ঊনিশ শতকের বাঙালী সমাজ – ১০

বদরুদ্দীন উমর

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মূল্যায়ন করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘তাহার প্রধান কীর্তি বঙ্গভাষা।[১৮] তিনি আরও বলেছেন:

বিদ্যাসাগর বাঙলা ভাষার প্রথম যথার্থ শিল্পী ছিলেন। তৎপূর্বে বাঙলায় গদ্যসাহিত্যের সূচনা হইয়াছিলো কিন্তু তিনিই সর্বপ্রথমে বাঙলা গদ্যে কলানৈপুণ্যের অবতারণা করেন। ভাষা যে কেবল ভাবের একটা আধারমাত্র নহে তাহার মধ্যে যেন-তেন-প্রকারের কতকগুলো বক্তব্য বিষয় পুরিয়া দিলেই যে কর্তব্য সমাপন হয় না, বিদ্যাসাগর দৃষ্টান্ত দ্বারা তাহাই প্রমাণ করিয়াছিলেন। তিনি দেখাইয়াছিলেন যে, যতটুকু বক্তব্য, তাহা সরল করিয়া, সুন্দর করিয়া সুশৃঙ্খল করিয়া ব্যক্ত করিতে হইবে। আজিকার দিনে এ কাজটিকে তেমন বৃহৎ বলিয়া মনে হইবে না, কিন্তু সমাজ বন্ধন যেমন মনুষ্যত্ব বিকাশের পক্ষে অত্যাবশ্যক তেমনি ভাষাকে কলাবন্ধনের দ্বারা সুন্দররূপে সংযমিত না করিলে, সে ভাষা হইতে কদাচ প্রকৃত সাহিত্যের উদ্ভব হইতে পারে না। সৈন্যদলের দ্বারা যুদ্ধ সম্ভব, কেবলমাত্র জনতার দ্বারা নহে, জনতা নিজেকেই নিজে খণ্ডিত প্রতিহত করিতে থাকে, তাহাকে চালনা করাই কঠিন। বিদ্যাসাগর বাঙলা গদ্যভাষার উচ্ছৃঙ্খল জনতাকে সুবিভক্ত, সুবিন্যস্ত, সুপরিচ্ছন্ন এবং সুসংহত করিয়া তাহাকে সহজগতি এবং কার্যকুশলতা দান করিয়াছেন—এখন তাহার দ্বারা অনেক সেনাপতি ভাব প্রকাশের কঠিন বাধা সকল পরাহত করিয়া সাহিত্যের নব-নব ক্ষেত্র আবিষ্কার ও অধিকার করিয়া লইতে পারেন—কিন্তু যিনি এই সেনানীর রচনাকর্তা যুদ্ধ জয়ের যশোভাগ সর্ব প্রথম তাঁহাকেই দিতে হয়।

বাঙলা ভাষাকে পূর্ব প্রচলিত অন্যাবশ্যক সমাসাড়ম্বরভার হইতে মুক্ত করিয়া তাহার পদগুলির মধ্যে অংশযোজনার সুনিয়ম স্থাপন করিয়া বিদ্যাসাগর যে বাঙলা গদ্যকে কেবলমাত্র সর্বপ্রকার ব্যবহারযোগ্য করিয়াই ক্ষান্ত ছিলেন, তাহা নহে; তিনি তাহাকে শোভন করিবার জন্যেও সর্বদা সচেষ্ট ছিলেন। গদ্যের পদগুলির মধ্যে ধ্বনি সামঞ্জস্য স্থাপন করিয়া, তাহার গতির মধ্যে একটি অনতিলক্ষ্য ছন্দ-স্রোত রক্ষা করিয়া, সৌম্য এবং সরল শব্দগুলি নির্বাচন করিয়া বিদ্যাসাগর বাঙলা গদ্যকে সৌন্দর্য ও পরিপূর্ণতা দান করিয়াছেন। গ্রাম্য পাণ্ডিত্য এবং গ্রাম্য বর্বরতা, উভয়ের হস্ত হইতেই উদ্ধার করিয়া তিনি ইহাকে পৃথিবীর ভদ্রসভার উপযোগী আর্যভাষারূপে গঠিত করিয়া গিয়াছেন। তৎপূর্বে বাঙলা গদ্যের যে অবস্থা ছিল, তাহা আলোচনা করিয়া দেখিলে এই ভাষাগঠনে বিদ্যাসাগরের শিল্প প্রতিভা ও সৃষ্টিক্ষমতার প্রচুর পরিচয় পাওয়া যায়।[১৯]

বাঙলা ভাষাকে আধুনিক রূপদানের ক্ষেত্রে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদানকে উপরোল্লিখিত ভাষায় বর্ণনা করে রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতপক্ষে বিদ্যাসাগরকে আধুনিক বাঙলা গদ্যের জনক রূপেই অভিহিত করেছেন। বিদ্যাসাগরের ভাষা-বিষয়ক কীতি সম্পর্কে এই মূল্যায়ন খুবই যথার্থ কমা, সেমিকোলন ইত্যাদি ছেদচিহ্নসমূহ প্রচলন করে তিনি বাঙলা ভাষায় যে গতিশীলতা সৃষ্টি করেন তার ফলেই ভাষা হিসেবে বাঙলা সর্বপ্রকার রচনার উপযোগী হয়ে ওঠে।

বিদ্যাসাগরের অধিকাংশ রচনা হয় অনুবাদ, নয়তো পাঠ্যপুপ্রস্তক—এই যুক্তি দেখিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর রচনায় উৎকর্ষ এবং মৌলিকতার অভাবের কথা বলেন।[২০] ‘বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ভাষা অতি সুমধুর ও মনোহর। তাঁহার পূর্বে কেহই এ রূপ সুমধুর বাঙলা গদ্য লিখিতে পারেন নাই এবং তাঁহার পরেও পারে নাই।’[২১] এই বক্তব্যের দ্বারা তিনি ‘সংস্কৃতানুরাগী পণ্ডিতদের’ মধ্যে বিদ্যাসাগরের ভাষাকে কুণ্ঠিতভাবে শ্রেষ্ঠ বললেও[২২] বিদ্যাসাগরের ভাষা ও সাহিত্যের তিনি ছিলেন একজন বিরুদ্ধ সমালোচক। তিনি বলতেন যে, বিদ্যাসাগর কঠিন সব সংস্কৃত শব্দ প্রয়োগ করে বাঙলা ভাষার ধাতটা খারাপ করে গেছেন।[২৩] বিদ্যাসাগরের ‘সীতার বনবাস’ বঙ্কিমের কাছে ‘কান্নার জোলাপ’[২৪] ব্যতীত কিছুই নয়। বঙ্কিমচন্দ্রের নাম উল্লেখ না করলেও এই ধরনের সমসাময়িক সমালোচনা সম্পর্কে রামগতি ন্যায়রত্ন বলেছেন,

বিদ্যাসাগরের রচনা প্রণালীর প্রাদুর্ভাবের সময়ই বাঙলা ভাষার পক্ষে অন্ধকারাবস্থা হইতে আলোকে প্রবিষ্ট হইবার প্রায় প্রথম উদ্যমকাল। ঐরূপ কালে সকল ভাষাতেই মূলগ্রন্থ অপেক্ষা অনুবাদগ্রন্থই অধিক হইয়া থাকে, ইহা এক সাধারণ নিয়ম। বিদ্যাসাগর সে নিয়মের অনধীন হইতে পারেন নাই, সুতরাং তাঁহাকে মূলগ্রন্থ অপেক্ষা অনুবাদ গ্রন্থই অধিক করিতে হইয়াছে। কিন্তু যিনি উপক্রমণিকা, কৌমুদী, বিধবাবিবাহ সংক্রান্ত ১ম ও ২য় পুস্তক, সংস্কৃত ভাষা ও সংস্কৃত সাহিত্য বিষয়ক প্রস্তাব, সীতার বনবাস ও বহুবিবাহ বিচার রচনা করিয়াছেন, তাঁহাকে মূলরচনা করিবার শক্তিবিহীন বলা নিতান্ত ধৃষ্টতার কার্য হয়।[২৫]

বঙ্কিমচন্দ্রের সঙ্গে সমাজ-সংস্কার নীতি ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গীর ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগরের তীব্র বিরোধিতার কারণে বঙ্কিমচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মূল্যায়নে কোন ক্ষেত্রেই সঠিক সমালোচকের পরিচয় দিতে পারেননি। এমন কি বিদ্যাসাগরকে ‘মূর্খ* পর্যন্ত বলতে তাঁর দ্বিধাবোধ ছিল না।[২৬] কাজেই ভাষা ও সাহিত্য ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগরের কৃতিত্ব সম্পর্কে বঙ্কিমের বক্তব্য যে ভ্রান্ত সংস্কারদুষ্ট সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। রবীন্দ্রনাথ ও রামগতি ন্যায়রত্নের বক্তব্যই এ ক্ষেত্রে যথার্থ এবং গ্রহণযোগ্য।

[*সূর্যমুখীর পত্র : “আর একটা হাসির কথা। ঈশ্বর বিদ্যাসাগর নামে কলিকাতায় কে না কি বড় পণ্ডিত আছেন, তিনি আবার একখানি বিধবাবিবাহের বহি বাহির করিয়াছেন। যে বিধবার বিবাহের ব্যবস্থা দেয়, সে যদি পণ্ডিত, তবে মূর্খ কে?” বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় : ‘বিষবৃক্ষ’।]

বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাসে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের এই অবদানের মধ্যে শুধু তাঁর কৃতিত্ব নয়, তাঁর প্রগতিশীলতারও যথার্থ পরিচয় পাওয়া যায়। কারণ সমাজের মধ্যে যে সমস্ত বাধা-বন্ধন সামাজিক অগ্রগতিকে রোধ করে, সমাজের বিকাশকে বাধা দেয়, তার মধ্যে ভাষার বাধা-বন্ধন হলো অন্যতম এবং খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ জন্যে দেখা যায় যে, ইউরোপে শিল্প-বাণিজ্যের বিকাশের মাধ্যমে যখন আধুনিক বুর্জোয়া জাতীয় রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয় সেখানে যখন জনগণের অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক জীবনের মধ্যে পরিবর্তনের এক বৈপ্লবিক ধারা প্রবাহিত হতে শুরু করে, তখন লাতিন ভাষার প্রভাব উত্তীর্ণ হয়ে ইউরোপে ইংরেজী, ফারসী, জার্মান ইত্যাদি ভাষার বিকাশ শুরু হয় এবং তার পরিণতিতে শিক্ষা সংস্কৃতি, এমনকি ধর্মচর্চার ভাষা হিসেবেও লাতিন বাতিল হয়ে যায়। মার্টিন লুথার জার্মান ভাষায় বাইবেলের অনুবাদ করেন। এ দিক দিয়ে রামমোহনের বেদান্তের অনুবাদ লুথারের জার্মান ভাষায় বাইবেল অনুবাদের সঙ্গে তুলনীয়*।

[* কিন্তু ভাষার বিকাশের দিক দিয়ে এ তুলনা সঠিক হলেও অন্য দিক দিয়ে তা বিভ্রান্তিকর হতে পারে। কারণ লুথারের অনুবাদ ধর্মপ্রাণ কৃষকদের বাইবেলের ধনিকশ্রেণী-বিরোধী বক্তব্যসমূহ সম্পর্কে অবহিত করে তাদের ১৮২৫ সালের কৃষক বিদ্রোহের ক্ষেত্রে অনুপ্রাণিত করেছিলো (লুথারের বিদ্রোহ-বিরোধিতা সত্ত্বেও)। কিন্তু রামমোহনের বেদান্ত অনুবাদ বাঙালী সমাজের মধ্যে সে ধরনের কোন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি না করে উপরন্তু তাদের রক্ষণশীলতার দুর্গের মধ্যেই নোতুন করে নিক্ষেপ করেছিলো।]

বিদ্যাসাগর তাঁর লেখায় কত সংস্কৃত শব্দ ব্যবহার করতেন, সেটা বড় কথা নয়। আসল কথা হলো, তিনি সংস্কৃত রচনা পদ্ধতিকে পরিবর্তন করে বাঙলা ভাষার এক নোতুন শব্দ- বিন্যাস রীতি প্রচলন করেছিলেন। এই রীতির ওপর ভিত্তি করেই মাইকেল, বঙ্কিম, দীনবন্ধু, কেশব সেন, মশাররফ হোসেন, শিবনাথ শাস্ত্রী, রবীন্দ্রনাথ প্রভৃতি বিভিন্ন ধরনের রচনা ঊনিশ শতকে প্রকাশ করেছিলেন, শিল্প-সাহিত্য-বিজ্ঞানের ভাষারূপে বাঙলা ভাষার অনেকখানি উৎকর্ষ সাধন করতে সমর্থ হয়েছিলেন। এর ফলে সংস্কৃত শব্দের ব্যবহার বাঙলা ভাষায় ঐতিহাসিক নিয়মে এবং স্বাভাবিকভাবেই কমে এসেছিলো, ইউরোপে যেমন কমে এসেছিলো জাতীয় ভাষাগুলির মধ্যে লাতিন শব্দের ব্যবহার।

মোটকথা বিদ্যাসাগর সহজ ব্যাকরণ রচনা, বাক্যবিন্যাস রীতি, অনুবাদ ইত্যাদির মাধ্যমে বাঙলা ভাষার উন্নতি সাধন করে শুধু যে নব-নব সাহিত্য সৃষ্টির পথই উন্মুক্ত করেছিলেন তা নয়, তিনি সামাজিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে বাঙলা ভাষার ব্যবহার এবং প্রয়োগকে ব্যাপক ও সুবিস্তৃত করেছিলেন; এবং তার ফলে ঊনিশ শতকেই বাঙলা ভাষা বাঙালী জাতির জাতীয় ভাষা রূপে বিভিন্ন ভারতীয় ভাষার মধ্যে শ্রেষ্ঠ আসন পরিগ্রহ করেছিলো। ঊনিশ শতকে উত্তর এবং দক্ষিণ ভারতের আঞ্চলিক ভাষাগুলিরও বিকাশ শুরু হয়, কিন্তু সমাজভূমির পার্থক্যের জন্যে সেইসব অঞ্চলের ভাষাসমূহ ঊনিশ শতকে বাঙলার মতো উৎকর্ষ অর্জন করতে সক্ষম হয়নি।

নব উত্থিত বাঙালী মধ্যবিত্তের প্রয়োজনের তাগিদে বিদ্যাসাগর যে গদ্যরীতির প্রচলন করেছিলেন পরবর্তীকালে বাঙালী সমাজের, বিশেষতঃ বাঙালী মধ্যশ্রেণীর অন্তর্নিহিত দুর্বলতার জন্যে সে ভাষা বিজ্ঞান ও মননশীল রচনার বাহন রূপে যথেষ্ট বলিষ্ঠভাবে গঠিত হতে পারেনি। সে ত্রুটি বিদ্যাসাগরের নয়। তার মূল কারণ সমাজের ভিত্তি ও তার কাঠামোর দুর্বলতা এবং বাঙালী মধ্যশ্রেণীর মধ্যে শিল্পবিকাশ, নানা বিষয়ে মৌলিক গবেষণা ও বিজ্ঞানচর্চার একান্ত অভাব।

১১

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে ‘পাঠ্যপুস্তক রচয়িতা’ বলে বঙ্কিমচন্দ্র ব্যঙ্গ করলেও এই পাঠ্যপুস্তক রচনাও বিদ্যাসাগরের একটি বিশিষ্ট কীর্তি। বাঙলা শিক্ষা অর্থাৎ মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদানের গুরুত্ব উপলব্ধি করে মাতৃভাষায় ছাত্রছাত্রীরা যাতে উপযুক্তভাবে নিষ্প্রয়োজনীয় পরিশ্রম বাদ দিয়ে শিক্ষিত হতে পারে তার জন্যে তাঁর উদ্যমের অভাব ছিলো না। এ জন্যেই তিনি বর্ণপরিচয় থেকে উপক্রমণিকা পর্যন্ত সর্বস্তরের পাঠপুস্তক রচনাতেই বিশেষ যত্নবান হয়েছিলেন।

বাঙলা শিক্ষা প্রচলনের ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগরের প্রচেষ্টার অন্য দিকও আছে। শিক্ষা পরিষদের সদস্য ফ্রেডারিক হ্যালিডের কাছে তিনি বাঙলা সম্পর্কে একটি পরিকল্পনা পেশ করেন। তাতে তিনি বলেন—

১. বাঙলা শিক্ষার বিস্তার ও সুব্যবস্থা একান্ত প্রয়োজনীয়। তা না হলে দেশের জনসাধারণের কল্যাণ হবে না।

২. কেবল লিখন পঠন এবং গণনা ও সরল অঙ্ক কষার মধ্যে বাঙলা শিক্ষা সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না। যতদূর সম্ভব বাঙলা ভাষাতেই সম্পূর্ণ শিক্ষা দিতে হবে, এবং তার জন্য ভূগোল, ইতিহাস, জীবন-চরিত, পাটিগণিত, জ্যামিতি, পদার্থবিদ্যা, নীতিবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও শারীরবিজ্ঞানও বাঙলায় শিক্ষা দেওয়া প্রয়োজন।[২৭]

বিদ্যাসাগরের এই পরিকল্পনা (যার মধ্যে অনেক বাস্তব পদক্ষেপের প্রস্তাবও ছিলো) হ্যালিডে কর্তৃক অনুমোদিত হয় এবং তার ফলে মাতৃভাষায় শিক্ষার অনেকখানি প্রসার ঘটে। এখানে অবশ্য উল্লেখ করা দরকার যে, এই প্রসার সত্ত্বেও বাঙালীদের মাতৃভাষা-চর্চা ও শিক্ষা মোটামুটি উচ্চ ও মধ্যশ্রেণীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো।

কিন্তু এই সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও মাতৃভাষা-চর্চা এবং সেই ভাষাকে সাহিত্য সংস্কৃতির ভাষা হিসেবে গঠন প্রচেষ্টা যে তার শ্রেণীগত সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও ঊনিশ শতকে একটি প্রগতিশীল আন্দোলন ছিলো সেটা বোঝা যাবে যদি উচ্চ ও মধ্যশ্রেণীর মুসলমান সমাজ-নেতাদের শিক্ষা-সম্পর্কিত, বিশেষতঃ মাতৃভাষা সম্পর্কিত নীতিকে এ ক্ষেত্রে সংক্ষিপ্তভাবে উল্লেখ করা যায়।

১৮৮২ সালের ৩রা ফেব্রুয়ারী তদানীন্তন গভর্ণর জেনারেল লর্ড রিপন সমগ্র শিক্ষা-ব্যবস্থা সম্পর্কে তদন্তের জন্য উইলিয়াম হান্টারের সভাপতিত্বে একটি কমিশন গঠন করেন। মাতৃ- ভাষায় শিক্ষাদান সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে তৎকালীন মুসলমান সমাজের অন্যতম প্রধান নেতা ও মুখপাত্র নবাব আবদুল লতিফ লিখিতভাবে কমিশনকে বলেন যে, নিম্নশ্রেণীর মুসলমান, যারা জাতিগতভাবে হিন্দুদের থেকে পৃথক নয়, তাদের জন্যে প্রাথমিক পর্যায়ে বাঙলার শিক্ষা দেওয়া চলতে পারে। তবে হিন্দু-প্রভাবিত সংস্কৃত-শব্দবহুল বাঙলার মাধ্যমে সেটা সম্ভব নয়। তার জন্যে প্রয়োজন সংস্কৃত শব্দের পরিবর্তে বাঙলায় নোতুন করে আরবী ফারসী শব্দসমূহ আমদানী করা অর্থাৎ বাঙলা ভাষাকে ‘উপযুক্তভাবে পরিশোধিত’ করা। উচ্চ ও মধ্যশ্রেণীর জন্যে তাঁর সুপারিশ ছিলো অন্য প্রকার। সে ক্ষেত্রে তিনি উর্দুর মাধ্যমে শিক্ষাদানের পক্ষপাতী ছিলেন। তার প্রধান কারণ, উর্দু না জানলে সম্ভ্রান্ত মুসলমান মহলে কোন প্রকার গতিবিধি সম্ভব নয়। তা’ছাড়া উচ্চ ও মধ্যশ্রেণীর মুসলমানরা আরব, ইরান, তুর্কী ও মধ্য এশিয়া থেকে আগত মুসলমান বিজেতা, শাসনকর্তা, ধর্মনেতা, আলেম প্রভৃতিদের বংশধর। অর্থাৎ তাঁরা বাঙালী নন, কাজেই বাঙলা তাঁদের মাতৃভাষাও নয়। সেই হিসেবে উচ্চ ও মধ্যশ্রেণীর মুসলমানদের বাঙলা ভাষায় শিক্ষা গ্রহণের প্রশ্ন তাঁর কাছে ছিলো সম্পূর্ণ অবান্তর।[২৮]

এ কথা সত্য যে, অসংখ্য লোকজন আরব, ইরান, তুর্কী প্রভৃতি দেশ থেকে কয়েক শতক ধরে ভারতবর্ষ ও বাংলাদেশে এসেছিলো এবং এ দেশে স্থায়ীভাবে থেকে গিয়েছিলো। কিন্তু তার ওপর ভিত্তি করে নবাব আবদুল লতিফ উচ্চ ও মধ্যশ্রেণীর মুসলমানদের যে জাতি- পরিচয় নির্ণয় করেছিলেন তা যে নিতান্তই কাল্পনিক ও ভ্রান্ত সেটা বলাই বাহুল্য। ঊনিশ শতকের আবদুল লতিফের এই বিভ্রান্তিকর জাতিতত্ত্বের পরবর্তী সংস্করণ যে বিশ শতকের মহম্মদ আলী জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্ব সে, বিষয়েও কোন সন্দেহ নেই।

যাই হোক, এখানে মূল বক্তব্যটি হলো এই যে, বাঙলা ভাষায় উচ্চ ও মধ্যশ্রেণীর মুসলমানদের শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করে আবদুল লতিফ এবং তাঁর মতো অন্যান্য সমাজ নেতারা একদিকে যেমন মাতৃভাষার মাধ্যমে সংস্কৃতি-চর্চার উদ্যোগ ও প্রসারকে বিনষ্ট করেছিলেন, অন্যদিকে তেমনি শিক্ষিত মুসলমান অর্থাৎ প্রধানত মধ্যশ্রেণীর মুসলমানদের মধ্যে সৃষ্টি করেছিলেন একটা বিচ্ছিন্নতার মনোভাব। এই মনোভাবের জন্যে দেশের মাটি, তার ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতিকে তাঁরা নিজেদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি বলে মনে করতে পারেননি। এর মোটামুটি ফল দাঁড়িয়েছিলো এই যে, হিন্দু মধ্যশ্রেণী বৈষয়িক এবং শিক্ষা-সংস্কৃতিগত দিক দিয়ে ঊনিশ শতকে যতখানি উন্নতি করেছিলো ততখানি উন্নতি মুসলমান মধ্যশ্রেণীর দ্বারা সম্ভব হয়নি, তারা অনেকখানি পিছিয়ে পড়েছিলো এবং এই পিছিয়ে পড়াই অন্যতম প্রধান কারণ যার ফলে ঊনিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে শুরু করে বিশ শতক পর্যন্ত বাঙালী মুসলমানদের—শুধু বাঙালী মুসলমান নয়, সমগ্র বাঙালী এমন কি ভারতীয় জনগণকে অনেক সামাজিক, অর্থনৈতিক দুর্যোগের মধ্য দিয়ে পথ অতিক্রম করতে হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে অবশ্য উল্লেখ করা দরকার যে, স্যার সৈয়দ আহমদের নেতৃত্বে যুক্তপ্রদেশ অঞ্চলেও মুসলমান উর্দুর মাধ্যমেই শিক্ষা গ্রহণের নীতি ঊনিশ শতকের আলোচ্য সময়ে গ্রহণ করেন।[২৯] কিন্তু বাঙলাদেশের সাথে সেখানকার অবস্থার তফাৎ হলো এই যে, উর্দু ছিলো যুক্তপ্রদেশের মুসলমানদের মাতৃভাষা। এ জন্যে যুক্তপ্রদেশের জন্যে যে ভাষা ছিলো প্রগতির বাহন বাঙলাদেশের জন্যে তা ছিলো প্রতিক্রিয়ার আশ্রয়স্থল। মাতৃভাষা চর্চার ক্ষেত্রে যুক্তপ্রদেশ এবং বাঙলাদেশের মুসলমানদের দৃষ্টিভঙ্গীর এই পার্থক্য এই দুই এলাকার উচ্চ ও মধ্যশ্রেণীর মুসলমানদের আর্থিক জীবনের মধ্যেও সৃষ্টি করেছিলো অনেক পার্থক্য। সম্প্রদায় হিসেবে সেজন্যে যুক্তপ্রদেশের উচ্চ ও মধ্যশ্রেণীর মুসলমানরা নিজেদের এলাকায় ঐ একই শ্রেণীর বাঙালী মুসলমানদের থেকে আর্থিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের ক্ষেত্রে ছিলেন অনেক বেশী প্রভাবশালী

আর একটি বিষয়ও এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। উচ্চ ও মধ্যশ্রেণীর মুসলমানদের মধ্যে বাঙলা ভাষা সম্পর্কে উপরোক্ত মনোভাব বিরাজ করলেও নিম্নবিত্ত এবং নিম্ন- মধ্যশ্রেণীর মুসলমানরা বাঙলার প্রতি বীতশ্রদ্ধ তো ছিলেনই না, উপরন্তু বাঙলা ভাষা চর্চাকে তাঁরা নিজেদের শিক্ষা-দীক্ষা, ধর্মজীবন এবং ধর্মপ্রচারের ক্ষেত্রে অব্যাহত রেখেছিলেন। এ জন্যে দেখা যায় যে, এই শ্রেণীর মুসলমান ধর্মনেতারা গ্রামে গ্রামে বাঙলা ভাষায় শুধু যে ওয়াজ বা ধর্মশিক্ষা দান করেছেন তাই নয়, বাঙলা ভাষায় তাঁরা প্রচারপত্র এবং পুস্তক- পুস্তিকা ও রচনা প্রকাশ করেছেন। শুধু ধর্ম-সংক্রান্ত ব্যাপারেই নয়, অন্যান্য ব্যাপারে ও বাঙলা ভাষাকেই তাঁরা অবলম্বন করে থেকেছেন। এই কারণে বাঙলা ভাষার প্রশ্নে নবাব আবদুল লতিফ, সৈয়দ আমীর আলী প্রমুখ উচ্চশ্রেণীর মুসলমান সমাজের মুখপাত্রদের সঙ্গে তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গীর মৌলিক তফাৎ। এই তফাৎ ঊনিশ শতকের শেষ পর্যন্ত উচ্চ ও উচ্চ- মধ্যশ্রেণী এবং নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যশ্রেণীর মধ্যে বজায় ছিলো।[৩০]

দ্বিতীয়োক্ত শ্ৰেণীভুক্ত মুসলমানদের দ্বারা পরিচালিত সাময়িকপত্রসমূহে উর্দু-প্রীতিকে মোটেই সুনজরে দেখা হয়নি এবং এ বিষয়ে তৎকালীন পত্র পত্রিকায় লেখালেখিরও অন্ত ছিলো না।*

[*সুধাকর (১৮৮৯), ইসলাম প্রচারক (১৮৯১), মিহির (১৮৯২), হাজেফ (১৮৯২), কোহিনুর (১৮৯৮), প্রচারক (১৮৯৯) ইত্যাদি পত্রিকার নাম এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য।]

এ বিষয় কি ধরনের লেখা প্রকাশিত হতো তার একটি উদাহরণ দেওয়া দরকার নূর-অল- ইমান পত্রিকায় লেখা হয়—

আমাদের বঙ্গীয় মুসলমানের কোন ভাষা নাই। শরিফ সন্তানেরা এবং তাঁহাদের খেদমতকারগণ উর্দু বলেন, বাঙলা ভাষা ঘৃণা করেন; কিন্তু সেই উর্দু জবানে মনের ভাব প্রকাশ করা দূরে থাকুক, পশ্চিমা লোকের গিলিত চর্চিত শব্দগুলিও অনেকে যথাস্থানে শুদ্ধ আকারে যথার্থ অর্থে প্রয়োগ করিতেও অপারগ, অথচ বাঙ্গালায় মনের ভাব প্রকাশ করিবার সুবিধা হইলেও ঘৃণা করিয়া তাহা হইতে বিরত হন। বঙ্গের মোসলমান ভ্রাতা ভগিনিগণ! বাঙ্গালা ভাষাকে হিন্দুর ভাষা বলিয়া ঘৃণা না করিয়া আপনাদের অবস্থা ও সময়ের উপযোগী করিয়া লউন।[৩১]

এখানে দুটি জিনিস লক্ষণীয়। প্রথমতঃ, ভাষার প্রাঞ্জলতা এবং উৎকর্ষ। আরবী, ফারসী শব্দের কোন বাড়াবাড়ি এতে সেই। দ্বিতীয়তঃ, ভাষার প্রশ্নে অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গী। কিন্তু এই অসাম্প্রদায়িকতা শুধু ভাষার প্রশ্নেই ছিলো না। এই শ্রেণীভুক্ত মুসলমানেরা ধর্মপ্রবণ হওয়া সত্ত্বেও জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রেও তাঁরা সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে ছিলেন। শুধু তাই নয়, ঊনিশ শতকের শেষভাগে এঁরাই ছিলেন তিতুমীর, শরীয়তউল্লাহ, দুদু মিঞা প্রভৃতির নেতৃত্বে পরিচালিত ধর্মীয় ও কৃষক-আন্দোলনের উত্তরসূরী।

মুসলমান সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর বাঙলা ভাষা চর্চা বিষয়ক দৃষ্টিভঙ্গী সম্পর্কে এই আলোচনা থেকে দেখা যাচ্ছে যে, এই একটি মাত্র ক্ষেত্রে হিন্দু উচ্চ ও মধ্যশ্রেণীর সঙ্গে মুসলমান নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যশ্রেণীর একটা ঐক্য ঊনিশ শতকের শেষ দিকেও ছিলো। রক্ষণশীল উচ্চ ও মধ্যশ্রেণীর মুসলমানদের উর্দু-চর্চা ও বাঙলা বিরোধিতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে নিম্ন ও নিম্ন- মধ্যশ্রেণীর মুসলমানরা যেমন মাতৃভাষা বাঙলা-চর্চার স্বপক্ষে ছিলেন, তেমনি হিন্দু উচ্চ ও মধ্যশ্রেণীর মুখপাত্রেরাও তার স্বপক্ষে ছিলেন। এদিক দিয়ে দুই সম্প্রদায়ভুক্ত এই শ্রেণীসমূহের ভূমিকা মোটামুটিভাবে প্রগতিশীলই ছিলো। এ জন্যে বিদ্যাসাগর-প্রবর্তিত গদ্যরীতি সম্পর্কে উচ্চ ও মধ্যশ্রেণীভুক্ত মুসলমানরা অজ্ঞ থাকলেও* অন্য-শ্রেণীভুক্ত মুসলমানরা তার দ্বারা উপকৃত ও প্রভাবিত হয়েছিলেন এবং তাঁদের ভাষায় সামান্য কিছু অতিরিক্ত আরবী, ফারসী শব্দের ব্যবহার হলেও তাঁরা ‘মুসলমানী বাঙলা’ নামে কোন উদ্ভট ভাষা সৃষ্টির প্রতি কোনো দৃষ্টি দেননি।

[*মীর মশাররফ হোসেন এবং তসলিমউদ্দীন আহমদের মতো দুচারজন এ দিক দিয়ে উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম ছিলেন।]

কিন্তু উপরোক্ত সাময়িকপত্রগুলিতে বাঙলা চর্চা সম্পর্কে যে মত প্রকাশ করা হয়েছিলো, উনিশ শতকের মুসলমান সমাজের শিক্ষা ও সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রে তার প্রভাব তেমন ফলপ্ৰসু হয়নি। কারণ তদানীন্তন সরকারী নীতি-নির্ধারণ ও সেই নীতিকে কার্যকর করার ক্ষেত্রে নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যশ্রেণীর কোন ভূমিকা ছিলো না। সে ক্ষেত্রে সরকারের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের জন্যে উচ্চ ও মধ্যশ্রেণীভুক্ত সমাজ নেতাদের প্রভাবই ছিলো গুরুত্বপূর্ণ। এ জন্যে বিদ্যাসাগরের প্রচেষ্টায় হিন্দু সমাজের ক্ষেত্রে মাতৃভাষা বাঙলার চর্চা যতখানি ব্যাপক হয়েছিলো এবং বাঙলা ভাষা তাদের সাংস্কৃতিক জীবন উন্নত করার ক্ষেত্রে যতখানি সহায়ক হয়েছিলো, মুসলমান সমাজের ক্ষেত্রে সাধারণভাবে সেটা হয়নি।

১২

হিন্দু সমাজের ক্ষেত্রে মাতৃভাষার চর্চা অপেক্ষাকৃত ব্যাপক হওয়ার অর্থ অবশ্য এই নয় যে, হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত সাধারণ ও নিম্নশ্রেণীভুক্ত জনগণের মধ্যে শিক্ষা ও মাতৃভাষার চর্চা ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত হয়েছিলো। তা মোটেই হয়নি, এবং তা হওয়া সেকালে সম্ভব ছিলো না। এ ক্ষেত্রেও বিদ্যাসাগরের ভূমিকা উল্লেখ ও আলোচনার যোগ্য।

১৮৫৫ সালে বাঙলার ছোটলাট হ্যালিডে বাঙলা শিক্ষাকে গ্রামাঞ্চলে সম্প্রসারণের উদ্দেশ্যে একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। এই পরিকল্পনা প্রণয়নের ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগরের ব্যক্তিগত পরামর্শ অনেকাংশে কার্যকরী হয় এবং সেই অনুযায়ী হ্যালিডে সাহেবও নোতুন মডেল স্কুলগুলি পরিচালনা, নিয়ন্ত্রণ ও পরিদর্শনের দায়িত্ব বিদ্যাসাগরের ওপর অর্পণ করেন। এরপর ১৮৫৬ সালে দক্ষিণ বাঙলায় বিদ্যালয়ের স্পেশাল ইন্সপেক্টর ঈশ্বরচন্দ্র তাঁর এলাকাভুক্ত প্রত্যেকটি জেলায় পাঁচটি করে মডেল স্কুল স্থাপন করেন। এই স্কুলগুলির গৃহ গ্রামবাসীরা নিজেরাই নির্মাণ করেন এবং তার ব্যয়ভারও নিজেরাই বহন করেন। প্রথম ছয় মাস পরে ক্ষেত্রবিশেষ বেতন নেওয়া হতো।[৩২]

বাঙলা শিক্ষার ক্ষেত্রে এই কাজ শুরু হওয়ার তিন বৎসর পর বিদ্যাসাগর নিজে স্কুলগুলি সম্পর্কে একটি রিপোর্টে বলেন:[৩৩]

বাঙলাদেশের মডেল স্কুলগুলি প্রায় তিন বছর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই অল্প সময়ের মধ্যে স্কুলের বেশ আশাপ্রদ উন্নতি হয়েছে। ছাত্ররা সব বাঙলা পাঠ্যপুস্তক পাঠ করেছে। বাঙলা ভাষায় তাদের বেশ দখল আছে দেখেছি। প্রয়োজনীয় অনেক বিষয়ে তারা বেশ জ্ঞানলাভ করেছে। যখন এই কাজ আরম্ভ করা হয় তখন অনেকে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন যে, গ্রামের লোকেরা মডেল স্কুলের মর্ম বুঝতে পারবে না। কিন্তু স্কুলের সাফল্য সেই সন্দেহ দূর করেছে। যেসব গ্রামে স্কুল প্রণীত হয়েই সেই সব গ্রামের ও তার আশপাশের গ্রামবাসীরা স্কুলগুলিকে আশীর্বাদ বলে মনে করে এবং তার জন্য তারা সরকারের কাছে কৃতজ্ঞ। স্কুলগুলির যে যথেষ্ট সমাদর হয়েছে, ছাত্রসংখ্যা দেখলে তা পরিষ্কার বোঝা যায়।

এই সমস্ত মডেল স্কুল প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগরের উদ্দেশ্য সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বিনয় ঘোষ বলেছেন, ‘প্রকৃত জনশিক্ষার প্রসারের উদ্দেশ্যে অনুপ্রাণিত হয়ে যে তিনি এই মডেল স্কুল প্রতিষ্ঠার কাজে ব্রতী হয়েছিলেন তা মনে হয় না।’[৩৪]

বিনয় ঘোষের এই মন্তব্য যে তথ্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত সে তথ্য বিদ্যাসাগরের সামগ্রিক মূল্যায়নের ক্ষেত্রে অতিশয় তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ এই তথ্য সস্পষ্টভাবে বিদ্যাসাগরের শিক্ষানীতির শ্রেণীচরিত্র নির্দিষ্ট করে। এই তথ্য আর কিছুই নয়, বাঙলার ছোটলাট গ্রান্টের কাছে শিক্ষাবিষয়ক তাঁর একটি পরামর্শমূলক পত্ৰ:[৩৫]

An impression appears to have gained ground, both here, and in England, that enough has been done for the education of the higher classes and that attention should now be directed towards the education of the masses. An enquiry into the matter will however show a very different state of things. As the best, if not the only practicable means of promoting education in Bengal, the Government should, in my humble opinion, confine itself to the education of the higher classes on a comprehensive scale.

বিদ্যাসাগরের এই পত্রের যুক্তিযুক্ততা সম্পর্কে বিনয় ঘোষ বলেছেন যে, সেকালে অর্থাৎ ইংরেজ শাসনের আমলে এবং ঊনিশ শতকের ঐ পর্যায়ে ব্যাপক জনশিক্ষার কথা বলা ‘বুজরুকী’ ব্যতীত কিছু হয়তো না। কাজেই বিদ্যাসাগর সেদিকে না গিয়ে তৎকালীন অবস্থায় যা সম্ভব সে কথাই বলেছিলেন, সরকারকে সেই বাস্তব পরামর্শই নিবেদন করেছিলেন। এই নিবেদন কিছুটা ‘বেসুরে ঝংকৃত’ হয়েছিলো তার উল্লেখও অবশ্য বিনয় ঘোষ করেছেন এবং বলেছেন যে, বিদ্যাসাগর অন্তত শিক্ষার ক্ষেত্রে নিজের চিন্তাকে যে স্বদেশীর সীমানার বাইরে বেশীদূর পর্যন্ত প্রসারিত করতে পারেননি তা তাঁর এই শিক্ষানীতির ব্যাখ্যা থেকে বোঝা যায়।’[৩৬]

কিন্তু বিদ্যাসাগরের উপরোক্ত পত্র সম্পর্কে শুধু এটুকু বললে বিদ্যাসাগরের মূল্যায়ন এবং তাঁর শ্রেণীচরিত্র নির্ধারণের ক্ষেত্রে কিছু ত্রুটি থেকে যায়। কারণ, শিক্ষাক্ষেত্রে তাঁর এই পরামর্শের দ্বারা তিনি যে শুধু তাঁর ‘স্বশ্রেণীর সীমানার বাইরে’ যেতে অক্ষম হয়েছিলেন তাই নয়, এই পত্রে বিদ্যাসাগর তাঁর নিজের শ্রেণীর প্রতিনিধি হিসেবেই সরকারকে তাঁর শিক্ষা- বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিয়েছিলেন।

মডেল স্কুলের সাফল্য সম্পর্কে বিদ্যাসাগরের নিজের রিপোর্ট থেকেই বোঝা যায়, সেকালেও বাঙলাদেশে জনশিক্ষা প্রসারের উদ্যোগ একেবারে ব্যর্থ হওয়ার হতো কোন ব্যাপার ছিলো না। সেই উদ্যোগের দ্বারা শতকরা একশো জনের অক্ষর পরিচয় অথবা শিক্ষা না হলেও জনশিক্ষা যে তার দ্বারা অপেক্ষাকৃত সম্প্রসারিত হতো সে বিষয়ে কোন সন্দেহ ছিলো না। কিন্তু ইংরেজ সরকার যে অর্থ শিক্ষা খাতে তখন ব্যয় করতে প্রস্তুত ছিলো সে অর্থকে নিম্নশ্রেণীভুক্ত জনগণের শিক্ষার ব্যাপারে ব্যয় করতে দেওয়ার বিরুদ্ধে ছিলেন এবং সুস্পষ্টভাবেই সেই বিরোধিতা করেছিলেন। সেই বিরোধিতার মাধ্যমে তাঁর বাস্তবজ্ঞান অপেক্ষা তাঁর নিজস্ব শ্রেণী-চেতনাই যে অধিকতর প্রকটিত হয়েছিলো সে বিষয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।

ঊনিশ শতকের বাঙলাদেশ জনশিক্ষা সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে উচ্চ মধ্যশ্রেণীর শিক্ষাবিদ, ধর্মনেতা ও সমাজনেতাদের ভূমিকা সম্পর্কে সৈয়দ শাহেদুল্লাহ্ যে মন্তব্য করেছেন তা খুব প্রাসঙ্গিক,

প্রাশিয়ায় প্রোটেস্ট্যন্ট রিফর্মেশনের যুগে সোজাসুজি প্রতিক্রিয়া হয়েছিল, সাধারণ নাগরিক প্রজাকে পড়াতে হবে। কথা হলো, এদের আত্মাকে রক্ষা করতে হবে শয়তানের কাছ থেকে –আসলে প্রতিদ্বন্দ্বী অধিকার প্রয়াসী ক্যাথলিক গীর্জার সমর্থক হ্যাপ্‌সবুর্গ সম্রাটের কাছ থেকে।

…আর তা’ছাড়া মার্কস যেমন বলেছেন, লুথার ক্যাথলিক গীর্জার ভক্তিভাবজনিত দাস্যভাবের স্থানে বিশ্বাসের বন্ধনে শৃঙ্খলিত দাস্যভাবকে অধিষ্ঠিত করলেন। প্রাশিয়ার শাসকগোষ্ঠীর এই শিক্ষা-লালিত দাস্যভাবের প্রয়োজন ছিল। অষ্টাদশ শতাব্দীতে প্রচেষ্টা শুরু হয়ে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভেই সেখানে বাধ্যতামূলক সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা প্রবর্তিত হলো। তুলনায় এখানকার ‘নবজাগরণে’ অবশ্য মাতৃভাষার উপর সমভাবে জোর এসেছিল। কিন্তু সর্বসাধারণের প্রাথমিক শিক্ষার কথা কেউ ভাবতে পারেননি। ধর্মপ্রচারই বা কতদূর স্তরান্তরগামী ছিল? রামমোহন এমন কি মহর্ষিও তাঁদের পাল্কী বেহারাকে ব্রাহ্ম ‘সমাজে’ নেবার বা ব্রাহ্ম করার কথা ভাবতেন কি? সুতরাং তাদের ছেলেদের লেখাপড়া শেখানোর কথা ভাবার প্রশ্নই ওঠে না।[৩৭]

শিক্ষানীতির ক্ষেত্রে উচ্চশিক্ষা ও প্রাথমিক শিক্ষার মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব ঊনিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে শুরু হয়েছিলো। ইংরেজরা একদিকে উচ্চশিক্ষা অর্থাৎ জ্ঞানবিজ্ঞানের যথার্থ চর্চাকে যেমন ভয় করতো, সেটা চাইতো না, অন্যদিকে তেমনি তারা নিজেদের দেশে কাঁচামাল রপ্তানি বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর ক্ষেত্রে কৃষকদের মধ্যে কিছুটা প্রাথমিক শিক্ষা প্রসারের প্রয়োজনীয়তাও বোধ করতো। এই প্রয়োজন মেটানোর জন্যে তারা জমিদারের ওপর রেট অর্থাৎ শিক্ষা-ট্যাক্স বসানোর একটা পরিকল্পনাও করেছিলেন। কিন্তু তাদের সেই পরিকল্পনা জমিদারদের প্রবল বিরোধিতায় শেষ পর্যন্ত কার্যকর হয়নি।

ভূস্বামী শ্রেণীর কোন কোন মুখপাত্র অবশ্য কৃষির উন্নতির জন্যে কৃষি পদ্ধতির পরিবর্তন এবং তার জন্যে শিক্ষার প্রসার যে প্রয়োজন তা অস্বীকার করতেন না। কিন্তু সে সমস্যা সমধোনের জন্যে তাঁরা কি ধরনের পথনির্দেশ করতেন সেটা ঊনিশ শতকের শেষ পাদে ‘সংবাদ প্রভাকর’-এর নিম্নোক্ত সম্পাদকীয় বক্তব্য থেকে পরিষ্কার বোঝা যাবে:

কৃষিকার্যের প্রতি আমরা নিজেরা যেমন দৃষ্টিশূন্য গভর্ণমেন্টও সেইমত দৃষ্টিশূন্য। কৃষিকার্যের ভার বহুদিন হইতে মুর্খ, অজ্ঞ এবং দীন চাষাদিগের হস্তে রহিয়াছে। সুতরাং ইহার ক্রমিক কোনও উন্নতিই হইতেছে না। চাষারা জ্ঞানাভাবে, শিক্ষাভাবে এবং অর্থাভাবে কৃষিকার্যের কোনও উন্নতিই করিতে পারিতেছে না। তাহারা সেই মান্ধাতার আমলের অস্ত্র লইয়া সেই একভাবে কৃষিকার্য করিয়া আসিতেছে। কিন্তু কৃতবিদ্য সমাজ যতদিন না এই কৃষিকার্যে হস্তক্ষেপ করিবেন ততদিন এ বিভাগের এইরূপ অবস্থাই থাকিবে। বর্তমান কৃষকদিগের দ্বারা কৃষিকার্যের উন্নতি কোনক্রমে সম্ভব না। আমাদিগের মতে কৃষিকার্যে বৈজ্ঞানিক শিক্ষাপ্রাপ্ত ভদ্র সন্তানেরা যখন বর্তমানের কৃষককুলকে নিজ নিজ অধীনে নিযুক্ত করিয়া বাহুল্যরূপে কৃষিকার্য আরম্ভ করিবেন, তখন একদফা দেশের অনেক কৃতবিদ্যের অর্থোপার্জনের উপায় হইবে, এবং দেশের ধনবৃদ্ধিসহ বর্তমান কৃষকদিগের দুরবস্থা দূর এবং কৃষি বিভাগের ক্রমোন্নতি হইতে থাকিবে।[৩৮]

এ ক্ষেত্রে দুটি জিনিস লক্ষণীয়। প্রথমতঃ, কৃষি-ব্যবস্থার ক্রমাবনতির জন্যে সংবাদ প্রভাকর জমিদারের লুণ্ঠন ব্যবস্থার প্রতি দৃষ্টিহীনতা, উৎপাদন বৃদ্ধির পরিবর্তে জোর জুলুমের দ্বারা নিজেদের আয়বৃদ্ধি ইত্যাদির কথা এখানে না বলে কৃষকদের মূর্খতা এবং জ্ঞানের অভাবকেই কৃষিব্যবস্থার চরম অবনতির কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। দ্বিতীয়তঃ, কৃষকদের প্রাথমিক শিক্ষার পরিবর্তে এখানে জোর দেওয়া হচ্ছে কৃতবিদ্যা জমিদার শ্রেণীভুক্ত ব্যক্তিদের কৃষিশিক্ষার ওপর।[৩৯] শুধুমাত্র কৃতবিদ্যদের কৃষিশিক্ষার দ্বারা যে তৎকালে কৃষি-উৎপাদন বৃদ্ধির কোন সম্ভাবনা ছিলো না সে কথা বলাই বাহুল্য।

কৃষিশিক্ষা, প্রাথমিক শিক্ষা ইত্যাদি জনগণকে শিক্ষা দেওয়ার যে কোন নীতি অথবা প্রস্তাবই ঊনিশ শতকে উচ্চ ও মধ্যশ্রেণীর দ্বারা প্রবলভাবে বাধাপ্রাপ্ত হতো এবং ইংরেজ সরকারেরও সে ব্যাপারে কোন উৎসাহ না থাকায় সে ক্ষেত্রে কোন অগ্রগতিও সাধিত হতো না।

ভূস্বামী শ্রেণী ছিলো প্রাথমিক শিক্ষার ঘোরতর বিরোধী। কৃষকদের সর্বাংশে শোষণ করেই তারা নিজেদের আয় ও সম্পদ বৃদ্ধি করতো। সেজন্যে ইংরেজ সরকারের প্রাথমিক শিক্ষা বিস্তারের সামান্যতম উদ্যোগকেও বানচাল করার জন্যে তারা সর্বশক্তি নিয়োগ করতো। গ্রান্ট সাহেবের কাছে লিখিত পত্রে নিম্ন শ্রেণীসমূহের প্রাথমিক শিক্ষার পরিবর্তে উচ্চ শ্রেণীসমূহের (মধ্যশ্রেণীও যার অন্তর্ভুক্ত ছিলো) শিক্ষার জন্য সমস্ত অর্থ ব্যয় করার প্রস্তাব দিয়ে বিদ্যাসাগর শিক্ষানীতির ক্ষেত্রে এই জমিদার শ্রেণীর পাল্লাই ভারী করেছিলেন। নিম্নশ্রেণীসমূহের শিক্ষার ব্যাপারে তাঁর নীতিগত কোন আপত্তি ছিলো না, কারণ গ্রান্টের কাছে প্রেরিত উপরোক্ত[৪০] পত্রে তিনি বলেছিলেন,

To educate a whole people is certainly very desirable but this is a task which, it is doubtful whether any government can undertake or fulfill.

প্রাথমিক শিক্ষা বিস্তারকে বিদ্যাসাগর নীতিগত দিক থেকে বাঞ্ছনীয় মনে করলেও তার জন্যে তাঁর বিন্দুমাত্র উৎসাহ ছিলো না। তাহলে তিনি সরকার কর্তৃক প্রাথমিক শিক্ষার জন্যে জমিদারদের ওপর রেট ধার্যের প্রস্তাব অন্তত সমর্থন করতে পারতেন।* তাতে whole people বা সমগ্র জনগণের শিক্ষা না হলেও জনগণের নিম্নশ্রেণীভুক্ত একটা অংশের শিক্ষা নিশ্চয়ই কিয়দাংশে সম্প্রসারিত হতো।

[*উক্ত ডিসপ্যাচে [১৮৫৯ সালে সেক্রেটারী অব স্টেটের ডিসপ্যাঁচ—ব. উ.] সেক্রেটারী অব স্টেট প্রস্তাব করলেন, শিক্ষার জন্যে একটা ‘রেট” অর্থাৎ পৃথক শিক্ষাকর বসাতে হবে। “এরই ফলস্বরূপ ১৮৬১-৭১ এর মধ্যে বাঙলা প্রদেশ ছাড়া সমস্ত প্রদেশে শিক্ষাকর প্রযুক্ত হলো (ভগবান দয়াল : Development of Modern Indian Education পৃষ্ঠা, ১০০)। বাঙলাদেশের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রতিবন্ধক হলো”। “বাঙলা গভর্নমেণ্ট ভারত গভর্নমেন্টের সঙ্গে একমত না হয়ে এই মত গ্রহণ করলেন যে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত শিক্ষাকর প্রয়োগ অসম্ভব করছে।” (ব্লিচ রিপোর্ট, ৩১ নং অনুচ্ছেদ)। “কেন? জমিদারের প্রচুর পরিমাণ মুনাফার উপর ট্যাক্স করলে কি হতো? ইংরেজ তাদের পোষ্যদের উপর কর প্রয়োগ করতে অক্ষম। দেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে ইংরাজ ও জমিদারদের যোগসাজশের বহু নিদর্শনের মধ্যে এও একটি। জমিদার ইংরাজ যোগসাজশ এইভাবে প্রাথমিক শিক্ষার দিকে পদক্ষেপ রুখে দিলো। ষাট-সত্তর বছরের মধ্যে কোন অগ্রগতি হলো না। ১৮৫৯-৬০ সালে জমিদারগণ যখন এইভাবে তাঁদের কার্য সিদ্ধ করলেন তখনো বাঙলাদেশের নবজাগরণে প্রাতঃস্মরণীয় অনেক মনীষী বেঁচে ছিলেন, কেউ প্রতিবাদ করলেন না। বাঙলাদেশের গাছের পাতাটি পর্যন্ত নড়লো না। জমিদারদের প্রভাব মধ্যবিত্তকেও কীরূপ আচ্ছন্ন করে রেখেছিলো তা এতেই বোঝা যায়।”—সৈয়দ শাহেদুল্লাহ্ : শিক্ষা ও শ্রেণী সম্পর্ক, পৃ.২২ এবং ২৪।]

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মূল্যায়নে তাঁর এই ধরনের মতামত ও কার্যকলাপকে উপেক্ষা করা চলে না। এ সব বিষয়ে তাঁর সুনির্দিষ্ট কতকগুলি মতামতের সঙ্গে তাঁরা কতকগুলি ব্যক্তিগত কার্যকলাপকে জড়িয়ে ফেলে অনেকেই বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন।

বিদ্যাসাগর স্বভাবতঃ অত্যন্ত উদারচেতা ও হৃদয়বান মানুষ ছিলেন। এ রকম অনেক উদাহরণ হয়তো পাওয়া যাবে যেখানে তিনি কোন নিম্ন শ্রেণীভুক্ত ছাত্রের বা বিশেষ কোন এক এলাকার কিছু সংখ্যক দরিদ্র মানুষের শিক্ষার জন্যে ব্যক্তিগতভাবে অকাতরে অর্থ ব্যয় করেছেন। কিন্তু সেই ধরনের ব্যক্তিগত উদ্যোগ এবং অর্থব্যয়ের দ্বারা কেউ যদি মনে করেন যে, বিদ্যাসাগর জনশিক্ষা অথবা দরিদ্র ও নিম্নশ্রেণীর জনগণের শিক্ষা-বিকাশের ক্ষেত্রে প্রকৃত অর্থে উদ্যোগী ছিলেন, তাহলে ভুল হবে। সে উদ্যোগ তাঁর ছিলো না। কেন ছিলো না সে সম্পর্কে তিনি যা বলেছেন এবং যেভাবে বলেছেন তার মধ্যেই তাঁর শ্রেণী-আনুগত্যের এবং শ্রেণী-চেতনার যে সুস্পষ্ট পরিচয় পাওয়া যায় তাকে অস্বীকার করতে চেষ্টা করা তাত্ত্বিক বিড়ম্বনা সৃষ্টিরই নামান্তর মাত্র।

১৩

শিক্ষাক্ষেত্রে অনেক সামন্তবাদী ধ্যান-ধারণার ও ব্যবহারের (Practice) যথাসাধ্য বিরোধিতা এবং শিক্ষা-সংস্কার ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও প্রগতিশীল কীর্তি। এ বিষয়ে সংস্কৃত কলেজের পাঠ্য-তালিকার পরিবর্তন সম্পর্কে তাঁর প্রচেষ্টার উল্লেখ সর্বপ্রথম প্রয়োজন।

Notes on the Sanskrit College, এই শিরোনামে ১৮৫২ সালের ১২ এপ্রিল বিদ্যাসাগর সাধারণভাবে বাঙালী উচ্চ ও মধ্যশ্রেণীর এবং বিশেষভাবে সংস্কৃত কলেজের শিক্ষা-ব্যবস্থার সংস্কার বিষয়ে ২৬ প্যারা সম্বলিত একটি খসড়া প্রণয়ন করেন।[৪১] এই খসড়ার মধ্যেই তাঁর শিক্ষা-চিন্তার মূল রূপটি দেখা যায় এবং এই চিন্তাকেই কার্যকর করার জন্যে তিনি যথাসাধ্য চেষ্টা করেন। ২৬ প্যারার মধ্যে নীচে উদ্ধৃত কয়েকটি বর্তমান আলোচনায় প্রাসঙ্গিক-

১. বাংলাদেশে শিক্ষার তত্ত্বাবধানের ভার যাঁরা নিয়েছেন তাঁদের প্রথম লক্ষ্য হওয়া উচিত, সমৃদ্ধ ও উন্নত বাংলা সাহিত্য সৃষ্টি করা।

২. যাঁরা ইউরোপীয় আকর থেকে জ্ঞান-বিদ্যার উপকরণ আহরণ করতে সক্ষম নন, এবং সেগুলিকে ভাবগম্ভীর, প্রাঞ্জল বাংলা ভাষায় প্রকাশ করতে অক্ষম, তাঁরা এই সাহিত্য সৃষ্টি করতে পারবেন না।

৩. যাঁরা সংস্কৃত ভাষায় পারদর্শী নন, তাঁরা সুসংবদ্ধ প্রাঞ্জল বাংলা ভাষায় রচনা সৃষ্টি করতে পারবেন না। সেই জন্য সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতদের ইংরেজী ভাষা ও সাহিত্যে সুশিক্ষার প্রয়োজন।

৪ . অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে, যাঁরা কেবল ইংরেজী বিদ্যায় পারদর্শী, তাঁরা এত বেশী ইংরেজী-ভাবাপন্ন যে তাঁদের যদি অবসর সময়ে খানিকটা সংস্কৃত শিক্ষা দেওয়া যায়, তা হলেও তাঁরা শত চেষ্টা করেও, পরিমার্জিত দেশী বাংলা ভাষায় কোনও ভাবই প্রকাশ করতে পারবেন না।

৫. তা হলে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে যে, সংস্কৃত কলেজের ছাত্রদের যদি ইংরেজী সাহিত্যে ভালোভাবে শিক্ষা দেওয়া যায়, তাহলে তারাই একমাত্র সুসমৃদ্ধ সাহিত্যে সুদক্ষ ও শক্তিশালী রচয়িতা হতে পারবে।

৯. ব্যাকরণ, সাহিত্য ও অলংকারশাস্ত্র পাঠ করলে ছাত্রদের সংস্কৃতবিদ্যার ভিত দৃঢ় হবে।

১০. স্মৃতিশাস্ত্রে এইগুলি পাঠ্য হতে পারে : মনুস্মৃতি, মিতাক্ষরাদায়ভাগ, দত্তক মীমাংসা ও দত্তকচন্দ্রিকা। এই শাস্ত্রগুলি পাঠ করলে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের ব্যবস্থাদি সম্বন্ধে ছাত্রদের জ্ঞান সম্পূর্ণ হবে।

১১. বর্তমান গণিত শাস্ত্রের পাঠ্য হলো লীলাবতী ও বীজগণিত। গণিতবিজ্ঞানের পক্ষে এই দু’খানি বই যথেষ্ট নয়। তা ছাড়া এমন এক পদ্ধতিতে বই দুখানি রচিত, প্রচলিত ছড়া আর্যা ইত্যাদির সাহায্যে, যে আসল বিষয়বস্তু এক একটি প্রহেলিকা হয়ে উঠেছে।

১২. সেইজন্য সংস্কৃতে গণিতশিক্ষা না দেওয়াই বাঞ্ছনীয়।

১৩. এ থেকে এ কথা বুঝলে ভুল হবে যে, আমি শিক্ষার ব্যাপারে গণিতবিদ্যার যথাযথ গুরুত্ব দিই না, তা আদৌ ঠিক নয়। আমি শুধু বলতে চাই যে, সংস্কৃতের বদলে ইংরেজীর মাধ্যমে গণিতবিদ্যার শিক্ষা দেওয়া উচিত, কারণ তাতে ছাত্ররা অর্ধেক সময়ে দ্বিগুণ শিখতে পারবে।

১৪. হিন্দু দর্শনের ছয়টি উল্লেখযোগ্য সম্প্রদায় আছে- ন্যায়, বৈশেষিক, সাংখ্য, পাতঞ্জল, বেদান্ত ও মীমাংসা। ন্যায় দর্শনে প্রধানত তর্কবিদ্যা, আধ্যাত্মবিদ্যা এবং মধ্যে মধ্যে কিঞ্চিৎ রসায়ন আলোকবিদ্যা ও বলবিদ্যা সম্বন্ধে আলোচনা আছে। পাতঞ্জল ও মীমাংসা সম্বন্ধেও প্রায় ঐ একই কথা বলা যায়। মীমাংসায় উৎসব পার্বণের এবং পাতঞ্জলে ঈশ্বরচিন্তা হলো বিষয়বস্তু।

১৫. কলেজ-পাঠ্য হিসেবে এইসব বিষয় প্রয়োজনীয় কি-না, সে সম্বন্ধে ১৬ ডিসেম্বর, ১৮৫০, আমি আমার রিপোর্টে যে মত ব্যক্ত করেছি আজও তা সমর্থন করি।’*

[*১৬ ডিসেম্বর ১৮৫০-এর এই উল্লিখিত রিপোর্টের পুরো বিবরণ আমি গোপাল হালদার সম্পাদিত ‘বিদ্যাসাগর রচনা সংগ্রহ’ অথবা বিনয় ঘোষ রচিত ‘বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ’-এ পাইনি। তবে এ বিষয়ে বিদ্যাসাগর ১২ এপ্রিল ১৮৫১ সালের এই শিক্ষা প্রস্তাবের ১৬ প্যারায় যা বলেছেন এবং ব্যালেন্টাইনের চিঠির জবাবে যা বলেছেন তা থেকে স্পষ্টই মনে হয়, এই সমস্ত দৰ্শন সংস্কৃত কলেজের পাঠ্যতালিকা থেকে হয়তো বাদ দেওয়ার পরামর্শ না দিলেও অন্তত পাশ্চাত্য দর্শন পাঠের পূর্বে তার পাঠ তিনি খুব সম্ভবত অনুমোদন করেননি।]

১৬. এ কথা ঠিক যে হিন্দু দর্শনের অনেক মতামত আধুনিক যুগের প্রগতিশীল ভাবধারার সঙ্গে খাপ খায় না, কিন্তু তা হলেও প্রত্যেক সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতের এই দর্শন সম্বন্ধে জ্ঞান থাকা উচিত। ছাত্ররা যখন দর্শন শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হবে, তার আগে ইংরাজী ভাষায় তারা যে জ্ঞান অর্জন করবে তাতে ইউরোপের আধুনিক দর্শনবিদ্যা পাঠ করারও সুবিধা হবে তাদের। ভারতীয় ও পাশ্চাত্য দুই দর্শনেই সম্যক জ্ঞান থাকলে এদেশের পণ্ডিতদের পক্ষে আমাদের দর্শনের ভ্রান্তি ও অসারতা কোথায় তা বোঝা সহজ হবে। সমস্ত রকম মতামতের দর্শন ছাত্রদের পড়তে বলার উদ্দেশ্য হলো, সেগুলি পড়লে তারা দেখতে পাবে কিভাবে এক সম্প্রদায় অন্য সম্প্রদায়ের মত খণ্ডন করেছে এবং এক দর্শনের পণ্ডিত ভিন্ন দর্শনের ভুলভ্রান্তি দেখিয়েছেন এবং প্রতিপাদ্যের যৌক্তিকতা খণ্ডন করেছেন। সুতরাং আমার ধারণা সর্ব মতের দর্শন পাঠ করবার সুযোগ দিলে ছাত্রদের নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গী ও মতামত গড়ে উঠবে। তার সঙ্গে পাশ্চাত্য দর্শন সম্বন্ধে জ্ঞান থাকলে, দুই দর্শনের মধ্যে সাদৃশ্য ও পার্থক্য কোথায় তাও তারা বুঝতে পারবে।

১৭. এই শিক্ষার আর একটি সুবিধা হলো এই যে, পাশ্চাত্য দর্শনের ভাবধারা আমাদের বাংলা ভাষায় প্রকাশ করতে হলে যে বৈজ্ঞানিক পরিভাষা (Technical Word) জানা দরকার, তা পণ্ডিতদের আয়ত্তে থাকবে।

১৮. এ সব বিষয়ে প্রগাঢ় পাণ্ডিত্য থাকার প্রয়োজন নেই। ছাত্ররা যদি এইগুলি পড়ে তাহলেই যথেষ্ট হবে : ন্যায় দর্শন-গৌতম সূত্র ও কুসুমাঞ্জলী; বৈশেষিক দর্শন-কণাদের সূত্র; সাংখ্য দর্শন-কপিলের সূত্র এবং কৌমুদী; পতঞ্জল দর্শন-পতঞ্জলের সূত্র; বেদান্ত দর্শন-বেদান্তসার এবং ব্যাসের সূত্র, প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ; মীমাংসা দর্শন— জৈমিনীর সূত্র। এগুলি ছাড়া ছাত্ররা ‘সর্বদর্শন-সংগ্রহ’ পড়বে, কারণ তার মধ্যে সমস্ত দর্শনের সারকথা পাওয়া যাবে।

১৯. সংস্কৃত কলেজের ছাত্রদের ব্যাকরণ ও সাহিত্য শ্রেণীতে পড়বার সময় তিনভাগের দুইভাগ সময় সংস্কৃতের জন্য এবং একভাগ সময় ইংরেজীর জন্য দেওয়া উচিত। অলংকার, স্মৃতি ও দর্শন শ্রেণীতে পড়ার সময় তাদের প্রধান মনোযোগের বিষয় হবে ইংরেজী। অর্থাৎ তিনভাগের দুইভাগ সময় ইংরেজী বিদ্যার জন্য নিয়োগ করা উচিত।

পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের শ্রেণীগত নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এই শিক্ষা-সংস্কার প্রস্তাব ও প্রচেষ্টার মধ্যেই একদিকে তাঁর যথার্থ প্রগতিশীলতা এবং অন্যদিকে তাঁর শ্রেষ্ঠতম কীর্তির পরিচয় পাওয়া যায়। বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যের উন্নতির ক্ষেত্রে তাঁর উদ্যোগ ও প্রচেষ্টাও এই কীর্তিরই অন্তর্গত।

উপরোল্লিখিত প্রস্তাবের প্রথম প্যারাতেই বিদ্যাসাগর বলেছেন যে, যাঁরা শিক্ষার তত্ত্বাবধানের ভার নিয়েছেন তাঁদের প্রথম লক্ষ্য হওয়া উচিত সমৃদ্ধ এবং উন্নত বাঙলা সাহিত্য সৃষ্টি করা। বিদ্যাসাগর শিক্ষাক্ষেত্রে নিজের দৃষ্টিকে এই লক্ষ্যের প্রতিই একনিষ্ঠভাবে নিবদ্ধ রেখেছিলেন। তাঁর দ্বিতীয় লক্ষ্য ছিলো, কুসংস্করাচ্ছন্ন দেশীয় শিক্ষা, যাকে রবীন্দ্রনাথ, গ্রাম্য পাণ্ডিত্য এবং গ্রাম্য বর্বরতা’ বলে অভিহিত করেছিলেন তার হাত থেকে এদেশের শিক্ষার্থীদের উদ্ধার করে তাদের চিত্তকে প্রকৃত জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলোকে উদ্ভাসিত করা। এই দুই প্রধান লক্ষ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে একদিকে তিনি বাংলা ও ইংরেজী উভয় ভাষাতেই শিক্ষার্থীদের দক্ষতা অর্জনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন এবং অন্যদিকে, তিনি গুরুত্ব আরোপ করেন প্রাচীন ভারতীয় কাব্যসাহিত্য অলংকার, ন্যায়, দর্শন ও ইউরোপীয় দর্শন, গণিত, বিজ্ঞান ইত্যাদির সুশৃঙ্খল অধ্যয়নের ওপর।

দেশীয় এবং পাশ্চাত্য উভয় প্রকার দর্শন, বিজ্ঞান, ভাষা সাহিত্য ইত্যাদির চর্চা এবং শিক্ষার মাধ্যমে এই সমস্ত বিষয়ের ওপর একটা কার্যকরী দখল ব্যতীত যে বাঙলাদেশে কোন সৃষ্টিশীল সাহিত্য দর্শন বিজ্ঞানের উদ্ভব হতে পারে না, বিদ্যাসাগর এই সত্যকে ঊনিশ শতকের প্রথমার্ধের অভিজ্ঞতার আলোকে বিচার করে সেই সত্যের ওপর নিজের শিক্ষা- চিন্তাকে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। শিক্ষাক্ষেত্রে এই সমন্বয়-সাধন ব্যতীত একদিকে ‘গ্রাম্য পাণ্ডিত্য ও গ্রাম্য বর্বরতা’ এবং অন্যদিকে নব্য ইংরেজী শিক্ষিত সম্প্রদায়ের ‘শিশু- সুলভ উচ্ছৃঙ্খলতার’ কুপ্রভাব অতিক্রম করে শিক্ষা-সংস্কৃতির মধ্যে গতিশীলতা ও সৃজনশীলতা সৃষ্টি যে সম্ভব ছিলো না; সে বিষয়ে বিদ্যাসাগর যথার্থভাবেই নিঃসন্দেহ ছিলেন। তাঁর রচিত উপরোক্ত খসড়ার ৪ নম্বর প্যারার বক্তব্য এ ব্যাপারে খুবই সুস্পষ্ট।

এ প্রসঙ্গে মুসলমান সমাজের শিক্ষার* প্রতি দৃষ্টি দিলে বিদ্যাসাগরের প্রগতিশীল ভূমিকা স্পষ্টতর হবে এবং তাঁর শিক্ষানীতির মৌলিক প্রতিপাদ্য বিষয়সমূহের যথার্থতাও প্রমাণিত হবে। হাজী মহম্মদ মহসীন (জন্ম ১৭১০, মৃত্যু ১৮১২) ১৮০৬ সালে তাঁর বিখ্যাত উইলে নিজের যথাসর্বস্ব মুসলমান সম্প্রদায়ের উপকার এবং সাধারণভাবে জনশিক্ষার জন্য আল্লাহর নামে উৎসর্গ করেন। এই উইলটিতে মহম্মদ মহসীন যে উদার দৃষ্টিভঙ্গীর পরিচয় দেন সেটা ঊনিশ শতকের হিন্দু মুসলমান উচ্চ ও মধ্যশ্রেণীর কারও মধ্যে দেখা যায়নি। কারণ জনশিক্ষা বলতে এই উইলে তিনি বিশেষভাবে মুসলিম শিক্ষা অর্থাৎ নিজের সম্প্রদায়ের শিক্ষা বোঝাননি। এ ব্যাপারে তাঁর উইলে হিন্দু-মুসলিম ইত্যাদি কোন সম্প্রদায়ের উল্লেখই** ছিলো না।[৪২]

[* দ্রষ্টব্য : বদরুদ্দীন উমর : “ঊনিশ শতকে মুসলিম শিক্ষা ও মাতৃভাষা চর্চা’, সংস্কৃতির সংকট।

** সম্প্রদায়ের কথা এখানে যদি অনবধানতাবশতও অনুল্লেখিত হয়ে থাকে তা’হলেও তা উল্লেখযোগ্য। কারণ সেকালে এ বিষয়ে সম্প্রদায়ের উল্লেখ করাটাই ছিলো ব্যতিক্রমহীন রেওয়াজ।]

সাম্প্রদায়িকতার উন্মেষ উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের ব্যাপার হলেও তার ভিত্তিভূমি প্রথমার্ধেই রচিত হয়েছিলো এবং সেই আবহাওয়াতেও হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ভুক্ত উচ্চশ্রেণীর সমাজনেতারা কেবল মাত্র নিজ নিজ সম্প্রদায়ের শিক্ষা-দীক্ষা এবং উন্নতির চিন্তাই করতেন। অন্য সম্প্রদায়ের কোনো অস্তিত্ব এসব ব্যাপারে তাঁদের কাছে ছিলো না। এজন্যে ইংরেজী বাঙলা চর্চার ক্ষেত্রে, পাশ্চাত্য শিক্ষার ক্ষেত্রে, হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত নেতারা যে উদ্যোগ হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠা ইত্যাদির মাধ্যমে নিয়েছিলেন সেগুলি বিশেষভাবে হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত ছাত্রদের শিক্ষার জন্যেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো, তাতে মুসলমানদের কোন প্রবেশাধিকারের কথা কেউ চিন্তা করেননি। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরও এ দিক দিয়ে কোন ব্যতিক্রম ছিলেন না। শিক্ষা-সংস্কারের ক্ষেত্রে তাঁর নিজের চিন্তা হিন্দু সম্প্রদায়ের শিক্ষার ক্ষেত্রেই বিশেষভাবে সীমাবদ্ধ ছিলো। সে দিক দিয়ে বিচার করলে, শ্রেণী, ধর্ম ইত্যাদি নির্বিশেষে সাধারণভাবে জনশিক্ষার জন্য হাজী মহম্মদ মহসীনের বিরাট দান (যার বাৎসরিক আয় ১৮৩০-এর পর দাঁড়ায় ৫১,০০০ টাকায়) একটা উল্লেখযোগ্য ব্যাপার।

কিন্তু হাজী মহম্মদ মহসীনের নিজের দৃষ্টিভঙ্গী যাই হোক তৎকালীন উচ্চ ও মধ্যশ্রেণীভুক্ত অন্যান্য মুসলমানদের দৃষ্টিভঙ্গী ছিলো সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। তারা যখন দেখলো যে, মহসীন তহবিলের অর্থে প্রতিষ্ঠিত হুগলী কলেজে মুসলামান ছাত্রের তুলনায় হিন্দু ছাত্রদের সংখ্যা বিপুল পরিমাণে বেশি* তখন তারা সরকারী তত্ত্বাবধানে পরিচালিত সেই কলেজের ব্যয়ভার মহসীন তহবিল থেকে দেওয়ার ব্যাপারে ঘোরতর আপত্তি উপস্থিত করলো।[৪৩] ‘বাংলাদেশে মুসলিম শিক্ষার ইতিহাস ও সমস্যা’ নামক পুস্তকে মোহাম্মদ আজিজুল হক (পরে স্যার আজিজুল হক) সাধারণভাবে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিতে মুসলিম শিক্ষার ইতিহাস ও সমস্যাকে বিচার করলেও এ কথা স্বীকার করেন যে, মহসীনের অর্থ দ্বারা সর্বসাধারণের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা এ কারণে সমর্থনযোগ্য ছিলো যে, সে অর্থ সৎকার্যেই ব্যয়িত হয়েছিলো এবং তা উইল-কর্তার অভিপ্রায় বহির্ভূত নয়।[৪৪]

[* “হুগলী কলেজের কার্যারম্ভের তারিখ পহেলা আগস্ট ১৮৩৬। তিন দিনের মধ্যেই কলেজের ইংরেজী বিভাগে ছাত্র ভর্তি হলো ১২০০ জন এবং প্রাচ্য বিভাগে ৩০০ জন। এ দুই বিভাগে হিন্দু ছাত্রের সঙ্গে মুসলমান ছাত্রের সংখ্যানুপাত ছিল যথাক্রমে ৩১ : ৯৪৮ এবং ১৩৮ : ৮১। ১৯৫০ সাল নাগাদ দেখা যাচ্ছে যে, কলেজ বিভাগে মুসলমান ছাত্রের সংখ্যা মোট ৪০৯ জন ছাত্রের মধ্যে মাত্র ৫ জন এবং স্কুল বিভাগে মোট ১৩০ জনের মধ্যে মাত্র ৭ জন” মোহাম্মদ আজিজুল হক : বাংলাদেশে মুসলিম শিক্ষার ইতিহাস এবং সমস্যা।]

কিন্তু ‘উইল-কর্তার অভিপ্রায়-বহির্ভূত’ না হলেও নবাব আবদুল লতিফের মতো রক্ষণশীল সমাজ-নেতাদের নেতৃত্বে মহসীন তহবিলের এই ব্যবহারের বিরুদ্ধে মুসলিম জনমত ক্ৰমশঃ তীব্রতর হতে থাকে এবং সরকার ১৮৭২ সালে হুগলী কলেজ থেকে মহসীন তহবিল প্রত্যাহার করে সেই অর্থে হুগলী, ঢাকা, চট্টগ্রাম, এবং রাজশাহীতে একটি করে মাদ্রাসা স্থাপন করে মুসলিম শিক্ষা এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের উন্নতি সাধনের নামে মুসলমান সমাজকে সামন্তবাদী, রক্ষণশীল এবং পশ্চাদমুখী শিক্ষা ও চিন্তাধারার গহ্বরে নিক্ষেপ করেন। এ প্রসঙ্গে ১৮৮২ সালে লর্ড রিপন কর্তৃক নিযুক্ত শিক্ষা কমিশনের সামনে সাক্ষ্য প্রদান করতে গিয়ে সৈয়দ আমীর আলী বলেন,

মনে হচ্ছে মৃত একটা গুরুভার বস্তুর চাপে মুসলমান সম্প্রদায় এখনো ক্যুব্জ হয়ে রয়েছে। মাধ্যমিক শ্রেণীতে উচ্চতর শিক্ষায় সমস্ত ছাত্রদের ইংরেজীকে অবশ্যপাঠ্য না করে ১৮৭২ সালে একটি ভুল কাজ করা হয়েছিলো। তার ফল দাঁড়িয়েছে এই যে, একমাত্র যে-জাতীয় শিক্ষা মুসলমানদের গত পঞ্চাশ বছরের ক্ষতিপূরণের জন্য প্রয়োজন, আজ তার অতীব অসন্তোষজনক অবস্থা…। আমার মনে হয়, অভিজ্ঞতার দ্বারা এ কথাটা পর্যাপ্তরূপে প্রমাণিত হয়ে গেছে যে, মুসলমানদের মধ্যে অবিমিশ্র প্রাচ্য শিক্ষা-প্রসারের জন্য স্যার জর্জ ক্যাম্পবেলের ১৮৭২ সালের পরিকল্পনাটি বস্তুত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে।[৪৫]

এই ‘অবিমিশ্র প্রাচ্যশিক্ষার’ বিরুদ্ধেই স্থাপিত ছিলো ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের শিক্ষাদর্শ। প্রাচ্য শিক্ষাকে বাতিল করে কেবলমাত্র পাশ্চাত্য ভাষা ও জ্ঞান বিজ্ঞানে শিক্ষিত ইয়ংবেঙ্গল গোষ্ঠীর মতো একটি সমাজ-বিচ্ছিন্ন গোষ্ঠী অথবা সম্প্রদায় সৃষ্টির তিনি যেমন বিরোধী ছিলেন, তেমনই তিনি কেবলমাত্র প্রাচ্য শিক্ষার মধ্যেই ছাত্রদের শিক্ষাকে সীমাবদ্ধ রেখে কুসংস্কার ও বর্বরতাকে প্রশ্রয় দেওয়ারও বিরোধী ছিলেন। এ জন্য ইংরেজী ও বাংলা ভাষা এবং প্রাচ্য পাশ্চাত্যের দর্শন, সাহিত্য, জ্ঞানবিজ্ঞান এ দুইয়েরই চর্চার মাধ্যমে তিনি চেয়েছিলেন বাঙলাদেশে নোতুন এক সাহিত্য, সংস্কৃতি এবং জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার ভিত্তি স্থাপন করতে।

গণিত-শিক্ষা সংস্কৃত ভাষায় না দিয়ে ইংরেজী ভাষায় প্রদান করার পরামর্শও এ দিক থেকে খুব উল্লেখযোগ্য। গণিতচর্চা বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ অপরিহার্য, তাই গণিতচর্চাকে সংস্কৃত ভাষায় লিখিত গণিত বিষয়ক পুস্তকের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে এবং একটি আধুনিক উপযোগী ভাষার পরিবর্তে সংস্কৃত ভাষার মাধ্যমে গণিত-শিক্ষা দেওয়া হলে ছাত্রদের প্রকৃত গণিত-শিক্ষা ও বিজ্ঞানচর্চা যে অগ্রসর হতে পারে না, একথা তিনি যথার্থভাবেই উপলব্ধি করেছিলেন এবং এজন্যেই সরকারের কাছে প্রদত্ত সংস্কৃত কলেজের শিক্ষা-সংস্কার সংক্রান্ত নোটটির ১১, ১২ এবং ১৩ প্যারায় তিনি গণিত-শিক্ষা সম্পর্কে তাঁর দৃঢ় এবং সুস্পষ্ট অভিমত ব্যক্ত করেছিলেন।

শ্রেণীবদ্ধতা সত্ত্বেও বিদ্যাসাগর নিজের শ্রেণীকে অন্যান্য বহু রক্ষণশীল হিন্দু ও মুসলমান সমাজ নেতাদের মতো সামন্তবাদের খুঁটিতে বেদম জোরে বেঁধে রাখার চেষ্টা তো করেনইনি, উপরন্তু ঊনিশ শতকের মধ্যশ্রেণী সামন্তবাদের সাথে যে গাঁটছড়ায় আবদ্ধ ছিলো সেই গাঁটছড়া ছিঁড়ে ফেলতে সক্ষম না হলেও, তাকে অনেকখানি আল্ল্গা করার চেষ্টাতেই নানাভাবে নিযুক্ত ছিলেন। এ জন্যেই উপরোক্ত নোটটির ১৬ নম্বর প্যারায় তিনি বলেন, ‘ভারতীয় ও পাশ্চাত্য দুই দর্শনেই সম্যক জ্ঞান থাকলে এ দেশের পণ্ডিতদের পক্ষে আমাদের দর্শনের ভ্রান্তি ও অসারতা কোথায় তা বোঝা সহজ হবে।’ এ সম্পর্কে ৭ সেপ্টেম্বর, ১৮৫৩, ব্যালেন্টাইনের মতামতের সমালোচনা প্রসঙ্গে শিক্ষা সংসদের কাছে প্রেরিত রিপোর্টের একটি অংশে তিনি যা বলেন তার উল্লেখ খুব প্রাসঙ্গিক, ‘সম্প্রতি আমাদের দেশে, বিশেষ করে কলকাতায় ও তার আশেপাশে, পণ্ডিতদের মধ্যে একটা অদ্ভুত মনোভাব পরিস্ফুট হয়ে উঠছে। শাস্ত্রে যার বীজ আছে, এমন কোনও বৈজ্ঞানিক সত্যের কথা শুনলে, সেই সত্য সম্বন্ধে তাঁদের শ্রদ্ধা ও অনুসন্ধিৎসা জাগা দূরে থাক, তার ফল হয় বিপরীত। অর্থাৎ সেই শাস্ত্রের প্রতি তাঁদের বিশ্বাস আরও গভীর হয় এবং শাস্ত্রীয় কুসংস্কার আরও বাড়তে থাকে। তাঁরা মনে করেন, যেন শেষ পর্যন্ত তাঁদের শাস্ত্রেরই জয় হয়েছে, বিজ্ঞানের জয় হয়নি।’[৪৬] ‘যাহা নাই ভারতে তাহা নাই জগতে’ ধরনের কূপমণ্ডূকতা ও সামন্তবাদী বর্বরতার হাত থেকে হিন্দু সমাজের শিক্ষাব্যবস্থা ও হিন্দু শিক্ষিত সমাজকে উদ্ধার করার জন্যে তিনি যে বিবিধ প্রকার উদ্যোগ নিয়েছিলেন ১৬ নম্বর প্যারায় প্রদত্ত মতামত ও পরামর্শও ছিলো তারই অন্তর্গত। মুসলমান সমাজের মধ্যেও ‘কোরানে যা নেই তা কোথাও নেই’ অর্থাৎ ‘কোরানে সমস্তই আছে’ ধরনের কূপমণ্ডূকতা ও বর্বরতার অস্তিত্ব সমানভাবেই ছিলো কিন্তু উচ্চ ও মধ্যশ্রেণীর মুসলমান ছাত্র ও শিক্ষিত সমাজকে উদ্ধার করার জন্যে কোন বিদ্যাসাগরের আবির্ভাব হয়নি। এর ফলে মুসলমান উচ্চ ও মধ্যশ্রেণীর মধ্যে সামন্তবাদী প্রভাব যে হিন্দু উচ্চ ও মধ্যশ্রেণীর মধ্যে সামন্তবাদী প্রভাব থেকে ঊনিশ শতকে তো বটেই, এমন কি বিশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত সাধারণভাবে অনেক বেশী ব্যাপক ও প্রবল ছিলো সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কেবলমাত্র হিন্দু শাস্ত্রীয় গ্রন্থ এবং হিন্দু শাস্ত্রীয় কুসংস্কারের কবল থেকেই যে ছাত্রদের উদ্ধার করতে সচেষ্ট ছিলেন তাই নয়; তিনি ভাববাদী প্রভাবকেও শিক্ষাক্ষেত্রে যতখানি সম্ভব খণ্ডন করার জন্যে সবিশেষ যত্নবান ছিলেন। সংস্কৃত কলেজের পাঠ্য-তালিকা সম্পর্কে বারাণসী সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ ব্যালেন্টাইন বাঙলা সরকারের শিক্ষা সংসদকে যে পরামর্শ দিয়েছিলেন তার বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করতে গিয়ে বিদ্যাসাগর তাঁর রিপোর্টে এ প্রসঙ্গে বলেন,

বিশপ বার্কলের Inquiry বই সম্বন্ধে আমার মত এই যে, পাঠ্যপুস্তক রূপে এ বই পড়ালে সুফলের চেয়ে কুফলের সম্ভাবনা বেশী।

কতকগুলি কারণে সংস্কৃত কলেজে বেদান্ত ও সাংখ্য আমাদের পড়াতেই হয়। কি কারণে পড়াতে হয় তা এখানে উল্লেখ করার প্রয়োজন নেই। কিন্তু সাংখ্য ও বেদান্ত যে ভ্রান্ত দর্শন, সে সম্বন্ধে এখন আর বিশেষ মতভেদ নেই। তবে ভ্রান্ত হলেও এই দুই দর্শনের প্রতি হিন্দুদের গভীর শ্রদ্ধা আছে। সংস্কৃতে যখন এইগুলি পড়াতেই হবে তখন তার প্রতিষেধক হিসেবে ছাত্রদের ভালো ভালো ইংরেজী দর্শন শাস্ত্রের বই পড়ানো দরকার। বার্কলের বই পড়ালে সেই উদ্দেশ্য সাধিত হবে বলে মনে হয় না, কারণ সাংখ্য ও বেদান্তের মতোই বার্কলে একই শ্রেণীর ভ্রান্ত দর্শন রচনা করেছেন। ইউরোপেও এখন আর বার্কলের দর্শন খাঁটি দর্শন বলে বিবেচিত হয় না, কাজেই তা পড়িয়ে কোনও লাভ হবে না। তাছাড়া হিন্দু ছাত্ররা যখন দেখবে যে, এই বেদান্ত ও সাংখ্যের মতামত একজন ইউরোপীয় দার্শনিকের মতের অনুরূপ তখন এই দুই দর্শনের প্রতি তাদের শ্রদ্ধা আরও বাড়তে থাকবে। এই অবস্থায় বিশপ বার্কলের বই পাঠ্য হিসেবে প্রচলন করতে আমি ব্যালেন্টাইনের সঙ্গে একমত নই।[৪৭]

শুধু ‘বিশপ বার্কলের বই পাঠ্য হিসেবে প্রচলন করতে আমি ব্যালেন্টাইনের সঙ্গে একমত নই’ –এ কথা বলেই বিদ্যাসাগর ক্ষান্ত হননি। কলকাতার সংস্কৃত কলেজের ক্ষেত্রে নিজের মতকেই তিনি প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, বার্কলে তিনি পড়াতে দেননি।

কলকাতা সংস্কৃত কলেজে বিদ্যাসাগর প্রবর্তিত ইংরেজি ও সংস্কৃত উভয় প্রকারের পাঠ পদ্ধতিই ভালো এ কথা স্বীকার করেও ব্যালেন্টাইন শিক্ষা সংসদের কাছে তাঁর উপরোক্ত রিপোর্টে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন যে, দুই ভাষায় জ্ঞানচর্চার ফলে সত্য দ্বিবিধ এই ভুল ধারণা ছাত্রদের মনে সৃষ্টি হতে পারে। এর জবাবে বিদ্যাসাগর শিক্ষা সংসদের কাছে প্রেরিত রিপোর্টটিতে বলেন,

আমার বিশ্বাস, যে ছাত্র সংস্কৃত ও ইংরেজী এই দুই ভাষায় বিজ্ঞান ও সাহিত্য বুদ্ধিমানের মতো পাঠ করেছে এবং সেটা বুঝতে চেষ্টা করেছে, তার সম্বন্ধে এ রকম ভয় করার কোনো কারণ নেই। যে সত্যিকার ধারণা একবার করতে পেরেছে তার কাছে সত্য সত্যই। ‘সত্য দুরকমের’ –এ রকম ধারণা অসম্পূর্ণ প্রত্যয়ের ফল। সংস্কৃত কলেজে আমরা যে শিক্ষা- পদ্ধতি অনুসরণ করছি, তাতে কোনো শিক্ষা থেকে ছাত্রদের মনে এ রকম ভুল ধারণা সৃষ্টি হবে না। যেখানে দুটি সত্যের মধ্যে আন্তরিক মিল আছে সেখানে সেই মিল যদি কোনো বুদ্ধিমান ছাত্র বুঝতে না পারে, তাহলে সেটা বাস্তবিকই আশ্চর্য ব্যাপার বলতে হবে। মনে করা যাক, ইংরেজী ও সংস্কৃত দুই ভাষাতেই ছাত্ররা লজিক অথবা দর্শন-বিজ্ঞানের যে কোনো বিভাগ পড়া শেষ করলো। এখন যদি তারা বলে, “লজিকের পাশ্চাত্য মতামত ও সত্য, হিন্দু মতামতও সত্য’ অথচ যদি তারা দুইয়ের মধ্যে কোনো মিল খুঁজে না পায় এবং না পেয়ে এক ভাষার সত্য অন্য ভাষায় প্রকাশ করতে অক্ষম হয়, তাহলে বুঝতে হবে, হয় ছাত্ররা বিষয়টি ভালো করে বুঝতে পারেনি, না হয় যে ভাষায় তারা নিজেদের ভাব প্রকাশ করতে অক্ষম, সেই ভাষায় তাদের জ্ঞান সামান্য।[৪৮]

এতদূর পর্যন্ত লেখার ঠিক পরই নিজের বিশিষ্ট চারিত্রিক ভঙ্গীতে বিদ্যাসাগর হিন্দু দর্শনের অনেক কিছু ইংরেজীতে প্রকাশ করার অসুবিধা সম্পর্কে বলেন, ‘এ কথা অবশ্য ঠিক যে, হিন্দু দর্শনে এমন অনেক অংশ আছে ইংরেজীতে যা সহজবোধ্য করে প্রকাশ করা যায় না। তার কারণ সেইসব অংশের মধ্যে পদার্থ বিশেষ কিছু নেই।’[৪৯]

বিধবাবিবাহ প্রচলনকে বিদ্যাসাগর নিজের জীবনের ‘সর্বপ্রধান সৎকর্ম’ বলে বর্ণনা করেছিলেন। কিন্তু শিক্ষা-সংস্কারকে তিনি বর্ণনা করেছিলেন নিজের জীবনের ‘প্রিয়তম উদ্দেশ্য’ বা ‘darling object’ বলে।[৫০] এই প্রিয়তম উদ্দেশ্য সাধন প্রচেষ্টার দ্বারাই বিদ্যাসাগর তাঁর জীবনের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন।

১৪

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ব্যক্তিগত ধর্মবিশ্বাস নিয়ে বিশেষত ঈশ্বরের অস্তিত্বে তাঁর বিশ্বাস স নিয়ে অনেকে আলোচনা করেছেন। এ আলোচনায় খুব বেশী দূর অগ্রসর হওয়া সম্ভব নয়, কারণ এ বিষয়ে কোন নিশ্চিত সিদ্ধান্তে আসার মতো তেমন কোন তথ্য নেই। বিদ্যাসাগর স্পষ্টভাবে এ বিষয়ে নিজের মত কখনই ব্যক্ত করেননি। এ ক্ষেত্রে তাঁর অবস্থান অনেকটা অজ্ঞেয়বাদীদের (Agnostics) মতোই।*

[* বিদ্যাসাগরের অনুজ শম্ভুচন্দ্র লিখেছেন, “এক দিবস দাদা সুখাসীন হইয়া কথাবার্তা কহিতেছেন, এমন সময় দুইজন ধর্ম-প্রচারক ও কয়েকজন কৃতবিদ্য ভদ্রলোক আসিয়া উপবেশনপূর্বক জিজ্ঞাসা করিলেন, “বিদ্যাসাগর মহাশয়! ধর্ম লইয়া বঙ্গদেশে বড় হুলুস্থুল পড়িয়াছে, যাহার যা ইচ্ছা সে তাহাই বলিতেছে, এ বিষয়ের কিছুই ঠিকানা নাই; আপনি ভিন্ন এ বিষয়ের মীমাংসা হইবার সম্ভাবনা নাই।’ এ কথায় দাদা বলিলেন, ‘ধর্ম যে কি, তাহা মানুষের বর্তমান অবস্থায় জ্ঞানের অতীত এবং ইহা জানিবারও কোনো প্রয়োজন নাই।” শম্ভুচন্দ্রের বিদ্যাসাগর জীবন চরিত্র থেকে উদ্ধৃত। বিনয় ঘোষ, বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ পৃ ৩৬০।]

কিন্তু ব্যক্তিগত বিশ্বাস সম্পর্কে স্পষ্ট মতামত ব্যক্ত না করলেও হিন্দুশাস্ত্রের প্রতি তিনি যে মনোভাব পোষণ করতেন এবং সামাজিক নীতির ক্ষেত্রে তিনি যে পথ অনুসরণ করতেন সে বিষয়ে কারও কোন সন্দেহের অবকাশ তিনি রাখেননি। শুধু তাই নয়, ভাববাদ সম্পর্কে তাঁর সাধারণ মতামতও তিনি অতি সুষ্পষ্ট ভাষায় এবং পরিচ্ছন্ন ভঙ্গীতে ব্যক্ত করেছিলেন। প্রথমে হিন্দুশাস্ত্রের প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গী কি ছিলো সেটা দেখা যাক।

বিধবাবিবাহ প্রচলন আন্দোলন করতে গিয়ে বিদ্যাসাগর খুব ব্যাপকভাবে শাস্ত্রীয় আলোচনার মধ্যে প্রবেশ করেছিলেন। কেন তিনি সে কাজ করেছিলেন তার ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে তিনি তাঁর অনবদ্য ভাষায় এবং অপূর্ব ভঙ্গীতে বলেন,

বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এ বিষয়ে বিচারে প্রবৃত্ত হইতে হইলে, সর্বাগ্রে এই বিবেচনা করা আবশ্যক যে, এ দেশে বিধবাবিবাহের প্রথা প্রচলিত নাই; সুতরাং বিধবার বিবাহ দিতে চাইলে এক নতুন প্রথা প্রবর্তিত করিতে হইবেক। কিন্তু বিধবাবিবাহ যদি কর্তব্য কর্ম না হয়, তাহা হইলে কোন ক্রমে প্রবর্তিত ও প্রচলিত হওয়া উচিত নহে। কারণ কোন ধর্মপরায়ণ ব্যক্তি অকর্তব্য কর্মের অনুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হইবেন? অতএব বিধবাবিবাহ কর্তব্য কর্ম কিনা অগ্রে ইহার মীমাংসা করা অতি আবশ্যক। যদি শাস্ত্রে কর্তব্য কর্ম বলিয়া প্ৰতিপন্ন করা থাকে, তবেই তাঁহারা কর্তব্য কর্ম বলিয়া স্বীকার করিতে ও তদনুসারে চলিতে পারেন।

এ রূপ বিষয়ে এ দেশে শাস্ত্রই সর্বপ্রধান প্রমাণ এবং শাস্ত্রসম্মত কর্মই সর্বতোভাবে কর্তব্য কর্ম বলিয়া পরিগৃহীত হইয়া থাকে। অতএব বিধবাবিবাহ শাস্ত্রসম্মত অথবা শাস্ত্রবিরুদ্ধ কর্ম ইহার মীমাংসা করাই সর্বাগ্রে আবশ্যক।[৫১]

এই মীমাংসার উদ্দেশ্যেই বিধবাবিবাহ প্রবর্তনের পক্ষে বিদ্যাসাগর শাস্ত্রীয় আলোচনার আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন, অন্য কোন ভক্তিমূলক উদ্দেশ্যে নয়। এখানে সবিশেষ লক্ষণীয় এবং উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো, যে কোন উদ্দেশ্য সাধন ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগরের বাস্তব কৌশল জ্ঞান। গ্রাম্য বর্বরতায় আচ্ছন্ন ঊনিশ শতকের বাঙালী সমাজের পক্ষে কোন্ কোন্ সংস্কার প্রয়োজনীয় এবং হিতকর শুধুমাত্র এই জ্ঞানই তাঁর ছিলো; সেই সংস্কার প্রচেষ্টাকে তৎকালীন পরিবেশে সফল করতে হলে কোন্ কোন্ বিষয়ে সতর্ক ও সাবধান হতে হবে, শাস্ত্রীয় ও সামাজিক নানা কুসংস্কারের প্রতি খোলাখুলি অথবা বেপরোয়া অশ্রদ্ধা প্রকাশ না করে সেগুলির মূলে কিভাবে কুঠারাঘাত করতে হবে, এ বিষয়ে বাস্তব কর্মপন্থা নির্ধারণেও তিনি যথেষ্ট যত্নবান ছিলেন। একদিকে তাঁর পূর্ববর্তী ইয়ংবেঙ্গল গোষ্ঠীর পরিণতি এবং অন্যদিকে দেশীয় সমাজ ও লোকাচার সম্পর্কে তাঁর সুগভীর জ্ঞান এ দুই-ই এ ক্ষেত্রে তাঁর সহায়ক ছিলো।

সংস্কারমূলক প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গী যে শুধুমাত্র বিধবাবিবাহ প্রচলনের ক্ষেত্রে সীমিত ছিলো তা নয়। ব্যালেন্টাইনের পরামর্শ সম্পর্কে শিক্ষা সংসদের কাছে লিখিত পূর্বোক্ত রিপোর্টে বিদ্যাসাগর বলেন,

কতকগুলি কারণে সংস্কৃত কলেজে বেদান্ত ও সাংখ্য আমাদের পড়াতেই হয়। কি কারণে পড়াতে হয় তা এখানে উল্লেখ করার প্রয়োজন নেই। কিন্তু সাংখ্য ও বেদান্ত যে ভ্রান্ত দর্শন, সে সম্বন্ধে এখন আর বিশেষ মতভেদ নেই। তবে ভ্রান্ত হলেও এই দুই দর্শনের প্রতি হিন্দুদের গভীর শ্রদ্ধা আছে। সংস্কৃতে যখন এগুলি পড়াতেই হবে তখন তার প্রতিষেধক হিসেবে ছাত্রদের ভালো ভালো ইংরেজী দর্শন শাস্ত্রের বই পড়ানো দরকার।

কি কারণে সংস্কৃত কলেজে সাংখ্য ও বেদান্ত পাঠ্য হিসেবে রাখতে হবে সে বিষয় ‘উল্লেখ করার প্রয়োজন নেই’ বললেও বিদ্যাসাগর বস্তুতপক্ষে এখানে তা উল্লেখ করেছেন–“ভ্রান্ত হলেও এই দুই দর্শনের প্রতি হিন্দুদের গভীর শ্রদ্ধা আছে”—সংস্কৃত কলেজের পাঠ্যতালিকায় সাংখ্য ও বেদান্তের অন্তর্ভুক্তির এটাই যে মূল কারণ, সে বিষয়ে তিনি আর কোন সন্দেহ রাখেননি। কিন্তু বাধ্যতাবশতঃ যখন এ দুই ‘ভ্রান্ত দর্শন’ পাঠ্যতালিকায় রাখতেই হবে তখন তার কুপ্রভাব থেকে ছাত্রদের কিভাবে রক্ষা করা যায়, সেটাই ছিল তাঁর চিন্তা। এই চিন্তার ফলস্বরূপ যে প্রতিষেধক তিনি নির্ধারণ করেন তা হচ্ছে ইংরেজী দর্শনশাস্ত্রের বই অর্থাৎ ইংরেজীতে লিখিত অথবা অনূদিত পাশ্চাত্য দর্শন শাস্ত্রের বই।

কিন্তু সেখানেও তিনি ঢালাওভাবে পাশ্চাত্য দর্শন শাস্ত্রের যে-কোন বই ছাত্রদের পাঠ্যতালিকাভুক্ত করার নিতান্ত বিরোধী ছিলেন। এ বিষয়ে বার্কলের দর্শন সম্বন্ধে তাঁর বক্তব্যের মাধ্যমে খুব স্পষ্টভাবে তিনি তাঁর সাধারণ মতামত ব্যক্ত করেছেন। ভারতীয় শাস্ত্রের এবং ভারতীয় ভাববাদী দর্শনের প্রভাব খণ্ডন করার জন্যে ইউরোপীয় ভাববাদী দর্শন নিতান্তই অনুপযোগী। সাংখ্য ও বেদান্তের প্রতিষেধক বার্কলের Inquiry নয়, জন স্টুয়ার্ট মিলের Logic ও ডেভিড হিউমের Treaties।

ধর্ম সম্পর্কে বিদ্যাসাগরের দৃষ্টিভঙ্গী আলোচনা প্রসঙ্গে বিনয় ঘোষ বলেছেন,

ধর্মের বিরুদ্ধে কোনো প্রত্যক্ষ আন্দোলন করে মানুষকে যে ধর্মের মোহমুক্ত করা যায় না, এ সত্য বাঙলার বিদ্যাসাগর এ যুগের অন্যতম বিপ্লবী দার্শনিক কার্ল মার্কসের সমসাময়িককালে উপলব্ধি করেছিলেন। তাই জীবনে একটিবারের জন্যও তিনি ধর্ম বিষয়ে প্রকাশ্যে আলোচনা করেননি। ঘরোয়া বৈঠকেও না। নবযুগের শক্তিমান মানুষের মতো তাঁর চিন্তাধারা ছিল ইহজগৎকেন্দ্রিক ও মানব-কেন্দ্রিক। বালকদিগের বোধশক্তির বিকাশের জন্য যখন তিনি ‘বোধোদয়’ লিখেছিলেন তখন কয়েক সংস্করণে তার মধ্যে ‘ঈশ্বর’ সম্বন্ধে কোনো আলোচনাই তিনি করেননি। পরে ঈশ্বর প্রসঙ্গ যোগ করেন, কিন্তু সে ঈশ্বর ‘নিরাকার চৈতন্যস্বরূপ’ বালকদের সাধ্য নেই এই সংজ্ঞা বোঝে। সেই জন্যই তিনি প্রথম বোধোদয়ের মধ্যে ঈশ্বরের স্বরূপ ব্যাখ্যা করতে চাননি, তা পরিষ্কার বোঝা যায়। কিন্তু যখন করলেন তখনও দেখা গেলো, বোধোদয়ের প্রথমে ‘পদার্থ’ বা ‘Matter’, তারপরে ‘ঈশ্বর’।

‘ঈশ্বরের’ প্রতি এই মনোভাব ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সমস্ত লেখার মধ্যে ঈশ্বর সম্বন্ধে তাঁর অভিমত যে সব থেকে সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করে সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। ‘ঈশ্বরকে তিনি যদি সত্যিই কোন ‘সার’ পদার্থ বলে মনে করতেন তাহলে সংজ্ঞা প্রদানের ক্ষেত্রে তাঁর মতো একজন ন্যায়শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত স্রষ্টাকে সৃষ্টির পর কোন মতেই স্থান দিতেন না।*

[*পদার্থ : “আমরা ইতস্তত যে সকল বস্তু দেখিতে পাই, সে সমুদয়কে পদার্থ বলে। পদার্থ ত্রিবিধ চেতন, অবচেতন, উদ্ভিদ।…” ঈশ্বর : “ঈশ্বর কি চেতন কি অচেতন কি উদ্ভিদ, সমস্ত পদার্থের সৃষ্টি করিয়াছেন। এ নির্মিত্ত ঈশ্বরকে সৃষ্টিকর্তা বলে।…’ —বিদ্যাসাগর রচনা সংগ্রহ, প্রথম খণ্ড, পৃ ১৭৭।]

বিদ্যাসাগর যে পরকাল মানতেন না, সে বিষয়ে সকলেই নিঃসন্দেহ। বিনয় ঘোষও তার উল্লেখ করেছেন।[৫২] কিন্তু তা সত্ত্বেও সারা জীবন তিনি চিঠিপত্রের শিরোনামায় শ্রীশ্রী দুর্গা শরণং’, ‘শ্রীশ্রী হরি শরণং’ লিখেছেন এ কারণে তাঁকে নাস্তিক আখ্যা দিতে চাননি।[৫৩] নিতান্ত লোকাচারে দাস হয়ে তিনি যে তা লিখতে পারেন না, এই যুক্তিই এ ক্ষেত্রে দিয়েছেন। কিন্তু লোকাচারের দাস না হয়ে প্রচলিত একটা রীতিকে মামুলীভাবে অনুসরণ করেও তিনি যে তা করতে পারতেন না, তা নয়। খুব সম্ভবতঃ তিনি এই দ্বিতীয় কারণেই চিঠিপত্রের শিরোনামায় ঐ সব লিখতেন। কারণ ঈশ্বর সম্পর্কে যাঁর মনোভাব নিতান্তই তাচ্ছিল্যপূর্ণ তিনি সে বিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে চিঠিপত্রের শিরোনামায় ‘শ্রীশ্রী দুর্গা শরণং লিখবেন এ কথা সম্পূর্ণরূপে অবিশ্বাস্য এবং বিদ্যাসাগরের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে তাকে খুব অসঙ্গতিপূর্ণ বলেই মনে হয়।

‘লোকাচারের দাসত্ব’ প্রসঙ্গে এখানে আর একটা জিনিসের উল্লেখ করা যেতে পারে। বিদ্যাসাগর আমৃত্যু ব্রাহ্মণের বর্ণচিহ্ন উপবীত নিজ দেহে ধারণ করেছিলেন। তার অর্থ কি এই যে, তিনি জাতিভেদ প্রথায় বিশ্বাসী ছিলেন? রামমোহন যেভাবে জাতিভেদের বিরুদ্ধে লেখালেখি করেছিলেন এবং আন্দোলনের কথা বলেছিলেন, সেভাবে বিদ্যাসাগর যদি জাতিভেদের বিরুদ্ধে, বিধবাবিবাহ প্রবর্তনের মতো সামাজিক আন্দোলন করতেন তাহলে তিনি নিশ্চয় উপবীত ধারণের মতো লোকাচারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে উপবীত নিজ দেহ থেকে ছিন্ন করতেন। কিন্ত জাতিভেদে বিশ্বাস না করলেও তিনি তার বিরুদ্ধে কোন আন্দোলন করতে তৎকালে আগ্রহী ছিলেন না। তিনি সে বিষয়ে কোন লেখালেখিও প্রকৃতপক্ষে করেননি।

আসল কথা হলো, লোকাচার সম্পর্কে বিদ্যাসাগরের নিজের একটি বিশিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গী ছিলো। যে সমস্ত লোকাচারকে তিনি তৎকালীন পরিপ্রেক্ষিতে নিজের সামাজসংস্কার আন্দোলনের প্রতিবন্ধক মনে করতেন, সেগুলিকে দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করতেন এবং সেগুলির বিরুদ্ধে দাঁড়াতেন। কিন্তু যে সমস্ত লোকাচার অনেকখানি ‘নিরীহ প্রকৃতির’ ছিলো, সেগুলিকে ‘মান্য’ করলে সমাজসংস্কার আন্দোলনের ক্ষেত্রে কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হতো না, সেই সমস্ত লোকাচার ও প্রচলিত নিয়মগুলিকে তিনি ‘সশ্রদ্ধভাবে’ নয়, নিতান্তই যান্ত্রিকভাবে মান্য করে চলতেন। চিঠিপত্রের শিরোনামায় ‘শ্রীশ্রী দুর্গা শরণং’ ইত্যাদি লেখা এবং নিজ দেহে উপবীত ধারণ ইত্যাদি এই দ্বিতীয় ধরনেরই লোকাচার এবং প্রচলিত নিয়ম। এগুলি মান্য করার মধ্যে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের আস্তিকতা অথবা জাতিভেদে বিশ্বাস কোনটিই বিন্দুমাত্র প্রমাণিত হয় না। কারণ একদিকে তিনি যেমন কোনদিন লোকাচারের দাসত্ব করেননি, অন্যদিকে তেমনি তিনি প্রতিটি লোকাচার, দেশাচার, ও প্রচলিত সামাজিক ব্যবহারের (Social practices) বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণারও কোন প্রয়োজন বোধ করেননি। এ বিষয়ে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গী ছিলো অতিশয় বাস্তবমুখী।

এ সম্পর্কে বরীন্দ্রনাথ বিদ্যাসাগর স্মরণ সভায় যা বলেছিলেন তা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ এবং সেই হিসেবে উল্লেখযোগ্য,

আমাদের দেশের লোকেরা একদিক দিয়ে তাঁকে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন না করে থাকতে পারেনি বটে, কিন্তু বিদ্যাসাগর তাঁর চরিত্রের যে মহত্ত্বগুণে দেশাচারের দুর্গ নির্ভয়ে আক্রমণ করতে পেরেছিলেন, সেটাকে কেবলমাত্র তাঁর দয়াদাক্ষিণ্যের খ্যাতির দ্বারা তাঁরা ঢেকে রাখতে চান। অর্থাৎ বিদ্যাসাগরের যেটি সকলের চেয়ে বড় পরিচয় সেইটিই তাঁর দেশবাসীরা তিরস্করণীর দ্বারা লুকিয়ে রাখবার চেষ্টা করেছেন। এর থেকে একটা কথার প্রমাণ হয় যে তাঁর দেশের লোক যে যুগে বদ্ধ হয়ে আছেন, বিদ্যাসাগর সেই যুগকে ছাড়িয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। অর্থাৎ সেই বড় যুগে তাঁর জন্ম, যার মধ্যে আধুনিককালেরও স্থান আছে, যা ভাবীকালকে প্রত্যাখ্যান করে না। যে গঙ্গা মরে গেছে তার মধ্যে স্রোত নেই, কিন্তু ডোবা আছে। বহমান গঙ্গা তার থেকে সরে এসেছে, সমুদ্রের সঙ্গে তার যোগ। এই গঙ্গাকেই বলি আধুনিক। বহমান কালগঙ্গার সঙ্গেই বিদ্যাসাগরের জীবন ধারার মিলন ছিল, এইজন্য বিদ্যাসাগর ছিলেন আধুনিক। যারা অতীতের জড় বাধা লঙ্ঘন করে দেশের চিত্তকে ভবিষ্যতের পরম সার্থকতার দিকে বহন করে নিয়ে যাবার সারথিস্বরূপ, বিদ্যাসাগর মহাশয় সেই মহারথিগণের একজন অগ্রগণ্য ছিলেন।[৫৪]

বিদ্যাসাগরের মূল্যায়ন সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের এই উক্তি খুবই যথার্থ। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে তাঁর সামন্তবাদী ধ্যান-ধারণা-বিরোধী সামাজিক ও দার্শনিক অবস্থানের দিক দিয়ে বিচার করলে এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা চলে যে, ঊনিশ শতকের বাঙলাদেশে বুর্জোয়াশ্রেীর যে শ্রেণীগত বিকাশ শুরু হয়েছিলো সেই বিকাশের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন বাঙালী বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন