প্রথম অধ্যায় – বাদশাহি ও নবাবি খাদ্য বিলাস

প্রথম অধ্যায় – বাদশাহি ও নবাবি খাদ্য বিলাস

ভারতের মধ্যযুগের ইতিহাস তুর্ক-মোগলদের আধিপত্য। ১১ শতক থেকে বিভিন্ন তুর্কি গোত্রের যোদ্ধারা ভারতবর্ষের দিকে নজর দিতে শুরু করে যা ১৩ শতকের গোড়ায় দিল্লিতে সুলতানশাহি প্রতিষ্ঠায় মূলে ছিলেন তারাই। মালোয়া যা আজ মান্ডু নামে রাজ বাহাদুর-রূপ মতির প্রেম খ্যাত আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র ছিল সুলতানদের রাজধানী দিল্লিতে মোগল শাসন প্রতিষ্ঠার আগে থেকেই তারা সেখানে স্বাধীনভাবে রাজত্ব করেছেন (১৪০১-১৫৬১)। খিলজি বংশের তুর্কি সুলতান গিয়াসউদ্দিন (১৪৬৯-১৫০০) ও তার পুত্র নাসিরউদ্দিন (১৫০০-১৫১১) এর সময়ে নেয়ামতনামা নামে একটি সুচিত্রিত রান্নার বই সংকলন করিয়েছিলেন। যার পাণ্ডুলিপি বর্তমানে লন্ডনের ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত রয়েছে। মোগল আমলের আগেই যে ভারতে বাদশাহি রান্নার সূত্রপাত, এটিই হলো তার উল্লেখযোগ্য নিদর্শন। সম্ভবত মধ্যযুগে ভারতে লেখা একমাত্র রান্নার বই।

ভারতে ১৫২৬ সালে মোগল যুগের সূচনার আগে বাবরের পূর্ব পুরুষ তৈমুর ছিলেন বরলাস নামের এক মোঙ্গল গোত্রের মানুষ। তাদের বসবাস ছিল মোগলিস্তান যা বর্তমানে দক্ষিণ কাজাখিস্তান। বরলাস ছাড়াও মোগলদের মধ্যে আরও এক গোত্র ছিল “চাকতাই”। বাবরের মা ছিলেন এই গোত্রের যা মধ্য এশিয়ার তুর্কি ও মোগল দুই প্রতিবেশী জাতি। কালক্রমে মোগলরা তুর্কিদের সঙ্গে মিশে যান যদিও বাবর ও তাঁর বংশধরদের পরিচয় মোগল হলেও তারা অবশ্য নিজেদের মোগল বলতেন না। চেঙ্গিস খান মুসলমান ছিলেন না। মুসলমান হয়েছেন আরও পরে। মুসলমান হওয়ার পরে তুর্কি ও মোগলরা উন্নত ইরানি বা পারস্য সংস্কৃতির সংস্পর্শে আসেন। ফলে ভারতে মোগল বাদশাহদের মধ্যে পারসিক সভ্যতার প্রভাব ছিল বেশি। যা তাদের খাদ্য রন্ধন প্রণালি, পরিবেশন রীতিসহ সব কিছুতেই পারস্যের ছায়া লক্ষ করা যায়।

ভারতে মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা জহির উদ্দিন মোঃ বাবর (১৪৮৩- ১৫৩০) তার তুর্কি ভাষায় লেখা “বাবরনামা” আত্মজীবনীতে খাবার দাবারের কথা খুব অল্পই উল্লেখ পাওয়া যায়। আত্মজীবনীতে বাবর লিখেছেন যে, তিনি স্থানীয় পাচকদের তৈরি খাবার খেতেন। খরগোসের মাংস তার খুব পছন্দের, শুকনো ঝলসানো মাংস আর সঙ্গে অনেকটা গাজর ভাজা। ইব্রাহিমের মায়ের ষড়যন্ত্রে একবার তার খাবারে বিষ মেশানে হয়েছিল। সেদিনের পাতে ছিল পাতলা রুটি আর মাখনে ভাজা মাংস। তিনি ফল খুব ভালোবাসতেন তবে তার বেশি পছন্দ ছিল নিজের দেশের ফল যা আঙুর, খরমুজ, খোবানি ইত্যাদি। ভারতে যে সব ফল হয় সেগুলোর বিস্তারিত পরিচয় দিলেও ভারতে আঙুর ও খরমুজের চাষ তিনিই প্রথম শুরু করেন।

বাবরের জ্যেষ্ঠপুত্র ও উত্তরাধিকার নাসিরউদ্দিন মোহাম্মদ হুমায়ুন (১৫০৮- ১৫৫৬) পিতার সাম্রাজ্য পেয়েও তা খুইয়ে ফেলেন। তারই পিতার প্রাক্তন সেনাপতি ফরিদখান শেরশাহ্ সুরির কাছে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে রাজ্য হারিয়ে আশ্রয় নেন ইরানের শাহ্রে দরবারে এবং তারই সাহায্যে পরে নিজের সিংহাসন পুনরুদ্ধার করেন। ভারত থেকে পালিয়ে যখন তিনি ইরানের আশ্রয়ের খোঁজে যাচ্ছিলেন তখন পথে বাধ্য হয়ে তাকে খেতে হয়েছিল সৈন্যদের শিরোস্ত্রাণে সিদ্ধ করা ঘোড়ার মাংস। তবে ইরান পৌঁছে তার খাদ্য সুখের অভাব হয়নি। স্ত্রী হামিদা বানু ছিলেন জাতে ইরানি। ইরানের শাহ্ তার সম্মানে একবার বিশাল ভোজসভা আয়োজন করেছিলেন এবং সেখানে ছিল সব রকম হালাল মাংসের ব্যবস্থা। নির্বাসন জীবনে তিনি পারস্যের খাবারের প্রেমে পড়েন। ফলে দিল্লিতে ফেরার পর মোগল পাকশালায় লাগল ইরানি হাওয়া। যদিও তখনও খাদ্য তালিকায় আদি মধ্য এশীয় ও তুর্ক পদ্ধতির ঝলসানো ও পুর দেওয়া ভেড়ার মাংস, শিক কাবাব, তন্দুরে সেঁকা মুরগি, কোফতা ইত্যাদি বজায় ছিল। তবুও ইরানি পাচকদের রন্ধনগুণে তার মধ্যেই চলে আসে রান্নায় কিছু সূক্ষ্মতা।

বাবর ও হুমায়ুনের সাম্রাজ্যের ভিত শক্ত করতে ব্যস্ত থাকলেও সাম্রাজ্যের প্রকৃত বিকাশ ঘটান তৃতীয় মোঘল সম্রাট জালাল উদ্দিন মোহাম্মদ আকবর (১৫৪২-১৬০৫)। এজন্য তিনি মাত্র ১৩ বছর বয়সে সিংহাসনে বসে রাজত্ব করেছেন আমৃত্যু প্রায় ৫০ বছর। নিজে খুব পেটুক না হলেও, খাদ্য ও রন্ধনশালাকে তিনি বেশ গুরুত্ব দিতেন। তার সাম্রাজ্যের ইতিহাস লিখে গেছেন তার উজির ও আস্থাভাজন আবুল ফজল ইবনে মোবারক “আকবর নামা” নামে তিন খণ্ডের বইয়ে। এতে মোগল বাবুর্চিখানা ও কিছু বিশেষ রান্নার বিবরণ পাওয়া যায়। সম্রাট ও তার পরিবারে খাবার-দাবার তদারককারী প্রধান রাজ কর্মচারীকে বলা হয় “মীর বাকবাল”। আকবর খাওয়া শুরু করতেন দই বা দুধ দিয়ে। নিরামিষ ও আমিষ দুই ধরনের খাবারই পরিবেশন করা হতো। মাংসের প্রতি তার তেমন আকর্ষণ ছিল না। চাল, গম, ছোলা, বার্লি জাতীয় খাদ্যই তার প্রিয় ছিল। যেদিন আকবর মাংস খেতেন না সেদিন তার জন্য রান্না হতো অনেক রকম পোলাও, খিচুড়ি, মসলা দিয়ে ফোটানো ময়দা আটা, ডাল, পালং শাক ও আরও কিছু সবজি, হালুয়া, শরবত ইত্যাদি। আকবর প্রথমে সপ্তাহের শুক্রবার মাংস খেতেন না। পরের সপ্তাহের রবিবারও মাংস খাওয়া ছেড়ে দেন। আবার মাসের প্রথম দিনও মাংস বন্ধ। এইভাবে মাংস খাওয়া কমাতে কমাতে গোটা মার্চ মাসই হলো মাংসহীন। নিজের জন্ম মাস অক্টোবরে মাংস তিনি আরও খেতেন না। মোগল বাদশাহদের বাবুর্চিখানার পাশেই থাকত সবজি বাগান সেখানে বাদশাহ যে সবজি খেতে ভালোবাসেন সেগুলোই লাগানো হতো। খুব যত্ন করে তৈরি করা হতো মাটি। গোলাপজলের সঙ্গে কস্তুরি মিশিয়ে মাটিতে ছড়ানো হতো যাতে ফসলে সুগন্ধ আসে। আকবর কুলফি খেতে ভালোবাসতেন যা তার বাবুর্চিরা খুব ভালো বানাত।

আকবর পুত্র চতুর্থ মোগল সম্রাট নুরুদ্দিন মোঃ সেলিম জাহাঙ্গীর (১৫৬৯- ১৬২৭) ক্ষমতাপূর্ব বেশির ভাগ সময় পাঞ্জাব ও কাশ্মিরে কাটাতেন। যে কারণে তার রাজত্ব কালে মোগল বাবুর্চি খানায় ঐ দুটি প্রদেশের প্রভাব পড়েছে যথেষ্ট পরিমাণে। সাম্রাজ্যের বিস্তৃতির সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য অঞ্চলের রান্নাও বাদশাহর রন্ধনশালায় স্থান করে নিতে থাকে। জাহাঙ্গীরকে সবচেয়ে বেশি মৎস্যপ্রেমী মোগল বাদশাহ হিসেবে মনে করা হয়। কেননা তিনি আঁশযুক্ত মাছ পছন্দ করতেন বিশেষ করে রুই মাছ। একবার তিনি গুজরাটে গিয়েছিলেন এবং অনেকদিন মাছ খাওয়া হয়নি বলে তাকে রুই মাছ রেঁধে খাওয়ানো হয়। খেয়ে তিনি এতই তৃপ্তি পেয়েছিলেন যে খুশি হয়ে রন্ধনকারীকে একটি দামি ঘোড়া উপহার দেন। উপমহাদেশে ভারতের মাছ বিষয়ে বাবরনামা থেকে জানা যায়,

“ভারতের মাছ খেতে খুব সুস্বাদু। এগুলোতে অল্প ছোট ছোট কাঁটা থাকে। মাছগুলো চটপটে একবার জাল ফেলে নদীর এপাশ ওপাশ ছেকে ফেললে জালে প্রচুর মাছ ধরা পড়ে। জালের দুই পাশে আধ গজ উঁচু করে তোলা হয়। তা সত্ত্বেও অনেক মাছ জালের উপর দিয়ে লাফিয়ে বেরিয়ে যায়। অনেক ছোট ছোট মাছ যেগুলো জোর শব্দ এমনকি পায়ের আওয়াজ শুনলেও পানির উপর এক দেড় গজ লাফিয়ে উঠতে পারে”।

আরও জানা যায় জাহাঙ্গীর লাজিজাহ নামে একধরনের খিচুড়ি খেতেন। যা জোয়ার চাল ও ডাল দিয়ে গুজরাটি কায়দায় রান্না করা হতো।

সৌখিন বাদশাহ ও তাজমহল নির্মাতা আবুল মোজাফফর সামসুদ্দিন মোহাম্মদ খুররাম শাহজাহান (১৫৯২-১৬৬৬) শিল্পকলার মতো রন্ধনশৈলীর পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তার সময়ে পর্তুগিজদের আনা মরিচ, আলু, টমেটো মোগল খাদ্যে যুক্ত হয়। যার ফলে লালকেল্লার বাদশাহি খাবার কোরমা, কালিয়া, বিরিয়ানি, কাবাব ও নানা ধরনের সবজির রঙের বাহার অনেক বৃদ্ধি পায়। মোগল আমলে রুটি তৈরির জন্য ছিল আলাদা রকাব খানা (বেকারি)। সেখানে নানা আকারের রুটি তন্দুরে তৈরি হতো। এইগুলো হলো বুর্জুগ তন্দুরি অর্থাৎ বড় তন্দুর। আর এক ধরনের রুটি হতো তাওয়ায় যার নাম “তনখ তবকি”। তাওয়ায় সেঁকা রুটিকে তখনও চাপাতি বলা হতো। শাজাহানের সময় তাওয়া রুটিতে বৈচিত্র্য আসে এবং তখন থেকে শুরু হয় খেজুরি রোগানি, মিঠি রোগানি ইত্যাদি নানা রকম বাহারি রুটি।

শেষ শক্তিশালী মোগল সম্রাট শাহজাহান পুত্র আবুল মোজাফফর মহিউদ্দিন মোহাম্মদ আওরঙ্গজেব আলমগীর (১৬১৮-১৭০৭) তার আগের বাদশাহদের মতো জাঁকজমক প্রিয় ছিলেন না। তবে সুখাদ্যের প্রতি দুর্বলতা ছিল বরাবরই। তার প্রিয় খাদ্য ছিল ছোলার ডাল আর চালের তৈরি কুবুলি। এছাড়াও ফল ও শাক-সবজিই বেশি পছন্দ করতেন। তিনি একবার ছেলের কাছে অনুযোগপত্র পাঠিয়ে ছিলেন যাতে তিনি বলেন যে,

“তোমার ওখানে খিচুড়ি আর বিরিয়ানি খেয়ে আমি তোমার বাবুর্চি সুলেমানকে চেয়েছিলাম, কিন্তু তুমি দাওনি। যাক, সুলেমানের যদি কোনো যোগ্য সাগরেদ পাও আমার কাছে পাঠিয়ো। খাওয়ার লোভ আমাকে এখনও পুরোপুরি ছেড়ে যায়নি”।

শেষ মোগল সম্রাট আবু জাফর সিরাজউদ্দিন মুহাম্মদ বাহাদুর শাহ জাফর (১৭৭৫-১৮৫৭) তার রাজ্য দিল্লির লাল কেল্লার চার দেয়ালের মধ্যে সীমিত হয়ে গেলেও তার সময়েই দিল্লিতে সাহিত্য ও সংস্কৃতির সবচেয়ে বেশি বিকাশ ঘটে। শেষ মোগল বাদশাহ ও কবি একজন খাদ্য রসিক এবং বুড়ো বয়সেও ভালো খাবারের লোভ সামলাতে পারতেন না। বেশি খেয়ে ফেলার কারণে প্রায়ই তিনি পেটের অসুখে ভুগতেন। তার ভোজন তালিকায় থাকত খাসি করা মোরগ, হরিণের মাংসের কাবাব, ভাজা তিতির ও বটের, ঝলসানো পাতিহাঁস ও কচি ভেড়া, টক দই, আলু ও মসলাসহ রান্না করা মাছ, অল্প আঁচে সারারাত রান্না করা কচি ভেড়ার বুকের মাংস। এছাড়াও ভেড়া ও মুরগির পোলাও, বিরিয়ানি, নান, চাপাতি, পরোটা, কুলচা, বাকরখানি ও নানারকম ক্ষীর জাতীয় খাবার। বাহাদুর শাহ জাফর নিজেও কিছু নতুন ধরনের রান্না আবিষ্কার করেছিলেন যেমন করলার হালুয়া, মরিচের হালুয়া, রাহাজানি নামের একধরনের চাটনি ইত্যাদি। তার কবিপরিপূর্ণ রাজসভার সেরা সম্পদ ছিলেন কবি মির্জা গালিব। একবার বাদশাহ তাঁর পছন্দের মুগডালের রান্না দালশাহ্ পসন্দ কবি মির্জা গালিবকে পাঠিয়েছিলেন এবং গালিবের সেটা এতই পছন্দ হয়েছিল যে তিনি তা নিয়ে এক চতুষ্পদি কবিতা লিখে ফেলেছিলেন।

মোগল বাদশাহদের জলের প্রাণীর প্রতি বিশেষ আকর্ষণ ছিল না। মোগল বাবুর্চিরা এ জন্য মাছের গন্ধ দূর করার জন্য লেবুর রস ও লবণসহ লেবু পাতা, এলাচ ও লবঙ্গ বাটা মাখিয়ে সারারাত রেখে দিতেন। তারপর খুব কৌশলে কাটা বাদ দিয়ে মাছ রাঁধতেন। বাদশাহ ও নবাবের খাবার তৈরি করতেন যারা তারা তিনটে দলে থাকত। একদল ডেকশোর যাদের কাজ শুধু ডেগ বা ডেগচি ও অন্যান্য রান্নার সরঞ্জাম ধোয়া এবং বাবুর্চিদের ফরমায়েশ খাটা। আরেকদল বাওয়ারচি বা বাবুর্চি যারা বড় বড় ডেকচিতে রান্না করতেন ও নামাতেন। তৃতীয় দল রকাবদার, ছোট ডেকচি বা রেকাবি নিয়ে যাদের কাজ। রান্নার নানা রকম শিল্পকর্ম এরাই করতেন। বড় ডেকচি নামানো বা উঠানোকে এরা নীচু কাজ বলে মনে করতেন। বাদশাহর বাবুর্চিদের পরামর্শ দেওয়ার জন্য হাকিম নিয়োগ করা হতো। তারা বাদশাহর শরীর স্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে ঠিক করতেন মাংস কী রকম হবে, হালকা না মসলাদার। তাছাড়াও বাদশাহর অসুখ হলে ঔষুধিগুণ সম্পন্ন গুল্ম ও অন্যান্য উপকরণ তারা রান্নায় দিতে বলতেন। আবার বাদশাহর চাহিদা মতো পৌরষবর্ধক বিশেষ খাবারের ব্যবস্থা এই হাকিমরাই করতেন।

মোগল বাদশাহদের পান চিবানোর অভ্যাস ছিল। খাবার পর পানের বিড়া পেশ করা হতো তাদের সামনে- এক একটা বিড়ায় থাকত এগারোটা করে পান। পান পাতায় মাখানো হতো কপূর ও গোলাপজল। চন্দন দিয়ে সিদ্ধ করা সুপারি আর চুনে মেশানো হতো জাফরান ও গোলাপ কেওড়া জল।

বাদশাহ ও আমিরদের পানীয় জলের ব্যবস্থার নাম আবদারখানা। সেকালে বরফ ছিল না। গ্রীষ্মকালে ঠান্ডা পানীয় পাওয়া যেত না। তাই পানির জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করতে হতো। নতুন ঘড়ায় পানি ভরে রাখা হতো। পানি পানের জন্য থাকত মাটির তৈরি পাতলা পেয়ালা। ঘড়া ও পেয়ালায় ভিজে কাপড় জড়ানো হতো যাতে বাতাস লেগে কাপড় ঠান্ডা থাকে এবং তলার জলাধার ও পানিকে ঠান্ডা রাখে।

নবাবি সংস্কৃতি ও সুখাদ্যের শহর বলতে যে নামটি প্রথমে আসে তা হলো উত্তর ভারতের অযোদ্ধার লাখনৌ। লাখনৌর নবাবেরা মধ্য এশিয়া, মধ্য প্রাচ্য এবং উত্তর ভারতের রান্নার সাথে মোগলীয় রন্ধনশৈলীর সংমিশ্রণে ব্যাপক জনপ্রিয়তা ও নতুন নতুন খাবার তৈরিতে বিলাসী ভূমিকা রাখেন। এছাড়াও কাশ্মির, পাঞ্জাব, হায়দ্রারাবাদের নবাবদেরও অবদান কম নয়। কাবাব, কোরমা, কালিয়া, বিরিয়ানি, শিরমার, নেহারি, তাফতান রুটি, রুমালি রুটি, জর্দার ভিন্ন ভিন্ন প্রকার ভেদ তৈরিতে নতুনত্ব সবই তাদের সময়ের দান।

মোগল ও ব্রিটিশ আমলে নবাবদের খাদ্য বিলাসিতা ও সখ দেখে বাবুর্চিরা নতুন নতুন রান্না বের করার চেষ্টা করতেন। একজন বানিয়েছিলেন আনার দানার পোলাও। যার প্রতিটি দানা অর্ধেক সাদা, অর্ধেক লাল আর কাচের মতো ঝকঝকে। আরেকজনের আবিষ্কার নব রতন পোলাও। যা নয়টা রঙের চাল দিয়ে তৈরি। অযোদ্ধার নবাব আবুল কাশেম খান ছিলেন সৌখিন স্বভাবের মানুষ। তার বাড়িতে খুব মসলাদার পোলাও রান্না হতো। ৩৪ সের মাংস ফুটিয়ে রস বের করে তাতে সেদ্ধ করা হতো চাল। যা মুখে দিলেই মনে হতো সব দানা গলে হজম হয়ে গিয়েছে। এতই হালকা ছিল যে বোঝার উপায় থাকত না তাতে এত কিছু মেশানো হয়েছিল। তার চেয়েও নাকি আকর্ষণীয় পোলাও নবাব ওয়াজেদ আলী শাহের বেগম খাস মহল সাহেবাদের জন্য প্রায়ই রান্না হতো। আবার নবাব হোসেন আলী খান ছিলেন উঁচু দরের ভোজন রসিক। তার বাড়িতে প্রায় ২০ রকম পোলাও রান্না হতো। এজন্য তার নামই হয়ে গিয়েছিল “চাওয়াল ওয়ালে”। নবাবদের ঘরোনায় তৈরি এই সময়ে বিখ্যাত মতি পোলাও, চামেলি পোলাও, কোকা পোলাও, নূর পোলাও, গুলজার পোলাও ইত্যাদির নাম করা যায়।

আরেকজন নবাব আগা আলী খান ছিলেন ইরানের খোরাসানের নশপুরি বংশের সবচেয়ে খানদানি মানুষ। তিনি দিল্লির বাদশাহর জন্য ঘি ও রোগানি রুটি পাঠাতেন। এমন সুন্দরভাবে বানানো রুটি যা ছিল কাগজের মতো পাতলা। কোথাও একটু কাঁচা নয় এবং একফোঁটা দাগও চোখে পড়ত না। সঙ্গে সাধারণ ঘি নয় মিষ্টি ঘি খুবই যত্নে তৈরি করা হতো। ঘি নিয়ে অযোদ্ধার নবাব গাজী উদ্দিন হায়দারের (১৮১৪-১৮২৭) সময়ে একটি মজার গল্প প্রচলিত রয়েছে, নবাব পরোটা খেতে খুব ভালোবাসতেন এবং তার বাবুর্চি রোজ তার জন্য ছয়টা পরোটা বানাতেন এবং পরোটা পিছু নিতেন পাঁচ সের করে মোট ৩০ সের ঘি। একদিন প্রধান উজির মোতাম উদ-দৌলা আগা-মীর বাবুর্চিকে ডেকে জানতে চাইলেন এত ঘি লাগে কেন? বাবুর্চির সরল উত্তর পরোটা করি। উজির সন্তুষ্ট না হয়ে হুকুম দিলেন ঠিক আছে বানাও দেখি আমার সামনে। বাবুর্চি রোজকার মতো পরোটা বানালেন, যা বাঁচল বাবুর্চি ফেলে দিলেন। উজির তখন তাকে চেপে ধরলেন কই, সব ঘি তো লাগল না। বাবুর্চির জবাব, এখন এই ঘি তো একে বারে তেল হয়ে গেছে। এ আর কাজে লাগবে না। উজিরের সন্দেহ হলো তিনি বললেন এবার থেকে ৬ সের করে ঘি দেওয়া হবে। পরোটা পিছু এক সের ঘিই যথেষ্ট। এরপর পরোটার সেই আগের গুণ থাকল না। নবাব তার বাবুর্চিকে বকতেই তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, উজির সাহেব যে রকম পরোটা বানাতে বলেছেন আমি সেরকমই বানাচ্ছি। নবাব তখন ডাকলেন মোতাম উদ-দৌলাকে। উজির বাবুর্চিকে দোষ দিতে লাগলেন। বললেন, লোকটা ঘি চুরি করত আমি সেটা বন্ধ করে দিয়েছি। নবাব রেগে গিয়ে উজিরকে যথেষ্ট শাসন করলেন বললেন, তুমি চুরি করো না? ও একটু বেশি ঘি নিয়েছে, তাও আমার খাওয়ার জন্য, সেটাও তোমার সহ্য হচ্ছে না? এরপর থেকে বাবুর্চি আগের মতোই ঘি পেতে লাগলেন।

নবাবদের বাবুর্চিদের রান্নার উদ্ভাবনী গুণ ও হাতযশ ছিল তৎকালীন সময়ে কল্প কাহিনির মতো। তারা এমন সব রান্না তৈরি করতেন যা নবাবদের এখানে আগত অতিথিরা খেয়ে বিমোহিত হতেন। লাখনৌর এক বাবুর্চি “বাদাম কা সালান” (বাদামের সবজি) বানাতেন। একদম সিমের দানার মতো দেখতে ছিল আর খেতে তার চেয়েও ছিল অনেক ভালো। কোনো কোনো বাবুর্চি করলার মোসল্লাম বানাতেন এমন সুন্দর যা দেখলে মনে হতে কাঁচা। একমাত্র কেটে খেলেই বোঝা যেত এর স্বাদ। বাবুর্চি পীর আলীর খুব নাম ছিল অরহর ডালের জন্য। নবাবদের পছন্দের এই ডালকে বলা হতো সুলতানি ডাল। এই রকমই এক ঘটনা জানা যায়, লাখনৌর নবাব আলী নকি খান একদিন তার এক বন্ধুকে অনুরোধ করেন যেন রাতের খাবার একটু অপেক্ষা করে খান। তিনি কিছু পাঠাবেন। বন্ধুবর আশায় আশায় ছিলেন নবাব কী পাঠান তা দেখার জন্য। যখন খাবার এল, দেখা গেল খাঞ্জায় রাখা একটি আস্ত কাঁচা কুমড়া। তিনি হতাশ হয়ে নিজের রাঁধুনীকে ডেকে বলেছিলেন, রেখে দাও কাল রান্না হবে। শুনে নবাবের কর্মচারী যিনি খাঞ্জাটি বয়ে নিয়ে এসেছিলেন তিনি মাথা নিচু করে জানালেন হুজুর, এটা রান্না করাই, এখনই কেটে খেতে পারেন। বন্ধুবর মুখে দিতেই টের পেলেন কী অনাস্বাদিত পূর্ব অপরূপ খাদ্য।

ঢাকার নবাবেরা ভারতের কাশ্মির থেকে আগত। কাশ্মিরি নবাবি রান্নার সাথে স্থানীয় রান্নার বিভিন্ন উপকরণের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে তারা খাবারের বৈচিত্র্যতা দান করেছিলেন। যে কারণে এ সব বাদশাহি ও নবাবি খাবার দীর্ঘ দিনের খাদ্য অভ্যাসে স্থানীয় ঢাকায় বসবাসকারীদের খাদ্য সংস্কৃতিতে ঢুকে পড়ে। যা এখন ঢাকাই খাবার নামে পরিচিতি পেয়েছে। ঢাকার কিছু খাবার একান্তই নিজস্ব উদ্ভাবন আর কিছু খাবার স্বাদ বিচারে মোগলীয় খাবারের অনুরূপ।

অধ্যায় ১ / ২১

সকল অধ্যায়

১. প্রথম অধ্যায় – বাদশাহি ও নবাবি খাদ্য বিলাস
২. দ্বিতীয় অধ্যায় – ঢাকার রুটি
৩. তৃতীয় অধ্যায় – ঢাকার কাবাব
৪. চতুর্থ অধ্যায় – ঢাকার পোলাও ও বিরিয়ানি
৫. পঞ্চম অধ্যায় – মাংসের মসলাদার খাবার
৬. ষষ্ঠ অধ্যায় – বাংলা খাবার
৭. সপ্তম অধ্যায় – নাস্তা জাতীয় খাবার
৮. অষ্টম অধ্যায় – ঢাকার পানীয়
৯. নবম অধ্যায় – ঢাকার মিষ্টান্ন
১০. দশম অধ্যায় – ঢাকার পিঠা
১১. একাদশ অধ্যায় – ঢাকার বিশেষ খাবার
১২. দ্বাদশ অধ্যায় – খাদ্য পরিবেশন
১৩. ত্রয়োদশ অধ্যায় – ঢাকায় রমজানে সেহরি ও ইফতার
১৪. চতুর্দশ অধ্যায় – ধর্মীয় উৎসবের খাবার
১৫. পঞ্চদশ অধ্যায় – পান-হুক্কা-চা
১৬. ষষ্ঠদশ অধ্যায় – ঢাকার ক্যাটারিং, ডেকোরেটর ব্যবস্থা ও বাবুর্চিরা
১৭. সপ্তদশ অধ্যায় – ঢাকার নিরাপদ পানির ব্যবস্থাপনা
১৮. অষ্টাদশ অধ্যায় – হিন্দু সম্প্রদায়ের খাবার
১৯. ঊনবিংশ অধ্যায় – ঢাকার বিয়ের খাবার
২০. বিংশ অধ্যায় – ৪০ দশক পরবর্তী ঢাকার জনপ্রিয় খাবার ও পর্যালোচনা
২১. ২১. পরিশিষ্ট

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন