বদরুদ্দীন উমর
রেনেসাঁসের সাথে উনিশ শতকীয় বাঙালী মধ্যশ্রেণীর আলোচ্য আন্দোলনের এত মৌলিক প্রভেদ সত্ত্বেও সেই আন্দোলনকে কি কারণে রেনেসাঁস বা নবজারণ আখ্যা দেওয়া হলো? কি কি লক্ষণ তার মধ্যে প্রকটিত হলো যার ফলে তার সাথে রেনেসাঁসের এই তুলনা?
প্রথমতঃ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সাদৃশ্যের কথা। বাঙালী নবজাগরণের প্রবক্তারা এই সাদৃশ্য দেখেছেন নোতুন এক শ্রেণীর ব্যবসায়ীর মধ্যে। কিন্তু এই ব্যবসায়ীরা কি ধরনের ব্যবসায়ী ছিলো? তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য কি ছিলো? কোম্পানীর দালাল মহারাজা নবকৃষ্ণ থেকে শুরু করে ইয়ংবেঙ্গল দলের রাজনৈতিক মুখপাত্র রামগোপাল ঘোষ পর্যন্ত যারা এই নোতুন বেনিয়ান ব্যবসায়ী শ্রেণীর অন্তর্গত তাঁদের সব থেকে উল্লেখযোগ্য চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হলো এই যে, ব্যবসায়ী হিসেবে তাঁরা কেউই প্রকৃত অর্থে স্বাধীন ছিলেন না। অর্থনৈতিক জীবনে এঁরা সকলেই মোটামুটিভাবে ইংরেজের ব্যবসায়িক স্বার্থের সাথে গাঁটছড়ায় বাঁধা ছিলেন। তাছাড়া সেকালের মধ্যশ্রেণীর আর্থিক জীবনের মূল ভিত্তি ব্যবসা-বাণিজ্য ছিলো না। সে ভিত্তি রচিত হয়েছিলো চিরস্থায়ী ভূমি-ব্যবস্থার দ্বারা। কাজেই ইউরোপীয় বাণিজ্যিক বুর্জোয়ারা যেখানে ছিলো সামন্তবাদ বিরোধী, বাঙালী ব্যবসায়ীরা সেখানে ছিলো সামন্তবাদের রক্ষক ও মুনাফাভোগী।
দ্বিতীয়তঃ, রাজনৈতিক সাদৃশ্যের কথা। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে রেনেসাঁসের নেতা ও প্রবক্তারা অনেক নোতুন নোতুন তত্ত্ব উদ্ভাবন করে ধর্মপ্রভাব-মুক্ত স্বাধীন জাতীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথ প্রশস্ত করেছিলেন। কিন্তু বাঙালী মধ্যশ্রেণীর নেতারা নিজেদের উত্থানের যুগে কী করেছিলেন? তাঁদের অর্থনৈতিক জীবন ব্যবসা বাণিজ্য এবং ভূমিস্বত্বের দিক দিয়ে যেহেতু ইংরেজ শাসনের খুঁটিতে দৃঢ়ভাবে বাঁধা ছিলো সেজন্য ইংরেজ শাসনকে এ দেশে কিভাবে দীর্ঘস্থায়ী করা যায়, কিভাবে এ দেশকে ইংরেজ বিরোধী বিপ্লবের হাত থেকে রক্ষা করা যায়, এই ছিলো তাঁদের রাজনৈতিক চিন্তার মর্মবস্তু। ইয়ংবেঙ্গল দলের রাজনৈতিক বক্তব্য অন্যদের থেকে অনেক স্পষ্ট এবং জোরালো হলেও অর্থনৈতিক জীবনের মেরুদণ্ডহীনতার জন্য তাঁদের ইংরেজ বিরোধিতা ইংরেজ শাসনের কতকগুলি দুষ্কৃতির সমালোচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো। ইংরেজ শাসনের উচ্ছেদ তারা কেউই কামনা করেননি এবং তার জন্যে কোন রাজনৈতিক শক্তিকে সংগঠিত করার বিন্দুমাত্র চেষ্টাও তাঁদের দ্বারা সম্ভব হয়নি। রাজনৈতিক জীবনের এই সাধারণ অবস্থার জন্যেই ঊনিশ শতকের অভিজাত ও মধ্যশ্রেণীর এই ধরনের প্রতিনিধিদের কারও মধ্যে প্রকৃত দেশপ্রেমের কোন বালাই ছিলো না। এ জন্যেই রামমোহন, দ্বারকানাথ, প্রসন্ন ঠাকুর প্রমুখ হোমরা-চোমরা ব্যক্তিরা কলকাতার টাউন হলে সমবেত হয়ে ১৮২৯ সালে বৃটিশ কর্তৃপক্ষের কাছে দলবদ্ধভাবে আবেদন জানিয়েছিলেন যাতে করে ইংরেজদের এ দেশে এসে বসবাস ও উপনিবেশ স্থাপনের জন্যে আইনগত অনুমতি দান করা হয়।[২] রামমোহন নিজেও ১৯৩২ সালে ব্যক্তিগতভাবে হাউস অব কমনসের কাছে এই মর্মে আবেদন করেন।[৩] অভিজাত শ্রেণীর ইংরেজরা এ দেশে এসে বসবাস শুরু করলে এ দেশ অনেক সুসভ্য ও সমৃদ্ধ হয়ে উঠবে এই ছিলো তাঁদের যুক্তি। এবং এ যুক্তি তাঁরা দিলেন কখন? ঠিক সেই সময় যখন এ দেশে নীলকর সাহেবেরা গ্রামে গ্রামে আস্তানা গেড়ে নীলচাষের জন্যে কৃষকদের ওপর অকথ্য নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে এবং এ দেশের কৃষি অর্থনীতিকে ভেঙেচুরে খান খান করছে। এ জন্যেই রামমোহন এ দেশে নীলচাষের সমৃদ্ধি কামনা করে, নীলকরদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে কৃষক স্বার্থের বিরুদ্ধে যেভাবে মুখর হয়েছিলেন[৪] তাতেও আশ্চর্য হওয়ার কিছুই ছিলো না।
এরপর আসে রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আরও একটি সমস্যা, মুদ্রাযন্ত্র ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার কথা। বাঙলাদেশে সংবাদপত্রের ওপর সরকারী বিধিনিষেধের বিরুদ্ধে, সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্য রামমোহন বৃটিশ সরকারের কাছে জোরালো আবেদন করেছিলেন বলে তাঁর প্রসিদ্ধি। সেই জোরালো ভাষার মধ্যে না কি একদিকে ছিলো ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের এবং অন্যদিকে দেশপ্রেমের অভিব্যক্তি।
এই ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ও দেশপ্রেমের পরিচয় সঠিকভাবে পাওয়া যাবে যদি সংবাদপত্র সংক্রান্ত তাঁর বক্তব্যকে৫ বিচার করা হয়। ইংরেজ কর্তৃপক্ষের কাছে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার দাবী জানাতে গিয়ে রামমোহন বলছেন যে, এই স্বাধীনতা দরকার কারণ, তা না হলে জনসাধারণ নিজেদের অভাব অভিযোগ স্বাধীনভাবে সরকারের কাছে জানাতে পারবে না এবং তার ফলে সরকারের পক্ষে দেশের প্রকৃত অবস্থা অবগত হওয়ার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি হবে। দ্বিতীয়তঃ, সংবাদপত্রের মাধ্যমে যদি স্বাধীনভাবে মতামত ব্যক্ত করার অধিকার জনগণের না থাকে তাহলে এ দেশে ইংরেজ শাসন-বিরোধী বিপ্লবী শক্তি (মূলতঃ কৃষকশ্রেণী) জোরদার হবে এবং পরিণতিতে তা হয়ে দাঁড়াবে বৃটিশ শাসনের পক্ষে বিপজ্জনক। এই দুই উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্যে এ দেশে সংবাদপত্র ও মুদ্রাযন্ত্রের স্বাধীনতা প্রয়োজন এবং সেই উদ্দেশ্য সাধনের জন্যেই ইংরেজ কর্তৃপক্ষের কাছে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্যে রামমোহনের জোরালো আবেদন।
এর মধ্যে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য আর দেশপ্রেম কোথায়? ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ও দেশপ্রেমের নিকেশ করার জন্যেই তো সংবাদপত্রের এই তথাকথিত স্বাধীনতার প্রয়োজন। যে উদ্দেশ্যে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার দাবী তিনি উত্থাপন করেছিলেন সেই উদ্দেশ্যের দ্বারা সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খর্ব করারই কি ব্যবস্থা হয়নি? আশ্চর্য হওয়ার কিছুই নেই যে, রামমোহন জীবদ্দশায় এবং পরবর্তীকালে এই ‘স্বাধীন সংবাদপত্র’ কৃষকদের ইংরেজ শাসন বিরোধী নানান বিক্ষোভ, বিদ্রোহ ও সশস্ত্র সংগ্রামের বিরোধিতা এবং সেই সংক্রান্ত সংবাদসমূহকে বিকৃত করে বিদেশী ইংরেজের শাসন স্বার্থকে উদ্ধার করতেই নিযুক্ত হয়েছিলো। দুই এক ক্ষেত্রে দুই একটি সংবাদপত্র কিছুটা অন্য ভূমিকা গ্রহণ করলেও মোটামুটিভাবে এই ছিলো তৎকালের অভিজাত ও মধ্যশ্রেণী পরিচালিত সংবাদপত্রসমূহের সাধারণ চরিত্র।
এ ক্ষেত্রে সহজেই প্রশ্ন উত্থাপন করা যেতে পারে, দেশপ্রেমিক প্রকৃত অর্থে কারা? ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহীরা, না যারা একদিকে কৃষক-স্বার্থের বিরোধিতা এবং অন্যদিকে ইংরেজ-স্বার্থের খয়েরখায়ী করে নিজেদের ক্ষুদ্র শ্রেণীস্বার্থ সংহত করতে ব্যস্ত ছিলো তারা? ঈশ্বর গুপ্তের মতো কবি, যিনি দেশের কুকুরকেও বিদেশের ঠাকুর থেকে শ্রেষ্ঠ জ্ঞান করার আহ্বান জানিয়েছিলেন এবং সেই আহ্বানের জন্যেই যিনি মধ্যশ্রেণী কর্তৃক এতদিন দেশপ্রেমিক হিসেবে প্রশংসিত হয়ে আসছেন তিনি দেশীয় কৃষকদের বিদেশী ইংরেজ বিরোধী সংগ্রামে কার পক্ষ নিয়ে নিজের পত্রিকা সংবাদ প্রভাকর-এ এ জেহাদ চালিয়েছিলেন?[৬] কুকুর ও ঠাকুরের ক্ষেত্রে দেশী বিদেশীর যে তারতম্যের জন্যে তাঁর দেশপ্রেমিক হিসেবে এত উচ্চাসন সে তারতম্য বিদেশী শক্তির বিরুদ্ধে দেশীয় শক্তির সংগ্রামের ক্ষেত্রে কোথায় উধাও হলো?
তৃতীয়তঃ, রেনেসাঁসের সাথে বাঙালী মানবতাবাদী চিন্তা, ধর্ম ও সংস্কৃতির সাদৃশ্যের কথা। এই তথাকথিত সাদৃশ্যও খুব বিভ্রান্তিকর। পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, পনেরো ষোলো শতক ইতালীতে মানবতাবাদী সংস্কৃতির বিকাশের যুগে সেখানে সামন্তবাদের ক্ষয়িষ্ণুতা ও ক্রমাবসান সূচিত হওয়ায় বাণিজ্যিক বুর্জোয়া ও ভূমিদাসের স্বার্থের মধ্যে একটা গভীর সংযোগ সেকালে স্থাপিত হয়। এই সংযোগের দ্বারা মানবতাবাদী চিন্তা, কর্মকাণ্ড ও সংস্কৃতির সীমা ও পরিধি নির্ণীত হয় এবং সমাজের সকল শ্রেণীর উৎপীড়িত মানুষের সুখ- দুঃখর সেই সীমা ও পরিধিই অন্তর্গত থাকে। এই জন্যেই দেখা যায় রেসেসাঁসের যুগে শুধু যে প্রাচীন সংস্কৃতির নোতুন চর্চা শুরু হয়েছে তাই নয়, সে যুগের চিন্তানায়করা তৎকালীন সম্পত্তি সম্পর্কের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন এবং এক ধরনের (কল্পলৌকিক) সাম্যবাদের তত্ত্বও উদ্ভাবন করে মানব-শোষণের অবসান ঘটাতে চেয়েছেন।
বাঙালী ‘মানবতাবাদ’-এর মধ্যে এই ঔদার্যের লেশমাত্র ছিলো না। কারণ বাঙালীরা মানুষের উন্নতি ও মুক্তি, দেশের উন্নতি ও মুক্তি এবং জাতির উন্নতি ও মুক্তিকে নিজেদের শ্রেণী ও ধর্মসম্প্রদায়ের উন্নতি ও মুক্তির সাথেই নিবিড় ও গভীরভাবে এক করে দেখেছিলেন। শ্ৰেণী ও ধর্মসম্প্রদায় এর দুই-ই এ ক্ষেত্রে সমান গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় নিজেদের ধর্মসম্প্রদায়ের দরিদ্র শ্রেণীর প্রতি এই ‘মানবতাবাদীদের’ কোন ভ্রূক্ষেপ ছিলো না। তাঁদের আর্থিক-জীবন, শিক্ষা-দীক্ষা, সুখ-দুঃখ সব কিছুই ছিলো তাঁদের তথাকথিত মানবতাবাদের ক্ষেত্রে অপ্রাসঙ্গিক অর্থাৎ তাঁদের মানবতাবাদের মর্মার্থ হলো বাঙালী অভিজাত ও মধ্যশ্রেণীর শ্রেণীগত স্বার্থকে সংহত করার ক্ষেত্রে সেকালে যে সমস্ত সামাজিক বাধা ও নিষেধ ছিলো সেগুলি অপসারণ করা। শুধু তাই নয়, এই বাধা অপসারণ করতে গিয়ে তাঁরা বিনীতচিত্তে ধর্না দিয়েছিলেন ইংরেজের দরবারে। তাই ইংরেজ যাতে আবার তাঁদের প্রতি বিরূপ না হয় সেজন্যে তাঁরা ইংরেজ-বিরোধী দেশীয় শক্তিসমূহের বিরুদ্ধে নিজেদের ‘মানবতাবাদী’ সাহিত্য, সংস্কৃতি ও রাজনীতি পরিচালনা করতে বিন্দুমাত্র ইতস্তত করেননি।
ঊনিশ শতকীয় বাঙালী ‘মানবতাবাদ’ কতখানি মাতবতাবাদী ছিলো তার একটি উদাহরণ এ ক্ষেত্রে দেওয়া চলে। হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্তর্গত সকল বর্ণের ছাত্রদের সংস্কৃত কলেজে ভর্তির প্রশ্ন যখন উঠে তখন রক্ষণশীলরা ভয়ানকভাবে সেই প্রস্তাবের বিরোধিতা করে। এই বিরোধিতা এত প্রবল ছিলো যে, ইচ্ছে সত্ত্বেও বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজের দ্বার সকলের জন্যে উন্মুক্ত করার প্রস্তাব কর্তৃপক্ষের কাছে দিতে পারেননি। যে প্রস্তাব তিনি দিয়েছিলেন তাতে কায়স্থ পর্যন্ত ভর্তির কথা ছিলো। তার থেকে নিম্নবর্ণের ছাত্রদের সংস্কৃত কলেজে ভর্তির অধিকার তখনো পর্যন্ত না দেওয়ারই সিদ্ধান্ত হয়।[৭]
যে সমাজে সামন্তবাদী প্রভাব এতদূর প্রবল সেখানে বিজ্ঞানের বিকাশ যে হতে পারে না সে কথা বলাই বাহুল্য। বিজ্ঞানের বিকাশ বাঙলাদেশে হয়ওনি এবং এই বিকাশের অভাবই অন্যতম প্রধান কারণ যার জন্যে তৎকালীন বাঙালী বুদ্ধিজীবী ও সংস্কৃতিসেবীদের চিন্তা ও কর্মের মধ্যে মানবতাবাদের প্রকৃত উন্মেষ ও বিকাশ সম্ভব হয়নি।
কিন্তু ইউরোপীয় মানবতাবাদের মতো কোন মানবতাবাদের বিকাশ বাঙলাদেশে না ঘটলেও মানবতাবাদের একটা খণ্ডিত রূপ এখানে অবশ্য দেখা গিয়েছিলো এবং সেই খণ্ডিত মানবতাবাদের সর্বোচ্চ অভিব্যক্তি ঘটেছিলো ইয়ংবেঙ্গল গোষ্ঠী, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, অক্ষয়কুমার দত্ত এবং হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের মধ্যে।
এ পর্যন্ত আলোচনায় যা দেখা গেলো তাতে ঊনিশ শতকের নোতুন বাঙালী সংস্কৃতির সাথে ইউরোপীয় রেনেসাঁস সাদৃশ্যের থেকে বৈসাদৃশ্য এত বেশী যে, তাকে বাঙলার রেসেসাঁস বা নবজাগরণ আখ্যা দেওয়ার অর্থই হলো সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক চিন্তার ক্ষেত্রে নিদারুণ বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা। বস্তুতঃপক্ষে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের অনুগত বাঙালী মধ্যশ্রেণীর এই উত্থানকে এইভাবে আখ্যায়িত করার ফলে বিভ্রান্তি এত সর্বব্যাপক হয়েছিলো যে, তার সুদূরপ্রসারী দুষ্ট প্রভাব আজ পর্যন্ত বাঙলাদেশে এবং সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশে প্রবলভাবে বিদ্যমান। এই বিভ্রান্তির মধ্যে নিক্ষিপ্ত হওয়ার ফলেই তথাকথিত বাঙালী নব- জাগরণের সময় যে সমস্ত প্রতিক্রিয়াশীল সামাজিক ও রাজনৈতিক চিন্তাধারার জন্ম ও বিকাশ ঘটেছিলো সেগুলিকে প্রতিক্রিয়াশীল ধারা হিসেবে যথার্থভাবে চিহ্নিত করা হয়নি। এর ফলে বিশ শতকের এই সত্তরের দশকেও বাঙলাদেশ ও ভারতে প্রগতিশীলতা ও বিপ্লবের আবরণে রঙ-বেরঙের বহু প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি আত্মগোপন করে থেকে সাফল্যের সঙ্গে মেহনতী জনগণের পৃষ্ঠদেশে ছুরিকাঘাত করছে।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে প্রসঙ্গত এ বিষয়ে কিছু আলোচনা অবশ্যই করতে হবে। কিন্তু তার পূর্বে ঊনিশ শতকের এই তথাকথিত নবজাগরণ সম্পর্কে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখ করা দরকার।
এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে, মধ্যশ্রেণীর তৎকালীন কাঠামোর মধ্যে সামন্তবাদী ও সামন্তবাদ-বিরোধী শক্তির লড়াই। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ওপর এই মধ্যশ্রেণীর নির্ভরশীলতার জন্যে তার পক্ষে সরাসরি সামন্ত-বিরোধী কোন ব্যাপক সংগ্রামে লিপ্ত হওয়া সম্ভব হয়নি। কিন্তু তা সত্ত্বেও সেই মধ্যশ্রেণীর নিজের বিকাশের পথে অনেক রকম সামন্তবাদী ধ্যান- ধারণা ও প্রথা ছিলো বাধাস্বরূপ। নিজের শ্রেণীগত বিকাশের প্রয়োজনে মধ্যশ্রেণীর একাংশ সামন্তবাদী মূল্যবোধ ও নানাবিধ সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিলেন। কিন্তু সেইসব আন্দোলন সমগ্র মধ্যশ্রেণী কর্তৃক তৎকালে সমর্থিত হয়নি। মধ্যশ্রেণীর একাংশ আবার তার বিরোধিতা করতে দাঁড়িয়েছিলো। অর্থাৎ তৎকালীন মধ্যশ্রেণী চিন্তা ও সমাজ- সংস্কারের ক্ষেত্রে মোটামুটিভাবে দ্বিভাবিভক্ত হয়েছিলো। তাদের এক অংশ ছিলো অপেক্ষাকৃত প্রগতিশীল এবং অপর অংশ ছিলো অপেক্ষাকৃত প্রতিক্রিয়াশীল।
একটি জিনিস এখানে আবার বিশেষভাবে লক্ষণীয়। তা হলো এই যে, মধ্যশ্রেণীর এই প্রগতিশীল অংশ প্রধানত চাকুরীজীবী ও ব্যবসায়ী। জমিদারীর ওপর তাদের নির্ভরশীলতা হয় অতি অল্প ছিলো, অথবা একেবারেই ছিলো না। অন্যদিকে, মধ্যশ্রেণীর প্রতিক্রিয়াশীল অংশ ক্ষেত্র বিশেষে চাকুরী ও ব্যবসাজীবী হলেও তারা মূলতঃ ভূস্বামীশ্রেণীর অন্তর্গত।
মধ্যশ্রেণীর যে প্রগতিশীল অংশের কথা ওপরে উল্লেখ করা হয়েছে, ভূমিস্বার্থের সাথে সম্পর্ক ছাড়াও সেই অংশের আরও একটি বিশেষত্ব ছিলো। সেটি হলো ঊনিশ শতকে মধ্যশ্রেণী পরিচালিত বিভিন্ন ধর্মান্দোলনে তাদের সক্রিয় ও প্রত্যক্ষ ভূমিকা।
বাঙলাদেশে মধ্যশ্রেণীর উত্থান ধর্মীয় সংস্কার-আন্দোলনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলো। হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত মধ্যশ্রেণীর ক্ষেত্রে এ কথা বিশেষভাবে প্রযোজ্য, কারণ হিন্দু সমাজের সামাজিক কাঠামোর মধ্যে প্রতিটি বর্ণের লোকের জীবন এমন কঠিনভাবে নির্দিষ্ট ছিলো যে, তার মধ্যে কোন নোতুন ধরনের মানবীয় সম্পর্ক গড়ে তোলা ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী সংস্কার ব্যতীত সম্ভব ছিলো না। বুর্জোয়া উত্থানের যুগে যে কোন দেশেই ধর্ম- সংস্কার ঐতিহাসিক কারণেই অপরিহার্য হয়। হিন্দুধর্ম ও সমাজের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিলো। তবে বর্ণাশ্রম-উদ্ভূত বিধিনিষেধ খৃষ্টধর্ম অথবা ইসলামের বিধিনিষেধের থেকে এত বেশী নির্দিষ্ট ও ব্যাপক ছিলো যে, হিন্দু সমাজের মধ্যে কোন প্রবল সংস্কার আন্দোলন ব্যতীত বাঙলাদেশের হিন্দুদের মধ্যে বুর্জোয়া শিক্ষা-সংস্কৃতির বিকাশ অথবা বুর্জোয়াসুলভ কোন মানবীয় সম্পর্ক স্থাপন একেবারেই ছিলো অসম্ভব। এ কারণেই ঊনিশ শতকে মধ্যশ্রেণীর শ্রেণীগত বিকাশ ও সংগতি অর্জনের সংগ্রাম সমাজ ও ধর্ম-সংস্কারের আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত হয়েছিলো অবিচ্ছিন্নভাবে।
বাঙলাদেশের মুসলমান সমাজের মধ্যেও একই সময়ে ধর্ম-সংস্কার আন্দোলনের সূত্রপাত ও বিকাশ ঘটে। কিন্তু হিন্দু ও মুসলমান ধর্মের এই সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে একটা বড় রকমের পার্থক্য ছিলো। এ পার্থক্যকে মোটামুটিভাবে শ্রেণীগত পার্থক্যই বলা চলে। কারণ হিন্দুধর্মের সংস্কার-আন্দোলন ছিলো মূলতঃ মধ্যশ্রেণীর আন্দোলন। মধ্যশ্রেণীর মধ্যেই তা সীমাবদ্ধ ছিলো। কিন্তু মুসলমান ধর্মের সংস্কার আন্দোলন ছিলো মূলতঃ কৃষকশ্রেণীর আন্দোলন।
হিন্দু মধ্যশ্রেণীর মধ্যে যে ধরনের ব্যাপক ও প্রবল সংস্কার আন্দোলন উনিশ শতকে দেখা গিয়েছিলো, মুসলমান মধ্যশ্রেণীর মধ্যে সে ধরনের কোন সংস্কার আন্দোলনের সূত্রপাত ও বিকাশ ঘটেনি। অন্যদিকে, মুসলমান কৃষকশ্রেণীর মধ্যে যে ধরনের সংস্কার-আন্দোলন ঊনিশ শতকের গোড়া থেকে ছয়ের দশক পর্যন্ত দেখা গিয়েছিলো সে ধরনের কোন ব্যাপক ধর্ম সংস্কার অথবা সমাজ সংস্কার আন্দোলন হিন্দু কৃষক এবং অন্যান্য নিম্নশ্রেণীর মধ্যে লক্ষিত হয়নি। মধ্যশ্রেণীর সংস্কার আন্দোলনের কোন উল্লেখযোগ্য প্রভাবও তাদের জীবনে পড়েনি।
ঊনিশ শতকের গোড়া থেকেই হিন্দু সমাজের মধ্যশ্রেণীর মধ্যে সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা দেখা যায়। রামমোহন রায় ১৮১৪ সালে কলকাতায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন এবং তিনিই হন সংস্কার আন্দোলনের প্রধান মুখপাত্র।
সতীদাহের মতো মধ্যযুগীয়, অমানুষিক ও বর্বর প্রথার উচ্ছেদ শুধু যে রামমোহনের মতো নোতুন বাঙালী অভিজাত ও মধ্যশ্রেণীভুক্ত ব্যক্তিদের কাম্য ছিলো তাই নয় এ প্রথার উচ্ছেদের ক্ষেত্রে ভারতের ইংরেজ সমাজ এবং কোম্পানী কর্তৃপক্ষও সহযোগিতা করতে প্রস্তুত ছিলো। এ জন্যেই রক্ষণশীল হিন্দুদের আপত্তি, বিরুদ্ধতা ও প্রতিবন্ধকতা শেষ পর্যন্ত সতীদাহ নিবারণকে ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি। ১৮২৯ সালেই গভর্ণর জেনারেল উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক সতীদাহ নিবারণ আইন প্রণয়ন করেছিলেন, সতীদাহ নিষিদ্ধ হয়েছিলো।
মধ্যশ্রেণীর নোতুন প্রয়োজনের তাগিদ, পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাব, মুসলমান সমাজ ও সংস্কৃতির সাথে ঘনিষ্ঠ পরিচয় ইত্যাদি রামমোহনকে তৎকালীন বাঙালী হিন্দু সমাজের বহুবিধ সঙ্কীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠতে সাহায্য করেছিলো, তিনি অনেকখানি সাংস্কৃতিক ঔদার্যের অধিকারী হতে সক্ষম হয়েছিলেন। সতীদাহ নিবারণের মধ্যেই শুধু তিনি তার সংস্কার প্রচেষ্টাকে সীমাবদ্ধ রাখতে চাননি। তিনি তাকে হিন্দু সমাজের মধ্যে আরও ব্যাপকভাবে প্রসারিত করতে চেয়েছিলেন।
কিন্তু এ কাজ করতে গিয়ে তিনি যে পথ নিয়েছিলেন সে পথ ছিলো অপেক্ষাকৃত সরল। হিন্দুধর্মকে প্রয়োজন মতো সংস্কার করে হিন্দুধর্ম থেকে প্রয়োজন মতো উপাদান নিয়ে, তিনি একেশ্বরবাদের ভিত্তিতে একটি নোতুন ধর্ম-সমাজের প্রবর্তন করেছিলেন। যে কারণে রামমোহন সনাতন হিন্দুধর্ম পরিত্যাগ করে ব্রাহ্মধর্মের প্রবর্তন করেছিলেন ঠিক সেই কারণেই বিদ্যাসাগরের সংস্কার প্রচেষ্টা আইনের বলে বলীয়ান হয়েও তাঁর জীবদ্দশাতে অনেকাংশে ব্যর্থ হয়েছিলো। তিনি আক্ষেপ করেছিলেন, ‘আমার দেশের লোক এত অসার ও অপদার্থ বলিয়া পূর্বে জানিলে আমি কখনই বিধবাবিবাহ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করিতাম না।’[৮]
সে কারণটি কি ছিলো? তা আর কিছুই নয়, তৎকালীন হিন্দু সমাজের অন্তহীন কুসংস্কার এবং অজস্র শাস্ত্রীয় বিধিনিষেধ। আইন করে সতীদাহের মতো একটি বর্বর প্রথা নিবারণ করা যায়। কিন্তু একটি প্রথা নিবারণ করা যত সহজ, একটি প্রথা শুধুমাত্র আইনের জোরে প্রবর্তন ও চালু করা মোটেই তত সহজ নয়। উপরন্তু তা হাজার গুণে কঠিন এবং দুঃসাধ্য। এ জন্যে সতীদাহ বেআইনী ঘোষিত হওয়ার পর সতীদাহ নিবারণ হলেও বিধবাবিবাহ আইনসম্মত হওয়ার পর বিধবা বিবাহ প্রচলন ঠিক সম্ভব হয়নি। বিদ্যাসাগরকে বিধবাদের বিবাহ দেওয়ার জন্যে অনেক উদ্যোগ আয়োজন করতে হতো, তার জন্যে অনেক অর্থ ব্যয় হতো, বিদ্যাসাগর বিধবাবিবাহ প্রচলনের চেষ্টা করতে গিয়ে বস্তুতঃপক্ষে প্রায় সর্বস্বান্ত হয়েছিলেন। প্রথম দিকে যাঁরা তাঁকে উৎসাহ যুগিয়েছিলেন পরবর্তীকালে তাঁরা সেই আন্দোলন থেকে পিছিয়ে গিয়েছিলেন।[৯] বিদ্যাসাগর এ জন্যে দেশের লোককে ‘অসার ও অপদার্থ’ বলে নিজের হতাশাকে ব্যক্ত করলেও সেই হতাশার মূল কারণ ছিলো তৎকালীন হিন্দু-সমাজের কুসংস্কার এবং কাঠামোর মধ্যেই নিহিত। এই কুসংস্কার এবং কাঠামোর পুরো চেহারার দিকে তাকিয়েই রামমোহন হিন্দুধর্ম সংস্কার-প্রচেষ্টার মধ্যে নিমজ্জিত না হয়ে ধর্মত্যাগ করে প্রবর্তন করেছিলেন এক নোতুন ধর্ম-সমাজের।
কিন্তু এইভাবে প্রচলিত হিন্দুধর্ম থেকে পলায়ন করতে গিয়ে রামমোহন যা করেছিলেন তাতে সমাজ সংস্কারের থেকে ধর্মই প্রাধান্য পেয়েছিলো বেশী। কাজেই তাঁরপর দেবেন্দ্রনাথ, রাজনারায়ণ ও কেশবচন্দ্র হিন্দুধর্মকে রক্ষা করার জন্যে ব্রাহ্মধর্মকে যেভাবে ব্যবহার করেছিলেন, ব্রাহ্মসমাজকে তাঁরা হিন্দু রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে গড়ে তুলেছিলেন, তার ফল হিতে বিপরীতই হয়েছিলো।
যে ধর্মের প্রবর্তক হিন্দুধর্ম ত্যাগ করা সত্ত্বেও সংস্কারবশে মৃত্যুকাল পর্যন্ত ব্রাহ্মণের বর্ণচিহ্ন উপবীত নিজ দেহে ধারণ করেছিলেন[১০] সে ধর্মের পরিণতি যে শেষ পর্যন্ত এই দাঁড়াবে তাতে আশ্চর্যের কিছুই ছিলো না।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে সাধারণত রামমোহনের উত্তরসূরী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এই ঢালাও আখ্যা অনেকাংশে বিভ্রান্তিকর
রামমোহন সতীদাহ নিবারণের আন্দোলন করেছিলেন এবং বিদ্যাসাগর বিধবা বিবাহের প্রচলনের আন্দোলন করেছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও রামমোহন মূলতঃ ধর্ম সংস্কারক এবং বিদ্যাসাগর মূলতঃ সমাজ-সংস্কারক। সে যুগে সমাজ সংস্কার শুধু রামমোহন বিদ্যাসাগরের ব্যাপার ছিলো না। সমগ্র বাঙালী হিন্দু মধ্যশ্রেণী ছিলো সমাজ-সংস্কারের নানান আন্দোলনের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। ঊনিশ শতকে বাঙালী মধ্যশ্রেণীর এই সমাজ-সংস্কার আন্দোলন প্রবাহিত হয়েছিলো দুটি স্বতন্ত্র ধারায়। তার একটি ছিলো, ধর্ম-সংস্কারের মাধ্যমে সমাজ সংস্কার। রামমোহন ছিলেন প্রথম ধারার প্রবর্তক। দ্বিতীয় ধারার প্রবর্তক ছিলেন ইয়ংবেঙ্গল গোষ্ঠী এবং পরবর্তী পর্যায়ে বিদ্যাসাগর ছিলেন তার সর্বশ্রেষ্ঠ মুখপাত্র এবং সর্বপ্রধান চালিকাশক্তি।
সতীদাহ নিবারণ রামমোহনের সর্বপ্রধান সমাজ-সংস্কারমূলক কাজ হলেও তাঁর সংস্কার কাজ এই একটি মাত্র ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ ছিলো না। স্ত্রীশিক্ষা, বাঙলা গদ্যের সংস্কার, বিজ্ঞানের চর্চা, সংবাদপত্র ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা (তা যত সীমাবদ্ধ ক্ষেত্রেই হোক না কেন) ইত্যাদি বিষয়ে তিনি উৎসাহী ছিলেন এবং তার জন্য অনেক যত্ন ও পরিশ্রম স্বীকার করেছিলেন। তৎকালীন সামাজিক কাঠামোর মধ্যে এইসব প্রচেষ্টার ভূমিকা নিঃসন্দেহে অনেকখানি প্রগতিশীল ছিলো।
কিন্তু এ সত্ত্বেও রামমোহনের সংস্কার চিন্তা মূলগতভাবে বাঁধা ছিলো ধর্মের খুঁটিতে। বেদান্তের ব্যাখ্যা বিষয়ে অন্যের সঙ্গে তাঁর মতপার্থক্য থাকলেও বিদ্যাসাগরের মতো বেদান্তকে তিনি প্রকৃতপক্ষে ভ্রান্ত দর্শন মনে করেননি। উপরন্তু, ‘স্বদেশীয় লোকদিগকে দেবদেবীর আরাধনা হইতে বিরত করিয়া বেদান্ত প্রতিপাদিত পরম ব্রহ্মের উপাসনায় প্রবৃত্ত করিবার নিমিত্ত সবিশেষ যত্নবান হইয়াছিলেন।’[১১]
“তিনি যখন আপন ভাষায় বাঙালীর আত্মপ্রকাশের উপাদানকে বলিষ্ঠ করবার জন্য প্রবৃত্ত ছিলেন তখন বাঙলা গদ্যভাষার অনুদ্ঘাটিত পথ তাঁকে প্রায় প্রথম থেকেই কঠিন প্রয়াসে খনন করতে হয়েছিলো’[১২]–রামমোহন সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের এই উক্তি খুবই যথার্থ। কিন্তু এখানে উল্লেখযোগ্য বিষয় এই যে, আত্মপ্রকাশের যে পথ তিনি কঠিন প্রয়াসে এইভাবে খনন করেছিলেন সে পথ ছিলো মূলতঃ ধর্মপথ। তাঁর বাঙলা রচনার প্রায় সমস্তই ধর্ম- বিষয়ক। বাঙলা গদ্যকে গুরুতর বিষয় আলোচনার মাধ্যম হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান ও প্রগতিশীল ভূমিকা অনস্বীকার্য। কিন্তু অন্যদিকে, তাঁর বাঙলা রচনা ধর্মপথ ধরে অগ্রসর হয়ে বেদান্ত উপনিষদের গণ্ডীর মধ্যেই ঘুরপাক খেতে থাকার ফলে শেষ পর্যন্ত তাঁর ধর্ম-সংস্কার আন্দোলনও ব্রাহ্মধর্ম রক্ষণশীলতার একটি প্রশ্রয়কেন্দ্রেই পরিণত হয়।
এই রক্ষণশীলতার ধারা তাঁর মধ্যে প্রগতিশীলতার পাশাপাশি আরও প্রবলভাবে প্রবাহিত ছিলো। ঊনিশ শতকের গোড়াতে হিন্দুধর্মের ও সমাজের প্রাথমিক সংস্কার কাজে লিপ্ত যে কোন ব্যক্তির পক্ষে সেটাই ছিলো স্বাভাবিক। রামমোহনের মধ্যেও তাই ধর্মীয় সংস্কার এবং রক্ষণশীলতার অভাব ছিলো না।
একদিকে তিনি যেমন বেদান্তের প্রচলিত পণ্ডিতি ব্যাখ্যা স্বীকার না করে নিজেই তার একেশ্বরবাদী ব্যাখ্যা দিয়ে ব্রাহ্মধর্মের* প্রবর্তন করেন, অন্যদিকে তেমনি জাতিভেদ ইত্যাদির বিরুদ্ধে তত্ত্বগতভাবে জোরালো যুক্তি উপস্থিত করলেও নিজের ব্যক্তিগত জীবনে তিনি জাতিভেদ প্রথার সংস্কারসমূহ মেনে চলতেন। তাই জাতিভেদ প্রথার বিরোধী হওয়া সত্ত্বেও তিনি ব্রাহ্মণের পক্ষে নিষিদ্ধ কোন খাদ্য গ্রহণ করতেন না, অন্য ধর্মাবলম্বী অথবা অন্য জাতিভুক্ত লোকদের সঙ্গে একত্রে আহার পর্যন্ত করতেন না। ব্রাহ্মণের পবিত্র সূত্র উপবীতও তিনি নিজ দেহে ধারণ করতেন।[১৩]
[* রামমোহন প্রবর্তিত ধর্মের নাম আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রাহ্মধর্ম দেওয়া হয় ১৮৪৭ সালে।]
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে রামমোহনের এখানেই তফাৎ। এ জন্যেই মূলতঃ তাঁরা সংস্কার আন্দোলনে একই ধারার অন্তর্গত নন। বিদ্যাসাগর বেদান্তকে ভ্রান্ত মনে করতেন এবং সেই ভ্রান্ত দর্শনের প্রভাব থেকে দেশ ও সমাজকে মুক্ত করার জন্যে তিনি তাঁর সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিলেন। তিনি বিধবাবিবাহ আন্দোলনের নেতা এবং বিধবাবিবাহের প্রবর্তক ছিলেন। কিন্তু নিজের পারিবারিক জীবন ও ঘনিষ্ঠতম সমাজকে সেই সংস্কার আন্দোলনের বাইরে রেখে তিনি নিজের ‘সনাতন ধর্ম’ রক্ষা করতে চাননি। বিধবাবিবাহ প্রচলনকে তিনি সৎকর্মই মনে করতেন, তাই নিজের পারিবারিক ও গ্রাম্য সমাজের আপত্তি সত্ত্বেও তিনি নিজের পুত্র সন্তানের বিধবাবিবাহে আপত্তি তো করেনইনি, উপরন্তু তাতে গর্বই বোধ করেছিলেন।[১৪] সর্বপ্রকার ধর্মীয় সংস্কারের ঊর্ধ্বে থাকার জন্যেই রামমোহন, কেশবচন্দ্রের** পক্ষে যা সম্ভব হয়নি, তাঁর পক্ষে তা অনায়াসেই সম্ভব হয়েছিলো।
[** কেশবচন্দ্র নিজের উদ্যোগে প্রণীত সিভিল ম্যারেজ সম্পর্কিত আইনের খেলাফ করে কোচবিহারের মহারাজার সঙ্গে হিন্দু মতে নিজের তেরো বছরের মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন।]
এ কথা সত্য যে, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সমাজ-সংস্কার আন্দোলন বৃহত্তর বাঙলার জনজীবনকে প্রভাবিত করতে পারেনি, মধ্যশ্রেণীর মধ্যেই তার প্রভাব মোটামুটি সীমাবদ্ধ থেকেছে। কিন্তু এ কথাও আবার সত্য যে, সমাজ-সংস্কারকে ধর্ম-সংস্কারের আর্বতের মধ্যে নিক্ষেপ করে রক্ষণশীলতার পথকে বিদ্যাসাগর কখনও প্রশস্ত করেননি।
রামমোহন ও বিদ্যাসাগরের মধ্যবর্তী সময়ে কলকাতার সামাজিক জীবনে যে উত্তাল তরঙ্গ দেখা দেয় সে তরঙ্গের নাম ইয়ংবেঙ্গল আন্দোলন। হেনরী ভিভিয়ান ডিরোজিওর নেতৃত্বে এই আন্দোলন শুরু হয় এবং তাঁর অকালমৃত্যুর (১৮৩১) পর কৃষ্ণমোহন বন্দোপাধ্যায়, তারাচাঁদ চক্রবর্তী, দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, রামগোপাল ঘোষ, রসিককৃষ্ণ মল্লিক প্রভৃতি হন তার প্রধান মুখপাত্র।
এই ইয়ংবেঙ্গল গোষ্ঠীকে অনেকে ভ্রান্তভাবে ‘র্যাডিক্যাল’ বলে আখ্যায়িত করেন। এই আখ্যাও নিতান্ত ভ্রান্ত। ইয়ংবেঙ্গল গোষ্ঠীভুক্ত ব্যক্তিরা ‘র্যাডিক্যাল’ ছিলেন না, ‘র্যাডিক্যাল’ হিসেবে সমাজে কোন অবদানও তাঁরা রেখে যেতে পারেননি! প্রকৃতপক্ষে তাঁরা ছিলেন একটি ‘সমাজচ্যুত’ গোষ্ঠী। পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিক্ষা-সংস্কৃতির সংস্পর্শে এসে তাঁরা তৎকালীন হিন্দুসমাজের সঙ্গে নিজেদের কোনো রকমেই খাপ খাওয়াতে না পেরে পাশ্চাত্যের অনুকরণে বাঙলাদেশে একটি ‘সুসভ্য’ সমাজের স্বপ্ন দেখেছিলেন। এই দেখতে চাওয়ার ক্ষেত্রে তাঁদের সমাজ ও বিশ্বদৃষ্টির মধ্যে একটা সংস্কারমুক্ত ঔদার্যের পরিচয় পাওয়া যায় সত্য, কিন্তু তার মধ্যে তাঁদের বাস্তব জ্ঞানের অভাবও দারুণভাবে প্রকটিত হয়। এ জন্যে সোশালিস্ট ইউটোপীয়ন না হলেও তাঁরা ছিলেন এক বিশেষ ধরনের ইউটোপীয়ন তাঁদের সেই তথাকথিত র্যাডিক্যালিজমের সঙ্গে তৎকালীন সমাজভূমির কোন প্রত্যক্ষ সম্পর্ক না থাকার ফলে উনিশ শতকের বাঙলাদেশকে তাঁরা ঊনিশ শতকের ইংল্যান্ড হিসেবেই দেখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তবু এ কথাও আবার সত্য যে, হিন্দুধর্মের কুসংস্কারসমূহের সম্পূর্ণ ঊর্ধ্বে উঠে ধর্মকে সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে মিশ্রিত না করে বিধবাবিবাহ প্রচলন, বহুবিবাহ ও বাল্যবিবাহ রোধ আন্দোলনের এক নোতুন ধারা তাঁরাই প্রবর্তন করেন।
কিন্তু যে সমাজে অল্প কয়েক বছর আগে পর্যন্ত মানুষকে ধর্মীয় কারণে নিয়মিতভাবে জীবন্ত দগ্ধ করা হতো, তৎকালীন সেই বঙ্গসমাজ ছিলো তাঁদের সামনে পর্বত প্রমাণ বাধা। সেই বাধার উচ্চতা দেখে, শ্রেণীগত কারণে সেই বাধা অপসারণের জন্যে কোন সুসংগঠিত আন্দোলনের জন্মদানের চিন্তা পর্যন্ত করতে অক্ষম হয়ে তারা সমাজ নামের সেই পৰ্বত লক্ষ্য করে কিছু ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করেছিলেন।[১৫]
রামমোহনের সঙ্গে এ ক্ষেত্রে ইয়ংবেঙ্গল গোষ্ঠীর কিছু সাদৃশ্য আছে। উভয়েই সনাতন হিন্দুধর্ম থেকে পলায়ন করতে চেয়েছিলেন। রামমোহন পলায়ন করে আশ্রয় নিয়েছিলেন একেশ্বরবাদের ভিত্তিতে স্বপ্রবর্তিত একটি নোতুন ধর্মে। ইয়ংবেঙ্গল গোষ্ঠীর পলায়ন প্রচেষ্টা মূলতঃ তাঁদের নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো এবং কলকাতার ইংরেজী শিক্ষিত সমাজের বাইরে তার বিন্দুমাত্র কোন স্পন্দনও কোথাও সৃষ্টি হয়নি। ‘সমাজচ্যুত’ এই গোষ্ঠীর বিদ্রোহ বেশীদিন স্থায়ীও হয়নি। তাঁদের মধ্যে ক্রমশঃ নানা রকম বিপরীতমুখী চিন্তা, এমন কি রক্ষণশীল চিন্তারও অনুপ্রবেশ ঘটে। বিদ্রোহের প্রাথমিক স্তর উত্তীর্ণ হওয়ার পর কৃষ্ণমোহন হিন্দুধর্মের পরিবর্তে খৃষ্টধর্ম গ্রহণ করেন, দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায় পশ্চিম ভারতে চাকুরী উপলক্ষ্যে গিয়ে টিকি রেখে পরম ব্রাহ্মণ সাজেন,[১৬] এমন কি রামগোপাল ঘোষ পর্যন্ত চরম দক্ষিণপন্থী রাধাকান্ত দেব ও দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে একজোট হয়ে খৃষ্টান ধর্মের হাত থেকে হিন্দু সমাজকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে হিন্দুধর্ম হিতার্থী বিদ্যালয় স্থাপন করেন।[১৭] কাজেই হিন্দুধর্ম থেকে রামমোহনের পলায়ন প্রচেষ্টা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত রামমোহন প্রবর্তিত ব্রাহ্মধর্ম যেমন দেবেন্দ্রনাথ, রাজনারায়ণ ও কেশবচন্দ্রের নেতৃত্বে হিন্দু রক্ষণশীলতারই একটি হাতিয়ারে পরিণত হয়, অন্যদিকে তেমন ইয়ংবেঙ্গল গোষ্ঠীর হিন্দুধর্ম থেকে পলায়ন প্রচেষ্টা সমাজভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন থাকায়, তা হয়ে পড়ে দিগ্ভ্রান্ত। তার একাংশ সমাজের মূল ধারা থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয় এবং অপর একটি অংশ ধর্মীয় রক্ষণশীলতার সাথে আপস করে।
এ সবের ফলে ইয়ংবেঙ্গল গোষ্ঠীর ঐক্য ও গোষ্ঠী-চরিত্র বিনষ্ট হয় এবং তার থেকে কোন নোতুন আন্দোলনেরও আর উদ্ভব হয় না।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন