ঊনবিংশ অধ্যায় – ঢাকার বিয়ের খাবার
ঢাকার বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানগুলোর মধ্যে বিয়ে ও তার অনুষ্ঠানের আড়ম্বরতা পারিবারিক এবং সামাজিক কারণে হয়ে রয়েছে মর্যাদা ও তার ঐতিহ্যের অংশ। বিয়ের অনুষ্ঠান পালনে ধর্ম, বিত্ত, পারিবারিক, পরম্পরা ভেদে রয়েছে ভিন্ন রূপ ও বৈশিষ্ট্য। মোগলদের আগমন ঢাকার জীবন যাপনে শিল্প, সংস্কৃতি, ব্যবসা, বাণিজ্যসহ আচার অনুষ্ঠানে খাবার দাবারে বিশেষ প্রভাব রেখে গেছে। তাই ঢাকাবাসীর দৈনন্দিন জীবনে এই খাবারগুলো কমবেশি প্রভাবিত করলেও তাদের সামাজিক অনুষ্ঠান বিশেষত্ব বিয়েতে খাবার দাবারে মোগলীয় ঢং ও চাকচিক্যের আধিক্য লক্ষ করা যায়। বিয়ের এই পারিবারিক ও আত্মিক বন্ধনকে ঢাকাই লোকজন সব সময় বিশেষ গুরুত্ব দান করে থাকেন। দীর্ঘ দিনের পারিবারিক সংস্কার, প্রথা এবং অনুশাসন তারা তাদের সাধ্যের মধ্যে কঠোরভাবে পালনে অভ্যস্ত। প্রতিটি পরিবারই এই বন্ধন তৈরিতে তার সামর্থ্য ও উৎসবকে আনন্দময় করতে কার্পণ্য করেন না। তারা বিয়েকে খোদা প্রদত্ত বর কনের জোড় স্থির করা মনে করে থাকেন। প্রাচীন কাল থেকে ধারাবাহিকভাবে ধর্মভেদে এই বিয়ের আনুষ্ঠানিক প্রথা নিয়মনীতি মেনে পালন করে আসলেও ২০ শতকের গোড়ায় হিন্দু ও মুসলিম বিয়ের অনুষ্ঠানের বিভিন্ন পর্বগুলোতে সাদৃশ্য দেখা যায়। তবে ঢাকার সাধারণ মুসলিম বিয়ে অনুষ্ঠানের ধারাবাহিক পর্বটা কয়েকটা ভাগে সম্পন্ন হয়। কমপক্ষে ৫/৭ দিন অতিথি আপ্যায়ন আর মূল বিয়ের অনুষ্ঠান হতে দেখা যায়। তবে অনুষ্ঠান পর্বের নামগুলো ঢাকাবাসীর বহুবিদ মিশ্রিত ভাষার কারণে বিভিন্ন নামে ডাকা হতো। অর্থ একই কিন্তু অনুষ্ঠান সার্বজনীন। আচার প্রথা পালনে পরিবারগুলোতে সামান্য ভিন্নতা দেখা যায়।
এই পর্ব দিয়ে শুরু হয় বিয়ের প্রাথমিক আনুষ্ঠানিকতা। আদি কাল থেকে কনে দেখার কাজটি করে এলাকার মহিলা ঘটকরা। যাকে ঢাকাই ভাষায় বলা হয় “মোতাসা”। প্রাথমিক বর কনে নির্বাচন সম্পন্ন বা সম্মতি দানে কনে দেখার অংশ হিসেবে উভয় বাড়িতে আদান প্রদান হয় পান-সুপারি আর মিষ্টি। ক্ষেত্র বিশেষে মোতাসাই ঠিক করে দিতেন এর পরিমাণ। নিয়ম মতো বড় কাঠের সুসজ্জিত খঞ্জা বা ডালায় পান-সুপারির বিড়া, মাটির নকশা করা পাতিলে মিষ্টি আর অত্যাবশ্যকীয় বিশেষ উপাদান দুধ, মালাই, পেস্তা বাদাম, জাফরানের তৈরি জাফরানি শরবত।
বিয়ের প্রথম আনুষ্ঠানিক পর্ব নির্ধারিত দিনে বর পক্ষ আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যান কনের বাড়িতে। সাথে নিয়ে যান ডালায় ডালায় মিষ্টি, জর্দা, পান সুপারিসহ কনের জন্য উপহার স্বরূপ স্বর্ণের আংটি বা অলঙ্কার। পাকা কথা ও বিয়ের দিন তারিখ নির্ধারণের পর দোয়াপূর্বক বর পক্ষকে আপ্যায়ন করেন কনে পক্ষ। পরিবেশন করেন সাধ্যমত মোরগ, মুরগির রেজালা, মোরগ মোসাল্লাম, জালি কাবাব, মাছের কাবাব, খাসির চাপ, বিভিন্ন ঋতুভিত্তিক ফল ফলাদি আর দুধ জাতীয় মিষ্টান্নসহ শরবত। কনের বাড়িতে বর পক্ষের পান সুপারি আর মিষ্টি দিয়ে পরের দিন আত্মীয়স্বজন পাড়া প্রতিবেশীকে জানানো হয় শুভ বার্তাটি। যেহেতু এই অনুষ্ঠানের বর হাজির হবার নিয়ম নাই। তাই কনে পক্ষ তার নতুন জামাইয়ের জন্য অনুষ্ঠান শেষে তার প্রতিনিধি মারফত খাবার পাঠানো হয়। যাকে বলে “জামাই খাওন”। এই খাবারের পদ বিবেচনা করলে তালিকা শেষ করা যাবে না। অতি রঞ্জিত অপচয় বা বিলাসিতা যাই বলা হোক না কেন ঢাকাই লোকেরা এই খাবার পর্বে তার পারিবারিক সম্মান, ঐতিহ্য, রেওয়াজ এবং কনে পক্ষের আভিজাত্য প্রকাশে কার্পণ্য করেন না। খাবার তালিকায় মোরগ পোলাও, কাচ্চি বিরিয়ানি, মুরগির রোস্ট, মুরগির রেজালা, কাবাব, তেক্কা, খাসির রেজালা, গরুর চাপ, নার্গেসি কাবাব, মাছের ফ্রাই, আস্ত ইলিশ কাবাব, খাস্তা পরোটা, রুটি, আস্ত খাসির রোস্ট, কোফতা মিষ্টান্নর মধ্যে শাহি টুকরা, জর্দা, শির বিরিঞ্জ, মাকুতি। পিঠা পুলির আলাদা ডালায় সাথে মটকায় ভরা লাচ্ছি, জাফরানি শরবত, বোরহানিসহ কমপক্ষে শতখানেক পদের খাবারের উপস্থিতি দেখা যেত। একেই বলে জামাই খাওয়া। তবে এই বিষয়টিও বর কনের আর্থিক সংগতির উপর নির্ভর করে কমবেশি হয়ে থাকে।
বিয়ের নির্ধারিত দিনের দুই বা একদিন আগে শুরু হয় বর কনের বাড়িতে সন্ধা কুটা অনুষ্ঠান। বর কনের গায়ে হলুদ মাখানোর আগেরদিন সন্ধ্যায় নিজ নিজ পরিবার ও আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে চলে সন্ধা কুটা বা হলদিকুটাই উৎসব। হলুদ বরণ অনুষ্ঠানের যাবতীয় প্রস্তুতি এই সন্ধ্যায় করা হয়। নিজেরা গান গেয়ে বাজনা বাজিয়ে বাড়িতে বর কনের অতিথিদের আগমন উপলক্ষে সব কাজ সম্পন্ন করতেন। সবার খাদ্য হিসেবে নাস্তা জাতীয় খাবার অনুষ্ঠানে পরিবেশন করা হয়ে থাকে। হলুদের দিনকে বলা হয় হলদি বা বালাবালি। বরপক্ষের লোকজন প্রথমে কনে বাড়ি আসেন কনেকে হলুদ মাখিয়ে বরণ অনুষ্ঠানে। তার পূর্বে সকালে কনে বাড়ি পাঠানো হয় বাজারের বড় দুটি মাছ। মাছ হিসেবে রুই মাছের চল বেশি। মাছকে নানা নকশায় ও সুন্দর পোশাক পরিয়ে ঢালায় পাঠানো হয়। বরপক্ষ অনুষ্ঠানে নিয়ে আসেন কনের বিয়ের পোশাক, আনুষঙ্গিক জিনিস আর সাথে ডালায় ডালায় মিষ্টান্ন ও পিঠা পুলিসহ নানা পদের মিষ্টি। কনের হলুদ বরণের সামনে দেওয়া হয় বিভিন্ন নকশা করা ক্ষীর, পায়েস, পিঠা, ফলের বাহারি নকশায় কাঠিতে গাঁথা খিলি পান। পিঠার মধ্যে নারিকেলের চিল গজা বিশেষভাবে তৈরি করা হয়ে থাকে। আগত অতিথি স্বজনদের খাবার জন্য কাচ্চি বিরিয়ানি বা তেহারি সাথে জর্দা পরিবেশিত হয়। লক্ষ্মীবাজার থেকে ময়রারা বাড়িতে আসতেন মিষ্টি বানাতে। দিনভর বাড়ির উঠোনে বিয়ে উপলক্ষে তৈরি করতেন ফরমায়েশ দেওয়া বিশাল সাইজের বিশেষ মিষ্টান্ন। মাষকালাই ডালের এক কেজি ওজনের ঘিয়ে ভাজা আমৃতি ছিল বিয়ের বিশেষ মিষ্টি। বিশাল বিশাল সাইজের কারণে অনেকে এই মিষ্টিগুলোকে এটোমবোম নামেও সম্বোধন করতেন। গায়ে হলুদ অনুষ্ঠানে গান বাজনার জন্য ডাক পড়ত ঢাকার কাওয়াল দলের। তারা ইসলামি ও বর কনের প্রশংসামূলক গজল পরিবেশন করে বিয়ে বাড়িতে উৎসবের আমেজ তৈরি করতেন। আত্মীয় স্বজনের নাম ধরে তারা গান বাধতেন, পেতেন সেলামি ও বকসিস। আরেকদল ছিল ‘মিরাসিন’। মিরাসিনরা মহিলা ছিলেন এবং পেশা ছিল গান বাজনা করা। বিয়ে অথবা মুসলমানি উৎসবে এদের এনে গান বাজনা করা হতো। তাদের গানের ভাষা ছিল হিন্দি, উর্দু ও বাংলা মিশ্রিত। হলুদের দিন রাতে সারারাত ময়দার পরোটা আর বুটের ডাল গোস্ত রান্না করা হতো। সকালে সেই নাস্তা দাওয়াতি মেহমানদের বাড়িতে পাঠানো হতো। এই নাস্তা পাঠানোর মধ্য দিয়ে বোঝা যেত যে, কারা বিয়েতে আসবেন আর কারা আসবেন না। যারা বিয়েতে আসতে ইচ্ছুক তারা এই নাস্তা গ্রহণ করতেন। ঠিক অনুরূপভাবে বর পক্ষের বাড়িতেও কনে পক্ষের মেহমান বা আত্মীয় স্বজনরা আসতেন জামাইকে হলুদ রাঙাতে। আয়োজন হতো খাবার দাবার আর গান বাজনার জলসা।
উভয়পক্ষের উপস্থিতিতে মহল্লার মসজিদেই বিয়ে পড়ানো হতো। কনে পক্ষের তরফ থেকে খোরমা ও মিষ্টি দিয়ে শুভ কাজ সম্পন্ন হতো। বিয়ের দিন বর যাত্রীরা বরকে নিয়ে কনে বাড়িতে যাবার সময় ঘোড়ার গাড়িতে চকবাজারে সাত চক্কর দেওয়ার ঢাকাই রেওয়াজ ছিল। এই সময়ে পটকা ও আতসবাজি ফুটানো হতো। বর যাত্রীরা রাস্তার লোকদের সালাম দিতে দিতে চলত আর এভাবে পৌঁছত কনে বাড়ি। যাদের সামর্থ্য কম ছিল তারা বর যাত্রী নিয়ে হেঁটেই যেতেন। বর পক্ষের খাস মেহমানদের আপ্যায়নের জন্য থাকত স্বতন্ত্র ব্যবস্থা। বিত্তবানরা ও সম্ভ্রান্ত বাড়িতে বিয়েতে মোরগ পোলাও দিয়ে আপ্যায়ন ছিল রেওয়াজ। তবে সাধারণভাবে সামর্থ অনুযায়ী সাদা পোলাও, ডাল গোস্ত, পান ও মিষ্টান্নের ব্যবস্থা থাকত। ঢাকায় বিয়ের খাবারের পদ বিবেচনায় বরের খাবারে দেখা যেত মোরগ পোলাও, মোরগ মোছাল্লাম, মুরগির রোস্ট, মুরগির রেজালা, খাসির লেগরোস্ট, সুসজ্জিত বরের জন্য আস্ত খাসির রোস্ট, নার্গেসি কোফতা, পনির, কাবাব, হাঁসের রোস্ট, গরুর চাপ, আস্ত ইলিশ কাবাব, হান্ডি কাবাব ইত্যাদি। শীতকালে কাচ্চি বিরিয়ানি, জালি কাবাব, বোরহানি, সালাদ মিষ্টান্নের মধ্যে জাফরানি শরবত, শাহি টুকরা, ফিন্নি, মাকুতি, জর্দা ঢাকার এই খাবারগুলো বরের সামনে উপস্থাপন করা হতো বিশেষভাবে সাজিয়ে। বরের এই খাবারকে “সাহেবানা” বলা হয়। খাবারের পদ বিচারে ৪০-৪৫ রকমের খাবার এই সাহেবানার আয়োজন বিয়ের আসরের বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। বিয়ের এই খাবার আয়োজনের বাবুর্চিদের ডাক পড়ত। বাবুর্চিরা তাদের সুনাম ও রন্ধনযশ প্রদর্শনের ক্ষেত্র হিসেবে বিয়ের খাবারকে বেছে নিতেন। বিয়ের পরদিন বরের বাড়িতে নতুন বউ বরণ উপলক্ষে আনন্দ ও একে অন্যের গায়ে রং ঢেলে আনন্দে মেতে উঠতেন। কনে বাড়ি থেকে সকালে নতুন জামাতার জন্য পাঠানো হতো নাস্তা। যাকে হাজারি নাস্তা বলা হয়। সবাই মিলে ঘটা করে সকালের নাস্তা সারেন কমপক্ষে একশো বাকরখানি রুটি, ভিগা রুটি, নানা রকম পিঠা, মিষ্টি ও নানা রকম ফল দিয়ে।
বউ ভাত বা ওয়ালিমা বর পক্ষের আয়োজিত অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠানে বর ও কনের পক্ষের সকল আত্মীয়স্বজনরা বরের বাড়িতে নিমন্ত্রিত হয়ে আসেন। অনুরূপভাবে সবার জন্য পরিবেশন করা হয় নানা পদের পোলাও, কোরমা, রেজালা, কাবাব, শরবত, শির বিরিঞ্জসহ পান সুপারি। এই অনুষ্ঠানের পর কনের পিতৃ গৃহে অনুষ্ঠিত হয় ফিরানি বা ফিরুল্টা। জামাই শ্বশুর বাড়িতে আড়াই দিন থাকার পর বর কনে তার বরের বাড়িতে প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে কনে বাড়িতে আয়োজন করা হয় ফিরানি, ফিরানাইওর বা আড়াই নাইওর। বর পক্ষের কয়েকজন নিকট আত্মীয় নব দম্পতিকে স্বগৃহে নিয়ে আসেন। এই উপলক্ষে ভুঁড়ি ভোজনে মোরগ পোলাও, রেজালা, মুরগির ফ্রাই, কাবাব পনিরসহ অনেক পদের খাবার আয়োজন করা হয়। নতুন জামাই তার শ্বশুর বাড়িতে বাজার করার নিয়ম রয়েছে। বাজার না করা পর্যন্ত জামাইকে পোলাও খাওয়ানো হয়। বাজার করা হলে ভাত, মাছ অন্যান্য খাবার তাকে রান্না করে খাওয়ানো হয়। এটাই ছিল ঢাকাই রীতি। কনে শ্বশুর বাড়ি যাওয়ার সময় মিষ্টির সাথে বড় আধ কেজি ওজনের তেলের পিঠা পাঠানো হতো। যাকে ঢাকাই লোকেরা “জামাই খেদাইন্না” পিঠা নামে ডেকে থাকেন। তাই বিয়ে ও তার বাহারিসহ খাবারগুলো ঢাকার সংস্কৃতিতে সব সময় এক স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ও প্রথা হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন