ঊনিশ শতকের বাঙালী সমাজ – ১৫

বদরুদ্দীন উমর

উচ্চ ও মধ্যশ্রেণী কর্তৃক সামন্তবাদী ধ্যান-ধারণার বিরোধিতা করা অথবা বাঙালী বুর্জোয়াদের মধ্যে প্রগতিশীলতার ধারক ও বাহক হওয়ার ক্ষেত্রে যে সীমাবদ্ধতা ঊনিশ শতকের বাঙলাদেশে ছিলো সে বিষয়ে পূর্বেই সাধারণভাবে উল্লেখ করা হয়েছে এবং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সামগ্রিক মূল্যায়নের ক্ষেত্রেও আবার নোতুনভাবে সে বিষয়ের উল্লেখ প্রয়োজন হবে। কিন্তু তার পূর্বে বিদ্যাসাগরের নারীমুক্তি আন্দোলনের বিশেষ কয়েকটি দিক সম্পর্কে কিছু সংক্ষিপ্ত আলোচনা দরকার।

চার্লস ফুরিয়রের প্রসঙ্গে এঙ্গেলস বলেছেন যে, ‘তিনিই প্রথম ঘোষণা করেন, যে কোন সমাজে নারীমুক্তি কি পরিমাণ অর্জিত হয়েছে সেটাই হলো সাধারণ মানুষের মুক্তি কি পরিমাণ অর্জিত হয়েছে তার একটা স্বাভাবিক মাপকাঠি।[৫৫] এই মাপকাঠিতে বিচার করলে দেখা যাবে যে, বিদ্যাসাগর যে বাঙালী সমাজে জন্মগ্রহণ করেছিলেন সে সমাজ কোন সুসভ্য সমাজ ছিলো না। কারণ সেই সমাজে পুরুষেরা ইচ্ছা ও সাধ্যানুযায়ী অসংখ্য বিবাহ করতে পারতো, স্বামীর মৃত্যু ঘটলে স্ত্রীদের পুড়িয়ে মারা হতো এবং যদি কোনমতে তাদের প্রাণ রক্ষা পেতো তাহলেও বিধবার পুনর্বিবাহের প্রশ্ন সেখানে কোনমতেই উঠতো না।

এই সামাজিক পরিবেশকে শুধু সামন্ততান্ত্রিক পরিবেশ বললে তার বর্ণনা সম্পূর্ণ হয় না। কারণ ইউরোপীয় সামন্ততন্ত্রে নারীর অধিকার যতই সংকুচিত থাকুক, সেখানে নারীর সামাজিক অবস্থান ভারতীয় অথবা বাঙলাদেশের নারীদের সামাজিক অবস্থানের মতো ছিলো না। এশিয়ার অন্যান্য দেশে বহুবিবাহ প্রথা প্রচলিত থাকলেও সেখানে বিধবাদের জীবন্ত পুড়িয়ে মারা অথবা তাদের বাধ্যতামুলক ‘চিরবৈধব্য’ ছিলো না। এদিক দিয়ে সামন্ততান্ত্রিক সমাজ হিসেবেও বাঙলাদেশে এক অসাধারণ পরিস্থিতি বিরাজ করেছিলো। এ পরিস্থিতি অবশ্য অসাধারণ হলেও আকস্মিক ছিলো না। ভারতীয় সমাজ, ধর্মশাস্ত্র এবং দেশাচারের দ্বারাই সেই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিলো।

ঊনিশ শতকের বাঙলাদেশে যে বিকলাঙ্গ বুর্জোয়া শ্রেণীর উত্থান ঘটেছিলো সেই সমাজেও নারীমুক্তির প্রশ্ন বিদ্যাসাগরের জন্মের পূর্বেই বাঙালী উচ্চ ও মধ্যশ্রেণীর একাংশের মধ্যে আলোচিত হতে থাকে। এ ব্যাপারে একদিকে রামমোহন রায় এবং অন্যদিকে ইয়ংবেঙ্গল গোষ্ঠী নিজ নিজ অবস্থান থেকে সমাজের মধ্যে বিতর্কের সূত্রপাত করেন এবং উনিশ শতকের মধ্যভাগে ও দ্বিতীয়ার্ধে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরই হন বাঙলাদেশের এই নারীমুক্তি আন্দোলনের সর্বপ্রধান নেতা ও মুখপাত্র।

এই আন্দোলনের কয়েকটি বিশেষ লক্ষ্য ছিলো। সে লক্ষ্যগুলি হলো স্ত্রীশিক্ষা ও বিধবাবিবাহ প্রচলন এবং বহুবিবাহ ও বাল্যবিবাহ নিবারণ।

স্ত্রীশিক্ষার ক্ষেত্রে রামমোহন রায় এবং ইয়ং বেঙ্গল গোষ্ঠীর প্রাথমিক উদ্যোগ এ দিক দিয়ে উল্লেখযোগ্য ছিলো। এ উদ্যোগ তাত্ত্বিক আলোচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও স্ত্রীশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে তাঁরাই প্রথম উল্লেখ করেন। পরবর্তীকালে এ ক্ষেত্রে অক্ষয়কুমার দত্তও একজন অগ্রণী ব্যক্তি ছিলেন। তবে ড্রিংকওয়াটার বেথুন ও বিদ্যাসাগরের যৌথ প্রচেষ্টার পূর্বে ১৮৪৭ সালে যিনি বারাসাতে প্রথম একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন তিনি হলেন প্যারিচাঁদ সরকার।[৫৬]

বেথুন ও বিদ্যাসাগরের স্ত্রীশিক্ষা প্রচেষ্টা উচ্চশ্রেণীর মধ্যেই তাঁরা নিজেরাই সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন। ১৮৪৭ সালে বেথুনের প্রতিষ্ঠিত ক্যালকাটা ফিমেল স্কুলে (বেথুনের মৃত্যুর পর স্কুলটির নামকরণ হয় বেথুন স্কুল) তিনি নিয়ম করেছিলেন যে, শুধু উচ্চশ্রেণীর ধনিক হিন্দু পরিবারের মধ্যে স্ত্রীশিক্ষা সীমাবদ্ধ থাকবে।[৫৭]

উচ্চশ্রেণীর এই স্ত্রীশিক্ষার ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান প্রতিবন্ধক ছিলো পর্দা প্রথা। এই পর্দা প্রথা হিন্দু নিম্নশ্রেণীর মধ্যে প্রচলিত ছিলো না। মুসলমান উচ্চশ্রেণীর দ্বারা অনুসৃত এই প্রথা মোগল পাঠান এবং অন্যান্য বংশীয় মুসলমান শাসকদের আমলে হিন্দু উচ্চশ্রেণীর মধ্যেও প্রচলিত হয় এবং তার কুপ্রভাবে ঊনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধেও হিন্দু উচ্চ সমাজ আচ্ছন্ন থাকে। প্রথম বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রায় পনেরো বছর পর ব্রাহ্মনেতা কেশব সেন যেভাবে সর্বপ্রথম পর্দা প্রথার বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেন তা অনেকাংশে নাটকীয় হলেও তার সামাজিক গুরুত্ব অনস্বীকার্য।

হিন্দু সমাজের অনেক নেতা, এমন কি রাধাকান্ত দেব পর্যন্ত নীতিগতভাবে স্ত্রীশিক্ষার বিরোধী ছিলেন না বলে মত প্রকাশ করলেও পর্দা প্রথা ভঙ্গ করে বিদ্যালয়ে স্ত্রীশিক্ষার তাঁরা ঘোর বিরোধী ছিলেন। বিদ্যালয় শিক্ষার পরিবর্তে গৃহশিক্ষাই তাঁরা স্ত্রীলোকদের ক্ষেত্রে অনুমোদন করতেন। উচ্চশ্রেণীর মুসলমানদের সংস্কার এইভাবেই বাঙালী হিন্দুদের দেশাচারে পরিণত হয়ে হিন্দু উচ্চশ্রেণীর স্ত্রীলোকদের শিক্ষাক্ষেত্রে এক বিরাট প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে।

বড়লাট লর্ড ডালহৌসী এবং ভারত সরকারের সেক্রেটারী হ্যালিডে ১৮৫০-এর দিকে বেথুনের পরামর্শ মতো উচ্চশ্রেণীর স্ত্রীলোকদের শিক্ষার সহায়তা করতে কিছুটা অগ্রণী হন এবং ১৮৫৭ সালের ব্যাপারে হ্যালিডে নিজে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেন। বিদ্যাসাগর এই সরকারী মনোভাব লক্ষ্য করে তৎকালীন পরিস্থিতিকে স্ত্রীশিক্ষা প্রচলন ও প্রসারের ক্ষেত্রে উপযোগী মনে করেন এবং নিজেই কতকগুলি মডেল বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৫৭-৫৮ এই এক বছরের মধ্যেই সেই বিদ্যালয়গুলিতে ছাত্রী সংখ্যা দাঁড়ায় ১৩০০।[৫৮]

কিন্তু স্ত্রীশিক্ষার ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগর যে সরকারী আনুকূল্য প্রত্যাশা করেছিলেন সে আনুকূল্য ইংল্যান্ডীয় কর্তৃপক্ষের বিরোধিতায় সম্ভব হয়নি। এর ফলে বালিকা বিদ্যালয়গুলির ব্যয় সংস্থান নিয়ে বিদ্যাসাগর যথেষ্ট বিপদগ্রস্ত হন এবং শেষ পর্যন্ত স্কুলগুলি চালানো আর সম্ভব হয় না। এরপর শিক্ষাবিভাগের সঙ্গে নানান মনোমালিন্যের ফলে তিনি ১৮৫৮ সালের নভেম্বরে সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষের পদ ত্যাগ করেন।

বালিকা বিদ্যালয় স্থাপনের ক্ষেত্রে আর একটি প্রতিবন্ধক ছিলো মহিলা শিক্ষিকার অভাব। মিস মেরী কার্পেন্টার এই অভাব পূরণের জন্যে স্ত্রী নর্মাল বিদ্যালয় (মহিলা শিক্ষিকাদের ট্রেনিং বিদ্যালয়) স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। মডেল স্কুলগুলি স্থাপন করতে গিয়ে বিদ্যাসাগর যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন তার ফলে তিনি মিস কার্পেন্টারের এই প্রচেষ্টাকে সমর্থন তো করেনইনি, উপরন্তু সরকারকেও তার বিরুদ্ধে পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু সরকার বিদ্যাসাগরের পরামর্শ গ্রহণ না করে একটি স্ত্রী নর্মাল বিদ্যালয় স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেন এবং তা স্থাপনও করেন। কিন্তু তিন বছর পরীক্ষামূলকভাবে স্কুলটি চালানোর চেষ্টা করলেও শেষ পর্যন্ত তাতে কোন ফললাভ না হওয়ায় ১৯৭২ সালে ফিমেল নর্মাল স্কুলটি সরকার বন্ধ করে দেন।[৫৯]

স্ত্রী নর্মাল বিদ্যালয় সম্পর্কে পরামর্শ দিতে গিয়ে বিদ্যাসাগর সরকারকে যা লিখেছিলেন তা হলো এই,

আমাদের দেশের হিন্দু সমাজের যে বর্তমান অবস্থা এবং দেশবাসীর যে মনোভাব তাতে এই ধরনের কোনো প্রতিষ্ঠান চালানো সম্ভব নয়। এ সম্বন্ধে আমি যত ভেবেছি, তত এই ধারণাই আমার দৃঢ় হয়েছে। যে কাজ বা পরিকল্পনা বাস্তবে সফল হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই, তা আমি কোনো মতেই সরকারকে গ্রহণ করতে পরামর্শ দিতে পারি না। এদেশের ভদ্রপরিবারের হিন্দুরা যখন অবরোধ প্রথার গোঁড়ামীর জন্য দশ-এগারো বছরের বিবাহিতা বালিকাদেরই গৃহের বাইরে যেতে দেয় না, তখন তারা যে বয়স্কা মহিলাদের শিক্ষয়িত্রীর কাজ গ্রহণ করতে সম্মতি দেবে, এ আশা দুরাশা মাত্র। বাকি থাকে অসহায় অনাথা বিধবারা এবং তাদেরই এ কাজে পাওয়া যেতে পারে। শিক্ষকতার কাজে তারা কতদূর উপযুক্ত হবে আপাতত সে প্রশ্ন বাদ দিয়েও আমি নিঃসন্দেহে বলতে পারি যে, অন্তঃপুর ছেড়ে বাইরে বিধবারা যদি সাধারণ শিক্ষয়িত্রীর কাজে যোগ দেয়, তাহলে লোকের কাছে তারা অবিশ্বাসের পাত্রী হয়ে উঠবে। তা যদি হয়, তাহলে এই প্রতিষ্ঠানের সমস্ত মহৎ উদ্দেশ্য ব্যর্থ হবে। … যে কাজে সাফল্যের কোনো সম্ভাবনা নেই তা আমি নিজে যেমন সমর্থন করি না তেমনি সরকারকেও তা করতে পরামর্শ দিতে পারি না।[৬০]

বিদ্যাসাগর বেথুনের সঙ্গে একত্রে উচ্চশ্রেণীর জন্য স্ত্রীশিক্ষা প্রচলনের ক্ষেত্রে একটা অগ্রণী ভূমিকা পালন করলেও তৎকালীন দেশাচারের প্রসঙ্গ উত্থাপন করে স্ত্রী নর্মাল বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তাঁর এই বিরোধিতা যে পরোক্ষভাবে স্ত্রীশিক্ষারই বিরোধিতা এবং বালিকা বিদ্যালয়গুলির সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার অন্তরায় সৃষ্টিরই নামান্তর সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। স্ত্রীশিক্ষক ব্যতীত বিদ্যালয়গুলি বাস্তবত পরিচালনা করার অসুবিধা ছিলো অনেক এবং সে অসুবিধা দূরীকরণের একমাত্র পথ ছিলো স্ত্রীশিক্ষক তৈরির উদ্দেশ্যে স্ত্রী নৰ্মাল বিদ্যালয় স্থাপনের ওপর যথোপযুক্ত গুরুত্ব আরোপ। কিন্তু এই গুরুত্ব যথাযথভাবে আরোপ করে তার জন্যে উদ্যোগ গ্রহণ তো দূরের কথা, সরকারী উদ্যোগকেও অবাস্তব হিসেবে বর্ণনা করে তিনি তার বিরোধিতাই করে বসলেন। তাঁর এই বিরোধিতায় সোমপ্রকাশ ও বামাবোধিনী পত্রিকা যে বিস্ময় প্রকাশ করে সেটা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।[৬১] কারণ সে সময় স্ত্রীশিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতাগুলি দূর করার জন্য শুধু যে এই পত্রিকা দুটিই এগিয়ে এসেছিলো তাই নয়, অন্যান্য অনেকেও এ বিষয়ে তাঁদের সমর্থন জ্ঞাপনে পিছিয়ে ছিলেন না। স্ত্রী নর্মাল বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ও সুষ্ঠু পরিচালনার ক্ষেত্রে দেশাচার উদ্ভূত অনেক বাধা বর্তমান থাকলেও উপযুক্ত প্রচারণা ও প্রচেষ্টার ফলে তার দ্বারা আপেক্ষিক ফললাভও সম্ভব নয়, এ কথা ১৮৬৭ সালে বিদ্যাসাগর বললেন। মনে করা যেতে পারে যে, বিধবা বিবাহ প্রচলনের ক্ষেত্রে বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হয়ে তিনি স্ত্রীশিক্ষার ক্ষেত্রে খুব একটা সাফল্যের আশা করেননি, এ জন্যেই তাঁর উপরোক্ত বক্তব্য। কিন্তু তাহলে ১৮৭১ ও ১৮৭২ সালে পর তিনি বহুবিবাহ নিরোধের জন্যে দুটি উল্লেখযোগ্য পুস্তিকা রচনা করে সে বিষয়ে সংস্কার আন্দোলন আবার নোতুনভাবে শুরু করলেন কেন? বহুবিবাহ রোধের ক্ষেত্রে দেশাচারের প্রতিবন্ধকতাসমূহ কি স্ত্রী নর্মাল বিদ্যালয় পরিচালনায় প্রতিবন্ধকতাসমূহের অপেক্ষা কোন অংশে কম শক্তিশালী ছিলো?

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর উচ্চশ্রেণীর শিক্ষার বিরোধী ছিলেন, এ কথা কোন প্রমাণের ভিত্তিতে বলা চলে না। উপরন্তু শিক্ষা বিস্তারকেই তিনি তৎকালীন বাঙলাদেশে হিন্দু সমাজের উন্নতি ও প্রগতির মূল সূত্র হিসেবে বিবেচনা করে বিজ্ঞানসম্মত ও প্রগতিশীল শিক্ষা প্রধানত উচ্চশ্রেণীর মধ্যে বিস্তারের ক্ষেত্রে যথাসম্ভব উদ্যোগ ও প্রচেষ্টা গ্রহণ করেছিলেন। ইংরেজ শাসনের প্রতি তাঁর অচল আনুগত্যও মূলতঃ এই কারণেই। কাজেই স্ত্রী নৰ্মাল বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সরকারী প্রস্তাবকে সমর্থনের পরিবর্তে বিরোধিতা, বিশেষত দেশাচারের উল্লেখ করে তার বিরোধিতার কোন ব্যাখ্যা কোন প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে প্রদান করা সম্ভব নয়। এই স্ব-বিরোধিতা যে তাঁর শ্রেণীসুলভ স্ব-বিরোধিতারই প্রতিফলন এ কথা বিনয় ঘোষ যথার্থভাবেই উল্লেখ করেছেন।[৬২] বিদ্যাসাগরের এই স্ব-বিরোধিতা পূর্বে সংস্কৃত কলেজে অব্রাহ্মণদের মধ্যে কেবলমাত্র কায়স্থদের প্রবেশাধিকারদানের মাধ্যমে যেমন প্রতিফলিত হয়েছিলো, তেমনি পরবর্তীকালে তা প্রতিফলিত হয়েছিল ‘সহবাস সম্মতি’ আইন সম্পর্কে তার মতামতের মধ্যে।

১৬

বিধবাবিবাহ প্রচলন আন্দোলনই বিদ্যাসাগরের সর্বাপেক্ষা বিখ্যাত সমাজসংস্কার আন্দোলন। ঊনিশ শতকের বাঙলাদেশে সেই আন্দোলন বিধবাবিবাহ প্রচলনের ক্ষেত্রে কোন উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন না করলেও একদিকে নারীমুক্তির প্রশ্নকে তা সামাজিক চিন্তার অন্যতম প্রধান বিষয়বস্তু হিসেবে সামনে নিয়ে আসে এবং অন্যদিকে তা হিন্দু সমাজের কতকগুলি শক্তিশালী সংস্কার ও আচারের ভিত্তিমূলে আঘাত করে সেই সমাজের মধ্যে আবার কতকগুলি তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। ঈশ্বরচন্দ্রের বিধবাবিবাহ প্রচলন আন্দোলন ঊনিশ শতকের বাঙলাদেশের ইতিহাসে এ দুই কারণেই গুরুত্বপূর্ণ।

সতীত্বকে আদর্শ হিসেবে স্থাপন করে ভারতীয় হিন্দু সমাজে নারী নির্যাতনের যে বিস্তীর্ণ জাল বিস্তার করা হয়েছিলো, হিন্দু বিধবার চিরবৈধব্য তারই এক অনিবার্য অঙ্গ। এই সামাজিক প্রথা অবশ্য সতীদাহের মতোই নিম্নশ্রেণীর হিন্দুদের মধ্যে প্রচলিত ছিলো না। এই দুই প্রথাই ছিলো উচ্চশ্রেণীর অর্থাৎ বিত্তবান বর্ণহিন্দু সম্প্রদায়ের। মুসলমানদের শাস্ত্রে বিধবাবিবাহের বিরুদ্ধে কিছু নেই, উপরন্তু তা সর্বতোভাবে শাস্ত্রসম্মত। হজরত মহম্মদের প্রথম বিবাহই ছিলো বিধবাবিবাহ। সেই হিসেবে বিধবা-বিবাহের প্রশ্ন মুসলমান সম্প্রদায়ের সমস্যা না হলেও উচ্চশ্রেণীর মুসলমানদের মধ্যে বিধবাবিবাহ ঊনিশ শতকের বাঙলাদেশে তেমন প্রচলিত ছিলো না। হিন্দু উচ্চশ্রেণী যেমন মুসলমান উচ্চশ্রেণীর মধ্যে প্রচলিত পর্দা প্রথার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলো তেমনি মুসলমান উচ্চশ্রেণীও এ ক্ষেত্রে হিন্দু উচ্চশ্রেণীর বিধবাদের চিরবৈধব্যের আদর্শের দ্বারা অনেকাংশে প্রভাবিত হয়েছিলো। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সংস্কার আন্দোলন অবশ্য মুসলমান উচ্চশ্রেণীর বিধবাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ছিলো না। সে দিক দিয়ে তাঁর সামাজিক আন্দোলনের যেমন একটা শ্রেণীচরিত্র ছিলো তেমনি তার একটা ‘জাতিগত’ বা সাম্প্রদায়িক চরিত্রও ছিলো। উচ্চশ্রেণীর হিন্দু বিধবা নারীদের ওপর যে নিপীড়ন ‘চিরবৈধব্যের আদর্শের মাধ্যমে প্রচলিত ছিলো, সেই নিপীড়নের বিরুদ্ধেই নিয়োজিত হয়েছিলো বিদ্যাসাগরের মূল সংস্কার প্রচেষ্টা।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ব্যক্তিগতভাবে কেন বিধবাবিবাহ প্রচলন আন্দোলন করেছিলেন এবং সেই আন্দোলন পরিচালনা করতে গিয়ে কি কি শাস্ত্রীয় যুক্তি উপস্থিত করেছিলেন, সেইসব প্রশ্ন আলোচনার থেকে কি কারণে ঊনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে উপরোক্ত আন্দোলন বাঙালী উচ্চ ও মধ্যশ্রেণীর এক ব্যাপক অংশের মধ্যে সাড়া জাগিয়েছিলো এবং আর এক শক্তিশালী অংশ তার বিরোধিতা করতে এগিয়ে এসে, কিভাবে পরবর্তী পর্যায়ে রক্ষণশীলতা ও প্রতিক্রিয়াশীলতার উত্থান ঘটিয়ে হিন্দু সমাজের এবং সেই সঙ্গে সমগ্র বাঙালী সমাজের অগ্রগতির ক্ষেত্রে দুস্তর প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিলো সেইসব প্রশ্নের আলোচনাই অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ।

এ কথা সুবিদিত যে, বিধবাবিবাহ প্রচলনের প্রশ্নকে কেন্দ্র করে ঊনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে উচ্চ ও মধ্যশ্রেণীর বাঙালী হিন্দু সমাজ দ্বিধাবিভক্ত হয়েছিলো। ফুরিয়রের মাপকাঠিতে বিচার করে বলা চলে যে, তৎকালের বাঙালী হিন্দু উচ্চশ্রেণীর আত্মপ্রকাশ ও আত্মপ্রতিষ্ঠা প্রচেষ্টার একটা বিশেষ দিক হিসেবেই নির্দয়ভাবে নিপীড়িত নারী সমাজের মুক্তির প্রশ্নটি হিন্দু সমাজের একাংশকে আলোড়িত করে। তাঁদের মধ্যে যে খণ্ডিত নৈতিক চেতনার বিকাশ ঘটে সেই বিকাশই নারীমুক্তি আন্দোলনে তাঁদের প্রেরণা দান করেছিলো। অন্যদিকে সামাজিক সংস্কার, বিশেষতঃ যে কোন দেশেই যেমন ঐতিহাসিকভাবে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে তেমনি তা বাঙলাদেশেও করেছিলো। বিধবাবিবাহ প্রচলন আন্দোলন ছিলো এই ধরনেরই এক সংস্কার আন্দোলন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ছিলেন সেই আন্দোলনের নেতা এবং সেই আন্দোলন তৎকালীন সমাজে যে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিলো, ‘টিকিদাস ভট্টাচার্য’ শ্রেণীর পণ্ডিত সমাজের বাইরে যে বুদ্ধিজীবী সমাজ ছিলো সেই প্রতিক্রিয়ার নেতা ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। শুধু বিধবাবিবাহ আন্দোলনের ক্ষেত্রেই নয, বহু বিবাহ নিরোধ ইত্যাদি অন্যান্য সামাজিক আন্দোলনের ক্ষেত্রেও বঙ্কিমচন্দ্রের এই ভূমিকা অপরিবর্তিত ছিলো।

সংস্কার আন্দোলনের ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগরের যেমন বিশেষ কতকগুলি কৌশল ছিলো (যেমন সংস্কার শাস্ত্রসম্মত প্রমাণ করা একটি) তেমনি সংস্কার আন্দোলন বিরোধিতার ক্ষেত্রে বঙ্কিমচন্দ্রেরও কতকগুলি কৌশল ছিলো। তার মধ্যে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য হলো, সংস্কারের প্রয়োজনীয়তাকে স্বীকার করে নিয়ে তার স্বপক্ষে জোরালোভাবে আলোচনা করা এবং ঠিক তার পরবর্তী পর্যায়েই অন্যান্য কতকগুলি প্রসঙ্গের অবতারণার দ্বারা সেই সংস্কার যে অর্থহীন তা প্রমাণ করে বাস্তব ক্ষেত্রে তার বিরোধিতা করা। বহু বিবাহের ক্ষেত্রে বঙ্কিমচন্দ্রের এই কৌশল যে কতখানি চমৎকারিত্ব অর্জন করেছিলো সেটা তাঁর লেখা থেকে উদ্ধৃত কয়েকটি অংশ থেকে পরিষ্কার বোঝা যাবে।

বহুবিবাহ প্রথা যে অনিষ্টকর ও বর্জনীয় এ প্রসঙ্গে তিনি প্রথমে বলছেন,

বহুবিবাহ যে সমাজের অনিষ্টকারক, সকলের বর্জনীয় এবং স্বাভাবিক নীতিবিরুদ্ধ, তাহা বোধ হয় এ দেশের জনসাধারণের হৃদয়ঙ্গম হইয়াছে। সুশিক্ষিত বা অল্পশিক্ষিত, এ দেশে এমন লোক বোধ হয় অল্পই আছে, যে বলিবে, ‘বহুবিবাহ অতি সুপ্রথা, ইহা ত্যাজ্য নহে’।* যাঁহারা বিদ্যাসাগর মহাশয়ের পুস্তকের প্রতিবাদ করিয়াছেন, বোধ হয় তাঁহাদেরও এইমাত্র উদ্দেশ্য যে, তাঁহারা আপন আপন জ্ঞানমতো বহুবিবাহের শাস্ত্রীয়তা প্রতিপন্ন করেন। তাঁহাদের প্রনীত গ্রন্থ আমরা সবিশেষ পড়ি নাই, কিন্তু বোধ হয় তাহারা কেহই বলেন না যে, বহুবিবাহ সুপ্রথা ইহা তোমরা ত্যাগ করিও না। যদি কেউ এমতো কথা বলিয়া থাকেন, তবে ইহা বলা যাইতে পারে যে, তাঁহার মতো কুসংস্কারবিশিষ্ট লোক এক্ষণে অতি অল্প। বহুবিবাহ যে কুপ্রথা, তদ্বিষয়ে বাঙালীর মতৈক্য সম্বন্ধে আমাদের কোন সংশয় নাই।[৬৩] বহুবিবাহ এদেশে স্বতঃই নিবারিত হইয়া আসিতেছে; অল্প দিনে একেবারে লুপ্ত হইবার সম্ভাবনা; তজ্জন্য বিশেষ আড়ম্বর আবশ্যক বোধ হয় না। সুশিক্ষার ফলে উহা অবশ্য লুপ্ত হইবে।[৬৪]

[*এখানে বহু বিবাহকে ‘কুপ্রথা ও ত্যাজ্য’ বলে ঘোষণা করলেও দেবী চৌধুরাণী উপন্যাসের শেষ পর্বে দেবী চৌধুরাণীর ভূমিকা পরিত্যাগ করে, প্রফুল্ল ব্রজেশ্বরের বহু পত্নীর একজন হিসেবে গৃহে প্রত্যাবর্তন করার পর নিম্নোক্ত ভাষায় বঙ্কিমচন্দ্র বহু বিবাহ প্রথার জয়গান করোন : “প্রফুল্লের যাহা কিছু বিবাদ সে ব্রজেশ্বরের সঙ্গে। প্রফুল্ল বলিত, “আমি একা তোমার স্ত্রী নহি। তুমি যেমন আমার, তেমনি সাগরের, তেমনি নয়ন বৌয়ের। আমি একা তোমায় ভোগ দখল করিব না। স্ত্রীলোকের পতি দেবতা; তোমাকে ওরা পূজা করিতে পায় না কেন?’ ব্রজেশ্বর তা শুনিত না। ব্রজেশ্বরের হৃদয় কেবল প্রফুল্লময়। প্রফুল্ল বলিত, ‘আমায় যেমন ভালোবাসো, উহাদিগকেও তেমনি ভালো না বাসিলে, আমার উপর তোমার ভালোবাসা সম্পূর্ণ হইবে না। ওরাও আমি’।’ —বঙ্কিম রচনাবলী; প্রথম খণ্ড, পৃ. ৮৭১, সাহিত্য সংসদ।]

এই যুক্তি দেখিয়ে* বহুবিবাহ বন্ধের জন্যে বিদ্যাসাগর সরকারের কাছে আইন প্রণয়ণের যে আবেদন জানিয়েছিলেন তার বিরুদ্ধে বঙ্কিমচন্দ্র আবার নিম্নোক্ত যুক্তি প্রদান করেন―

আর একটি কথা এই যে, এ দেশে অর্ধেক হিন্দু, অর্ধেক মুসলমান। যদি বহুবিবাহ নিবারণের জন্য আইন হওয়া উচিত হয় তবে হিন্দু মুসলমান উভয় সম্বন্ধেই সে আইন হওয়া উচিত। হিন্দুর পক্ষে বহুবিবাহ মন্দ, মুসলমানের পক্ষে ভালো এমত নহে। কিন্তু বহুবিবাহ হিন্দুশাস্ত্রবিরুদ্ধ বলিয়া, মুসলমানের পক্ষেও তাহা কি প্রকারে দণ্ডবিধি দ্বারা নিষিদ্ধ হইবে? রাজব্যবস্থা বিধাতৃগণ কি প্রকারে বলিবেন যে, ‘বহুবিবাহ হিন্দুশাস্ত্রবিরুদ্ধ, অতএব যে মুসলমান বহুবিবাহ করিবে, তাহাকে সাত বৎসরের জন্যে কারারুদ্ধ হইতে হইবে।’ যদি তাহা না বলেন, তবে অবশ্য বলিতে হইবে যে, আমরা বড় প্রজাহিতৈষী ব্যবস্থাপক বটে; প্রজার হিতার্থে আমরা বহুবিবাহ কুপ্রথা উঠাইবো; কিন্তু আমরা অর্ধেক প্রজাদিগের মাত্র হিত করিবো। হিন্দুদিগের শাস্ত্র ভালো তাঁহাদের ব্যাকরণের গুণে এক স্থানে ‘ক্রমশো বরা’ ও ‘ক্রমশোহ বরাত উভয় পাঠ চলিতে পারে, সুতরাং তাহাদিগেরই হিত করিবো। আমাদিগের অবশিষ্ট প্রজা তাহাদিগের ভাগ্যদোষে মুসলমান, তাহাদিগের শাস্ত্রপ্রণেতৃগণ সুচতুর নহে, আরবী কায়দা হেলে দোলে না, বিশেষ মুসলমানের মধ্যে শ্রীযুক্ত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ন্যায় কেহ পণ্ডিত নাই, অতএব অর্ধেক প্রজাগণের হিত করিবার আবশ্যকতা নাই।’ আমাদিগের ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে বোধ হয় যে, ব্যবস্থাপক সমাজ এই দ্বিবিধ উক্তির মধ্যে কোন উক্তিই ন্যায়সঙ্গত বিবেচনা করিবেন না।[৬৫]

[*উল্লেখযোগ্য যে ভারতে এমন কি পাকিস্তানেও আইন দ্বারাই বহুবিবাহ রদ অথবা নিয়ন্ত্রিত করা হয়।]

বঙ্কিমচন্দ্রের এই কৌশলের চমৎকারিত্ব পরিপূর্ণভাবে উপলব্ধি করা সম্ভব হবে যদি তাঁর ‘ভারত-কলঙ্ক” প্রবন্ধের নিম্নোদ্ধৃত অংশটির প্রতি লক্ষ্য রেখে উপরোক্ত উদ্ধৃতিটি বিবেচনা করা হয়:

হিন্দু জাতি ভিন্ন পৃথিবীতে অন্য অনেক জাতি আছে। তাহাদের মঙ্গলমাত্রেই আমাদের হওয়া সম্ভব নহে। অনেক স্থানে তাহাদের মঙ্গলে আমাদের অমঙ্গল। যেখানে তাহাদের মঙ্গলে আমাদের অমঙ্গল, সেখানে তাহাদের মঙ্গল যাহাতে না হয় আমরা তাহাই করিব। ইহাতে পরজাতিপীড়ন করিতে হয়, করিবো। অপিচ, যেমন তাহাদের মঙ্গলে আমাদের অমঙ্গল ঘটিতে পারে, তেমনি আমাদের মঙ্গলে তাহাদের অমঙ্গল হইতে পারে। হয় হউক, আমরা সে জন্য আত্মজাতির মঙ্গলসাধনে বিরত হইব না; পরজাতির অমঙ্গল সাধন করিয়া আত্মমঙ্গল সাধিতে হয়, তাহাও করিব।[৬৬]

মুসলমান সমাজের (জাতির) মঙ্গলের প্রতি বঙ্কিমচন্দ্রের কি শুভদৃষ্টি ছিলো তার স্পষ্ট পরিচয় তিনি এখানে দান করেছেন। কিন্তু সেই মুসলমানদের মঙ্গলের প্রশ্ন তুলে বহুবিবাহ রোধের আইন প্রণয়নের বিরুদ্ধে যুক্তি উত্থাপন করতে তাঁর কোন অসুবিধে হয়নি। এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য যে, বহুবিবাহের ওপর নিজের এই প্রবন্ধ সম্পর্কে বঙ্কিমচন্দ্র নিজেই বলেন, ‘উহার দ্বারাই বহুবিবাহবিষয়ক আন্দোলন নির্বাপিত হয়, এইরূপ প্রসিদ্ধি।’[৬৭]

‘উহার দ্বারাই বহুবিবাহবিষয়ক আন্দোলন নির্বাপিত হয়, এইরূপ প্রসিদ্ধি’ যেমন সত্য, তেমনি এইভাবে সুকৌশলে ঊনিশ শতকের উচ্চ ও মধ্যশ্রেণীর হিন্দু সমাজের মধ্যে যেটুকু প্রকৃত প্রগতিশীলতার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিলো, তাকে বহুলাংশে নাকচ করে দেওয়ার ক্ষেত্রে বঙ্কিমচন্দ্রের উপরোক্ত ভূমিকার জন্যই তাঁর নিজেরও সমধিক প্রসিদ্ধি। এ জন্যেই ঊনিশ শতকের শেষ দিকে এবং বিশ শতকেও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর হলেন ‘দয়ার সাগর’, ‘করুণাসিন্ধু’ ইত্যাদি এবং বঙ্কিমচন্দ্র বৃটিশ সরকারের ডেপুটিগিরি করেও হলেন “ঋষি”!

ঊনিশ শতকের শেষ দিকে হিন্দু উচ্চ মধ্যশ্রেণীর রক্ষণশলীতার এই উত্থান ঐ শ্রেণীরই একজন হিসেবে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মধ্যে যে হতাশার সৃষ্টি করেছিলো, তার সব থেকে বড় প্রমাণ সহবাস সম্মতি আইন সম্পর্কে ১৮৯১ সালের ফেব্রুয়ারীতে অর্থাৎ মৃত্যুর মাত্র কয়েক মাস পূর্বে, তাঁর অভিমত। এ প্রসঙ্গে বাল্যবিবাহ প্রথা আইনের দ্বারা রহিত করার দাবি না জানিয়ে তিনি সরকারকে লিখেছিলেন,

…I should feel like the measure to be so framed as to give something like an adequate protection to child-wives, without in any way conflicting with any religious usage. I would propose that it should be an offence for a man to eonsummate marriage before his wife has her first menses…such a law would not only serve the interest of humanity…but would, so far from interfering with religious usage, enforce a rule laid down in the Sastras.[৬৮]

যে ব্যক্তি ১৮৭০ সালে পুত্রের বিবাহ প্রসঙ্গে ভ্রাতা শম্ভুচন্দ্রের কাছে লিখেছিলেন, ‘আমি দেশাচারের নিতান্ত দাস নহি, নিজের বা সমাজের মঙ্গলের নিমিত্ত যাহা উচিত বা আবশ্যক বোধ হইবে তাহা করিব; লোকে বা কুটুম্বের ভয়ে কদাচ সঙ্কুচিত হইবো না।[৬৯]–তিনিই বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে পূর্বে লেখনী ধারণ ও আন্দোলন করা সত্ত্বেও ১৮৯১ সালে ধর্মীয় আচার লঙ্ঘন না করে শাস্ত্রসম্মত আইন প্রণয়নের জন্যে সরকারের কাছে প্রস্তাব করলেন। এই পরাজয় শুধু বিদ্যাসাগরের পরাজয় ছিলো না। এ পরাজয় ছিলো ঊনিশ শতকের সমগ্র হিন্দু সমাজের উচ্চ ও মধ্যশ্রেণীর অগ্রণী অংশের। শুধু হিন্দু সমাজেরও নয়, সমগ্র বাঙালী সমাজের। যে কারণে ঊনিশ শতকের প্রথমার্ধের বাঙালী বণিক পরিবারগুলি ঊনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাণিজ্যের পাট তুলে দিয়ে জমিদারীর মধ্যে নিজেদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তার সন্ধান করেছিলো, ঠিক সেই কারণেই ঊনিশ শতকের পাঁচের দশক পর্যন্ত হিন্দু সম্প্রদায় ও বাঙালী সমাজের উচ্চ ও মধ্যশ্রেণীর যেটুকু অগ্রগতি সাধিত হয়েছিলো, সে অগ্রগতিও প্রতিক্রিয়ার আবর্তে নিক্ষিপ্ত হয়ে অনেকাংশে বিলুপ্ত হয়েছিলো।

১৭

এখানেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সংস্কার আন্দোলনসমূহের অন্তনির্হিত দুর্বলতা এবং তাঁর নিজের ও তাঁর শ্রেণীর সামাজিক অবস্থানের প্রসঙ্গটি আবার নোতুনভাবে উত্থাপন করা দরকার। বাঙালী উচ্চ ও মধ্যশ্রেণী সিপাহী বিদ্রোহকে* সমর্থন ও সাহায্য না করলেও সিপাহী বিদ্রোহের পরবর্তীকালে এ-দেশীয় সমাজ, সংস্কৃতি, ধর্ম ইত্যাদির প্রতি ইংরেজরা যে অবজ্ঞা উত্তরোত্তর প্রকাশ করতে থাকে এবং চাকুরীজীবী শিক্ষিত সমাজের একাংশের সঙ্গে প্রশাসনিক সুযোগ ও মর্যাদার ক্ষেত্রে তাদের যে কিছু কিছু সংঘাত দেখা দেয় তার ফলেই ধীরে ধীরে জাতীয় চেতনার উত্থান ঘটে। এই জাতীয় চেতনাই ধর্মীয় ও সম্প্রদায় চেতনার সঙ্গে একাকার ও একাত্ম হয়ে থাকার ফলে সমাজের নানান ধর্মীয়, রক্ষণশীল ও প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তাধারার প্রবল প্রতাপ ও রাজত্ব উনিশ শতকের সত্তরের দশক থেকে বাঙালী সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এ জন্যেই এই সময়েই ঊনিশ শতকের প্রথমার্ধের ধর্মীয় উদারনৈতিকতা ও সংস্কারমুখী চিন্তাসমূহ প্রতিক্রিয়ার আঘাতে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন ও পরাজিত হয়ে সমাজের চারিদিকে রক্ষণশীলতার প্রাচীর তো গড়ে তোলেই, উপরন্তু তা নবউত্থিত জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক চেতনাকেও সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে বিষাক্ত করে।

[*সিপাহী বিদ্রোহ সম্পর্কে আমার সাম্প্রদায়িকতা নামক পুস্তকে যে সংক্ষিপ্ত মূল্যায়ন করেছিলাম তাকে আমি এখন বহুলাংশে ভ্রান্ত মনে করি। –ব. উ.।]

সাম্রাজ্যবাদী নির্যাতন, শোষণ এবং অধিকৃত দেশের সমাজ, সংস্কৃতি, ধর্ম ইত্যাদি সম্পর্কে ইংরেজদের তাচ্ছিল্যপূর্ণ মনোভাব, এ সমস্তই যে ঊনিশ শতকের প্রথমার্ধে বর্তমান ছিলো না, তা নয় (ভারতীয় সাহিত্য-সংস্কৃতি সম্পর্কে মেকলের সুপরিচিত বক্তব্য এ ক্ষেত্রে স্মরণীয়)—সবই ছিলো। কিন্তু বাঙালী উচ্চ ও মধ্যশ্রেণী তখন নিজের শিক্ষাদীক্ষা, আর্থিক অবস্থা ইত্যাদি গুছিয়ে নেওয়ার কাজে এত বেশী ব্যস্ত ছিলো যে, সেগুলির প্রতি দৃষ্টি দেওয়া বা সেগুলির দ্বারা বিচলিত হওয়া তাদের দ্বারা তেমন সম্ভব ছিলো না। রামগোপাল ঘোষ, দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায় প্রভৃতি ইয়ং বেঙ্গল দলের নেতারা কিছু কিছু রাজনৈতিক বক্তব্য এবং ইংরেজ শাসনের কিছু কিছু সমালোচনা ক্ষেত্রবিশেষে করলেও সামগ্রিকভাবে তার কোন গুরুত্ব তেমন ছিলো না। ঊনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে শিক্ষাদীক্ষা, চাকুরী ইত্যাদি ক্ষেত্রে বাঙালীরা পূর্বের থেকে কিছুটা অগ্রসর হওয়ার ফলে তাদের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই আত্মগৌরবের প্রবণতা পূর্বের তুলনায় বৃদ্ধি পায়। কিন্তু এই আত্মগৌরব ‘জাতীয়তাবাদী’ চেতনায় রূপান্তরিত হওয়ার কালে তার মধ্যে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধিতা থেকে ধর্মীয় কুসংস্কার, সাম্প্রদায়িক চেতনা এবং সামাজিক রক্ষণশীলতার প্রভাবই তুলনায় দাঁড়িয়ে যায় বেশী। এ জন্যই দেখা যায় যে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সহবাস সম্মতি আইন সম্পর্কে উপরোক্ত অভিমত সরকারের কাছে ব্যক্ত করা প্রসঙ্গে বিহারীলাল তাঁর বিদ্যাসাগর জীবনীতে লেখেন

বিধবাবিবাহ বিচারে যে ভ্রম হইয়াছিলো, সম্মতি আইনের বিচারে সে ভ্রম ঘটে নাই দেখিয়া সমগ্র হিন্দু সমাজ সুখী হইয়াছিলো। ইতিপূর্বে বিদ্যাসাগর মহাশয় বিধবাবিবাহের কার্যকারিতা সম্বন্ধে অনেকটা নির্লিপ্ত ছিলেন। এক্ষণে আবার সহবাস সম্মতি আইনের বিপক্ষে মত দিতে দেখিয়া অনেকেই জল্পনা-কল্পনা করিয়া থাকেন যে, বিদ্যাসাগর মহাশয় বিধবাবিবাহ সম্বন্ধে আপনার ভ্রম অনুভব করিতে পারিয়াছেন।[৭০]

বিদ্যাসাগর সম্পর্কে, বিশেষত বিধবাবিবাহ সম্পর্কে, বিহারীলালের এই মূল্যায়ন যে সর্বাংশে ভ্রান্ত সে কথা বলাই বাহুল্য। বিদ্যাসাগরের মধ্যে সহবাস সম্মতি আইনের ক্ষেত্রে যে স্ববিরোধিতা দেখা গিয়েছিলো তার উৎপত্তি বিধবাবিবাহ সম্পর্কে তাঁর ভ্রান্ত চেতনার মধ্যে ঘটেনি। বাল্যবিবাহের ঘোর বিরোধী হওয়া সত্ত্বেও সহবাস সম্মতি আইন সম্পর্কে তাঁর স্ববিরোধী সুপারিশ ঊনিশ শতকে প্রতিক্রিয়ার উত্থানের মুখে তাঁর হতাশা এবং পরাজয়েরই অভিব্যক্তি মাত্র। সেই হিসেবেই তাঁকে দেখতে হবে। কিন্তু বিহারীলাল সেভাবে তাঁকে দেখেননি। দেখা তাঁর পক্ষে সম্ভবও ছিলো না। কারণ বঙ্কিমের মতো তিনিও ছিলেন ঊনিশ শতকের প্রতিক্রিয়াশীল সমাজ-চিন্তার অন্যতম কাণ্ডারী এবং উপরোক্ত “জল্পনা কল্পনাকারীদেরই একজন।

১৮

ঊনিশ শতকের বাঙালী সমাজে সামাজিক রক্ষণশীলতা এবং রাজনৈতিক প্রশ্নটি আর একটু বিস্তারিতভাবে আলোচনার পূর্বে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত এবং তার ওপর বাঙালী উচ্চ ও মধ্যশ্রেণীর নির্ভরতা সম্পর্কে কিছুটা উল্লেখ করা দরকার। এই উল্লেখ ব্যতীত বাঙলার সামাজিক ইতিহাসে সাধারণভাবে উপরোক্ত শ্রেণীভুক্ত বুদ্ধিজীবী, সমাজ-সংস্কারক, কবি- সাহিত্যিক, ঋষি-মহর্ষি, স্বামীজী, সাধুসন্ত, ওলী আউলিয়াদের কার স্থান কোথায় সেটা যথাযথভাবে নির্ণয় ও নির্ধারণ করা সম্ভব নয়।

ভারবর্ষের ইতিহাস সম্পর্কে লিখতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন,

দেশের ইতিহাসই আমাদের স্বদেশকে আচ্ছন্ন করিয়া রাখিয়াছে। মামুদের আক্রমণ হইতে লর্ড কার্জনের সাম্রাজ্য গর্বোদ্‌গার-কাল পর্যন্ত যাহা-কিছু ইতিহাস কথা তাহা ভারতবর্ষের পক্ষে বিচিত্র কুহেলিকা, তাহা স্বদেশ সম্বন্ধে আমাদের দৃষ্টির সহায়তা করে না, দৃষ্টি আবৃত করে মাত্র। তাহা এমন স্থানে কৃত্রিম আলোক ফেলে যাহাতে আমাদের দেশের দিকটাই আমাদের চোখে অন্ধকার হইয়া যায়। সেই অন্ধকারের মধ্যে নবাবের বিলাসশালার দীপালোকে নর্তকীর মণিভূষণ জ্বলিয়া ওঠে; বাদশাহের সুরাপাত্রের রক্তিম ফেনোচ্ছ্বাস উন্মত্ততার জাগররক্ত দীপ্ত নেত্রের ন্যায় দেখা দেয়।[৭১]

রবীন্দ্রনাথ ভারতের এতকাল প্রচলিত ইতিহাস-কাহিনী সম্পর্কে যে মন্তব্য করেছেন বাঙলার সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ইতিহাস সম্পর্কেও তা প্রযোজ্য এবং সেটাই স্বাভাবিক। কারণ বাঙলার ইতিহাস ভারতের ইতিহাস থেকে স্বতন্ত্র ও বিচ্ছিন্ন নয়, উপরন্তু তারই অবিচ্ছেদ্য অংশ। যে উদ্দেশ্যে ‘লর্ড কার্জনের সাম্রাজ্য গর্বোদ্‌গার-কাল পর্যন্ত ভারতের ইতিহাস ইতিপূর্বে রচিত হয়েছিলো বাঙলাদেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাস রচনাও যে সেই উদ্দেশ্যের দ্বারাই পরিচালিত হয়েছিলো, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। এ জন্যে রবীন্দ্রনাথের ভাষাতেই তৎকালীন সামাজিক ইতিহাস রচয়িতাদের সম্পর্কে বলা চলে,

সেদিনও সেই ধূলিসমাচ্ছন্ন আকাশের মধ্যে পল্লীর গৃহে গৃহে যে জন্ম-মৃত্যু-সুখ-দুঃখের প্রবাহ চলিতে থাকে, ঢাকা পড়িলেও মানুষের পক্ষে তাহাই প্রধান। কিন্তু বিদেশী পথিকের কাছে এই ঝড়টাই প্রধান, এই ধূলিজালই তাহার চক্ষে আর-সমস্তই গ্রাস করে; কারণ সে ঘরের ভিতরে নাই, সে ঘরের বাহিরে। সেই জন্য বিদেশীর ইতিহাসে এই ধূলির কথা, ঝড়ের কথাই পাই; ঘরের কথা কিছুমাত্র পাই না। সেই ইতিহাস পড়িলে মনে হয়, ভারতবর্ষ তখন ছিল না, কেবল মোগল-পাঠানের গর্জনমুখর বাত্যাবর্ত শুষ্ক পত্রের ধ্বজা তুলিয়া উত্তর হইতে দক্ষিণ এবং পশ্চিম হইতে পূর্বে ঘুরিয়া বেড়াইতেছিল।[৭২]

রবীন্দ্রনাথের রচনার এই অংশটিতে বিদেশীর স্থলে বিদেশী শাসক শ্রেণীর দ্বারা সৃষ্ট ও পরিপুষ্ট বাঙালী উচ্চ ও মধ্যশ্রেণীকে যদি স্থাপন করা যায় তাহলে এ দেশের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা স্পষ্টভাবে বোঝা যাবে। ‘পল্লীর গৃহে গৃহে যে জন্ম মৃত্যু সুখ দুঃখের প্রবাহ’ ঊনিশ শতকের বাঙলাদেশের সাধারণ মানুষের জীবনে প্রধান ছিলো, তার প্রতি উচ্চ ও মধ্যশ্রেণী সাধারণভাবে কি চরম ঔদাসীন্য ও অবজ্ঞা দেখিয়েছিলো, তাদের প্রতি তারা কতদূর শত্রুভাবাপন্ন ছিলো তার হিসেবও পাওয়া যাবে এবং বোঝা যাবে যে, তাদের সেই ঔদাসীন্য, অবজ্ঞা এবং শত্রুতার কারণ, সে ঘরের ভিতরে নাই, সে ঘরের বাহিরে।’

পল্লীর গৃহে গৃহে জন্ম-মৃত্যু-সুখ-দুঃখের প্রবাহ যাদের জীবনে প্রধান ছিলো তাদের ঘরের বাইরে অবস্থানরত ঊনিশ শতকের বুদ্ধিজীবী, সাহিত্যিক ও সমাজনেতাদের ‘অবস্থান’ এবং প্রতিভাকে একত্রে বিচার করলে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ই সর্বাগ্রগণ্য হিসেবে বিবেচনার যোগ্য। বাঙলাদেশের সাধারণ জীবনের বাইরে অবস্থানরত ব্যক্তিদের মধ্যে তাঁর প্রভাবই ঊনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে, প্রতিক্রিয়ার হট্টগোলের যুগে দাঁড়িয়েছিলো সব থেকে প্রবল ও সুদূর প্রসারী। তথাকথিত ভারতীয় জাতীয়তাবাদ ও দ্বিজাতিতত্ত্বের প্রথম দার্শনিক বঙ্কিমচন্দ্রের এই শ্রেণী প্রতিনিধিত্বমূলক চরিত্রের জন্যেই তৎকালীন বাঙলাদেশের কৃষক- সমস্যা ও চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গী বিচার না করে সামাজিক রক্ষণশীলতা ও রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়ার প্রতিনিধি রূপে তাঁর সম্পর্কে এবং সামগ্রিকভাবে তৎকালীন পরিস্থিতি সম্পর্কে কোন আলোচনা সম্ভব নয়।

১৯

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ও কৃষক সমস্যার ক্ষেত্রে বঙ্কিমচন্দ্র যে কৌশল অবলম্বন করেছিলেন সে কৌশল সমাজ-সংস্কার সমস্যাসমূহের ক্ষেত্রে তাঁর দ্বারা অনুসৃত কৌশল থেকে স্বতন্ত্র ছিলো না। এ জন্যে বঙ্গদেশের কৃষক নামক রচনাটিতে তিনি প্রথমদিকে কৃষকদের ওপর জমিদার ও তাদের নায়েব গোমস্তাদের নির্যাতন এবং চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কৃষক-বিরোধী চরিত্রের আলোচনা করেন। ঊনিশ শতকের রক্ষণশীল সাহিত্যিক ও সমাজনেতাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা প্রতিভাবান ও সর্বাপেক্ষা শ্রেণীসচেতন বঙ্কিমচন্দ্রকে বঙ্গদেশের কৃষক-এ একই সঙ্গে যেভাবে পাওয়া যায়, অন্যত্র তেমন পাওয়া যায় না। বুদ্ধির আলোকে উদ্ভাসিত দৃষ্টিতে এবং অননুকরণীয় ভাষায় তৎকালীন বাঙলাদেশের কৃষকদের দুরবস্থার যে বর্ণনা তিনি তাঁর ক্ষুদ্র গ্রন্থটির ‘জমিদার’ শীর্ষক দ্বিতীয় পরিচ্ছেদটিতে লিপিবদ্ধ করেন তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় লিখিত অক্ষয় কুমার দত্তের এই ধরনের কতকগুলি রচনা ব্যতীত তৎকালীন বাঙলা সাহিত্যে তার অন্য কোনো তুলনা নেই।

মুসলমানদের রাজত্বকালে প্রজাদের কি পরিমাণ সর্বনাশ হয়েছিলো সে কথা বলার পর কর্নওয়ালিসের বন্দোবস্ত সম্পর্কে চতুর্থ পরিচ্ছেদে বঙ্কিমচন্দ্র বলেন,

তাহার পর ইংরেজরা রাজা হইলেন। তাঁহারা যখন রাজ্য গ্রহণ করেন, তখন তাহাদিগের সেই অবস্থা। তাহাদিগের দুরবস্থা মোচন করিবার জন্য ইংরেজদিগের ইচ্ছার ত্রুটি ছিল না; কিন্তু লর্ড কর্নওয়ালিস্ মহাভ্রমে পতিত হইয়া প্রজাদিগের আরও গুরুতর সর্বনাশ করিলেন। তিনি বলিলেন যে জমিদারদিগের জমিদারীতে তাঁহাদিগের যত্ন হইতেছে না। জমিদারীতে তাঁহাদিগের স্থায়ী অধিকার হইলে পর, তাহাতে তাঁহাদের যত্ন হইবে। সুতরাং তাঁহারা প্রজাপালক হইবেন। এই ভাবিয়া তিনি চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সৃজন করিলেন। রাজস্বের কন্ট্রাক্টরদিগকে ভূস্বামী করিলেন।

তাহাতে কি হইল? জমিদারেরা যে প্রজাপীড়ক, সেই প্রজাপীড়ক রহিলেন। লাভের পক্ষে প্রজাদিগের চিরকালের স্বত্ব একেবারে লোপ হইল। প্রজারাই চিরকালের ভূস্বামী; জমিদারেরা কস্মিকালে কেহ নহেন—কেবল সরকারী তহশীলদার। কর্নওয়ালিস্ যথার্থ ভূস্বামীর নিকট হইতে ভূমি কাড়িয়া লইয়া তহশীলদারকে দিলেন। ইহা ভিন্ন প্রজাদিগের আর কোন লাভ হইল না। ইংরাজ-রাজ্যে বঙ্গদেশের কৃষকদিগের এই প্রথম কপাল ভাঙ্গিল। এ চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বঙ্গদেশের অধঃপাতের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত মাত্র—কস্মিনকালে ফিরিবে না। ইংরেজদিগের এ কলঙ্ক চিরস্থায়ী; কেন না এ বন্দোবস্ত চিরস্থায়ী।[৭৩]

জমিদার চিরকালই প্রজার ফসল কাড়িয়া লইতেন, কিন্তু ইংরেজরা প্রথমে সে দস্যুবৃত্তিকে আইনসঙ্গত করিলেন। অদ্যপি এই দস্যুবৃত্তি আইনসঙ্গত।[৭৪]

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত সম্পর্কে এই সাধারণ মন্তব্যকালে বঙ্কিমচন্দ্র তাকে প্রকৃতপক্ষে ‘চিরস্থায়ী’ হিসেবে বর্ণনা করে তার পরিবর্তনের সম্ভাবনাকে চিন্তার ক্ষেত্রেও অগ্রাহ্য করেন। এছাড়া আরও একটি বিষয় এ ক্ষেত্রে লক্ষণীয়। ইংরেজ ও জমিদার শ্রেণী যাতে তাঁর রচনাটির দ্বারা তাঁর প্রতি বিরূপ ও রুষ্ট না হয় তার জন্যে তিনি যথেষ্ট যত্নবান ছিলেন। এ জন্যে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের অন্যায় ও কুফল, জমিদারের নির্যাতন, কৃষকদের দুর্দশা ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়েও তিনি বারবার বলেছেন—

‘আমরা জমিদারের দ্বেষক নহি। কোন জমিদার কর্তৃক কখনো আমাদিগের অনিষ্ট হয় নাই। বরং অনেক জমিদারকে আমরা বিশেষ প্রশংসাভাজন বিবেচনা করি।[৭৫] ‘আমাদিগের বিশেষ বক্তব্য এই, আমরা যাহা বলিতেছি, তাহা জমিদার সম্প্রদায় সম্বন্ধে বলিতেছি না। যদি কেহ বলেন, জমিদার মাত্রেই দুরাত্মা বা অত্যাচারী, তিনি নিতান্ত মিথ্যাবাদী।[৭৬] সকল জমিদার অত্যাচারী নহেন; দিন দিন অত্যাচারপরায়ণ জমিদারের সংখ্যা কমিতেছে। কলিকাতাস্থ সুশিক্ষিত ভূস্বামীদিগের [যার মধ্যে বঙ্কিমচন্দ্র নিজেও একজন ছিলেন-–ব. উ.] কোন অত্যাচার নাই—যাহা আছে, তাহা তাঁহাদিগের অজ্ঞাতে এবং অভিমত বিরুদ্ধে, নায়েব গোমস্তাগণের দ্বারা হয়। মফস্বলেও অনেক সুশিক্ষিত জমিদার আছেন তাঁহাদিগের ও প্রায় ঐরূপ। বড় বড় জমিদারদিগের অত্যাচার তত অধিক নহে; –অনেক বড় বড় ঘরে অত্যাচার একেবারে নাই। সামান্য সামান্য ঘরেই অত্যাচার অধিক। যাঁহার জমিদারী হইতে লক্ষ টাকা আইসে—অধর্মাচরণ করিয়া প্রজাদিগের নিকট আর ২ হাজার টাকা লইবার জন্য তাঁহার মনে প্রবৃত্তি দুর্বলা হইবারই সম্ভবনা, কিন্তু যাঁহার জমিদারী হইতে বারো মাসে বারো শত টাকা আসে না, অথচ জমিদারী চাল-চলনে চলিতে হইবে, মারপিট করিয়া আর কিছু সংগ্রহ করিবার ইচ্ছা তাঁহাতে সুতরাং বলবতী ইহবে।[৭৭] [এ ক্ষেত্রে বড় জমিদারের প্রতি পক্ষপাতিত্ব সুস্পষ্ট—ব. উ.

অনেক জমিদারীর প্রজাও ভালো নহে। পীড়ন না করিলে খাজনা দেয় না। সকলের উপর নালিশ করিয়া খাজনা আদায় করিতে গেলে জমিদারের সর্বনাশ হয়।[৭৮] ‘যাঁহারা জমিদারদিগকে কেবল নিন্দা করেন, আমরা তাঁহাদিগের বিরোধী। জমিদারদের দ্বারা অনেক সৎকার্য অনুষ্ঠিত হইতেছে।[৭৯]

ইচ্ছাপূর্বক বৃটিশ রাজপুরুষেরা প্রজার অনিষ্ট করেন নাই। তাঁহারা প্রজার পরম মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী। দেওয়ানী পাইয়া অবধি এ পর্যন্ত কিসে সাধারণ প্রজার হিত হয়, ইহাই তাঁহাদিগের অভিপ্রায় এবং ইহাই তাঁহাদিগের চেষ্টা। দুর্ভাগ্যবশতঃ তাঁহারা বিদেশী; এ দেশের অবস্থা সবিশেষ অবগত নহেন, সুতরাং পদে পদে ভ্রমে পতিত হইয়াছেন। ভ্রমে পতিত হইয়া এই মহৎ অনিষ্টকর বিধি সকল প্রচারিত করিয়াছেন।[৮০]

ইংরেজরা যে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ভ্রমে পতিত হয়ে করেছেন এ কথা বঙ্কিমচন্দ্র বঙ্গদেশের কৃষক-এ একাধিকবার উল্লেখ করেছেন। উপরোক্ত ‘ভ্রমের’ দ্বারা কি কি গুরুতর অনিষ্ট বঙ্গদেশের কৃষকদের হয়েছে, তাদের কপাল কিভাবে ভেঙেছে তার বর্ণনা করলেও সেই ‘ভ্রম’, সেই অনিষ্ট ও সেই ভাঙা কপালের সংশোধন নিবারণ ও পরিবর্তন যে তাঁর কাম্য নয় এ কথা তিনি খুব সুস্পষ্ট ভাষাতেই ব্যক্ত করেছেন:

১৭৯৩ সালে যে ভ্রম ঘটিয়াছিলো, এক্ষণে তাহার সংশোধন সম্ভব না। সেই ভ্রান্তির উপরে আধুনিক বঙ্গসমাজ নির্মিত হইয়াছে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ধ্বংসে বঙ্গসমাজের ঘোরতর বিশৃঙ্খলা উপস্থিত হইবার সম্ভবনা। আমরা সামাজিক বিপ্লবের অনুমোদক নহি। বিশেষ যে বন্দোবস্ত ইংরেজরা সত্য প্রতিজ্ঞা করিয়া চিরস্থায়ী করিয়াছেন, তাহার ধ্বংস করিয়া তাঁহারা এই ভারতমণ্ডলে মিথ্যাবাদী বলিয়া পরিচিত হয়েন, প্রজাবর্গের চিরকালের অবিশ্বাসভাজন হয়েন এমত কুপরামর্শ আমরা ইংরাজদিগকে দিইনি। যে দিন ইংরাজের অমঙ্গলাকাঙ্ক্ষী হইব, সমাজের অমঙ্গলকাঙ্ক্ষী হইব, সেই দিন সে পরামর্শ দিব।[৮১]

আধুনিক বঙ্গসমাজ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ওপর নির্মিত, সেই বন্দোবন্তের উচ্ছেদ অথবা পরিবর্তন সমাজে ঘোর বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে, সামাজিক বিপ্লব অনুমোদনের অযোগ্য- ইত্যাদি বক্তব্য যে প্রবলভাবে শ্রেণী সচেতন ও সাম্রাজ্যবাদের অনুরক্ত ব্যক্তিরই বক্তব্য এ কথা বলাই বাহুল্য। তিনি যে ইংরেজের অতিশয় মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী এ কথা তিনি নিজেও এখানে ঘোষণা করেছেন।

এদিক দিয়ে বঙ্কিমচন্দ্রের চিন্তা সাধারণভাবে ঊনিশ শতকের উচ্চ ও মধ্যশ্রেণীর চিন্তা থেকে পৃথক ছিলো না। এই শ্রেণী তৎকালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত এবং ইংরেজ শাসন উভয়ের প্রতিই অনুগত ছিলো। বস্তুত পক্ষে এ দুইয়ের সম্পর্ক এতখানি অবিচ্ছিন্ন ছিলো যে, একটির প্রতি আনুগত্যের অর্থই ছিলো অন্যটির প্রতি আনুগত্য। তবে এই আনুগত্য সাধারণ হলেও এই শ্রেণীর দুই অংশের মধ্যে একটি বিষয়ে পার্থক্য ছিলো। এদের একটি অংশ ছিলো মূলতঃ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ভূমি-ব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল এবং সেই ব্যবস্থাকে রক্ষার পক্ষপাতী। এই নির্ভরশীলতার জন্যেই তাদের প্রয়োজন ছিলো ইংরেজের প্রতি আনুগত্যের। কারণ ইংরেজ শুধু সেই ব্যবস্থার স্রষ্টা ছিলো না, তারা ছিলো সর্বতোভাবে তার রক্ষাকর্তাও। এদের অপর অংশটি মনে করতো যে, তাদের সমাজের যে উন্নতি শিক্ষা-দীক্ষা ও প্রগতি সম্ভব হচ্ছে, সেটা ইংরেজ শাসন উচ্ছেদ হলে সম্ভব নয়। এ জন্যে তাদের মূল আনুগত্য ছিলো উচ্চ ও মধ্যশ্রেণীর সামাজিক প্রগতি ও ইংরেজ শাসনের প্রতি। তাদের ভূমিস্বার্থও অন্য অংশের থেকে অল্প ছিলো, অথবা কিছুই ছিলো না। কিন্তু তবু তারা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বিরুদ্ধে কিছুই লেখেনি, বলেনি, আন্দোলন করেনি, তারা উচ্ছেদও কামনা করেনি। এই না করার কারণ, তারা উপলব্ধি করত যে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো এবং ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো ছিলো সমার্থক। ইংরেজ শাসনের উচ্ছেদ তারা চায়নি বলেই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের উচ্ছেদও তারা চায়নি। বঙ্কিমচন্দ্র ছিলেন প্রথম অংশভুক্ত, দ্বিতীয় অংশভুক্ত ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।

বঙ্গদেশের কৃষক নামক গ্রন্থটিতে বঙ্কিমচন্দ্র কৃষকদের দুরবস্থা বর্ণনা করে তারপর সঠিক বাস্তব নীতি ও কর্মপন্থা অনুসরণের ক্ষেত্রে শ্রেণী-স্বার্থের কথা চিন্তা করে অসচেতনভাবে পশ্চাদ্‌পসরণ করেছিলেন বলে কেউ কেউ তাঁর সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন।[৮২] বঙ্গদেশের কৃষক গ্রন্থটি কৃষকদের দুরবস্থা বর্ণনার দ্বারা অভিভূত না হয়ে রচনাক্ষেত্রে বঙ্কিমচন্দ্রের পূর্ণবর্ণিত কৌশলের কথা মনে রাখলে দেখা যায় যে, আসলে তিনি অসচেতনভাবে ‘পশ্চাদপসরণ’ করেননি। তাঁর এই ‘পশ্চাদপসরণ’ পূর্ব-চিন্তিত, পূর্ব-নির্ধারিত এবং কৌশলগত। বঙ্গদেশের কৃষক-এ তিনি যা করতে চেয়েছেন প্রকৃতপক্ষে তা সচেতন প্রতারণারই নামান্তর। কারণ কৃষকদের দুরবস্থাকে চিরস্থায়ী ও অপরিবর্তনীয় এবং চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের উচ্ছেদকে সমাজের পক্ষে অনিষ্টকর বিবেচনা করে তিনি যখন প্রতিনিধিস্থানীয় কৃষক পরাণ মণ্ডলের জন্য চোখের পানি ফেলেছেন, তখন সে পানি কুম্ভীরাশ্রু ব্যতীত আর কি? যে ব্যক্তি কৃষকদের দুরবস্থার মূল কারণ অপসারণের বিরোধী, তিনি সেই দুরবস্থাকে বর্ণনার ক্ষেত্রে নিজের সাহিত্যিক প্রতিভার এবং বাক্চাতুর্যের একটা স্বাক্ষর রাখতে পারেন কিন্তু তার দ্বারা সামাজিক চিন্তা এক পা-ও অগ্রসর হয় না। উপরন্তু সেই চিন্তা হয়ে দাঁড়ায় সামাজিক পশ্চাদপদতা এবং অচলায়তনকে দীর্ঘতর করা ও টিকিয়ে রাখারই অপকৌশল মাত্র। বঙ্কিমচন্দ্রের বঙ্গদেশের কৃষক-এর ক্ষেত্রে ঠিক তাই হয়েছিলো এবং সেই অপকৌশল যে বৃথা গেছে তা নয়। কৃষকদের দুরবস্থার বর্ণনার জন্যে বঙ্কিমচন্দ্রের এই রচনাটি আজও অনেকের কাছে তাঁর প্রগতিশীলতার প্রমাণ, এর মধ্যেই না-কি তাঁর সামন্তবাদ ও জমিদার- বিরোধিতার অভ্রান্ত পরিচয়!

বঙ্কিমচন্দ্র বাঙলাদেশের কৃষকদের শ্রেণীশত্রু ছিলেন। কিন্তু ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে কৃষক-স্বার্থের কোন মৌলিক সংঘাত ছিলো না। আর্থিক জীবনে ভূসম্পত্তির ওপর তিনি একেবারেই নির্ভরশীল ছিলেন না। সরকারী চাকুরীর ওপর নির্ভরশীলতাও তাঁর তেমন বেশী এবং বেশীদিন ছিলো না (বস্তুতপক্ষে তিনি মাত্র আটত্রিশ বছর বয়সে ১৮৫৮ সালে সরকারী চাকুরীতে ইস্তফা দেন)। তাঁর আর্থিক জীবনের মূল ভিত্তি ছিলো তাঁর প্রকাশনা ব্যবসায় এবং নিজের রচিত বইপত্রের বিক্রয়লব্ধ অর্থ। সেই হিসেবে তিনি ছিলেন স্বাধীন ব্যবসায়ী।

কৃষকদের প্রতি, হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে দরিদ্র জনগণের প্রতি তাঁর যে ব্যক্তিগত মমতা ছিলো, তাদের ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখের সঙ্গে তিনি যে নিজেকে অনেকখানি একাত্ম করে দেখার ক্ষমতা রাখতেন এবং সেই দুঃখ ব্যক্তিগতভাবে দূরীভূত করার চেষ্টা করতেন তার অনেক উদাহরণ তাঁর জীবনে দেখা যায়। কিন্তু তবু তিনি একজন সুলেখক হওয়া সত্ত্বেও, পত্র-পত্রিকা, ছাপাখানা, প্রকাশনা সংস্থা ইত্যাদির ওপর তাঁর যথেষ্ট কর্তৃত্ব থাকা সত্ত্বেও তিনি কৃষকদের দুরবস্থা অথবা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত সম্পর্কে একটি বাক্যও রচনা করেননি। বিদ্যাসাগরের সেটা না করার কারণ বঙ্কিমের মতো তিনিও জানতেন যে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বিরুদ্ধে আন্দোলনের অর্থ ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো, তার উচ্ছেদ ঘটাতে চাননি এবং সেটা চাননি বলেই তিনি কৃষকদের দুরবস্থা বর্ণনা করতেও আগ্রহী হননি। এ ক্ষেত্রে সচেতনভাবে পশ্চাদপসরণ বঙ্কিমচন্দ্র করেননি, করেছিলেন বিদ্যাসাগর। প্রতারণা বিদ্যাসাগরের ব্যক্তিগত রুচি বহির্ভূত ছিলো। এ জন্যে তিনি কৃষকদের প্রতি কুম্ভীরাশ্রু বর্ষণ না করে একদিকে যেমন চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত সম্পর্কে, কৃষকদের দুরবস্থা সম্পর্কে রচনা, প্রকাশনা ও প্রচারণা থেকে বিরত ছিলেন, অন্যদিকে তেমনি তিনি ব্যক্তিগত দয়া-দাক্ষিণ্য, সেবা-কার্যের মাধ্যমে তাদের দুঃখ-দুর্দশা যথাসম্ভব লাঘব করার জন্যে যথেষ্ট যত্নবান ছিলেন। এ কারণেই বিধবাদের দুঃখে বিদ্যাসাগরের চিত্ত বিচলিত হওয়ার ফলে এবং নারীমুক্তিকে সামাজিক অগ্রগতির একটা অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ মনে করে, তিনি বিধবাদের চিরবৈধব্য প্রথা বিলোপের যে প্রচেষ্টা করেছিলেন সে রকম কোন প্রচেষ্টা বৃহত্তর কৃষক- সমাজের মুক্তির জন্যে করেননি। স্বশ্রেণীর মুক্তির চিন্তাতেই তিনি বরাবর আকণ্ঠ নিমগ্ন থেকেছেন। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত-সৃষ্ট ভূসম্পত্তির ওপর দাঁড়িয়ে থাকা উচ্চ ও মধ্যশ্রেণীর স্বার্থকেই বিবেচনার বিষয় মনে করেছেন; সেই স্বার্থকে অগ্রসর করতেই নিযুক্ত হয়েছে বঙ্কিমচন্দ্রের মতো কৃষকশ্রেণীর শত্রু না হলেও, এ জন্যেই তিনি শ্রেণীগতভাবে তাদের বন্ধুও ছিলেন না। নিজের শ্রেণীর প্রতি মৌলিক আনুগত্য ও কৃষকশ্রেণীর বিরুদ্ধে শত্রুতাচরণে উৎসাহের অভাব—এ দুইয়ের সমন্বয় তিনি এ ক্ষেত্রে ঔদাসীন্যের মাধ্যমেই সাধন করেছিলেন। এখানেই বিদ্যাসাগরের চিন্তা ও কর্মের সঙ্গে ইউরোপীয় রেনেসাঁস আন্দোলনের নেতাদের চিন্তা ও কর্মের একটা মৌলিক পার্থক্য। এখানেই তাঁর বিশেষ শ্রেণীবদ্ধতা। এই শ্রেণীবদ্ধতাকে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মূল্যায়নের ক্ষেত্রে উপেক্ষা করা অথবা বিস্মৃত হওয়ার অর্থ তাঁর নিজের এবং তাঁর সমাজ শ্রেণী ও যুগের সঠিক মূল্যায়ন ও চরিত্র নির্ধারণে বহুলাংশে ব্যর্থ হওয়া।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন