বিংশ অধ্যায় – ৪০ দশক পরবর্তী ঢাকার জনপ্রিয় খাবার ও পর্যালোচনা

বিংশ অধ্যায় – ৪০ দশক পরবর্তী ঢাকার জনপ্রিয় খাবার ও পর্যালোচনা

৪০ দশক পরবর্তী ঢাকার জনপ্রিয় খাবার ও পর্যালোচনা

ব্রিটিশ আমলের শেষ দিকে ঢাকায় খাবার হোটেল ও মিষ্টান্ন দোকানের যুগের সূচনা হয়। ৫০ দশকে ঢাকা প্রাদেশিক শহরের লোকসংখ্যা ৩ লক্ষ্যের বেশি ছিল না। তথাপি শহরের জনসংখ্যা চাপ ঢাকাকে কেন্দ্র করে শহরের গুরুত্ব ক্রমেই বাড়তে থাকে। এই বাড়তি চাপ আর মানুষের খাবার সংস্থানের চাহিদার প্রয়োজনে গড়ে উঠতে থাকে নতুন নতুন খাবার দোকান ও হোটেল। সেই সময়ে সদরঘাট, সোয়ারিঘাট, ওয়াইজঘাট, বুড়িগঙ্গার নদীতে ছিল ভাসমান দোতলা হোটেল। বুড়িগঙ্গার নদীর উপর বড় বড় পিনিস নৌকায় বা বজরায় ছিল এই সব হোটেল। এর মধ্যে বুড়িগঙ্গা হিন্দু হোটেল, লক্ষ্মী পাইস হিন্দু হোটেল, বরিশাল হিন্দু হোটেল, শ্রী দুর্গা হোটেলসহ কিছু মুসলিম হোটেলও ছিল ভাসমান অবস্থায়। তাদের খাবার ছিল খুব সুস্বাদু। এই হোটেলগুলোতে বেশির ভাগ দক্ষিণ অঞ্চলীয় ব্যবসায়ীরা এসে থাকতেন। দেশ ভাগের সময় ঢাকায় ১২০টির মতো পিনি স হোটেল ছিল। ক্রমশই এই ভাসমান হোটেল কমতে থাকে। বর্তমানে একটি কাঠের ও দুটি স্টীল দিয়ে গড়া দোতলা এই হোটেল ওয়াইজ ঘাটে এখনও রয়েছে। ব্রিটিশ সৃষ্ট হিন্দু মুসলিম সাম্প্রদায়িক দ্বন্দের কারণে আলাদা আলাদা মুসলিম ও হিন্দু হোটেল গড়ে ওঠে শহরের মূল ভূখণ্ডের নবাবপুর, জনসন রোড, ইসলামপুর, বাংলাবাজার এলাকাগুলোতে। ইংরেজদের ওকে হোটেল, দিল্লি মুসলিম হোটেল, ইসলামিয়া হোটেল, ক্যাপিটাল রেস্তোরাঁ ছিল প্রথম দিককার হোটেল ও রেস্তোরাঁ। ৫০ দশক থেকে ঢাকায় চৌরঙ্গি, বাবুবাজারে চুন্নু মিয়ার হোটেল, ক্যাফে কর্নার, বিউটি বোর্ডিং, শংকর বোর্ডিং, কল্পনা বোর্ডিং, সাভার বোর্ডিং, ক্যাফে চায়নাসহ আরও অনেক হোটেল রেস্তোরাঁ গড়ে উঠতে থাকে। আর গুলিস্তানকে ঘিরে রমনা এলাকাতে গড়ে উঠে ঢাকার বিখ্যাত ও জনপ্রিয় সব খাবারের হোটেল ও রেস্তোরাঁগুলো। আসুন জেনে নেই সেই সময়ের ঢাকাবাসীর নষ্টালজিতে স্থান করে নেওয়া খাবারের দোকানগুলোর ইতিকথা। ৪০ দশকের শেষে বর্তমান যেখানে গুলিস্তান সিনেমা ভবন, ঠিক সেখানেই একতলা ভবনে তুরস্কের এক ভদ্রলোক খুলে বসেন রেক্স রেস্তোরাঁ। ঢাকা শহরের আভিজাত্যের প্রতিনিধিত্ব করত রেক্স। পরোটা আর বিচিত্র ধরনের কাবাবের জন্য বিখ্যাত হয়ে উঠে। এছাড়াও এখানকার বাটার টোস্ট সাথে ইংলিশ ছোঁয়ায় উর্দি পড়া বেয়ারারা খাদ্য পরিবেশন করত। ৪৭ এ দেশ ত্যাগ করে চলে যান মালিক তুরস্কের ভদ্রলোক। দেশ ত্যাগের পূর্বে দোকানের কর্মচারী আহমদের কাছে রেস্তোরাঁটি বুঝিয়ে দিয়ে যান। পরবর্তী সময় বর্তমান বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে স্থান পরিবর্তন করে দীর্ঘদিন জনপ্রিয়তার সাথে টিকে ছিল। বঙ্গবন্ধু এভিনিউর আরেক নামকরা রেস্টুরেন্ট ‘লা সানি’ বর্তমান অগ্রণী ব্যাংকের শাখাটি যেখানে ঠিক সেখানেই ছিল এর অবস্থান। গুলিস্তান জিরো পয়েন্টের উল্টো দিকের কোণে ছিল কসবা রেস্টুরেন্ট। ৫০ দশকের ইংরেজদের রেস্টুরেন্ট ছিল রিডজ। ব্রিটিশ মালিকানাধিন পল্টন ময়দানের কাছে একতলা টিনশেড পাকা দালানে ছিল এই রেস্তোরাঁ। ইংরেজদের জন্য দুপুরের খাবার এছাড়াও ইংলিশ ্যাক্স, ক্রিমরোল, স্যান্ডউইচ, রুটি- মাখন আর অরেঞ্জ স্কয়াস। ৬০ দশকে রমনা ভবনের কাছে ছিল সলিমাবাদ রেস্টুরেন্ট’। সাধারণ আয়ের লোকদের ভিড় থাকত এখানে। ৬ আনায় একজন ভাত দরকারী ও ডাল পেটপুরে খেতে পারতেন। গুলিস্তান হল ভবনে ‘চু চিন চৌ চাইনিজ রেস্টুরেন্ট’ যা ক্যাফে চায়নার মালিকরা খুলেন। ভবনের পশ্চিম পাশে বিখ্যাত পূর্ণিমা সেনগুপ্তের মালিকানায় ‘গুলিস্তান রেস্টুরেন্ট অ্যান্ড বার’ আর চলচ্চিত্র পরিচালক এহতেশাম ও মোস্তাফিজ যুগলের ‘সুইট হ্যাভেন’ রেস্তোরাঁ ছিল বিত্তশালীদের আড্ডাস্থল। গুলিস্তান সিনেমা হলের পেছনে ছিল বেশির ভাগ বহিরাগত ভারতীয়দের ছোট ছোট দোকান ঘরগুলো। কম দামে গুর্দা খিরি কাবাব, রুটি, চটপটি, ফুচকাসহ নানা পদের খাবার বিক্রি করতেন যার মূল ছিল বেশির ভাগ ১ টাকার নিচে।

ঢাকার মোগলাই পরোটা খেতে চাইলে প্রথম নামটি চলে আসত নবাবপুরের ‘ক্যাপিটাল রেস্তোরাঁ’। মোগলাই ঘারানার খাবারের জন্য শহরের লোকদের স্মৃতি যা আজও অমলিন। ফরাশগঞ্জের এসকে দাশ অ্যান্ড বাদার্সের মালিকানায় ক্যাপিটাল রেস্তোরাঁ পরিচালনা হত। ১৯৬৫ সালে এর মালিক ব্যবসা বন্ধ করে কলকাতায় চলে যান। জনসন রোডের আরেক ‘হোটেল দিল্লি মুসলিম’। একজন দিল্লির অদিবাসী যা শুরু করেন। সব ধরনের খাবারের ব্যবস্থা ছিল বিশেষত কোর্টের কর্মকর্তা, ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের খাবারের স্থান ছিল এই হোটেলটি। ওয়াইজঘাটের স্টার সিনেমা হলের বিপরীতে ‘সাভার বোর্ডিং’ কবি, সাহিত্যিকদের আড্ডা আর বাকল্যান্ড বাধ ওয়াইজঘাটের ধারে শংকর বোর্ডিং’ বিকেলের নাস্তায় ফিশ কাটলেট সাথে ন্যাপকিনে মোড়ানো কাঁটা চামচ আর শান্ত বুড়িগঙ্গা নদীর নৌকা, স্টিমারের দৃশ্য উপভোগের জন্য ছিল উত্তম জায়গা। ইসলামপুর রোডে আহসান মঞ্জিলের গেটের বিপরীতে দুটি বিখ্যাত মিষ্টির দোকান ‘সিতারাম মিষ্টান্ন ভাণ্ডার’ আর ‘কালাচাঁদ গন্ধবনিক’ এ ব্যবসায় ছিল তাদের একচ্ছত্র আধিপত্য। চকবাজারে আলাউদ্দিন হালুয়াই এর পুরি, হালুয়া, জিলাপী, শাকারপাড়া জন্য সকাল সকাল বেশ ভিড় হত। চকবাজারের ‘পাকিস্তান হোটেল’ সকালের নাস্তায় নানরুটি নেহারি, পুরি ভাজি, দই বুন্দিয়া, কালা জামন ৫০ দশকের শুরু যার মূল্য ছিল আট আনা থেকে এক টাকায় মধ্য দুপুরে ও রাতে উন্নতমানের চালের ভাত, সাদা বিরিয়ানি, তেহারি, খিচুড়িসহ ইলিশ মাছের কারি সাথে খাশি বা মুরগির রোস্ট ভোজনবিলাসীদের স্বাদ তৃপ্ত করত। রায়সাহেব বাজারের ‘ইসলামিয়া রেস্টুরেন্ট’ সকালের নাস্তার জন্য বিখ্যাত ছিল। খোশকা পোলাও যা সাদা পোলাও নামেই সবাই চিনত খেতে হলে রথখোলার কাছে মালিটোলা গলির মুখে ছিল ‘খোশমহল রেস্তোরাঁ’। ঢাকার কাবুলিওয়ালাদের আড্ডা ছিল ‘সেন্ট্রাল রেস্টুরেন্ট’। এছাড়াও মিরানভা বার মুকুল সিনেমা হলের সাথে (যা এখন আজাদ সিনেমা হল) নবাবপুরের ‘ডিকেন হোটেল’ ঐ সময়কার ঢাকার নামকরা এবং লোকপ্রিয়তা ছিল সবচেয়ে বেশি। ১৯৭১ পরবর্তী রাজধানী ঢাকার গুরুত্ব বেড়ে যাওয়ায় গড়ে উঠতে থাকে নতুন নতুন খাবার দোকান যা আজ শিল্পে রূপ লাভ করেছে। খাদ্য রসিক ঢাকাবাসীরা ঘুরে ঘুরে এই সব দোকানের খাবার খেয়ে রসনা তৃপ্ত হন। হোটেল বা খাবার দোকানগুলো নির্বাচনে তাদের ব্যবসায়ীক দীর্ঘ সময় উপস্থিতি খাদ্য মান, বিশেষ খাবারের জনপ্রিয়তা এবং সেবা দানের সততার গুণাবলির দিকে খেয়াল রেখে নির্বাচন করা হয়েছে। কেননা ঢাকার খাবারের ইতিহাসে অনেক হোটেল রেস্তোরাঁ বা বিশেষ জনপ্রিয় খাবারের দোকানগুলো চাকচিক্য ও মান সম্পন্নভাবে ব্যবসা শুরু করলেও অদক্ষতা, অতিমুনাফা অর্জন এবং তাদের খাবারের জনপ্রিয়তার মান ধরে রাখতে পারেননি ফলে তাদেরকে বিদায় নিতে হয়েছে এই ব্যবসা বা শিল্প থেকে। আবার অনেক আদি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সুনাম থাকা সত্ত্বেও এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মের এই খাবার ব্যবসায়ের যুক্ত হবার অনিহা বা আগ্রহ ও বর্তমান বাজার ব্যবস্থার সাথে তাল মিলিয়ে চলার অক্ষমতার কারণে ঢাকার ঐতিহ্য হয়ে যাওয়া এই খাবারের দোকানগুলো এক প্রজন্মেই বন্ধ হয়ে গেছে। তারপরও নতুন নতুন দোকান রেস্তে ারাঁ গড়ে উঠছে ঢাকার ঐতিহ্যবাহী খাবারকে পুঁজি করে। কেই বা টিকে থাকছে কেউ বা অল্প দিনেই হারিয়ে যাচ্ছেন নানাবিধ কারণে।

পাগলার গেলাসি

গ্লাসি, ঢাকাই লোকেরা বলে গেলাসি। ঢাকাবাসীর একসময়ের জনপ্রিয় খাবার। গ্লাসির ঢাকায় আগমনের সঠিক তথ্য জানা যায়নি। ব্রিটিশ আমলেই সুস্বাদু গ্লাসির নাম ও স্বাদ পায় ঢাকাবাসী। ঢাকার জিন্দাবাহার এলাকায় লায়ন সিনেমার পাশে বেড়ার ঘরে ছিল পাগলার গেলাসির দোকান। সাঈদ আহমদ তার স্মৃতি কথায় বলেছেন, “পাগলার বাবা ছিল ইংরেজ থমসন সাহেবের কুক (বাবুর্চি)। ওরা বংশ পরম্পরায় রান্নার কাজ করত। একসময় থমসন সাহেব বিলেত চলে গেলে পাগলার বাবার চাকরি চলে যায়। ক্ষেতি খোলার কাজ কিছু দিন করা হলেও পাগলার মন সায় দিত না তাই বাবার অনুপ্রেরণায় রান্নায় চলত পরীক্ষা-নিরীক্ষা। সাথে শিখেন গ্লাসি তৈরি। বাবার মৃত্যুর পর পাগল জীবিকার অন্বেষণে খুপচি ঘরেই খুলে বসল গ্লাসির দোকান। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে দোকানে খাদ্য রসিকদের ভিড় এবং রাত যত গভীর হয় কিছু লোক সোম রসে সিক্ত হয়ে পাগলার গেলাসি খেতে আসত। চকবাজার থেকে লক্ষ্মীবাজার পাগলার সুখ্যাতি চার হাতের কারিগরি দেখতে লোক আসতো। মেজাজি হলেও পাগল ছিল না পাগলা। জায়গার মালিক তার গ্যারেজ সম্প্রসারণে জন্য নোটিশ দিলেন সরে যাওয়ার জন্য। পাগলা অন্যত্র দোকান করল কিন্তু সেখানো আর জমল না। লায়ন সিনেমার গলিতে তার দেখা মেলেনি। হারিয়ে গেল পাগলার গেলাসি”

ঢাকায় বাড়িতে আসত এই গেলাসি। মহিলারা অনেকেই খেতো না, ধারণা করতেন এতে আফিম মেশানো হতো। রগরগে মসলায় মাখা দেড় ইঞ্চি মোটা চাকচাক মাংস কাচের মতো চকচক করত। মুখে দিলে গলে যেত। গ্লাসি তৈরির মূল উপকরণ মাখন এবং ঘি মাংস মিশ্রণ। সারারাত আঙুর রস বা আদা সিরকা, ভিনেগার (ইংরেজরা রেডওয়াইন ব্যবহার করত) ভেড়া বা খাসির মাংস সের এ ৮ টুকরো ভিজিয়ে মাংস প্রস্তুত করা হতো। মসলা বলতে আস্ত পিঁয়াজ, গোল মরিচ, আর সঠিক পরিমাণ মাখন ও ঘি’র ব্যবহার। যা তৈরিতে বিশেষ নৈপুণ্য ও দক্ষতার প্রয়োজন ছিল।

ঢাকার ইংরেজরা গ্লাসি রুটির সাথেই ধোত পছন্দ করত। কিন্তু ঢাকার লোকজন পোলাও ছাড়া অন্য কিছুর সাথেই গ্লাসি খেতেন না। আর সুস্বাদু গ্লাসির কারিগর এখন ঢাকায় নেই। গেলাসির স্বাদ আদি ঢাকাই লোকজন ভুলতে বসেছে। তারপরও ঢাকায় এখন গ্লাসির মানের বিকল্প প্রায় খাবার কিছু হোটেল রেস্তোরাঁয় ঐতিহ্য হিসেবে পরিবেশন করা হয়। মূল স্বাদ পার্থক্য ও অর্থ বিবেচনায় ঢাকাবাসী সেই গ্লাসি খেয়েই ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রেখেছেন।

ঢাকার ডালপুরি

ঢাকাবাসীর সকাল বিকাল নাস্তায় ডালপুরি অতি জনপ্রিয় ও পছন্দনীয় একটি খাবার। যা চা বা সবজির সাথে বেশ উপভোগের সাথে সবাই থেয়ে থাকেন। ঢাকার তৈরি পুরিগুলোর মধ্যে ডালপুরি, আলু পুরি, কিমাপুরি, ডিমপুরি, মাছের পুরির প্রচলন থাকলেও ডাল ও আলুপুরির জনপ্রিয়তা বেশি। আকারে গোল ও ডুবো তেলে পুরি ভাজা হয়। ময়দা, তেল ময়ান যোগে বিভিন্ন উপকরণ মিশিয়ে তৈরি হয় ঢাকার ঐতিহ্যবাহী পুরি। ঢাকার প্রায় সব মহল্লার হোটেল রেস্তোরাঁগুলোতে নিয়মিত সকাল-বিকাল পুরি তৈরি করা হয়ে থাকে। ৫০ দশকে বিভিন্ন মহল্লার বাড়ি বাড়ি ফেরি করে মহিলারা পিঠার সাথে পুরিও বিক্রি করত। রাস্তার ধারে বিশেষত বিনোদন প্রতিষ্ঠান, বিদ্যালয়, সিনেমাহল, থিয়েটার, বাজার, শহরের জন গুরুত্বপূর্ণ রাস্তায় পুরির দোকান বসত। নাস্তা হিসেবে বহুল প্রচলিত যাকে ইটার উপর বসে খাবার কারণে তাকে ইটালিয়ান হোটেল নামে লোকজন রসিকতায় ডাকত। জানা যায় ৫০ দশকে ৪আনায় পুরির সাথে মাংসের ঝোলে এক জনের ভরপেট উদরপূর্তি সম্ভব ছিল।

ঘুগনি

ঘুগনি যা মটর ডালের তৈরি ফেরি করে বিক্রি করা একধরনের মুখরোচক খাবার। মটর সিদ্ধ করে নরম ও মন্ড প্রকৃতির ন্যায় তৈরি করা হয় ঘুগনি। মটর সিদ্ধের সাথে ব্যবহার হয় লবণ ও খাবার সোডা। ঢাকায় ঘরে তৈরি হলেও শহর ও সস্তা খাবার হিসেবে ফেরি করে বিক্রির প্রচলন স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বেশি দেখা যায়। ঢাকায় রমজান উপলক্ষে বাড়িতে বাড়িতে মুড়ি ভর্তা তৈরির জন্য একটি বিশেষ খাদ্য উপাদান ঘুগনি। ঢাকার বিভিন্ন প্রান্তে মেলা, খেলার মাঠ, লোক সমাবেশের অনুষ্ঠান ফেরি করে ঘুগনি বিক্রি রেওয়াজ আজও ঢাকায় দেখা যায়। ঘুগনির ব্যবহার বিভিন্ন চাট মশলার সাথে কেউ কেউ শশা, ডিম ও পুরির ব্যবহার করে বিক্রি করে থাকেন।

চটপটি ও ফুচকা

ঢাকার মুখরোচক ও জনপ্রিয় খাবার। বৈকালিক নাস্তাজাতীয় চটপটির একমাত্র উৎস বাংলাদেশ। ৬০ দশকে ঢাকার চার চাকার ভ্যান গাড়িতে অধিকাংশ ক্ষেত্রে রাস্তার পাশে, পার্কে, স্কুল, খেলার মাঠ কলেজের প্রবেশদ্বার বা অনুরূপ জনসমাগম স্থলে অস্থায়ী দোকানে চটপটি বিক্রি হয়ে আসছে। কাবুলি, মটরডাল সিদ্ধ, আলু কুচি, পেঁয়াজ, মরিচ, ডিম, ধনেপাতা, পুদিনা বিভিন্ন মসলার সংমিশ্রণে তৈরি হয় চটপটি। সাথে তেঁতুল বা লেবুর টকপানি। ঢাকার মটরডালের ঘুগনির বিক্রেতাদের কথা জানা গেলেও চটপটি তৈরির ইতিহাস জানা যায় না। তবে ধারণা করা হয় ঘুগনি বিক্রেতাদের হাত ধরেই চটপটির সৃষ্টি হয়েছে। ঝটপট বা তাড়াতাড়ি তৈরি করা যায় এজন্যই এরূপ নামকরণ। চটপটির সাথে আরেকটি খাবার বিক্রি হয় নাম ফুচকা। ঢাকাসহ উপমহাদেশের বহুল প্রচলিত এই ফুসকা। ঢাকায় ফুসকা নাম হলেও ভারতে পশ্চিমবঙ্গসহ অনেক স্থানে এটি পানি পুরি, কেরালায় দই ফুসকা, অন্যান্য অঞ্চলে গোলা গাপ্পা নামে সমাদৃত। তবে ঢাকার ফুচকার আকার পুর হিসেবে উপাদানে পার্থক্য রয়েছে। আটা ও সুজি মিশ্রণে ছোট লেচি থেকে তৈরি হয় পাপড়ি সাদৃশ্য গোল ফুসকা। ফুচকার মাঝে পুর হিসেবে ব্যবহৃত হয় মটর সিদ্ধ ডাল, আলু, ডিম, মসলার সংমিশ্রণ সাথে কাপে তেঁতুল, লেবু বা টক দই-লেবুর পানি। ঢাকার রাস্তার ধারের ফুচকা আজকাল বিভিন্ন দোকান রেস্তোরাঁয় এটা পরিবেশিত হয়। গাড়ির চটপটি ফুচকা মানসম্মতভাবে পাকিস্তান আমল থেকে তৈরি করছেন আরমানিটোলা স্কুলের গেটে জুম্মুন মিয়া। ১৯৮০ সাল থেকে গোপীবাগের জয়নাল মিয়া, হাল আমলের সোহরাওয়ার্দী কলেজের সামনে জসিমের চটপটি বেশ জনপ্রিয়।

ঢাকায় চাইনিজ রেস্তোরাঁর আগমন

১৮ শতকের শেষ দিকে চাইনিজ বণিক ও নাবিকেরা চট্টগ্রাম ও কোলকাতা বন্দরে কাজের অন্বেষণে এসে বাংলায় বসবাস শুরু করে। এই চাইনিজ জনগোষ্ঠী বিভিন্ন এলাকায় সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনে অবদান রাখতে শুরু করে। তবে তাদের একটা অসুবিধা ছিল স্থানীয় ভাষা শেখার অনাগ্রহ এবং নিজ গোত্র ছাড়া মেলামেশায় অনাগ্রহ। ফলে কাজ হিসেবে তাদের সামনে ২টি পথ খোলা ছিল এক, ধোপা বা লণ্ডি ব্যবসা, দুই, খাবার তৈরি করে বিক্রয়। তাদেরই একটা বড় অংশ চাইনিজ খাবারের রেস্তোরাঁ খুলে বাঙালিরা স্বাদ অঙ্কুরে চাহিদা ও প্রভাব বিস্তারে ভূমিকা রাখে।

চাইনিজদের নিজস্ব চাইনিজ খাবারের সাথে আমাদের চাইনিজ খাবারের ভিন্নতা রয়েছে। বর্তমানের বিশ্বের যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য “ইন্ডিয়ান চাইনিজ” নামে এই খাবার কে চিনে থাকে। চাইনিজরা বাংলার খাদ্যরীতি অনুধাবন ও পর্যবেক্ষণ করে তাদের মূল চাইনিজ খাবারের সাথে মসলা ও বিভিন্ন খাদ্য উপাদান যা এখানে পাওয়া তার সংমিশ্রণ ঘটিয়ে তৈরি করেন চাইনিজ খাবার। তাই বাঙালির স্বাদ ও রসনা বর্ধনে এই চাইনিজ জনপ্রিয় হতে বেশি সময় লাগে নাই।

চাইনিজরা খাদ্যে মূলত ঝাল তেমন খায় না, তেলের ব্যবহার কম, পরিবর্তে সস ব্যবহার করে বেশি। বাংলার চাইনিজে মিশ্রিত ক্যান্টন সস, মরিচ চিরে দেয়া, হটসস আর সবচেয়ে মূল জিনিস টেস্টিং সল্ট, (মনোসোডিয়াম গুটামেন্ট) তারা তৈরি করে ভিন্নস্বাদের আদর্শ ডিস, যেমন- সুইট কর্ন স্যুপ, চিলি চিকেন এবং মানচুরিয়ান ধারার নিজস্ব নামের ডিস ক্রেতা আকর্ষণে পরিবেশন করে। নুডুলস যাকে আমরা সেমাই নামে চিনি এর ভিন্নতর ব্যবহার বাঙালির রসনায় প্রথম চাইনিজদের হাতে ধরেই ঘটে।

ঢাকায় চাইনিজ খাবারের প্রচলন ২০ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ১৯৪৪-৪৫ সালের দিকে। জানা যায় ঢাকার চায়নাপট্টি (মিডফোর্ড এলাকা) মি. মিং নামে একজন ঢাকার সেগুনবাগিচা রোডে “ক্যাফে চায়না” নামে প্রথম চাইনিজ রেস্তোরাঁ চালু করেন। ঢাকার আদি লোকজন চাইনিজ খাবারের সাথে পরিচয়ে “ক্যাফে চায়না” নাম স্মরণ করেন। ঢাকার চাইনিজ খাবারে জনপ্রিয়তা খুব অল্প সময়ে এখানে ঢাকায় আরও নতুন নতুন চাইনিজ রেস্তোরাঁর আবির্ভাব ঘটে। তার মধ্যে ৬০-৬৫ দিকে বিজয় নগরে “চাং ওয়া”, গুলিস্তানে চু-চিন চাউ, মধুমিতা সিনেমা হলের উপরে টাই টুং সেই সময়ের ঢাকার বিখ্যাত চাইনিজ রেস্তোরাঁ। পরবর্তীতে মালয়েশিয়ান দম্পতির গুলশানে ক্যাথে, মগবাজারের টাই কিং ও ক্যান্টন রেস্তে ারার গোড়াপত্তন হয়।

দীর্ঘ সময় আগে ঢাকার চাইনিজ ব্যবসায়ীর ঢাকা ত্যাগ করলেও বাঙালি মালিকেরা ঢাকার চাইনিজ খাবারে জনপ্রিয়তা ও পরিবেশনের মান ও নিয়মনীতি ঠিকই ধরে রেখেছেন। দেশ ছেড়ে বিদেশেও বাঙালি ইমিগ্রেন্ট (অভিবাসী) সুনামের সাথে এই চাইনিজ খাবারের ব্যবসা করছেন। বছর পাঁচ ধরে ঢাকার চাইনিজের নতুন খাদ্য সংযোজন করছে। তার মধ্যে তিব্বতীয় রন্ধনশালা থেকে যোগ হয়েছে নতুন THAKPA (থাকপা) মমসহ আরও কিছু খাবার। চাইনিজ রন্ধনশিল্পীদের বড়গুণ ছিল তারা কর্মঠ। খাবার তৈরিতে একনিষ্ঠা তাদের চেহারার চাইনিজভাব মানুষকে ভিন্ন কিছু আস্বাদনে আকৃষ্ট করত।

একবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে চাইনিজ খাবারের পাশাপাশি ঢাকার রেস্তোরাঁয় খাবারের বিশ্বজনীয়তা প্রভাব দেখা যায়। ঢাকার মানুষের খাবারে স্বাদ গ্রহণে যোগ হচ্ছে ইটালিয়ান, মেক্সিকো, জাপানিস, আরবীয়, ভারতীয় খাবারের সংযোজন। এর সাথে ফাস্ট ফুড খাবার সাংস্কৃতি ভোজন রসিক ঢাকাবাসী তাদের খাদ্রগ্রহণ ও খাদ্য বিচারে এক নতুনত্বের দিক নির্দেশ দান করছে।

ঢাকার হোটেল ও বোর্ডিং

আরবি ফারসি সাহিত্যে কাটারা শব্দের বিশেষ ব্যবহার রয়েছে। কাতরা বা কাতারা থেকে কাটারা শব্দটির অর্থ খিলান সারি বিশিষ্ট স্থাপনা। কাটারা বলতে সাধারণত ক্যারাভান সরাই (কারওয়ান সরাই) অর্থাৎ সরাইখানাকে বুঝিয়ে থাকে। পথের ধারে ও ব্যবসায়ীদের জন্য নির্মিত হতো এই সরাইখানা। সরাইখানা সাধারণত একটি অঙ্গনকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে। অঙ্গনের চারদিকে নির্মিত হয় বারান্দা এবং এর পরেই কক্ষগুলো। এই কক্ষসমূহে পথচারী ও ব্যবসায়ীরা রাত যাপন করেন। আর তাদের যানবাহনের পশু যেমন ঘোড়া, উট ইত্যাদি এবং শকট ও ভ্রমণের অন্যান্য সরঞ্জামাদি রাখা হয় এই প্রাঙ্গণে। পৃথিবীর দেশে দেশে বাণিজ্য পথের পাশেই কয়েক মাইল পর পর কাটারা বা সরাই খানা নির্মিত হতো শাসকদের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে। আজকাল যেমন সাধারণ ব্যবসায়ী বা ভ্রমণকারীরা অনুমোদন নিয়ে হোটেলে অবস্থান

অবস্থান করেন তখনো ছিল তেমনি। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য প্রসারের ফলে এক সময়ে বাণিজ্যের সুবিধার্থে ঢাকাতেও মোগলরা নির্মাণ করেন বড় কাটারা ও ছোট কাটারা। ধারণা করা হয়, বড় কাটারা বা ছোট কাটারা ঢাকার প্রথম সরাইখানা বা হোটেল।

বুড়িগঙ্গার নদীর ধারে চকবাজারের দক্ষিণে বড় কাটারা অবস্থিত। দক্ষিণ দিকের বড় কাটারার প্রধান প্রবেশ পথে অবস্থিত শিলালিপি থেকে জানা যায় ১৬৪৪ সালে মোগল সুবেদার শাহ সুজার “মীর ই ইমরাত” বা প্রধান স্থপতি দি ওয়ান মীর মোঃ আবুল কাসেম এটি নির্মাণ করেন। দুর্গ সাদৃশ্য জাঁকালো বড় কাটারা নির্মাণে পারস্যিক কেরাভান সরাই অর্থাৎ সরাইখানার প্রভাব স্পষ্টভাবেই প্রতিফলিত হয়েছে। দেওয়াল বেষ্টিত উন্মুক্ত প্রাঙ্গণের চারিদিকে ২২টি কক্ষ সম্বলিত বড় কাটারার ভূমি নকশা ও গঠন সম্রাট আকবরের ফাতেহপুর সিকরির সরাইখানার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। বাংলাদেশের মোগল পূর্ব সুলতানি স্থাপত্যে যা একে বারেই পরিলক্ষিত হয় না। সুউচ্চ ইউয়ান সম্বলিত তোরণের আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য পারস্যিক স্থাপত্য থেকে উত্তর ভারতে মোগল রাজকীয় স্থাপত্যে বিকশিত হয়। বড় কাটারার দ্বিতীয় শিলালিপিতে ব্যবসায়ী ভ্রমণের উদ্দেশ্যে পরিব্রাজক মোসাফিরদের নিরাপদে থাকার ব্যবস্থা করার জন্য এটি নির্মাণ করা হয়। এ তথ্যের সমর্থন পাওয়া যায়।

বড় কাটারা থেকে ১৮০ মিটার বর্তমান হাকিম হাবিবুর রহমান লেন এ আরেকটি কাটারা শায়েস্তাখান ১৬৬৩-৬৪ সালে নির্মাণ করেন। বড় কাটারার অনুকরণে অপেক্ষাকৃত ছোট আকারে নির্মাণ করেন ছোট কাটারা। এটি ছিল তার নির্মিত প্রাসাদ ও স্থাপত্য নিদর্শনের অন্যতম অংশ। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বড় কাটারা দুটো আদি অব্যয় জীর্ণ থেকে অবলুপ্তির পথে। এছাড়াও সেই সময়ে অন্যান্য কাটারা বা সরাইখানাগুলো হলো মকিম কাটারা, মায়া কাটরা, নওয়াব কাটরাসহ আরও কাটারার অবস্থান ঢাকায় ছিল।

ঢাকা থেকে কাটারা বা সরাইখানা বিদায় নিয়েছে। তার জায়গায় দখন করেছে অতিথিশালা, যাত্রী নিবাস, বোর্ডিং, হোটেল এইগুলো। সেই সময়ে সরাইখানায় থাকা ও খাওয়া চলত সমান তালে। এখন সবাই সেই দায়িত্ব ভাগ হয়ে থাকার জন্য আবাসিক হোটেল আর খাবার জন্য রয়েছে রেস্টুরেন্ট বা রেস্তোরাঁ। ঐতিহ্যগতভাবে এদেশের মানুষ তাদের অতিথিকে নিজ বাড়িতে রাখেন এবং তাদের খাবার দাবারের ব্যবস্থা করে থাকেন। অতিথি বা আত্মীয় স্বজনদের হোটেলে রাখা বা তাদের রেস্তোরাঁয় আপ্যায়ন করার প্রস্তাব নিন্দনীয় বিষয় বলে গণ্য হতো। ব্রিটিশ আমলে ঢাকায় সরকারি কর্মচারী ও তাদের অতিথিকে থাকার জন্য ডাক বাংলো, সার্কিট হাউজ, রেস্ট হাউজ তৈরি হতে থাকে। রাত্রি যাপন ও আহারের ব্যবস্থাও থাকত এখানে। ২০ শতকের ৫০ ও ৬০ দশক থেকে ঢাকার সদরঘাট, ইসলামপুর, বাংলাবাজার, জনসন রোড, পাকিস্তান আমলে নবাবপুর, মতিঝিল, শাহাবাগ এলাকা ঘিরে গড়ে উঠতে থাকে ব্যক্তি উদ্যোগ ও বিভিন্ন পৃষ্ঠপোষকতায় ঢাকার হোটেল, রেস্টুরেন্ট, বোর্ডিং নামের প্রতিষ্ঠানগুলো।

ওকে হোটেল

ঢাকার প্রথম হোটেল ও রেস্টুরেন্ট। ব্রিটিশ আমলে ঢাকায় আগত ইংরেজ ও বিদেশি পর্যটকরা ঢাকায় বাণিজ্য প্রশাসনিক কাজে আসলে তারা সরকারি বাংলো বা অতিথিশালায় অবস্থান করতেন। ঢাকায় কোনো হোটেল ছিল না। আনুমানিক ১৯৪৩-৪৪ সালের দিকে ঢাকার জনসন রোডে মুকুল সিনেমার পাশে ওকে হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট এর আবির্ভাব ঘটে। বিদেশি অতিথি ও পর্যটকদের অস্থায়ী আবাস্থল হিসেবে ওকে হোটেলের নাম ছিল। তাদের রেস্টুরেন্টে ব্রিটিশ খাবারের পাশাপাশি পাউরুটি, মাখন, অমলেট ঢাকার খাবারে নতুন দিক নির্দেশনা দান করেছিল। দুপুরে খাবার পর হলুদ মিশ্রিত এক বিশেষ স্যুপ তারা খেতেন যাকে আদর করে নাম দিয়েছিলেন “মুন্নি কি-তানি”। ঢাকার লোকেরাও সকাল বেলা এই হোটেলে মাখন রুটির জন্য আসতেন।

পাকিস্তান আমলে নামবদলে হয় ‘মাইরেন্ডার’। তখন আংলো ইন্ডিয়ান মিসেস ডলি এই অভিজাত রেস্টুরেন্ট ও হোটেলটির পরিচালনা করতেন। ফ্রিজ নামক জিনিসটি সেই সময় ছিল দুর্লভ; তাদের ঐখানে সেটিও ছিল। খাদ্য পরিবেশকরা অনেকটা আর্দালি মতো পোশাক তাদের মাথায় পাগড়ি পড়ান শেওয়ানী আর কোমরে লালবেল্ট থাকত। হোটেলটি স্বাধীনতার আগেই বন্ধ হয়ে যায়।

বিউটি বোর্ডিং

বাংলাবাজারের শ্রী শী শ দাস লেনের এই পুরনো বাড়িটি ১৯৪৭ এর দেশ ভাগের আগে সেখানে ছিল সোনার বাংলা পত্রিকার অফিস। এ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল কবি শামসুর রাহমানে প্রথম কবিতা। দেশ ভাগের পর পত্রিকার অফিসটি কলকাতায় চলে গেলে ৫০ এর দশকে প্রহদ চন্দ্র সাহা ও তার বড় ভাই নলিনী মোহন সাহা এই বাড়িটি ভাড়া নিয়ে গড়ে তোলেন বিউটি বোর্ডিং। বাংলাবাজার প্রকাশনা পাড়া বলে এখানে আড্ডা জমাতেন দেশ বরেণ্য কবি শিল্পী ও সংস্কৃতি কর্মীরা। খাওয়া দাওয়া থেকে আড্ডাই সবার কাছে ছিল বেশ আকর্ষণীয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তান আর্মিদের হাতে নিহত হন প্রহদ চন্দ্র সাহাসহ ১৭জন। জীবন বাঁচাতে ভারতে চলে গেলেও দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২ এ প্রহদ চন্দ্রের স্ত্রী প্রতিভা সাহা তার দুই ছেলে সমর ও তারককে নিয়ে আবার চালু করেন বিউটি বোর্ডিং। আগের মতো মুখর আড্ডা না জমলেও ভোজন রসিকরা ঠিকই এখানে ছুটে আসেন। বড় স্টিলের থালায় সাদা ভাত আর মাছের সমারোহ। বিখ্যাত সরষে ইলিশ। পেঁয়াজ, রসুনের ব্যবহার নেই। ইলিশ ছাড়াও সারা বছর মাছ ডাল সবজি রান্না হয়। স্বাদ গ্রহণে আসেন দেশি-বিদেশিসহ অনেকেই নস্টালজিয়ার বিউটি বোর্ডিং-এ।

কল্পনা বোর্ডিং

১৯৬৫ সালে শাঁখারিবাজারের বিন্দাবন নাগ ভাইয়েরা চালু করেন বাড়ির উপরে থাকার বোর্ডিং আর নিচতলায় ছোট একটা কক্ষে রেস্তোরাঁ। হিন্দু সনাতন পদ্ধতিতে রান্না হয় সব দেশি খাবার। ঐতিহ্য নিয়ে টিকে থাকা এখানে রান্না হতো টক ঝাল কই মাছ, রুই, কাতলা, বোয়াল মাছের ঝোল, নানারকম সবজি ও ভাজি। তবে তাদের বিখ্যাত রান্না ছিল চিতল মাছের পেটি, চিতলের শুধু পেটি রান্না হলেও তার পিঠের অংশ দিয়ে তৈরি করত কোফতা। পারিবারিকভাবে চালিয়ে যাওয়া ব্যবসা তারা রান্নাকে সাধনা ও প্রার্থনার অংশই মনে করত। জানা যায়, এখানে আসতেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, কোলকাতার প্রিয় দাশ মুন্সীসহ বিখ্যাত ব্যক্তিরা।

শাহাবাগ হোটেল

ঢাকার প্রথম তিন তারকা মানের হোটেল। হোটেলটির স্থপতি ছিলেন ইংরেজ এডওয়ার্ড হাইক্স ও নকশায় ছিলেন ডোনাল্ড ম্যাককেলেন। বর্তমান ঢাকার শাহবাগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে রাস্তার পাশে যেখানে পূবালী ব্যাংকের শাখাটি আছে তার পেছনের ভবনটি ছিল শাহাবাগ হোটেল। আর পূবালী ব্যাংকের বিল্ডিংটা ছিল মুসলিম লীগের কার্যালয়। এই হোটেলটি প্রতিষ্ঠার পেছনে আছে এক ইতিহাস। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের ফলে ঢাকা পূর্ব বাংলার নতুন প্রাদেশিক রাজধানী হয়। ১৯ শতকে ঢাকার নবাব পরিবার শাহবাগের জমিদারি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি থেকে কিনে নেন। এই এলাকায় তৈরি করেন বেশ কিছু দালান কোঠা ও বাগান। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ইসরাত মঞ্জিল যা মূলত বাইজীদের নাচঘর হিসেবে ব্যবহৃত হতো। নবাব সলিমুল্লাহ ১৯০৬ সালের ১৪ ও ১৫ই এপ্রিল এই ভবনটি নিখিল ভারত মুসলিম শিক্ষা সম্মেলনের স্থান হিসেবে নির্বাচন করেন। পরে ৩০ শে ডিসেম্বর এই ভবনেই অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে এটিকে সংস্করণ করে হোটেলে রূপান্তরিত করা হয়। ঢাকায় আগত উচ্চ পদস্থ ব্রিটিশ প্রতিনিধি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের এটাই ছিল একমাত্র সাময়িক আবাসস্থল। ইংলিশ খাবারের পাশাপাশি ছিল ঢাকার ঐতিহ্যবাহী খাবার ও বেকারি যার রুটি ও পেটিস এর ক্রেতা ছিল শহরের অভিজাত ও উচ্চ পদস্থ সরকারি কর্মকর্তারা। এখানে করা যেত পরিবারসহ নৈশভোজ আর ছিল নবাবি আবহ। ১৯৬৫ সালে ভবনটি ইন্সটিটিউট অব পোস্ট গ্রাজুয়েট মেডিসিন অ্যান্ড রিসার্চ যা পিজি হাসপাতাল নামে পরিচিত ছিল— অধিগ্রহণ করে পাকিস্তান সরকার। ১৯৯৮ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় নামে এই ভবনটি আবার অধিগৃহীত হয়ে বর্তমানে পরিচালিত হচ্ছে।

ইন্টার কন্টিনেন্টাল হোটেল

দেশের প্রথম বিলাসবহুল পাঁচতারা হোটেল, ১৯৬৬ সালে ব্রিটিশ স্থপতি উইলিয়াম বি ট্যাবলারের নকশায় এই হোটেলটি রমনায় স্থাপিত হয়। হোটেলটি ইন্টার কন্টিনেন্টাল নাম হলেও সবাই ইন্টারকন নামেই ডাকত। ঢাকায় আগত বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ব্যক্তিদের ঢাকার আবাসস্থল ছিল। ১৯৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধে রেডক্রস ঘোষিত একমাত্র নিরাপদ অঞ্চল ঘোষণা করা হয়। স্বাধীনতা সময়ে গুরুত্বপূর্ণ সমঝোতা ও স্মারক তৈরি, আশ্রয় ও সভার জন্য একমাত্র সাক্ষী এই হোটেলটি। ইয়োরোপীয় ধাঁচের খাবার ও বিদেশি সেফ বা রাধুনির রান্নার সাথে সাহেবি কোট টাইয়ে ক্রেতা দুরস্থ পরিবেশন রীতি ঢাকাবাসী প্রথম অবলোকন করে। হোটেলের ভিতর ক্যাফে আরাম নামে রেস্টুরেন্ট খাবার জন্য ২৪ ঘণ্টাই খোলা থাকত। চ্যাম্বেলি রুম যেটা খোলা থাকত শুধু দুপুরের খাবারের সময়। আর সন্ধ্যার পর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত নৈশ ভোজ ও ডান্সের জন্য। সেখানে বিদেশি ব্যান্ড শিল্পীরা গিটার, ড্রাম ও কিবোর্ডে বাজাতেন সর্বাধুনিক বিদেশি মিউজিক। সাথে গাইত পপ শিল্পীরা। সাকিরার যেখানে দুপুরও সীমিত ও বিকাল থেকে মাঝ রাত পর্যন্ত পরিবেশন করা হতো এলকোহলিক পানীয়। পুল সাইড রেস্টুরেন্ট পার্টি ও সাঁতারুদের জন্য সকাল থেকে রাত পর্যন্ত পরিবেশন করা হতো খাবার ও কোমল পানীয়। অফিসার ও সাধারণ কর্মচারীদের জন্য ছিল আলাদা আলাদা ক্যাফেটেরিয়ার। ঢাকায় আগত বিদেশি, স্থানীয় উচ্চবিত্ত ও অভিজাত পরিবারগুলোই ছিল এই হোটেলের ক্রেতা। স্বাধীনতার পরেই রেস্তে ারাঁগুলোর নাম পরিবর্তন হয়ে যায়। হোটেলটি ১৯৮৪ সালে শেরাটন নামে যাত্রা শুরু করে, পরে ২০১১তে রূপসী বাংলা এখন ২০১৭তে নতুন সংস্করনের মাধ্যমে মূল নকশায় ফিরে আসছে হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টাল।

হোটেল পূর্বাণী

১৯৬৮ সালে মতিঝিল দিলকুশা বাণিজ্যিক এলাকায় গড়ে ওঠে তিন তারকা বিশিষ্ট পূর্বাণী হোটেলটি। ঢাকার ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ ও বিদেশি মেহমানদের আবাসিক, সভা-সেমিনার এবং ঢাকার বিশিষ্ট খাবারের অন্যতম কেন্দ্র। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে ঘটনা প্রবাহের এই হোটেলটি গুরুত্বপূর্ণ স্বাক্ষী ১৯৭০ এর নির্বাচনে বিজয়ীদের নিয়ে আওয়ামী লীগের সংসদীয় সভা এখানেই বসে। ১লা মার্চ এই হোটেল ঘিরেই জনতার বিক্ষোভে পরবর্তী কর্মসূচির ভাষণ দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১০তলা এই ভবনে ২০১০ সাল পর্যন্ত তিনবার সংস্কার করা হয়। এই হোটেলে রয়েছে পুরো ভবনের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থাসহ একটি মিনিবার, সেমিনার রুম, কনফারেন্স হল, লন্ড্রী, লকার ব্যাংক, রুম সার্ভিস, ট্রাভেল এজেন্সি, রেস্তোরাঁ, বিজনেস সেন্টার, অতিথিদের রুমে আধুনিক সুযোগ সুবিধা আর খাবার। ঢাকার ঐতিহ্যবাহী খাবার, হালিম, জিলাপী শাহি টুকরা একসময় এই হোটেলে বিশেষ উপলক্ষে পরিবেশন করত এই বিভিন্ন খাবার।

প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁ হোটেল

ঢাকার প্রথম আন্তর্জাতিক মানের পাঁচতারা হোটেল। রাজধানীর ক্রম বিকাশমান চাপ, বিশ্বমানের সুযোগ-সুবিধা, বিদেশি অতিথিদের চাহিদা প্রভৃতি কারণে ১৯৮১ সালে সরকারি মালিকানাধীন এবং জাপানের আর্থিক সহায়তায় ঢাকা এয়ারপোর্ট রোডে কাওরান বাজার মূল সড়কে গড়ে ওঠে দৃষ্টি নন্দন হোটেলটি। প্রাথমিকভাবে হোটেলটি ১১তলা করার পরিকল্পনা থাকলেও সেই সময়ে তেঁজগাও বিমান বন্দর কাছে হওয়ায়। হোটেলটি ৮তলা বিশিষ্ট হাই রাইস ও ৩ তলা বিশিষ্ট লো রাইস ভবন নির্মাণ করা হয়। বাংলার একসময়ে ঐতিহ্যবাহী রাজধানী সোনাওগাঁও এর নামে নামকরণ করা হয় প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেল। এই হোটেলে ৩শো অত্যাধুনিক রুম ও স্যুট, সুপরিসর বলরুম, কয়েকটি সেমিনার রুম ও সভাকক্ষ, বিজনেস সেন্টার, ক্লাবরুম, সুইমিং পুল, ইনডোর, আউটডোর গেমসহ হেলথ্ ক্লাব, নিচতলা ও লো রাইস ভবনে ব্যাংক বিপণী কেন্দ্র বিভিন্ন এয়ারলাইন্স অফিস রয়েছে। আর খাবার জন্য ক্যাফে বাজার, লবি লাউঞ্জ, পুল ক্যাফে, ব্যালকনি বার, ওরিয়েন্টাল গ্রিল, চিয়াও বিসট্রো, এরোমাজ নামে রেস্তোরাঁ ও বার রয়েছে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে ঢাকায় ওআইসি, সার্ক শীর্ষ সম্মেলনসহ বহু আন্তর্জাতিক ও জাতীয় পর্যায়ের সম্মেলনের ভেন্যু হিসেবে হোটেলটি সফলভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। আন্তর্জাাতিক মানের এই হোটেলটি গত ৩০ বছরে প্রশান্ত মহাসাগরীয় এশিয়া অঞ্চলের মধ্যে অন্যতম পর্যটন হোটেল হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। এছাড়াও সামাজিক দায়িত্ববান ২৫টি হোটেলের মধ্যে প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁ হোটেল বিশ্বে অন্যতম বলে বিবেচিত হচ্ছে।

পঞ্চাশ দশকের পোলাওওয়ালা

আজকাল ঢাকা শহরের রাস্তা ঘাট অলি গলিতে বিরিয়ানি ও পোলাওয়ের দোকান দেখা গেলেও একসময়ে কিন্তু হাতে গোনা দু-চারজন পোলাওওয়ালারা ঢাকার দোকান খুলে ব্যবসা করতেন। তারা অনেকেই ছিলেন নবাববাড়ির রসুই খানার উত্তরাধিকার। চকবাজার মসজিদের সামনে, ইসলামপুর, বাবুবাজার, বেগমবাজার এলাকাতে ছাপরা ঘর বা মোড়ের পাশে পোলাও বা বিরিয়ানি দোকান নিয়ে তারা বসতেন। কাঁঠাল পাতার দাওনা বা ঠোঙায় বিক্রি করতেন সুস্বাদু পোলাও। যা আদি লোকদের স্মৃতিতে ধারণ করা বিখ্যাত সব পোলাওওয়ালার নামে পোলাও বা বিরিয়ানি। এদের মধ্যে চকবাজারের আজিজ পোলাওওয়ালা বিক্রি করতেন খাসি ও গরুর তেহারি যা সরিষার তেলে তৈরি হতো। লতিফ পোলাওওয়ালার মোরগ পোলাও, মতি মিঞা, মিশর পোলাওওয়ালা, বাবুবাজারের চুন্নু মিয়ার তেহারি, বেগমবাজারে গোলাপের মোরগ পোলাও আর ইসলামপুরের “সাইনু পালওয়ানের” মোরগ পোলাও ছিল বিখ্যাত। বিশিষ্ট নাট্যকার সাঈদ আহমেদ তার স্মৃতি কথায় বলেন “দোকানটি ইসলামপুরের প্রধান রাস্তা থেকে একটু নিচু তিন সিঁড়ি নামতে হতো। দোকান মালিক “সাইনু পালওয়ান” দেখতে খুব মোটা ছিল। ইয়া বড় ভুঁড়ি আর মোটা মোচ। খাঁটি ঘি দিয়ে রান্না হতো মোরগ পোলাও। সকালে দেড় টাকায় ফুল প্লেট সন্ধায় দুই টাকায় ফুল প্লেট। এমন সুস্বাদু মোরগ পোলাও আজ আর কোনো দোকানেই তৈরি হয় না। খাবারও পর ও রাত অবধি হাতে ঘিয়ের সুগন্ধ লেগে থাকত “ ঐ সময়ের ঢাকার পোলাওওয়ালারা পোলাও ও বিরিয়ানি তৈরিতে প্রয়োজনীয় উপাদান সঠিক মান এবং রন্ধন পদ্ধতির মাধ্যমে অনেক কাল পর্যন্ত তাদের রন্ধন যশ ও সুনাম বজায় রেখে ঢাকার খাবারের ঐতিহ্য ধরে রেখেছিলেন। তখন যারা এই খাবারে ব্যবসার সাথে যুক্ত ছিলেন তারা শুধু ব্যবসার উদ্দেশ্যেই ব্যবসা করতেন না। প্রধান বিষয় ছিল সুনাম ও মানুষকে ভালো জিনিস খাওয়ানো সদিচ্ছা।

শাহ সাহেবের বিরিয়ানি

ঢাকার আব্দুল লতিফ তার বাবুর্চি শ্বশুরের কাছ থেকে এই বিরিয়ানি রান্নার পদ্ধতি শেখেন। চকবাজারের ছাপরা ঘরে এই বিরিয়ানি ব্যবসা তিনি শুরু করেন। যা লতিফ বিরিয়ানি নামে পরিচিত ছিল। ১৯৬৬ সালে তার মৃত্যুর পর তার ছেলে আব্দুল রহমান শাহ সাহেব তার পৈতৃক ব্যবসা চালু রাখেন। যা পরবর্তীতে শাহ সাহেবের বিরিয়ানি নামে লোক মুখে প্রচলিত হয়ে যায়। এই বিরিয়ানির বিশেষত্ব হলো যে, খাসির মাংসের তৈরি এবং সপ্তাহে একদিন মুরগির বিরিয়ানি তৈরি করা হয়। প্রতিদিন দুই ডেকের বেশি বিক্রয়ের জন্য তৈরি হয় না। শুধু সকাল বেলাই এই বিরিয়ানির স্বাদ গ্রহণ করা যায়।

হাজির বিরিয়ানি

১৯৩৯ সালে হাজি গোলাম হোসেন ঢাকার গতানুগতিক বিরিয়ানি থেকে আলাদা বিশেষ পদ্ধতিতে রান্না করে ঢাকাবাসীর ভোজন বিলাসে একটা ব্র্যান্ড তৈরি করেন। যা এক কথায় হাজির বিরিয়ানি নাম একটা ইতিহাসের গল্প। নাজিরা বাজারে হাজির দোকানে এক সময়ে সকালে দুই ডেক বিকালে দুই ডেকের বেশি বিরিয়ানি রান্না হতো না। ক্রেতাকে কাঁঠাল পাতার দাওনায় এখনও বিরিয়ানি দেওয়া হয়। বিরিয়ানির বিশেষত্ব হলো তেল ঘি নয় সম্পূর্ণটাই সরিষার তেলে রান্না এবং মাংস হিসেবে খাসি। জানা যায় নিজ হাতে তদারকির মাধ্যমে নিয়ম ও অনুশাসন মেনে হাজি গোলাম হোসেন এই বিরিয়ানি তৈরি ও পরিবেশন করতেন। সেই সময়ে ফুল প্লেট খাসির তেহারি বারো আনায় বিক্রি করতে শুরু করেন। ঢাকায় বিরিয়ানির জন্য সকাল বিকাল লাইন দিয়ে কেনা একমাত্র হাজির বিরিয়ানির দোকানেই দেখা যেত। ঢাকার অন্যান্য বিরিয়ানির দোকানের নাম ও প্রসারের যুগেও হাজির বিরিয়ানি তার ঐতিহ্য ও অনুশাসন মেনেই ঢাকার নাজিরা বাজারে একটি মাত্র দোকান থেকে ব্যবসা করে আসছেন। তবে দেরিতে হলেও দেশে ও বিদেশে পরবর্তী বংশধররা হাজি নামে দোকানের শাখা বিস্তার করেছেন।

ঝুনুর বিরিয়ানি

১৯৮০ সালের দিকে নূর মোহাম্মদ নারিন্দার মোড়ে একটি বিরিয়ানির দোকান খোলেন। আদরের কন্যা ঝুনুর নামেই দোকানটির নাম রাখেন। মুরগি প্রধান এই বিরিয়ানি ভিন্ন স্বাদ হওয়ার কারণে এলাকায় ঝুনুর পোলাও নামে জনপ্রিয়তা পায়। ১৯৮৮ তে নূর মোহাম্মদ মারা গেলে তার ভাই ইসার উদ্দিন ও পরে তার ছেলে মোঃ স্বপন ও মোঃ শামিম দোকানটি পরিচালনা করছেন। বিকাল বেলায় এই দোকনটি খোলা হয় আর রাত নয়টা অবধি তাদের পোলাও বিক্রি শেষ হয়ে যায়। আগের মানের মতো না হলেও সময় বিচারে দোকান ঘরটি এখনও টিকে আছে।

ফখরুদ্দিনের কাচ্চি

ফখরুদ্দিন বাবুর্চির আদি বাড়ি ছিল চট্টগ্রামে। থাকতেন ভারতের পাটনা শহরে। তার ওস্তাদ মুসলিম মিঞা ছিলেন ভারতের এক নবাব পরিবারের বাবুর্চি। তার সান্নিধ্যেই রান্নায় হাত যশ শিখে ফেলেন তিনি। ১৯৫৬ সালের দিকে তিনি ঢাকায় চলে আসেন। জীবিকার অন্বেশনে ১৯৬৬ সালের দিকে সিদ্ধেশ্বরীর ভিকারুননিসা স্কুলে নাইট গার্ডের চাকরি নেন। পরে ঐ স্কুল প্রাঙ্গণে কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে একটি ক্যান্টিন খোলেন। ১৯৮০ সালের পরে স্কুল প্রাঙ্গণের পিছনে বাড়ির পাশে বিভিন্ন রান্নার কাজ শুরু করেন। তার তৈরি অন্য খাবার থেকে কাচ্চির সুনাম হতে থাকে বেশি। ঢাকার অভিজাত ও উচ্চবিত্তের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ফখরুদ্দিন বাবুর্চির ডাক আসতে থাকে। ফখরুদ্দিনের কাচ্চির খ্যাতির কারণে জর্ডানের বাদশাহর রাজকীয় অনুষ্ঠানে কাচ্চি বিরিয়ানি পরিবেশনের জন্য তার একবার ডাক পড়ে। তার হাতের তৈরি কাচ্চি বিরিয়ানির ব্যাতিক্রমী স্বাদ আর লোকপ্রিয়তার জন্য ফখরুদ্দিনের নিষ্ঠা ও নিজ হাতে খাবার তৈরির ব্যবস্থাপনা ছিল তখনো অনুকরণীয়। ১৯৯৫ সালে ফখরুদ্দিন মারা যান কিন্তু তার রেখে যাওয়া নাম ও সুনাম আজও তার দুই ছেলে মোঃ রফিক ও মোঃ সফিক ফখরুদ্দিন গ্রুপ অব কোম্পানি নামে দেশে বিদেশে পরিচালনা করে আসছে।

মিষ্টান্ন ও রেস্টুরেন্ট

সোনা মিয়ার দই

১৯৪৭ সালে শরিয়তপুরের সোনামিয়া কাজের অন্বেষণে ভারতের কোলাকাতায় মিষ্টির দোকানের কাজ নেন। সেখান থেকে ১৯৫১ সালে ঢাকার গেন্ডারিয়ায় এসে তার বিখ্যাত সোনা মিয়া মিষ্টান্ন ভাণ্ডার দোকান ও মিষ্টি তৈরির কারখানা খুলে বসেন। তার দইয়ের সুনাম দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও ছড়িয়ে পড়ে। দেশে বিদেশের নাম করা ব্যক্তিদের আপ্যায়নে সোনা মিয়ার দই এক সময় প্ৰসিদ্ধ ছিল। বর্তমানের মুন্সিগঞ্জের কাঠপট্টি থেকে খাঁটি দুধ এনে দই তৈরি করে থাকেন। যা বাজারের অন্যান্য দই থেকে ব্যতিক্রমী বটে এবং মিষ্টি থেকে তার দইয়ের সুনামই বেশি।

মুসলিম সুইটস্

ঢাকার শহরের মুসলিম সুইটস্ নামে অনেক দোকান রয়েছে। তবে এর আদি প্রতিষ্ঠাতা হাসান আলি ও তার ছেলে মোহাম্মদ আলি, ১৯৬৭ সালে মুসলিম মিষ্টান্ন ভাণ্ডার নামে প্রথম মালিবাগে একটি মিষ্টির দোকান চালু করেন। পরবর্তীতে মুসলিম সুইটস্ নামে বিজয় নগরে তারা ব্যবসা চালু রাখেন। নিজস্ব কারখানায় তৈরি মিষ্টি আর আটটি শাখার মাধ্যমে ঢাকায় ব্যবসা পরিচালনা করছেন।

দেশবন্ধুর নাস্তা

আনুমানিক ১৯৬৫ সালে শচী মোহন গোপ ঢাকায় এসে মতিঝিল গোপীবাগের মোড়ে মিষ্টির ব্যবসা শুরু করেন। সঙ্গে সকালের ক্রেতাদের জন্য তৈরি হতো পরোটা, ভাজি আর সুজির হালুয়া। মিষ্টির খ্যাতির চেয়ে মুখ্য হয়ে ওঠে পরোটা ভাজির সুনাম। এই পুরনো দোকানে ঢাকার নামকরা কবি সাংবাদিকদের পদচারণায় একসময় মুখর থাকত। খাঁটি ময়দার খামির, ভাজির জন্য বিশেষ মসলা আর সুস্বাদু সুজির হালুয়া এর সাথে বর্তমানে টিকাটুলিতে এখনও সুনামের সাথে টিকে রয়েছে দেশবন্ধু সুইটমিট অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট।

নূরানীর লাচ্ছি

আনুমানিক ১৯৪৫ থেকে ৪৬ সালের দিকে আব্দুল বারেক চকবাজার জামে মসজিদের পাশে ছোট খুপচি ঘরে লাচ্ছি বানিয়ে ঢাকার লোকদের খাওয়ানো শুরু করেন। লাচ্ছির দইসহ সব উপকরণ তিনি নিজেই তৈরি করতেন এবং সম্পূর্ণ হাতেই বানাতেন। দইয়ের সাথে চিনির সিরা, জাফরান পানি, মধু, গোলাপজল ও বরফ কুচি মিশিয়ে তৈরি করতেন অপূর্ব স্বাদের লাচ্ছি। এই লাচ্ছির সুনাম ছড়াতে খুব বেশি সময় লাগেনি। তাই সকলের প্রিয় এখনও নূরানী লাচ্ছি। এখনও তৈরি পদ্ধতিটি হাতেই করা হয় আর সাথে যুক্ত হয়েছে লেবুর শরবত।

মদিনা মিষ্টান্ন ভাণ্ডার

১৯৬৮ সালে ঢাকার লালবাগে ওয়াজির আহম্মেদ প্রতিষ্ঠা করেন মদিনা মিষ্টান্ন ভাণ্ডার নামে একটি মিষ্টির দোকান ও কারখানা। তাদের তৈরি মাখন বড়া, সর মালাই ও মালাই চপ বিখ্যাত। বিকাল থেকেই এই মিষ্টির ক্রেতার ভিড় লেগে থাকে। তাদের আরেকটি বিশেষত্ব হলো সকালের নাস্তা। ব্যতিক্রমী স্বাদের ভাজি, বুটের ডাল, লুচি আর বুন্দিয়া। তাদের নাস্তা, মিষ্টির সুনাম লালবাগ ছাড়িয়েও ঢাকার দূর প্রান্তের লোকেদেরও আকর্ষণ করে।

দয়াল ভাণ্ডার

১৯৯১ সালে সুভাষ ঘোষ বিক্রমপুর থেকে এসে চকবাজারে দয়াল ভাণ্ডার নামে দোকানটি খুলে বসেন। নামী দামি মিষ্টির দোকানের পাশে তারা স্থান দখল করে খাঁটি ক্ষিরশা, মালাই, লাবড়ি আর দই দিয়ে। গতানুগতিক ধারার মিষ্টির বাইরে মোরব্বা, জিরি (খাজা), রমজান উপলক্ষে মাঠা, ছানা, মাওয়া, জর্দা, লালমোহন, ক্রিম, টকদই তৈরির জন্য তারা প্রসিদ্ধ। বর্তমানে ঢাকার সাতরওজা (আবুল হাসনাত রোড) তাদের দোকানে ব্যবসা পরিচালনা করছেন।

ক্যাফে ঝিল

ঢাকার পুরনো আধুনিক এক রেস্তোরাঁ। ঢাকার বিখ্যাত মাজেদ সরদারের ছোট ছেলে বেলায়েত হোসেন ১৯৭৭ সালে মতিঝিলে তাদের নিজস্ব ভবনে একটি রেস্তোরাঁ খোলেন নাম দেন ক্যাফে ঝিল। প্রথমদিকে কাচ্চি বিরিয়ানি দিয়ে শুরু করলেও পরে ঢাকার ঐতিহ্যবাহী সব খাবারই তৈরি হতে থাকে এই রেস্তোরাঁয়। মতিঝিলের অফিস পাড়ায় এক সময় জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ক্যাফে ঝিল। পরে তোপখানা রোডে রেস্তোরাঁটি স্থানান্তর হয়ে চলে আসে।

মুস্তাকিমের চাপ

মোহাম্মাদপুর জেনেভা ক্যাম্পের অধিবাসী মুস্তাকিম এক সময়ে লোহার টাংকি তৈরির কাজ করতেন। পরে কাজের সুবিধা না দেখে শুরু করেন স্কুলের সামনে ঝালমুড়ি বিক্রি। মুস্তাকিম পারিবারিকভাবে একটা জিনিস শিখে নিয়েছিলেন। যেটা কাবাব তৈরির কৌশল। ১৯৮৮ সালে বিকাল বেলা ছোট কাঠের টুল বিছিয়ে তৈরি করতে লাগলেন চাপ, বটি কাবাব, মগজ, কলিজা, হান্ডি কাবাবসহ লুচি। লোকজন রাস্তায় দাঁড়িয়ে খেত সেখানে অনেক রাত অবধি। প্রথমে এলাকা তারপর শহরময় ছড়িয়ে পড়ে তার তৈরি কাবাবের সুনাম। ১৯৯২ সালে বতর্মান জেনেভা ক্যাম্পে দোকানটিতে চলে আসেন। এবং চকবাজারেও একটি শাখা খুলেন মুস্তাকিম ভ্যারাইটি কাবাব অ্যান্ড স্যুপ নামে। কয়েক বছর চলার পর চকবাজারের এই শাখাটি বন্ধ হয়ে যায় নানা কারণে। ২০০৩ সালে চাঁদাবাজের গুলিতে নিহত হন মুস্তাকিম তারপর থেকে তার স্ত্রী দোকানটির বর্তমান হাল ধরে আছেন।

শওকতের কাবাব

মিরপুর বেনারসি পল্লির শেষ প্রান্তে শওকত আলী আনসারির কাঁঠাল গাছের নিচে বস্তা বিছিয়ে দোকান খুলেন ৯০ দশকে। যা শওকতের কাবাব নামেই পরিচিত। দূতাবাসে বাবুর্চির চাকরির সুবাদে তার বাবা আব্দুর রাজ্জাক শিখেন এই কাবাব তৈরি দূতাবাসের অন্য বাবুর্চিদের কাছ থেকে। মাংসে মসলা মিশিয়ে আগের রাতেই রেখে দেওয়া হয়। ক্রেতা আসলেই কড়াই ভর্তি তেলে মাংস ছেড়ে ভাজা হয় সুস্বাদু এই কাবাব। মগজ ও গরুর চাপ তাদের বিখ্যাত।

মানিকের চিড়া-দই

পুরান ঢাকার অধিবাসী ইকবাল হোসেন একবার বরিশালের গৌরনদীতে বেড়াতে যান। গৌরনদীর দইয়ের সুনাম দেশ জুড়েই। গৌরনদীতে গিয়ে দই চিড়া খেয়ে এর প্রেমে পড়েন তিনি। ঢাকায় এসে জনসন রোডে মানিক সুইটমিটে চালু করেন দই চিড়া। নিয়ে আসেন গৌরনদী থেকে কারিগর। মিষ্টির চেয়ে জনপ্রিয় হয় দই চিড়া। সাধারণ হলেও তিনি দই চিড়ায় যোগ করে মাঠা ও মুড়ি। আদালত পাড়ায় মানিকের চিড়া দইয়ের বেশ নাম ডাক। গরমের দিনে বৈচিত্র্যময় এই খাবারের ক্রেতার ভিড় লেগে থাকে সব সময়।

রথখোলার মাঠা

দিনে ও রাতে মাঠার তেমন কদর নেই। সকালে রোদ বাড়ার সাথে সাথে মাঠার টক স্বাদ বাড়তে থাকে। সেজন্য যত ভোরে মাঠা পান করা যায় তত বেশি এর স্বাদ নেওয়া যায়। তাই ভোরের জন্য মাঠা তৈরি হয় আগের দিন বিকাল থেকেই। দুধকে অনেকক্ষণ জ্বাল দেওয়ার পর সেই দই ঠান্ডা করা হয়। এর পর বিশেষ কায়দায় দুধ থেকে তুলে নেওয়া হয় মাখন। এরপর তরল যা থাকে তা দিয়েই মাঠা তৈরি করা হয়। এর সঙ্গে আর পানি মেশানো হয় না। কেবল এক রাত রেখে দিলেই হয়। ঢাকার রথখোলা ব্রিটিশ আমল থেকেই দুধের বাজার হিসেবে পরিচিত ছিল। সকাল সন্ধায় এখান থেকে দুধ বিক্রেতারা দুধ সংগ্রহ করতেন। স্বাধীনতার ৬-৭ বছর পর বিক্রমপুর ছেড়ে ঢাকায় আসেন সুকুমার চন্দ্র ঘোষ। রথখোলার মোড়েই তখন থেকে তিনি মাঠা বিক্রি করে চলেছেন আরেকজন স্বপন ঘোষ তিনিও এখানে মাঠা বিক্রি করছেন অনেক বছর ধরে। মাঠার সাথে ছানা ও মাখনও তারা বিক্রি করছেন, পৈতৃক এই ব্যবসা সুনামের সঙ্গে। ঢাকার বিভিন্ন গলি ও রাস্তার মোড়ে মাঠাওয়ালারা বংশানুক্রমিকভাবে যার যার নির্দিষ্ট স্থানে মাঠা বিক্রি করে আসছেন। নারিন্দার মোড়ে সৌরভ, চকবাজার মসজিদের সামনে মজিদ, ঠাঁটারিবাজারের কবিরের মাঠা ও ছানা, বংশাল পুকুরপাড়া, নাজিরাবাজার, কলতাবাজার, ধুপখোলার মাঠসহ বিভিন্ন জায়গায় সকালে মাঠা ও ছানা বিক্রেতাদের দেখা যায়।

বুদ্ধুর ডাল পুরি

৪৭ এর দেশ ভাগের আগে আফতাব উদ্দিন পাতা বিড়ি তৈরি করতেন। ব্যবসা খারাপ হওয়ায় সূত্রাপুরের ডাল পট্টিতে শুরু করেন ডাল পুরি ও চায়ের ব্যবসা। এলাকার সবাই বুদ্ধ নামে চিনত তাকে তার পুরির সুনামের সাথে সাথে মুন্সী হরি মোহন দাস লেন গলিটার নামই হয়ে যায় বুদ্ধর গলি। ১৯৯২ সালে আফতাব উদ্দিন মারা গেলে দোকানের হাল ধরেন তার ছেলে মোঃ ইউনুস। বুদ্ধুর পুরির বিশেষত্ব হচ্ছে খাঁটি ময়দা আর এক নম্বর মসুরের ডাল। পুরিগুলো আকারে বড় এবং ডাল পুরি ছাড়াও ডিম পুরি এখানে বেশ জনপ্রিয়। শীতকালে টাকি মাছের পুরি তৈরি হয়। বর্তমানে সত্যিকার স্বাদের ডাল পুরির নাম ও সুনাম তারা বংশানুক্রমিকভাবে এখনও ধরে রেখেছেন।

ক্যাফে কর্নারের কাটলেট

১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর ১৯৬১ সালে বাংলাবাজার আর লালকুঠি রাস্তার মোড়ে (নর্থব্রুক হল রোড) হরিপদ ঘোষ খুলেন ক্যাফে কর্নার নামে ছোট্ট এই দোকানটি। পারিবারিক মিষ্টি ব্যবসা থাকলেও তিনি বেছে নেন সাহেবি খাবারের ব্যবসা। কালিগঞ্জের জোসেফ ছিল এর মূল কারিগর বা বাবুর্চি সন্ধ্যা হতেই জমে উঠত দেশ বরেণ্য ব্যক্তিদের আড্ডা। রাত অবধি বিক্রি চলত। বিখ্যাত কাটলেট, ক্র্যাম চপ, ফিস ফ্রাই, কিমা চপ আর চিংড়ি ফ্রাই সাথে সিরকার ডুবানো সালাদ মজাদার সব খাবার। জোসেফের মৃত্যু হলে বাবুর্চির হাল ধরেন জন গোমেজ। ১৯৯৫ সালে হরিপদ ঘোষ ভারতে যাবার সিদ্ধান্ত নেন। নিয়মিত ক্রেতা ও আড্ডাবাজ সোলায়মান মল্লিক দোকানটি কিনে নেন। মালিকানা বদল হলেও খাবারের মান বদলায়নি একটুও। হাল আমলের জনপ্রিয় ক্র্যাম চপ এ খাসির মাংসের কিমা, মরিচ, পেঁয়াজ, ধনে পাতা, পুদিনা কুচি শেরকায় মিশিয়ে সাথে বিস্কুটের গুঁড়া দিয়ে তৈরি করে রসালো ক্র্যাম চপ। প্রাচীন এই রেস্তোরাঁটি পুরনো টেবিল- চেয়ার পরিবেশ বিলেতি ক্রেতার ছুড়ি কাঁটা আর স্টিলের প্লেটে খাবার পরিবেশন পুরনো দিনের সনাতনি রেস্তোরাঁর কথা ঢাকাবাসীকে স্মরণ করিয়ে দেয়।

ঘরোয়ার খিচুড়ি

শরিয়তপুরের ইয়ার উদ্দিন বয়াতি মতিঝিলের অফিস পাড়ায় সাধারণ মানের ভাত, মাছ খাবারের হোটেল চালু করেন। ব্যবসা ভালো না হওয়ায় হোটেলটি এক সময় ছেড়ে দিতে চাচ্ছিলেন। কিন্তু তার ছেলে নজরুল ইসলাম বয়াতি আগ্রহী হয়ে ১৯৯১ সালে হোটেল টিকে ঢেলে সাজান। নতুন আঙ্গিকে দুপুরে বাবুর্চি মজিদ মিয়া তৈরি করলেন ভিন্নধর্মী খিচুড়ি। মতিঝিলে আগতরা খেয়ে প্রশংসাই করলেন না সাথে নিয়মিত অফিস পাড়ার সকলের সুনাম পেতে লাগলেন। ভালো মানের পোলাও এর চাল, মুগ ডাল, খাসির মাংস, আর বিশেষ মসলায় তৈরি হতো খিচুড়ি যা খেতে দুপুরে ক্রেতার ভিড় সব সময় লেগে থাকত। পুরনো ঢাকার জনসন রোডে ঢাকার সবচেয়ে প্রাচীন দিল্লি মুসলিম হোটেলটি যেখানে ছিল ঠিক সেই জায়গাতেই মতিঝিল ঘরোয়া হোটেলটি বর্তমানে স্থানান্তরিত হয়ে ব্যবসা করে যাচ্ছেন।

স্টার হোটেলের কাচ্চি

স্টার হোটেলের নাম ঢাকায় ভোজন রসিকদের কাছে একটি প্রিয় নাম। শহর জুড়েই বর্তমানে স্টার তার শাখা প্রশাখা ছড়িয়ে মান সম্পন্ন খাবার ও ঐতিহ্যকে এখনও ধরে রেখেছে। ১৯৬৫ সালে পুরান ঢাকার ঠাঁটারিবাজারে ১০০০ বর্গফুটের জায়গায় মীর মমতাজ উদ্দিন চালু করেন স্টার হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট। অবশ্য এই ব্যবসা হঠাৎ করেই শুরু করেননি মমতাজ উদ্দিন। তার বাবা মীর হাফিজ উদ্দিন প্রথম এখানে চালু করেন একটি রেস্তোরাঁ। মৎস্য শিকারি ও সৌখিন মানুষ হাফিজ উদ্দিন প্রায়ই তখন ছেলেকে দোকানে বসিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়তেন। মমতাজ উদ্দিন তখন চালু করেন তাজ বেকারি ও পরে বেকারির উল্টো দিকে স্টার হোটেল নামে একটি খাবার দোকান। শুরুতে মোরগ পোলাও দিয়ে খাবারের মেন্যু সাজালেও ১৯৭১ এর পরে খাবারে যুক্ত হয় নবাবি খাবার কাচ্চি। যা এখন অবধি তাদের সবচেয়ে জনপ্রিয় খাবার। তাদের খাবারে যোগ হয়েছে খাসির গ্লাসি, জালি কাবাব, লেগ রোস্ট, স্পেশাল পরোটা, ফালুদা আর বিখ্যাত চা। জয়কালী মন্দির রোডে হোটেল সুপার, ধানমন্ডি সাত মসজিদ রোড, বনানী, কারওরান বাজার, ধানমন্ডি ২ নং রোড, এলিফ্যান্ট রোড আর হাল আমলে জনসন রোডে চালু রয়েছে স্টার এর সর্বশেষ শাখা। ২০০১ তে মমতাজ উদ্দিনের মৃত্যু তার যোগ্য উত্তরসূরি আক্তার উদ্দিন বর্তমানে স্টারের অগ্রযাত্রা ধরে রেখেছেন। ১৯৮২ সাল থেকে স্টার হোটেলে স্টাফ খাবার নামে এক বিশেষ সুবিধা চালু রয়েছে। প্রথমে এটা শুরু হয়েছিল নাস্তা দিয়ে তখন রুটি কিনতে হতো ভাজি দেওয়া হতো বিনা মূল্যে। এরপর মাত্র ৩৫ টাকায় দুপুর ও রাতের খাবার দেওয়া হয় নিয়মিত। এই টাকার মধ্যে ইচ্ছে মতো ভাত ডাল খেতে পারেন ক্রেতা পাশাপাশি ভাজি ও মাছ, ডিম বা গিলা কলিজা, যে কোনো একটি পদ দেওয়া হয়। সব শাখাতেই এই সুবিধা চালু রয়েছে। শুধু মাত্র রেস্তোরাঁয় গিয়ে স্টাফ খাবার বললেই খেতে পারেন স্বল্প আয়ের ক্রেতারা। খাবার নিয়ে গবেষণা মান যাচাই দীর্ঘ দিনের অভ্যাসে আজকে ঢাকার স্টার খ্যাতি ও সুনাম সর্বত্রই দেখা যায়। সাথে মমতাজ উদ্দিনের দিয়ে যাওয়া ব্যবসায়িক পরামর্শ “সততা থাকলে ব্যবসা টিকে থাকবে, মানুষকে ঠকাবে না। ভালো খাওয়ানোটা একটা সেবা যার প্রতিদান তুমি অবশ্যই পাবে”। ৫০ বছরে ঢাকার স্টার হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টের সাফল্যের মূল রহস্য এটাই

হোটেল আল রাজ্জাক

১৯৯৩ সালে বংশাল এলাকায় এই রেস্তোরাঁ প্রতিষ্ঠা করেন পুরান ঢাকার হোসেন মোল্লা। সময়ের সাথে ঢাকার ঐতিহ্যবাহী খাবারগুলোর খাদ্য রসিকদের প্রিয় স্থানে পরিণত হয়েছে। রাজ্জাকের গ্লাসির সুনাম রয়েছে সর্বত্র। বিরিয়ানি, কাবাব, তন্দুর থেকে শুরু করে ভাত, মাছ, লাচ্ছি আর ফালুদা সবই সুস্বাদু আর মান সম্পন্ন। যা খাবার জন্য শহরের দূর দূরান্ত থেকে ভোজন প্রিয় লোকেরা দিনরাত ভিড় করেন। নবাবপুরে রয়েছে হোটেলটির আরেকটি শাখা পাশাপাশি যুক্ত করেছে তারা বেকারি ও মিষ্টির দোকান। হোটেল আল রাজ্জাক ঢাকার ঐতিহ্যবাহী খাবারগুলো এখনও মানসম্পন্নভাবে ঠিক আদিতে না হলেও বর্তমান যুগোপযোগী খাবার হিসেবে আজও পরিবেশন করে যাচ্ছে।

ঢাকার বেকারি

আবেদ অ্যান্ড কোং

ঢাকার প্রথম বেকারি চালু করে আবেদ অ্যান্ড কোম্পানি। ১৯৪০-৪৫ সালের দিকে আবেদ কনফেকশনারি রুটি, বিস্কুটের কারখানা তৈরি করেন ঢাকায়। ঢাকার বিখ্যাত কাকচা, নানখতাই, কুলিচাসহ সকালে তৈরি হতো পাউরুটি। বর্তমানে নাজিমুদ্দিন রোডের মোড়ে আমপট্টিতে ছিল আবেদের দোকান। তবে অনেকে একে পিনচুর রুটির দোকান নামেই ডাকত। ঢাকায় ব্রিটিশদের আগমনে সকাল বেলার নাস্তায় পাউরুটি ও মাখনের সাহেবি চল অভিজাত পরিবারগুলোতে দেখা যেত। এছাড়াও এখানে আমদানি করা স্টে ফোর্ড নামের রেলের ইঞ্জিনের ছবি দেওয়া আর পলসন টিনের কোটার মাখন পাওয়া যেত। এখান থেকে কোম্পানির সিলযুক্ত পাউরুটি নিয়ে ফেরিওয়ালারা শহরের বাড়ি বাড়ি বিক্রি করতেন।

ইউসুফ বেকারি

ব্রিটিশ আমলের শেষের দিকে ঢাকা গোয়ালঘাট মহল্লার পঞ্চায়েত সরদার হাজি ইউসুফ রায় সাহেব বাজারে ইসলামিয়া রেস্টুরেন্টের পাশে এই বেকারির কার্যক্রম শুরু করেন। ইউসুফ সরদারের আরেকটি পরিচয় ছিল তিনি মিউনিসিপালিটি থেকে ধোলাইখালের লিজ নিয়ে নৌকা ও অন্যান্য জলযান থেকে টোল সংগ্রহ করতেন। ইউসুফ বেকারি পরবর্তী পাকিস্তান আমলে জনসন রোডের পুলিশ ক্লাব ভবনের নিচে স্থানান্তরিত করা হয়। বর্তমানে ইউসুফ সরদারের পুত্ররা ইউসুফ গ্র্যান্ড সন্স ও ইউসুফ বেকারি নামে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ব্যবসা করে যাচ্ছেন।

অলিম্পিয়া বেকারি

১৯৪৭ সালের দিকে নবাবপুর রোডে অলিম্পিয়া কনফেকশনারির যাত্রা শুরু হয়। পরবর্তীতে বায়তুল মোকাররমে আরেকটি শাখা স্থাপন করেন। ওয়ারী ও মিরপুরে দুটি ফ্যাক্টরির মাধ্যমে বর্তমানে ৮টি শাখায় বেকারির ব্যবসা করছেন। ১৯৯৯ সাল থেকে তোপখানা রোডে এবং আরেকটি ধানমন্ডিতে অলিম্পিয়া চাইনিজ নামে ব্যবসার সাথেও যুক্ত হন।

আনন্দ বেকারি

৮০ দশকে আবুল হাসনাত রোড সাতরওজা গড়ে ওঠে আনন্দ বেকারি। আব্দুল ওয়াজিদ বাবুল এর একনিষ্ঠতা ও ক্রেতাকে মানসম্পন্ন খাবার খাওয়ানোর মানসিকতা নিয়েই আনন্দের যাত্রা শুরু করেন। তিনি সকল আদি ঢাকার অনেক খাবারই এখানে তৈরি করেন গুণগত মান বজায় রেখেই। টোস্ট বিস্কুট, নোনতা বিস্কুটসহ কুলচা, কাকচা এবং ঢাকার হারিয়ে যাওয়া শিরমাল রুটির ঐতিহ্য তারা ধরে রেখেছেন। বিখ্যাত সুতি কাবাব, মোরগ মোসাল্লাম, টিকিয়ার জন্য ঢাকার খাদ্য রসিকরা আনন্দ বেকারির কথা স্মরণ করেন। সাতটি শাখায় বর্তমানে আনন্দ বেকারি ঢাকায় ব্যবসা পরিচালনা করছেন।

ডিসেন্ট বেকারি

ঢাকার বিখ্যাত মাজেদ সরদারের ছেলে মোঃ জাকির হোসেন ১৯৯২ সালে প্রতিষ্ঠিত করেন ডিসেন্ট বেকারি। বেকারি শিল্পের মানসম্মত খাবার পরিবেশনে তারা ধারাবাহিকতার সাথে ব্যবসা পরিচালনা করছেন। মতিঝিলে প্রথম দোকান আর নবাবপুরের ঢাকা হোটেলের পাশে বেকারির জন্য কারখানা খুলেন। জনপ্রিয়তা আর খাদ্য গুণে ঢাকায় তাদের ১৮টি শাখা রয়েছে। ঢাকা আদি বিস্কুটগুলোর নতুনত্ব নাম ও মানের দুধ কাকচা, পনির কাকচা, চিজ স্টু, বাটার নাট, ওভালটিন বিস্কুট তারা তৈরি করেন। প্লেইন কেক ও পেস্ট্রিসহ চিকেন পাই, নান আর বিখ্যাত পেটিস। রমজান মাসে তাদের লাহোরের ফর্মুলায় তৈরি হয় ঢাকার ব্যতিক্রমী নবাবি হালিম। কাশ্মিরি পেস্তা শরবত, আরবীয় লাবাং ক্রেতার চাহিদায় সুনামের সাথে ব্যবসা করছেন।

সুইস বেকারি

১৯৮৫ সালে ঢাকার বেইলি রোডে সুইস বেকারির জন্ম। উলফাত কাদের বাবার ক্যাপিটাল কনফেকশনারির পুরনো ব্যবসায় না জড়িয়ে খুললেন ভিন্নধর্মী পাশ্চাত্য ঘরানায় মান সম্পন্ন সুইস বেকারি। পারিবারিক ঝামেলার কারণে তিনি বেশ কিছু সময় বিদেশে চলে যান। ভাইরা ব্যবসা পরিচালনা করে আসলেও ১৯৮৭ সালে এসে দেখেন ব্যবসা লাভজনক নয়। তিনি দায়িত্ব আবার বুঝে নেন এবং গড়ে তোলেন নতুন করে সুইস বেকারি। যা এখনও নির্ভেজাল খাবার ও মানের ব্যাপারে আপসহীন এক বেকারি। দোকানের উল্টো দিকেই পরিচ্ছন্ন ও স্বাস্থ্যসম্মত কারখানা এবং প্রতিযোগিতা মূল্যে বেকারি পণ্য তৈরি করে সুনামের সাথে ব্যবসা পরিচালনা করছেন। ৮০ দশকে সুইসের প্যাটিস, পেস্ট্রি, বার্গার, সুইস রোল, ফ্রুট কেক, অর্ডার কেক, ঢাকায় বেশ জনপ্রিয় ছিল। মাঝখানে তারা একটি শাখা খুলেন কিন্তু গ্রাহক সন্তুষ্টির কথা বিবেচনা করে সেটি আবার বন্ধও করে দেন। অন্যান্য বেকারিগুলো শহরময় বিভিন্ন শাখা খুলে ব্যবসার পরিধি বৃদ্ধি করলেও সুইস বেকারি এখনও সেই বেইলি রোডেই একমাত্র দোকানটিতে খাবারের সুনামের সাথে টিকে আছে। ব্যবসায় অর্থই শুধু লাভ নয় মানব সেবা ও ক্রেতা সন্তুষ্টি যে একটি ধর্ম এই মানসিকতা প্রথম থেকে লালন করে আসছেন সুইস বেকারি।

কুপারস বেকারি

প্রকৃত বেকারি শব্দের অর্থগত ব্যবহার এবং পাশ্চাত্যের ঘরানার মান ঢাকাবাসীকে কুপারস প্রথম উপহার দেয়। তাদের সব খাবার বেকচ করা কোনো ভাজা পোড়ার বালাই নেই। ১৯৮৪ সালে ঢাকার ধানমন্ডি মাঠের উল্টো দিকে কলাবাগানে দিদার জাফর আকবর কুপার যিনি দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময় ব্রিটিশ আর্মি অফিসার ছিলেন এবং তার স্ত্রী সুফিয়া কুপার যিনি পাশ্চাত্যের বেকারির অভিজ্ঞতা রাখতেন একত্রে পারিবারিকভাবে শুরু করেন সরেন্টো নামের বেকারি। ঠিক এক বছরের মাথায় তাদের বিচিত্র সব নামের ও স্বাদের খাবারগুলো জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ১৯৮৬ সালে তাদের পারিবারিক উপাধি কুপার শব্দটি ব্যবহার করে বেকারিটি নতুন নামে কুপারস রাখেন। ১৯৯০ সালে পুরনো এয়ারপোর্ট রোডে বড় পরিসরে মূল শাখা স্থানান্তর করেন। তাদের তৈরি ভিন্ন ভিন্ন স্বাদের পাউরুটি, পিজাবন, বেকর্ড সিংগারা, সমুচা, কুকিজ, লেমন টার, পাফ, পেস্ট্রি কেক, ডেজারড, স্যান্ডুইচ সবই আন্তর্জাতিক মানের। ১৯৯৮ তে ডি. জে. কুপার মারা গেলে তার ছেলেরা ঠিক একই মান ও উৎকর্ষ চর্চাটা এখনও করে যাচ্ছেন। বর্তমানে সাভার আশুলিয়ায় কুপারসের রয়েছে পরিচ্ছন্ন ও আধুনিক কারখানা। ১৫টি শাখার মাধ্যমে ঢাকায় বেকারির ব্যবসা সুনামের সাথে এখনও করে যাচ্ছেন।

ঢাকার আইসক্রিম পার্লার

বিশ্বের বেশ কিছু প্রাচীন সভ্যতায় ঠান্ডা খাবার তৈরিতে বরফের ব্যবহারের কথা জানা যায়। আনুমানিক ২০০ খ্রিষ্ট পূর্বে চীনে আইসক্রিম জাতীয় খাবার প্রথম উদ্ভব হয়। যা ছিল বরফায়িত দুধ আর চালের গুঁড়া। ৮০০ খ্রিষ্টপূর্বে পারশিয়ানরা এক বিশেষ ধরনের ঘন ও ঠান্ডা তরল খাবার তৈরি করত যা এক ধরনের পাস্তা ও গোলাপজল সহযোগে। চীনের তাং শাসন আমলে খ্রি. (৬১৮-৯০৭) বরফের এক ধরনের খাবার রাজারা খেতেন যা গরম দুধ, ময়দা, আর কর্পূর দিয়ে তৈরি হতো। আর পাহাড় থেকে বরফ আনার জন্য ৯৪ জন বরফবাহক কাজ করতেন। ঐ মিশ্রণটা একটা ধাতব টিউবে ভরে মাটির নিচে রেখে দেয়া হতো। অনেক পরে ভারতে কুলফি এভাবে তৈরি হতো। প্রাচীন গ্রিকরা দুধ, গোলাপজল, শুকনো কল ও বাদাম সহযোগে এক ধরনের ঠান্ডা খাবার খেত। রোমান সম্রাট নিরো ও ক্লাসিয়াস সিজার লোক পাঠিয়ে পাহাড়ি বরফ এনে সাথে ফল ও ফলের রস মিশিয়ে খেতেন। বাগদাদের খলিফাদের প্রিয় ছিল আইসক্রিম জাতীয় খাবার। মোগলরাও বাদ যায়নি। উত্তর ভারতে মোগল সম্রাটরা হিন্দুকুশ থেকে বরফ এনে ফল মিশিয়ে তৈরি মিষ্টান্ন জাতীয় খাবারের কথা জানা যায়। কুলফি তাদের সময়েই সৃষ্টি।

১৮৪৩ সালে ন্যান্সি এম. জনসন (১৭৯৫-১৮৯০) আবিষ্কার করেন হাতে আইসক্রিম তৈরি যন্ত্র। এই যন্ত্রের মূল নকশাটি এখনও ব্যবহৃত হয়। ঐ যন্ত্রের সাহায্যে ঘরে বসে সহজে আইসক্রিম তৈরি করা যেত। ন্যান্সি ১৮৪৩ সালে ৯ সেপ্টেম্বর যন্ত্রটি প্যাটেন্ট করেন। ১৮৫০ সালে কার্লোগাতি (১৮১৭-১৮৭৮) পেনি আইস বিক্রি শুরু করেন। গাতি আইসক্রিমের গাড়ি করে মানুষের হাতে হাতে পৌঁছে আইসক্রিমের গাড়িকে জনপ্রিয় করে তোলেন। ১৮৫১ সালে মেরিল্যান্ডের জ্যাকব ফুসেল খোলেন প্রথম বিপুল পরিমাণে আইসক্রিম তৈরির কারখানা। বিংশ শতকের শুরুর দিকে সারা বিশ্বে আইসক্রিমের কদর বাড়তে থাকে। এখনকার নরম, কোমল যে আইসক্রিম পাওয়া যায় তা ঐ সময়েই উদ্ভাবিত হয়।

৬০ দশকের প্রথমদিকে বেবি আইসক্রিম ছিল ঢাকার প্রথম আইসক্রিম। বর্তমান আজিমপুর পলাশির মোড়ে ছিল বেবি আইসক্রিমের কারখানা। গুলিস্তান সিনেমা হলের উল্টো দিকে ছিল বেবি আইসক্রিমের বিক্রয় কেন্দ্র। পরিবার নিয়ে খাবার মতো বিলেতি কায়দায় প্রথম আইসক্রিম পার্লার। এছাড়াও কারখানায় বিক্রি হতো এক আনায় লাল, সবুজ রঙের ঘ্রাণ যুক্ত কাঠিতে আইসক্রিম আর দুই আনায় পাওয়া যেত দুধ সাদা আইসক্রিম।

১৯৬৪ সালে ঢাকায় আসে ইগলু আইসক্রিম। তোপখানা রোডে ইগলু একটি আইসক্রিম পার্লার খোলে। পরিবেশন করত আইসক্রিম গ্লাসে একটু পাফ দেয়া সাদার উপর লালা ডোরা কাটা আইসক্রিম বল। বিভিন্ন স্বাদে ও ফ্লেভারে আইসক্রিম তারাই প্রথম ঢাকার চালু করেন। এ সময়ে নিউ মার্কেটে নোভেলটি নামে দোতলায় আইসক্রিম পার্লার গড়ে ওঠে। স্বাধীনতা পরবর্তী চাঁদনি চকের দোতলায় নানা ফ্লেভারে বিক্রি করত ফ্লেমিংগো নামের আইসক্রিম পার্লার। ঢাকার বিভিন্ন বরফ কলের সুবাদে ফেরি করে কাঠের বাক্সে বিক্রি হতো বরফ চিনি আর নানা রং মিশ্রিত আইসক্রিম। ১৯৭৫-৭৬ সালে ১০ পয়সায় ২টা পিপাসা আইসক্রিম কেনা যেত, ১ টাকায় বেবি বা লুসি আইসক্রিম আর দেড় টাকায় ইগলু ললি, ৩ টাকায় চকবার। আজকাল যেমন আইসক্রিমগুলো পুরো প্যাকেট করা থাকে ফুড গ্রেড প্যাকেটে তখন আইসক্রিমগুলো অর্ধেক প্যাক করা থাকত সাধারণ কাগজে। ঢাকায় পোলার আইসক্রিম প্রথম ফুড গ্রেড প্যাক করা শুরু করেন। আবার এখন প্লাস্টিক বক্সে আইসক্রিম বিক্রি হয় ঠিক তেমনি ইগলু শক্ত ও সুন্দর কাগজের বাক্সে আইসক্রিম বিক্রি করত। ঢাকায় এই সময়ে বিভিন্ন মহল্লা ও রাস্তায় আইসক্রিম কোম্পানিগুলো তাদের সুন্দর সুসজ্জিত করা আইসক্রিম ভ্যানগুলো চালু করেন।

দেশে আইসক্রিম শিল্প ক্যাটাগরিতে বৃহৎ শিল্প বিভাগে যুক্ত হয়েছে। বাড়ছে বিনিয়োগ, যুক্ত হচ্ছে আনন্দ বিনোদনের উপাদান হিসেবে ফাস্ট ফুডের পাশাপাশি আইসক্রিম। ইগলু, পোলার, কোয়ালিটি ছাড়াও দেশের বাইরের আইসক্রিমের স্বাদ নেওয়ার জন্য কিছু আইসক্রিম পার্লার ঢাকায় পাশ্চাত্য ঘরানায় সুসজ্জিত দোকান খুলেছেন। ক্লাব জেলোটা, বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ড, নিউজিল্যান্ড ন্যাচারাল বাংলাদেশ তৈরি করছেন ব্রাউনি, স্মুদি, চিলোম, সান্ডেসহ নানা রকম আইসক্রিম। ইগলু তার আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে বাটার স্কচ, অ্যাম্বসিয়া, ব্ল্যাক ফরেস্ট, ডাবল ক্রিম, ডিলাইট, ওয়াইল্ড স্ট্রবেরি, সুইস চকলেট চিপসসহ শাহি কুলফি, দুধ মালাই, নবাবি মিঠাই নামের স্থানীয় ক্রেতা আকর্ষিত করা আইসক্রিম বাজারজাত করতে। আইসক্রিম এখন রাজা বাদশাহদের বিশেষ খাবার নয়। সাধারণ মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে আইসক্রিম আর চলছে বাণিজ্যিক লাভ ও পুষ্টি গুণের উপর গবেষণা।

ফাস্ট ফুড ও কফি সপ

অল্প সময়ে বা তাড়াতাড়ি তৈরি ও পরিবেশন করা খাবারকে ইংরেজি শব্দে ফাস্ট ফুড বলা হয়। সারা বিশ্বেই বর্তমানের জনপ্রিয় খাবার। খাবার অর্ধ ক্রিয়াজাত বা অর্ধ রান্নাকৃত করা খাবারগুলো ক্রেতারা দোকানে বসে ও প্যাকেটজাত করে বাসায় বা নিজ জায়গায় নিয়ে খাবারের জন্য ফাস্ট ফুড তৈরি হয়। ফাস্ট ফুডের ধারণাটা তৈরি খাবার বিক্রির সাথে প্রাচীন রোমের রাস্তার ধারে সাধারণত দুপুরের কাজের মাঝে খাদ্য ও পানীয় হিসেবে পরিবেশিত হতো। ছোট পরিবারের কর্মজীবিকা ও রান্না ঘরের সুবিধা কম হবার কারণে দুপুর ও রাতে খাবার হিসেবে ফাস্ট ফুডকেই অনেকে বেছে নিতেন। শুধু রোম নয় বিংশ শতকে আমেরিকা, ইয়োরোপসহ পাশ্চাত্যের অনেক দেশেই ফাস্ট ফুডের চল শুরু হয়। স্থানীয়ভাবে প্রাপ্ত ও সহজ কমমূল্যের খাবারগুলোই ফাস্ট ফুডের অন্তর্ভুক্ত থাকত। তবে ব্রিটিশ ফাস্ট ফুডে আঞ্চলিক সংস্কৃতির খাবারগুলো ছাড়াও অন্যান্য সংস্কৃতির ফাস্ট ফুড যেমন-পিৎজা, কাবাব, কারিসহ নানান খাবার তারা তাদের খাবারে যোগ করেছে। ১৯২১ সালে ভ্যান গাড়ি রেস্টুরেন্টে খাবার বিক্রিকে জনপ্রিয় করেন আমেরিকান কোম্পানি ওয়াইট ক্যাসেল। কমমূল্যে ৫ সেন্টে হ্যাম বার্গার, চেইন সপ চালু করেন। তাদের সাফল্যে অন্যান্যদেরও কোম্পানি খুলে ফাস্ট ফুড ব্যবসায় উৎসাহিত করেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইয়োরোপসহ তুরস্কে দ্রুত বাড়তে থাকে ফাস্ট ফুড খাবারের ব্যবহার। মানুষের দৈনিক কাজের কর্মঘণ্টা বৃদ্ধি, বসবাসের আবাসন পরিসর ছোট, কমদামে সহজলভ্য খাবার হিসেবে ফাস্ট ফুড বেছে নিতে থাকে। পাশ্চাত্যের কমন ফাস্ট ফুড আইটেমগুলো অঞ্চলভেদে ফিস অ্যান্ড চিপস স্যান্ডইচ, বার্গার, ফ্রাইড চিকেন, ফ্রেঞ্চ ফ্রাইচ, অনিয়ন রিং, চিকেন নাগেট, টেকোস, পিৎজা, হটডগ এবং আইসক্রিম। আবার আরব ও ভারতীয় উপমহাদেশে কাবাব রুটি, মোগলাই, লাচ্ছি, দই বড়া সবই ফাস্ট ফুড। তবে ঢাকায় ফাস্ট ফুড বলতে পাশ্চাত্যের খাবারগুলোই প্রচলিত ও জনপ্রিয়। খেতে সুস্বাদু ও মুখরোচক হলেও পুষ্টি বিজ্ঞান ও গবেষণা বলছে অতিরিক্ত ফাস্ট ফুড গ্রহণ মানুষের শরীরে কোলরেক্টর, ক্যান্সার, অতি স্থূলতা এবং উচ্চ কোলেস্টরেল হতে পারে। এর বিরুদ্ধেও ১৯৮৬ সালে আমেরিকায় চালু হয়েছে স্লোয়ার ফুড যেমন-চিলি, ম্যাশ, পটেটোস ও সালাদ। ঢাকার ফাস্ট ফুড সংস্কৃতি চালু হয়েছে বিংশ শতকের ৯০ দশকে। ঢাকায় খাবার ভ্যান করে সাজানো রেস্টুরেন্ট এবং এলিফ্যান্ট রোডে কফি হাউজ, শর্মা হাউজ, গুলশানে ক্যান্ডি ফ্লস, মৌচাকে কফি পার্লার, সোনারগাঁও রোডে, বিগ বাইটসহ কিছু দোকান ঢাকার ফাস্ট ফুড সংস্কৃতির মূল উদ্যোক্তা। আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড ও চেইন সপগুলো তাদের বিপণন ঢাকায় এখন সম্প্রসারণ করছে। নান্দোস, সাবওয়ে, পিৎজা হাট, কেএফসিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলো এখানে ব্যবসা করছে।

কফি পার্লার

১৯৮২ সালে মৌচাক মার্কেটের পাশে ঢাকার কলতাবাজারের কামাল উদ্দিন আহম্মেদ কফি পার্লার নামে একটি কফি সপ খুলেন। ঢাকার ফাস্ট ফুড বা এই ঘরানায় প্রথম প্রজন্মের দোকান। এই এলাকার লোকজনদের তিনি প্রথম কফি সপের ধারণাটা দেন। বিকাল থেকে রাত পর্যন্ত তরুণ যুবকদের আড্ডা আর সময় ধরে খাবার তৈরি হয়ে আসার অপেক্ষায় ক্রেতা বিরক্ত হলেও গরম গরম চিকেন ক্রন স্যুপ, ভেজিটেবল স্যুপ, চিকেট উইথ ব্রেড, কাটলেট, বার্গার ও ফ্রেঞ্চ ফ্রাই পরিবেশিত হলে সেই বিরক্ত প্রশংসায় রূপান্তরিত হতো। দোকানের প্রথম থেকে জড়িত কর্মচারী চিত্ত, আলী সবাইকে সরল ব্যবহার নিয়মিত গ্রাহকদের সাথে বন্ধুর মতো মেলামেশা ও আচরণে এখানে সবাই খাবার খেতে আসতে বাধ্য হতেন। ২০০৮ সালের দিকে দোকানটি বন্ধ হয়ে যায়। কামাল উদ্দিন এই দোকানের জায়গায় তৈরি করেন সুউচ্চ ভবন ও মার্কেট। আলী মারা গেলেও চিত্তরা এখনও এই এলাকাতেই কফি পার্লারের স্মৃতি নিয়ে দিন কাটাচ্ছেন।

ক্যান্ডি ফ্লস

১৯৮৮ সালে গুলশান ১ নম্বর মোড়ে সাদেকুল কবির ছোট্ট একটি দোকানে ক্যান্ডি ফ্লস নামের ফাস্ট ফুড দোকানটি খোলেন। অল্প পরিসর হলেও দোকানটিতে খাবার জন্য গাড়ি করে আসা তরুণদের সন্ধ্যায় ভিড় লেগে থাকত। কফি, কোল্ড কফি, তাজা ফলের জুসসহ গ্রিল, স্যান্ডুইচ, বার্গার, ফ্রাইড চিকেন তারা অর্ডার দেবার পর তৈরি করে ক্রেতাদের পরিবেশন করত। বর্তমানে দোকানটি বড় পরিসরে গুলশান ও বনানীতে কয়েকটি শাখা খুলে ব্যবসা করে যাচ্ছেন।

বিগ বাইট

৯০ দশকের প্রথম দিকে ঢাকার হাতিরপুলে বিগ বাইট নামে ফাস্ট ফুড দোকানটি খোলা হয়। দোকানটির সাজসজ্জা ছিল দৃষ্টি নন্দন। পাশ্চাত্যের ভাব দেয়ালে পেইন্ট কোটিং, এলভিস প্রিসলি ছবি, ছোট গোল গোল কাঠের টেবিল খাবার, পরিবেশনে কারুকার্যময় বাঁশের খাঞ্জায় খাবার পরিবেশন এবং সাথে হালকা সুরে পাশ্চাত্য সংগীতের আবহ এগুলোই ছিল এর বৈশিষ্ট্য। আর খাবার? প্রিটি ওমেন, রোমান্স ইন দ্য বিচ নামের স্যান্ডুইস, সাইক্লোন, থান্ডার স্ট্রম নামের বার্গার, কোলক্সো দিয়ে চিকেন ফ্রাই ছিল তাদের খাবারের বৈচিত্র্যতা। ঢাকার কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ-তরুণীদের আড্ডা ও দোকানটির খাবারের জনপ্রিয়তা খুব অল্প দিনেই ফাস্ট ফুড প্রেমীদের নজর কাড়ে। ২০১৫ সালের দিকে দোকানটি নতুন করে পরিসর বৃদ্ধি করে সাথে করে নতুন সজ্জা। কিন্তু ঝেড়ে ফেলে পাশ্চাত্যের পুরনো ভাব। শুরু হয়েছে গতানুগতিক ধারার যুগের সাথে তাল মিলিয়ে ব্যবসা আর বাকিটা শুধু স্মৃতি।

কেএফসি ও পিৎজা হাট

ঢাকাতে ২০০৩ সালে আমেরিকান চেইন হিসেবে পিৎজা হাট গুলশানে প্রথম প্রবর্তন হয়। আমেরিকার ও ইয়োরোপীয় পরিবেশ ভোজন বিলাসীদের একটি বড় আকর্ষণীয় স্থান। ট্রান্সকম ফুড লিঃ ইতালীয়/আমেরিকান পিত্জার প্রস্তুতে ঢাকায় ৬০ ভাগ মসলা, আর বাকী মাংস ইত্যাদি বিদেশ থেকে আমদানি এবং তিন মাস পর পর রেস্তোরাঁর মান পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে পিৎজা হাট পরিচালনা করছেন। আধুনিক সাজ-সজ্জা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, খাবার পরিবেশনা সবই বিদেশি ঢঙেই হয়। এই রেস্তোরাঁ গুলশান ছাড়াও, ধানমন্ডি, বেইলি রোডসহ কয়েকটি আউটলেটের মাধ্যমে টেবিলে খাবারের অর্ডার দেওয়া ও পরিবেশনা হয়ে থাকে যাকে ক্যজুয়াল ডাইনিং বলা হয়। এভাবেই তারা তাদের খাবারের বিপণন করে থাকে।

ঢাকায় দ্বিতীয় আমেরিকান চেইন রেস্তোরাঁ কেএফসি ২০০৭ সালে ট্রান্সকম ফুড লিঃ এর ব্যবস্থাপনা ও তত্ত্বাবধানে চালু হয়। পিজা হাটের মতোই এখানেও রন্ধন অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জা পরিবেশনা সবই পর্যবেক্ষণ হয়ে থাকে। তবে দ্রুত পরিবেশন বা কুইক সার্ভিস এবং ক্রেতা নিজের খাবার নিজেই অর্ডার দিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে খাবার সংগ্রহ করতে হয়। চিকেন বা মুরগি প্রধান খাবার স্থানীয় বাজার থেকেই তারা সংগ্রহ করেন। আর মসলা আসে বিদেশ থেকে। আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে কেএফসি রেস্তোরাঁ শহরের সব গুরুত্বপূর্ণ এলাকাতেই আউটলেট বা শাখা খুলে ব্যবসা করছে। এর ক্রেতা ঢাকার তরুণ তরুণী ও ছাত্র-ছাত্রী যারা উচ্চ মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আগত। পিৎজা হাট ও কেএফসি ঢাকার ফাস্ট ফুড সংস্কৃতিতে মাইলফলক হিসেবে পরিচিত হচ্ছে।

ঢাকার কফি সংস্কৃতি

ব্রিটিশ আমলে ইংরেজরা যেমন বিনে পয়সায় চা খাইয়ে বাঙালিকে যেভাবে চা পানের অভ্যাস গড়ে দিয়েছিল তেমনি কফি পানের চল বিংশ শতাব্দীর ৯০ দশকের অনেক পরে। স্বাধীনতা পরবর্তী ঢাকায় সাধারণের মধ্যে চা পান ও অতিথিকে চা দ্বারা আপ্যায়নের অংশ হিসেবে দেখা গেলেও কফি পান বলতে ঢাকার তিনটি তারকা হোটেল (পূর্বাণী, শেরাটন, সোনারগাঁ) দূতাবাস, বিদেশি এনজিও কর্মকর্তা, গুটি কয়েক বিদেশ ফেরত বাংলাদেশির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। বিভিন্ন অফিস বা প্রতিষ্ঠানে চায়ের বিকল্প কফি দ্বারা আপ্যায়ন ছিল অভিজাত্যের প্রতীক। হাতে গোলানো এবং আমদানি করা কফির বোতল ছিল ভরসা। ৯০ দশকে ঢাকার খাবারের সংস্কৃতিতে বিশ্বায়নের প্রভাব পড়তে শুরু করে। ঢাকা কেন্দ্রিক বিদেশিদের আবস্থান তৎকালীন ৩৮টি দূতাবাসের কর্মকর্তা, গুটি কয়েক অভিজাত গ্রাহক, তখনকার সময়ে পড়াশুনা শেষে বিদেশ ফেরত বাংলাদেশি, ঢাকায় কফি সংস্কৃতির গোড়াপত্তনের মূল কারিগর।

১৯৭১ সালে আমেরিকার সিয়াটলের পাইক প্লেস মার্কেটে স্টার বাক্স যাত্রা শুরু করে। ১৯৮১ তে এর নবযাত্রায় প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান হাউয়ার্ড সুলোজ এর পদার্পণ। কফি ও কফি তৈরির সরঞ্জাম তারা সারা বিশ্বেই ছড়িয়ে দেন। যা এখন ৫০টি দেশের ১৫ হাজার কফি সপের সমন্বয়ে কফির রোল মডেল আজ তারা। ১৯৯৯ সালে কানাডিয়ান নাগরিক রোমিনা হোসাইন ও এইচ এস ইকবাল ঢাকায় গুলশানে প্রিমিয়াম সুইটসে স্টার বাক্সে এসপ্রেসো বেইস কফি শুরু করেন। ঢাকায় তখন শুধু এখানেই পাওয়া যেত মিডিয়াম রোস্টেড অ্যারাবিকা বিনের এসপ্রেসো কফি। প্রতিদিন সকালে শুরু স্টার বাক্সের গ্রান্ডের ওয়াইড চকোলেট মোকা উইথ হুইপ ক্রিম দিয়ে। পরে ২০০৫ এ হোটেল সোনারগাঁ এসপ্রেসো কফির স্বাদ যুক্ত করেন তাদের হোটেলে।

মানুষের কফির প্রতি ক্রমশ বাড়তি কৌতূহল ও আকর্ষণ বহু উদ্যোক্তাকে নতুন নতুন কফির দোকান শুরুর ব্যাপারে উৎসাহ যুগিয়েছে। রুচি ও চাহিদার পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ঢাকা শহরে নানা জায়গায় গড়ে উঠেছে কফির দোকান। বিশ্ব মানের কফির সঙ্গে তাল রেখে ঢাকায় ব্যক্তি উদ্যোগ ও বহুজাতিক কোম্পানিরা আধুনিক কফি সংস্কৃতি বিস্তার বর্তমান সময়ে প্রভাবক হিসেবে কাজ করছে। যা এক সময়ে শত খুঁজলেও রাজধানীতে ভালো মানের কফি সপ খুঁজে পাওয়া ছিল দুষ্কর।

বারিস্তা লাভাজ্জা

ঢাকার গুলশান ১ এ বারিস্তা রেস্তোরাঁ ইটালিয়ান লাভাজ্জা ব্রান্ডের বিন দিয়ে কফি প্রস্তুত করে এখানে। এসপ্রেসো কাপুচিনো, লাটে, মোকাসহ নানা রকম কফি ধানমন্ডি, উত্তরা, কারওয়ান বাজার শাখাসহ ব্যবসা করছে বারিস্তা।

কিভা হান বুটিক ক্যাফে

২০০৭ সালে কফি পাগল সামিত বিন সালাম নামে এক তরুণ উদ্যোক্তা এই কফি সপটি গুলশান ১ এ খোলেন। দোকানটি খোলার আগে নিজেই কফি বানানোর বিদ্যা রপ্ত করেন যুক্তরাষ্ট্র ও সিঙ্গাপুরে। পৃথিবীর প্রাচীনতম কফি সপের নাম থেকে এই নাম এসেছে বলে জানা যায়। মিশ্র ধরনের চিত্রকর্ম ও পোস্ট মর্ডান ঘরানায় সাজানো চেয়ার টেবিল আর তাদের দোকানের বৈশিষ্ট্য স্মুথ চিকেন স্যান্ডইচ আর সাথে কফি।

ব্রোনিয়া ক্যাফে অ্যান্ড গ্যালারি

কফি আর চিত্রকর্ম, একই ছাদের নিচে। গুলশানের এই ক্যাফেতে দেয়াল জুড়েই অনেক চিত্রকর্ম। প্রায়ই অনেক চিত্রশিল্পী এখানে অতিথিদের জন্য পোট্রেইট করেন। কফির জন্য বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বিন ব্যবহার করলেও ব্যবহার করছেন স্টার বক্সের কয়েকটি রোস্টিং কাপুচিনোর গন্ধের কফি সাথে চিত্র প্রদর্শনী মন্দ মিলবে না আর সাথে চিকেন চিজ স্যান্ডউইচ।

বিনস অ্যান্ড অ্যারোমা

উত্তরার সেক্টর ৩ এ বিনস অ্যান্ড অ্যারোমা ব্রাজিলের উৎপাদিত কফি তারা ব্যবহার করেন। নিজেরা কফি রোস্টিং করে আর তা ব্যবহার করেন ৩ সপ্তাহের মধ্যেই। কেননা তাতে নাকি কফির স্বাদের ভাটা পড়তে থাকে ধীরে ধীরে।

ব্লুজ অ্যান্ড বাইটস

এখানে কফি বানাতে ব্যবহার করেন ইলি কফি বিনস। বাংলাদেশে ইলি কফি যারা বিপণন করেন তারাই খুলেছেন এই ক্যাফে। আধুনিক অন্দরসজ্জা ইলি তৈরি কাপে লগো আর বিশেষত্ব এসপ্রেসো তিয়ামিসু। যা ঢাকার কোথাও পাওয়া যায় না এটাই তাদের দাবি। হট ও কোল্ড মিলে ১৬টি ভিন্ন স্বাদের কফি তারা প্রস্তুত করে।

গ্লোরিয়া জিনস

গুলশানে বিশ্বের অন্যতম সেরা কফি তৈরির মেশিন লা মার্জোকোর কফি মেশিনে তারা পরিবেশন করেন। সকালে বিগ ব্রেকফাস্ট আর সারা দিন-রাত জুড়ে কফি সাথে নাস্তা, সালাত, বার্গারসহ নানান স্ন্যাকস। কফি প্রেমীদের বন্ধু ও পরিবারসহ এক সঙ্গে কফির স্বাদ আধুনিক পরিবেশে উপভোগ করার ব্যবস্থা রয়েছে এখানে। গুলশানে ২টি আর ধানমন্ডিতে ১টি শাখা গ্লোরিয়া জিনস কফিজ এর। সুইস হট চকোলেট, ক্যবাাামেল কম্বো স্লাইস কেক, গোমেট চকলেট চিলার, হোয়াইট মোকা, পটেটো WEDGES I

এছাড়াও ঢাকার বনানীতে ক্যাফে ইটালিয়ানো, কলম্বাস কফি, মোকা ক্যাফে অ্যান্ড বিট্র, ধানমন্ডিতে কফি ওয়ার্ল্ড, এরিক’স বিট্র, উত্তরাতে জজে’স ক্যাফে, গুলশানের নর্থ অ্যান্ড কফি বোস্টারস মান সম্পন্ন কফি তৈরি করে। ঢাকার কফি প্রেমীদের মন জয় করছে আর সাথে বৈচিত্র্য স্বাদপূর্ণ পাশ্চাত্য ঘরানায় মুখরোচক খাবার।

সকল অধ্যায়

১. প্রথম অধ্যায় – বাদশাহি ও নবাবি খাদ্য বিলাস
২. দ্বিতীয় অধ্যায় – ঢাকার রুটি
৩. তৃতীয় অধ্যায় – ঢাকার কাবাব
৪. চতুর্থ অধ্যায় – ঢাকার পোলাও ও বিরিয়ানি
৫. পঞ্চম অধ্যায় – মাংসের মসলাদার খাবার
৬. ষষ্ঠ অধ্যায় – বাংলা খাবার
৭. সপ্তম অধ্যায় – নাস্তা জাতীয় খাবার
৮. অষ্টম অধ্যায় – ঢাকার পানীয়
৯. নবম অধ্যায় – ঢাকার মিষ্টান্ন
১০. দশম অধ্যায় – ঢাকার পিঠা
১১. একাদশ অধ্যায় – ঢাকার বিশেষ খাবার
১২. দ্বাদশ অধ্যায় – খাদ্য পরিবেশন
১৩. ত্রয়োদশ অধ্যায় – ঢাকায় রমজানে সেহরি ও ইফতার
১৪. চতুর্দশ অধ্যায় – ধর্মীয় উৎসবের খাবার
১৫. পঞ্চদশ অধ্যায় – পান-হুক্কা-চা
১৬. ষষ্ঠদশ অধ্যায় – ঢাকার ক্যাটারিং, ডেকোরেটর ব্যবস্থা ও বাবুর্চিরা
১৭. সপ্তদশ অধ্যায় – ঢাকার নিরাপদ পানির ব্যবস্থাপনা
১৮. অষ্টাদশ অধ্যায় – হিন্দু সম্প্রদায়ের খাবার
১৯. ঊনবিংশ অধ্যায় – ঢাকার বিয়ের খাবার
২০. বিংশ অধ্যায় – ৪০ দশক পরবর্তী ঢাকার জনপ্রিয় খাবার ও পর্যালোচনা
২১. ২১. পরিশিষ্ট

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন