানি না বাবা! তবে বাবা তো দূর স্থান—বাবার বাবা চেষ্টা করলেও ওকাজ করতে পারতো না শশী বামনীকে দিয়ে। তারপর শশীতারা হেসে বলেছিলেন, পচা কথা ছাড় দিকি। ঠাকুমার কবে ন বছর বয়েস ছিল, তাই নিয়ে চিন্তা। সে কি আর এ জন্ম? আমার তো মনে হয় আর জন্ম।…গোলমাল করে আসল কথাটা চাপা দেওয়া হচ্ছে কেমন? ছেলের যত্ন করবি, শ্বশুরদেরও দেখবি। আমি দৃষ্টি না দিলেই ওরা পেট না ভরতেই উঠে পড়ে।

ঠাকুমা, আপনার মত আমরা কি ওঁদের পেটে এক ছটাকের জায়গায় এক সের মাল ঢোকাতে পারবো?

শশীতারা বলেন, শিখবি! এ নইলে আর মেয়েমানুষ কি! পুরুষ ছেলেরা তো কেবল খাওয়ার ফাঁকি দেওয়ার তালে থাকে।

শশীতারার নাতবৌয়েরা অবশ্য শশীতারার এই মতবাদ বিশ্বাস করে না, সংসারের কেউই করে কি না সন্দেহ, কারণ তার বিপরীতটাই বরং দেখে আসছে তারা। তবু এই বিশ্বাসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদও করে না। শুধু মনে মনে হাসে।

শশীতারার যাওয়ার খবরে গ্রামসুদ্ধু লোকের একই প্রশ্ন, কতো দিনের জন্যে যাবেন? কবে আসবেন?

কারণ শশীতারা এই ফুলপুর গ্রামের এক দীর্ঘদিনের নায়িকা। ভগবানের শশীতারা বিহনে রাতের আকাশও যেমন নিষ্প্রভ, এই শশীতারা বিহনেও ফুলপুর গ্রাম তেমনি নিষ্প্রভ হয়ে যাবার সম্ভাবনা।

শশীতারা না থাকলে শেষরাত্রে সদর দরজা খুলে বেরিয়ে রাস্তায় হাততালির আওয়াজ করতে করতে পুকুরের জলে পড়বে কে?

গ্রামে টিউবকল হয়ে পর্যন্ত ভদ্রলোকদের অনেকেরই পুকুর ভীতি হয়ে গেছে। চাটুয্যে বাড়ির কেউই আর পুকুরে চান করে না, এক এই শশীতারা ব্যতীত। তবে শুধু ওই ভোরের বেলাটি। ওই আসল স্নানটি অবগাহন না হলে তৃপ্তি হয় না তাঁর। তাছাড়া যতবার চান করেন (সেটা অনেক বারই করেন) উঠোনের টিউব ওয়েলেই সারেন।

রাখাল ছোঁড়াটাকে ডেকে বলেন, এই, একটু খ্যাচার খ্যাচার করে দে দিকি, কি জানি পথে কি মাড়িয়ে মলাম!

পথে অহরহই বেরোনো চাই শশীতারার, আর যে কোনো সন্দেহে মাথাটা ভিজিয়ে নেওয়া চাই। কেচে কেচে মটকা তসর সব পয়লট্ট। আগে প্রত্যেকবারই পুকুরে পড়তেন, টিপকল হয়ে সেটা বন্ধ হয়েছে।

তা সে যাই হোক—শশীতারার মতো অতো ভোরে গিয়ে কেউ পড়ে না। হাততালি দেওয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে, তখনও যদি কীট পতঙ্গ সাপ খোপরা পথে থেকে থাকে, শব্দ শুনে সরে যাবে।

অতএব বলা যায় শশীতারা ঘুমন্ত গ্রামটাকে সোনার কাঠি ছোঁয়ান।

শশীতারা না থাকলে স্নান সেরে আবছা ভোরে কে পাড়া চষে ফুল তুলে বেড়াবে? আর পাড়ার ফুলচোর ছোঁড়াগুলোকে শাসন করবে? এই কাকভোরে উঠে ফুল চুরি করতে বেরিয়েছিস হাভাতেরা? বলি মা বাপের কি একটু শাসন নেই? গাছে চড়ছিস? পড়ে হাত পা ভাঙবি? নেমে আয় বলছি।

ছেলেগুলো বলে, বা রে ঠাকুমা, তুমিও তো ফুল নিচ্ছো?

চুরিটা আর উচ্চারণ করতে সাহস করে না। আড়ালে বলে, নিজের বেলায় আঁটিসুটি পরের বেলায় দাঁতকপাটি।

সামনে বলার সাহস নেই।

শশীতারা জোরালো গলায় বলেন, আমি তোদের মতন ফুল নষ্ট করতে নিচ্ছি কেমন?

আমরা কি নষ্ট করছি?

তবে কী করছিস?

এই যদি কেউ পূজো টুজো করে। তুমি তো চাঁপা গাছে উঠতে পারো না, নেবে ঠাকুমা চাঁপা ফুল?

শশীতারা হাসি মেশা গলায় বলেন, তোরা যে দিতে চাইলি এতেই আমি সাতপুরুষে বর্তে গেলাম বাবা ধনেরা। তোদের ওই অ্যাড়াবাসি পেণ্টুল পরে তোলা ফুল নিয়ে আর সগগে যেতে চাই না বাবা! তারপর তেজালো গলায় বলেন, ভোরের বেলা এসে গাছে ছাইভস্ম হাত দিবি না বলে দিচ্ছি। ফের যদি দেখি তো দেখাবো মজা।

ছেলেগুলো পালায়।

অতঃপর শশীতারা কৃষ্ণের অষ্টোত্তর শতনাম আওড়াতে বাকি ফুল তুলসী সংগ্রহ করে বাড়ি ফেরেন। শশীতারা না থাকলে এই সাড়াটি জাগাবে কে?

শশীতারা বলেন, ঠাকুরের নাম গান স্তব স্তোত্র উচ্চৈচস্বরে করতে হয়। ওতে ত্রিজগতের উপকার করা হয়। বৃক্ষলতা কীট পতঙ্গ জলস্থল আকাশ বাতাস ওদের তো নাম করার ক্ষমতা নেই, তবু শ্রবণে উদ্ধার হয়।

এইসব বলেন বটে, তবে একথা মনে করার হেতু নেই শশীতারা কৃষ্ণপ্রেমে বিভোর।

এসব কথা শশীতারা লোক শিক্ষার্থে ব্যবহার করেন। জনগণের তো শিক্ষার দরকার?

তা শশীতারা ছাড়া কে এই সব দরকার বোঝে? কে বুঝবে?

তাছাড়া শশীতারা না থাকলে রোজ সকালে বাড়ি বাড়ি ঘুরে সবাইয়ের তত্ত্বতল্লাশ নেবে কে?

সকালবেলা পূজো আহ্নিক সেরে চরণামৃতটুকু মাত্র গলায় ঢেলে শশীতারা ওই তত্ত্বতল্লাশে বেরোন। পথেই যাদের সঙ্গে দেখা হয়, প্রায় সকলেই চাষাভুষো সক্কাল বেলাই না বেরোলে নয় তাদের।

নচেৎ গ্রামের বা মফস্বলের লোক সাধারণতঃ একটু অলস আয়েসী হয়। শহরের মতো তারা ভোরে থেকেই ছুটোছুটি করে না। তারা ঘুম থেকে ওঠে বেলায়, দাঁতন করে একঘণ্টা। সকালে চায়ের অভ্যাসটি থাকলেও তাদের সেটা শহুরেদের মতো শুধু দুখানা বিস্কিট কি একটা টোস্ট দিয়ে সারা হয় না, তার সঙ্গে মুড়ি ফুলুরি, ছোলা মটর সেদ্ধ, এসব থাকেই প্রায়। কাজেই প্রাতরাশেও দেরী।

অতএব দোকানী দোকানের ঝাঁপ খোলে বেলা আটটা নটায়, গোয়ালা দশটার আগে দুধ দেয় না, বাসন মাজা ঝি আসে বেলা চড়চড়িয়ে।

প্রাইমারী স্কুলের ছেলেগুলোকে যেতে হয় বটে সক্কাল বেলা, প্রায়ই তারা ঘুম থেকে উঠে বাসিমুখ ধোয়া কি না ধোয়া করে বাসি রুটি পরোটা আর গুড় খেয়ে ছোটে। আর দুপুরের ক্লাসের ছেলেমেয়েগুলো প্রায়শঃ ফেনভাত খেয়ে রওনা দেয়। একান্নবর্তী পরিবার এখনো এরকম সব জায়গায় কিছু পাওয়া যায়, কাজেই বাড়ির দু’তিনটি বৌয়ের মধ্যে একজন বৌ হয়তো চান না করেই রান্না ঘরের বাইরে দাওয়ায় গর্ত কাটা উনুনে দুটো কাঠকুটো জ্বেলে ওই ভাতে ভাতটা চড়িয়ে দেয়। ইদানীং অনেক বাড়িতে ওই কাঠকুটোর জায়গাটা জনতা ষ্টোভ দখল করেছে, কিন্তু সেটা হিসেবী বাড়িতে নয়, বে—হিসেবী বাড়িতে। গাঁয়ে ঘরে কাঠকুটো অমনি অমনি মেলে, কেরোসিন অমনি মেলে না।

তবে যাদের বাড়িতে ডেলি প্যাসেঞ্জারীর ব্যাপার আছে তাদের বাড়ির পদ্ধতি আলাদা। যেমন ওই চাটুয্যে বাড়িতেই। শশীতারার উকিল ভাইপো অবশ্য সদরে বাসা ভাড়া করে আছে, কিন্তু বৌকে নিয়ে, নয়তো পুরনো চাকর দামোদরকে নিয়ে। ছুটির আগের দিন চলে আসে। আর কোটে তো ছুটিছাটা লেগেই আছে।

আর দুই ভাইপো এবং ভাইপোর ছেলেরা ডেলিপ্যাসেঞ্জারী করে। বড় ভাইপো কিছুদিন হলো অবসর নিয়েছে। নচেৎ সেও যেতো।

অতএব চাটুয্যে বাড়িতে ভোর থেকেই কর্মচক্রের ঘর্ঘর ধ্বনি শোনা যায়।

তবে ওই ডেলি প্যাসেঞ্জারীর প্রয়োজন না থাকলেও শশীতারা কি কাউকে স্বস্তি দিতেন? ছোট ভাইপোবৌ বলে, পাগল! কাজ না থাকলেও উনি অন্ধকার থাকতে লাগ ঝমাঝম লাগিয়ে দিতেন।

তা এতো কাজই আছে।

এই যে বেরোন শশীতারা, সে কি বাড়ির মোহড়া না মিটিয়ে? নিজে হাতে পায়ে কিছু এ সময় না করলেও মুখের জোরেই চাকাকে ঘুরিয়ে চালু করে দিয়ে তবে যান। ওরা কেউ আটটা, কেউ সাড়ে আটটার গাড়িতে বেরোয়, শশীতারা তার মধ্যেই টহল সেরে বাড়ি ফেরেন। এ সময় তো কারুর বাড়ির মধ্যে ঢোকেন না, বাইরে থেকেই ডাক দেন, কিরে সাধন, এখনও নাকে তেল দিয়ে ঘুমোচ্ছিস না কি? বলি দোকানের ঝাঁপ তুলবি কি তিনপো’র বেলায়? ওতে লক্ষ্মী ছেড়ে যান সাধন! ভোরের বেলা কাচা কাপড়ে গিয়ে দোকানে ধুনো গঙ্গাজল দিবি, ঠাকুরের নাম স্মরণ করে ঝাঁপ খুলে বসবি। তবে না মা লক্ষ্মী ফিরে তাকাবেন। তা নয়—বেলা দুপুরে ঘুম থেকে উঠছে।

বকতে বকতে ততক্ষণে আর একটা বাড়িতে এসে পৌঁছে গেছেন। অনাথ, উঠেছো নাকি? ও অনাথ? উঠেছো? তবু ভালো, আমি ভাবছি তোমারও হয়তো ওই সাধন নগেন ভজুর মতন এখনও ঘুম ভাঙ্গেনি। মাস্টারী করে খাও, তোমার তো বাপু আয়েস করা চলবে না। চলা উচিত নয়। কথায় আছে আপনি আচরি ধর্ম শেখাও অপরে! নিজেই যদি দিষ্টান্ত না হবে তো ছাত্তররা শিখবে কোথা থেকে?

অনাথ মাষ্টার ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বলে, পিসিমা, চান আহ্নিক হোয়ে গেছে এরই মধ্যে?

প্রশ্নটা বাহুল্য।

এই সময় ওটা হবে না শশীতারার এমন হয় না। তবু শশীতারাকে এ হেন প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়। কারণ—এই সব লোকেরা কথায় বৈচিত্র আনতে জানে না। একই কথা রোজ কয়।

শশীতারাও হয়তো একই কথা বলেন, কিন্তু একই ভাষায় নয়। শশীতারা আজ যদি বলেন, তোমার এক কথা অনাথ মাষ্টার! বেলা কি বসে আছে?

তাহলে কাল বলবেন, হ্যাঁ বাবা, লোক জাগরণের আগেই ও পাট চুকিয়ে ফেলা ভাল। সংসার জাগলেই বিঘ্ন।

অথচ নিজেই তিনি নির্বিঘ্নে বসে ভগবানের নাম করার বদলে সংসারকে জাগিয়ে বেড়ান। তা সে কথা বলার সাহস তো দূরস্থান, বলার কথা মনেই আসে না কারুর!

অনাথ মাষ্টার সম্ভ্রমে বলে, পিসিমার পুণ্যের শরীর।

অধ্যায় ১ / ১০

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন