পঞ্চদশ অধ্যায় – পান-হুক্কা-চা

পঞ্চদশ অধ্যায় – পান-হুক্কা-চা

ঢাকার জীবনে সকল আনুষ্ঠানিকতায় পান অত্যাবশ্যক। অতিথি আপ্যায়ন সামাজিক রীতি-নীতিতে পানের বিচিত্র ব্যবহার ঢাকাবাসীরা লোকগল্পের জন্ম দিয়েছে। পান তৈরি, পরিবেশন পানের জন্য ব্যবহার্য বিভিন্ন পাত্র যা এর শ্রীবৃদ্ধি শুধু করেনি সাথে বৈচিত্র্যতাও দান করেছে। পান মূলত “বাংলা পান” নামেই পরিচিত। এর একটা প্রকার সাঁচি পান। যা নরম, ঝাঁজ কম এবং স্বাদের দিক থেকে ভালো এবং কিছুটা সুগন্ধি। ঢাকায় সাচি পানের কদর ছিল বেশি। যে কারণে ঢাকার একটা বাজারের নামই ছিল “সাঁচি পান দরীবাহ”। এলাকাটি বর্তমান ঢাকার বাদামতলি এলাকা।

জানা যায় সুলতানি আমল থেকে সোনারগাঁয়ের “কাফুরি” পান খুব প্ৰসিদ্ধ ছিল ছোট ছোট পাতলা অথচ মচমচে পান হতো যা খুবই সুগন্ধ যুক্ত এবং এই পান সোনারগাঁও থেকে দূর দূরান্তে উপহার হিসেবে পাঠানো হতো। কিন্তু ১৯১৯ সালের প্রচণ্ড সাইক্লোনের ফলে এই পানের সমস্ত চারা নষ্ট হয়ে যায়। যার ফলে এই পান এখন দুষ্প্রাপ্য এবং বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তখন ঘোড়াশাল, ময়মনসিংহের নান্দাইলসহ আরও কিছু এলাকা থেকে ঢাকায় পানের সরবরাহ আসত।

পানের ব্যবহারে তিনটি প্রয়োজনীয় অংশ খয়ের চুন ও সুপারি। খয়ের দেশের নিকটবর্তী জেলা থেকে আসলেও তিন ধরনের খয়ের ব্যবহৃত হতো। গ্রামের পাখরা খয়ের যাকে “পাপড়িয়া” বলে। আরেকটি কালো খয়ের যা গ্রামবাসীরা বেশি ব্যবহার করত এবং উত্তম প্রকার হচ্ছে সেই লাল খয়ের যাকে ঢাকায় “জনকপুরী” বলে। প্রথমত খয়ের কে পানিতে ভেজানো হতো এবং বারবার পানি বদলের ফলে লালিমা দূর হয়ে খয়েরের সাদা ভাব এসে যেত। তারপর খয়েরকে মাখানো হতো যাতে এর দানা দানা ভাব দূর হয় অতঃপর গোলাপ কেওড়া মিশিয়ে ছোট ছোট শুকনো টিকিয়া বানানো হতো। ব্যবহারের সময় আর একবার কেওড়ার পানিতে ভেজানো হতো। এই খাবারই জনকপুরি খয়ের নামে ঢাকায় জনপ্রিয়।

পানের চুন দুই ধরনের হয়ে থাকে পাথরের চুন যা সিলেট সংলগ্ন এলাকা থেকে আসত। এছাড়াও নোয়াখালি চট্টগ্রাম, ফরিদপুরসহ দক্ষিণ অঞ্চলের ঝিনুকের চুন ব্যবহার করা হতো। ঢাকার সম্ভ্রান্ত পরিবারে চুন পানিতে না ভিজিয়ে দইয়ের মধ্যে ভেজানো হতো। যাতে চুনের ঝাঁজ কমে গিয়ে জিব পুড়ে যাওয়ার ভয় না থাকে। চুন মাটির পাত্রে রাখা হতো যেন পাত্রের সঙ্গের বিক্রিয়ায় চুনের স্বাদের পরিবর্তন না হয়।

ঢাকায় সুপারি বরিশাল ও নোয়াখালী জেলা থেকে আসত। এর কয়েকটি প্রকার ভেদ আছে। বড় সুপারিকে “জাহাজি” বলে এবং আরেক প্রকার কে “মগওয়া” বলে। মগওয়া কাঁচা সুপারীকে দুধে জ্বাল দিয়ে শুকিয়ে বিক্রি করা হতো। এ কাজে মগ মূলত মায়ানমারের অধিবাসীরা করত যারা অনেক আগে থেকেই বরিশাল জেলার সুন্দরবন এলাকায় বসবাস করে আসছিল। স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে ঢাকার মগবাজার ও মগটুলি এলাকার নাম করা যায়। মগওয়া সুপারিকে দক্ষিণের ক্রেতারা নিয়ে যেত এবং তাকে পরিষ্কার করে চিকন টুকরা বানাতো। ঢাকার রমণীরা অবসরে বড় পারদর্শিতার সাথে সুপারি কাটত বলে অনেকে “সুপারি কাটা বেগম” নামের সম্ভাষণে ভূষিত হতেন।

পানের সংশ্লিষ্টতা ঢাকার জীবনে নানাভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। যুদ্ধের ময়দানে যাওয়ার সময় সুরমা, পানের বিড়া সঙ্গে নিয়ে যাওয়া হতো। বিদায়কালীন স্ত্রী স্বামীকে পান দিতেন। “পান-চিনি”ঢাকার পাত্র পাত্রীর বিবাহ সম্পর্কিত পাকা কথা শর্ত, দেনমোহর প্রভৃতি সম্পর্কে অভিভাবকদের বৈঠক। এই বৈঠকে মিষ্টি ও পান দিয়ে আপ্যায়ন করা সামাজিক রীতি হিসেবে গণ্য করা হয়। হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে সব সম্প্রদায়ের মাঝে এটি প্রচলিত ছিল। সম্ভ্রান্ত বংশের ভদ্রতা এবং সামাজিক পরিচয় ঢাকার অভিভাবক শ্রেণি পানের মাধ্যমেই নির্ধারণ করতেন। কোনো নিমন্ত্রণের জন্য পানের চারটি বিড়া পাঠানো হতো আমন্ত্রিত ব্যক্তির বাড়িতে। যদি আমন্ত্রিত বেড়াতে আসতে সম্মত হতেন তাহলে পানের পুরো চারটি বিড়া গ্রহণ করা হতো। আর না এলে দুটো রেখে বাকি দুটো ফেরত পাঠানোর রেওয়াজ ঢাকায় প্রচলিত ছিল।

পান সাধারণত খিলি রূপে তৈরি হয়। সিংগারা আকৃতির, কোথাও কোথাও মোরব্বার আকারেও পানের ব্যবহার দেখা যেত। পানের ব্যবহার্য পাত্র “খাশদান” (পানের খিলি রাখার সুদৃশ্য পাত্র) বাটা, ডাবর, পিকদান, ওগলদান এগুলোর আকৃতি প্রকৃতি, নিয়মনীতি নকশা অলঙ্কার মোগলীয় কৃষ্টির কথাই মনে করিয়ে দেয়।

ঢাকার পান বিক্রেতাদের কিছু বৈশিষ্ট্য না উল্লেখ করলেই নয়। যারা গলি গলিতে পানের দোকান দিতেন। বিকেল থেকে মাঝ রাত পর্যন্ত দোকান চালাতেন। জানা যায়, বিংশ শতকের গোড়াতেও এক পয়সায় চার খিলি পান পাওয়া যেত।

কলা পাতার খিলিতে করে, সাধারণত পান বিক্রি করা হতো। একে গোলাপি খিলি বলা হতো। পানের স্বাদ ছিল মিষ্টি, এরা যে খয়ের বানাত তাতে সাধারণত যষ্ঠি মধু মেশাত আর সাথে গোলাপ কেওড়া এলাচি ব্যবহার করতেন। ঢাকার এই সব দোকানে খুব ভিড় দেখা যেত। সাথে দোকানে অনেকে হুক্কাও রাখতেন। এইসব পান ওয়ালারা সকলেই মাথায় বাবরি চুল ও রঙিন পোশাক পরিধান করতেন। চোখে সুরমা, চুলে সিঁথি যা খুব সুন্দর করে আঁচড়াতেন। চাল চলনে মেয়েলিপনা এবং কথায় শুধু মহিলাদের প্রবচন ব্যবহার করতেন। চাল চলনে বিশেষ ভঙ্গিমা থাকলেও এরা হিজড়া ছিল না। সকলেরই সন্তান সন্ততি ছিল। এই লোকেরাই ঢাকার বিভিন্ন অনুষ্ঠান পার্বনে খিলি বানাত। বিভিন্ন মাহফিলে পানের সিংগারা সোনালি তবক লাগিয়ে পানের ডালা সাজিয়ে বকসিস পেতেন।

আরবি হাক্কা থেকে হুক্কা শব্দ। পারস্যে সাফভি রাজ বংশের হাত ধরে ভারতে মোগল সম্রাট আকবরের রাজ দরবারে সর্বত্রেই জনপ্রিয় হুক্কা। হুক্কা পান মোগল সময়ে অভিজাত ও ভদ্র সমাজের প্রতিক ছিল। ঢাকায় হুক্কার ব্যবহারে বৈচিত্র্যতা কোনো অংশে কম ছিল না। বাংলাদেশের গ্রাম বাংলার সমাজ জীবনে হুক্কা নিজস্ব পদ্ধতি থাকলেও শহর কেন্দ্রিক সমাজের হুক্কা পানের পদ্ধতিগত বিভিন্ন ব্যঞ্জনার ব্যবহার, পাত্রের বিচিত্র কারুকাজ, নকশায় রাজকীয় ভাব ও ব্যবহারকারীর রুচি ও আভিজাত্য প্রকাশই ঘটত। প্রাচীন ও প্রচলিত হুক্কা নারিকেলের শক্ত কোরার ব্যবহার এর কারণে পারস্যে “নারগিল” শব্দ থেকে চলে এসেছে বলে ধারণা করা হয়। উজবেক ও আফগানে চিলিম, মধ্যপ্রাচ্যে শিশা যা “ফারসি অর্থে গ্লাস”, মাদা, নানা শব্দেই হুক্কা ব্যবহৃত হয়। হুক্কা ঢাকার একটি শিল্প যা শুধুমাত্র হুক্কা পানের সঙ্গেই সম্পৃক্ত ছিল। অভিজাত সম্‌ভ্রান্তদের মধ্যে স্ফটিক ও বিদুরি (তামাকে শিশা দিয়ে নিকেল করা) হুক্কার প্রচলন ছিল। নিবিত্তের মধ্যে তামা, পিতল, দস্তা থেকে শুরু করে মাটির হুক্কার পর্যন্ত প্রচলন ছিল। উন্নতমানের কলকি ঢাকার কামাররা বানাতেন। কুমাররা বিদূরির নকলে মাটির তৈরি এমন ঝালোর বিশিষ্ট হুক্কা তৈরি করেছিলেন যা দূর থেকে বিদূরির হুক্কাই মনে হতো। এ কৃতিত্ব ছিল শুধু তাদের। ঢাকায় ধরন হিসেবে ২০-২৫ প্রকারের হুক্কার ব্যবহার ছিল আর ছিল হুক্কার নৈচা ও তামাকের অসংখ্য উদ্ভাবনি। নৈচা সম্‌ভ্রান্তরা অনেক দিন ব্যবহার করতেন। প্রস্তুতকারকরা বেশ মজমুত ও অনেক স্থায়ী করে তৈরি করতেন। নতুন নৈচা তৈরিতে ব্যবহার পূর্বক কয়লার আগুনে প্রভাবক দ্রব্যের গুঁড়া সুগন্ধকে বিগড়ে দেওয়ার জন্য ঔষধি মসলার ব্যবহার করে দুই দিকে কর্ক লাগিয়ে কয়েকদিন রাখা হতো। যা ছিল খাটুনি ও দক্ষতার ব্যাপার। ঢাকায় সাধারণত মতিহারি সাদা তামাকের বেশি প্রচলন ছিল। বাজার থেকে সাদা পাতা আনা হতো। ধুলো বালি দূর করার জন্য ধুয়ে শুকানো হতো। কেউ কেউ পাতার উপর চুনের প্রলেপ লাগাত যার ফলে তামাকের তেজ বৃদ্ধি পেত। ঢাকার কিছু বাড়িতে “কাওয়াম” খেতে বা বানাতে দেখা যেত। এর প্রক্রিয়া ছিল খুবই সাধারণ অর্থাৎ তামাকের পাতা দুই-তিন দিন যাবৎ পানিতে ভেজানো হতো অতঃপর গরম পানিতে জ্বাল দিয়ে পাতা কচলিয়ে নিয়ে ফেলে দেওয়া হতো। এবং যে নির্যাস থাকত তা আগুনো জ্বালিয়ে শুকানো হতো। সুগন্ধের জন্য এলাচি, দারুচিনি, লবঙ্গ পরিমাণ মতো মেশানে হতো। ঢাকার বাজারে ভারতের লাখনৌ থেকে সুগন্ধিযুক্ত কাওয়াম আমদানির সুবাদে এর ব্যবহার অনেকগুণ বৃদ্ধি পেতে থাকে। তামাক কড়া, মিঠা কড়া এবং খামিরা পান করা হতো। যা বাড়িতেই তৈরি হতো।

হুক্কার আনুষঙ্গিক জিনিস টিকিয়া ও গুল। টিকিয়া খুবই হালকা পাতলা এক কাঠি আগুনেই কয়েকটা জ্বালানো যেত। মধ্য যুগ থেকেই ঢাকায় টিকিয়া প্রস্তুতকারীরা বসবাস করে আসছিল যার একটা এলাকা বর্তমান টিকাটুলী নামে পরিচিত। গুল যা শুধুমাত্র তাওয়ারই কাজে আসে এবং এই গুলের বিশেষত্ব ছিল যে এটা অনেকক্ষণ পর্যন্ত আগুনে জ্বলে থাকে। বলা হতো যে যদি একটা জ্বলন্ত গুলকে উঠিয়ে পানিতে ডুবিয়ে সঙ্গে সঙ্গে হাওয়ার রাখা হয় তা পুনরায় জ্বলে উঠত যা ছিল একটি বিশেষ নৈপুণ্য। হুক্কার ব্যবসার পতনের সাথে সাথে এই নৈপুণ্য বিলুপ্ত হয়ে গেছে। হুক্কার পানিতে গোলাপজলে, কেওরাজল মিশ্রণ করে সুগন্ধি করা রীতি ছিল। ঢাকার কিছু প্রাচীন লোককে বার্মার সিগার ও পাইপ পান করতে দেখা যেত যা সংখ্যায় ছিল খুবই কম। ব্রিটিশ আমলে সম্ভবত ১৮৯৯ সালের দিকে ঢাকার মানুষ সিগারেটের সাথে পরিচিত হয়। কলকাতার ফেরত কিছু লোকের কাছে দেখা যেত বিড়ি। যা লোকেরা অবাক হয়েই তা দেখতেন।

চায়ের জন্মের অনেকগুলো পৌরণিক কাহিনি থাকলেও চা এর মূল উৎস ভূমি চীন। চীনা ভাষায় তেতো গুল্মকে বলা হতো “টেয়”। আবার জাপানিরা বলত “চিয়া”। এই শব্দটি থেকে ইংরেজি টি শব্দের উদ্ভব। যা থেকে এশিয়া মহাদেশে বিভিন্ন ভাষায় চা শব্দের উদ্ভব হয়েছে। প্রথমদিকে চা ঔষুধি হিসেবে প্রচলন থাকলেও ১৬ শতকে চা পানে বাণিজ্যিককরণে প্রসার ঘটতে সময় লাগেনি। পর্তুগিজরা চায়ের খোঁজ পেয়েছিল চীন ফেরত একদল ধর্ম যাজকদের মাধ্যমে। ১৬৬০ সালে ব্রিটিশ রাজা দ্বিতীয় চার্লসের সাথে পর্তুগিজ রাজকন্যার বিয়ে হয়। রানি স্বদেশ থেকে পাওয়া চা পানের অভ্যাস ব্রিটিশ রাজ পরিবারে আমদানি করতে সক্ষম হন। তখন থেকেই ব্রিটিশ জনগণের মধ্যে চা পান ও চা সম্পর্কে কৌতূহল তৈরি হতে থাকে। কিছুদিন পর ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, চীনের ক্যানটন (গুয়ানজু) শহরের বাণিজ্যিক বন্দর থেকে রুপোর বিনিময়ে ব্রিটেনে চা আমদানি করতে থাকে। চা ক্রমান্বয়ে সেখানকার প্রায় সব শ্রেণি বা পেশার মানুষের নিকট ক্লান্তি ও জীবনকে চাঙা করার এক দৈনন্দিন অপরিহার্য উষ্ণ পানীয় হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়।

বঙ্গ দেশে যে সব ইংরেজরা এসেছিলেন তাঁরাও চীন থেকে আনা চা-ই খেতেন। স্বদেশে চায়ের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তার কারণে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আর্থিক লাভ ভালোই হচ্ছিল। কিন্তু বড় সমস্যাটা বাধে ১৮৩৩ সালে আফিম যুদ্ধের সময়। ব্রিটেন ও চীনের মধ্যে বাণিজ্য সম্পর্কে চিড় ধরে, যার প্রভাব পরে চায়ের বাজারেও। তাই তাদের ভারতের জমিতে চা চাষের কথা ভাবতে হয়। চা চাষ সোজা বিষয় নয়। ১৭৭৪ সালেও চীন থেকে বীজ এনে এখানে চা চাষ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। আবার কোলকাতার শিবপুরের বোটানিক্যাল গার্ডেনেও গাছ লাগিয়ে তা বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা ফলপ্রসূ হয়নি। চা গাছের বৈজ্ঞানিক নাম “ক্যামেলিয়া সিনেনসিম”। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বোটানিস্টরা আসামে খুঁজে পেলেন এক বন্য জাতের ক্যামেলিয়া। বহু গবেষণার পর ১৮৩৭ সালে অবশেষে প্রথমবার আসামে পরীক্ষামূলক চায়ের আবাদ শুরু হয়। যা ভারতের সংগঠিত চা উৎপাদন শিল্পের গোড়াপত্তন ছিল। এই খবরটি পৌঁছে যায় লন্ডন ও ভারতের বিভিন্ন কোম্পানির কাছে। এখানে গড়ে উঠতে থাকে আসাম টি কোম্পানি, দ্য বেঙ্গল টি অ্যাসোসিয়েশন, কোকেরেল অ্যান্ড কোম্পানিসহ আরও প্রতিষ্ঠান। আসামের পর ১৮৪৫ সালের দিকে দার্জেলিংয়ে চা বাগান স্থাপনের উদ্যোগ নেন ব্রিটিশ সার্জন ডা. ক্যাম্পবেল। চীন থেকে আনা বীজ দিয়ে গড়ে তোলেন নার্সারি। অতঃপর ১৮৫৩ সালে বাণিজ্যিকভাবে বাগান তৈরি করে চা উৎপাদন শুরু হয়। ১৮৪৩ সালে চট্টগ্রামে বাণিজ্যিকভাবে চা উৎপাদন শুরু হয় এর পরের চল্লিশ বছরে সিলেট, মৌলভিবাজার, হবিগঞ্জ জেলার বিভিন্ন পাহাড়ি এলাকায় ব্রিটিশদের প্রচেষ্টায় উপযুক্ত জায়গা খুঁজে বের করে চা বাগান স্থাপন ও উৎপাদন শুরু হয়। ফিনলে কোম্পানির উদ্যোগে চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চলে চা শিল্পের দ্রুত বিস্তার ঘটে। ১৮৫৪ সালে সিলেটের মালনিছড়া টি এস্টেটে চা কেবল ব্রিটিশরা নিজেদের ও বাণিজ্যিক ব্যবহারে সীমাবদ্ধ ছিল। এ প্রসঙ্গে ১৯১০ সালে চট্টগ্রামে প্রশাসনিক কাজে থাকা অর্থার ড্যাশ তার স্মৃতি কথায় বলেন, “ফিনলে টি কোম্পানির দাবি চট্টগ্রাম বন্দরকে তাদের তৈরি শিপিং লাইনই পঞ্চাশ বছর ধরে এই বন্দরকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। আমদানি-রপ্তানির সুবিধার জন্যই বেঙ্গল রেল এখানে রেল লাইন ও স্টেশন স্থাপন করতে উদ্যোগী হন।” এতে ব্রিটিশদের চা উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো গুরুত্ব কিছুটা অনুধাবন করা যায়।

চা চাষ আর চা বাণিজ্য নিয়ে ব্রিটিশদের মাতামাতি থাকলেও উপমহাদেশে সাধারণের মাঝে এর প্রভাব ছিল না বললেই চলে। ১৯ শতকের শেষার্ধে এসে চা শহরের শিক্ষিত ও অভিজাত সম্পদশালী ব্যক্তিদের শখের পানীয় হিসেবেই সীমাবদ্ধ ছিল। আর সাধারণ মধ্যবিত্ত ও নিম্ন বিত্তের রোজকার পান অভ্যাসের গণ্ডিতে এসে পড়ে আরও পরে যা ২০ শতকে দ্বিতীয় দশকে।

ব্রিটিশদের বিনা পয়সায় চা ও সাধারণের চা বিলাসিতা

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ভারতের চা বাণিজ্যে সমস্যা তৈরি হয়। জাহাজ সংকট যুদ্ধ সংশ্লিষ্ট আরও কিছু সমস্যা ভারতে উৎপাদিত চা রপ্তানিতে ব্যাহত হচ্ছিল। বিশাল উৎপাদিত চা নিয়ে ভারতীয় চা কোম্পানি ও চা বোর্ড বেশ সমস্যায় পড়েন। এগিয়ে আসেন ইন্ডিয়ান টি মার্কেট এক্সপ্লেনেশন বোর্ড ও টি চেজ কমিটি। এই কমিটির অর্থ আসত ভারতের চা রপ্তানির উপর আদায়কৃত কর থেকে। তারা তাদের বাজার সম্প্রসারণের লক্ষ্যে দৃষ্টিপাত করেন ভারতের বিশাল জনগোষ্ঠির বাজারকে। এই কমিটির প্রধান কাজ ছিল চা পানের সুফল সম্পর্কে মানুষের মাঝে প্রচারণা চালানো। প্রচারণা যতই চলুক চা যে বিভিন্নভাবে উপকারী তা যদি জনগণের হাতের নাগালে আসছে ততক্ষণ কিন্তু চায়ের ব্যবসায়ীর কোনো লাভ নেই। এ অবস্থায় ভারত জুড়ে বড় বড় শহরে চায়ের দোকান স্থাপন শুরু হয়। খদ্দেরদের আকর্ষণ করতে বিভিন্ন আমোদ প্রমোদের ব্যবস্থা, সিনেমা, ভারতীয় অর্কেস্ট্রা. গ্রামোফোন, ঘরোয়া খেলাধুলা ও আকর্ষণীয় ডেকোরেশন সবই তারা ব্যবহার করতেন। চি চেজ কমিটির প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সারা ভারতে ৭০০ গ্রামোফোন, ২০০ হারমোনিয়াম, স্থানীয় ভাষায় ৮,০০০ রেকর্ড এবং ঘরোয়া খেলাধুলার জন্য অসংখ্য টেবিল তারা ব্যবহার করেছেন। খনি শ্রমিক, সেনাবাহিনী, কল-কারখানার শ্রমিকদের জন্য পর্যাপ্ত চায়ের সরবরাহ থাকত। পাটকলগুলোতে সারাদিন চায়ের দোকান খোলা থাকত। ১৯২০ ১৯২১ সময়ে মার্ক থন হিল তার সমকালের ভারত ভ্রমণের উপর অভিজ্ঞতা নিয়ে একটি গ্রন্থ রচনা করেন যার নাম “হন্টস হবিজ অব এ্যম ইন্ডিয়ান অফিসিয়াল”। সেখানে তিনি বর্ণনা করেন “চা পান ভারতীয় শ্রমিকদের মধ্যে এক ধরনের নতুন রীতি। কারখানা এলাকাগুলোতে চায়ের দোকান বেশ জনপ্রিয়। অনেকক্ষেত্রে এই দোকানগুলো সারাদিন খোলা থাকত। শ্রমিকরা এই সব দোকানে চা পানের জন্য ভিড় করতেন। আবার কিছু কারখানায় চায়ের দোকানে আসার সময় নির্দিষ্ট করা ছিল। অনেক কারখানায় চা পানের জন্য দুটি কক্ষ থাকত একটি মুসলমানদের অন্যটি হিন্দুদের জন্য। অবশ্য রান্না একটিই থাকত। কিন্তু চা বানানোর জন্য একজন উচ্চ বর্ণের হিন্দু ও একজন মুসলমান থাকতেন। পিতলের গ্লাসে দুধ ছাড়া শুধু চিনি দিয়ে এ চা পরিবেশন করা হতো। চা পানে শুধু ধৰ্ম নয় লিঙ্গ প্রশ্নটিও চলে আসত। কেননা নারী শ্রমিকদের দোকানের বাইরে বসে চা পান করতে হতো। তারা দোকানে ঢুকতে পারতেন না।”

রেল স্টেশনগুলোতে গড়ে উঠতে থাকে টি স্টল। দেয়ালে সাঁটানো হতো চায়ের বিজ্ঞাপন। রেল স্টেশনে চায়ের কেন্টিনে বিনামূল্যে চা পান এবং চা প্রস্তুত প্রণালীর ছাপানো নির্দেশিকা দেওয়া হতো। বাংলাদেশের রংপুরে কাউনিয়া, পাবনার ঈশ্বরদি স্টেশনে দেখা গেছে সেকালে এই চটকদার বিজ্ঞাপন চিত্র। তবে যেখানে যে ভাষা সেখানে সে ভাষায় নানা রকম চিত্রাকর্ষক রঙিন চা সংক্রান্ত বিজ্ঞাপন টাঙিয়ে রাখা হতো। বড় শহরের চৌরাস্তায় দোকান স্থাপন করে সবাইকে চা খাওয়ানো হতো। বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য ক্ষুদ্র মোড়কে এক পয়সার চা পাতাও বিনা পয়সায় বিলি করা হতো। ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের পরও ১৯৫১ সালে বরিশাল শহরে এমন কার্যক্রম চলতে দেখা যেত। নদীপথে চলত অ্যাসোসিয়েশনের নৌ-বহর ও প্রচারণা। প্রচারণায় ধর্ম ও সামাজিক শ্রেণিকে মাথায় রাখা হতো। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় ১৯১৫ সালে কোলকাতায় চায়ের দোকান ছিল ৪৪৪ টি। পরের বছর শেষ নাগাদ বৃদ্ধি পেয়ে যা হয় ১১২৪টি। ভারতের অন্যান্য বড় শহরের চিত্রটাও এমনই ছিল। দোকানগুলো বেসরকারি উদ্যোগে চললেও টি চেজ কমিটির তত্ত্বাবধায়ন থাকত দোকানিদের ভালো চা আর দক্ষতা বৃদ্ধির প্রচেষ্টায়।

মানুষকে চা খাওয়ানো গেলেও ছোট ছোট প্যাকেটে স্থানীয় বাজারে বিক্রি ছিল এক অসম্ভব প্রকল্প। কেননা চা বাতাস থেকে দূরে আর কাগজের ব্যাগ দিয়ে সেটা সুরক্ষা সম্ভব ছিল না। এ ছাড়াও প্যাকেট করার জন্য এত শ্রমিকের বেতন দেওয়াও ছিল ব্যয় সাপেক্ষ। কিন্তু টি চেজ কমিটি এ সমস্যার সমাধান বের করে ফেললেন। তারা ইনভেলাপের মতো কাগজের প্যাকেট তৈরি করেন যাতে ৬ কাপের চা পাতা রাখা যেত। আগ্রহী খুচরা চা বিক্রেতাদের এই প্যাকেটে সরবরাহ করা হতো। ক্রেতা সেখানে চা কিনতে এলে দোকানি তার টিন বা বাক্স থেকে সুরক্ষিত চা বের করে ইনভেলাপে ভরে বিক্রি করত। ইনভেলাপের উপর চারটি ভাষায় নির্দেশনাটি ছাপা থাকত। যেমন— “বাংলায় ছয় কাপ চায়ের জন্য প্যাকেটের মধ্যে থাকা চা ফুটন্ত পানিতে ঢালুন। স্বাদের জন্য দুধ ও চিনি যোগ করুন”। এভাবেই সরাসরি চায়ের পাতা বিক্রি শুরু হয়। ১৯১৮ সালে শুরু আর ১৯২০ সালের জুলাই নাগাদ ভারতজুড়ে ৭,০০০ দোকানে প্যাকেটে চা বিক্রি শুরু হয়। একই সময়ে টি চেজ কমিটি ৭০ লক্ষ ইনভেলাপ প্যাকেট সরবরাহ করে।

চায়ের প্রতি একদল বাঙালির আগ্রহ যেমন জন্মেছিল ঠিক তেমনি এর বিরুদ্ধে আরেকদল বাঙালি নেমেছিলেন বিদ্রোহ ঘোষণা করে। যে সব কারণ কখনো নির্মিত হয়েছে স্বাস্থ্যগত ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতাকে মিশিয়ে। আবার কখনো চা বাগানের শ্রমিকদের অধিকারের প্রসঙ্গটিকে ঘিরে। আন্দোলনে নেমেছিলেন অনেক বিখ্যাত বাঙালি ব্যক্তিত্ব। ব্রাহ্ম সমাজ থেকে প্রচারিত সঞ্জিবনী পত্রিকাতে এই নিয়ে বিভিন্ন খবরও প্রকাশিত হয়েছিল। এছাড়াও কেউ কেউ তুমুল স্বদেশিয়ানার আমলে ইংরেজের তৈরি পানীয় গ্রহণ করাটা গর্হিত অপরাধ বলে চা ছুঁতে চাননি। পক্ষে বিপক্ষে প্রচারণা যাই থাক চায়ের প্রচরণা এতে থেমে থাকেনি। আর বিরোধী প্রচারণা সত্ত্বেও তা হালে পানি পায়নি। চায়ের জয়যাত্রা অপ্রতিরোধ্য গতিতেই এগিয়ে চলেছিল।

বাঙালি বিখ্যাত ব্যক্তিদের মধ্যে স্বামী বিবেকানন্দের যেমন ছিল চায়ের প্রতি টান ঠিক তেমনি কবিগুরু রবিন্দ্রনাথের ছিল চা পানের ভীষণ আগ্রহ। শান্তি নিকেতনে চা চক্র এর এক পরিপূর্ণ আড্ডার নাম তিনি দিয়েছিলেন “চাক্র”। কবি কাজী নজরুল ইসলামের চায়ের প্রতি টান ছিল রীতিমত কিংবদন্তি তূল্য। কিছুক্ষণ পর পর তার চা না পেলে চলতই না। কথিত আছে চা ও পান দিয়ে তাকে একটি ঘরে আটকে রেখে বহু গান লিখিয়ে ও সুর করিয়ে নিয়েছিলেন গ্রামোফোন কোম্পানির কর্মকর্তারা। একবার কবি নজরুল বঙ্গীয় রাষ্ট্রীয় সমিতির আমন্ত্রণে ফরিদপুর গিয়েছিলেন এবং উঠলেন আরেক কবি পল্লি কবি জসিম উদ্দিনের বাড়িতে। কবি জসিম উদ্দীন “যাদের দেখেছি” স্মৃতি কথায় লিখলেন, রাতে বসল গানের আসর। রাত্রি বেলা এক মুসকিলে পড়া গেল। চা না পাইয়া কবি অস্থির হইয়া উঠিলেন। এই পাড়া গায়ে চা কোথায় পাইব? নদীর ওপারে গিয়া যে চা লইয়া আসিব তাহারও উপায় নাই। সাহস করিয়া কে এত বড় পদ্মা নদী পাড়ি দিবে? অনেক খোঁজা খুঁজির পর আলিম মাদবরের বাড়ি হতে কয়েকটা চায়ের পাতা বাহির হইল। চা পাতা গ্রামের লোকদের খাওয়াইয়া চা পাতা যখন কম হইয়া আসিত তখন তাহার সহিত কিছু শুকনো ঘাস পাতা মিশাইয়া চায়ের ভাঁড়ার তিনি অফুরান্ত রাখিতেন। কলিকাতা ভ্রমণের আশ্চর্য কাহিনি বলিতে বলিতে সেই চা পাতা আনিয়া কবিকে উপঢৌকন দিলেন। চা পাতা দেখিয়া কবির তখন কি আনন্দ! যাহার এত রন্ধন বিদ্যা জানা ছিল সমস্ত উজাড় করিয়া অবশেষে বদনায় ভর্তি হইয়া বৈঠকখানায় আগমন করিল। কবির সঙ্গে আমার ও তাহার কিঞ্চিত প্রসাদ পাইলাম। কবি তো মহাপুরুষ। চা পান করিতে করিতে চায়ের রাঁধুনীদের অজস্র প্রশংসা করিতেছিলেন। আমরাও ধুয়া ধরিলাম। গ্রাম্য চাষির বাড়িতে যত রকমের তরকারি রান্না হইয়া থাকে, সেই চায়ের মধ্যে তাহার সবগুলোই প্রসাদ মিশ্রিত ছিল।”

কার্যত ভারতের চায়ের বাজার সৃষ্টিতে এ সবই ছিল ব্রিটিশদের মস্তিষ্ক প্রসূত বিপনন কৌশল। চায়ের বাজারে মন্দা ধরেছিল বলে নাকি সে যুগে ভারতীয় মানুষের মধ্যে বাজার ধরবার জন্য এই সব নাছোরবান্দা ও রোমাঞ্চকর চেষ্টা তারা করেছিলেন। প্রকারান্তরে বিনে পয়সায় চা বাঙালিকে প্রতিদিনের সকালে বা বিকালে এক কাপ গরম চা গ্রহণে আসক্তি বা অভ্যাসের সংস্কৃতি দান করে।

ঢাকায় চায়ের আগমন

ঢাকায় ১৯ শতকের শেষের দিকে অভিজাত্য ও শিক্ষিত উচ্চবিত্তের মধ্যেই চা পান সীমাবদ্ধ ছিল। ঢাকায় অবস্থিত ব্রিটিশ, আরমেনীয় আর কাশ্মিরিদের বাড়িতেই মিলত চা নামক পানীয়টি। বলা হয় ঢাকায় ইংরেজদের পাশাপাশি আরমানীয় বণিকেরা শহরে চায়ের প্রসার ঘটান। ১৮৭০ সালে শাঁখারিবাজারে তারা খুলেন অভিজাত ও আধুনিক চায়ের দোকান। চায়ের গ্রাহক ছিলেন তাদের সম্প্রদায়ের এবং স্থানীয় কিছু অধিবাসী। তবে মোগল আমলে আসা ঢাকার কাশ্মিরিদের চা পানের অভ্যাস ছিল। তাদের ওখানে যাতায়াত কারী ব্যক্তিদের উপলক্ষে চা শহরে অল্প বিস্তার প্রসার লাভ করে। ঢাকার চা বলতে কাশ্মিরি চা’ই ছিল বিখ্যাত এবং তারাই ছিল এই চায়ের প্রসিদ্ধ কারিগর। ঢাকাতে কাশ্মিরিদের বিদায়ে চা পানে ভাটা পড়ে তবে ঢাকার নবাব খাজা আব্দুল গণিও নাকি প্রায় প্রত্যেক সকালে তার বাড়িতে চায়ের আসর বসাতেন। তিনি নিজেও প্রতিদিন চা খেতে ভালোবাসতেন। ঢাকার বেগুণবাড়ি এলাকায় তিনি ৩০ বিঘা জমি কিনে জঙ্গল পরিষ্কার করে চা চায়ের চেষ্টাও চালিয়ে ছিলেন। ১৯৪০ সালের পরে প্রচারণা ও আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে মধ্যবিত্ত শ্রেণিতেও চা পানের অভ্যাসটি তৈরি হয়। ঢাকার অলিগলিতে এখন অসংখ্য চায়ের দোকান গড়ে উঠলেও ৫০ এর দশকে একটি চায়ের দোকান খুঁজে পাওয়া ছিল মুশকিলই। এই সময়ে ঢাকায় অল্প বিস্তর গড়ে ওঠা চকবাজার, নবাবপুর, জনসন রোড, ফুলবাড়ি এলাকায় রেস্তোরাঁগুলোতে খাবারের পাশাপাশি সাধারণের চা পানের সুযোগ ঘটে। বিস্তৃতি ঘটতে থাকে শহরের গুরুত্বপূর্ণ মোড় আর এলাকাগুলোতে। চা বলতে লিকার চিনি মিশ্রিত কালো রং চা আবার ঢাকাই লোকজনের পছন্দ ছিল না। চা বলতে তারা বুঝতো ঘন দুধের সাথে সর, চিনি আর লিকার। যা ঢাকাই ভাষায় “মালাই ভাসাকে চা” বলা হতো। সেই সময়ে চকবাজারে রওশন মিয়ার খাঁটি গরুর দুধের মালাই ভাসাকে চা খেতে দূর দূরান্ত থেকে লোক আসতেন। ঢাকার ৭০ দশকে চায়ের দোকানগুলোতে গ্রাহক আকর্ষণের জন্য রেডিও বাজানো হতো। সকাল সন্ধ্যা গান, দেশের সংবাদ শুনতে ক্রেতার ভিড় বাড়ত এবং জমত ব্যবসা, বসত আসর বা আড্ডা আর সাথে চা। উচ্চবিত্ত থেকে নিম্নবিত্তের চা এখন একটি অত্যাবশ্যকীয় পানীয়। চা পানের অভ্যাস এখন নিছক নেশা নয় এ এক সহজ বিলাসিতা।

কাশ্মিরি চা

কাশ্মিরি চা দুই ধরনের-একটা “নামকিন চা” বা “গোলাবি চা”(লবণ) আরেকটি “শির চা” (মিষ্টি)। চা কাশ্মিরিদের ঐতিহ্যবাহী পানীয়, দিনে দুই থেকে তিন বার রুটির (শিরমাল, বাখরখানি, কুলচা, লাবাসা) সাথে পান করে থাকে। ঢাকায় কাশ্মিরি চা বর্তমানের ব্যবহার নাই কারণ হিসেবে বলা যায় প্রক্রিয়াগত সময় উপকরণগত মূল্য ও মিশ্রণের কারণেই এই পানীয় ঢাকায় বিলুপ্ত ঘটেছে। কাশ্মিরি চা তৈরির পাত্রকে বলা হয় “সমভার”। এক ধরনের রাশিয়ান চা পাত্র যা আগুনসহ বহনযোগ্য। জ্বালানী হিসেবে কয়লার ব্যবহার করা হয়। সমভার পাত্রের ধাতু পিতল লোহা, ব্রোঞ্জ, ব্রাশ, কপার, রৌপ্য ব্যবহারসহ অসংখ্য সুন্দর কারুকাজ নকশায় ও আকারে বৈচিত্র্যতার উপস্থিতি যা শিল্পের রূপ দান করে ছিল। সাধারণত বাড়িতে এক লিটার পরিমাপের সমভার ব্যবহারের প্রচলন ছিল। ঢাকার কাশ্মিরিরা কপারের সমভার ব্যবহার করতেন বেশি।

ঢাকায় তৈরি নামকিন চা বা গোলাবী চায়ের প্রস্তুত প্রণালীটা অনেকটা এই রকম ছিল। ৪ কাপ চার এর জন্য ২ চা চামচ চা পাতা, ১/২ চা চামচ বেকিংসোডা, ১ কাপ পূর্ণননীযুক্ত দুধ (শীর চার জন্য)৬ থেকে ৮ কাপ পানি সমভার না থাকায় যা চুলায়ও তৈরি করা যায়। প্রথম বিশ মিনিট চা পাতা মাঝারি আঁচে দেড় কাপ পানিতে সিদ্ধ করতে হবে। আবার দেড় কাপ পানি যোগ করে হালকা আঁচে রাখতে হবে। চা পাতা মন্ড বা জাউয়ের মতো দেখতে হওয়া পর্যন্ত তারপর পাতা ছেঁকে ফেলতে হবে। এরপর সাড়ে তিন কাপ পানি দিয়ে আবার হালকা আঁচে সিদ্ধ করতে হবে অনেক সময় ধরে, এরপর বেকিং সোডা যোগ করে বড় হাতলের চামচ দিয়ে নারতে হবে। চায়ে গোলাপি রং চলে আসলে লবণ যোগ করতে হবে। ৩০ মিনিট রেখে ঠান্ডা করলে তৈরি হয়ে যায় নামকিন চা। শির চায়ের জন্য পূর্ণ ননীযুক্ত দুধ বা এক কাপ মালাই চিনির প্রয়োজন। এই চা তৈরিতে দেড় থেকে দুই ঘণ্টা সময় প্রয়োজন যা ধৈর্য ও সূক্ষ্ম খেয়ালে তৈরি করতে হয় নচেৎ তা পান উপযোগী থাকে না। এটা সংরক্ষণ করেও পান করা যায়। শুধু পানের পূর্বে চাকে চুলায় হালকা জ্বাল দিয়ে দুধ চিনি বা লবণ মিশিয়ে পান করা যায়। পাহাড়ী ঘন ও কড়া সবুজ পাতা কাশ্মিরি চায়ের আদর্শ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। আরেকটি বিষয় কাশ্মিরি চা তৈরিতে মূল উপাদানগুলো ছাড়াও পরিবেশনের পূর্বে বিভিন্ন মসলা ও বাদামের মিশ্রণ যেমন গোল মরিচ, দারুচিনি, এলাচির বিচি, বাদাম, পেস্তা বাদামের পেস্ট যোগ করে পানীয়কে আরও স্বাদ যুক্ত করতে মধ্য এশিয়াসহ অনেক দেশে কাশ্মিরি চা’র বিবর্তিত রূপ দান করতে দেখা যায়।

সকল অধ্যায়

১. প্রথম অধ্যায় – বাদশাহি ও নবাবি খাদ্য বিলাস
২. দ্বিতীয় অধ্যায় – ঢাকার রুটি
৩. তৃতীয় অধ্যায় – ঢাকার কাবাব
৪. চতুর্থ অধ্যায় – ঢাকার পোলাও ও বিরিয়ানি
৫. পঞ্চম অধ্যায় – মাংসের মসলাদার খাবার
৬. ষষ্ঠ অধ্যায় – বাংলা খাবার
৭. সপ্তম অধ্যায় – নাস্তা জাতীয় খাবার
৮. অষ্টম অধ্যায় – ঢাকার পানীয়
৯. নবম অধ্যায় – ঢাকার মিষ্টান্ন
১০. দশম অধ্যায় – ঢাকার পিঠা
১১. একাদশ অধ্যায় – ঢাকার বিশেষ খাবার
১২. দ্বাদশ অধ্যায় – খাদ্য পরিবেশন
১৩. ত্রয়োদশ অধ্যায় – ঢাকায় রমজানে সেহরি ও ইফতার
১৪. চতুর্দশ অধ্যায় – ধর্মীয় উৎসবের খাবার
১৫. পঞ্চদশ অধ্যায় – পান-হুক্কা-চা
১৬. ষষ্ঠদশ অধ্যায় – ঢাকার ক্যাটারিং, ডেকোরেটর ব্যবস্থা ও বাবুর্চিরা
১৭. সপ্তদশ অধ্যায় – ঢাকার নিরাপদ পানির ব্যবস্থাপনা
১৮. অষ্টাদশ অধ্যায় – হিন্দু সম্প্রদায়ের খাবার
১৯. ঊনবিংশ অধ্যায় – ঢাকার বিয়ের খাবার
২০. বিংশ অধ্যায় – ৪০ দশক পরবর্তী ঢাকার জনপ্রিয় খাবার ও পর্যালোচনা
২১. ২১. পরিশিষ্ট

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন