আশাপূর্ণা দেবী
কদিন পরে শশীঠাকরুণের উকিল ভাইপোকে দেখা গেল বীরনগরের বাঁড়ুয্যেদের দালানে।
জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছে উঠোনের ওপাশে, সদরে বেরোবার একধারে টিউবওয়েল বসানোর কাজ চলছে, মিস্ত্রীদের কণ্ঠে একটা উদ্দাম অবোধ্য শব্দ যেন গানের মতো তালে তালে ধ্বনিত হচ্ছে।
সেই দিকে তাকিয়ে মুখ কালো করে ভাইপো বলল, এইটাই যদি তোমার মনের মতলব ছিল পিসি, তো আমায় অমন নাচালে কেন?
শশীতারা তাচ্ছিল্যের গলায় বললেন, নাচাতে আমি যাইনি অজা, তুই নিজেই নেচেছিলি। তুই তোড়জোড় করলি, তাই ভাবলাম, দেখি তো বলছে যখন তবে যাই একবার। দাবি দাওয়া তো আছে একটা, উড়িয়ে দিতে পারবে না। এই যে চারকাল ধরে মাসে দুটো একাদশী করে মরছি, ন্যাড়াহাত নাড়া দিয়ে বেড়াচ্ছি, সমাজে যমের অরুচি হয়ে বসে আছি, এ কিসের জন্যে? ওই সম্পর্কটুকুর জন্যেই তো? তা সেই ভেবেই আসা। এসে দেখছি শ্বশুরের ভিটেখানা যেন ক্ষয়কাশের রুগীর মতন মরণের দিন গুনছে বসে বসে, তার মুখে এক ফোঁটা ওষুধ পড়েনি কখনো। তা চোখে দেখে তো আর মুমূর্ষু রুগীটাকে ফেলে রেখে চলে যাওয়া যায় না? ডাক্তার বদ্যি ডেকে এনে দুফোঁটা ওষুধ দিতে হয়। তবু তো গাঁটের কড়ি খরচা করে নয়। সেই যে বলে না, তোর ধন তোকে খাওলাম শ্বশুরের জমি বেচেই শ্বশুরের বাড়ী মেরামত!
অজিত প্রায় ক্ষেপে উঠে বলে, চুণ বালির পাহাড় এসে পড়েছে তো দেখে এলাম, টিউবওয়েলও বসছে দেখতে পাচ্ছি, জমির দরুণ দশ বারো হাজার টাকা তাহলে এদের ভাঙাবাড়ির গহ্বরেই ঢালছ।
শশীতারা এবার গম্ভীর হন। গম্ভীর গম্ভীর গলায় বলেন, এদের বাড়ি বলছিস কেন রে অজা? আমার শ্বশুরের ভিটে নয়? ভাঙা বাড়িটা এদের, আর ডাঙা জমিটা আমার, এমন হিসেব তো ন্যায্য নয়।
অজিত গুম হয়ে গিয়ে বলে, ঠিক আছে, তোমার জিনিস তুমি বুঝবে। তবে ইনিই বা ভিটে বাড়িকে এমন মুমূর্ষু করে তুলেছেন কেন? বাপের জমি বেচেই বাপের ভিটে সারাতে পারেননি?
শশীতারা অবহেলায় বলেন, পারবে কোথা থেকে? এতোদিন যে কুইন ভিক্টোরিয়ার আমল ছিলো। তাঁর ইচ্ছেয় কর্ম। ও বেচারী নোখ ডোবাতে পেরেছে এযাবৎ? তিনি বোধহয় ভেবেছিলেন, জমিগুলো সঙ্গে নিয়ে সগগে যেতে পারবেন। আর এ হতভাগার দেখছো তো? ছেলেদুটো স্বার্থপর, মেয়েটা গলায় পড়া। স্বাস্থ্য শরীরও ভাল নয়। যা করবার আমাকেই করতে হবে।
তবে আর বলবার কি আছে? দাদা বলে দিয়েছিল পরীর বিয়ের কথাটা এগোচ্ছে, তুমি না গেলে তো পাকাপাকি কিছু হতে পারে না। যাবে তো? না কি?
শশীঠাকরুণ ঈষৎ চঞ্চল ভাবে বলেন, আহা যাবো না বলেছি। তবে এদিকে মস্ত একটা দায়িত্বের কাজ ফেঁদে বসে আছি, একটু না সামলে তো যেতে পারিনে। তোর বাপ কাকা মা খুড়ি, সবাই রয়েছিস, ক’ পাকা কথা। পিসি কি চিরকালের?
অজি চলে গেল।
রাজবালা কপালে করাঘাত করে পাড়ায় বলতে বেরোলো, ভাইপো নিতে এসেছিল, সাধ্য সাধনা করলো, ইনি গেলেন না। দ্যাওরের সর্বস্ব খেয়ে তবে যাবেন।
জমি বেচার কথা সকলেই জেনে গেছে, আর রমেশ মাষ্টারের নির্বুদ্ধিতাকে ছি ছি করছে। এই বয়সে মেয়েমানুষের মোহিনী মায়ায় পড়লো! কোথা থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসে আজ্ঞাবাহী চাকরের মতো ওঠ বোস করাচ্ছে তোমায় ওই সর্বনেশে মেয়েমানুষটি! স্ত্রী পুত্র পরিবার কারুর কথায় কান নেই, ওনার চরণে পুষ্প অর্ঘ? ছ্যা ছ্যা!
তা ওদের কথা একেবারে মিথ্যেও নয়। সত্যিই কারো কথার কান নেই রমেশের। শশীতারা সে কানে মন্তর ঝেড়ে চলেছেন, টিপকল বসিয়েছো বলেই যে কুয়োটা ফেলে দিতে হবে, সেটা কোনো কাজের কথা নয়। ওটাও সংস্কার করিয়ে ফেলতে হবে। তা ছাড়া কলের জলও আনতে হবে ভবিষ্যতে। রাস্তায় যখন এসেছে।…ও তোমার এই টানেই ইলেকট্রিক লাইটটা এনে ফেলা! ভালো ঠাকুরপো! টাকায় না কুলোয় আমি আছি।…এই বাড়ি যখন আগাগোড়া রং হবে, আর সেবাড়ি লাইটের আলোয় ভাসবে, কেমন শোভাটি হবে ভাব? আমি তো চোখ বুঝলেই দেখতে পাই।…
রমেশও বুঝি ক্রমশঃ এই স্বপ্নলোকের বাসিন্দা হয়ে পড়েছেন। তিনিও বলেন, তুমি হুকুম করে চলো, আমি সব করে তুলবো। কী বলবো বড়বৌ, তোমার সাহসে আমার যেন শরীরে মনে একশো হাতীর বল এসেছে। জানলা দরজার যে পাল্লাগুলো খেয়ে গেছে, তার মাপ দিয়ে অর্ডার দিয়ে এলাম। বলেছি, নাঃ ওই কেটে কুটে তালি দিয়ে আবার দাঁড় করিয়ে দেওয়া নয়, একেবারে নতুনই হোক।…আবার বলেন, বিলিতি মাটির ব্যবস্থা হয়ে গেল বড়বৌ। ব্ল্যাকে ছাড়া তো এ অঞ্চলে ওসব জিনিস মেলা শক্ত, তবু আমায় একজন ন্যায্য দামে সাপ্লাই করবে বলেছে। আমারই ছাত্তর ছিল এক সময়ে। বড় ভালো ছেলে।
তারপর দুজনে মিলে বসে নতুন নতুন পরিকল্পনায় বিভোর থাকেন।
উঠোনটার খোয়া খাপরা ভাঙাচোরা সব উপড়ে ফেলে নতুন বিলিতি মাটির মেঝে করতে হবে। লাল টুকটুকে। তার ধারে সবুজ বর্ডার। আর ঠিক মাঝখানটায় যেখানে বিয়ে টিয়ের ‘বৌ’ ছত্র আলপনা আঁকা হয়, ছাঁদনাতলা বানানো হয়, সেখানে বিরাট করে শিঙ্খলতা প্যাটার্নের আলপনার মতো ছবি আঁকানো হবে। ভবিষ্যতে আর আলপনার জন্যে ভাবতে হবে না—বলেন শশীঠাকরুণ নতুন বৌ এসে দাঁড়াবে একেবারে পাকা আলপনার ওপর।
রান্নাঘরের দেওয়ালে দুটো দেওয়াল—আলমারী করাতে হবে বুঝলে ঠাকুরপো, রাঁধুনীকে তাহলে চোদ্দবার ভাঁড়ারের দরজায় গিয়ে দাঁড়াতে হবে না। আট দশ দিনের মতো জিনিস নিয়ে গিয়ে রেখে দিলেই হবে। ফুলপুরের এই রকমটা করিয়ে দিয়েছিলাম সেবার। বৌরা দু’বেলা ধন্যবাদ দেয়।
রমেশ মৃদু হেসে গলা নামিয়ে বলে, এখানে সেটি পাবে না। শত সুবিধে পেলেও ধন্যবাদ দেবে না।
তা জানি! শশীঠাকরুণও মুখ টিপে হাসেন, ওর হয়েছে বুড়ো বয়সে ধেড়ে রোগ।
হ্যাঁ বোঝেন বৈকি শশীঠাকরুণ, রাজবালার চিরকালের অন্যমনস্ক, সংসারের ব্যাপারে উদাসীন, অলস চিত্ত স্বামীর হঠাৎ কর্মোৎসাহ দেখে রাজবালা সুখী হওয়া তো দূরে থাক, জ্বলে মরছে, তা বুঝতে বাকি নেই শশীঠাকরুণের। তবে ওসব তিনি গ্রাহ্য করেন না। তাঁর মতে কুকুরের কামড় হাঁটুর নীচে।
তিনি বলেন, যখন দেয়ালে হাত টিপে আলো জ্বালাতে পাবে তোমার বৌ, আর ঘেরা নাইবার ঘরে কল টিপে জল বার করতে পাবে, তখন মনে মনে শশীবামনীকে পেন্নাম করবে।…তুমি লেখা লিখিটার তোড়জোড় করো।
মিস্ত্রী খাটানোর নেশা, একটি বড় নেশা। মানুষ বিশেষে মদের নেশার মতই তীব্র। শশীঠাকরুণ চিরদিন এই নেশার বশ! ফুলপুরে শুধু চাটুয্যে বাড়িতেই নয়, যাদের যখন বাড়িতে মিস্ত্রী লাগে, শশীঠাকরুণ দাঁড়িয়ে তত্ত্বাবধান করেন। তারাও বাঁচে, বলে, দিদি ঠাকরুণ এসে দাঁড়িয়েছেন। পিসিমা এসে দাঁড়িয়েছেন। যাক নিশ্চিন্ত। আর ব্যাটারা এক মিনিট ফাঁকি দিতে পারবে না।
সময়ের ফাঁকি এবং কাজের উৎকর্ষে ফাঁকি, কোনোটাই শশীঠাকরুণের চোখকে ফাঁকি দিতে পারে না।
সেই চির অভ্যস্ত কাজের নেশায় আর এক নতুন মাদকতার যোগ হয়েছে।
এইটাতে শশীঠাকরুণ যেন ‘আমার’ শব্দটায় স্বাদ পাচ্ছেন। এ স্বাদ তো কই ফুলপুরের চাটুয্যেদের কাজে কখনো পাননি শশীঠাকরুণ?
এই জন্যেই বুঝি বলে, মেয়ে সন্তান পরভূমির মাটিতে গড়া। তারা জন্মপর।
তা নইলে বাহাত্তর বছর বয়স পর্যন্ত ফুলপুরের চাটুয্যে বাড়িতে সাম্রাজ্ঞীর আসনে বসে কাটিয়ে এসেও আজ বীরনগরের ভবেশ বাঁড়ুয্যের ভাঙা ভিটেয় এসে শশীঠাকরুণ ‘আমার’ শব্দটার স্বাদ উপলব্ধি করছেন? আর সেই উপলব্ধির মধ্যে একটা উত্তেজনাময় মাদকতার স্বাদ পাচ্ছেন।
কথাটা শুনে ফুলপুরের সবাই গালে হাত দিল।
পরীর বিয়ের দিনস্থির হলে, তবে নাকি দিন চার পাঁচের জন্য আসতে পারবেন শশীঠাকরুণ।
মানুষ বদলে টদলে যায় ঠিকই, আঙুল ফুলে কলাগাছ হলে বদলায়, অভাবে স্বভাব নষ্ট হলে বদলায়, কিন্তু শশীঠাকরুণের মতন মানুষের এ হেন শোচনীয় পরিবর্তন?
এ যে অভাবিত, অসম্ভব!
তা ছাড়া কিসে বদলালেন তিনি? অভাবও ঘটেনি, হঠাৎ কিছু ঐশ্বর্যও জোটেনি। তবে?
ওই তবেটার উত্তরটা কারুর বুদ্ধিতে আসছে না।
তবে লোকে দেখলো পরীর বিয়েতে শশীঠাকরুণ সত্যিই প্রায় নেমন্তন্নীর মতো এলেন।
সকলের অভিমানবাণী, অভিযোগবাণী, ও হৈ চৈ এর উত্তরে হাসলেন, দুটো রঙ্গ কথা বললেন, কনের গহনা কাপড় কি কি হয়েছে তা এক নজর দেখলেন, ভাইপোর কাছে বসে দেনা পাওনার বিবরণটা শুনলেন, এই পর্যন্ত। অবিশ্যি কাজের সময় খাওয়াদাওয়ার তদবির, গ্রামের সবাই এসেছে কিনা তাঁর খোঁজ খবর নেওয়া, সবই করলেন, তবু যেন কেমন ছাড়া ছাড়া ভাসা ভাসা। যেন শেকড় থেকে শক্ত হয়ে বসে নয়।
যখন যুগী বৌ কেঁদে পড়ে বললো, তুমি যে চেরকালের মতন গাঁ ছাড়বে তা তো বলে গেলে না? আমার যে এতোদিন কী হাড়ির হাল, তা আর তোমায় কী বলবো? তখন এমন আশ্বাস দিলেন না, ওরে চিরকালের জন্য নয়, আবার আসবো আমি।
যখন নাড়ুবোসের বাড়িতে গিয়ে উকি মারলেন, তখন আর বোধহয় তেমন করে মনে পড়লো না শশীঠাকরুণের এদের দাঁড় করিয়ে রাখা আমারই দায়িত্ব!
শশীঠাকরুণ শুধু অপ্রতিভ মুখে এক মুঠো করে টাকা ধরে দিলেন ওদের হাতে। আর শ্বশুরের ভিটেটায় সংস্কারে হাত দিয়ে বসে কী পরিমাণ আটকে গেছেন সেটাই বোঝাতে চেষ্টা করলেন। শশীঠাকরুণের মুখে কৈফিয়ৎ দেওয়া! এটাও নতুন ঘটনা।
শশীঠাকরুণের দীর্ঘ অনুপস্থিতিতে ফুলপুরের মনোজগতে অনেক ঢেউয়ের ওঠা পড়া হয়েছে।
অধিকাংশটা এই—এখনকার বৌ ঝিরা আর তেমন নয়, গুরুজনের মান মর্যেদা রাখে না, নির্ঘাৎই তলে তলে অনেকদিন থেকেই অতিষ্ঠ হচ্ছিলেন শশীঠাকরুণ, তবে মানী মানুষ, লোক হাসিয়ে ঝগড়াঝাঁটি না করে একটা ছুতো দেখিয়ে চলে গেলেন।
আরো একটা দলের অভিমত—স্বর্গত অঘোর চাটুয্যে তো হাঘরের ঘরে নাতনীকে দেননি? সমৃদ্ধ ঘরেই দিয়েছিলেন, নাতনীর ভাগ্যে ভোগ নেই তিনি কি করবেন? তা এতোদিনে বোধ হয় শশীঠাকরুণের চেতনা হয়েছে, তাঁরও কিছু সেখানে ভাগ আছে বিষয় আশয়ে, তাই দেখতে গেছেন কী আছে না আছে!
শেষের দলের কথা ক্রমশঃই ঝাপসা হয়ে যাচ্ছিল শশীঠাকরুণের ফিরে না আসায়, শুধু দেখতেই যদি গেছেন, তো আর ফিরে আসবেন না?
অতএব?
অতএব ওই আগের দলের হিসেবই বলবৎ।
মনের ঘেন্নায় দেশ ছেড়েছেন শশীঠাকরুণ।
নির্ঘাৎ ভাইপো বৌরা এখন গিন্নী হতে চায়।
নাতবৌরা পোঁছে না, অগ্রাহ্য করে।
তার সাক্ষী শশীঠাকরুণ যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চাটুয্যে বাড়ির ব্যবহার।
আর কি গাঁ সুদ্ধ সবাই আমাদের আপন জায়গা, আমাদের আশ্রয় স্থল, ভেবে যখন তখন এতে বসতে সাহস পাচ্ছে?
এসে বসলে তেমন আদর আপ্যায়ন পাচ্ছে?
একদিন নন্দ ছুতোরের মা এসে বসে দুটো পান চেয়েছিল, পেতে দেরী হয়েছিল। সেই অপরাধে শশীঠাকরুণ ভাইপো বৌদের চোখের জল বার করে ছেড়েছিলেন। অতিথি যে নারায়ণ তুল্য সে কথা যাতে আর না ভুল হয়, তার জন্যেই অমন দাওয়াই।
সেই বাড়িতে এখন এসে দাঁড়ালে কেউ তাকিয়ে দেখে না।
সকলেরই আশা ছিল, পরীর বিয়ে উপলক্ষে এসে যাবেন পিসিমা, আবার নিজ সিংহাসনে বসে রাজদণ্ড হাতে নেবেন। কিন্তু এ কি সংবাদ? মাত্র চারদিনের জন্যে আসছেন তিনি, সেখানে নাকি তার জরুরী দরকার, থাকবার জো নেই।
সংবাদে সবাই বিস্মিত হলো। এ কিরে বাবা? জন্ম গেল ছেলে খেয়ে আজ বলছে, ডান? এখন তোমার সেই অদেখা অজানা পচা শ্বশুরবাড়ির দেশে এমন টান হলো যে ফুলপুরের মাটিকে ভুলেই গেলে? ভুলে গেলে সেখানের মানুষদের? যারা তোমার মুখোপেক্ষী ছিল, যারা তোমার স্নেহাশ্রিত ছিল?
এতো পরিবর্তন শশীঠাকরুণেরও কি সম্ভব?
তা নিজের পরিবর্তনে নিজেও মনে মনে অদ্ভুত একটা বিস্ময় অনুভব করছেন শশীতারা। হয়তো বিস্ময়টা ঈষৎ বিষণ্ণও।
যে সংসারটা নিয়ে এতোবড়ো জীবনটা কাটিয়ে এলেন শশীঠাকরুণ, যে সংসারের একটা ভাঙা পাথরবাটিও শশীঠাকরুণ বাঘিনীর মতো আগলেছেন, যার পান থেকে চূণ খসলেও রসাতল করেছেন, সে সংসারটা সম্পর্কে আর কোনো মূল্যবোধের সাড়া পাচ্ছেন না কেন?
কই একবারও তো মনে হচ্ছে না, ইস আমার হাতে গড়া সংসারটা এরা কী যা তা করেই চালাচ্ছে! কী নষ্ট হচ্ছে, কী অপচয় হচ্ছে!
অথচ চোখে যে পড়ছে না তা নয়। চির অভ্যস্ত তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে এক নজরেই ধরা পড়েছে কোথায় কী বিশৃঙ্খলা, কোথায় কী অপচয়, কোথায় কী অবহেলা।
বাড়িতে বিয়ে এসে গেছে, বাড়ির বাইরে একটা কলিও ফেরানো হয়েছে, কিন্তু ভাঁড়ার ঘরের কড়িবরগায় ঝুল ঝুলছে, রান্নাঘরের তাক ধোঁয়ায় অন্ধকার হয়ে আছে।
গলি থেকে বালিশ বিছানাগুলো নামানো হয়েছে। কিন্তু তাদের গায়ে ওয়াড় পরানো হয়নি। অনাবৃত বালিশগুলোই ব্যবহার হচ্ছে তেলতেলে মাথায়।
শশীঠাকরুণ কি ভাবতে পারতেন এটা হতে দেওয়া যায়?
বিয়ে বাড়ির এখানে সেখানে একটা থালায়, একটা রেকাবিতে, একটা বাটিতে, কতকগুলো করে মিষ্টি পড়ে রয়েছে। পিঁপড়ে ধরছে।
এক একবার ডাক দিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে। আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে, এটা কী?
কিন্তু ভেতর থেকে তেমন প্রেরণা পাচ্ছেন না। মনে হচ্ছে, মরুকগে, ওরা তো এই রকম করেই সংসার করবে। আমি আর দু’দিনের জন্যে এসে বলে মন্দ হই কেন? চিরদিনের ফুলপুর যেন এই ক’মাসেই ঝাপসা হয়ে গেছে শশীঠাকরুণের কাছে।
এ পরিবর্তন অনুভব করছে বৈকি শশীতারা। তীক্ষ্ন অনুভূতিসম্পন্ন মন তাঁর। আর ভাবছেন, নতুন বিয়ে হয়ে শ্বশুর বাড়ি থেকে ঘুরে এলে কি এই রকমই হয় মেয়েগুলোর? বোধহয় হয়।
বিয়ে হয়ে অষ্টমঙ্গলার ক’দিন ঘুরে আসার পরেই ভাইঝিগুলোর ভাবান্তর চোখে পড়তো শশীঠাকরুণের। যেন আড়ো আড়ো ছাড়ো ছাড়ো ভাব, যেন যেটা করতে বলবে শুধু সেটাই করবে। যেন শেকড় নেই কোথাও। দেখে রেগে জ্বলে গিয়েছেন শশীঠাকরুণ।
আজ নিজেকে নিজেই কৌতুক করছেন, কি, তোরও কি ওই ছুঁড়িগুলোর মতন দশা হলো নাকি? তুইও তো এই আজীবনের জায়গায় আর তেমন শেকড় খুঁজে পাচ্ছিস না।
শশীঠাকরুণের চিত্ত যেন উৎকর্ণ হয়ে আছে বৈঠকখানা বাড়ী থেকে একটা খবর আসার অপেক্ষায়।
মেয়ের বিয়েতে শশীঠাকরুণকে আনতে যাবার সময় বড় ভাইপো সৌজন্য করে রমেশ মাষ্টারকেও নেমন্তন্নর চিঠি দিয়ে বলে এসেছিল, আপনিও দয়া করে পায়ের ধুলো দেবেন। চিরকালের কুটুম্ব ঘর, কিন্তু আসা যাওয়া তো নেই, তাই এযাবৎ আসতেও ভরসা পাইনি। এখন যখন পিসীমা দরজা খুলে দিয়েছেন—
সেই সৌজন্যের বাণীটুকুর সূত্রধরে শশীঠাকরুণ সদরের খোলা দরজাটার দিকে তাকিয়ে আছেন, লোকটা এলো কি না। এসে পড়লে আদর আপ্যায়নের ঘাটতিতে আহত হয়ে ফিরে না যায়। চেনেনা তো কেউ। হয়তো বসতে বলবে না, হয়তো ডেকে কথা কইবে না।
তাই ছোটমোট ছেলেপুলেকে বারবার বাইরে পাঠাচ্ছেন। দেখ তো বীরনগর থেকে কেউ এসেছে কিনা?
কানে যে কারুর যাচ্ছে না তাও নয়।
নাতবৌরা শুনতে পেয়ে নিজেরা হাসাহাসি করছে। শ্বশুর বাড়ির লোকের জন্যে ঠাকুমার মন ছটফট করছে, না জানি তোমাদের ঠাকুর্দা থাকলে কি হতো।
ভাইপোবৌরা আতঙ্কে আতঙ্কে ছিলেন, আবার এসে সিংহাসনের দাবি করে কিনা। অথচ ওঁর এই নির্লিপ্ত নিরাসক্ত ভাব দেখে বিরক্ত না হয়েও ছাড়ছে না।
উনি আবার আমাদের জিজ্ঞেস করে কাজ করছেন! যেন কুটুম এসেছেন। মরণকালে জ্বরচ্ছেদ। আবার সতাতো দ্যাওরের জন্যে হামলাচ্ছেন। এতো লোকজন এসেছে, কারুর দিকেই যেন লক্ষ্য নেই। বীরনগরের কেউ এসেছে কিনা তাই নিয়েই অস্থির।
সত্যি, কারই বা ভাল লাগে এমন অকৃতজ্ঞতা?
ভাইপোদেরও ভালো লাগছে না।
চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে পিসীমার মন পড়ে আছে সেই বীরনগরের মজুর মিস্ত্রীর ওপর। এর থেকে অকৃতজ্ঞতা আর কি হতে পারে?
এখানটা হয়তো শশীঠাকরুণ তাঁর তীব্র অনুভূতি দিয়েও বুঝতে পারছেন না। শশীঠাকরুণ মনে করছেন, জন্মে আসে না এমন কুটুম যদি তোদের মেয়ের বিয়েতে এসে আদর অভ্যর্থনা না পায়, তবে তো তোদেরই লজ্জা। শশীতারা সেই লজ্জাটার ভয়েই—
ইত্যবসরে যে আরও একটা খবর কানাঘুষোয় এই ফুলপুরে এসে পৌঁছেছে, সেটা জানা নেই শশীতারার। এমনিতে কখনো কোনো খবরই আসতো না, কিন্তু কথাতেই আছে, আগুন আর কলঙ্কের কথা বাতাসের আগে ছোটে।
যদিও কথাটা হাস্যকর রকমের অবিশ্বাস্য, কিন্তু ভাব ভঙ্গিটাও যে রীতিমত বিরক্তিকর। বাধ্য হয়েই বিশ্বাস করতে হচ্ছে। বীরনগরের রমেশ মাষ্টার বিয়ে বাড়িতে নেমন্তন্নে এলো কিনা, এটার জন্যে যদি শশীঠাকরুণ নব অনুরাগিনী রাধার মতো উতলা হন, তাহলে তাঁর বাহাত্তর বছর বয়স হতে চললো বলেই কি ছেড়ে দেবে লোকে?
আর বীরনগরেও যখন ওই নিয়ে কানাঘুষো চলছে। সতাতো জা নাকি ওঁদের হাসিগল্প মস্করা মাখামাখি দেখে গলায় দড়ি দেবে কি বিষ খাবে তাই চিন্তা করছে।
তা প্রমাণ হাতে হাতেই মিললো।
বীরনগরের রমেশ মাষ্টার এসেছেন নেমন্তন্নে, ওই শুনে যে ভাবে ছুটলেন শশীঠাকরুণ তা দেখবার মতো।
একথা কেউই ভেবে দেখলো না, আজন্ম একদুয়োরি শশীঠাকরুণ এই মরণ কালেও আর একটা খোলা দরজার বাতাসে একটা অনাস্বাদিত মুক্তির স্বাদ পেয়েছেন, তাই তাঁর আচরণে এমন চাঞ্চল্য।
কেউ ভেবে দেখছে, না ইহজীবনে শশীঠাকরুণের নিজস্ব কোন জগৎ ছিল না, ছিল না একান্ত ভাবে নিজের কোন আপনজন, হঠাৎ সেইটা পেয়ে গেছেন শশীঠাকরুণ। মেয়েদের জীবন দুটো পরিবারের ওপর ভর দিয়ে গড়ে ওঠে, শশীঠাকরুণ ইহজীবনে সেই গড়নটা পাননি। অথচ প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে তার জন্যে ছিল চির পিপাসা, যার খবর শশীঠাকরুণ নিজেও কোনদিন টের পাননি।
ওরা জানে না, অজিত যখন বীরনগরে গিয়েছিল, শশীতারা রমেশ মাষ্টারকে আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে বলেছিলেন, তোমায় তো ভাই একবার গণেশ ময়রার দোকানে যেতে হচ্ছে। কুটুম এসেছে যখন। তোমাদের দেশের সেরা সেরা মিষ্টি টিষ্টি নিয়ে আসবে, বুঝলে? চট করে। বলেছিলেন, আমি বললে ভাল দেখাবে না, তুমি নিজে একবার বল ভাল করে, ওকে আজকের রাত্তিরটা থেকে যেতে।
অজিত অবিশ্যি থাকেনি, কিন্তু বলেছিলেন রমেশ মাষ্টার।
এখনো সেই মনোভঙ্গীই কাজ করছে।
শুধু এরা সেটা বুঝতে পারে না।
জগতের সবাই যদি সবাইকে বুঝতে পারত, অন্ততঃ বুঝতে চাইত, তাহলে তো পৃথিবীতে সমস্যা বলে কিছু থাকতই না। সংসারটা স্বর্গ তুল্য হতো।
কিন্তু কেউ কাউকে বুঝতে চেষ্টা করে না, হয়ত বা বুঝতে রাজীই হয় না। বরং অদ্ভুত অসম্ভব অবিশ্বাস্য কথাও বিশ্বাস করবে, তবু তলিয়ে বুঝতে চাইবে না আর কি হতে পারে।
অন্য কিছু হতে পারে কিনা।
অতএব শশীঠাকরুণের চিরভক্ত ফুলপুর যখন দেখল শশীঠাকরুণ ভাইপোদের অনুরোধ ঠেলে আর দুটো দিনও থেকে না গিয়ে সেখানে জরুরি দরকারের ছুতো দেখিয়ে এই ক’দিনের চেনা লোকটার সঙ্গে বোঁ বোঁ করে ছুট মারলেন, একটা রিকশয় গায়ে গা দিয়ে বসে, তখন ছি ছিক্কার করে উঠল।
এতোদিনের সমস্ত ছেদ্দা ভক্তি ভালবাসা সমীহ সব জলাঞ্জলি দিয়ে বলতে লাগল, এই জন্যেই বলে, পুড়বে মেয়ে উড়বে ছাই, তবে মেয়ের গুণ গাই। তা নইলে শশীঠাকরুণ কিনা চারকাল পার করে এসে এখন সতাতো দ্যাওরের সঙ্গে—ছি ছি! দুর্গা দুর্গা! সন্ধ্যেবেলায় আস্তাকুড় মাড়ানো আর কাকে বলে?
শশীঠাকরুণের কানে অবশ্য এসব পৌঁছয় না।
পৌঁছলেই কি তিনি কেয়ার করতেন নাকি?
ট্রেন ছাড়ো ছাড়ো সময় ষ্টেশনে এসে পৌঁছন হয়েছে, হাঁপাতে হাঁপাতে ওঠা। রেলগাড়িটা ছেড়ে দিতেই শশীঠাকরুণ একটা পরম স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেন, যেন খুব কৌশলে একটা জেলখানা থেকে পালিয়ে এসেছেন।
আলো আলো মুখে বললেন, আমি চলে আসার পর আর মিস্ত্রীর কাজ হয়েছিল নাকি?
রমেশ মাষ্টার বললেন, পাগল, কে দেখবে?
কেন বাপু, তুমি বুড়ো মদ্দ একটু দেখতে পারো না?
আমার দায়!
শশীতারা জানলা থেকে এসে পড়া রোদ থেকে মুখটা বাঁচিয়ে সরে এসে বলেন, হুঁ যত দায় আমার! ইলেকট্রিক কোম্পানীর চিঠির উত্তর এসেছে?
গাড়িটার কোথায় একটা ধাক্কা লাগে, শব্দ ওঠে, উত্তরটা শোনা যায় না। কিন্তু না যাক, শশীতারার মুখে সেই না—আসা বিদ্যুতের আলোর দীপ্তি।
হয়ত শশীতারা সম্পর্কে অপবাদটা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীনও নয়, এই বয়সে প্রেমেই পড়ে গেছেন শশীতারা। যে জীবনটার স্বাদ তাঁর জানা ছিল না, অথচ তার সাধটা কোন গভীর অলক্ষ্যে একটি সোনার কৌটায় লুকনো ছিল, হঠাৎ পেয়ে গিয়ে সেই জীবনটারই প্রেমে পড়ে গেছেন তিনি!
ওরা চারজনে তাস খেলছিল।
সুখেন, ননী, রাজেন আর জগাই।
স্থান কাল পাত্র, স্রেফ সোনায় সোহাগার মতই। সমস্ত পরিবেশটা দেখলেই মনে হবে, ঠিক! এদের এইখানেই মানায়। এদের এখানে ছাড়া কোথায় মানায় না।
স্থানটা করণপুর রেলওয়ে স্টেশনের ধারের একটা চা—বিস্কুটের চালা।
চালার সামনে দুটো নড়বড়ে কালো কালো বেঞ্চি পড়ে আছে বাঁকাচোরা হয়ে, সামনের বাঁশের খুঁটি দুটোর গায়ে খানিকটা করে নারকেল দড়ি বাঁধা। ওই দড়ি দুটোর বাঁধনের গিঁঠের যে আগাদুটো ঝুলন্ত অবস্থায় রয়েছে, একটু আগেও তার মুখে আগুন জ্বলছিল। এখন শেষ ট্রেন চলে গেছে, এখন আগুন নিভিয়ে দেওয়া হয়েছে।
দোকানটা ননীর।
এবং ননীই ওদের মধ্যে বয়োজ্যেষ্ঠ।
এরা ননীর দোকানের কর্মচারী অবশ্য নয়, তবে সকালে যখন পর পর দু তিন খানা ট্রেন আসে, ননীর দোকানে খদ্দের ধরে না, তখন খদ্দেররা এদের কাউকে না কাউকে দেখতে পায়। ননীকে সাহায্য করতে আসে এরা। নইলে ওদের তিনজনেরই ওই রেলেরই খাঁজে খোঁজে কোথাও একটু চাকরী আছে। সে চাকরীর ডিউটির ফাঁকে ফাঁকে এরা ননীর দোকানে ডিউটি দিয়ে যায়।
পয়সাকড়ির সম্পর্ক নেই, এক গেলাস চা আর দুখানা লেড়ো বিস্কুট, মাত্তর এই, তবু তার বিনিময়েই এরা এসে পড়ে, জোরে জোরে পাখা নেড়ে উনুন ধরিয়ে দেয়। ডেকচিতে ফুটন্ত জলের মধ্যে ন্যাকড়ার পুঁটুলিতে গুঁড়ো চা বেঁধে ছেড়ে দেয়, তার মধ্যেই দুধ চিনি ঢেলে দিয়ে হাতায় নেড়ে নেড়ে কাঁচের গ্লাসে গ্লাসে সাপ্লাই করে। চোখে—কানে দেখতে পায় না, হিমসিম খেয়ে যায়।
ননী শুধু বিস্কুট দেয়, আর পয়সার লেনদেনের হিসেব করে। ফাঁকে ফাঁকে চালার কোণের দিকে কোথায় যেন একটা মাটির কলসী আছে তার মধ্যে ফেলে ফেলে আসে।
ননীর মা বলত, ‘ঘটই হচ্ছে মা লক্ষ্মীর আধার। সকল দেবতারই ঘটেই অধিষ্ঠান, খদ্দেরের পয়সাকড়ি ঘটের মধ্যে থুবি ননী! রাত হলে তখন ঘরে এনে বাক্সয় তুলবি।’
মা—র কথাটা শুনেছে ননী।
তাতে সুবিধেও।
বাক্সর ডালা তোলা, ডালা নামানো, সময়—সাপেক্ষ।
বিকেলের দিকেও ট্রেন আসে।
পাঁচটা পঞ্চান্ন, সাতটা চল্লিশ, আর ন’টা বত্রিশে। এটাই শেষ।
তবে বিকেলের দিকে এত হিমসিম ভাব হয় না। তখন খদ্দেরও কম থাকে, আর কাজও খানিক এগোনো থাকে। সকালের হৈ চৈ মিটলেই ননী ওই ডেকচিতে এক ডেকচি চা তৈরি করে উনুনে গুঁড়োকয়লা দিয়ে বসিয়ে রাখে, সেটাই সাপ্লাই দেয়। দুধটা মিশিয়ে রাখে না কালো হয়ে যাবার ভয়ে, সেটা শুধু পরে মিশোয়।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন