পরিশিষ্ট ১ – ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

বদরুদ্দীন উমর

ঊনিশ শতকীয় বাঙলাদেশের রেনেসাঁস নামে পরিচিত সাংস্কৃতিক আন্দোলন ছিলো নগরকেন্দ্রিক এবং চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত উদ্ভুত ভূস্বামীশ্রেণী ছিলো তার মেরুদণ্ড। বাঙলাদেশের এই আন্দোলনের সঙ্গে ইউরোপীয় রেনেসাঁসের এখানেই হলো মৌলিক তফাৎ। কারণ ইউরোপীয় রেনেসাঁসের নেতা ছিলো ব্যবসায়ী বুর্জোয়া শ্রেণী এবং তার লক্ষ্য ছিলো সামন্ত প্রথা ও সামন্ত ভূমিব্যবস্থার উচ্ছেদ। পনেরো থেকে আঠারো শতকের মধ্যে এই ব্যবসায়ী- বুর্জোয়া-শ্রেণী ইউরোপীয় চিন্তাধারা ও সমাজ কাঠামোর ক্ষেত্রে যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করে তার ফলে সামন্ত ভূমিব্যবস্থার উৎপীড়ন থেকে বৃহত্তর কৃষক-সমাজ মুক্তি লাভ করে এবং ইউরোপে প্রগতিশীল ধনতন্ত্রের জয় সুপ্রতিষ্ঠিত হয়।

ঊনিশ শতকীয় বাঙলাদেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সঙ্গে ইউরোপীয় বুর্জোয়া শ্রেণীর চরিত্রগত প্রভেদই উপরোক্ত দুই সাংস্কৃতিক নবজাগরণের মধ্যে এই পার্থক্য সৃষ্টির জন্যে দায়ী। ইউরোপীয় বুর্জোয়া শ্রেণী পনেরো শতকের প্রথম দিকেই একটি নোতুন ও স্বাধীন শ্রেণী রূপে জন্মলাভ করে। এরপর তিন চার শতক ধরে নব-নব রূপে বিকাশ লাভ করে নিজের এই যাত্রাপথে সমগ্র সমাজ-কাঠামোর বৈপ্লবিক পরিবর্তনের মাধ্যমে এই বুর্জোয়া শ্রেণী ইউরোপীয় সমাজের পরিপূর্ণ রূপান্তর ঘটায়। কিন্তু বাঙলাদেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মূল ভিত্তি ব্যবসা-বাণিজ্য অথবা শিল্পকার্য ছিলো না। তার মূল ভিত্তি ছিলো চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত-জাত ভূমিব্যবস্থা। এ জন্যেই ঊনিশ শতকীয় মধ্যবিত্ত বাঙালীর নবজাগরণ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়নি। অনেকে সেই বন্দোবস্তের কঠোর সমালোচনা করলেও তার উচ্ছেদের প্রশ্নে তাঁরা মোটামুটিভাবে নীরব থেকেছেন। প্রচলিত সামন্ত ব্যবস্থার প্রতি এই মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গীর ফলেই বাঙলার নবজাগরণ সমগ্র বাঙালী সমাজে, এমন কি মধ্যবিত্ত সমাজের মধ্যেও কোন বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়নি। ইংরেজ-সৃষ্ট সামন্ততান্ত্রিক সমাজ-কাঠামোর মধ্যে সারা ঊনিশ শতক ধরে সাংস্কৃতিক আন্দোলন ছিলো বন্দীদশাপ্রাপ্ত।

ইউরোপীয় রেনেসাঁস আন্দোলন সামন্ত প্রথার বিরুদ্ধে স্থাপিত হওয়ার জন্যে তা গ্ৰামাঞ্চল এবং কৃষক-সমাজকেও বিপুলভাবে নাড়া দেয়। সমাজ-কাঠামোর পরিবর্তন তাদের জীবনের মধ্যেও আনে বিপুল উদ্দীপনা। কিন্তু বাঙলাদেশের ঊনিশ শতকীয় নবজাগরণ বাঙলার কৃষক-সমাজকে স্পর্শই করেনি, প্রায় সর্বতোভাবে তা কলকাতা এবং আরও কয়েকটি শহরকে কেন্দ্র করেই বিকাশ লাভ করেছে। রামমোহনের সতীদাহ প্রথা নিবারণ আন্দোলন এবং ঈশ্বরচন্দ্রের বিধবাবিবাহের আন্দোলন এ দিক দিয়ে সামান্য ব্যতিক্রম হলেও তা গ্রাম- বাঙলার জীবনে রেনেসাঁসের মতো কোন বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনেনি।

ঊনিশ শতকের বাঙলায় যে সাংস্কৃতিক ও সমাজ-সংস্কার আন্দোলন হয়েছিলো সেটা অবশ্য কোন সরল রেখা ধরে অগ্রসর হয়নি। তৎকালীন বাঙালী সমাজের শ্রেণী বিন্যাস এবং বিভিন্ন শ্রেণীর সংঘাতের ফলে রেনেসাঁস নামে কথিত এই সাংস্কৃতিক ও সংস্কার আন্দোলনের মধ্যেও দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের যথেষ্ট প্রমাণ ও পরিচয় পাওয়া যায়। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এবং বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের দ্বন্দ্ব ও বিরোধিতার উল্লেখ এ ক্ষেত্রে খুবই প্রাসঙ্গিক। কারণ এই বিরোধ শুধুমাত্র ব্যক্তির বিরোধ নয়। এই বিরোধ ছিলো ঊনিশ শতকের বাঙালী মধ্যবিত্ত শ্রেণীর দুই অংশের বিরোধ। এর এক অংশ ছিলো পুরোপুরিভাবে সামন্ততন্ত্রের এবং সামন্ততান্ত্রিক মূল্যবোধের রক্ষক এবং অন্য অংশ সামন্ততান্ত্রিক ভূমিব্যবস্থার উচ্ছেদকামী না হলেও ইউরোপীয় চিন্তা ভাবনার প্রভাবে বাঙালী মধ্যবিত্ত শ্রেণীর চিন্তাকে অনেকাংশে সামন্ত প্রভাবমুক্ত করতে উদ্যোগী। বঙ্কিমচন্দ্র ছিলেন প্রথম অংশের নেতা; ঈশ্বরচন্দ্র, অক্ষয়কুমার দত্ত ছিলেন দ্বিতীয় অংশের নেতা।

ঊনিশ শতকের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অপেক্ষাকৃত প্রগতিশীল অংশ অন্য অংশের মতো চিরস্থায়ী বন্দোবস্তপুষ্ট হলেও ইউরোপীয় শিক্ষা এবং উদারনৈতিক চিন্তাধারা তাঁদের সামন্ততান্ত্রিক মূল্যবোধের বিরুদ্ধে অনেকখানি সচেতন ও সক্রিয় করে তোলে। সমাজে নানা কুসংস্কার এবং রক্ষণশীল রীতিনীতির বিরুদ্ধে তাঁরা শুরু করেন তাঁদের সংগ্রাম ও সংস্কার আন্দোলন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের দার্শনিক ও শিক্ষাচিন্তা এবং বিধবাবিবাহ প্রচলনের আন্দোলন হলো তারই সর্বপ্রধান ও সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য উদাহরণ।

সমগ্র বাঙালী হিন্দু সমাজে যখন ধর্মের জোয়ার বইছে, ধর্মচিন্তাকে নানাভাবে সংস্কার করে, বেদ-বেদান্ত নোতুনভাবে ব্যাখ্যা ও বিচার প্রচেষ্টা চলছে, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তখন বেদান্তের অসারত্ব সম্পর্কে নিঃসন্দেহ। শুধু তাই নয়, ইউরোপীয় দার্শনিকদের মধ্যে বার্কলের মতো ভাববাদীদের প্রভাব থেকে বাঙালী শিক্ষিত যুবসমাজকে রক্ষা করতেও তিনি রীতিমতো ব্যগ্র। বারাণসী হিন্দু কলেজের তৎকালীন ইউরোপীয় অধ্যক্ষের সঙ্গে এ ব্যাপারে তাঁর বিতর্কই তাঁর এই ব্যগ্রতার পরিচয় প্রদান করে।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ইংরেজী শিক্ষা এবং ইউরোপীয় উদারনীতিবাদকে বাঙালী সমাজের চিন্তাগত পশ্চাৎপদত্ব এবং অন্তহীন কুসংস্কার দূরীকরণের একটা নিশ্চিত ও উপযুক্ত প্রতিষেধক হিসেবে ধরে নিয়েছিলেন এবং সেজন্যেই তিনি ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসনের বিরোধিতা তো করেনইনি, উপরন্তু সিপাহী বিদ্রোহের ব্যাপারে সম্পূর্ণভাবে উদাসীন থেকে ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসনের দীর্ঘ জীবনই কামনা করেছিলেন। কোন প্রত্যক্ষ ভূমিস্বার্থ না থাকা সত্ত্বেও এ জন্যেই বঙ্কিমচন্দ্র প্রভৃতির মতো তিনি চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের উৎখাত কামনা করেননি।

তবে এ ক্ষেত্রে বঙ্কিমচন্দ্রের সাথে তাঁর একটা বড় পার্থক্যকেও উপেক্ষা করা চলে না। বঙ্কিমচন্দ্র যে শুধু চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত-সৃষ্ট ভূমিব্যবস্থা এবং তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকল প্রকার স্বার্থ ও সংস্কারের রক্ষক ছিলেন তাই নয়, তিনি ছিলেন তৎকালীন বুদ্ধিজীবী মহলে প্রতিক্রিয়ার সর্বপ্রধান প্রতিনিধি। সে জন্য বিদ্যাসাগর, অক্ষয় দত্ত প্রমুখের বিভিন্ন সংস্কার প্রচেষ্টা তৎকালীন বাঙালী সমাজের মধ্যে যে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলো, সমাজের মৌলিক কাঠামোকে না হলেও উপরিভাগে যেভাবে আঘাত হেনেছিলো তার বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন রীতিমতো সোচ্চার। এই কারণেই বঙ্কিমচন্দ্রের সাহিত্য প্রচেষ্টা একদিকে যেমন নিযুক্ত ছিলো কৃষক-স্বার্থের বিরুদ্ধে, অন্যদিকে তেমনই তা নিষ্ঠার সঙ্গে নিযুক্ত ছিলো ঈশ্বরচন্দ্রের সমগ্র চিন্তা ও সংস্কার আন্দোলনের বিরুদ্ধে। এ জন্যেই একদিকে তিনি যেমন লিখেছিলেন বঙ্গদেশের কৃষক তেমনই অন্যদিকে লিখেছিলেন কৃষ্ণকান্তের উইল এবং বিষবৃক্ষ।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের চিন্তা ছিলো সর্বতোভাবে সংস্কারমুখী, ইউরোপীয় রেনেসাঁসের নেতাদের মতো তাঁর চিন্তাধারা প্রচলিত সমাজব্যবস্থা ও ভূমিব্যবস্থার উচ্ছেদের উদ্দেশ্যে নিয়োজিত ছিলো না। এ জন্যেই তাঁর চিন্তার মধ্যে কোন বৈপ্লবিক সম্ভাবনাও থাকেনি। দীনবন্ধু মিত্র এবং হিন্দু পেট্রিয়ট-এর সম্পাদক হরিশচন্দ্র যেভাবে নির্যাতিত কৃষকদের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র তা কোনদিন চিন্তাও করেননি। হিন্দু বিধবাদের দুরবস্থার কথা চিন্তা করে তাঁর হৃদয় বিচলিত হলেও দরিদ্র কৃষকদের ওপর নীলকরদের নির্যাতন চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের হাজারো অত্যাচার তাঁর মনকে বিন্দুমাত্র আলোড়িত করেনি। তাই বিধবা বিবাহের সংস্কার আন্দোলনে তিনি প্রচুর অর্থ ও শক্তি ব্যয় করলেও নিজের কথা, লেখা ও কর্মের মাধ্যমে বৃহত্তর কৃষকসমাজের সুখ-দুঃখের প্রতি ছিলেন সম্পূর্ণ উদাসীন।

কিন্তু এ দিক দিয়ে আবার ঈশ্বরচন্দ্র কোন ব্যতিক্রম ছিলেন না। ঊনিশ শতকের বাঙালী মধ্যবিত্তের স্বার্থ সাধারণভাবে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ওপরই ছিলো প্রতিষ্ঠিত এবং তার প্রভাবে সমগ্র মধ্যবিত্ত শ্রেণীই কৃষক-স্বার্থের প্রতি শুধু উদাসীনই ছিলো না, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ছিলো শত্রুভাবাপন্ন। অর্থাৎ তাঁরা ছিলেন দরিদ্র কৃষকদের শ্রেণীশত্রু। বঙ্কিমচন্দ্রের মতো ঈশ্বরচন্দ্র কৃষক-স্বার্থের বিরুদ্ধে সরাসরি কোন বক্তব্য উপস্থিত না করলেও তার প্রতি ঔদাসীন্যই তাঁর চিন্তার সরাসরি কোন বক্তব্য উপস্থিত না করলেও তার প্রতি ঔদাসীন্যই তাঁর চিন্তার একটা বিশেষ পরিধি নির্দিষ্ট করে এবং এই পরিধিকে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মূল্যায়নে সঠিকভাবে বিচার ও বিবেচনা করা প্রগতিশীল চিন্তার ক্ষেত্রে অপরিহার্য।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন