বদরুদ্দীন উমর
ঊনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে সমাজ-সংস্কার আন্দোলনের পরিণতি সম্পর্কে কোন সুষ্ঠু আলোচনা এবং তথাকথিত জাতীয়তাবাদের চরিত্র সম্পর্কে কোন যথার্থ বিশ্লেষণ তৎকালীন বাঙলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা এবং সেই অবস্থা সম্পর্কে বঙ্কিমচন্দ্রের মতামতের একটা উল্লেখ ব্যতীত সম্ভব নয়।
১৮৯২ সালে বঙ্গদেশের কৃষক পুনর্মুদ্রিত হওয়ার সময় বঙ্কিমচন্দ্র বলেন,
বঙ্গদেশের কৃষকে এ দেশীয় কৃষকদিগের যে অবস্থা বর্ণিত হইয়াছে, তাহা আর নাই। জমিদারের আর সেরূপ অত্যাচার নাই। নূতন আইনে তাঁহাদের ক্ষমতাও কমিয়া গিয়াছে। কৃষকদিগের অবস্থারও অনেক উন্নতি হইয়াছে। অনেক স্থলে এখন দেখা যায়, প্ৰজাই অত্যাচারী জমিদার দুর্বল।[৮৩]
ভারতীয় জাতীয়তাবাদের দার্শনিক ভিত্তি রচয়িতা কৃষক ও জমিদার শ্রেণী সম্পর্কে উপরোক্ত মন্তব্য করলেও, তৎকালে এ ক্ষেত্রে প্রকৃত অবস্থা কি ছিলো সে বিষয়ে ভারতীয় অর্থনীতির ইতিহাস রচয়িতা রমেশচন্দ্র দত্তের মত হলো—
Cultivation has largely extended under the peace and security assured by British Rule. But no man familiar with the inner life of the cultivators will say that the extension of cultivation has made the nation more prosperous more resourceful, more secure against famines.[৮৪]
দেশীয় শিল্প-বাণিজ্য যখন সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজের শিল্প-বাণিজ্যের দ্বারা প্রভূতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত এবং বস্তুতপক্ষে ধ্বংসপ্রাপ্ত হচ্ছে, বিদেশী ইংরেজ যখন এ দেশ থেকে বিপুল সম্পদ লুণ্ঠন করে নিয়ে যাচ্ছে, সেই সময়ে এ বিষয়ে বঙ্কিমচন্দ্রের মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গী সবিশেষ প্রণিধানযোগ্য। বঙ্গদেশের কৃষক-এর চতুর্থ পরিচ্ছেদে তিনি বলছেন―
আমরা ছয় টাকা দিয়া বিলাতি থান কিনিলাম। টাকা ছয়টি কি অমনি দিলাম? অমনি দিলাম না, তাহার পরিবর্তে একটি সামগ্রী পাইলাম। সেই সামগ্রীটি যদি আমরা উচিত মূল্যের উপর একটি পয়সা বেশী দাম দিয়া লইয়া থাকি, তবে সেই পয়সাটি আমাদের ক্ষতি। কিন্তু যদি একটি পয়সাও বেশী না দিয়া থাকি, তবে আমাদের কোন ক্ষতি নাই। এক্ষণে বিবেচনা করিয়া দেখুন, ছয় টাকার থানটি কিনিয়া একটি পয়সাও বেশি দিয়াছি কি না। দেখা যাইতেছে যে, ছয় টাকার এক পয়সার কমে সে থান আমরা কোথাও পাই না, পাইলে তাহা সাধারণ লোকে ছয় টাকায় কেন কিনিবে? যদি ছয় টাকার এক পয়সা কমে ঐ থান কোথাও না পাই, তবে ঐ মূল্য অনুচিত নহে। যে ছয় টাকার থান কিনিল, সে উচিত মূল্যেই কিনিল। যদি উচিত মূল্যে সামগ্রীটি কেনা হইল, তবে ক্রেতাদিগের ক্ষতি কি? কি প্রকারে তাহাদিগের টাকা অপহরণ করিয়া বিদেশীয় বণিক বিদেশে পলায়ন করিল? তাহারা দুই টাকা মুনাফা করিল বটে, কিন্তু ক্রেতাদিগের কোন ক্ষতি করিয়া লয় নাই; কেন না, উচিত মূল্য হইয়াছে। যদি কাহারও ক্ষতি না করিয়া মুনাফা করিয়া থাকে, তবে তাহাতে আমাদের অনিষ্ট কি? যেখানে কাহারও ক্ষতি নাই, সেখানে দেশের অনিষ্ট কি? আপত্তির মীমাংসা এখনও হয় নাই। আপত্তিকারকেরা বলিবেন যে, ঐ ছয়টি টাকায় দেশী তাঁতির কাছে থান কিনিলে টাকা ছয়টি দেশে থাকিত।… স্থূল কথা, ঐ ছয় টাকা দেশী তাঁতি পাইলো না, তাহাতে কাহারও ক্ষতি নাই। ক্রেতাদিগের যে ক্ষতি নাই, তাহা দেখাইয়াছি। দেশী তাঁতিরও ক্ষতি নাই।…
তার্কিক বলিবেন, তাঁতির ক্ষতি আছে। এই থানের আমদানীর জন্য তাঁতির ব্যবসায় মারা গেল। তাঁতি থান বুনে না ধুতি বুনে। ধুতির অপেক্ষা থান সস্তা, সুতরাং লোকে থান পরে ধুতি আর পরে না। এজন্য অনেক তাঁতির ব্যবসায় লোপ হইয়াছে।
‘উত্তর। তাহার তাঁত বুনা ব্যবসায় লোপ পাইয়াছে বটে, কিন্তু সে অন্য ব্যবসা করুক না কেন? অন্য ব্যবসায়ের পথ রহিত হয় নাই। তাঁত বুনিয়া আর খাইতে পায় না, কিন্তু ধান বুনিয়া খাইবার কোন বাধা নাই।[৮৫]
এইভাবে সাম্রাজ্যবাদী বাণিজ্যের কীর্তনের পর ইংল্যান্ডের শিল্পজাত দ্রব্যসমূহের বিনিময়ে এ দেশের কাঁচামাল লুণ্ঠন করার যে ব্যবস্থা সাম্রাজ্যবাদী শোষণের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ছিলো সে বিষয়ে বঙ্কিমচন্দ্র বলেছেন—
বাণিজ্য বিনিময় মাত্র। আমরা যদি ইংল্যান্ডের বস্ত্রাদি লই, তবে তাহার বিনিময়ে আমাদের কিছু সামগ্রী ইংল্যান্ডে পাঠাইতে হইবে, নহিলে আমরা বস্ত্র পাইব না। আমরা কী পাঠাই?… অধিকাংশের বিনিময়ে আমরা কৃষিজাত দ্রব্যসকল পাঠাই—যথা, চাউল, রেশম, কার্পাস, পাট, নীল ইত্যাদি। ইহা বলা বাহুল্য যে, যে পরিমাণে বাণিজ্য বৃদ্ধি হইবে সেই পরিমাণে এই সকল কৃষিজাত সামগ্রীর আধিক্য আবশ্যক হইবে। সুতরাং দেশে চাষও বাড়িবে। ব্রিটিশ রাজ্য হইয়া পর্যন্ত এ দেশের বাণিজ্য বাড়িতেছে—সুতরাং বিদেশে পাঠাইবার জন্য বৎসর অধিক কৃষিজাত সামগ্রীর আবশ্যক হইতেছে, অতএব এ দেশে প্রতি বৎসর চাষ বাড়িতেছে।
‘চাষ বৃদ্ধির ফল কী? দেশের ধনবৃদ্ধি, শ্রীবৃদ্ধি।… [৮৬]
বঙ্কিমচন্দ্রকে এত বিস্তারিতভাবে উদ্ধৃত করার কারণ হলো এই যে, বঙ্গদেশের কৃষক-এ তিনি চিরস্থায়ী ভূমিব্যবস্থা, কৃষি, দেশীয় শিল্প-বাণিজ্য ইত্যাদি বিষয়ে যে সব বক্তব্য উপস্থিত করেছেন সেগুলি কেবল মাত্র তাঁর ব্যক্তিগত বক্তব্য ছিলো না। বিশেষ শ্রেণীগত অবস্থান থেকেই তিনি এইসব অর্থনৈতিক মতামত ব্যক্ত করেছিলেন। এই শ্রেণীগত অবস্থান আবার বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ এ জন্যে যে, এই অবস্থান থেকেই বঙ্কিমচন্দ্র এবং তাঁর মতো অন্যান্যরা ভারতীয় জাতীয়তাবাদের রূপরেখা, তার চরিত্র, তার সীমাবদ্ধতা সমস্ত কিছুই নির্ধারণ করেছিলেন।
যাই হোক, বঙ্কিমচন্দ্রের উপরোক্ত বক্তব্যসমূহ যে কতদূর ভ্রান্ত, ইংরেজের শোষণ যে আমাদের জাতীয় জীবনে কতদূর ক্ষতিকারক এবং সামগ্রিক অর্থনীতি ক্ষেত্রে তাদের বাণিজ্য ও রাজস্ব নীতি কি পরিমাণ ধ্বংসাত্মক সেটা রমেশচন্দ্র দত্ত ১৯০১ সালে নিম্নোক্ত ভাষায় বিবৃত করেন—
India in the eighteenth century was a great manufacturing as well as a great agricultural country, and the products of the Indian loom supplied the markets of Asia and Europe. It is, unfortunately, true that the East Indian Company and the British parliament, following the selfish commercial policy of a hundred years ago, discouraged Indian manufacturers in the early years of British rule in order to encourage the rising manufacturers of England. Their fixed policy, pursued during the last decades of the eighteenth and the first decades of the nineteenth, was to make the Indian people grow raw produce only, in order to supply material for the looms and manufacturers of Great Britain. This policy was pursued with unwavering resolution and with fatal success; orders were sent out, to force Indian artisans to work in the company’s factories; commercial residents were legally vested with extensive power over villages and communities of Indian weavers; prohibitive tariffs excluded Indian silk and cotton goods from England; English goods were admitted into India free of duty or on payment of normal duty…. It is a painful episode in the history of British rued in India; but it is a story which has to be told to explain the economic condition of the Indian people and their present helpless dependence on agriculture.[৮৭]
‘…কি আমদানীতে, কি রপ্তানীতে, বিদেশীয় বণিকেরা আমাদের টাকা লইয়া যাইতেছেন না এবং তন্নিবন্ধন আমাদিগের দেশের টাকা কমিতেছে না। বরং বিদেশীয় বাণিজ্য কারণ আমাদিগের দেশের ধন বৃদ্ধি হইতেছে।[৮৮]—বঙ্কিমচন্দ্র এ কথা বললেও তাঁরই সমসাময়িক রমেশচন্দ্র বলেছেন—
Taxation raised by a king says the Indian poet is like the moisture of the earth sucked up by sun to be returned to the earth as fertillising rain; but the moisture raised from the Indian soil now descendes as fertillising rain largely on other lands, not on India, Every nation reasonably expects that the proceeds of taxes raised in the country should be mainly spent in the country. Under the worst government that India had in former times, this was the case. The vast sums that the Afgan and Moghal emperors spent on their armies went to support great and princely houses, as well as hundreds of thousands of soldiers and their families. The gorgeous palaces and monuments they built, as well as the luxuries and displays in which they indulged, fed and encourged the manufacturers and artisans of India. Nobles and commanders of the army, subadars, dewans and kazis, and host of inferior officers in every province and every district, followed the examples of the court; and mosques and temples, roads, canals and reservoirs, attested to this wider liberality, or even to their vanity, under wise rulers, as under foolish kings the proceeds of taxation flowed back to the people and fructified trade and industries. but a change came over India under the rule of the East India Company. They considered India as a vast eastate or plantation, the profits of which were to be withdrawn from India and deposit in Europe. …A nation is impoverished if these sources of its wealth are narrowed, and the proceeds of taxation are largely remitted out of the country. These are plain, self-evident economic laws, which operate in India as in every other country….[৮৯]
বঙ্কিমচন্দ্র কাপড়ের থান ইংল্যান্ড থেকে আমদানী এবং দেশীয় বাজারে বিক্রয় প্রসঙ্গে যা বলেছেন সেটা দেশপ্রেমিক ও প্রকৃত জাতীয়তাবাদীর কথা নয়। সর্বাংশে একজন মামুলি খরিদ্দারের দৃষ্টিভঙ্গী থেকেই তিনি থান আমদানী ও বিক্রয়ের প্রশ্নটিকে বিচার করেছেন এবং থানের ক্ষেত্রে যে কথা প্রযোজ্য সেটা অন্যান্য সামগ্রীর ক্ষেত্রেও যে সমান প্রযোজ্য তা বলাই বাহুল্য। চাকুরী এবং জমিদারীর নিশ্চিন্ত ও মোটামুটি বাঁধা-ধরা আয়ের ওপর নির্ভরশীল ভদ্রলোকের ‘দেশপ্রেমের ‘ দৌড় কতদূর ছিলো সেটা বঙ্কিমচন্দ্রের এই খরিদ্দার মনোবৃত্তি থেকেই খুব স্পষ্টভাবে বোঝা যায়। দেশের অর্থনীতি, শিল্প-বাণিজ্য-কৃষি যখন ধ্বংসপ্রায় এবং দেশের সাধারণ জীবন যখন সাম্রাজ্যবাদী নির্যাতন ও লুণ্ঠনে জর্জরিত ও সর্বস্বান্ত সে সময় বঙ্কিমচন্দ্রের একমাত্র বিবেচনা হচ্ছে ক্রয়যোগ্য যে কোন সামগ্রী কত অল্প মূল্যে পাওয়া যায়। স্বদেশী বিদেশীর কোন বিবেচনা সেখানে নেই। কাজেই অপেক্ষাকৃত অল্প মূল্যে তাঁরা এবং তাঁদের শ্রেণী ভাইরা সামগ্রী পেলেই হলো। তাতে দেশের অর্থনীতি, দেশের কারিগর, শিল্প ও বাণিজ্য সমস্ত কিছুই ধ্বংস হয়, হোক।
ভারতবর্ষ থেকে সম্পদ পাচারের যে উল্লেখ রমেশচন্দ্র করেছেন, বঙ্কিমচন্দ্র তার বিরোধী বক্তব্য উপস্থিত করে বলেছেন, ইংরেজের বাণিজ্যের ফলে আমাদের দেশের ‘ধনবৃদ্ধি’ হচ্ছে। বঙ্কিমচন্দ্রের এই সমস্ত বক্তব্য এত বিস্তারিতভাবে উল্লেখ এবং আলোচনার প্রয়োজন হতো না, যদি না তিনি ভারতীয় জাতীয় আন্দোলনের জনক ও দার্শনিক এবং ঋষি হিসেবে বাঙালী রেনেসাঁস ও ভারতীয় জাতীয়তাবাদের জয়গানরত ব্যক্তিদের দ্বারা ব্যাপকভাবে বন্দিত হতেন। তাছাড়া বিদ্যাসাগর এবং অন্যান্যদের দ্বারা পরিচালিত সংস্কার আন্দোলনের অবক্ষয় ও পতনের সঙ্গে ভারতীয় জাতীয় আন্দোলনের উত্থান কিভাবে এবং কেন সম্পর্কিত ছিলো সেটা উপলব্ধির জন্যেও এই উল্লেখ নিতান্ত প্রয়োজনীয়।
উপরে যে রমেশচন্দ্র দত্তকে কয়েকবার উদ্ধৃত করা হয়েছে তিনি ছিলেন বৃটিশ ভারতীয় সরকারের একজন অগ্রগণ্য দেশীয় আমলা, আঠারো ঊনিশ শতকের বৃটিশ ভারতের অর্থনৈতিক ইতিহাসের প্রথম উল্লেখযোগ্য রচয়িতা এবং ১৮৯৯ সালে কংগ্রেসের লক্ষ্ণৌ সম্মেলনের সভাপতি। ঊনিশ শতকের অন্যান্য কংগ্রেস নেতাদের মতো তিনিও ভারতের বৃটিশ রাজত্ব উচ্ছেদের কামনা করেননি এবং তার সম্ভাবনাকে সুদূর পরাহত মনে করেছেন। তৎকালীন ভারতের অর্থনৈতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অর্থনৈতিক ইতিহাস রচনার উদ্দেশ্য বর্ণনা করতে গিয়ে ১৯০১ সালে তিনি উপরোক্ত গ্রন্থটির ভূমিকাতে বলেছেন—
In the presence of facts like these, party controversy is silenced and every Englishman and every Indian, experienced in administration and faithful to the Brithsh Empire, feel it their duty to suggest methods for the removal of the gravest danger which has ever threatened the empire of India.
জাতীয় আন্দোলনের এই সমস্ত নেতারা ভারতের এবং বাঙলার অর্থনৈতিক অবস্থার সঙ্গে অপরিচিত ছিলেন না কিন্তু সেই পরিচয় এবং রমেশচন্দ্র দত্তের ক্ষেত্রে সেই গভীর পরিচয় সত্ত্বেও, এই ধরনের জাতীয়তাবাদী নেতারা ভারতে বৃটিশ শাসনের অবসান চাননি। তাঁরা শুধু চেয়েছিলেন বৃটিশ শাসনের কতকগুলি দোষ-ত্রুটির সংশোধন, ভারতীয় আমলাদের প্রতি বৃটিশ সরকারের আরও সহানুভূতিশীল ও সমতুল্য ব্যবহার, শিল্পের কিছু সম্প্রসারণ এবং ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষেত্রে অধিকতর সুযোগ সুবিধা।
কি কারণে ভারতীয় উচ্চ ও মধ্যশ্রেণীর এই তথাকথিত জাতীয়তাবাদী আন্দোলন বৃটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ঊনিশ শতকে এবং বিশ শতকেরও প্রথম তিন দশকে স্বাধীনতার আন্দোলন হিসেবে পরিচালিত হতে পারেনি তার কারণ অনুসন্ধান ভারতীয় এবং বাঙলাদেশের অর্থনীতির মধ্যেই করতে হবে। বাঙলাদেশের ক্ষেত্রে এই অর্থনীতি হলো চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত-সৃষ্ট কৃষি অর্থনীতি
ঊনিশ শতকে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের নেতৃত্ব প্রধানত এসেছিলো বাঙলাদেশ থেকে। এ জন্যে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের অর্থনৈতিক ভিত্তির ওপর রচিত বাঙালীদের ভারতীয় জাতীয়তাবাদ পরবর্তীকালে সারা ভারতের জাতীয়তাবাদকে প্রদেশ, জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে অনেকাংশে প্রভাবিত এবং আচ্ছন্ন করে। বাঙালীদের অর্থাৎ বাঙালী উচ্চ ও মধ্যশ্রেণীর, এই জাতীয়তাবাদের দার্শনিক প্রবক্তা বঙ্কিমচন্দ্রের মধ্যে জাতীয়তাবাদ কি চরিত্র পরিগ্রহ করেছিলো এবং কি কি লক্ষণ তার মধ্যে পরিস্ফুট হয়েছিলো সেগুলির বিচার শুধু যে ঊনিশ শতকের ভারতীয় জাতীয়তাবাদের আলোচনার ক্ষেত্রেই প্রয়োজনীয় এবং প্রাসঙ্গিক তাই নয়। বিশ শতকের এই সত্তরের দশকেও সেই আলোচনা সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার সামন্তবাদ সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী সংগ্রামের পর্যালোচনার ক্ষেত্রেও যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক এবং অতীব গুরুত্বপূর্ণ।
আঠারো শতকের দ্বিতীয়ার্ধে এবং ঊনিশ শতকের প্রথমার্ধে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনে বাঙলাদেশ এবং বৃটিশ-পদানত ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে যে অর্থনৈতিক প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিলো সেই প্রক্রিয়া ঊনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাঙালী এবং ভারতীয় শিল্প-বাণিজ্যকে প্রায় সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দিয়ে চিরস্থায়ী ভূমি ব্যবস্থা এবং সরকারী চাকুরীর উপর উচচ ও মধ্যশ্রেণীকে নির্ভরশীল করে। এর ফলেই ঊনিশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত যে সমস্ত বাঙালী পরিবারসমূহ ব্যবসা বাণিজ্যে যথেষ্ট প্রতিপত্তি অর্জন করেছিলো সেই পরিবারগুলি পরবর্তীকালে নিজেদের ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নতিসাধন ও সম্প্রসারণ তো করতে পারেইনি, উপরন্তু বাণিজ্যলক্ষ্মীকে বিদায় দিয়ে ভূসম্পত্তি ক্রয়ের মাধ্যমে নিজেদের অর্থনৈতিক জীবনকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা এবং নিরাপদ করতে নিযুক্ত হয়েছিলো। এ কারণেই রামমোহন রায়, দ্বারকানাথ ঠাকুর, রামগোপাল ঘোষ, মতিলাল শীল, রামদুলাল দে, প্যারিচাঁদ মিত্র, তারাচাঁদ চক্রবর্তী প্রভৃতি যাঁরা ঊনিশ শতকের প্রথমার্ধে ব্যবসা-বাণিজ্যে অল্প বিস্তর প্রতিষ্ঠা অর্জন করেছিলেন তাঁদের পরিবারগুলি পরবর্তীকালে নিজেদের ব্যবসা- বাণিজ্যকে আর টিকিয়ে রাখতে পারেনি। এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য যে ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত এই সমস্ত ব্যক্তিরাই প্রথমার্ধে ছিলেন তৎকালীন উচ্চশ্রেণীর মধ্যে যা কিছু প্রগতিশীলতা দেখা গিয়েছিলো তার সর্বপ্রধান ধারক ও বাহক। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর অন্যান্যদের মতো ব্যবসায়ী না হলেও তাঁর আর্থিক জীবনের মূল ভিত্তিও পরবর্তীকালে দাঁড়িয়েছিলো স্বাধীন পুস্তক ব্যবসায়।
বৃটিশ শাসনে ঊনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে, বিশেষত সত্তরের দশক থেকে, ব্যবসা বাণিজ্যের এমন অবনতি ঘটে যে, শিক্ষা-সংস্কৃতির সঙ্গে যাঁরা ঐ সময়ে জড়িত থাকেন তাঁদের মধ্যে বাণিজ্য প্রবৃত্তি সম্পূর্ণভাবে নিবৃত্ত হয়। তাঁদের আর্থিক জীবন থেকে বাণিজ্যের বিলুপ্তির ফলে তাঁরা সরকারী চাকুরী এবং ভূসম্পত্তির ওপরেই প্রধানতঃ নির্ভরশীল হন। এই নির্ভরশীলতাই পরবর্তীকালে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এবং অন্যান্যদের সমাজ-সংস্কার আন্দোলনকে যেমন একদিকে রক্ষণশীলতার আবর্তের মধ্যে আকর্ষণ করে তাকে পাতালে প্রেরণ করেছিলো, তেমনই তা জাতীয়তাবাদের উত্থানের যুগে জাতীয়তাবাদী ধ্যান-ধারণা ও চিন্তাকে করেছিলো কতকগুলি প্রতিক্রিয়াশীল লক্ষণবিশিষ্ট।
স্বাধীন ব্যবসা-বাণিজ্যের অভাবে ভূমি-স্বার্থ এবং সরকারী ও আধাসরকারী চাকুরীর ওপর উচ্চ ও মধ্যশ্রেণীর নির্ভরতা ঊনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে, বিশেষতঃ সত্তরের দশক থেকে, বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে তাদের পক্ষে বৃটিশ শাসনের বিপক্ষে দাঁড়ানো অথবা তার উচ্ছেদের জন্যে সংগ্রাম করা সম্ভব ছিলো না। এই সময়ে বাঙালীদের মধ্যে শিক্ষা-দীক্ষার কিছুটা সম্প্রসারণ হয়। কিন্তু যে জাতীয় শিক্ষা তাদের কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে দান করা হতো তার দ্বারা জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার অনুপ্রেরণার পরিবর্তে সরকারী চাকুরীতে প্রবেশ করার তাড়নাই তাদের মধ্যে অধিকতর প্রবল থাকে। অল্পসংখ্যক ওকালতি, চিকিৎসা, শিক্ষকতা ইত্যাদি বৃত্তি অবলম্বন করলেও অধিকাংশেরই ঝোঁক থাকে আমলা হওয়ার দিকে। বৃটিশ ভারতীয় সরকারও এই সময় প্রশাসন যন্ত্রের মধ্যে দেশীয় আমলার সংখ্যাবৃদ্ধির দিকে কিছুটা নজর দেয়।
কিন্তু শিক্ষা-দীক্ষার প্রসার এবং সরকারী চাকুরীর ক্ষেত্রে এইভাবে কিছুটা সম্প্রসারণ হওয়া সত্ত্বেও এই সময় শিক্ষিত বাঙালী সমাজের সঙ্গে ইংরেজ শাসকদের একটা মৃদু সংঘাত শুরু হয়। এই সংঘাতের কারণ পূর্ববর্তী যুগে বাঙালী শিক্ষিত শ্রেণীকে সরকার যতখানি সুনজরে দেখতো, ততখানি সুনজরে তারা পরবর্তীকালে, বিশেষত সিপাহী বিদ্রোহের পর, তাদের আর দেখলো না। শিক্ষা-দীক্ষায় অগ্রসর হলেও বাঙালী আমলারা সুযোগ, সুবিধা ও মর্যাদার ক্ষেত্রে বৃটিশ আমলাদের থেকে অনেক নিম্নস্তরে ছিলো। চাকুরী ক্ষেত্রে এই বৈষম্য তাদের মধ্যে একটা জাত্যাভিমান সৃষ্টি করে। কিন্তু এই জাত্যাভিমান তাদের বৃটিশের বিরুদ্ধে কিছুটা বিক্ষুব্ধ করলেও সেই বিক্ষোভকে বিদ্রোহের চরিত্র দান করার ক্ষমতা শ্রেণীগতভাবে তাদের ছিলো না। কাজেই এই সমস্ত সরকারী চাকুরীরত জাত্যাভিমানীদের মধ্যে বৃটিশ শাসনের কতকগুলি অন্যায় দিক সম্পর্কে একটা বিক্ষোভ থাকলেও তার কোন সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী চরিত্র থাকা সম্ভব ছিলো না। কারণ তারা চাকুরীরত অবস্থায় সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধিতা করতে গেলে তাদের চাকরী খোয়া যেতো এবং আর্থিক জীবন ভেঙে পড়তো। আর্থিক জীবন যেখানে শ্রেণীগতভাবে সাম্রাজ্যবাদের খুঁটিতে বাঁধা ছিলো, সেখানে তাদের জাত্যাভিমান যে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী কোন বৈপ্লবিক চরিত্র পরিগ্রহ করবে না সেটা স্বাভাবিক।
তাছাড়া এইসব সরকারী আমলা ও শিক্ষিত শ্রেণীর লোকদের আর্থিক জীবনের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিলো এরা প্রায় সকলেই জমিদার শ্রেণী থেকে উদ্ভুত এবং চাকুরীতে থাকা অবস্থায় অথবা অবসর গ্রহণের পর নিজের সঞ্চিত অর্থ তারা জমি এবং জমিদারী ক্রয়ের জন্য ব্যয় করতো। এইসব শ্রেণীর সঞ্চিত অর্থ যে চিরস্থায়ী বন্দোদবস্তের ফলে এইভাবেই বাঙালী উচ্চশ্রেণীর লোকেরা ব্যয় করবে সে কথা দূরদৃষ্টি সম্পন্ন কর্নওয়ালিস কোম্পানির ডিরেক্টরদের কাছে ১৭৯৩ সালে লিখিত একটি চিঠিতে নিম্নোক্ত ভাষায় উল্লেখ করেন, ‘ভূমিস্বত্বকে নিরাপদ ঘোষণা করার সঙ্গে সঙ্গেই এ দেশীয়দের হাতে যে বিরাট পুঁজি আছে সেটাকে তারা অন্য কোনভাবে নিয়োগ করার উপায় না দেখে ভূসম্পত্তি ক্রয়ের উদ্দেশ্যেই ব্যয় করবে। সঞ্চিত অর্থ যাতে ‘অন্য কোনো উপায়ে ব্যয় অর্থাৎ শিল্প-বাণিজ্য ইত্যাদির উদ্দেশ্যে ব্যয় করা এ দেশীয়দের দ্বারা সম্ভব না হয় তার জন্যে বৃটিশ ভারত সরকারের নীতি যে সর্বতোভাবে নিয়োজিত ছিলো সেটা ইতিপূর্বে দেখা গেছে।
এইভাবে একদিকে চাকুরী এবং অন্যদিকে ইংরেজের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত সৃষ্ট ভূসম্পত্তির ওপর প্রায় সমগ্র বাঙালী শিক্ষিত সমাজের আর্থিক জীবন দাঁড়িয়ে থাকার ফলে জাত্যাভিমান উদ্ভুত তাদের সেই তথাকথিত জাতীয়তাবাদ বৃটিশ শাসনের বিরুদ্ধে, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত হতে পারেনি। উপরন্তু, সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থে আপোসের মাধ্যমে নিজেদের ক্ষুদ্র শ্রেণীস্বার্থ গুছিয়ে নেওয়াই ছিলো সেই উচ্চ ও মধ্যশ্রেণীর জাতীয়তাবাদের মূল রাজনৈতিক লক্ষ্য। ভারতীয় জাতীয়তাবাদের এই লক্ষ্য, আপসের এই নিদারুণ প্রবণতা শেষ পর্যন্ত বজায় ছিলো। ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ সমগ্র ভারতবর্ষকে যে রাজনৈতিক অবস্থার মধ্যে নিক্ষেপ করে গিয়েছিলো তা সম্ভব হওয়ার মূল কারণ ভারতীয় জাতীয়তাবাদের নেতৃত্বদানকারী উচ্চ ও মধ্যশ্রেণীর ওপরে বর্ণিত আর্থিক জীবনের মধ্যেই যে নিহিত ছিলো সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।
সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে এই আপসের রাজনীতির দার্শনিক ভিত্তি বঙ্কিমচন্দ্রই রচনা করেন। তাঁর লেখা আনন্দমঠ নামক উপন্যাসটি ভারতীয় ‘জাতীয়’ আন্দোলনের ক্ষেত্রে যে প্রভাব বিস্তার করে সে প্রভাব অল্পকাল স্থায়ী ছিলো না। উপরন্তু, ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে আপসমূলক ও সাম্প্রদায়িক চরিত্রদান করে তার ওপর এক গভীর ও সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করেছিলো।
জাতিকে হিন্দু ধর্ম সম্প্রদায়ের সঙ্গে এক করে বঙ্কিমচন্দ্র বাঙলাদেশে যে জাতীয়তাবাদের জন্ম দেন সে জাতীয়তাবাদ একদিকে ছিলো বৃটিশ-শাসন বিরোধিতায় বিমুখ এবং অন্যদিকে ছিলো সাম্প্রদায়িক হলাহলে পরিপূর্ণ। জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের এই দুই চরিত্রই আবার মূলতঃ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের দ্বারা সৃষ্ট। ইংরেজের ব্যবহারে অপমানিত হয়ে তাদের মধ্যে যে জাত্যাভিমান দেখা দিয়েছিলো, সে জাত্যাভিমান ইংরেজের বিরুদ্ধে পরিচালিত হওয়ার কোন পথ না থাকায় তা প্রায় সর্বাংশে পরিচালিত হয়েছিলো মুসলমান সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে। শত্রু ব্যতীত জাতীয় আন্দোলন সংহত ও শক্তিশালী হয় না। জাতীয় আন্দোলনকে শক্তিশালী করতে হলে শত্রু প্রয়োজন। ইংরেজকে শত্রু হিসেবে গণ্য করা সেই মেরুদণ্ডহীন শ্রেণীর পক্ষে সম্ভব ছিলো না। কাজেই মুসলমান সম্প্রদায়কেই ভারতীয় জাতীয় আন্দোলনের জনক শত্রু হিসেবে দাঁড় করিয়ে যে রাজনৈতিক মত আনন্দমঠ, ধর্মতত্ত্ব (অনুশীলন) এবং বঙ্গদর্শন-এ প্রচার করলেন তার কুপ্রভাবে হিন্দু উচ্চ ও মধ্যশ্রেণীর অপেক্ষাকৃত প্রগতিশীল অংশও বহুলাংশে প্রভাবিত হলো। *
[*“জাতীয়তা ও হিন্দুত্বকে সমার্থক করে ফেলার ফলে সাম্প্রদায়িকতার সমস্যা ছাড়াও সুষ্ঠু রাজনৈতিক চিন্তারও যে গুরুতর ক্ষতি হয়েছিল তাতে সন্দেহ নেই। হিন্দুত্ব নিয়ে ব্যতিব্যস্ত থাকার ফলে ব্যক্তি-জীবনের নৈতিক সমস্যাগুলির ওপর যত গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল, সামগ্রিক জীবনের রাজনৈতিক সমস্যাগুলি ঠিক সেই পরিমাণ অবহেলিত হয়ে পড়ে। হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের রচনায় কোথাও আমরা মানুষের অধিকার সম্বন্ধে, স্বাধীন ভারতের সম্ভাব্য রাজনৈতিক কাঠামো সম্বন্ধে, বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের পারস্পরিক সম্বন্ধের বিষয়ে এবং রাষ্ট্র ও সরকারের চরিত্রের বিষয়ে কোনো আলোচনা পাই না। অথচ রাজনৈতিক আন্দোলনের পশ্চাতে যদি কেবল নৈতিক ভাবনা থাকে এবং রাজনৈতিক চিন্তা ও সচেতনতা যদি অনুপস্থিতির দ্বারা লক্ষ্যগোচর হয়, তবে তার ফলে আর যা-ই হোক রাজনৈতিক সাফল্য সুদূরপরাহত হয়। বাংলা তথা ভারতবর্ষের পরস্পরাগত রাজনৈতিক আন্দোলনের ইতিহাস তাই যুবকদের অমিত আত্মত্যাগ সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত এত করুণ।” — অসিতকুমার ভট্টাচার্য, বাংলার নবযুগ ও বঙ্কিমচন্দ্রের চিন্তাধারা, পৃ ৭৭- ৭৮।]
ঊনিশ শতকের শেষ দিকে মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যেও শিক্ষা-দীক্ষার কিছুটা সম্প্রসারণ হচ্ছিলো এবং পূর্ববর্তী ইংরেজ-বিরোধিতা বাদ দিয়ে নিজেদের আর্থিক জীবন নোতুনভাবে তারা গুছিয়ে নিতে ব্যস্ত ছিলো। মুসলমান সম্প্রদায়ভুক্ত এই উচ্চ ও মধ্যশ্রেণীও সে সময় হিন্দুদের মতোই চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ও সরকারী চাকুরীর ওপর নির্ভরশীল এবং সমান মেরুদণ্ডহীন ছিলো। বৃটিশের প্রতি আনুগত্য এবং সাম্প্রদায়িকতা সে সময় তাদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক চিন্তাকেও সর্বাংশে আচ্ছন্ন করে রাখে।** হিন্দু মুসলমান উচ্চ ও মধ্যশ্রেণী এইভাবে একদিকে বৃটিশের সঙ্গে আপস এবং অন্যদিকে পরস্পরের ক্ষমতা, প্রভাব ও প্রতিপত্তি বৃদ্ধি করে নিজ নিজ সাম্প্রদায়িক স্বার্থ উদ্ধার করার উদ্দেশ্যে একে অপরের সঙ্গে ধীরে ধীরে রাজনৈতিক সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ এই সংঘর্ষকে ঊনিশ শতকের শেষ দিক থেকে সুকৌশলে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে এবং ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষকে দ্বিখণ্ডিত করে হিন্দু এবং মুসলমান শোষক শ্রেণীসমূহের হাতে পৃথক পৃথকভাবে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক ক্ষমতা হস্তান্তর করে।
[**দ্রষ্টব্য : বদরুদ্দীন উমর সাম্প্রদায়িকতা, সাংস্কৃতিক সংকট, সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা।]
ঊনিশ শতকে যে ‘জাতীয়তাবাদ’ ও ‘জাতীয়তাবাদী আন্দোলন’-এর উদ্বোধন হলো তা যে শুধু সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে আপোস এবং সাম্প্রদায়িকতার লক্ষণ বিশিষ্ট ছিলো, তাই নয়। তার অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ (অবশ্য অন্য দুটির মতো নয়) লক্ষণ ছিলো সন্ত্রাসবাদের প্রতি ঝোঁকের মূল কারণও চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত এবং উচ্চ ও মধ্যশ্রেণীর আর্থিক জীবনের মধ্যেই নিশ্চিতভাবে নিহিত ছিলো।
কোন দেশে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী জাতীয় আন্দোলন কৃষকশ্রেণীর অংশগ্রহণ ব্যতীত সাফল্য অর্জন করতে পারে না। ভারতবর্ষ এবং বাঙলাদেশের ‘জাতীয়তাবাদী’ আন্দোলন কিন্তু সে পথে যায়নি। কারণ এই জাতীয়তাবাদীরা জাত্যাভিমানবশত ইংরেজকে ঘৃণা করতেন যত, তার থেকে অনেক বেশী ঘৃণা ও ভয় করতেন কৃষকশ্রেণীকে—তাদের উত্থান ও রাজনৈতিক শক্তি অর্জনকে। এ জন্যে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে তাঁরা যত আগ্রহশীল ছিলেন তার থেকে অনেক বেশী আগ্রহশীল ছিলেন সেই আন্দোলন থেকে কৃষকদের তফাৎ রাখতে। তাই ‘সন্ন্যাসী বিদ্রোহ’ নামে পরিচিত আঠারো শতকের দ্বিতীয়ার্ধে কৃষক ও কর্মহারা কারিগরদের সশস্ত্র বিদ্রোহকে কতকগুলি ধর্মান্ধ সন্ন্যাসীর সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ হিসেবে চিত্রিত করে বঙ্কিমচন্দ্র একদিকে যেমন একটি ইংরেজ-বিরোধী অসাম্প্রদায়িক সংগ্রামকে ইংরেজের সঙ্গে আপোসমূলক ও সাম্প্রদায়িক চরিত্র দান করেছেন, অন্যদিকে তেমনি তিনি একটি গণসংগ্রামকে দান করেছেন সন্ত্রাসবাদী চরিত্র। ধর্মতত্ত্ব এবং অনুশীলন রচনায় তিনি এই সন্ত্রাসবাদেরই দার্শনিক ভিত্তি রচনা করেন।
সন্ত্রাসবাদ কিন্তু উপরোক্ত জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের একটা পদ্ধতি হিসেবে তেমন প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারেনি। এই না পারার কারণ, সন্ত্রাসবাদের একটা স্বাভাবিক প্রবণতা হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার দিকে। পদ্ধতিগত দিক থেকে ভ্রান্ত হলেও লক্ষ্যের দিক দিয়ে বিবেচনা করলে তাকে ভ্রান্ত বলা চলে না। ঊনিশ শতকের শেষ দশক থেকে শুরু করে প্রায় চল্লিশ বছর ভারতে এবং বাঙলাদেশে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন জাতীয় আন্দোলনের একটা অপ্রধান ধারা হিসেবে বর্তমান থাকে এবং এই সন্ত্রাসবাদীদের কার্যকলাপের মাধ্যমেই বৃটিশ-বিরোধিতা এই পর্যায়ে সর্বোচ্চ রূপ লাভ করে।
কিন্তু এই সন্ত্রাসবাদী যুবকেরা ছিলেন মধ্যশ্রেণীভুক্ত এবং তাঁদের ওপর জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রথম যুগের কতকগুলি কুপ্রভাবও অনেকাংশে বর্তমান ছিলো। ঐতিহ্য হিসেবে সেই সমস্ত কুপ্রভাবগুলির একটি হলো জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে রাজনৈতিক চিন্তা এবং অপরটি হলো সাম্প্রদায়িকতা।
তথাকথিত কংগ্রেসী জাতীয়তাবাদী নেতাদের (যাঁদের মধ্যে হিন্দু, মুসলমান এবং অন্যান্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের লোকেরা সকলেই ছিলেন) সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতায় পরান্মুখ দেখে মধ্যশ্রেণীর একদল যুবক প্রকৃত দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে এই সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনে যোগদান করেন। বাঙলাদেশের মধ্যে শ্রেণীভুক্ত এই সমস্ত যুবকেরা প্রায় সকলেই হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত। ইংরেজ-বিরোধী সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনে নামার সময় তাঁরা আনন্দমঠ, ধর্মতত্ত্ব, ভগবদগীতা হাতে নিয়েই সেই আন্দোলনে নামেন। এ জন্যে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধিতা সত্ত্বেও সন্ত্রাসবাদী হিসেবে চিন্তা ও পদ্ধতিগত দিক থেকে যেমন তাঁরা ভ্রান্ত পথের অনুসারী ছিলেন, তেমনই অন্যদিকে তাঁদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক প্রভাবেরও অভাব ছিলো না।
[* এই পর্যায়ে মধ্যশ্রেণীভুক্ত মুসলমানরা ঐ শ্রেণীভুক্ত হিন্দুদের থেকে ইংরেজের অনেক বেশী খয়েরখাঁ ছিলেন। এজন্যেই তাঁদের মধ্যে থেকে অতি অল্পসংখ্যক ব্যক্তিই ওই সময়ে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনে যোগদান করেন। বিশ শতকের গোড়া থেকেই এই মুসলমান মধ্যশ্রেণীর চাকরী, ব্যবসা ইত্যাদি ক্ষেত্রে সমশ্রেণীর হিন্দুদের সাথে প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে ছিল দুর্বল পক্ষ। সেই হিসেবে ইংরেজের ওপর রাজনৈতিক দিক দিয়ে তারা তুলনায় অনেক বেশি নির্ভরশীল ছিলো। অন্যদিকে, এই প্রতিযোগিতার মুখে তাদের মধ্যে যে ‘জাত্যাভিমান’ সৃষ্টি হয় সেই জাত্যাভিমানের বশবর্তী হয়ে তারা ভারত ও বাঙলাদেশকে বিদেশ জ্ঞান করে আরব, ইরান, তুর্কীর সাথে অধিকতর সাংস্কৃতিক যোগ কল্পনা করে এক উদ্ভট সাংস্কৃতিক বন্ধ্যাত্ব নিজেদের সমাজে সৃষ্টি করে। এই সংস্কৃতিকে তারা ‘মুসলিম সংস্কৃতি’ নাম দিয়ে বিশ শতকের চল্লিশের দশকে তার যে রাজনৈতিক সংস্করণ খাড়া করে সেই রাজনৈতিক সংস্করণের নামই হলো পাকিস্তান।]
এ কথার অর্থ অবশ্য এই নয় যে, সন্ত্রাসবাদীরা সকলেই সাম্প্রদায়িক ছিলেন, অথবা যাঁদের মধ্যে সেই পর্যায়ে সাম্প্রদায়িক চিন্তা-ভাবনা ছিলো তাঁরা কেউই সেই চিন্তা-ভাবনা পরবর্তীকালে কাটিয়ে উঠতে পারেননি। এর সরল অর্থ হলো এই যে, তৎকালীন সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের মধ্যে ইতিপূর্বে বর্ণিত চরিত্র-সম্পন্ন হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত মধ্যশ্রেণীর প্রাধান্য থাকার ফলে সাধারণভাবে সন্ত্রাসবাদীদের মধ্যে একদিকে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন রাজনৈতিক চিন্তা এবং অন্যদিকে ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক চিন্তা উভয়ই বর্তমান ছিলো। এই সন্ত্রাসবাদী ও সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গী সন্ত্রাসবাদী পদ্ধতিতে সাম্প্রদায়িক শত্রু হত্যার দিকে পরিচালিত না হলেও অতি সূক্ষ্মভাবে এবং সাধারণভাবে তা সামগ্রিক চিন্তার ক্ষেত্রে একটা ব্যাপক ও বিস্তৃত প্রভাব বিস্তার করে। চিন্তার কাঠামোকেও তা অনেকাংশে নির্ধারণ করে। ভারতীয় জাতীয় আন্দোলনের বন্ধ্যাত্বের জন্য সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন ভারতে এবং বিশেষতঃ বাঙলাদেশে যত বিচিত্র পথগামী হয়, অন্যত্র তা হতে দেখা যায়নি। এ দিক দিয়েও এ দেশীয় সন্ত্রাসবাদের ইতিহাস গুরুতর পর্যালোচনার যোগ্য।
কিন্তু অন্য আর একটি কারণেও এই সন্ত্রাসবাদের গুরুত্ব আমাদের দেশে খুব বেশী। সে কারণটি হলো, এই সন্ত্রাসবাদের মধ্যে থেকেই ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলনের জন্ম এবং সন্ত্রাসবাদীদের হাতেই তার প্রাথমিক ভিত্তি রচিত হয়। অন্যান্য দেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনে সন্ত্রাসবাদীদের কিছু কিছু গৌণ প্রভাব থাকে কিন্তু ভারতে ও বাঙলাদেশে সন্ত্রাসবাদীরাই কমিউনিস্ট আন্দোলনের জন্ম দেন এবং তার প্রাথমিক বিকাশ ঘটান।
পৃথিবীর সব দেশেই কমিউনিস্ট আন্দোলনের পূর্ববর্তী পর্যায়ে মধ্যশ্রেণীর যুবকদের নেতৃত্বে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের একটা অস্তিত্ব দেখা যায় এবং সেই হিসেবে কমিউনিস্ট আন্দোলন ঐতিহাসিকভাবেই সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের পরবর্তী পর্যায়। আমাদের দেশের ক্ষেত্রেও কমিউনিস্ট আন্দোলন ঐতিহাসিকভাবে সন্ত্রাসবাদী রাজনীতিরই পরবর্তী পর্যায় তবু এ ক্ষেত্রে একদিক দিয়ে অন্যান্য দেশের পরিস্থিতির সঙ্গে আমাদের দেশের পরিস্থিতির গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য আছে। অন্যান্য দেশে (উদাহরণ স্বরূপ রাশিয়া ও চীনে) কমিউনিস্ট আন্দোলন সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের পরবর্তী পর্যায় হলেও সন্ত্রাসবাদীরা সেখানে প্রধান চালিকা-শক্তি হিসেবে কমিউনিস্ট আন্দোলনের জন্মদান অথবা বিকাশ সাধন কোনটিই করেননি। কিন্তু এ দেশে ঠিক তাই হয়েছিলো। বর্তমান শতকের তিরিশের দশকে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন তার শেষ সীমায় উপনীত হওয়ার পর সন্ত্রাসবাদীরা দলে দলে মার্কসবাদে দীক্ষিত হন এবং কমিউনিস্ট আন্দোলনে যোগদান করেন। এই প্রক্রিয়া পূর্বেই শুরু হয়ে তিরিশের দশকে একটা পরিণতি লাভ করে। অল্পসংখ্যক ব্যতিক্রম বাদ দিলে–সন্ত্রাসবাদীরা সকলেই কমিউনিস্ট আন্দোলনে যোগদান করেন এবং গণ-আন্দোলন থেকে বেরিয়ে আসা মার্কসবাদীদের থেকে সংখ্যা ও প্রভাবের দিক দিয়ে তাঁরা প্রথম থেকেই প্রাধান্যে আসেন। এই কারণেই মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন, স্তালিন, মাও সে-তুঙ প্রভৃতি পাঠ এবং অনুশীলন সত্ত্বেও ভারতীয় সন্ত্রাসবাদের এবং সেই সঙ্গে ভারতীয় ‘জাতীয়তাবাদের’ বিশিষ্ট ঐতিহ্যিক লক্ষণগুলি (এমন কি আপোস-মুখীনতা পর্যন্ত) থেকে তাঁরা সম্পূর্ণভাবে কোন দিনই মুক্ত হতে পারেননি। এই লক্ষণগুলির মধ্যে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে চিন্তা জনগণের প্রতি যথোপযুক্ত আস্থার অভাব) এবং সাম্প্রদায়িক কাঠামোর মধ্যে চিন্তা—এই উভয়ই হলো প্রধান লক্ষণ হিসেবে উল্লেখযোগ্য।
বাঙলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার (পূর্ববর্তী ভারতবর্ষের) সর্বত্র কমিউনিস্ট আন্দোলনের ক্ষেত্রে জাতীয়তাবাদী ও সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের ঐতিহ্য কতখানি প্রভাব বিস্তার করেছে তার পর্যালোচনা তো আজ পর্যন্ত সঠিকভাবে হয়ইনি, উপরন্তু তার প্রচেষ্টা পর্যন্ত কেউ করেননি। কিন্তু বর্তমান বাঙলাদেশে এবং ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের পঞ্চাশ বছরের ইতিহাসের দিকে, বিশেষতঃ ১৯৪৭ সালের পরবর্তী ইতিহাসের দিকে তাকালে মনে হয় উপরোক্ত দুই কু-প্রভাব স্থূলভাবে না হলেও অতি সূক্ষ্মভবে কি পরিমাণে কমিউনিস্ট আন্দোলনের অবক্ষয় সৃষ্টি করে বারম্বার তাকে বিভ্রান্ত করেছে তার একটা হিসেব সেই পর্যালোচনার মধ্যেই পাওয়া যাবে।
কমিউনিস্ট আন্দোলনে সন্ত্রাসবাদ, বিশেষতঃ সাম্প্রদায়িক প্রভাবের অস্তিত্ব স্বীকার করতে অনেকে কুণ্ঠিত হবেন এবং সে বিষয়ের উল্লেখের জন্য অনেকে বিক্ষুব্ধ এবং ক্রোধান্বিত হবেন সন্দেহ নেই। কিন্তু সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ায় কমিউনিস্ট আন্দোলনের কতকগুলি মূল সমস্যার পর্যালোচনা ও চরিত্র উপলব্ধি, এই পর্যালোচনা ব্যতীত কিছুতেই সম্ভব নয়। সততা ও সাহসিকতার সঙ্গে এই আত্মসমালোচনামূলক পর্যালোচনায় এগিয়ে আসতে কমিউনিস্টরা যতদিন বিলম্ব করবেন ততদিন জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে চিন্তার অভ্যাস তাঁদের দূরীভূত হবে না এবং সাম্প্রদায়িকতা কত সূক্ষ্মভাবে, অচেতন ও আধা সচেতনভাবে, এ দেশের প্রগতিশীল কমিউনিস্ট আন্দোলনকে ভেতর তেকে ছুরিকাঘাত করছে সেটাও তাঁরা যথোপযুক্তভাবে উপলব্ধি করতে পারবেন না।*
[*আনন্দমঠ যে বিষবৃক্ষের বীজ, রামরাজ্যবাদী গান্ধিজীর সমধর্মী আন্দোলনের [পাকিস্তান আন্দোলনের ব. উ.] মাধ্যমে তার পরিণতি ঘটে দেশ বিভাগে। বঙ্কিমচন্দ্রের প্রথম দিকের নারী চরিত্রে সামাজিক বিদ্রোহের আভাস আছে; কিন্তু আনন্দমঠের পর তাঁর রাজনৈতিক-ঐতিহাসিক কাহিনীগুলিতে যে-সব বীরাঙ্গনার আবির্ভাব ঘটে তাদের অনেকে অবাস্তব। তাদের ক্রিয়াকলাপ মাঝে মাঝে অত্যন্ত পুরুষোচিত, অতীব বীরত্বব্যঞ্জক। শক্তির ধারিকা এই নায়িকারা হিন্দী সিনেমার কথা মনে করিয়ে দেয়। যে বিভ্রান্ত রাজনীতি বন্দে মাতরম্ গানের পেছনে, যে মনোভাবের ফলে মাতৃমূর্তির এত প্রচলন, সে রাজনীতি ও মনোভাব এখনো আমাদের মধ্যে বর্তমান বলে আজকাল রাস্তাঘাট বন্দে মাতরম্ ধ্বনিতে যখন তখন মুখরিত হয় [প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে, ধর্ম-নিরপেক্ষ রাষ্ট্র বাঙলাদেশে এখনো আল্লাহু আকবর ধ্বনি অনেক ‘প্ৰগতিশীল’ সংগঠনের মিটিং, মিছিলে শোনা যায় –ব. উ.]। কিন্তু এই মাতা অবাস্তব। একদিকে ছিলো সতীদাহ, অন্যদিকে মা নিয়ে আবেগ। আর একটি আশ্চর্য ব্যাপার, বঙ্কিমচন্দ্রের বিরূপ সমালোচনা নকশালপন্থীরা পর্যন্ত করেননি।’–সমর সেন, ‘বন্দে মাতরম্,’ এক্ষণ; (দশম বর্ষ ১- ৩ সংখ্যা; শারদীয় ১৩৭৯) পৃ ৩৫-৩৬।]
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও ঊনিশ শতকের বাঙালী সমাজ সম্পর্কে এই আলোচনা আমরা বিশুদ্ধ জ্ঞানান্বেষণের উদ্দেশ্যে করি নাই। সামন্তবাদ, দেশীয় মুৎসুদ্দী পুঁজি ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রামের ক্ষেত্রে নানান ভুলভ্রান্তি ও বিচ্যুতির সঙ্গে এই আলোচ্য বিষয় যদি সম্পর্কহীন হতো তা হলে এই সমালোচনাকে বিশুদ্ধ জ্ঞানান্বেষণের পর্যায়েই ফেলা যেতো। কিন্তু বস্তুতঃপক্ষে এই আলোচনা বর্তমান পরিস্থিতি পর্যালোচনা এবং বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে মোটেই অবান্তর অথবা অপ্রাসঙ্গিক নয়, উপরন্তু অতিশয় সম্পর্কিত এবং প্রাসঙ্গিক।
ইংরেজ-শাসন ও চিরস্থায়ী ভূমি-ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতার মধ্যে ঊনিশ শতকের প্রথমার্ধে যে প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক ও শিক্ষা আন্দোলনের সূত্রপাত হয়, সেই আন্দোলন পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে সমাজ-সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে একটা পরিণতি লাভ করে। কিন্তু সেই সঙ্গে দেশীয় শিল্প-বাণিজ্য ধ্বংসের মাধ্যমে এ দেশীয় লোকদের জীবন চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বেড়াজালের মধ্যে অধিকতরভাবে আটকা পড়ে। এই বেড়াজালই ঊনিশ শতকের ষাটের দশক থেকে সংস্কার-বিরোধী সামাজিক রক্ষণশীলতা ও সাংস্কৃতিক পশ্চাৎপদত্ব উচ্চ ও মধ্যশ্রেণীর মধ্যে বাড়িয়ে তোলে এবং পরবর্তী পর্যায়ের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে নানা প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তার দ্বারা আচ্ছন্ন করে।
এই জাতীয়তাবাদী চিন্তার সীমাবদ্ধতা থেকেই জন্মলাভ করে জাতীয়তাবাদী, সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন।* এ দিক দিয়ে বিবেকানন্দের চিন্তা রামমোহন, বিদ্যাসাগরের চিন্তা থেকে অগ্রসর তো ছিলোই না, উপরন্তু তা ছিলো বঙ্কিমী চিন্তারই পরবর্তী সংস্করণ। পরবর্তী পর্যায়ে কংগ্রেস মার্কা জাতীয় আন্দোলনের মধ্যে বিকাশের কোন সুযোগ না পেয়ে এই আন্দোলন কমিউনিষ্ট আন্দোলনের মধ্যে বিলুপ্ত হয় এবং সন্ত্রাসবাদীরা মার্কসবাদে দীক্ষিত হয়ে কমিউনিস্ট বিপ্লবের পতাকা হাতে নেন। এইভাবে ঊনিশ শতকের মধ্যশ্রেণীর সীমাবদ্ধ অবস্থান থেকে যে সামাজিক আন্দোলনসমূহের সূত্রপাত ঘটে, সেগুলি বাঙলাদেশ ও ভারতের বিশেষ পরিস্থিতিতে নানা ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে ঐতিহাসিকভাবে রূপান্তরিত হতে হতে পরিশেষে কমিউনিস্ট আন্দোলনের মধ্যে লয় প্রাপ্ত হয়।
[*বিশ শতকের প্রারম্ভে এই ধরনের সন্ত্রাসবাদী চিন্তা কিয়দংশে বিবেকানন্দকেও মাঝে মাঝে আচ্ছন্ন করে। কিন্তু ‘মুচি, মেথর, ডোম’ ইত্যাদিকে জাতভাই বলে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেও বিবেকানন্দ পুরোপুরিভাবেই ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্রের পথের পথিক।]
এই লয় প্রাপ্তির জন্যেই ঊনিশ শতকের বাঙলাদেশের উচ্চ ও মধ্যশ্রেণীর প্রগতিশীলতার সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও ঊনিশ শতকের বাঙালী সমাজ সম্পর্কে আলোচনা বিশ শতকের সত্তরের দশকে এই উপমহাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের পর্যালোচনার ক্ষেত্রেও অপ্রাসঙ্গিক নয়, উপরন্তু অতিশয় আবশ্যকীয়
১ Romesh Dutt, The Economic History of India, Vol. II. P 103-10; New Delhi, Publications Division, Ministry of Information & Broadcasting, Government of India.
২ ক) রামমোহন রচনাবলী, কলকাতা, হরফ প্রকাশনী, ১৯৭৩, পৃ ৫২৯।
(খ) সমাচার দর্পণ, ২৬/১২/১৮২৯ উদ্ধৃত : অসিত কুমার ভট্টাচার্যের বাংলার নবযুগ ও বঙ্কিমচন্দ্রের চিন্তাধারা, পৃ ২৯।
৩ দ্রষ্টব্য : ২ (ক) সংখ্যক টীকা, পৃ. ৫২৯-৩৫।
৪ পূর্বোক্ত, পৃ ৫২৯।
৫ পূর্বোক্ত, পৃ ৫১৯-২১।
৬ বিনয় ঘোষ, সাময়িকপত্রে বাংলার সমাজচিত্র, প্রথম খণ্ড : (সংবাদ প্রভাকর)।
৭ বিনয় ঘোষ, বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ, ওরিয়েন্ট লংম্যান, ১৯৭৩, পৃ ৫৪২-৪৪।
৮ ডক্টর দুর্গাচরণ বন্দোপাধ্যায়ের কাছে লিখিত পত্র (দ্র. বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ, পৃ. ৪৫৩)।
৯ পূর্বোক্ত।
১০ রামমোহন রচনাবলী, ভূমিকা : ডক্টর অসিত কুমার ঘোষ, পৃ ২১।
১১ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বক্তব্য, রামমোহন রচনাবলী, পৃ ৭৩০।
১২ ভারতপথিক রামোহন, উদ্ধৃত : রামমোহন রচনাবলী।
১৩ রামমোহন রচনাবলী, ভূমিকা, পৃ ২১।
১৪ বিদ্যাসাগর রচনা সংগ্রহ, দ্বিতীয় খণ্ড, কলকাতা, বিদ্যাসাগর স্মারক জাতীয় সমিতি, পৃ ৫৬৯
১৫ বিনয় ঘোষ, বাংলার সামাজিক ইতিহাসের ধারা (সাময়িকপত্রে বাংলার সমাজচিত্র গ্রন্থের শেষ খণ্ড), পৃ ৩০৬।
১৬ রাজনারায়ণ বসুর আত্মচরিত। পৃ ১১১-১১৩ তৃতীয় সংস্কারণ, ১৯৫১, উদ্ধৃত : বাংলার নবযুগ ও বঙ্কিমচন্দ্রের চিন্তাধারা, অসিত কুমার ভট্টাচার্যের গ্রন্থ, পৃ ২২।
১৭ দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘আত্মজীবনী’।
১৮ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘বিদ্যাসাগরচরিত’।
১৯ পূর্বোক্ত।
২০ বিদ্যাসাগর রচনাসংগ্রহ, তৃতীয় খণ্ড, ভূমিকা, পৃ ৮।
২১ বাঙ্গালা সাহিত্যে প্যারীচাঁদ মিত্রের স্থান- বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, উদ্ধৃত : গোপাল হালদারের ভূমিকা, বিদ্যাসাগর রচনাবলী, ৩য় খণ্ড, বিদ্যাসাগর স্মারক জাতীয় সমিতি। পৃ ৭।
২২ বিদ্যাসাগর রচনাবলী, (৩য় খণ্ড), গোপাল হালদারের ভূমিকা, পৃ ৭।
২৩ বিপিনবিহারী গুপ্ত পুরাতন প্রসঙ্গ ১ম পর্যায়। উদ্ধৃত : গোপাল হালদারের ভূমিকা, বিদ্যাসাগর রচনা সংগ্রহ, ৩য় খণ্ড, পৃ ৮।
২৪ পূর্বোক্ত।
২৫ রামগতি ন্যায়রত্ন, বাঙ্গালা ভাষা ও বাঙ্গালা সাহিত্য বিষয়ক প্রস্তাব (৩ সং) পৃ ১৮৩, উদ্ধৃতঃ বিনয় ঘোষ, বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ, পৃ ৩২৮, ওরিয়েন্ট লংম্যান, ১৯৭৩।
২৬ বঙ্মিকচন্দ্র, বিষবৃক্ষ, বঙ্কিম রচনাবলী, সাহিত্য সংসদ, প্রথম খণ্ড, কলকাতা, পৃ ২৭৯
২৭ বিনয় ঘোষ, বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ, পৃ ১৯৯, ওরিয়েন্ট লংম্যান।
২৮ Nawab Abdul Latif : A Short Account of My Life etc.
২৯ Two Mahomedans on Mahomedan Education. The Hindoo Patriot, Calcutta; 26th October, 1863. Quoted in full in A Short Account of My Humble Efforts to Promote, Education, Specially among the Mahomedans by Nawab Abdul Latif.
৩০ মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, ‘আধুনিক জনমতের উন্মেষ ও সাময়িকপত্র সাধনা’ মুসলিম বাংলা সাহিত্য, মিত্র সংঘ, রাজশাহী, ১৯৬৮।
৩১ নূর-আল-ইমান, প্রথম বর্ষ, ৩য় সংখ্যা, ১৩০৭। উদ্ধৃত : মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, মুসলিম বাংলা সাহিত্য, পৃ ১৪-১৫।
৩২ বিনয় ঘোষ, বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজম পৃ ২৩৯।
৩৩ General Report on Public Instruction 1857 58, APP A 178-80 উদ্ধৃত : বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ, পৃ ২১০।
৩৪ বিনয় ঘোষ, বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ, পৃ ২১০।
৩৫ Education Department Proceedings, October 1880 No. 53 বিনয় ঘোষ, ও বাঙালী সমাজ, পৃ ৪৪৩।
৩৬ বিনয় ঘোষ, বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ, পৃ ৪৪৩।
৩৭ সৈয়দ শাহেদুল্লাহ, শিক্ষা ও শ্রেণী সম্পর্ক, পৃ ১০-১১, নবজাতক প্রকাশন, কলকাতা।
৩৮ সংবাদ প্রভাকর সম্পাদকীয়, ৮.১২.১৮৯২; সাময়িকপত্রে বাংলার সমাজচিত্র (প্রথম খণ্ড) পৃ ৩৮৭।
৩৯ সৈয়দ শাহেদুল্লাহ, শিক্ষা ও শ্রেণী সম্পর্ক, পৃ ১০৭।
৪০ উদ্ধৃত, পূর্বোক্ত, পৃ ১০৮।
৪১ বিনয় ঘোষ, বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ, পরিশিষ্ট ১ ঘ, পৃ ৫১৬, বঙ্গানুবাদ পৃ ১৭৩-৭৬
৪২ (স্যার) মোহাম্মদ আজিজুল হক, বাংলাদেশে মুসলিম শিক্ষার ইতিহাস এবং সমস্যা (প্ৰথম প্রকাশ ১৯১৭); অনুবাদ, মুস্তাফা নূরউল ইসলাম। বাংলা একাডেমী, ঢাকা, পৃ ২৭-২৮।
৪৩ পূর্বোক্ত, পৃ ২৮। ৪৪ পূর্বোক্ত, পৃ ২৭।
৪৫ পূর্বোক্ত, পৃ ৩৯।
৪৬ বিনয় ঘোষ, বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ, পৃ ১৭৯।
৪৭ পূর্বোক্ত, পৃ ১৭৮।
৪৮ পূর্বোক্ত, পৃ ১৭৮।
৪৯ পূর্বোক্ত, পৃ ১৭৮-৭৯।
৫০ শিক্ষা সংসদের সেক্রেটারী ডক্টর ময়েটের কাছে চিঠি উদ্ধৃত, পূর্বোক্ত, পৃ ১৮২
৫১ বিদ্যাসাগর রচনা সংগ্রহ, দ্বিতীয় খণ্ড, বিদ্যাসাগর স্মারক জাতীয় সমিতি, পৃ ২১-২২।
৫২ বিনয় ঘোষ, বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ পৃ ৩৮০-৮১।
৫৩ পূর্বোক্ত, পৃ ৩৮১।
৫৪ পূর্বোক্ত, পৃ ৪১৩।
৫৫ Fredrick Engels: Socialism: Utipian And Scientific.
৫৬ বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ পৃ ২১৬।
৫৭ পূর্বোক্ত, পৃ ২১৮।
৫৮ পূর্বোক্ত, পৃ ২২৩।
৫৯ পূর্বোক্ত, পৃ ২৩৬। ৬০ পূর্বোক্ত, পৃ ২৩২। ৬১ পূর্বোক্ত, পৃ ৪৪২।
৬২ পূর্বোক্ত, পৃ ৪৪২।
৬৩ বঙ্কিম রচনাবলী; দ্বিতীয় খণ্ড, সাহিত্য সংসদ, পৃ ৩১৪-৩১৫।
৬৪ পূর্বোক্ত, পৃ ৩১৮।
৬৫ পূর্বোক্ত।
৬৬ পূর্বোক্ত, পৃ ২৩৯
৬৭ পূর্বোক্ত, পৃ ৩১৪
৬৮ বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ পৃ ৪৪১
৬৯ পূর্বোক্ত, পৃ ৪৫০
৭০ বিহারীলাল, বিদ্যাসাগর, উদ্ধৃত : বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ পৃ ৪৪১
৭১ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ইতিহাস; কলকাতা, বিশ্বভারতী (প্রবোধচন্দ্র সেন ও পুলিনবিহারী সেন কর্তৃক সংকলিত)।
৭২ পূর্বোক্ত।
৭৩ বঙ্কিম রচনাবলী, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ ৩০৫।
৭৪ পূর্বোক্ত, পৃ ৩০৬।
৭৫ পূর্বোক্ত, পৃ ২৯২।
৭৬ পূর্বোক্ত।
৭৭ পূর্বোক্ত, পৃ ২৯৭।
৭৮ পূর্বোক্ত, পৃ ২৯৮।
৭৯ পূর্বোক্ত।
৮০ পূর্বোক্ত, পৃ ৩০৭।
৮১ পূর্বোক্ত, পৃ ৩১০।
৮২ অসিত কুমার ভট্টাচার্য, বাংলার নবযুগ ও বঙ্কিমচন্দ্রের চিন্তাধারা, পৃ ১০।
৮৩ বঙ্কিম রচনাবলী, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ ২৮৭।
৮৪ Romesh Dutt, The Economic History of India, Vol. 2. Preface: P 7-8. Publications Division, Ministry of Information and Broadcasting, Govt. of India. (April, 1970).
৮৫ বঙ্কিম রচনাবলী, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ ৩১১-১২।
৮৬ পূর্বোক্ত, পৃ ২৮৯।
৮৭ Romesh Dutt, The Economic History of India, Vol. 1, Preface : P25-26.
৮৮ বঙ্কিম রচনাবলী, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ ১১৩
৮৯ Romesh Dutt, The Economic History of India, Vo, 1. Preface : P 28-29.
৯০ 2nd Report of Select Committee of House of Commons, 1808-12; P 9, P 103 (উদ্ধৃত : বিনয় ঘোষ, সাময়িকপত্রে বাংলার সমাজচিত্র, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ ৭৬ )।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন