বদরুদ্দীন উমর
১৫ ও ২২ শে চৈত্র, ১৩৮৭, তারিখের আনন্দবাজার পত্রিকায় অশোক রুদ্র ‘শতাব্দীর বিচার’ নামক একটি সমালোচনামূলক প্রবন্ধে আমার লিখিত ‘ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও ঊনিশ শতকের বাঙালী সমাজ’ নামক পুস্তকের ওপর যে আলোচনা করেছেন সেটি পাঠ করে রীতিমতো চমৎকৃত হলাম। দারুণ বিজ্ঞজনোচিত বিচার পদ্ধতি প্রয়োগ করে তিনি আমার বক্তব্যসমূহের যে তথাকথিত সমালোচনা করেছেন সেটা পড়ে আমার স্মরণ হলো দার্শনিক বার্কলের উক্তি প্রতিপক্ষের এক সমালোচনা প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, “You raise the dust and then complain that you can not see”।
অশোক রুদ্র নিশ্চয়ই পণ্ডিত ব্যক্তি। আমরা বিদ্রোহ এবং বিপ্লবের পার্থক্য বুঝি না, আমরা মনে করি ইউরোপীয় রেনেসাঁস দেশকাল নির্বিশেষে সকল দেশেই ঘটা উচিত ছিলো, আমরা জানি না যে, নিউটন ঈশ্বরে বিশ্বাস করতেন, প্রাক-বৃটিশ ভারতীয় সমাজব্যবস্থা সম্পর্কে আমাদের চিন্তার ঘরে রয়েছে এক বিরাট শূন্য ইত্যাদি তাঁর রচিত প্রবন্ধটি থেকে জানার পর তাঁর বিশাল পাণ্ডিত্য আমাকে ব্যক্তিগতভাবে খুবই অভিভূত করেছে।
বোধকরি তাঁর এই পাণ্ডিত্যের কারণেই তাঁর সমালোচনা পড়ে মনে হয় না যে তিনি আমার বইটি ঠিক মতো পড়ার প্রয়োজন বোধ করেছেন। বৃটিশ ঔপনিবেশিকতাবাদের সাথে ঊনিশ শতকীর মধ্যবিত্তের সম্পর্ক, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত, মধ্যশ্রেণীভুক্ত বুদ্ধিজীবীদের কৃষক স্বার্থ বিরোধিতা ইত্যাদি বিষয়ে আমার কতকগুলি বক্তব্যের ওপর বিক্ষিপ্তভাবে নজর দিয়েই তিনি এমন উত্তেজিত হয়েছেন যে, পুস্তকটিতে আমার মূল প্রতিপাদ্য বিষয়গুলির কোনটির প্রতিই যথার্থভাবে তাকানোর কোন প্রয়োজন তিনি বোধ করেননি।
আমার বক্তব্য সম্পর্কে তিনি আলোচ্য প্রবন্ধটিতে যা কিছু বলেছেন সেটা পড়ে মনে হয় যে, ঊনিশ শতকের সমাজ সংস্কারকদের নস্যাৎ করার উদ্দেশ্যেই আমি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও ঊনিশ শতকের বাঙালী সমাজ নামক পুস্তকটি রচনা করেছি। প্রথম থেকেই এই ধারণার বশবর্তী হয়ে আমার বক্তব্যের বিরুদ্ধে পাণ্ডিত্যের অস্ত্র প্রয়োগ করতে গিয়ে তিনি তাঁর আলোচনায় বিদ্যাসাগর সম্পর্কে আমার মূল বক্তব্য এবং মূল্যায়নের কোন উল্লেখই যে করেননি (যা কিনা যে কোন সমঝদার আলোচকের অবশ্য কর্তব্য) সেটা আমার লেখা পুস্তকটির যে কোন সতর্ক পাঠকেরই চোখে পড়বে। চোখে পড়বে বিশেষ করে এ জন্য যে, আমি বিদ্যাসাগর সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে তাঁকে মোটেই ‘নস্যাৎ’ করিনি। উপরন্তু তাঁর সামগ্রক মূল্যায়নের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের উক্তির যথার্থতা উল্লেখ করে বলেছি:
“ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে তাঁর সামন্তবাদী ধ্যান-ধারণা-বিরোধী সামাজিক ও দার্শনিক অবস্থানের দিক দিয়ে বিচার করলে এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা চলে যে, ঊনিশ শতকের বাঙলাদেশে বুর্জোয়া শ্রেণীর যে শ্রেণীগত বিকাশ শুরু হয়েছিলো সেই বিকাশের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন বাঙালী বুর্জোয়া বুদ্ধজীবীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম। (পৃ. ৫১ )
আমি আমার পুস্তকটিতে ঊনিশ শতকের সংস্কার আন্দোলনের দুটি ধারা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করে রামমোহন, দ্বারকানাথ ঠাকুর, কেশবচন্দ্র প্রমুখের সাথে বিদ্যাসাগরের পার্থক্য নির্দেশ করতে গিয়ে বলেছি,
এ কথা সত্য যে, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সমাজ-সংস্কার আন্দোলন বৃহত্তর বাঙলার জনজীবনকে প্রভাবিত করতে পারেনি, ‘মধ্যশ্রেণীর মধ্যেই তার প্রভাব মোটামুটি সীমাবদ্ধ থেকেছে। কিন্তু এ কথাও আবার সত্য যে, সমাজ সংস্কারকে ধর্ম সংস্কারের আবর্তের মধ্যে নিক্ষেপ করে রক্ষণশীলতার পথকে বিদ্যাসাগর কখনও প্রশস্ত করেননি। (পৃ. ২৫)
এই দুই ধারা সম্পর্কে বলতে গিয়ে আমি ইউরোপীয় রেনেসাঁস ও রিফরমেশনের উল্লেখ করে বলেছি যে,
রিফমেশন ছিলো মূলতঃ ধর্মীয় আন্দোলন এবং সেজন্য ধর্মীয় নেতারাই ছিলেন সেই আন্দোলনের নেতা। অন্যদিকে, রেনেসাঁস ধর্মীয় আন্দোলন ছিলো না বলে রেনেসাঁসের নেতারা সকলে ধর্মীয় চিন্তা সম্পর্কে উদাসীন না হলেও ধর্মীয় আন্দোলনের নেতা তাঁরা কেউই ছিলেন না। মূর, ক্যামপানেলা প্রমুখ রেনেসাঁসের নেতাদের সকলের ক্ষেত্রেই এই কথা প্রযোজ্য। (পৃ. ১৫ )
আমার এই বক্তব্যের জের টেনে অশোক রুদ্র বলেছেন, ‘তাঁর আলোচনা পড়লে মনে হয় তাঁর মতে ইউরোপীয় রেনেসাঁসের পথিকৃত্রা সকলেই ছিলেন নাস্তিক। এ রকম ধারণা তিনি কোথায় পেলেন?’ সত্যি কোথায় পেলাম? তা তো জানি না। কারণ আমি তো সে ধরনের কোন কথা লিখিনি! ধর্মীয় চিন্তা সম্পর্কে উদাসীন না হলেও ধর্মীয় আন্দোলনের নেতা তাঁরা কেউই ছিলেন না একথা বলার অর্থ কি এই যে, ‘ইউরোপীয় রেনেসাঁসের পথিকৃত্রা সকলেই ছিলেন নাস্তিক?’ এবার আমি কি জিজ্ঞেস করতে পারি না যে, অশোক রুদ্র নিজে এই উদ্ভট ধারণা কোথায় পেলেন? এই ধরনের সমালোচকদের ক্ষেত্রেই কি বার্কলের উপরে উল্লিখিত উদ্ধৃতিটি দারুণভাবে প্রযোজ্য নয়?
আরও আছে। ইউরোপীয় রেনেসাঁসে বাণিজ্যিক বুর্জোয়া শ্রেণীর ভূমিকা সম্পর্কে আমার বক্তব্যের সমালোচনা প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, “ইউরোপে ধনতন্ত্রের বিকাশে কৃষিব্যবস্থা থেকে উদ্ভুত গ্রামীণ বুর্জোয়া শ্রেণীর কোন ভূমিকা ছিল না। সেই ভূমিকা পালন করেছিল শুধুমাত্র বাণিজ্যিক বুর্জোয়া, এই তত্ত্বটি অনেকেই মানবেন না।’ জিজ্ঞেস করি, আমার এই বক্তব্য তিনি কোথায় পেলেন? আমি তো এ কথা কোথাও বলিনি যে, কৃষিব্যবস্থা থেকে উদ্ভুত গ্রামীণ বুর্জোয়া শ্রেণীর কোন ভূমিকা ইউরোপীয় ধনতন্ত্রের বিকাশের ক্ষেত্রে ছিলো না। আলোচ্য পুস্তকটিতে রেনেসাঁস সম্পর্কে আমি প্রাসঙ্গিক প্রয়োজনে খুব সংক্ষিপ্ত আলোচনা করে তার মৌলিক দিকগুলি উল্লেখ করার চেষ্টা করেছি, রেনেসাঁসের কোনো ইতিহাস রচনার চেষ্টা করিনি। ঠিক সে কারণেই গ্রামীণ বুর্জোয়ার ভূমিকা উল্লেখ করার কোন প্রয়োজন আমি বোধ করিনি। উল্লেখ করেছিলাম বুর্জোয়া শ্রেণীর সেই অংশটির কথা, রেনেসাঁসের ক্ষেত্রে যার ভূমিকা ছিলো মৌলিক। এর থেকে কোন পাণ্ডিত্যপূর্ণ বিবেচনার বশে অশোক রুদ্র মনে করলেন যে, ইউরোপীয় ধনতন্ত্রের বিকাশে শুধু বাণিজ্যিক বুর্জোয়ারাই একটি ভূমিকা পালন করেছিলো এ কথা আমি বলেছি? এ সম্পর্কে তিনি আরও বলেছেন,
বাণিজ্যিক বুর্জোয়াদের শ্রেণী স্বার্থের সঙ্গে ভূমিদাসদের শ্রেণী স্বার্থের কোন সংঘাত ছিল না বলা এক কথা। কিন্তু তার থেকে যদি বলা হয় যে রেনেসাঁসের মানবতাবাদ তার পরিধির মধ্যে সমাজের সকল শ্রেণীর উৎপীড়িত মানুষের সুখ-দুঃখকে ধারণ করেছিল তো ঐ তত্ত্বের অভিনবত্বে চমৎকৃত হতে হয় বৈকি।
কে কোন্ কথায় চমৎকৃত হবেন অথবা হবেন না, সেটা অনেকাংশে নির্ভর করে চমৎকৃত হওয়ার প্রবণতার ওপর। কাজেই সে ব্যাপারে বলার কিছু নেই। তবে আমার বক্তব্যকে অশোক রুদ্র এক্ষেত্রে কিভাবে বিকৃত করেছেন সেটা তাঁর দ্বারাই উদ্ধৃত আমার বক্তব্যের সাথে আমার বক্তব্য বলে তিনি যা চালিয়েছেন সেটা মিলিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে। আমি যেখানে বলেছি বাণিজ্যিক বুর্জোয়া এবং ভূমিদাসের স্বার্থের মধ্যে একটা গভীর সংযোগের দ্বারা ‘মানবতাবাদী চিন্তা, কর্মকাণ্ড ও সংস্কৃতির সীমা ও পরিধি নির্ণীত হয় এবং সমাজের সকল শ্রেণীর উৎপীড়িত মানুষের সুখ-দুঃখই সেই সীমা ও পরিধির অন্তর্গত থাকে।’ (প. ১৯) সেখানে তিনি আমার বক্তব্য হিসেবে বলছেন, ‘রেনেসাঁসের মানবতাবাদ তার পরিধির মধ্যে সমাজের সকল শ্রেণীর উৎপীড়িত মানুষের সুখ-দুঃখকে ধারণ করে।’ সকল শ্রেণীর উৎপীড়িত মানুষের সুখ-দুঃখকে সেই সীমা ও পরিধির অন্তর্গত থাকা এবং সকল শ্রেণীর উৎপীড়িত মানুষের সুখ-দুঃখকে ধারণ করা কি এক কথা?
ফরাসী বিপ্লবের সময় সেই বিপ্লবের চিন্তা, কর্মকাণ্ড ও সংস্কৃতির সীমা ও পরিধি সর্বহারা শ্রমিক, কৃষকসহ ফ্রান্সের তৎকালীন উৎপীড়িত জনগণের সুখ-দুঃখের সীমার অন্তর্গত ছিলো এ কথা কি অস্বীকার করা চলে? তা যদি না হতো তাহলে উৎপীড়নমূলক অভিজাততন্ত্রের বিরুদ্ধে শ্রমিক কৃষকরা কি সেই বুর্জোয়া বিপ্লবের শক্তি হিসেবে ঐতিহাসিকভাবে এগিয়ে মাসতো? তাহলে কি ফরাসী বিপ্লবকে একটি প্রগতিশীল ঐতিহাসিক ঘটনা বলা যেতো? কিন্তু তার অর্থ কি আবার এই যে, সেই বিপ্লবের নেতা বুর্জোয়া শ্রেণীর মানবতাবাদী চিন্তা শ্রমিক কৃষকের সুখ-দুঃখকে ধারণ করেছিলো? অর্থাৎ বুর্জোয়া শ্ৰেণী তৎকালীন শ্রমিকদের ওপর শোষণ করতো না অথবা পরবর্তীকালে সেই শোষণের হার তারা বৃদ্ধি করেনি? অথবা তাঁর কথা মতো ‘ইউরোপীয় বুর্জোয়া সভ্যতা যখন তার উত্তুঙ্গ শিখরে তখনই কি সেই সভ্যতার বাহক ও ধারকেরা এশিয়া আফ্রিকা ও আমেরিকার অধিবাসীদের ওপর চূড়ান্ত উৎপীড়ন, নিপীড়ন ও শোষণ চালাননি?
নিশ্চয়ই বুর্জোয়ারা সব সময়ই শ্রমিকদের শোষণ করেছে, পরবর্তীকালে সেই শোষণের হার বৃদ্ধি করেছে এবং উত্তুঙ্গ শিখরে থাকার সময় তারা এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার অধিবাসীদের ওপর অনেক শোষণ উৎপীড়ন চালিয়েছে। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, রেনেসাঁসের যুগের বুর্জোয়া শ্রেণীর ঐতিহাসিক ভূমিকা এবং ‘উত্তুঙ্গ’ পর্যায়ে তাদের ঐতিহাসিক ভূমিকা এক! তার অর্থ এই নয় যে, পরবর্তীকালে এবং বর্তমান যুগে বুর্জোয়া শ্রেণীর যা ভূমিকা রেনেসাঁসের যুগে এমন কি ফরাসী বিপ্লবের সময় তার সেই ভূমিকা ছিলো। তা যদি হতো তাহলে ফরাসী বিপ্লবকে বিপ্লব বলা যেতো না এবং বুর্জোয়া শ্রেণীরও ঐতিহাসিক বিবর্তন বলে কিছু থাকত না। পাণ্ডিত্যের ঘোরে এই কঠোর সত্যটি বিস্মৃত হওয়া আমরা মোটেই সমীচীন মনে করি না।
এরপর আসে আর এক কথা। অশোক রুদ্র বলেছেন—
এ কথা সকলেরই জানা যে, জাতীয়তাবাদ বলতে এখন যা বোঝানো হয় তার কোন চিহ্নই দুনিয়ার কোথাও উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে ছিল না। ১৮৪৮-এর সময় থেকে শুরু করে এই চেতনাকে ইউরোপীয় দেশগুলিতে ক্রমে ক্রমে বিকশিত হতে দেখা যায়। ইউরোপের বাইরে অন্যত্র কোথাও বিংশ শতাব্দীর আগে এই চেতনা প্রসার লাভ করেনি।
এসব কথা বলে অশোক রুদ্র ইতিহাস জ্ঞান ও তাত্ত্বিক কৃতিত্বের যে পরিচয় প্রদান করেছেন তা সত্যিই চমকপ্রদ এবং তুলনাহীন। ‘সকলেরই জানা’ এ কথা বলে জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে তিনি যে, ‘তথ্য’ এখানে পরিবেশন করেছেন, সেটা আমার অন্তত জানা নেই। কারণ আমি জানি যে, ‘জাতীয়তাবাদ বলতে এখন যা বোঝায় -এ কথার অর্থে যদি ১৮৮১ সালে ভারত, বাংলাদেশ ইত্যাদি দেশের মুৎসুদ্দী জাতীয়তাবাদ বোঝানো যায় তাহলে এই ধরনের জাতীয়তাবাদ নিশ্চয়ই ১৮৪৮ সালের পূর্বে ইউরোপে অথবা দুনিয়ার অন্য কোথাও ছিলো না। থাকা সম্ভব নয়। কারণ পুঁজিবাদের বিকাশ ও তার সাম্রাজ্যবাদের পরিণত হওয়ার সাথে সাথে জাতীয়তাবাদেরও রূপান্তর ঘটেছে। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, ১৮৪৮ সালের পূর্বে বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদ বলে কিছু ছিলো না। তা যদি না থাকবে তাহলে আমেরিকায় স্বাধীনতা সংগ্রাম কারা করেছিলো, যাকে মার্কস “Despot of the word market” বলেছেন সেই ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে নেপোলিয়নিক ফ্রান্স Continental system কেন প্রবর্তন করেছিলো এবং মার্কস এঙ্গেলস বা কেন ১৮৪৮-এ লিখিত কমিউনিস্ট ইশতেহারে বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদের বিপরীত সর্বহারার আন্তর্জাতিকতাবাদের কথা বলেছিলেন? সর্বহারার আন্তর্জাতিকতাবাদ কি বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদের ঐতিহাসিক পূর্ববর্তী? এ জন্যই বলেছি যে, অশোক রুদ্রের পাণ্ডিত্যে আমি রীতিমতো অভিভূত!
এই পাণ্ডিত্যের জের টেনে তিনি আরও বলেছেন যে, ইউরোপের বাইরে অন্যত্র কোথাও বিংশ শতাব্দীর আগে এই চেতনা প্রসার লাভ করেনি।’ এই ‘তথ্যও’ তাঁর অগাধ ঐতিহাসিক পাণ্ডিত্যের এক উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। বিংশ শতাব্দীর পূর্বে জাতীয়তাবাদ ইউরোপের বাইরে যদি প্রসার লাভ না করে থাকে তাহলে অন্য দেশের কথা বাদ দিলেও ১৮৮৫ সালে ভারতে ‘ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস’ নামে একটি জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠিত হলো কেমন করে?
অশোক রুদ্র জাতীয়বাদের প্রশ্নটি তুলেছেন ঊনিশ শতকের বুদ্ধিজীবীদের বৃটিশ-প্রীতি ও তাদের বৃটিশ-তোষণ সম্পর্কে আমার বক্তব্যে রুষ্ট হয়ে। এ প্রসঙ্গে তাই তিনি বলেছেন যে, বিপ্লব ও বিদ্রোহের মধ্যে পার্থক্য আমরা বুঝি না। শুধু তাই নয়, এ পার্থক্যটা ঠিক কি সেটা তিনি আমাদের মতো অর্বাচীনকে বুঝিয়ে দিয়েছেন এবং বোঝাতে গিয়ে বেশ কয়েকটি বিদ্রোহের কথা তিনি উল্লেখ করেছেন। যার মধ্যে সিপাহী বিদ্রোহ একটি। বিপ্লবী না হলেও এইসব বিদ্রোহীরা নমস্য ব্যক্তি এ-কথাও তিনি বলেছেন। তারপর তাঁর বক্তব্য হলো এই যে:
এই সব বিদ্রোহী বীরদের নাম করে যাঁরা রামমোহন বিদ্যাসাগরের ঐতিহাসিক ভূমিকাকে সংক্ষেপে নস্যাৎ করে দেন তাঁরা ভুলে যান যে, ঐ বিদ্রোহগুলির দ্বারা সমাজে কোন বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসেনি, আসা সম্ভবও ছিল না। অপরদিকে যে সকল সমাজ সংস্কারের লক্ষ্য নিয়ে রামমোহন বিদ্যাসাগর প্রমুখরা সামাজিক আন্দোলনে নেমেছিলেন তারা ছিলো সমাজকে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য আবশ্যক এক একটি ধাপ বিশেষ।
প্রথমতঃ, আমার পুস্তকটিতে ‘এই সব বিদ্রোহী বীরদের নাম করে রামমোহন বিদ্যাসাগরের ঐতিহাসিক ভূমিকাকে মোটেই ‘নস্যাৎ’ করা হয়নি। এ বিষয়টি উল্লিখিত পুস্তকের যে কোন সতর্ক এমন কি গড়পড়তা পাঠকের কাছেও পরিষ্কার হয়ে যাবে। অশোক রুদ্রের কাছেও হবে যদি তিনি পুরো পুস্তকটি একবার পাঠ করে দেখেন। দ্বিতীয়তঃ, ‘ঐ বিদ্রোহগুলির দ্বারা’ সমাজে কোন তাৎক্ষণিক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসেনি এবং আসা সম্ভব ছিলো না এ কথা সত্য। কিন্তু সেই তাৎক্ষণিক পরিবর্তন কি ঊনিশ শতকের সমাজ সংস্কারের দ্বারা এসেছিলো?—না সেটাও আসেনি।
এখানে যে বিষয়টি লক্ষ্য করার বিষয় তা হলো এই যে, আমার পুস্তকটিতে সমাজ পরিবর্তনের প্রক্রিয়ায় ঔপনিবেশিকতাবাদ-বিরোধী বিদ্রোহ এবং সমাজ সংস্কার উভয়ের ভূমিকাই খুব স্পষ্ট নির্দেশ করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে যে, প্রথমোক্ত প্রক্রিয়ায় সমাজ সংস্কারকদের কোন স্থান ছিলো না। উপরন্তু তাঁরা ছিলেন অনেকাংশে সেই প্রক্রিয়ার বিরোধী। অন্যদিকে দ্বিতীয়োক্ত প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে তাঁদের ভূমিকা ছিলো যথেষ্ট উল্লেখযোগ্য। তাই রামমোহন, বিদ্যাসাগর এবং অন্য অনেকের ভূমিকা এ ক্ষেত্রে আমি খুব নির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করেছি। বিশেষতঃ বিদ্যাসাগরের ভূমিকার উল্লেখ আমি যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গেই করেছি। এ বিষয়ে আমার পুস্তকটি থেকে পূর্ব দুটি উদ্ধৃতি দিয়েছি। এখানে আরও কয়েকটি উদ্ধৃতি দিলেই সমাজ সংস্কারদের আমি কিভাবে ‘নস্যাৎ’ করেছি সেটা স্পষ্টভাবে বোঝা যাবে
সতীদাহ নিবারণ রামমোহনের সর্বপ্রধান সমাজ-সংস্কারমূলক কাজ হলেও তাঁর সংস্কার কাজ এই একটি মাত্র ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ ছিলো না। স্ত্রীশিক্ষা, বাংলা গদ্যের সংস্কার, বিজ্ঞানের চর্চা, সংবাদপত্র ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা (তা যত সীমাবদ্ধ ক্ষেত্রেই হোক না কেন) ইত্যাদি বিষয়ে তিনি উৎসাহী ছিলেন এবং তার জন্য অনেক যত্ন ও পরিশ্রম স্বীকার করেছিলেন। তৎকালীন সামাজিক কাঠামোর মধ্যে এইসব প্রচেষ্টার ভূমিকা নিঃসন্দেহে অনেকখানি প্রগতিশীল ছিলো। (পৃ ২৪)
শ্রেণীবদ্ধতা সত্ত্বেও বিদ্যাসাগর নিজের শ্রেণীকে অন্যান্য বহু রক্ষণশীল হিন্দু ও মুসলমান সমাজ নেতাদের মতো সামন্তবাদের খুঁটিতে বেদম জোরে বেঁধে রাখার চেষ্টা তো করেনইনি, উপরন্তু ঊনিশ শতকের মধ্যশ্রেণী সামন্তবাদের যে গাঁটছড়ায় আবদ্ধ ছিলো সেই গাঁটছড়া ছিঁড়ে ফেলতে সম্ভব না হলেও, তাকে অনেকখানি আলগা করার চেষ্টাতেই নানাভাবে নিযুক্ত ছিলেন। (পৃ ৪৪)
বিধবাবিবাহ প্রচলনকে বিদ্যাসাগর নিজের জীবনের ‘সর্বপ্রধান সৎকর্ম’ বলে বর্ণনা করেছিলেন। কিন্তু শিক্ষা-সংস্কারকে তিনি বর্ণনা করেছিলেন নিজের জীবনের ‘প্রিয়তম উদ্দেশ্য’ বা ‘Darling object’ বলে। এই প্রিয়তম উদ্দেশ্য সাধন প্রচেষ্টার দ্বারাই বিদ্যাসাগর তাঁর জীবনের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন। (পৃ ৪৬)
এই দুই প্রক্রিয়া সম্পর্কে মার্কসের ধারণা খুব স্পষ্ট ছিলো বলেই অশোক রুদ্রের ভাষায় মার্কস ‘বৃটিশ শাসকদের প্রত্যক্ষ ভূমিকাকে শুকরোচিত বলে নিন্দা করলেও তিনি আশা করেছিলেন সাম্রাজ্যবাদে ভারতবর্ষের তৎকালীন জরাগ্রস্ত সমাজ ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে প্রগতির পথই খুলে দেবে।’ মার্কসের এই আশাবাদের মধ্যে কোন ‘ভ্রান্তি’ ছিলো না এবং যে প্রক্রিয়াকে লক্ষ্য করে মার্কস এ কথা বলেছিলেন, উনিশ শতকের সমাজ সংস্কারকরা ছিলেন সেই প্রক্রিয়ারই অন্তর্গত। কিন্তু এখানে লক্ষণীয় যে, এই একটি প্রক্রিয়ার মধ্যেই মার্কসের উপলব্ধি সীমাবদ্ধ ছিলো না এবং তা ছিলো না বলেই তিনি অপর প্রক্রিয়াটি সম্পর্কে অবহিত থেকেই সিপাহী বিদ্রোহের গতিপ্রকৃতি গভীর অভিনিবেশ সহকারে বিশ্লেষণ করেছিলেন এবং সেই বিদ্রোহকে ভারতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধ হিসেবে আখ্যায়িত করে তার প্রতি পূর্ণ সমর্থন জ্ঞাপন করেছিলেন।
অশোক রুদ্রের সমালোচনামূলক প্রবন্ধটিতে চিন্তার আরও অনেক খোরাক আছে। তার সব কয়টির উল্লেখ ও আলোচনা এখানে সম্ভব নয় এবং তার প্রয়োজনও নেই। তাই আর একটি বিষয়ের উল্লেখ করেই আমার বক্তব্য শেষ করবো। তিনি বলছেন,
মুশকিল হচ্ছে এই যে, ঊনবিংশ শতাব্দীর বিচারে যাঁরা বসেন তাঁদের প্রাক্-বৃটিশ ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থা সম্পর্কে চিন্তার ঘরে রয়েছে এক বিরাট শূন্য। এঁদের অনেকের আলোচনা থেকে মনে হয় যে ইতিহাস শুরু হয় চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত থেকে, তার আগে কিছুই ছিলো না। …এই ঐতিহাসিকদেরও ইতিহাসের হিসেব খাতায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ছাড়া আর কোন ঘটনার উল্লেখ নেই। ফলে যে কোন জিনিসের ব্যাখ্যা চাওয়া হোক, তাঁদের উত্তর সর্বদাই এক—‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। বাঙালী মধ্যবিত্ত কেন ছিলো বৃটিশ শাসন বিরোধিতায় বিমুখ? চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। কেন সেই জাতীয়তাবাদ ছিলো ‘সাম্প্রদায়িক হলাহলে পরিপূর্ণ? আবারও চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। ঐ জাতীয়তাবাদ পরবর্তীকালে যে সন্ত্রাসবাদীদের জন্ম দেয় তার মূলে ছিলো কী? অবশ্যই চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত।
বাঙালী মধ্যবিত্তের বৃটিশ শাসন বিরোধিতায় পরোন্মুখতা, ভারতে সাম্প্রদায়িকতার উত্থান ও সন্ত্রাসবাদের জন্ম প্রসঙ্গে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের উল্লেখ যে অশোক রুদ্রকে যথেষ্ট উত্তেজিত করেছে সেটা বোঝা গেলো। তাই তিনি আরও বলেছেন,
বলাই বাহুল্য ঊনবিংশ শতাব্দীর সমাজ সংস্কারের নেতারা যে কৃষক স্বার্থ সম্পর্কে উদাসীন ছিলেন তার ব্যাখ্যা হিসেবে তাঁদের জমিদার শ্রেণীভুক্ত হওয়াটা গ্রাহ্য। কিন্তু চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের আগে কৃষকদের অবস্থাটা কী রকম ছিল? তাদের তখন কি ছিল গোলাভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ, তাদের মাঠ ঘাট কি ছিল ধনধান্যে পুষ্পে ভরা, সমাজ জীবন কি ছিল অত্যাচারহীন, শোষণহীন, আনন্দ উৎসবময়? এই বিষয়ে সমালোচকরা অবলম্বন করেন এক গভীর নীরবতা। নীরব থাকাই অবশ্য ভালো। কারণ প্রাক-বৃটিশ ভারতীয় সমাজের পটভূমিকাকে সার্থকভাবে ব্যবহার করতে হলে যে ঐতিহাসিক তথ্য আহরণ ও তাদের তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করার প্রয়োজন রয়েছে, সেই কাজটার কথা চিন্তাও করা হয় না।
অশোক রুদ্রের এই সব বক্তব্যের সঙ্গে পরিচিত হয়ে আমার মনে হচ্ছে বাঙালী মধ্যবিত্তের বৃটিশ বিরোধিতায় পরোান্মুখতার কারণ মোগল ভূমিব্যবস্থা। সেই মধ্যশ্রেণীর জাতীয়তাবাদ সাম্প্রদায়িক হলাহলে পরিপূর্ণ হওয়ার কারণ আওরঙ্গজেবের প্রবর্তিত জিজিয়া এবং তাদের সন্ত্রাসবাদের কারণ শিবাজীর মোগল বিরোধী রণকৌশল!
আমাদের সমালোচক ইতিহাস জ্ঞান সম্পর্কে অনেক কথাই বলেছেন কিন্তু এ কথা সম্পূর্ণ ভুলে গেছেন যে, যে সমস্যাগুলি আমরা আলোচ্য পুস্তকে আলোচনা করেছি সেগুলি মূলতঃ ঊনিশ শতকের এবং সেই শতকে চিরস্থায়ী ভূমি ব্যবস্থাই ছিলো মধ্যশ্রেণীর আর্থিক জীবনের মূল ভিত্তি। সেই ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে থাকা সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক উপরিকাঠামোর একটি সংক্ষিপ্ত আলোচনাই আমরা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও ঊনিশ শতকের বাঙালী সমাজ-এ করেছি, আমাদের হয়তো বা জানা নেই যে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পূর্বে কৃষকের ‘গোলাভরা ধান, পুকুরে মাছ,’ ইত্যাদি ছিলো না। কিন্তু সেটা জানা থাকলেও আমাদের আলোচনার ক্ষেত্রে তা প্রাসঙ্গিক হতো না, পাণ্ডিত্যপূর্ণ বাগাড়ম্বর সৃষ্টি করতো মাত্ৰ।
আমরা পণ্ডিত নই। তাই পাণ্ডিত্যপূর্ণ বাগাড়ম্বর সৃষ্টির আমরা বিরোধী।
[২৮.৫.১৯৮১]
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন