চতুর্থ অধ্যায় – ঢাকার পোলাও ও বিরিয়ানি
পোলাও শব্দটি ফারসি “পুলাও” বা “পিলাও” থেকে উৎপত্তি। প্রাচীন সংস্কৃত শব্দ “পল্লাও” অনুরূপ শব্দ ছিল। অপরদিকে ফারসি শব্দ বিরিয়ান থেকে বিরিয়ানি শব্দের আগমন। যার অর্থ ভাজা বা ঝলসানো। বিরিয়ানির আগে থেকেই পোলাও এর প্রচলন ছিল। তাই সেই অর্থে পোলাও থেকে বিরিয়ানির সৃষ্টি বলা যায়। পোলাও আর বিরিয়ানির পার্থক্য হলো পোলাও এর চাল, মাংস, বিকল্পে সবজি এক সঙ্গে রান্নার নিয়ম কিন্তু বিরিয়ানিতে চাল ও মাংস বা সবজি আলাদাভাবে রান্না হয় পরে যা হাঁড়ির মধ্যে পরতে পরতে ঢালা হয়।
যাই হোক ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায় নামের বা শব্দের উৎস নিয়ে মতভেদ থাকলেও পোলাও মোগল আমলের অবদান এমন দাবি কেউ করেন না। যদিও এই পদটির মোগল রান্না ঘরে অনেক সূক্ষ্মতা পেয়েছে। পৃথিবীর নানান দেশ ও সংস্কৃতিতে বিভিন্ন নামে পোলাও ইরান, আফগানিস্তান, তাজিকিস্তান, উজবেকিস্তান, আজারবাইজান, স্পেন, রাশিয়া, গ্রিস, তুরস্ক, আরবসহ অনেক দেশেই প্রচলন আছে। তবে ১১ শতকের মধ্য যুগে অন্যতম দার্শনিক ও চিকিৎসক আবু আলী ইবনে সিনার লেখা চিকিৎসা সংক্রান্ত বইতে স্বাস্থ্যসম্মত রান্নার তালিকায় পোলাও এর নাম পাওয়া যায়। যে কারণে উজবেক ও তাজিকরা ইবনে সিনাকে পোলাও এর জনক মনে করেন।
অপরদিকে ইরানের বিরিয়ানি শ্রীবৃদ্ধি মোগল বাদশাহদের রান্না ঘরে। অতীতেও বিরিয়ানি নিয়ে নানান গল্প প্রচলিত ছিল। কেউ কেউ শব্দের উৎস অনুসরণ করে বিরিয়ানির জন্ম খোঁজেন খোদ পারস্যে। অবার কাজাকিস্তান থেকে তৈমুর লং বিরিয়ানি সঙ্গেই নিয়ে এসেছেন এমন দাবিও শোনা যায়। আবার বলা হয় শাহজাহান পত্নী মমতাজ মহলেই নাকি সৈনিকদের সুষম আহার যোগাতে বিরিয়ানি রান্নার পরামর্শ দিয়েছিলেন সেনা ছাউনির বাবুর্চিদের। তবে কার মাথা থেকে বিরিয়ানির ভাবনা বেরিয়েছিল ইতিহাসে তা লেখা নেই। আরব- বেদুইনেরাও চাল, মাংস ও মসলা গরম বালিতে চাপা দিয়ে তৈরি করত বিরিয়ানি জাতীয় খাবার। বিবিয়ানির বহু রকমফের রয়েছে যার স্বাদও ভিন্ন ভিন্ন। অঞ্চল ভেদে রয়েছে আঞ্চলিক রূপ। যেমন- ভারতের হায়দ্রাবাদ নিজাম আমলের কাচ্চি বিরিয়ানি, কনাটকের ভাটকালি বিরিয়ানি, গুজরাটের কচ্ছ বিরিয়ানি, মাদ্রাজের মাদ্রাজি বিরিয়ানি, অবধের লকনবি বিরিয়ানি, সিন্ধুর সিন্দি বিরিয়ানি, কলকাতার কলকাতিয়া বিরিয়ানি আর ঢাকার বিশিষ্ট কাচ্চি বিরিয়ানি।
দমপকত্ কথাটা ফারসি হলেও বিরিয়ানির দম দেওয়া পদ্ধতিটা ইরান থেকে এসেছে। যা বলার অপেক্ষা রাখে না। ঠিক একইভাবে পোলাও তার বিচিত্র রূপ মোগল শৈলীর মাধ্যমে নানাভাবে ব্যবহার হয়েছে। কাবুলি মহব্বত খানি পোলাও, কুকু পোলাও, কাবুলি পোলাও, কুন্দন পোলাও, কোফতা পোলাও, কোর্মা পোলাও, গিলানী পোলাও, জর্দা পোলাও, বাজমা পোলাও, মোরগ পোলাও, মতি পোলাও, সিরাজি পোলাও, নারঙ্গি পোলাও, পুরি পোলাও, মাহি পোলাও, মতাঞ্জান পোলাও, বাদাম পোলাও, নারকেলি পোলাও, কাশ্মিরি পোলাও, খুসকা পোলাও, দিলখুশ পোলাও— এখানেই তালিকার শেষ নয়; রয়েছে আরও নানান রকমের পোলাও এর পদ। ঢাকার সব পোলাও কম বেশি রান্না হলেও নিজস্ব কিছু উদ্ভাবিত পোলাও রয়েছে। জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতার বিচারে ঢাকার বিশিষ্ট খাবার “মোরগ পোলাও” আর “কাচ্চি বিরিয়ানি”।
পোলাওকে দুইভাবে রান্না করা যায়। প্রথমত কাঁচা পানিতে পোলাও এর চাল সিদ্ধ করার পর চালের মাড় গলানো অর্থাৎ পাশানো হয়। তারপর চালের দানার পোক্ততা পরীক্ষা করে প্রয়োজনীয় উপকরণ ঢেলে দম দিলেই তৈরি হয় পাশানো পোলাও। আরেকটিকে বলে “লাপেটা” যা হিন্দি শব্দ থেকে এসেছে অর্থাৎ যে পোলাও রান্না করার সময় চালের মাড় গলানো বা পাশানো হয় না। পাশানো পোলার ঢাকাই লোকজন পছন্দ করে না। পোলাও ঢাকাই জীবনের অন্যতম খাবার। খুশি, উৎসব, অনুষ্ঠান, শোক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান এমন উপলক্ষ নাই যে ঢাকাবাসীরা পোলাও খাবার গ্রহণ করে না। সময়ের বিবর্তনে ঢাকা অনেক পোলাও এর নাম ও পদ্ধতি হারিয়ে গেলেও আদি ঢাকাই লোকেরা এখনও এর সংস্কার ও ঐতিহ্য ধরে রেখেছে।
সাধারণভাবে সাদা পোলাও যে পদ্ধতিতেই রান্না হোক না কেন তাকে ঢাকাই লোকেরা হোগলা পোলাও নামেও ডাকে। মূলত একসময় বাংলাদেশের গ্রামে গঞ্জে বড় অনুষ্ঠান বা আয়োজনে বেশি মানুষের খাবার জন্য পর্যাপ্ত ডেগ বা পাতিলের ব্যবস্থা ছিল না। এবং ভালো পোলাও রান্নার বাবুর্চিও পাওয়া যেত না। ফলে পোলাও পাশানো পদ্ধতিতে রান্নার পর হোগলা বা বড় পাটিতে তা ঢেলে রেখে তার উপরে ঘি ছিটিয়ে দেওয়া হতো। যুগের সাথে উন্নতি ও ডেকোরেটর আসবাবের যোগানের প্রাপ্যতা বৃদ্ধি পেলেও ঢাকাই ভাষায় হোগলা পোলাও নামটি রয়ে গেছে। সব সময় এবং সাধারণ পোলাও হিসেবে সব জায়গা ও বাসা বাড়িতে সাদা পোলাও রান্নার প্রচলন রয়েছে।
এটিই হচ্ছে ঢাকার বিশিষ্ট পোলাও। মোরগ পোলাও মূলত মোগলদের কাছ থেকে পাওয়া। ঢাকার উচ্চ অভিজাত শ্রেণির দাওয়াত ও অনুষ্ঠানে অতিথিদের রসনা তৃপ্তির আকর্ষণ হতো মোরগ পোলাও। যার আরেক নাম “খাচ্চা পোলাও” যা এখন মোরগ পোলাও নামে বিশিষ্ট খাবার। ঢাকাবাসীরা বর্তমান যে পদ্ধতিতে মোরগ পোলাও রান্না করে তা মোগলীয় রন্ধনের প্রক্রিয়ার কিছুটা ব্যতিক্রম। ফলে স্বাদ, সুবাস ও বৈচিত্র্য ছিল ভিন্নরূপ। যাই হোক ঢাকা বিশিষ্ট পোলাও তৈরিতে এক কেজি চালে (চিনিগুঁড়া), চারটি মোরগের ১৬ টুকরা মাংস, যা হালকা কোরমার মতো করে কসিয়ে কিসমিস, বাদাম, আলু বোখারা, ঘি, খাঁটি দুধের মালাই, জাফরান দিয়ে তৈরি হয় আদর্শ মোরগ পোলাও। তৈরির প্রক্রিয়াটা হলো মাংস আর চাল এলোমোলো মেশানো, মাংস খাস্তা হবে, চাল ও মাংস একসঙ্গে মিলানো সত্ত্বেও আলাদা আলাদা দেখা যাবে, চালে তৈলাক্ততা এমনভাবে প্রবিষ্ট হবে যেন চাল থেকে তৈলাক্ত রস বের না হয় বরং প্রতিটি চালের পেট ঘিয়ে পরিপূর্ণ থাকবে। মোগলীয় রীতিতে পেশওয়ারি চাল ও অন্যান্য উপকরণের সামান্য পার্থক্য থাকলেও তৈরি পদ্ধতি প্রায় একই। তবে আমাদের দিনাজপুরের কালোজিরা বা চিনিগুঁড়া চালের মান ও সুগন্ধ অন্য যে কোনো চালের তুলনায় সেরা। মোগল দরবারেও এই চালের প্রবেশ বাংলাদেশ থেকে যাবার ইতিহাস জানা যায়।
সোয়াই শাক বা শুয়ো শাক প্রধান পোলাও। আশ্বিন মাসে ঢাকার আকাশে রং বদলের বাজারে আসে তখন বাজারে আসে শুয়ো শাক। বাড়িতে বাড়িতে খাবার টেবিলে এই পোলাও শীতের আগমন বার্তা নিয়ে আসত। যা বর্তমানে বিলুপ্ত প্ৰায়।
ফারসি শব্দ শাবাত অর্থ বীজ। শাবাত পোলাও বীজ সবজির পোলাও। মালগুবা হিন্দি শব্দের অর্থ পাঁচ মিশালি। সবজি পোলাও এর সঙ্গে মাংস সংমিশ্রণে তৈরি হয় মালগুবা পোলাও। তবে অবশ্যই কয়েক পদের সবজি থাকতে হবে। মালগুবা মোগলও আরমানীয় পরিবারের বিশিষ্ট খাবার। তারা মোরগের পরিবর্তে খাসির চর্বিহীন মাংস, সম ওজনের চাল ও মাংস, কপি, গাজর, শালগম, বিট, টমাটো ভেজে দমের সাথে রান্না করত। ইরানিদের এবং ঢাকায় বসবাসকারী মোগল ও আরমানীয় পরিবারগুলোতে যা উত্তম রূপে রান্না হতো। যদিও টমাটো অনেক পরবর্তী সংযোজন। এই মালগুবা পোলাও প্রক্রিয়ার আরেকটি সংস্করণ ডিম, পালং শাক দিয়ে “মাগরুবা পোলাও” যাকে আমরা “নার্গেসি পোলাও” নামে জানি যা বর্তমানে এ নামে পরিচিতি পেয়েছে।
বর্তমান ঢাকাসহ দেশের সবচেয়ে বেশি প্রচলিত খাবার তেহারি। তেহারি শব্দের অর্থ আরবিতে শুদ্ধ, হিন্দিতে সকালের মন ভালো করা খাবার। মোগল ও নবাবদের ফৌজিদের সকালের খাবার হিসেবে তৈরি করা হতো। যা মুসলিম নবাবদের রন্ধনশালায় উৎকর্ষতা লাভ করে যা প্রশাসনিক কাজের কর্মচারী, ফৌজি, হিসাবরক্ষণ, অর্থ বিষয়ক কর্মকর্তাদের জন্য তৈরি হতো এই বিশেষ তেহারি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রভাবে অন্যান্য জিনিসের সাথে মাংসের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যায়। ফলে খাদ্য হিসেবে সহজ ও সাশ্রয়ী তেহারি জনপ্রিয়তা লাভ করে। মাংসের পরিবর্তে সবজি ও আলু ব্যবহারে তেহারি ছিল মধ্যবিত্তের প্রিয় খাবার। ঢাকায় উনিশ শতকের শুরুতে বিভিন্ন অলি গলিতে সকাল সকাল ফেরিওলাদের গরম গরম তেহারি বিক্রি করতে দেখা যেত। সুস্বাদু তেহারি প্রথমে মধ্যবিত্তের খাবার হলেও পরে অভিজাত শ্রেণিতে সমাদর অর্জন করতে সময় লাগেনি। উপমহাদেশে তেহারি তৈরিতে নানা ভেদ থাকলেও ঢাকার তেহারির বিশেষত খাসির মাংস ও সরিষার তেল— যা অন্যান্য তেহারি থেকে ভিন্নতা দান করেছে। চাল মাংস মসলাসহ দম পদ্ধতিতে রান্না হলেও তেহারিতে মটরশুঁটি, টমেটো প্রয়োগে তৈরি হতো “টমেটোর তেহারি”। ঢাকার বিশেষ বিশেষ পরিবারে টমেটোর তেহারি শীতকালে তৈরি হতে দেখা যেত। তেহারির জনপ্রিয়তা এখন ভোজন বিলাসীদের কাছে ঐতিহ্য হিসেবে দেখা দিয়েছে। যদিও ঢাকাই লোকদের সকালে পোলাও খাবার অভ্যাস ও রীতি ছিল। যা সকাল সকাল তেহারি বিক্রির ফেরিওয়ালাদের বিশেষ অবদান হিসেবে দেখা হয়
মতানঞ্জান ফারসি শব্দ যার অর্থ “মিষ্টি খাবার বিশেষ”। মতানঞ্জান একটি রঙিন ও মিষ্টি বিরিয়ানি জাতীয় খাবার যা খাসি, ভেড়া বা দুম্বার মাংস দিয়ে তৈরি হয়। যার নাম ও স্বাদ এবং তৈরি প্রক্রিয়া ঢাকাবাসীর বিলুপ্ত খাদ্যের তালিকায় চলে গেছে।
কাবুলি প্রকৃতপক্ষে খিচুড়ি গোত্রের। ঢাকার কাবুলি পোলাও মূল কাবুলি পোলাও থেকে একটু আলাদা। আফগানদের প্রধান ও জনপ্রিয় খাবার কাবুলিতে খাসির মাংসের টুকরো, বাসমতি চাল, সবুজ মটর দানা, গাজরের টুকরো, কমলার খোসা ও বাদামের ব্যবহার থাকলেও ঢাকার কাবুলি পোলাও তৈরিতে সবুজ বুট, খোসা ছাড়ানো মটরশুঁটি দানা মোরগ পোলাও এর ন্যায় সের প্রতি তিনটি মোরগ যা সম বয়স্ক একরূপ হয়। ক্ষেত্র বিশেষে মোরগের পরিবর্তে নোনতা ছোট কোফতা প্রয়োগ পছন্দনীয়। এইরূপ কাবুলি পোলাও এমনি রং রূপ সৃষ্টি করে ফেলেছে যা ঢাকার প্রত্যেক জায়গায় সমাদৃত হতো। সিমের বিচির কাবুলি রান্না স্বাদ ও সৌন্দর্যে ঢাকাবাসীর পছন্দনীয় নয়। কাবুলি রন্ধন প্রক্রিয়াটা ভিন্ন এবং পরিবেশনে পাত্রের শোভা বৃদ্ধি করে। কালের গর্ভে ঢাকাবাসীদের এই প্রিয় খাবার হারিয়ে যেতে বসেছে।
ঢাকাবাসীর বর্ষাকালে খিচুড়ি খেতে খুবই আগ্রহী। পোলাও চাল, ভাজা মুগের খিচুড়ি অন্য জায়গাতে যেমন রান্না হয়ে থাকে এখানেও অনুরূপ রান্না হয়। এখানে সিদ্ধ ডিম ঘিতে ভেজে অপরিহার্যভাবে খিচুড়িতে প্রয়োগ করা হয়। সাধারণভাবে খিচুড়ির সঙ্গে মোরগ বা খাসির দো পিয়াজোর ব্যবহার করা হয়। কিছু পরিবারে মাংসের কিমা প্রয়োগের রীতিও দেখা যায়। খিচুড়িতে পনির প্রয়োগ ঢাকাবাসীর নিজস্ব উদ্ভাবন। এতে যথেষ্ট নৈপুণ্যতার প্রয়োজন পড়ে। মসুর, ছোলা, মাসকালের ডাল ব্যবহারে খিচুড়ি কম বেশি রান্না হতে দেখা যায়। খিচুড়ি রান্না প্রক্রিয়া পোলাও রান্নার দম প্রক্রিয়ার মতো। চাটনি বা আচার সহযোগে বর্ষা ও শীতের সময় ঢাকায় খিচুড়ি খাওয়ার আয়োজন হতো। ঢাকায় সবজি খিচুড়ি হিন্দু সম্প্রদায়ের একটি প্রিয় খাবার। বিশেষ প্রক্রিয়া নৈপুণ্যের মাধ্যমে এই খিচুড়ি তৈরিতে তারাই ছিল সেরা।
মধ্য এশিয়ার তুর্কি খাবার, শীত প্রধান ‘সমরখন্দ’ তুর্ক চাগতাই ভাষায় যার অর্থ চর্বির শহর। মোটা চর্বির লেয়ার যুক্ত লাল মাংসের খাবার যা সাধারণত ভেড়া বা খাসির মাংস থেকে পাওয়া যায়। যা গরুর মাংসের ভিতরে এতটা স্তরীভূত চর্বি থাকে না তাই কাচ্চির জন্য ভেড়া বা খাসির মাংসই আদর্শ। কাচ্চি রান্নায় অল্প আঁচে রান্না করার কারণে মাংসের চর্বি গলে গিয়ে চালের সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে কাচ্চির অপূর্ব স্বাদটা তৈরি করে। তুর্কিরা এই খাবারে লবঙ্গ ক্ষেত্র বিশেষে হিং, মাখন, গোল মরিচ, এলাচ ও স্থানীয় মসলায় সংমিশ্রণ ঘটাত। শীত প্রধান এই অঞ্চলগুলোতে এই খাবারের প্রচলন শুরু করে তুর্কি চাগতাইরা, কাবুল অবস্থানের সময় গজনির কিসমিস, জাফরান মিশে কাচ্চির নতুনত্ব দান করে। তুর্কি বা মোগলের ভারতে আগমনে কাচ্চির সাথে যোগ হয় কাশ্মিরি জাফরান, লবঙ্গ, দারুচিনি, জয়ত্রির সংমিশ্রন, মাখনের পরিবর্তে খাঁটি ঘি। জানা যায় মোঘল বাদশাহ জাহাঙ্গীরের সময় কাচ্চিতে আমদানি হয় আলু, টমেটু, ঘি-তে দেওয়া শুকনো মরিচের ফোরন, যা সমগ্র ভারতবর্ষ হয়ে ঢাকার খাদ্যে বিশেষ স্থান করে নিয়েছে। মোগল যাদের পাতে এক সময় চর্বিতে ডুবিয়ে রাখা বুড়ো ঘোড়ার মাংস আর শালগমের দুই এক টুকরো ছাড়া আর কিছুই জুটত না সেই তারাই পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী আর রূপকথা তুল্য এক সালতানাতের জন্মদাতা। সেই তারাই জন্ম দিয়েছে পৃথিবীর সমচেয়ে সুস্বাদু খাবারগুলো। ঢাকার অভিজাত পরিবার ও বিবাহ অনুষ্ঠানে জনপ্রিয় খাবার কাচ্চি বিরিয়ানি। ঢাকার কাচ্চিতে চিনিগুঁড়া বা কালিজিরা চাল ব্যবহার হলেও কলকাতার রন্ধনে বাসমতি চালের ব্যবহার দেখা যায়। খুব দক্ষ বাবুর্চি বা রাঁধুনি ছাড়া কাচ্চি বিরায়ানির সঠিক মান, স্বাদ ও গুণাগুণ অটুট থাকে না। কাচ্চি বিরিয়ানি চালের অর্ধসিদ্ধ অবস্থায় খাসির মাংসের দমে রান্নার প্রয়োজন হয়। মসলার ঘি আলু বোখারাসহ বিশেষ কিছু মসলার যোগে সূক্ষ্মভাবে হালকা দমে (কাঠ কয়লার ব্যবহার) রান্না হয়ে থাকে। ক্ষেত্ৰ বিশেষে কাচ্চি বিরানিতে ইদানীং আলু যোগ করে স্বাদে ভিন্নতা আনা হয়। রান্নার জন্য খাসির মাংসে এক কেজির ৬ টুকরা ব্যবহার উত্তম।
ঢাকার বাহারি পোলাওগুলোর মধ্যে আখনি পোলাও, মাহি পোলাও যা রুই মাছের তৈরি ইলিশ পোলাও অন্যতম। এক সময় শিকার প্রিয় মানুষদের বাড়িতে শিকারলব্ধ বক যাকে বুগুতি পাখি নামে ঢাকায় ডাকা হয় তৈরি হতো বুগুতি পোলাও। বিরিয়ানির মধ্যে মাটন বিরিয়ানি, চিংড়ি বিরিয়ানির প্রচলন বেশি ছিল। ঢাকার পোলা ও বিরিয়ানি রান্নায় নতুনত্ব ও উদ্ভাবিত ব্যাপারগুলো ঢাকার গৃহিণীরা তাদের প্রাত্যহিক রন্ধন কার্যের মাধ্যমেই বিকশিত করত।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন