পরিশিষ্ট ২ – ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রসঙ্গে

বদরুদ্দীন উমর

পরিচয়-এর ১৩৭৯ শারদীয় সংখ্যায় প্রদ্যুম্ন ভট্টাচার্য লিখিত ‘বিদ্যাসাগর, বাঙলার কৃষক এবং মার্কসবাদ’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ পড়লাম। তাতে রাজশাহী থেকে প্রকাশিত বিদ্যাসাগর নামক সংকলনে আমার একটি প্রবন্ধের কিছু সমালোচনা উপস্থিত করা হয়েছে। এই সমালোচনাকে আমি অত্যন্ত বিভ্রান্তিকর মনে করি

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর যে কৃষকদের সম্পর্কে উদাসীন ছিলেন না সেটা প্রদ্যুম্নবাবু কতকগুলি বিচিত্র উদাহরণের মাধ্যমে প্রমাণ করতে চেয়েছেন। এ প্রসঙ্গে এক জায়গায় তিনি বলেছেন যে, বিদ্যাসাগরের সাথে ভদ্রলোকদের বিচ্ছেদ ঘটেছিলো, যে কারণে তিনি বলেছিলেন, তোমাদের মতো ভদ্রবেশধারী আর্য সন্তান অপেক্ষা আমার অসভ্য সাঁওতাল ভালো লোক। বিদ্যাসাগরের এই উক্তি যে আমার জানা ছিলো না, তা নয়, কিন্তু এই ধরনের উদ্ধৃতির মাধ্যমে ঈশ্বরচন্দ্রের কৃষকপ্রীতি প্রমাণের চেষ্টাকে অপচেষ্টা মনে করেই তার কোন উল্লেখ করা আমি প্রয়োজন বোধ করিনি।

সামন্ত বুর্জোয়া সমাজে ‘তুমি একটা চাষা’, ‘তোমার চেয়ে একটা চাষাও ভালো’ অথবা ‘তুমি চাষার থেকেও অধম’–এই ধরনের উক্তি হামেশাই শোনা যায়। কিন্তু এর দ্বারা চাষীর প্রতি কোন ব্যক্তির শ্রদ্ধা, প্রীতি অথবা সহানুভূতি প্রকাশ পায় না। উপরন্তু তার থেকে এটাই মনে হয় যে, তার মতে চাষী নিকৃষ্ট ধরনের মানুষ। কাজেই তিনি যাকে ভর্ৎসনা করছেন সে কতখানি নীচে নেমে গেছে সেটা বোঝানোর জন্যেই তার সাথে চাষীর তুলনা।

ঊনিশ শতকের ভদ্রবেশী আর্য সন্তানেরা ঈশ্বরচন্দ্রের মতো মানুষকে যেভাবে উত্যক্ত করেছিলো তার ফলে তাদের প্রতি তাঁর এই উক্তি খুব স্বাভাবিক। এই উক্তিতে প্রচলিত রীতি অনুযায়ী সাঁওতালদের উল্লেখ থাকলেও এর মাধ্যমে সাঁওতাল-প্রীতি অপেক্ষা ‘ভদ্রবেশী আর্য সন্তানদের’ প্রতি তাঁর বিতৃষ্ণাই সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত হয়েছে। কাজেই বিদ্যাসাগরের এই উক্তিকে তাঁর কৃষকপ্রীতির উদাহরণ হিসেবে হাজির করার অর্থ বিদ্যাসাগরের চরিত্রকে বিকৃত করারই নামান্তর মাত্র। এর দ্বারা সত্য অর্থে ঈশ্বরচন্দ্রের চরিত্র যে খর্ব ও বিকৃত করা হচ্ছে সেটা উপলব্ধি না করাটা কি চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত-পুষ্ট মধ্যবিত্তসুলভ নয়?

প্রবন্ধটিতে অবশ্য কৃষকদের প্রতি বিদ্যাসাগরের ভালবাসার অন্য কতকগুলি উদাহরণও আছে। সেগুলি হলো ১৮৬৭ সালের দুর্ভিক্ষে বিদ্যাসাগরের কর্মকাণ্ড, ১৮৬৯ সালে বর্ধমানে ম্যালেরিয়া মহামারী রূপে শুরু হলে হিন্দু-মুসলমান চাষীদের মধ্যে তাঁর সেবাকর্ম এবং সাঁওতালদের সাথে তাঁর সহজ আত্মীয়তা। এসব ঘটনাও আমার অজানা নয়। কিন্তু এই ঘটনাসমূহ জানা সত্ত্বেও ‘বেয়াড়া তথ্যের ওপর ধামা চাপা দিয়ে ঝোঁকের মাথায় তাত্ত্বিক ছক বানানোর মধ্যবিত্ত রোগ’ দ্বারা আক্রান্ত হয়ে আমি যে সেগুলির উল্লেখ করা থেকে বিরত থেকেছি তা নয়। এই সব উদাহরণ আমি উল্লেখ করিনি এ জন্যে যে, আমার বক্তব্যের ক্ষেত্রে এই ধরনের উদাহরণ অপ্রাসঙ্গিক।

প্রদ্যুমবাবু তাঁর প্রবন্ধটির মাধ্যমে কৃষক-সমাজের সঙ্গে বিদ্যাসাগরের সম্পর্ক আলোচনা করতে গিয়ে বিষয়টিকে আমার আলোচনার মূল প্রতিপাদ্য বিষয় থেকে সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন করে যেভাবে উপস্থিত করেছেন তাতে মনে হয়, আমি বিদ্যাসাগরকে কৃষক-সমাজের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেছি। এ জন্যেই তিনি উপরের কয়েকটি উদাহরণ উল্লেখ করে আমার বক্তব্য যে কতখানি ‘তথ্যহীন’ সেটা দেখাতে সচেষ্ট হয়েছেন।

কৃষক-সমাজের সাথে বিদ্যাসাগরের উপরে উল্লিখিত সম্পর্ক যে শুধু মাত্র সত্য তাই নয়, তা অত্যন্ত স্বাভাবিক। তাঁর মানসিকতা, হৃদয়ের ঔদার্য এত বিশাল ছিলো যে, তা কোনদিনই বিধবাদের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ ছিলো না। মাইকেল মধুসূদনের মতো প্রতিভাধর ব্যক্তি থেকে শুরু করে শহরের হিন্দু মুসলমান দীন দুঃখী দরিদ্র, আদিবাসী সাঁওতাল কেউই তাঁর সেই বিশাল ঔদার্যের আওতা বহির্ভূত ছিলো না। এ জন্যেই তিনি ছুটে গিয়েছিলেন ১৮৬৭ সালের দুর্ভিক্ষ-পীড়িতদের সাহায্য করতে, ছুটে গিয়েছিলেন বর্ধমানে ম্যালেরিয়ার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে, গিয়েছিলেন সাঁওতালদের মধ্যে।

কিন্তু গ্রামের গরীবদের কাছে এইভাবে ছুটে যাওয়া, তাদের দুঃখকষ্ট লাঘব করার এই প্রচেষ্টা এবং বিধবাদের দুঃখ লাঘবের স্বপক্ষে তাঁর আন্দোলন—এই দুই কি একই পর্যায়ের? এই দুইয়ের মধ্যে কি কোন মৌলিক এবং গুরুতর পার্থক্য নেই? আছে এবং তা হলো এই যে, প্রথমটি নির্দিষ্ট কিছুসংখ্যক কৃষকদের দুঃখ লাঘবের জন্যে ব্যক্তি পর্যায়ের প্রচেষ্টা এবং দ্বিতীয়টি বিধবাকে দ্বিতীয়বার বিবাহ করতে না দেওয়ার সামাজিক ব্যবস্থা বা প্রথার বিরুদ্ধে ব্যাপক সামাজিক আন্দোলন।

ব্যক্তি পর্যায়ের দয়া-দাক্ষিণ্য যদি অসৎ উদ্দেশ্য প্রণোদিত না-ও হয় (এবং বিদ্যাসাগরের ক্ষেত্রে তো তা ছিলোই না) তাহলেও তার সামাজিক মূল্য নিতান্তই নগণ্য। তাছাড়া এ ধরনের দয়া-দাক্ষিণ্য অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখানো হয় করুণার বশবর্তী হয়ে, কখনো বা পুণ্য অর্জনের অথবা সমাজ-সেবক হিসেবে সুনাম অর্জনের জন্যে। এর মাধ্যমে তাই ‘বৃহত্তর’ সমাজের ভিত্তি পরিবর্তনের কোন প্রশ্ন তো থাকেই না উপরন্তু সেই ভিত্তিভূমিকে যারা নানাভাবে টিকিয়ে রাখার পক্ষপাতী তারাই এ ধরনের দয়া-দাক্ষিণ্যের প্রতি মনোযোগী হয় বেশী। এই দান খয়রাত সামাজিক বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে কোন পর্যায়ে পড়ে সেটা কি একজন মার্কসবাদীকে বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন হয়?

প্রদ্যুমবাবু ব্যক্তিগত পর্যায়ে কল্যাণকর কাজকর্ম কোন বিশেষ ব্যক্তি অথবা বিশেষ এলাকার ব্যক্তিদের দুঃখ-কষ্ট লাঘবের জন্যে ব্যক্তিগত প্রতিকার এবং বৃহত্তর সমাজের দুঃখ-কষ্ট এবং শোষণের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিকার এবং তার পক্ষে আন্দোলনের মৌলিক পার্থক্যকে উপলব্ধি করতে এ ক্ষেত্রে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছেন। এই ব্যর্থতার জন্যেই, ‘বৃহত্তর কৃষক সমাজের সুখ-দুঃখের প্রতি তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ উদাসীন’—আমার এই বক্তব্যকে খণ্ডন করতে গিয়ে তিনি—বিদ্যাসাগরের ব্যক্তিগত দয়া-দাক্ষিণ্য ইত্যাদি প্রসঙ্গের অবতারণা করেছেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জীবনে কোন অসাধুতা অথবা শঠতা ছিলো না, তাই তিনি যখন কৃষকদের মধ্যে দুর্ভিক্ষ অথবা মহামারীর সময় গিয়েছিলেন তখন তাদের সেবা করার সৎ উদ্দেশ্য নিয়েই গিয়েছিলেন। কিন্তু এ ধরনের সেবার প্রয়োজন সমাজে যাই থাকুক বা এই ধরনের সেবা যিনি করেন তাঁর হৃদয়ের ঔদার্য যত বিশালই হোক, তার দ্বারা দুর্ভিক্ষ- মহামারীর কোন স্থায়ী প্রতিকার সম্ভব নয়। কাজেই সেই স্থায়ী প্রতিকার করতে যাঁরা অগ্রসর হন তাঁরা প্রকৃত অর্থে বৃহত্তর সমাজের ব্যাপক পরিবর্তনের উদ্দেশ্যেই তা করেন। এই দ্বিতীয় ধরনের কর্মকাণ্ডের সাথে প্রথমোক্ত ধরনের কর্মকাণ্ডের গুণগত পার্থক্য যে কি তা কোন মার্কসবাদীকে বুঝিয়ে বলতে হবে?

কৃষকদের এই বৃহত্তর (বিদ্যাসাগরের ওপর আমার আলোচিত প্রবন্ধটিতে ‘বৃহত্তর’ শব্দটি আমি ইচ্ছাকৃতভাবে ব্যবহার করেছি) স্বার্থরক্ষার প্রচেষ্টা ঊনিশ শতকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ব্যতীত কোনক্রমেই সম্ভব ছিলো না এবং এ ক্ষেত্রেই বিদ্যাসাগরের ঔদাসীন্য উল্লেখযোগ্য। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের দ্বারা নিপীড়িত কৃষকদের দুঃখ-দুর্দশা লাঘবের চেষ্টা তিনি অনেক ক্ষেত্রে প্রাণ দিয়ে করেছেন কিন্তু সেই দুঃখ-কষ্টের মূল যে চিরস্থায়ী ভূমিব্যবস্থা, যা বৃহত্তর কৃষক সমাজের দুঃখ-দুর্দশার মূল কারণ তার উচ্ছেদের জন্যে তিনি কলম ধরেননি, আন্দোলনে অবতীর্ণ হননি, যেমনটি হয়েছিলেন বিধবাবিবাহ প্রবর্তনের ক্ষেত্রে এখানেই হরিশচন্দ্রের সাথে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের একটা পার্থক্য। বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে এই পার্থক্য নির্দেশ করতে যাওয়াকে বিদ্যাসাগরের বিরুদ্ধে ‘রোগাক্রান্ত’ আক্রমণ বলে বর্ণনা করার থেকে বিভ্রান্তিকর আর কি হতে পারে?

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কৃষক আন্দোলনের সমর্থক ছিলেন এ কথা বোঝাতে গিয়ে প্রদ্যুম্নবাবু সাধারণী, সোমপ্রকাশ এবং হিন্দু পেট্রিয়ট-এর উল্লেখ করেছেন। এগুলি এক এক করে বিচার করলেই ভালো হবে।

প্রথমেই সাধারণীতে প্রকাশিত প্রাসঙ্গিক অংশটি বিচার করা যাক। এখানে বলা হচ্ছে যে, জমিদারের নির্যাতনের বিরুদ্ধে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর একটি সভা করবেন বলে ‘একবার জনরব উঠিয়াছিলো’। প্রদ্যুম্নবাবু নিজেও প্রথমে খবরটিকে একটি ‘গুজব’ বলেই জমিদারের নির্যাতনের বিরুদ্ধে ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর একটি সভা করবেন বলে উল্লেখ করেছেন যে, বিদ্যাসাগর তখন ‘প্রবল পরাক্রমে বিরাজ’ করছিলেন অথচ সেই সংবাদের কোন প্ৰতিবাদ তিনি সাধারণীর পাতায় করেননি। কাজেই সেই ‘জনরব’কে নেহাত ভিত্তিহীন ঘটনা বলে উড়িয়ে দেওয়া অসমীচীন।

কেন অসমীচীন কেন? বিদ্যাসাগর এ ধরনের খবরের প্রতিবাদই বা করতে যাবেন কেন? এক জায়গায় প্রদ্যুম্নবাবু বিদ্যাসাগরের যে, ‘মেজাজ বা চরিত্রের’ উল্লেখ করেছেন, আমি এখানে তারই উল্লেখ করে বলতে চাই যে, বিদ্যাসাগরের মেজাজ এবং চরিত্র যা ছিলো তাতে এই সংবাদের প্রতিবাদ করার কোন প্রশ্ন তাঁর ছিলো না।

তিনি চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত উচ্ছেদের জন্যে কোনো চিন্তা-ভাবনা অথবা আন্দোলন না করলেও, কৃষকদের প্রতি তিনি বঙ্কিমচন্দ্রের মতো শত্রুভাবাপন্ন তো ছিলেন না। তাছাড়া প্রতিবাদ করার অন্য কোন কারণও ছিলো না। এ ধরনের খবরের প্রতিবাদ করে তারাই যারা সরকারের ভয়ে ভীতসন্ত্রন্ত। সরকারের কাছে গা-বাঁচিয়ে চলা লোকেই এই ধরনের কাজ করতে অভ্যস্ত। বর্তমানকালেও এই ধরনের প্রতিবাদ আমরা হামেশাই দেখি। এই সংবাদ প্রকাশের সময় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নিজের চরিত্রের গুণে বলীয়ান হয়ে ‘প্রবল পরাক্রমে বিরাজ’ করছিলেন বলেই তো তিনি এর প্রতিবাদ করে সরকারের খয়েরখাঁ-গিরি করার প্রয়োজন বোধ করেননি। এটাই তাঁর মৌনতার মূল কারণ হতে পারে না কি? আর একটি কথা। বিদ্যাসাগর যদি কৃষকসভা করবেন বলে সত্যসত্যই স্থির করতেন তাহলে তিনি তা করতেন। কিন্তু তিনি সে কাজ করেননি।

কাজেই বিদ্যাসাগর সাধারণীতে প্রকাশিত সংবাদের প্রতিবাদ করেননি, এই অতি ক্ষীণ সূত্র ধরে উপরোক্ত জনরবকে সত্য বলে ধরে নেওয়া অসমীচীনের পরিবর্তে সমীচীন হবে কেন?

দ্বিতীয়তঃ, সোমপ্রকাশ সম্পর্কে লেখকের বক্তব্য শ্রী বিনয় ঘোষ সম্পাদিত সাময়িকপত্রে বাঙলার সমাজচিত্র-এর তৃতীয় খণ্ডে সোমপ্রকাশ-এর অনেক রচনা সংকলিত হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেছেন। প্রকৃতপক্ষে সোমপ্রকাশ সংকলিত হয়েছে চতুর্থ খণ্ডে। এ ক্ষেত্রে তিনি বলেছেন যে, বিদ্যাসাগর সোমপ্রকাশ সংকলিত পত্রিকার আদি পরিকল্পক এবং অন্যতম-প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। তিনি দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণকে সম্পাদনার কাজে যথেষ্ট সাহায্য করতেন। এ ছাড়া পরবর্তীকালে বিদ্যাভূষণের মৃত্যুর পর তিনি এর ট্রাস্টিও নিযুক্ত হয়েছিলেন। এ হেন সোমপ্রকাশ-এ অর্থনৈতিক বিষয়ে যে সমস্ত প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিলো তার মধ্যে এক বিরাট সংখ্যক ছিলো কৃষক সম্পর্কিত (শ্রী বিনয় ঘোষের সংকলনে ৫৫টি রচনার মধ্যে ২২টি)। এতে যা কিছু লেখা হতো তার সাথে বিদ্যাসাগরের মতদ্বৈততা হলে তিনি তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতেন; কিন্তু তিনি তা করেননি। কাজেই ধরে নিতে হবে, ঈশ্বরচন্দ্র কৃষকদের বৃহত্তর স্বার্থরক্ষার জন্যে সচেষ্ট ছিলেন।

এখানেও সেই পূর্বোক্ত গাফলতি! প্রথমত, সোমপ্রকাশ-এর লেখাগুলিতে প্রধানত কি থাকতো? যা থাকতো তা হচ্ছে, কৃষকদের দুঃখ-দুর্দশা এবং তাদের ওপর নির্যাতনের চিত্র, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কিছু কিছু ছোট দোষ-ত্রুটির সমালোচনা ইত্যাদি। এই সমালোচনা সত্ত্বেও হিন্দু পেট্রিয়েট-এর মতো সোমপ্রকাশ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের উচ্ছেদের প্রশ্নে বিন্দুমাত্র উৎসাহী ছিলো না।

লেখক নিজেও বলেছেন যে, সোমপ্রকাশ শ্রেণীগত দ্বিধাদ্বন্দ্বের বা বিভ্রমের বাইরে যেতে পারেনি। সোমপ্রকাশ-এ জঘন্য প্রতিক্রিয়াশীল বক্তব্য অনেক সময় জোরালোভাবে উপস্থিত করা হতো। বিদ্যাসাগর তার প্রতিবাদ করেননি, বা তার জন্যে সোমপ্রকাশ-এর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেননি—এই যুক্তিতে বিদ্যাসাগরকে সে সমস্ত বক্তব্যের সমর্থক বলে ধরে নিতে প্রদ্যুম্নবাবু নিশ্চয়ই আমাদের পরামর্শ দেবেন! কিন্তু তাঁর এই পরামর্শ গ্রহণ করলে বিদ্যাসাগরের প্রকৃত মূল্যায়ন যে সম্ভব হবে না এবং তাঁর চরিত্র যে বিকৃত ও খর্ব হবে সেটা কি অস্বীকার করা চলে? দ্বিতীয়তঃ, একটি জিনিস এখানে বিশেষভাবে লক্ষণীয়। বিদ্যাসাগর সোমপ্রকাশ-এর ‘পরিকল্পক ও অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা’ হলেও তিনি সারাসরি কোন সময়ই নিজের স্বাক্ষরে এ বিষয়ে কিছু লেখেননি—অন্তত সেটা আমার জানা নেই। যেদিন এ ধরনের তথ্য হাতে পাবো সেদিন নিঃসন্দেহে সেই অনুসারে এ ব্যাপারে মত পরিবর্তন করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করব না। যে পর্যন্ত সেটা না পাওয়া যায় সে পর্যন্ত এ প্রশ্ন কি এখানে করা যায় না যে, বিদ্যাসাগরের মতো দৃঢ় এবং ঋজু চরিত্রের মানুষ, যিনি একজন প্রথম শ্রেণীর লেখক এবং প্রচারকও, তিনি কেন সোমপ্রকাশ পত্রিকা নিজের হাতে থাকা সত্ত্বেও চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বিরুদ্ধে অথবা তার উচ্ছেদের প্রশ্নে নিজের লেখনী ধারণ করেননি? আমি মনে করি না, এর কারণ কৃষকদের প্রতি তাঁর শত্রুতাভাব। না সেটা মোটেই নয়। কারণ শত্রুভাবাপন্ন হয়েও যে কৃষকদের জন্যে চোখের পানি ফেলা যায়, তার একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ বঙ্কিমচন্দ্রের বঙ্গদেশের কৃষক। পত্রিকা হাতে পেয়েও বিদ্যাসাগর কৃষকসমস্যা সম্পর্কে লেখেননি, তার কারণ তিনি তাঁর সমাজসংস্কার আন্দোলনের ক্ষেত্রে তার কোন প্রয়োজন বোধ করেননি। হিন্দু সমাজের অনেক পুরাতন নির্যাতন ‘বিধবার চিরবৈধব্য’ ঘোচানোকেই (এ সমস্যা ছিলো প্রধানত উচ্চবর্ণের হিন্দুদের অর্থাৎ চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত-পুষ্ট মধ্যশ্রেণীর) তিনি তাঁর কর্মক্ষেত্রের প্রধান সমস্যা হিসেবে ধরে নিয়েছিলেন। এ জন্যে তাঁর সেই সংস্কার আন্দোলন বিধবাবিবাহ আইনসঙ্গত হওয়ার পরও থামেনি। বেসরকারী সামাজিক বিরুদ্ধতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তাঁকে জীবনের অবশিষ্ট অংশ অবিরত সংগ্রাম করতে হয়েছিলো। তিনি নিজেই বলেছেন যে, বিধবাবিবাহ প্রচলন তাঁর জীবনের সর্বপ্রধান সৎকর্ম। এই সৎকর্ম সম্পাদন করতে গিয়ে বিদ্যাসাগর অন্য কোন সামাজিক আন্দোলনের কথা চিন্তা করেননি।

প্রদ্যুম্নবাবু সোমপ্রকাশ-এর ৫৫টি রচনার মধ্যে ২২টি রচনা কৃষক-সম্পর্কিত এ কথা বলে সোমপ্রকাশ পত্রিকায় কৃষক-সমস্যার ওপর যে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিলো তার একটা পরিমাণ নির্দেশের চেষ্টা করেছেন। গুরুত্ব নির্ণয়ের এই পদ্ধতির সাথে আমি মোটামুটি একমত। এখন প্রশ্ন হলো, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সমগ্র রচনা, সাধনা এবং কর্মের ক্ষেত্রে আমরা এই পদ্ধতি কি প্রয়োগ করতে পারি না? নিশ্চয় পারি এবং সেটা করাই যুক্তিসঙ্গত।

এই পদ্ধতি প্রয়োগ করে তাঁর সেই বিশাল রচনা ক্ষেত্র, তাঁর কর্মক্ষেত্র ইত্যাদিকে সামগ্রিকভাবে বিচার করলে দেখা যাবে যে, কৃষকদের বিরুদ্ধে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের নির্যাতন সেখানে হয়ে দাঁড়িয়েছে সম্পূর্ণ গুরুত্বহীন, তাৎপর্যহীন। কৃষক-সমস্যার প্রতি, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রতি এই ঔদাসীন্য থাকার ফলেই তিনি সোমপ্রকাশ এবং হিন্দু পেট্রিয়ট হাতে পেয়েও তাঁর লেখনীকে সেদিকে চালনা করেননি। অথচ তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় বিধবাবিবাহের স্বপক্ষে তিনি বেশ কতকগুলি জোরালো রচনা স্ব-নামেই প্রকাশ করেছিলেন।

হরিশচন্দ্র সম্পর্কে আমার একটি বক্তব্য প্রদ্যুম্নবাবু উদ্ধৃত করেছেন, ‘হিন্দু পেট্রিয়ট-এর সম্পাদক হরিশচন্দ্র যেভাবে নির্যাতিত কৃষকদের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র তা কোনো দিন চিন্তাও করেননি।’ ‘কোন দিন চিন্তাও করেননি’ এই উক্তির প্রতিবাদে তিনি বলেছেন যে, হরিশচন্দ্রের মৃত্যুর পর বিদ্যাসাগর নিজে তার পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন এবং তাঁর দায়িত্বে সেই পত্রিকাটির চরিত্র কোন দিন পরিবর্তিত হয়নি। এটাই প্রমাণ করে যে, তিনিও হরিশচন্দ্রের মতো নির্যাতিত কৃষকদের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন।

না, এর দ্বারা সেটা মোটেই প্রমাণিত হয় না। এ ক্ষেত্রে যা ঘটেছিলো সেটা হলো এই যে, হরিশচন্দ্রের মৃত্যুর পর পত্রিকাটি বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিলো, আর্থিক দুর্গতি, সরকারের শত্রুতাপূর্ণ মনোভাব ইত্যাদির ফলে।

হরিশচন্দ্রের প্রতি অত্যধিক স্নেহপরায়ণ বিদ্যাসাগর হরিশচন্দ্রের অকালমৃত্যুর পর সেই পত্রিকা বন্ধ হতে না দিয়ে তার দায়িত্বভার নিজ হাতে নিয়েছিলেন। তিনি কৃষকদের শত্রু ছিলেন না বলেই তাঁর পক্ষে সেটা সম্ভব হয়েছিলো। কিন্তু অন্যদিকে কৃষক-সমস্যার মৌলিক দিকটির প্রতি পূর্ব উল্লিখিত কারণে ঔদাসীন্যের ফলে তিনি হরিশচন্দ্রের মতো সেই পত্রিকায় কলম ধরার চিন্তা কোন দিন করেননি—এ কথা কি কেউ অস্বীকার করতে পারেন?

কৃষক-সমস্যার ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগরের যে প্রত্যক্ষ কোন বক্তব্য ছিলো এ কথা প্রদ্যুম্নবাবু কোন জায়গাতেই দেখাতে পারেননি। ১৮৬১ সালের হিন্দু পেট্রিয়ট-এ ২রা ডিসেম্বর যে বিজ্ঞপ্তির উল্লেখ তিনি করেছেন, সেখানেও তিনি নিজেই বলেছেন, ‘নীতির এই বয়ান স্বয়ং বিদ্যাসাগরের লেখা না হলেও তাঁর নির্দেশে লেখা—এ কথা নিশ্চিত।’

কথা হলো, বিদ্যাসাগরের ‘মেজাজ এবং চরিত্রের সাথে যাঁদের সঠিক পরিচয় আছে তাঁরাই জানেন যে, কোন বিষয়ে কিছু করার সংকল্প থাকলে বিদ্যাসাগরকে সেখানে নিরস্ত করা অথবা টলানো কিছুতেই সম্ভব ছিলো না। সেদিক দিয়ে তিনি তাঁর পিতামহ প্রদত্ত ‘এঁড়ে’ নামকরণের যথার্থতা সারা জীবন ধরে প্রমাণ করেছেন। তাছাড়া ঘোমটা দিয়ে কোন কাজ করার মানুষও তিনি ছিলেন না। কাজেই বৃহত্তর কৃষক-সমাজের মৌলিক সমস্যা সম্পর্কে তিনি যদি প্রকৃতপক্ষে উদাসীন না থাকতেন, তাহলে পত্র পত্রিকা হাতে থাকা সত্ত্বেও লেখনী তাঁর এ ব্যাপারে নীরব থাকতো না।

এতক্ষণ তো গেলো প্রদ্যুম্নবাবুর কতকগুলি বিশেষ বক্তব্যের সম্পর্কে আমার বক্তব্য। এর পর একটি কথা উল্লেখ না করলে আলোচনা এখানে নিতান্তই অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। কথাটি হচ্ছে এই যে, আমার বর্তমান সমালোচক ‘ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর’ নামক প্রবন্ধটির অন্য কোন দিক সম্পর্কে সামান্যতম উল্লেখ না করে অথবা সে বিষয়ে কোন উদ্ধৃতি না দিয়ে, দুটি উদ্ধৃতি যেভাবে নির্বাচন ও পরিবেশন করেছেন তাকে কোন যোগ্য সমালোচকই সমালোচনার সঠিক পদ্ধতি হিসেবে স্বীকার করবেন না।

পরিপ্রেক্ষিত থেকে বিচ্ছিন্ন করে দু একটি উদ্ধৃতি ইচ্ছে মতো নির্বাচন করে সমালোচনার যে প্রচেষ্টা সেটা অযোগ্য অথবা উদ্দেশ্য-প্রণোদিত হতে বাধ্য। এর দ্বারা বিভ্রান্তির বিস্তার ব্যতীত অন্য কোন উদ্দেশ্য সিদ্ধ হওয়ার কথা নয়। ঠিক এ জন্যেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সম্পর্কে আমি আলোচ্য প্রবন্ধটিতে কি বলতে চেয়েছি সেটা এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন। প্রদ্যুমবাবু আমার মার্কসবাদ প্রয়োগের ধরনকে ‘মেটাফিজিক্যাল’ আখ্যা দিয়ে বলেছেন যে, আমার আসল অভিযোগ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বিরুদ্ধে বিদ্যাসাগর কেন প্রত্যক্ষ লড়াইয়ে নামেননি। তিনি আরও বলেছেন, বিদ্যাসাগর মাও হলেন না এ আক্ষেপ মার্কসবাদে অবান্তর।

যে ধরনের ‘অভিযোগ’ এবং ‘আক্ষেপ’-এর কথা উপরে উল্লেখ করা হয়েছে তা শুধু মার্কসবাদ কেন, যে কোন বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের ক্ষেত্রেই অবান্তর। প্রশ্ন হলো, এই ‘অভিযোগ এবং ‘আক্ষেপ’—কি আমি করেছি? আমার মূল বক্তব্য সম্পর্কে কিছুটা ধারণা দেওয়ার জন্য ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নামক প্রবন্ধটি থেকে কিছু উদ্ধৃতি দেওয়া দরকার।

প্রথমতঃ, সাধারণভাবে ঊনিশ শতকের সামাজিক কাঠামো এবং ‘নবজাগরণ’ সম্পর্কে আমার বক্তব্যঃ

ইউরোপীয় বুর্জোয়া শ্রেণী পনেরো শতকের প্রথম দিকেই একটি নোতুন ও স্বাধীন শ্রেণী রূপে জন্মলাভ করে। এর পর তিন চার শতক ধরে নব নব রূপে বিকাশ লাভ করে নিজের এই যাত্রাপথে সমগ্র সমাজ-কাঠামোর বৈপ্লবিক পরিবর্তনের মাধ্যমে এই বুর্জোয়া শ্ৰেণী, ইউরোপীয় সমাজের পরিপূর্ণ রূপান্তর ঘটায়। কিন্তু বাঙলাদেশের মধ্যবিত্তশ্রেণীর মূল ভিত্তি ব্যবসা-বাণিজ্য অথবা শিল্পকার্য ছিলো না। তার মূল ভিত্তি হলো চিরস্থায়ী বন্দোবস্তজাত ভূমিব্যবস্থা। এইজন্যেই ঊনিশ শতকীয় মধ্যবিত্ত বাঙালীর নবজাগরণ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়নি। অনেকে সেই বন্দোবস্তের কঠোর সমালোচনা করলেও তার উচ্ছেদের প্রশ্নে তাঁরা মোটামুটিভাবে নীরব থেকেছেন। প্রচলিত সামন্ত-ব্যবস্থার প্রতি এই মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গীর ফলেই বাঙলার নবজাগরণ সমগ্র বাঙালী সমাজ, এমন কি মধ্যবিত্ত সমাজের মধ্যেও, কোন বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়নি। ইংরেজ-সৃষ্ট সামন্ততান্ত্রিক সমাজ কাঠামোর মধ্যে সারা ঊনিশ শতক ধরে সেই সাংস্কৃতিক আন্দোলন ছিলো বন্দীদশা প্রাপ্ত।

ইউরোপীয় রেনেসাঁস আন্দোলন সামন্ত-প্রথার বিরুদ্ধে স্থাপিত হওয়ার জন্যে তা গ্রামাঞ্চল এবং কৃষক-সমাজকেও বিপুলভাবে নাড়া দেয়। সমাজ কাঠামোর পরিবর্তন তাদের জীবনের মধ্যেও আনে বিপুল উদ্দীপনা। কিন্তু বাঙলাদেশের ঊনিশ শতকীয় নবজাগরণ বাঙলার কৃষক সমাজকে স্পর্শই করেনি, প্রায় সর্বতোভাবে তা কলকাতা এবং আরও কয়েকটি শহরকে কেন্দ্র করেই বিকাশ লাভ করেছে। রামমোহনের সতীদাহ প্রথা নিবারণ আন্দোলন এবং ঈশ্বরচন্দ্রের বিধবাবিবাহের আন্দোলন এ দিক দিয়ে সামান্য ব্যতিক্রম হলেও তা গ্রাম-বাঙলার জীবনে রেনেসাঁসের মতো কোন বৈপবিক পরিবর্তন আনেনি।

স্পষ্টতঃ এখানে তুলনাটা আমার রামমোহন ও বিদ্যাসাগরের সাথে ইউরোপীয় রেনেসাঁসের নেতাদের মাও-এর সঙ্গে নয়। কাজেই ঈশ্বরচন্দ্র কেন মাও হলেন না, এ ধরনের অর্বাচীনসুলভ আক্ষেপ করেছি, আমার সম্পর্কে এই উক্তি একটু বিস্ময়কর বই কি! অপ্রাসঙ্গিকভাবে হঠাৎ মাও-এর এই উল্লেখ খুব সম্ভবত মাও-বিদ্বেষের ফলেই সম্ভব হয়েছে। কারণ মাও-এর কথা অথবা কৃষিবিপ্লবের কথা তো আমি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সম্পর্কে আলোচনার ক্ষেত্রে কোথাও আনিনি। এ ক্ষেত্রে যে হরিশচন্দ্রের উল্লেখ আমি করেছি তিনি কি মাও হয়েছিলেন? তাঁর আন্দোলন কি কৃষিবিপ্লবের আন্দোলন ছিলো? না, তা ছিলো না। কারণ ঊনিশ শতকীয় বাঙলাদেশের সামাজিক অবস্থায় এ ধরনের আন্দোলনের কোন প্রশ্ন ওঠে না। কথাটা এই যে, সেই সামাজিক অবস্থাতেও হরিশচন্দ্রের পক্ষে যেটা সম্ভব ছিলো, বিভিন্ন কারণে বিদ্যাসাগরের পক্ষে সেটা সম্ভব হয়নি।

এবার আমি যে তুলনা করেছি সে প্রসঙ্গে আবার আসা যাক। এই তুলনা শুধু বিদ্যাসাগরের সঙ্গে ইউরোপীয় রেনেসাঁসের নেতাদের তুলনা নয়, তা হলো দুই দেশের দুই ঐতিহাসিক অবস্থার একটা তুলনা। এ সম্পর্কে সমালোচক প্রদ্যুমবাবু তো দেখি কিছুই বলেননি। একেই কি ধান ভানতে শিবের গীত বলে না? এ ধরনের গীতের সঙ্গে মার্কসবাদী সমালোচনার সম্পর্ক কী?

তিনি এক জায়গায় আমার ‘ক্ষেত্রে দোষ’ ঘটার কথা উল্লেখ করে বলেছেন যে, বিদ্যাসাগরের মূল্যায়ন করতে হবে তাঁর স্বক্ষেত্রে। এ তো খুব ভালো কথা। বস্তুতঃপক্ষে আমার আলোচ্য প্রবন্ধটিতে আমি তাই করেছি। ক্ষেত্র সম্পর্কে প্রদ্যুম্নবাবু যদি এতই সজাগ হয়ে থাকেন তাহলে বিদ্যাসাগরের ক্ষেত্র সম্পর্কে আমি যা বলেছি সেটা তিনি উল্লেখ করে উদ্ধৃত করেননি কেন? যাই হোক, বিদ্যাসাগরের মূল ক্ষেত্র এবং ঐতিহাসিক অবদান সম্পর্কে প্রবন্ধটিতে আমি যা বলেছি তা হলো এই—

ঊনিশ শতকের বাঙলায় যে সাংস্কৃতিক ও সমাজ-সংস্কার আন্দোলন হয়েছিলো সেটা অবশ্য কোন সরল রেখা ধরে অগ্রসর হয়নি। তৎকালীন বাঙালী সমাজের শ্রেণীবিন্যাস এবং বিভিন্ন শ্রেণীর সংঘাতের ফলে রেনেসাঁস নামে কথিত এই সাংস্কৃতিক ও সংস্কার আন্দোলনের মধ্যেও দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের যথেষ্ট প্রমাণ ও পরিচয় পাওয়া যায়। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এবং বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের দ্বন্দ্ব ও বিরোধিতার উল্লেখ এ ক্ষেত্রে খুবই প্রাসঙ্গিক। কারণ এই বিরোধ শুধুমাত্র ব্যক্তির অংশ নয়। এই বিরোধ ছিলো ঊনিশ শতকের বাঙালী মধ্যবিত্ত শ্রেণীর দুই অংশের বিরোধ। এর এক অংশ ছিলো পুরোপুরিভাবে সামন্ততন্ত্রের এবং সামন্ততান্ত্রিক মূল্যবোধের রক্ষক এবং অন্য অংশ সামন্ততান্ত্রিক ভূমিব্যবস্থার উচ্ছেদকামী না হলেও ইউরোপীয় চিন্তাভাবনার প্রভাবে বাঙালী মধ্যবিত্ত শ্রেণীর চিন্তাকে অনেকাংশে সামন্ত প্রভাবমুক্ত করতে উদ্যোগী। বঙ্কিমচন্দ্র ছিলেন প্রথম অংশের নেতা; ঈশ্বরচন্দ্র, অক্ষয়কুমার দত্ত ছিলেন দ্বিতীয় অংশের নেতা। …

ঊনিশ শতকের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অপেক্ষাকৃত প্রগতিশীল অংশ অন্য অংশের মতো চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত-পুষ্ট হলেও ইউরোপীয় শিক্ষা এবং উদারনৈতিক চিন্তাধারা তাঁদের সামন্ততান্ত্রিক মূল্যবোধের বিরুদ্ধে অনেকখানি সচেতন ও সক্রিয় করে তোলে। সমাজে নানা কুসংস্কার এবং রক্ষণশীল রীতিনীতির বিরুদ্ধে তাঁরা শুরু করেন তাঁদের সংগ্রাম ও সংস্কার আন্দোলন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের দার্শনিক ও শিক্ষাচিন্তা এবং বিধবাবিবাহ প্রচলনের আন্দোলন হলো তারই সর্বপ্রধান ও সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য উদাহরণ।…

সমগ্র বাঙালী হিন্দু সমাজে যখন ধর্মের জোয়ার বইছে, ধর্মচিন্তাকে নানাভাবে সংস্কার করে বেদ-বেদান্ত নোতুনভাবে ব্যাখ্যা ও বিচার প্রচেষ্টা চলছে, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তখন বেদান্তের অসারত্ব সম্পর্কে নিঃসন্দেহ। শুধু তাই নয়, ইউরোপীয় দার্শনিকদের বার্কলের মতো ভাববাদীদের প্রভাব থেকে বাঙালী শিক্ষিত যুব সমাজকে রক্ষা করতেও তিনি রীতিমতো ব্যগ্র। বারাণসী হিন্দু কলেজের তৎকালীন ইউরোপীয় অধ্যক্ষের সাথে এ ব্যাপারে তাঁর বিতর্কই তাঁর এই ব্যগ্রতার পরিচয় প্রদান করে।

বিদ্যাসাগরের চিন্তা ও কর্মক্ষেত্রের যে পরিধি আমি এখানে নির্দেশ করেছি তার সম্পর্কে প্রদ্যুমবাবু তো দেখি তাঁর সমালোচনায় একটি বাক্যও ব্যয় করেননি। যাইহোক, পরিশেষে বিদ্যাসাগরের মূল্যায়ন সম্পর্কে আমি যা বলেছি তা হলো, এই—

ঊনিশ শতকে বাঙালী মধ্যবিত্তের স্বার্থ সাধারণভাবে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ওপরই ছিলো প্রতিষ্ঠিত এবং তার প্রভাবে সমগ্র মধ্যবিত্ত শ্রেণীই কৃষক-স্বার্থের প্রতি শুধু উদাসীনই ছিলো না অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ছিলো শত্রুভাবাপন্ন। অর্থাৎ তারা ছিলো দরিদ্র কৃষকদের শ্রেণীশত্রু। বঙ্কিমচন্দ্রের মতো ঈশ্বরচন্দ্র কৃষক-স্বার্থের বিরুদ্ধে সরাসরি কোন বক্তব্য উপস্থিত না করলেও তার প্রতি ঔদাসীন্যই তাঁর চিন্তার একটা বিশেষ পরিধি নির্দিষ্ট করে এবং এই পরিধিকে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মূল্যায়নে সঠিকভাবে বিচার ও বিবেচনা করা প্রগতিশীল চিন্তার ক্ষেত্রে একান্ত অপরিহার্য।

এই পরিধি নির্ণয় করতে যাওয়ার নামই কি ‘অভিযোগ’? অ্যারিস্টটল মানুষের অধিকার সম্পর্কে অনেক মূল্যবান দার্শনিক আলোচনা করলেও সেই আলোচনার পরিধি নির্দেশ করতে গিয়ে যদি বলা হয় যে, তাঁর সেই ‘অধিকার’ স্ত্রীলোক, দাস এবং বিদেশীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ছিলো না, তাহলে কি অ্যারিস্টটলের বিরুদ্ধে ‘অভিযোগ করা হয়? আক্ষেপ করা হয়, অ্যারিস্টটল কেন মার্কস হলেন না? এই ধরনের পরিধি নির্দেশ এবং এই পরিধির কারণ নির্ণয়ের চেষ্টা না করে কি কোন দার্শনিক, সমাজ-বিজ্ঞানী, ঐতিহাসিক, সাহিত্যিক অথবা সমাজ-সংস্কারক সম্পর্কে যথাযথ মার্কসবাদী মূল্যায়ন সম্ভব?

মার্কসবাদী নামে পরিচিত অনেক বুদ্ধিজীবীকে দেখেছি সংস্কারবশে স্যার সৈয়দ আহমদের শ্রেণীচরিত্র বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে মার্কসবাদী হিসেবে নিজের বিশ্লেষণ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলতে। মার্কসবাদী নামে পরিচিত অন্যান্য অনেকে সেইভাবে ঈশ্বরচন্দ্র তো বটেই, এমন কি বঙ্কিমচন্দ্রের শ্রেণীচরিত্র বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে সংস্কারের বশবর্তী হয়ে ঠিক তাই করেন। প্রদ্যুম্নবাবুর বেলাতেও সেটাই ঘটেছে। বিদ্যাসাগরের মার্কসবাদী বিশ্লেষণের প্রশ্নে এ জন্যেই তাঁর অমার্কসবাদী উত্তেজনা।

আসলে মার্কসবাদের নামে এখন এত কিছু উদ্দেশ্য-প্রণোদিত এবং বুর্জোয়া-সুলভ বক্তব্যের প্রচলন হয়েছে, এই সব বক্তব্যের তাড়নায় বিভিন্ন বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গীর নামে অনেক কিছু আজকাল চলে যাচ্ছে এবং এগুলো চালাচ্ছেন প্রধানত এক ধরনের মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী। ‘নিপীড়িত’ মার্কসবাদকে এ ধরনের বুদ্ধিজীবীদের হাত থেকে রক্ষা করাই এখন হয়ে দাঁড়িয়েছে মার্কসবাদীদের অন্যতম গুরুতর দায়িত্ব। বিদ্যাসাগর সম্পর্কে যে কোন মূল্যায়নের ক্ষেত্রেও তাঁদের এই গুরু দায়িত্বের কথা স্মরণ রাখতে হবে।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন