চতুর্দশ অধ্যায় – ধর্মীয় উৎসবের খাবার

চতুর্দশ অধ্যায় – ধর্মীয় উৎসবের খাবার

ধর্মীয় উৎসবের খাবার

প্রাচীনকাল থেকে ঢাকার জনপদে বাস করে আসছে নানা ধর্ম, বর্ণ, গোত্রের মানুষ। প্রত্যেকেরই নিজ নিজ ধর্ম পালন ও উৎসব আয়োজনে ধর্মীয় অনুশাসন, বৈচিত্র্য এবং ভিন্নতা লক্ষণীয়। এই উৎসবগুলো শুধু বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের নয় সাথে সমৃদ্ধ ও প্রভাবিত করেছে ঢাকার ঐতিহ্য, কৃষ্টি এবং সংস্কৃতিকে। মুসলমান, হিন্দু, খ্রিষ্টান ও বৌদ্ধ নিজ নিজ ধর্মীয় উৎসব পালনে ঢাকার লোকজনের মধ্যে তৈরি করেছিল সহমর্মিতা, শ্রদ্ধা এবং পারস্পরিক অংশগ্রহণের মেল বন্ধন। ধৰ্মীয় উৎসবে তাদের খাবারের ভিন্নতা ও প্রথা সব ধর্মের লোকেরাই যুগ যুগ ধরে পালন করে আসছে।

মুসলিম সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উৎসবের খাবার

ঈদ-উল-ফিতর

ঈদ-উল-ফিতর মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রধান উৎসব। রমজান বা ঈদুল ফিতর এবং কোরবানির ঈদ বা ঈদুল আজহায় ঢাকাবাসীর খাবারের বৈচিত্র্যতা ও ভিন্নতা দেখা যায়। রমজানের এক মাস সিয়াম সাধনের পর আসে কাঙ্ক্ষিত খুশির ঈদ। ঢাকার শত বছর আগে থেকেই ঈদের চিত্রটা এরকমই। ঈদের চাঁদ দেখার সাথে সাথে শহরে শুরু হয় উৎসবের আমেজ। ঈদের খাবারের উপকরণগুলো আগেই সবাই সংগ্রহ করে রাখতেন। প্রত্যেক বাড়িতে গোয়ালা ও ফেরীরা খাঁটি ঘি, মালাই, দুধ পূর্বেই পৌঁছে দিত। তারপরও মাংস ও কাঁচা বাজারগুলোতে থাকত ক্রেতার ভিড়। ঢাকার মৌলভীবাজার, কাপ্তান বাজারসহ ছোট-বড় সব বাজারগুলোতে ঈদের আগের দিন থাকত ক্রেতা সাধারণে মুখর। ঢাকার বাড়িতে বাড়িতে রমণীরা সন্ধ্যা থেকেই শুরু করতেন ঈদের খাবার তৈরির প্রক্রিয়া। শিশু বৃদ্ধসহ একান্নবর্তী পরিবারে শুরু হতো উৎসবের আমেজ। বয়োবৃদ্ধরা শুনাতেন তাদের কালের সোনালি দিনের ঈদের গল্প। পুরুষেরা বাজার সদাই তদারকি করে মহল্লায় জমাতেন আড্ডা। সন্ধ্যার পরে কাওয়াল, কাশিদার, কাশিদারা গান গেয়ে ঈদের আগমন বার্তা ঘরে ঘরে পৌঁছে দিত। বিনিময়ে তাদের সেলামি দেওয়ার রেওয়াজ ছিল। কেউ কেউ তাদের মিষ্টি মুখ করাতেন। ঢাকার রমণীরা গভীর রাত পর্যন্ত ঈদের খাবারের প্রস্তুতি করে রাখতেন। পরদিন ফজর নামাজের সময় ঘুম থেকে উঠে রান্নায় বসতেন। সকালের ঈদের নামাজে যাওয়ার পূর্বে পুরুষেরা শরবত সেমাই খেয়ে ঈদ জামাতে যোগ দিতেন। প্রত্যেক বাড়িতেই সাধ্য অনুযায়ী শ্রেষ্ঠ খাবারটাই তৈরি করতেন সবাই। ঈদের জামাতের পরে ঢাকার অভিজাত পরিবারসহ বেশির ভাগ পরিবারই সকালের খাবার হিসেবে প্রধানত মোরগ পোলাও, টিকিয়া বা শামি কাবাব, বোরহানি পান করতেন। সেমাই ঈদের প্রধান অনুষঙ্গ। সেমাই ছাড়া ঢাকার ঈদ কল্পনা করা যায় না। মোগল আমল থেকে ঢাকার মহিলারা হাতে পাকানো “চুটকি সেমাই” তৈরি করতেন। রোজার মাসব্যাপী এই সেমাই বানিয়ে জমা করে শুকিয়ে রাখতেন। ঈদের চাঁদ দেখার পর পর পানিতে ধুয়ে ঘন দুধে কিসমিস, পেস্তাবাদাম সহযোগে তৈরি করতেন চুটকি সেমাই। এছাড়াও দুধে ভেজানো শিরখুরমা খাবার রীতিও ঈদের সকালে দেখা যেত। পরবর্তীকালে পাকিস্তান আমলে চিকন মেশিনে তৈরি সেমাই প্রচলনে ঢাকায় এই সেমাই বেশি ব্যবহার শুরু করেন তারা। মিষ্টি হিসেবে জর্দা সেমাই, দুধ সেমাই সর্বাধিক প্রচলিত ছিল। অনেক পরিবার খাবার হিসেবে সাদা পোলাও, মুরগির মোসাল্লাম, কালিয়া, নার্গেসি কোফতা রুচিভেদে তৈরি করতেন। মিষ্টান্ন বলতে সেমাই ছাড়াও ফালুদা, দুধ কদু ও ঘিয়ে ভাজা লাচ্ছা সেমাই তৈরি হতো ঘরে ঘরে।

পরিবারের সকলে একত্রে সালাম ও ঈদ মোবারক সম্বোধন বিনিময়ের পর বৈঠকখানা বা অন্দরমহলে মাটিতে ফারাস বা শতরঞ্জি বিছিয়ে দস্তরখানে খাবার গ্রহণ করাই ছিল ঈদের রেওয়াজ। বিভিন্ন বাড়ির খাবার তৈরির সুবাস সারা মহল্লায় জানান দিত ঈদের আগমন বার্তা। অভিজাত পরিবারে তৈরি নবাবি ঘরানায় ঘিয়ে ভাজা সেমাই, আনারস মোরব্বা, মিষ্টির বুন্দিয়া আর বাদাম পেস্তার সাথে খাঁটি দুধের মালাই সেমাইয়ের উপর বিছিয়ে তবক দিয়ে পরিবেশন করা হতো। শিশুরা প্রাপ্ত সালামির টাকায় ঘুরে বেড়াতো চকের মেলাসহ ঢাকার আত্মীয় বাড়ি। পাওয়া যেত কুলফি মালাই, বড়া, আচার, নিমকপারা, গোলাপি ঢেউরী, তাল মিশ্রির হাতি-ঘোড়া। বিকেলে বের হতো ঈদ আনন্দ মিছিল।

সব মানুষই ঈদে কম বেশি নতুন কাপড়ে পড়ে প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবকে আপ্যায়নে সারাদিনই ব্যয় করতেন। আতিথেয়তা গ্রহণে ঈদে সকল সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ ঢাকাই সংস্কৃতি ঐতিহ্যের চমৎকার মেলবন্ধন হিসেবে দৃষ্টিগোচর হতো। বিবর্তিত ঢাকায় এই খাবারগুলোর সাথে বর্তমানের পরোটা, কাস্টার্ড, পুডিং, নুডুলস্, চটপটিসহ আরও নতুন নতুন খাবার যুক্ত হয়েছে।

ঈদ-উল-আজহা

ঈদ-উল-আজহা বা কোরবানির ঈদে ঢাকার উৎসব পশু কোরবানি কেন্দ্রিক। যা ঢাকাই ভাষায় বকরি ঈদ। ধর্মীয়ভাবে পশু কোরবানি আল্লাহর সন্তুষ্টি বিধানের জন্য হলেও গরু-খাসি, উট-ভেড়া, মহিষ কোরবানি দেয়াই নিয়ম হিসেবে পালন করা হতো। গরুর প্রাপ্ততা সাপেক্ষে আকার, মাংস হিসেবে অধিক প্রচলিত হওয়ার কারণে সকলে গরু কোরবানিকেই বেছে নিতেন। বাংলাদেশে স্যাতস্যাতে আবহাওয়ার কারণে উট বা দুম্বার সহজলভ্যতা না থাকলেও মুসলমানদের প্রাত্যহিক খাবার ও কোরবানির প্রধান পশু গরু ছিল। মোগল আমল থেকেই নিজেদের মাংসের চাহিদার কারণে মুসলিম একটি শ্রেণি গরু পালন ও ব্যবসায়ী হিসেবে উৎসাহী ছিলেন যাদেরকে “মুকেরি” বলা হতো। ব্রিটিশ আমলে সমগ্র ভারত জুড়েই কোরবানি নিয়ে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে ধর্মীয় দ্বন্দ্বের সূচনা হয়। ঢাকার বাইরের জমিদাররা মুসলিম প্রজাদের কোরবানি দিতে বাধা দিতেন। সূধাকর পত্রিকা (৭ই ফেব্রুয়ারি ১৮৯০) সে কথাই জানাচ্ছে। “বগুড়ার নারহাট্টায়” কোরবানির ঈদে ঊর্ধ্বতন হিন্দু কর্মচারী এবং জমিদার আমলারা মুসলমানদের কোরবানি দিতে দেয়নি। মুসলমানদের উচিত এ ব্যাপারে গভর্নরের কাছে স্মারকলিপি পেশ করা। তবে ঢাকায় মুসলমানদের সংখ্যাধিক্য ও নবাবদের জন্য এসব বিতর্কের বাইরেই ছিল। “ঢাকার সমাজের অনেক ত্রুটি ও দুর্নাম বিদ্যমান ছিল না। উভয়ের ধর্মীয় উৎসবাদিতে যোগ দেয়া এবং কেউ কারো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিতে চান না। যা অন্যান্য অঞ্চলের উচিত ঢাকাকে অনুসরণ করা”। সারস্বত্তপত্র (৩০ শে মার্চ ১৮৯০)।

ঢাকার যেখানে কসাইয়ের দোকান ছিল সেখানে প্রকাশ্যে গরুর মাংস বিক্রি হতো। ১৯ শতকের ৭০ দশকে ঢাকার সিভিল সার্জেন জেমস্ ওয়াইজের মতে ঢাকার মুসলমান কসাইরা দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। একদল ছাগল বা বকরির কসাই এবং আরেকদল গরুর কসাই। এই দুই দলের মধ্যে ছাগল বা বকরির কসাইয়ের স্থান ছিল উপরে। এদের পদবি ছিল “মিহির”। তার অধীনে থাকত একজন নায়েব বা আমিন তবে ঢাকায় কখনো কখনো হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় প্রয়োজনে গরুর মাংসের দোকান বন্ধ রাখার নিয়মও জানা যায়। দেশে গরু কোরবানির জন্য তৎকালীন সময়ে মুসলমানদের গরু কোরবানির বিধিনিষেধের বেড়াজালে এত সহজ ছিল না। এর জন্য ঢাকার মুসলিম সমাজ ও নবাবদের এতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে দেখা যায়। যাই হোক ঢাকার কোরবানিকৃত মাংসের বিভিন্ন পদের খাবারের মধ্যে কালিয়া, রেজালা, কোরমাসহ সব পদের রান্নাই করা হয়ে থাকে যা রুটি ও পোলাও সহযোগে খাওয়া হয়। গরুর শিক কাবাব, তিল্লি ভুনা, গুরদা ভুনা, কলিজি কাবাব, গরুর কুঁজের নোনা মাংসের কাবাব, কিমা, মগজ ভুনা, টিক্কা, শামি কাবাব, সিনা তালা, খাসির বটি কাবাব, তেক্কা, খাসির পায়ার নেহারি ঢাকায় বিশেষভাবে তৈরি হয়ে থাকে। আরেকটি বিশেষ খাবার বাকরখানি রুটির ঝুড়া মাংস।

সাধারণভাবে কোরবানি দেবার সময়টা ঈদের দিন বিকেল নয়তো পরের দিন। গরু কোরবানি প্রধান হলেও সামর্থ অনুযায়ী খাসি কোরবানি করার প্রথা এখানে প্রচলিত সেই সময়ে ঢাকার বাড়িতে ফ্রিজ নামক জিনিসটা ছিল না। সব ঘরেই গরু কোরবানির পর মাংসকে রান ও সিনা আস্ত করে কেটে সারারাত দড়িতে ঝুলিয়ে রাখা হতো কারণ এতে মাংস ভিতরের রক্ত ঝরে গিয়ে মাংসের স্বাদ ও দীর্ঘদিন সংরক্ষণের উপযুক্ত হতো। পরেরদিন কোরবানির মাংসকে প্রয়োজন অনুযায়ী ছোট টুকরো করে বিভিন্ন উপায়ে খাবারের জন্য এবং বণ্টনের ব্যবস্থা করা হতো। এজন্য একজন পেশাদার কসাই খুবই নৈপুণ্যে এবং অল্প সময়ে একটা গরুকে খাবার উপযোগী তৈরি করতে পারতেন। কোরবানির মাংসকে বড় বা মাঝারি তামার কালাই করা পাতিলে হাড় ছাড়া মাংস, টকদই, আদা-রসুন অল্প পিঁয়াজ ও লবণ দিয়ে ঘি এবং চর্বি যোগে রান্না করা হয়। এখানে চর্বিটাই প্রধান সংরক্ষণের জন্য প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে মাংসের পাতিলটাকে জ্বাল দেওয়া হয়। এভাবেই কোরবানির পরবর্তী মহরম পর্যন্ত একমাস মাংস সংরক্ষিত অবস্থায় থাকে। ঢাকায় লোকজন বাড়িতে কোরবানির এই সংরক্ষিত মাংসকে ব্যবহার করে মহরমের খিচুড়ি রান্নার রেওয়াজ প্রচলিত রয়েছে। যা পবিত্র সংস্কার হিসেবে গণ্য করা হয়। খিচুড়ির নির্দিষ্ট কোনো প্রকার ভেদ নেই। একেক বাড়ি বা লোকজন তার পছন্দমত সাদা খিচুড়ি বা হলুদ যোগে ভিন্ন ভিন্ন খিচুড়ি রান্নার প্রকারভেদ দেখা যায়। বিশেষত যারা অসামর্থ্য ও দরিদ্র তাদেরও কোরবানি উপলক্ষে মাংস খাবার সুযোগ সৃষ্টি দৃষ্টি গোচর হয়। কোরবানির ঈদ ঢাকার মানুষের ত্যাগ ভাগ করে খাওয়ার মানসিকতা, ভাতৃত্ববোধের ইতিহাস সমাজে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রেখে চলেছে যুগ যুগ ধরে।

ঢাকার ঐতিহ্যবাহী মীরকাদিমের সাদা গাই

ঈদ-উল-আজহায় কোরবানি উপলক্ষে ঢাকাই লোকদের প্রথম পছন্দ মীরকাদিমের সাদা গাই। যুগ যুগ ধরে সাদা গাই গরু কোরবানি দেওয়ার রীতি এখনও চলে আসছে বংশ পরম্পরায়। এই বিশেষভাবে পালিত গরু শুধুমাত্র রহমতগঞ্জের গনি মিয়ার হাটেই ঈদের দুই বা একদিন আগে বিক্রির জন্য আনা হয়। এই গরুর রাখার জন্য হাটে থাকে বিশেষ ছাউনিসহ যত্ন আত্মির ব্যবস্থা। মুন্সিগঞ্জের মীরকাদিমে সারা বছর এই সাদা গাই লালন-পালন করা হয়। মুন্সিগঞ্জে পালিত হলেও এই জেলার কোনো হাটে এই গরু বিক্রি হয় না। রহমতগঞ্জের গনি মিয়ার হাটেই বিক্রি হয়ে থাকে যা অন্যান্য গরু থেকে কদর ও দাম একটু বেশি। বর্তমানে ৮০ হাজার থেকে ৮ লক্ষ টাকায় মেলে ঐতিহ্যবাহী সাদা গাই গরু। আর শতবছর এই চাহিদার জোগান দিয়ে চলেছে মীরকাদিমের খামারিরা। এই জায়গার নামটি বিখ্যাত হয়ে গেছে এই সাদা গাইয়ের সুবাদে।

খামারিরা যশোর, রাজশাহি, দিনাজপুর প্রভৃতি এলাকা থেকে সাদা গাই গরু বাছুর কিনে আনেন। আবার ভারত ও ভূটান থেকেও আবাল পশ্চিমা সাদা ষাড় ও সাদা গাভীর বাচ্চা কিনে থাকে। একেকটি বাছুর বড় করতে ও কোরবানির উপযোগী করতে ৮-১০ মাস সময় লাগে। খামারের বাইরের কাউকে ঢুকতে দেওয়া হয় না। খাবার হিসেবে নির্ভেজাল খৈল, ভুসি, ভাতের মার, ভাত ও মাটি চাপা দিয়ে ধানের কুটা পচিয়ে বিশেষ ধরনের খাবার তৈরি করে খেতে দেওয়া হয়। ৫-৭ জন শ্রমিক সারাদিন গরুর যত্ন নেওয়ার কাজ করেন। কোনো রকম ইনজেকশন বা রাসায়নিক ব্যবহার করা হয় না। গরুর ধোয়া মোছার যত্নে প্রতিদিন একটি নতুন গামছা ব্যবহার করা হয়। যে স্যাম্পু নিজে ব্যবহারের ক্ষেত্রে খরচের কথা ভেবে ১০ বার ভাবতে হয় সেই স্যাম্পু দিয়ে পরম আদরে পালিত গরুগুলোকে নিয়মিত গোসল করান। মশার কামড় থেকে বাঁচার জন্য গোয়াল ঘরে নিয়মিত মশারি খাটানো হয়। শীতে গরুর গায়ে বিশেষ ধরনের লেপ চাপানো হয় আর গরমে থাকে বৈদ্যুতিক পাখার ব্যবস্থা।

মীরকাদিম ব্রিটিশ আমল থেকেই পশুর খাদ্যের জন্য প্রসিদ্ধ। এছাড়াও এখানে রয়েছে প্রচুর তেল কল, ধানের চাতাল আর সাশ্রয়ী দামে খৈল ও ভুসি পাওয়া যায়। কৃষি প্রধান হওয়ায় ঘাসও সহজলভ্য। কঠোর যত্ন ও বিশেষভাবে পালিত হওয়ার কারণে গরুগুলো হয় নিখুঁত ও উচ্চতায় বেশি। এমনভাবে পালা হয় যাতে গরুর গায়ে প্রচুর চর্বি হয় আর চর্বি যুক্ত গরুর মাংস পুরান ঢাকাবাসীর বিশেষ পছন্দের। খামারিরা বংস পরম্পরায় গরু পালন করেন। মীরকাদিমের খামারগুলোতে আরেক ধরনের বিশেষ গরু রয়েছে। যার নাম গুড্ডি গরু। যেটি খুব ছোট আকারের উচ্চতা ২.৫/৩ ফুট এবং প্রস্থে ৪/৪.৫ ফুট হয়। কিন্তু দাম অনেক বেশি। একটা খাসির চেয়েও ছোট এই গরুর দাম ৬০-৮০ হাজার টাকার কাছাকাছি। শুধু এখানেই এই গরু পালন হয়। গুড্ডি গরুকে ঘাস খাওয়ানো হয় না। এর বাহ্যিক অবয়ব খুব তেলতেলে ও গোলাকৃতির হয়। মাংস মোলায়েম ও সুস্বাদু।

কোরবানি উপলক্ষে ঢাকাই আদি বাসিন্দারা দুই তিন গুণ বেশি দামে এই গরুগুলো কিনে থাকেন। তাই তারা অপেক্ষায় থাকেন ঈদের আগ পর্যন্ত মীরকাদিমের সাদা গাইয়ের জন্য। যা ছাড়া যেন কোরবানি সম্পন্ন হয় না পুরান ঢাকাবাসীর। এখনও অনেকে একে পারিবারিক ঐতিহ্য ও পশু বাছাইয়ের পছন্দের শীর্ষে রাখের মীরকাদিমের সাদা গাই।

মহরম

মহরম মুসলমানদের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় অনুষ্ঠান। মহরমের উৎসব শিয়া-সুন্নি উভয়ই সম্পূর্ণ আলাদা ও ভিন্ন রীতি নীতিতে পালন করেন। কারবালার প্রান্তরে মহানবী (স.) এর পৌত্র ইমাম হুসাইন ও তার পরিবারের শাহাদাত দিবস স্মরণে পালন করা হয়। মহরমের চাঁদ দেখার সঙ্গে সঙ্গে ইমামবারায় শিয়ারা আগত ভক্তদের মাঝে পানি ও শরবত বিতরন করেন। মহরমের তাজিয়া মিছিল বের হয়। মিছিলে দুধের শরবত, তোকমার শরবত তবারক হিসেবে খাওয়ানো হয়। ইমামবারায় খিচুড়ি ও লাড্ডু খাওয়ানো হতে দেখা যায়। মানতকারীরা “কায়েস লাড্ডু” মনবাসনা পূর্ণের আশায় গ্রহণ করেন। মনবাসনা পূর্ণ হলে ঘিমায় লাড্ডু তাদের পরের বছর দিতে হয়। মহরমের ৮ তারিখে হাজেরি বা নাস্তা হিসেবে পরোটা, বাখরখানি, সুতি কাবাব, টিকিয়া কাবাব, পুদিনা, পেঁয়াজ কাটা, এক টুকরা কলা, হালুয়া পরিবেশন করা হয়। আশুরার দিন সুন্নি মুসলমানেরা রোজা রাখেন। মহরম উপলক্ষে ঢাকার বাড়ি বাড়িতে খিচুড়ি তৈরির রেওয়াজ রয়েছে।

শবে-বরাত

মুসলমানদের প্রার্থনার ও পবিত্র একটি রাত। সারা রাত ইবাদত বন্দিগি দোয়া পাঠ, মিলাদ মাহফিল আয়োজনে সময় কাটান সবাই। এই বিশেষ দিনে দরিদ্র অসহায়দের দান খয়রাত খাবার বিতরণ এবং নিজেরাও গৃহে ভালো খাবারের ব্যবস্থা করেন। শবে-বরাত উপলক্ষে ঢাকার ঘরে ঘরে তৈরি হয় বুটের হালুয়া, সুজির হালুয়া, নেসাশতার হালুয়া, মৌসুমী গাজরের হালুয়া, বরফিসহ নানা পদের হালুয়া। সামর্থ্য অনুযায়ী আটার রুটি, চালের রুটি, ময়দার রুটি তৈরি হয়। শবে- বরাত উপলক্ষে কবে থেকে হালুয়া রুটি খাবার প্রচলন তার সঠিক সময় নির্ণয় করা সম্ভব হয় না। তবে রেওয়াজটি অতি প্রাচীন তা অনুমান করা যায়। কেননা মোগল যুগেও ঢাকার নবাবেরা বিশেষ মর্যাদার সঙ্গে এই পর্ব পালন করতেন। তৎকালীন সময়ে মিষ্টান্ন বলতে সুজি ময়দার তৈরি মিষ্টান্নই ছিল যা ভারতের উত্তর প্রদেশ থেকে এদেশে প্রবেশ করেছিল। ছানার মিষ্টির প্রচলন বিশ শতকের প্রথম দিকে। শবে-বরাত উপলক্ষে ঢাকার স্বচ্ছল পরিবারগুলোতে পোলাও, তেহারি, ভুনা খিচুড়ি, হাঁসের মাংস রান্না করতে দেখা যায়। শবে-বরাতে ঢাকার দোকানে একসময়ে শীলমার রুটি পাওয়া গেলেও তার জায়গায় এখন পাউরুটি ও বনরুটি দখল করেছে। বেকারিগুলোতে তৈরি হয় পাখি, কুমির, কাজ বসানো পুতি দিয়ে অলংকৃত করা দৃষ্টি নন্দন রুটি। শবে-বরাতে এই রুটি হালুয়া আত্মীয় স্বজন ও পারা প্রতিবেশীর বাড়িতে পাঠানো রেওয়াজ রয়েছে ঢাকায়।

এছাড়াও ঢাকার মুসলিম সম্প্রদায়ের আরও ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও উৎসব দেখা যায়। তার মধ্যে ঢাকার শিয়া সম্প্রদায় রজব এর ২২ তারিখে ইমাম জাফর সাদেক (রাঃ) সম্মানার্থে ঘরে তৈরি পায়েস, লুচি, বিভিন্ন পদের ফল যা “কোন্ডার শিরনি” নামে আয়োজন করে থাকে। এছাড়াও জিলহজ মাসে ১৮ তারিখ “ঈদে গাদির ই খুম” এবং ২৪ তারিখে ঈদে মোসহেলা নামে দুটি দিবস পালন করেন। মিলাদ মাহফিল, দোয়া, আলোচনা, কাসিদা পাঠ আয়োজন করে তবারক হিসেবে মেহমানদের মিষ্টি, জরদা বা পোলাও খাওয়ানোর প্রথা রয়েছে।

শিশু জন্মের পর নাম রাখা উপলক্ষে “আকিকা” অনুষ্ঠান পারিবারিকভাবে পালন করা হয়। এ উপলক্ষে ছেলে সন্তানের জন্য দুটি এবং মেয়ে সন্তানের জন্য একটি খাসি জবাই করে আত্মীয়, স্বজন, প্রতিবেশীদের মাঝে বিলিয়ে দেওয়া হয়। কখনো আপ্যায়নে অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। পোলাও, বিরিয়ানিসহ ঢাকাই খাবারগুলোই রান্না ও পরিবেশন করা হয়।

“সুন্নতে খত্না” যাকে ঢাকায় মুসলমানি বলা হয়। ধর্মীয়ভাবে ছেলে শিশুর খাতনা করা মুসলমানদের জন্য অত্যাবশ্যক। খাত্নার দিন মিষ্টি ও জরদা পাঠিয়ে আত্মীয় প্রতিবেশীর বাড়িতে সুসংবাদ পৌঁছে দেয়া হয়। জরদা পাঠানোর পর আত্মীয় ও ঘনিষ্ঠজনেরাও নিয়ে আসেন মুরগির তৈরি খাবার, ঘিয়ে ভাজা পাপড়ি, পিঠা ইত্যাদি। খত্নার সাত দিন থেকে এক মাসের মধ্যে অনুষ্ঠান করে আগত মেহমানদের পোলাও, কোরমা, রেজালা, ফিরনি বা জর্দা দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়।

ঢাকার কিছু ধর্মীয় প্রাচীন প্রথা প্রচলিত রয়েছে। পবিত্র কুরআন ও হেফজ খতম করা উপলক্ষে জর্দা রান্না করে অতিথিকে খাওয়ানো হয়। ঢাকার নবাব সলিমুল্লার মেয়ে আয়েশা খানমের কুরআন খতমের এবং এ উপলক্ষে নবাব পরিবারে সবাইকে মিষ্টি নাস্তা ও চা খাওয়ানোর কথা নবাব পরিবারের ডায়েরিতে উল্লেখ্য পাওয়া যায়। ঢাকাবাসীদের হজ্জ যাত্রাকালীন সময়ে পরিবার ও আত্মীয় স্বজনদের থেকে দীর্ঘ সময় দূরে থাকতে হতো। জাহাজে করে তিন মাস থেকে এক বছরও কারো কারো ফিরে আসতে সময় লাগত। দীর্ঘ যাত্রা ও পবিত্র স্থানে যাওয়ার প্রাক্কালে আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশীদের সাথে সাক্ষাৎ ও দোয়া প্রার্থনার জন্য ভোজ সভার আয়োজন অনুষ্ঠিত হতো। বাড়ির ও ঢাকার শ্রেষ্ঠ খাবারটাই সবাইকে খাওয়ানো হতো।

মৃত্যুর পর মৃতের বাড়িতে দাফন কার্য শেষ করে লোকজন ফিরে এলে নাস্তা হিসেবে “হাজেরিকা রুটি” যা বাখরখানি, জিলাপি বা মিষ্টি খেতে দেওয়া হয়। কারণ মৃত বাড়ির সবাই শোকে কাতর থাকেন এবং বেশ কয়েকদিন বাড়িতে রান্না হয় না। এই সময়ে ঘনিষ্ঠ আত্মীয় স্বজনেরা একাধিক বাড়ি থেকে ভাত, মাছ, মাংস, ডাল, সবজি পাঠিয়ে থাকেন। বর্তমানের অনেক ক্ষেত্রেই দৃষ্টিকটুভাবে অবস্থাসম্পন্ন পরিবার থেকে পোলাও, বিরিয়ানি, কাচ্চি বিরিয়ানি পাঠাতে দেখা যায়। কুলখানিতে দুস্থদের জন্য ভোজ আয়োজন করা হয়। অনেকে মৃত ব্যক্তির পছন্দের খাবারটা খাওয়ানোর চেষ্টা করেন। চল্লিশতম দিনে চেহলাম বা চল্লিশা পালিত হয়। এদিনে দুস্থদের দান খয়রাত, দোয়া মাহফিলসহ ভোজ সভায় সাদা পোলাও, কালিয়া, ফিন্নি বা জর্দা পরিবেশন করা হয়। বছর পর পালন করে মৃত্যু বার্ষিকী। দোয়া মাহফিলসহ সামর্থ্য অনুযায়ী দুস্থ, আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীদের ভোজ করানোর প্রচলন দেখা যায়।

হিন্দু ধর্মীয় উৎসবের খাবার

ঢাকার সংস্কৃতিতে পূজা, জন্মাষ্টমি, রথযাত্রা একটি বিশেষ স্থান দখল করে রয়েছে। হিন্দু সম্প্রদায়ের উৎসবের খাবারগুলো ঢাকা অন্যান্য সম্প্রদায়ের খাবার থেকে ভিন্ন। পূজার প্রসাদ হিসেবে আতপ চাল, আখের গুড়, কলা এবং বাতাসা অপরিহার্য।

দুর্গা পূজা

হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গা পূজা। দশ দিন ব্যাপী এই পূজা অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম পাঁচদিন হিন্দুরা নিরামিষ খাদ্য গ্রহণ করে থাকেন। প্রসাদ হিসেবে নিরামিষ সবজির খিচুড়ি, সাদা পোলাও, সন্দেশ, লাড্ডু খাওয়া হয়। ষষ্ঠীর দিন হতে দই, ক্ষীর, বড় মাছ, পাঠার মাংস, ফল-ফলাদি খেতে দেখা যায়। দশমির দিন অতিথিদের বড় মাছের ঝোল, ভাত, পায়েস দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়। লাড্ডু আর জিলাপি বাড়ি বাড়ি বিলিয়ে থাকেন।

জন্মাষ্টমী

শ্রী কৃষের জন্মদিন উপলক্ষে শ্রাবণ-ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমীতে এই উৎসব পালন করে থাকেন। ভক্তরা উপবাস থেকে কৃষ্ণ পূজা করেন। হিন্দুরা জন্মাষ্টমীর তিন দিন নিরামিষ খেয়ে থাকেন। ঢাকার বিখ্যাত ও ঐতিহ্যবাহী জন্মাষ্টমীর মিছিল জাঁক জমকতার সাথে সারা শহর প্রদক্ষিণ করা শেষে মালপোয়া, তালের বড়া, নানা রকম লাড্ডু, পায়েস ও ফলের প্রসাদ দেওয়া হয়। রাতে চলে খিচুড়ি রান্নার আয়োজন। উপবাস ভাঙা সকলে ফলমূল এবং পরের দিন দেবতার উদ্দেশ্যে ভোগ শেষে খিচুড়ি বা অন্য প্রসাদ গ্রহণ করে থাকেন।

রথযাত্রা

শ্রীজগন্নাথদেবের উদ্দেশ্যে আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে অনুষ্ঠিত হয় হিন্দুদের রথযাত্রা উৎসব। এ উৎসবে খিচুড়ি এবং পাঁচ সবজির তরকারি যেমন- পেঁপে, কুমড়া, ডাটা, আলু, বেগুণ সাথে পায়েস প্রসাদ হিসেবে সবাই খেয়ে থাকেন। এছাড়াও হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্যান্য পূজা ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে হিন্দুদের ধনদেবী লক্ষ্মীপূজায় পূজার ভোগ হিসেবে তিলের নাড়ু, খইয়ের নাড়ু, নারিকেলের নাড়ু, মুড়ির মোয়া, গুড়ের সন্দেশ নানা রকম পিঠা দেওয়া হয়। প্রসাদের মধ্যে লুচি, সুজির হালুয়া, পায়েস, দই, মিষ্টি, কদমা ও বাতাসা অবশ্য এগুলো সবপূজাতেই প্রসাদ হিসেবে দেওয়া হয়। মাঘের শুক্লা পঞ্চমিতে অনুষ্ঠিত হয় স্বরস্বতী পূজা। বিদ্যাদেবীকে প্রসাদ হিসেবে কুল বড়ই, শশা, কলাসহ বিভিন্ন রকমের ফল দেওয়া হয়। এছাড়াও পূজার প্রয়োজনীয় উপকরণ হিসেবে দুধ, পলাশ ফুল, মাটির দোয়াত, বেত গাছের কলম ইত্যাদিও অত্যাবশ্যক। ঢাকার হিন্দুদের সরস্বতী পূজার পরপরই জোড়া ইলিশ মাছ রান্না করা তাদের ঐতিহ্য। ইলিশ মাছে আলু, কলাই শুটি বা মটর শুটি, খিচুড়ি, বাঁধাকপি, ডালনা এই সময়ে উপাদেয় খাদ্য হিসেবে গণ্য করা হয়। কার্তিকের অমাবশ্যায় অনুষ্ঠিত হয় হিন্দুদের কালিপূজা। পাঠা বলি দিয়ে তার মাংস খাওয়ার প্রথা থাকলেও বর্তমানে তা কমে এসেছে। কালিপূজায় অনেককে কাচ্ছিমের মাংস খেতে দেখা যায়। অনেক রাতে পূজা আরম্ভ হওয়ার কারণে খুব ভোর বেলায় প্রসাদ হিসেবে সবজি খিচুড়ি দেওয়া হয়। ঢাকায় কার্তিক মাসে হিন্দুদের বাড়িতে অন্নকুট বা গোবর্ধন পূজার উৎসব দেখা যায়। জানা যায় শ্রী কৃষ্ণ ইন্দ্রপূজার পরিবর্তে গোবর্ধন পূজার প্রবর্তন করেন। সে জন্য নন্দ মহারাজ অন্নকুট মহা উৎসবের আয়োজন করেছিলেন। সেখান থেকে অন্নকুটের উৎপত্তি। এপূজায় কম বেশি প্রসাদে পাঁচ পদের ডাল, ১০৮ রকমের সবজি, মাস বড়া, পোলাও, নিরামিষ খিচুরি এবং ৬০-৭০ প্রকার মিষ্টান্ন থাকে।

হিন্দু পরিবারে কোনো ব্যক্তি মারা গেলে তার শ্রাদ্ধ পালন করা হয়। হিন্দু শাস্ত্রীয় বিধি অনুযায়ী মৃত ব্যক্তির পরিবার ফলাহার করে থাকেন। এক বেলা জাউ ভাত সাথে ঘি ও নারিকেল চিনি খেয়ে থাকেন। অন্যান্য আত্মীয়স্বজন নিরামিষ খাবার গ্রহণ করেন। ১১ দিন থেকে ১ মাসের মধ্যে মৃত ব্যক্তির আত্মার মঙ্গল কামনায় ভোজের আয়োজন করা হয়। এ ভোজ সভায় লুচি নিরামিষ, মাছ ভাত, কেউ কেউ মুড়ি বা দই চিড়া দিয়ে অতিথি আপ্যায়ন করেন।

খ্রিষ্ট ধর্মীয় উৎসবের খাবার

প্রতি বছর ২৫শে ডিসেম্বর যিশু খ্রিষ্ট্রের জন্মদিন উপলক্ষে খ্রিষ্টান সম্প্রদায় তার সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব পালন করেন। এ উপলক্ষে গির্জায় বিশেষ প্রার্থনার পর বাড়িতে বাড়িতে উৎসবের আয়োজন দেখা যায়। প্রত্যেকেই তাদের বাড়ি ঘরে আলোকসজ্জা, ক্রিসমাস ট্রি ও ক্রিসমাস কেক তৈরি করেন। আত্মীয় স্বজন বন্ধুদের জন্য বিশেষ খাবারের ব্যবস্থা থাকে। এ উপলক্ষে নতুন কাপড়ে নাচ- গানের আয়োজন এবং মদ পানের ব্যবস্থা করতে দেখা যায়। নানা রকম পিঠা, কেক, পোলাও বা বিরিয়ানি, হাঁস বা মুরগির মাংস, শূকরের মাংসের বিভিন্ন পদের খাবার তারা তৈরি করেন। ঢাকার খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের একটি প্রিয় খাবার “বিন্দালু”। টক ও মসলার তৈরি খাবার যা সাধারণত উৎসবের আগের দিন তৈরি করে উৎসবের দিন খাওয়া হয়।

গুড ফ্রাইডে খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ে একটি বিশেষ দিন। যিশু খ্রিষ্টের ক্রুশ বিদ্ধ হয়ে মৃত্যু বরণের জন্য তারা সারাদিন উপবাস থাকেন। উপবাসের পর ফলের রস বা শরবত এবং মুড়ি বিস্কুটসহ হাল্কা খাবার খেয়ে উপবাস ভঙ্গ করেন।

ইস্টার সানডেতে যিশুর পুনঃরুত্থান হয় গুড ফ্রাইডের তিন দিন পর রবিবার। এজন্য খ্রিষ্টান সম্প্রদায় এদিনকে ঈশ্বরের দিন হিসেবে দেখেন। রোববার তাদের বিশেষ প্রার্থনা দিবস। প্রতিকী রূপে বিভিন্ন দল ভোজ সভার আয়োজন করেন। পোলাও, মাংস, মাছ, দই, মিষ্টি, ফল-ফলাদি ছাড়াও সব ধরনের খাবার খাওয়ানো হয়।

বৌদ্ধ ধর্মীয় উৎসবের খাবার

বৌদ্ধ সম্প্রদায়ে উৎসব ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানের প্রধান খাবার নিরামিষ, ফলমূল ও পিঠা পায়েস। আমিষ খাদ্য বর্জনীয়। গৌতম বুদ্ধের জন্ম গ্রহণ উপলক্ষে বৌদ্ধ পূর্ণিমা ও মাঘি পূর্ণিমা, আষাড়ি পূর্ণিমা, ভাদ্র পূর্ণিমা পালন করেন যা বৌদ্ধের জীবন ও কর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে বিবেচিত হয়। প্রতি উৎসবে পায়েস তৈরি এবং তা সবার মাঝে বিতরণ করা হয়। ভাদ্র পূর্ণিমায় ভিক্ষুদের মধু পান করানোর রীতি রয়েছে। এছাড়াও আষাড়ি পূর্ণিমা থেকে আশ্বিনী পূর্ণিমা পর্যন্ত তৈরি হয় মধু ভাত। যা মধু, সরু চাল, দই তেজপাতা, চিনি দিয়ে তৈরি হয়। ভিক্ষু হওয়ার অনুষ্ঠান উপসম্পদাতে পিঠা তৈরি করে আমন্ত্রিতদের খাওয়ানো হয়। চৈত্র সংক্রান্তিতে বৌদ্ধ মূর্তি সুসজ্জিত করে দুধ ও নারিকেল স্নান করানো হয়। এ উপলক্ষে পিঠা, নাডু, মিষ্টি ছাড়াও, তেতো ভক্ষণ (পাচন) তৈরির রীতির প্রচলন আছে। কঠিন চীবর দানে খাবার হিসেবে নিরামিষ অন্তষ্টিক্রিয়ায় কচুরি দিয়ে সমাগতদের আপ্যায়ন পিন্ড দান অনুষ্ঠানে ফল ও মৃত ব্যক্তির পছন্দের খাবার উৎসর্গ করা হয়।

সকল অধ্যায়

১. প্রথম অধ্যায় – বাদশাহি ও নবাবি খাদ্য বিলাস
২. দ্বিতীয় অধ্যায় – ঢাকার রুটি
৩. তৃতীয় অধ্যায় – ঢাকার কাবাব
৪. চতুর্থ অধ্যায় – ঢাকার পোলাও ও বিরিয়ানি
৫. পঞ্চম অধ্যায় – মাংসের মসলাদার খাবার
৬. ষষ্ঠ অধ্যায় – বাংলা খাবার
৭. সপ্তম অধ্যায় – নাস্তা জাতীয় খাবার
৮. অষ্টম অধ্যায় – ঢাকার পানীয়
৯. নবম অধ্যায় – ঢাকার মিষ্টান্ন
১০. দশম অধ্যায় – ঢাকার পিঠা
১১. একাদশ অধ্যায় – ঢাকার বিশেষ খাবার
১২. দ্বাদশ অধ্যায় – খাদ্য পরিবেশন
১৩. ত্রয়োদশ অধ্যায় – ঢাকায় রমজানে সেহরি ও ইফতার
১৪. চতুর্দশ অধ্যায় – ধর্মীয় উৎসবের খাবার
১৫. পঞ্চদশ অধ্যায় – পান-হুক্কা-চা
১৬. ষষ্ঠদশ অধ্যায় – ঢাকার ক্যাটারিং, ডেকোরেটর ব্যবস্থা ও বাবুর্চিরা
১৭. সপ্তদশ অধ্যায় – ঢাকার নিরাপদ পানির ব্যবস্থাপনা
১৮. অষ্টাদশ অধ্যায় – হিন্দু সম্প্রদায়ের খাবার
১৯. ঊনবিংশ অধ্যায় – ঢাকার বিয়ের খাবার
২০. বিংশ অধ্যায় – ৪০ দশক পরবর্তী ঢাকার জনপ্রিয় খাবার ও পর্যালোচনা
২১. ২১. পরিশিষ্ট

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন