বদরুদ্দীন উমর
ঊনিশ শতকের সংস্কারক ও চিন্তানায়কদের সমাজ সংস্কার এবং ধর্মচিন্তা, সমাজচিন্তা, দার্শনিক ও রাজনৈতিক চিন্তা সম্পর্কে ইদানীং ব্যাপকভাবে কিছু আলোচনার সূত্রপাত হয়েছে। এইসব সাম্প্রতিক আলোচনাকে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কতকগুলি রাজনৈতিক ক্রিয়া এবং তার প্রতিক্রিয়া হিসেবে বিভক্ত করা চলে।
বাঙলাদেশে পীর মুর্শিদ অবতারের প্রভাব এখনো সাধারণ মানুষের জীবনে ও চিন্তায় একটা বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছে। চিন্তার এই কাঠামো সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থেকেই বাঙলা ভাষাভাষী অঞ্চলের শাসকশ্রেণীসমূহ এখন নোতুন উদ্যমে ঊনিশ শতকের সমাজ সংস্কারক ও চিন্তানায়কদের প্রায় অবতার রূপে চিত্রিত করে তার মাধ্যমে রাজনৈতিক ফায়দা ওঠাতে সচেষ্ট হয়েছে। যাঁরা রাজনীতিগতভাবে এই শাসক শোষক শ্রেণীসমূহের বিরুদ্ধে তাঁদের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই এর একটা প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। তাঁরাও এই আধুনিক অবতারবাদকে খণ্ডন করতে বদ্ধপরিকর হয়ে নিজেদের দৃষ্টিকোণ থেকে রামমোহন, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ প্রভৃতির মূল্যায়নে প্রবৃত্ত হয়েছেন।
এসবের ফলে একদিকে যেমন দেখা যাচ্ছে, শাসক শ্রেণীসমূহ এবং সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রতিপালিত এক শ্রেণীর লেখকরা (যার মধ্যে মার্কসবাদী হিসেবে পরিচয়দানকারী এক ধরনের বুদ্ধিজীবীরাও আছেন) রামমোহন, বিদ্যাসাগর, বঙ্কিম, বিবেকানন্দ প্রমুখের চিন্তাকর্মের শ্রেণী বিচারের ও শ্রেণী পরিধি নির্দিষ্টকরণের বিরোধিতা করে তাঁদের বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের জনগণের সামনে আদর্শ পুরুষ হিসেবে উপস্থিত করতে চাইছেন। অন্যদিকে, তেমনই দেখা যাচ্ছে রাজনৈতিক দিক দিয়ে যাঁদের অবস্থান শাসক-শোষক শ্রেণীসমূহের বিরুদ্ধে তাঁরা এই সমস্ত সমাজসংস্কারক ও লেখকদের ঠিক ঊনিশ শতকের মানুষ হিসেবে না দেখে তাঁদেরও যে একটা শ্রেণী পরিধি ছিলো এ কথা অনেকাংশে ভুলে গিয়ে এমনভাবে তাঁদের সমালোচনায় নিযুক্ত হচ্ছেন যেন তাঁরা বিশ শতকের এবং আমাদেরই সমসাময়িক। শুধু তাই নয়, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে যে, তাঁরা ঊনিশ শতকীয় সমাজ সংস্কারকে এবং দার্শনিক ও ধর্মচিন্তায় নিযুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে সত্যিকার কোন তারতম্য নির্দেশ করতে অক্ষম হয়ে বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ প্রমুখের যথেষ্ট সমালোচনা করে তাঁদের প্রস্তরমূর্তি চূর্ণ করলেও বঙ্কিমচন্দ্র এবং বিবেকানন্দকে তাঁরা মোটামুটি ক্ষমার চোখেই দেখছেন। সমালোচনার ক্ষেত্রে এই বিড়ম্বনার পরিণামে তাঁদের সমালোচনা যে পরোক্ষভাবে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিসমূহের হাতকেই জোরদার করছে সে কথা বলাই বাহুল্য।
সমালোচনার ক্ষেত্রে এইসব বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারী দৃষ্টিভঙ্গীর ঊর্ধ্বে উঠতে না পারলে আলোচনা একদিকে যেমন বিজ্ঞানসম্মত হবে না, অন্যদিকে তেমনই তার দ্বারা লাভের থেকে ক্ষতির পাল্লাই ভারী হবে বেশী।
এই বিভ্রান্তির নিরসন কিভাবে ঘটানো যায় সে বিষয়ে তত্ত্বের ক্ষেত্রে সাধারণভাবে অবশ্য কোন মতানৈক্য নেই। প্রায় সকলেই এক বাক্যে বলবেন যে, দৃষ্টিভঙ্গীকে বিজ্ঞানসম্মত করতে হলে তৎকালীন পরিপ্রেক্ষিতের ধারণা দরকার এবং তার জন্যে আবার দরকার ঊনিশ শতকীয় বাঙলাদেশের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থার সঙ্গে পরিচিত হওয়া। কিন্তু এই মতৈক্য সত্ত্বেও বাস্তব ক্ষেত্রে এর ঠিক বিপরীতটিই দেখা যায়। কাজেই অধিকাংশ সমালোচকই হয় জনগণকে ঊনিশ শতকে টেনে নিয়ে গিয়ে তাঁদের তৎকালীন সামাজিক রাজনৈতিক ও ধর্মীয় খুঁটিতে বেঁধে রাখার চেষ্টা করেন, নতুবা তাঁরা রামমোহন, বিদ্যাসাগর প্রমুখকে বিশ শতকের সত্তরের দশকে টেনে এনে তাঁদেরকে কাঠগড়ায় দাঁড় করান। উপরে উল্লিখিত ঐতিহাসিক ব্যক্তিদের কার অবস্থান ঠিক কোথায় সেটা নির্ণয়ের জন্যে দরকার ঊনিশ শতকের বাঙলার আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামোর চরিত্র নির্দেশ এবং সেই কাঠামোর মধ্যে প্রগতিশীলতার অর্থ ও সেই সঙ্গে তার যথার্থ সীমা ও পরিধি নির্ণয় করা। একমাত্র এ কাজটি উপযুক্তভাবে করতে পারলেই ঊনিশ শতকের পরিপ্রেক্ষিতে ঊনিশ শতকের ব্যক্তিদের কর্মকাণ্ডের প্রগতিশীল ও প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্র নির্ণয় ও নির্ধারণ যথাযথভাবে সম্ভব হবে।
ঊনিশ শতকের বাঙলাদেশের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামোর সঙ্গে পরিচিত হতে হলে প্রথমেই মনে রাখা দরকার যে, বাঙলাদেশ তখন ইংরেজের অধীন এবং ইংরেজ প্রবর্তিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত তখন এ দেশের জনগণের আর্থিক জীবনের মূল ভিত্তি।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বাঙলাদেশের আর্থিক জীবনে নোতুনভাবে দুটি পরস্পর বিরোধী শ্রেণীর সৃষ্টি করেছিলো। একটি, বন্দোবস্তের দ্বারা উপকৃত জমিদার শ্রেণী; অপরটি তার দ্বারা উৎপীড়িত ও ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক শ্রেণী। একদিকে এই জমিদার শ্রেণী যেমন ছিলো ঊনিশ শতকের নবোত্থিত বাঙালী মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মেরুদণ্ড; অন্যদিকে তেমনই জমিদার শ্রেণীর সাথে মধ্যশ্রেণীর এই সম্পর্কই ছিলো শ্রেণী হিসেবে মেরুদণ্ডহীনতার কারণ।
স্বাধীন ব্যবসা, বাণিজ্য, শিল্পের ওপর নির্ভরশীল হতে না পেরে ইংরেজ-সৃষ্ট জমিদারীর ওপর মূলতঃ নির্ভরশীল থাকার ফলে মধ্যশ্রেণীর আর্থিক জীবনের এই দুর্বলতাই তার মধ্যে সৃষ্টি করেছিলো ইংরেজ রাজত্বের প্রতি আনুগত্য। ইংরেজ রাজত্ব তাই তাদের কাছে আশীর্বাদস্বরূপ।
কৃষক শোষণের ওপর ভিত্তি করে যে মধ্যশ্রেণী তখন দাঁড়িয়েছিলো সে শ্রেণী যে সাধারণভাবে কৃষক সমাজের সুখ দুঃখের সাথে নিজেকে জড়িত করবে না, উপরন্তু কৃষক-স্বার্থকে খর্ব করে নিজের স্বার্থকে রক্ষা ও সম্প্রসারণ করতে সচেষ্ট থাকবে সেটাই স্বাভাবিক এবং ঊনিশ শতকের আর্থ-সামাজিক পরিবেশে সেই স্বাভাবিক জিনিসটিই ঘটেছিলো। এই জন্যেই দেখা যায় যে, তৎকালে বাঙলাদেশে যে সমস্ত কৃষক বিদ্রোহ হয়েছিলো সেগুলি একদিকে যেমন জমিদার শ্রেণী ও তাদের রক্ষক বৃটিশ শাসনের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়েছিলো, অন্যদিকে তেমনি সেইসব বিদ্রোহ জমিদার শ্রেণী এবং তার সাথে প্রায় একাত্ম মধ্যশ্রেণীকে করেছিলো কৃষক-স্বার্থের প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ বিরোধী এবং বৃটিশ শাসনের প্রতি অধিকতর অনুগত।
নীলকর সাহেবদের নীল চাষ এবং তার সাথে সম্পর্কিত নির্যাতন মধ্যবিত্ত ও জমিদার স্বার্থকেও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করার ফলে একমাত্র নীল বিদ্রোহের সময়েই শহরকেন্দ্রিক মধ্যবিত্তেরা, বিশেষতঃ কলকাতার মধ্যবিত্তেরা, এই বিদ্রোহের প্রতি কিছু প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমর্থন দান করেছিলো। সেখানেও এ কথা মনে রাখা দরকার যে, নীল বিদ্রোহ, বারাসতের কৃষক-বিদ্রোহ, ফরিদপুরের ফারায়েজী বিদ্রোহ অথবা সাঁওতাল বিদ্রোহের মতো ইংরেজের বিরুদ্ধে ততখানি ব্যাপক ও তীব্র সশস্ত্র বিদ্রোহ ছিলো না। উপরন্তু এই বিদ্রোহ ছিলো অর্থনৈতিক গণ্ডীর মধ্যে সীমাবদ্ধ। এদেশ থেকে ইংরেজের রাজশক্তি উচ্ছেদের মতো কোন রাজনৈতিক লক্ষ্য এর ছিলো না। শেষ পর্যায়ে কিছুটা সশস্ত্র আকার ধারণ করলেও নীল বিদ্রোহ অনেকাংশে কৃষক ধর্মঘটের মতো। কৃষকরা নীলকরদের অধীনে নীলের জন্যে জমি আবাদ করতে অস্বীকার করার ফলেই বিদ্রোহের সূত্রপাত এবং সেই অস্বীকৃতির দ্বারাই নীল বিদ্রোহের সীমা মোটামুটি নির্দিষ্ট। আর একটি কারণেও নীল বিদ্রোহের ক্ষেত্রে মধ্যশ্রেণীর সমর্থন সম্ভব হয়েছিলো। সে কারণটি হলো এই যে, নীলকর সাহেবদের নীল চাষের ব্যাপারে কলকাতার ইংরেজ সমাজ এবং সরকারী প্রশাসনও ঊনিশ শতকের পাঁচের দশকে পুরোপুরি একমত ছিলো না। তাদের মধ্যেও এ বিষয়ে মতানৈক্যের ফলে নীল বিদ্রোহের প্রতি তাদের একাংশের পরোক্ষ সমর্থন ছিলো। এই সমর্থন যে মেরুদণ্ডহীন ভূসম্পত্তি-সচেতন কলকাতার মধ্যবিত্তের একাংশের অন্তরে বিদ্রোহের প্রতি প্রকাশ্য সমর্থন দান করতে প্রেরণা যুগিয়েছিলো সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ভূমি অর্থনীতির ভিত্তিতে এবং ইংরেজ শাসনের রাজনৈতিক কাঠামোর মধ্যে ঊনিশ শতকের বাঙলাদেশে এই মধ্যশ্রেণীর উত্থান তৎকালে যে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের জন্ম দিয়েছিলো তাকে সাধারণত বাঙালী জাতির রেনেসাঁস বলে আখ্যায়িত করা হয়। অন্ততঃ কিছুকাল আগে পর্যন্ত তাকে নির্বিবাদে এই আখ্যায় ভূষিত করা হতো।
পূর্বোক্ত আন্দোলনকে এইভাবে আখ্যায়িত করার ফলে একদিকে যেমন ইতিহাসকে এতকাল কদর্যভাবে বিকৃত করা হয়েছে, অন্যদিকে তেমনই সেই আন্দোলন হতে উদ্ভূত বহু প্রতিক্রিয়াশীল ভাবধারা এবং নোতুনতর সামাজিক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্রকে উদ্ঘাটন না করে তাকে প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে। বাঙলাদেশ ও ভারতের সামাজিক সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আবহাওয়া এই মূল্যায়ন ও আখ্যার দ্বারা যে কতখানি দূষিত হয়েছে এবং এদেশের গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল রাজনীতি যে তার দ্বারা কতখানি বিভ্রান্ত ও বিপথগামী হয়েছে তার সঠিক পরিমাপ এখনো সম্ভব হয়নি। এই কারণে শুধু রামমোহন, বিদ্যাসাগর, বঙ্কিম প্রভৃতি ঊনিশ শতকীয় ব্যক্তিদের অবস্থান নির্ণয়ের জন্যেই যে রেনেসাঁস নামে কথিত আন্দোলনের পর্যালোচনা প্রয়োজন তাই নয়, বর্তমান বাঙলাদেশের এবং ভারতের রাজনৈতিক অবস্থার সঠিক উপলব্ধির জন্যেও তার প্রয়োজন অপরিহার্য।
ঊনিশ শতকের এই আন্দোলনকে রেনেসাঁস আখ্যা দেওয়া কেন চলে না, সেই আলোচনার পূর্বে ইউরোপীয় রেনেসাঁসের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলি দেখা দরকার।
প্রথমতঃ, ইউরোপীয় রেনেসাঁস (এরপর থেকে শুধু রেনেসাঁস নামে উল্লেখ করা হবে) ইতালীতে পনেরো শতকের দিকে যখন শুরু হয় তখন সেখানে সামন্তবাদের অবক্ষয় শুরু হয়েছে। বাণিজ্যিক বুর্জোয়া শ্রেণীই ছিলো সেই আন্দোলনের চালিকাশক্তি। এই বাণিজ্যিক বুর্জোয়াদের দ্বারাই সেকালে ইউরোপীয় বুর্জোয়া সমাজের প্রাথমিক ভিত্তি স্থাপিত হয়। ভূমিস্বার্থের সঙ্গে এই বুর্জোয়া শ্রেণীর কোন সংযোগ ছিলো না বলে নিপীড়িত ভূমিদাসদের সামন্ত শোষণের বিরুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করে তাদের অর্থনৈতিক বিপ্লবের আবর্তের মধ্যে টেনে আনতে তারা সক্ষম হয়েছিলো। অর্থাৎ এই পর্যায়ে বাণিজ্যিক বুর্জোয়া শ্রেণী এবং ভূমিদাস শ্রেণী একত্রে সামন্তবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে নিযুক্ত হয়েছিলো এবং তার অবক্ষয়কে ত্বরান্বিত করেছিলো।
দ্বিতীয়তঃ, রেনেসাঁসের সময় ইতালীতে মধ্যযুগীয় দর্শনের প্রভাব বর্তমান থাকা সত্ত্বেও তার সঙ্গে সমান্তরালভাবে সেখানে এক নোতুন মানবতাবাদী সংস্কৃতির উন্মেষ হয়। ফলে একদিকে যেমন প্রাচীনকালের বিশেষতঃ প্রাচীন গ্রীসের, দার্শনিক চিন্তাধারার পুনরুজ্জীবন ঘটে অন্যদিকে তেমনি শুরু হয় বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার বিকাশ। সামাজিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে প্রগতিশীল শক্তিসমূহের সাথে একাত্মতা এবং বিজ্ঞানের এই অনুশীলনের ফলে প্রাচীন দর্শন-চর্চা রেনেসাঁসের নায়কদের পশ্চাৎমুখী না করে তাঁদের চিন্তাধারাকে করেছিলো সৃষ্টিশীল এবং প্রগতির বাহক। অর্থাৎ প্রাচীন দার্শনিক চিন্তা থেকে রস ও শক্তি সংগ্রহ করে রেনেসাঁসের নায়করা নিজেদের চিন্তা ও কর্মের মাধ্যমে সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাষ্ট্রনৈতিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে সহায়ক হয়েছিলেন।
তৃতীয়তঃ, রেনেসাঁসের সময় নোতুনভাবে জীবন ও প্রকৃতি সম্পর্কে যে দার্শনিক চিন্তা শুরু হয় সে চিন্তা বাইবেলের তত্ত্বসমূহের ভ্রান্তি উদ্ঘাটন করে তৎকালে প্রচলিত ক্যাথলিক ধর্মের নৈতিকতার মূলে দারুণ আঘাত করে। এর দ্বারা একদিকে বস্তুবাদী দর্শনের প্রভাব এবং অন্যদিকে বৈজ্ঞানিক অনুশীলনের ব্যাপকতা বৃদ্ধি পায়।
চতুর্থত, আর্থ-সামাজিক জীবনে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের প্রক্রিয়া বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে যুক্ত হয়ে সেকালে সমাজ সম্পর্কেও নানা যুগান্তকারী চিন্তাধারার প্রবর্তন করে। এর ফলে সামন্তবাদী মূল্যবোধ এবং আর্থিক জীবনের ভিত্তিতে গঠিত প্রচলিত সামাজিক ও দার্শনিক চিন্তার কাঠামো চূর্ণ হয়।
পঞ্চমত, সামন্তবাদ ও ক্যাথলিক ধর্মের ওপর এই আঘাত চার্চ ও রাষ্ট্রের সম্পর্ককে আমূলভাবে পরিবর্তিত করতে সাহায্য করে। এই পরিবর্তনই রাষ্ট্রকে ধর্মীয় প্রভাবমুক্ত করে ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য ও জাতীয় রাষ্ট্রের উৎপত্তি ও বিকাশ ঘটায়।
রেনেসাঁস শুরু হওয়ার প্রায় একশ বছর পর তার সঙ্গে সমান্তরালভাবে ইউরোপে শুরু হয় রিফরমেশন বা ধর্ম-সংস্কার আন্দোলন। এই আন্দোলনও একদিকে ছিলো সামন্ত-বিরোধী এবং অন্যদিকে সরাসরি ক্যাথলিক চার্চ-বিরোধী। বস্তুতঃপক্ষে, রেনেসাঁসের মধ্যে দিয়ে সামন্ত বিরোধী চিন্তাধারা, বস্তুবাদী দর্শন এবং বৈজ্ঞানিক অনুশীলনের সূত্রপাত হয়েছিলো, রিফরমেশন ছিলো ধর্মীয় আন্দোলনের ক্ষেত্রে তারই অবশ্যম্ভাবী পরিণতি। এ জন্যে রিফরমেশন শুরু হওয়ার সময় ইউরোপে বুর্জোয়া চিন্তা অপেক্ষাকৃত গভীরতা ও প্রসারতা লাভ করে। অর্থনৈতিক জীবনেও যে পরিবর্তন আসে সেটাও খুব ব্যাপক।
রিফরমেশন একটি ধর্মীয় আন্দোলন হলেও ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলিকে পোপের প্রভাব থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত করতে গিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে ধর্মেরও প্রভাব খর্ব করতে সহায়তা করে। এ ছাড়া সাধারণভাবে সমাজে চার্চের প্রভাব কমে আসাতে পূর্বে বস্তুবাদী চিন্তা ও বৈজ্ঞানিক অনুশীলনের ক্ষেত্রে চার্চ যে দুর্জয় বাধা সৃষ্টি করতো সে বাধাও অপসারিত হয়। এর ফলে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে দ্রুতগতিতে নানা মৌলিক বৈজ্ঞানিক সূত্র আবিষ্কৃত হতে থাকে এবং সেই সমস্ত আবিষ্কার ইউরোপীয় অর্থনীতির মধ্যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করে সেখানে ধনতন্ত্রের বিকাশ ঘটায় এবং প্রগতিশীল বুর্জোয়া সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করে।
ঊনিশ শতকের তথাকথিত বাঙালী রেনেসাঁসের চালিকাশক্তি অভিজাত ও মধ্যশ্রেণীর আর্থিক জীবনের ভিত্তি কি ছিলো, রামমোহন, দ্বারকানাথসহ তৎকালীন মুৎসুদ্দী শ্রেণীকে অনেকে বাণিজ্যিক বুর্জোয়া আখ্যা দিয়ে ইউরোপীয় বাণিজ্যিক বুর্জোয়ার সাথে তাঁদের তুলনা করেন। এই তুলনা খুবই বিভ্রান্তিকর। কারণ ইউরোপীয় বাণিজ্যিক বুর্জোয়ারা ছিলো নিজ নিজ দেশে স্বাধীন ব্যবসায়ী। তারা কোন বৈদেশিক বাণিজ্যিক স্বার্থ এবং বৈদেশিক শাসনের বন্ধনে আবদ্ধ ছিলো না; কিন্তু বাঙালি অভিজাত ও মধ্যশ্রেণীর ব্যবসায়ী স্বার্থ ছিলো বিদেশী ইংরেজের বাণিজ্য ও শাসন-স্বার্থের সাথে অবিচ্ছিন্নভাবে জড়িত। ইংরেজের স্বার্থ উদ্ধারের উদ্দেশ্যেই রামমোহনের মতো ব্যক্তি ইংরেজ কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন জানিয়েছিলেন বাঙলাদেশে লবণ প্রস্তুত বন্ধ করে ইংল্যান্ড থেকে লবণ আমদানীর। হয়েছিলোও তাই। এর ফলে একদিকে দেশীয় লবণ-শিল্পের উচ্ছেদ হয়েছিলো, লক্ষ লক্ষ লবণ-শিল্প-শ্রমিক বেকার হয়েছিলো এবং অন্যদিকে রামমোহনের শ্রেণীভুক্ত ব্যবসায়ীরা সেই ব্যবসায়ে অংশগ্রহণ করে ইংরেজের মুনাফার এক ক্ষুদ্র অংশ নিজেদের পাতে উঠিয়েছিলেন রামমোহন ও তাঁর শ্রেণীভুক্ত অন্যান্যদের এই কর্মের ফলে দেশীয় অর্থনীতির বিকাশ না ঘটে তার ধ্বংসের পথই প্রশস্ত হয়েছিলো।[১]
আর্থিক জীবনের দিক থেকে ইউরোপীয় বাণিজ্যিক বুর্জোয়া এবং বাঙালী অভিজাত ও মধ্যশ্রেণীর আর একটি মস্ত তফাৎ ছিলো। ইউরোপীয় বাণিজ্যিক বুর্জোয়ার কোন ভূমিস্বার্থ ছিলো না, কাজেই সামন্তবাদের ভিত্তি ক্রমশঃ ধ্বংস করে তারা নিজেদের শ্রেণীস্বার্থকে এগিয়ে নিয়েছিলো। বাঙালী অভিজাত ও মধ্যশ্রেণীর আর্থিক জীবনের মূল ভিত্তি হলো ভূমিস্বার্থ, যে স্বার্থ ছিলো আবার ইংরেজ-সৃষ্ট চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ওপর প্রতিষ্ঠিত।
ঊনিশ শতকের বাঙালী ব্যবসায়ী শ্রেণীর লোকেরা ইংরেজের মুৎসুদ্দী হিসেবেই নিজেদের ধন সম্পদ বৃদ্ধি করেন। তাঁরা অনেকে মনে করতেন, তাঁদের ধন সম্পত্তি বৃদ্ধির অর্থ দেশের সম্পদ বৃদ্ধি। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাঁরা ধন-সম্পত্তি অর্জন করেছিলেন সে প্রক্রিয়ার মধ্যে দেশীয় শিল্প, বাণিজ্য ও কৃষির ধ্বংসকে ত্বরান্বিত এবং দুর্দশাকে স্থায়ী করার ব্যবস্থা ছিলো। এ জন্যে দেখা যায় যে, বাঙালী অভিজাত ও মধ্যশ্রেণীর লোকেরা প্রথম দিকে ব্যবসা-বাণিজ্য করে কিছু ধন সম্পদ অর্জন করলেও পুরুষানুক্রমে তাঁরা এ দেশে ব্যবসায়ী পরিবার হিসেবে দাঁড়াতে সক্ষম হননি। ব্যবসার পাট উঠিয়ে জমি ও জমিদারী ক্রয় করেই নিজেদের আর্থিক জীবনের ধ্বংসকে তাঁদের রোধ করতে হয়েছিলো। রামমোহন, দ্বারকানাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে ইয়ংবেঙ্গল দলের মুখপাত্রদের প্রায় সকলেরই আর্থিক জীবনের এই একই পরিণতি ঘটেছিলো। যাঁরা চাকুরীতে নিযুক্ত ছিলেন তাঁদের মধ্যেও প্রায় সকলেরই (বিদ্যাসাগর, মাইকেল, অক্ষয় কুমার, দীনবন্ধু, হরিশচন্দ্র প্রভৃতির মতো অল্প কয়েক জনকে বাদ দিয়ে) আর্থিক জীবনের যোগ এইভাবে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ভূমি- ব্যবস্থার সঙ্গে স্থাপিত হয়েছিলো। অর্থাৎ আর্থিক জীবন ব্যবসা-বাণিজ্য চাকুরী ইত্যাদি অন্য যা কিছুর ওপরই নির্ভরশীল হোক সেকালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চুম্বকের মতো প্রত্যেকের আর্থিক জীবনকেই নিজের দিকে আকর্ষণ করতো এবং এই ভূমি-স্বার্থের জন্যে সেকালের মধ্যশ্রেণী শ্রেণীগতভাবে থাকতো কৃষক-স্বার্থের বিরোধী এবং সামন্তবাদের রক্ষক ও মুখপাত্র। এ দিক দিয়ে রেনেসাঁসের বাণিজ্যিক বুর্জোয়ার সাথে ঊনিশ শতকীয় বাঙালী মধ্যশ্রেণীর পার্থক্য যে আকাশ পাতাল সে বিষয়ে বিন্দুমাত্র কোন সন্দেহ নেই।
ইউরোপে রেনেসাঁস ও রিফরমেশনের দুটি স্বতন্ত্র ধারা ছিলো। পনেরো শতকে শুরু হয়ে রেনেসাঁস সতেরো শতকের গোড়া পর্যন্ত স্থায়ী হয়। রিফরমেশন ষোলো শতকে শুরু হয়ে লুথার, ক্যালভাঁ প্রমুখের নেতৃত্বে ঐ শতকেই একটা পরিণতি লাভ করে। সামন্তবাদ বিরোধিতা, বৈজ্ঞানিক অনুশীলনের পথ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পরিষ্কার করা, অভিজাততন্ত্রের বিরুদ্ধে কৃষক ও বুর্জোয়া শক্তিকে সংহত করা, রাষ্ট্রকে ধর্মের প্রভাব মুক্ত করা, জাতীয় রাষ্ট্রের উত্থানে সহায়তা ইত্যাদি দিক দিয়ে এই দুই আন্দোলনের মধ্যে অনেক সাদৃশ্য থাকলেও এই দুই আন্দোলনের ধারা ও নেতৃত্ব এক ছিলো না।
রিফরমেশনের মূল লক্ষ্য ছিলো প্রচলিত খৃষ্ট ধর্মের সংস্কার। এই সংস্কারের কাজ অন্য কতগুলি কাজকে বাদ দিয়ে সেকালে সম্ভব ছিলো না এবং এই অন্য কাজগুলিই পরোক্ষভাবে ইউরোপে সামন্তবাদ বিরোধিতা, বুর্জোয়া সংস্কৃতির বিকাশ, বিজ্ঞানের অনুশীলন, জাতীয় রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি ক্ষেত্রে সহায়ক হয়েছিলো। মূলতঃ ধর্মীয় আন্দোলন হওয়ার ফলেই আন্দোলনের নেতৃত্ব ছিলো মার্টিন লুথার, ক্যালভা প্রমুখ ধর্মীয় ব্যক্তিদের হাতে।
রেনেসাঁসের সাথে কোন ধর্মীয় আন্দোলনের যোগ ছিল না। এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সেকুলার সংস্কৃতির বিকাশ ঘটেছিলো এবং সামন্ত বিরোধিতা বাণিজ্যিক বুর্জোয়ার অর্থনৈতিক আত্মপ্রতিষ্ঠা, বিজ্ঞানের অনুশীলন ইত্যাদি সেই বিকাশকেই ত্বরান্বিত করেছিলো। রেনেসাঁস ধর্মীয় আন্দোলন ছিলো না বলে রেনেসাঁসের নেতারা সকলে ধর্মীয় চিন্তা সম্পর্কে উদাসীন না হলেও ধর্মীয় আন্দোলনের নেতা তাঁরা কেউই ছিলেন না। মূর, ক্যামপানেলা প্রমুখ রেনেসাঁসের নেতাদের সকলের ক্ষেত্রেই এ কথা প্রযোজ্য।
ঊনিশ শতকে বাঙালী মধ্যশ্রেণীর উত্থানের যুগে রামমোহন, দ্বারকানাথ, ডিরোজিও, কৃষ্ণমোহন, রামগোপাল ঘোষ, দেবেন্দ্রনাথ, বিদ্যাসাগর, অক্ষয় দত্ত, মাইকেল, ভুদেব মুখোপাধ্যায়, হরিশচন্দ্র, বঙ্কিম, দীনবন্ধু, বিবেকানন্দ প্রমুখকে ঢালাওভাবে তথাকথিত নবজাগরণের নেতা বলে আখ্যা দেওয়া তো হয়ই উপরন্তু তাঁদের মধ্যে ধর্মীয় আন্দোলনে নিযুক্ত ব্যক্তি এবং ধর্মীয় আন্দোলনের সঙ্গে সম্পর্কহীন ব্যক্তিদের কোন তফাৎ করা হয় না। এর ফলে দাঁড়ায় এই যে, রামমোহন, ডিরোজিও, বিদ্যাসাগর, বঙ্কিম, বিবেকানন্দ সকলেই নির্বিবাদে একই দলভুক্ত হয়ে বাঙালীর নবজাগরণের নায়ক হিসেবে আখ্যায়িত হন। এইভাবে দলবদ্ধ এবং আখ্যায়িত হওয়ার মূল কারণ এই যে, বাঙালী জাতির এই তথাকথিত নবজাগরণ ধর্মীয় চিন্তা ও কুসংস্কার দ্বারা এত প্রবলভাবে আচ্ছন্ন ছিলো যে ধর্মীয় আন্দোলনে নিযুক্ত ব্যক্তিদের থেকে অন্যদের পৃথক করার কোন জরুরী তাগিদ পরবর্তীকালে সমালোচকরাও তেমন অনুভব করেননি।
এ ক্ষেত্রে তাই একটি বিষয়ের উল্লেখ একেবারে অপরিহার্য। সে বিষয়টি হলো এই, ঊনিশ শতকের বাঙালী মধ্যবিত্তের নেতৃস্থানে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিরা ধর্মীয় আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থাকুন অথবা না থাকুন, তাতে নেতৃত্ব দেন অথবা নাই দেন, তাঁরা সকলেই জাতি ও ধর্ম সম্প্রদায়কে নিজেদের চিন্তায় এক করে দেখতেন। কাজেই জাতীয় উন্নতি ও মুক্তি বলতে তাঁরা নিজেদের ধর্মসম্প্রদায়ের উন্নতি ও মুক্তিকেই বোঝাতেন। এই দৃষ্টিভঙ্গীই রামমোহন, দেবেন্দ্রনাথ, বিদ্যাসাগর, বঙ্কিম, আবদুল লতিফ, আমীর আলী, বিবেকানন্দ প্রমুখের মাধ্যমে পত্রপল্লবে সুশোভিত হয়ে পরবর্তীকালে পরিণতি লাভ করেছিলো সাম্প্রদায়িকতায়। রাজনীতি ও ধর্ম পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন না হয়ে ধর্মাশ্রিত রাজনীতিই হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে বিস্তার করেছিলো ব্যাপক প্রাধান্য। এদিক দিয়েও রেনেসাঁসের পরিণতি এবং ঊনিশ শতকীয় বাঙালীর সংস্কৃতিচর্চার পরিণতির মধ্যে আমূল পার্থক্য।
এ পর্যন্ত যে আলোচনা হলো তাতে দেখা যাচ্ছে যে, বাঙালী মধ্যবিত্তের উত্থান ও প্রাথমিক প্রতিষ্ঠার যুগে বাঙালী মধ্যশ্রেণীর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ছিলো মূলতঃ তিনটি। প্রথমত, বিদেশী ইংরেজ শাসনের প্রতি আনুগত্য (যা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দাসসুলভ)। দ্বিতীয়ত, অর্থনৈতিক জীবনে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত-সৃষ্ট সামন্ত ভূমি ব্যবস্থার ওপর একান্ত নির্ভরশীল। তৃতীয়ত, সমাজ ও রাষ্ট্র সম্পর্কীয় চিন্তার ক্ষেত্রে ধর্ম ও সম্প্রদায়ের প্রবল প্রাধান্য (জাতিকে ধর্মসম্প্রদায়ের সাথে এক করে দেখার মধ্যে যে প্রাধান্যের প্রায় সর্বজনীন বহিঃপ্রকাশ)।
এখানে লক্ষণীয় বিষয় এই যে, উপরোক্ত তিনটি মূল চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য রেনেসাঁসের পূর্বোল্লিখিত বৈশিষ্ট্যসমূহের সম্পূর্ণ বিপরীত। কিন্তু তা সত্ত্বেও মধ্যশ্রেণীভুক্ত বুদ্ধিজীবীরা তাকে রেনেসাঁস বা নবজাগরণ আখ্যাই এতদিন দিয়ে এসেছেন।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন