আমাজনের জঙ্গলে – ৩

অমরেন্দ্র চক্রবর্তী

কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানি না, ঘুম ভাঙতেই দেখি সকালের রোদ্দুরে আমাজন নদী জ্বলছে ৷ বোটচালক লোকটা লম্বা হয়ে শুয়ে তখনও ঘুমোচ্ছে ৷ তার পাশে একটা স্যান্ডউইচের খালি প্যাকেট আর একটা কোকাকোলার খোলা টিন পড়ে আছে ৷ কাকারা কেউ ফেরেনি!

যেদিকেই চাই হয় জল, নয় জঙ্গল, জল আর জঙ্গল ছাড়া কোথাও কিছু নেই ৷ এ যেন আমাদের পৃথিবীর একেবারে বাইরে, শুধু জল-জঙ্গলের একটা আলাদা জগৎ ৷

কী করব, কোথায় যাব, কাকাদের খোঁজ করবই বা কীভাবে কিছুই ভেবে পাচ্ছি না ৷ পৃথিবী ঘোরার প্লেনের টিকিট পেয়ে নিজের ওপরেই রাগ হচ্ছিল ৷

এদিকে খিদেয় গা গুলোচ্ছে ৷ কাকাদের খাবারের ব্যাগ থেকে বিস্কুট বের করতে গেলাম, সেই শব্দে লোকটার ঘুম ভেঙে গেল ৷ বোটের মধ্যে চোখ বুলিয়ে নিয়ে বেশ বিরক্ত হয়ে পুরো পর্তুগিজ ভাষায় কী বলল আমি কিছুই বুঝলাম না ৷

আমি ইংরিজিতে বললাম, ‘কাকারা বোধহয় কোনও বিপদে পড়েছে, হয়তো জঙ্গলে পথ হারিয়ে ফেলেছে, তুমি জঙ্গলের রাস্তা জানো?’

লোকটা উত্তর না দিয়ে আমাকেই প্রশ্ন করল, ‘আমাজনের গভীর জলে ডুব দিয়ে নদীর পেটের মধ্যে বোতোর শহরে যাবার রাস্তা তুমি জানো? হুঁ! আমাজনের জঙ্গলের রাস্তা!’

বলে সে হঠাৎ উঠে গিয়ে বোটের ইঞ্জিন চালু করল ৷ তারপর বোটের মুখ ঘোরাতে ঘোরাতে বলল, ‘যদি প্রাণে বাঁচতে চাও, ভেতরে গিয়ে চুপ করে বসো, আমি তোমাকে মানাউসে পৌঁছে দেব ৷ যদি মরতে চাও, তাহলে বলো, তোমাকে জঙ্গলে নামিয়ে দিয়ে যাই ৷ এখানে আর অপেক্ষা করে লাভ কী, আমি ফিরে যাচ্ছি ৷’

লোকটার কথায় এই প্রথম আমার চোখ ফেটে জল এল ৷ আমি শক্ত গলায় বললাম, ‘আমাকে জঙ্গলে নামিয়ে দাও ৷’

কাল কাকারা ঠিক যেখানে যেভাবে নেমে গিয়েছিল লোকটা আমাকে আজ প্রায় সেইখানে সেইরকম তক্তা পেতে নামিয়ে দিয়ে তক্তাটা তুলে নিয়ে, ধীরে ধীরে বোটের মুখ ঘুরিয়ে চলে গেল ৷

আমার মন একেবারে শূন্য হয়ে গেছে, কী করব, এরপর কী হবে— কিছুই ভাবতে পারছি না ৷ শুধু বোটের দূরে চলে যাওয়া দেখছি ৷

বোট ক্রমে খুব ছোট হয়ে এল, ছেলেবেলায় গামলার জলে খেলনা বোটের মতো দেখাচ্ছে ৷ হঠাৎ মনে হল বোটটা যেন এদিকেই ফিরে আসছে ৷

একটু পরে আর সন্দেহ রইল না যে বোট আমার কাছেই আসছে ৷ এতেই আমার এত আনন্দ হল, যে যে-ভগবানকে কোনওদিন দেখিনি, হয়তো ভাবিনিও কখনও, সেই ভগবানের উদ্দেশে আমার সমস্ত মন নত হয়ে প্রণাম জানাল ৷

লোকটা বোটটাকে নদীর একেবারে কিনারে এনে যতটা পারে জঙ্গলের গায়ে লাগিয়ে সেই লম্বা তক্তাটা পেতে দিল ৷ তারপর দুহাতে কাকাদের খাবার দাবারের দুটো ব্যাগ নিয়ে আমার কাছে এসে বলল, ‘কোনটা নেবে বেছে নাও ৷ তুমি বোতো কে জানো না, বোতোকে মানো না, তোমাকে এই আদি অন্তহীন অরণ্যে কে বাঁচাবে! অন্তত ব্যাগের খাবার আর জল খেয়ে যে কদিন পারো বাঁচার চেষ্টা করো ৷ আমাকেও অনেক নদী পেরিয়ে অনেকটা পথ যেতে হবে, একটা ব্যাগ তাই আমাকেও নিতে হবে ৷ তুমি কোনটা চাও— তোমার কাকারটা, না কাকার বন্ধুরটা, তুমিই বেছে নাও ৷’

তখন তুচ্ছ ব্যাগের চেয়ে অনেক গুণ বড় ভাবনা এত বড় বনে কোথায় যাব, কোথায় খুঁজব আমার কাকাকে, যতদিন খুঁজে না পাই ততদিন বেঁচেই বা থাকব কী করে ৷

তবু আমি কাকার ব্যাগটা নেওয়াই স্থির করলাম, আমার জামাকাপড়ও তো ওই ব্যাগেই আছে ৷

লোকটা এবার ‘দাঁড়াও, আসছি’ বলে জঙ্গলের মধ্যে বড় বড় গাছ আর ঝোপঝাড়ের আড়ালে হারিয়ে গেল ৷

পাঁচ-সাত মিনিট পর লোকটা ফিরে এল, হাতের মুঠোয় হরীতকীর মতো সাত-আটটা ফল ৷ গঞ্জালোর খাবারের ব্যাগে একটা লম্বা কাটারি ছিল, লোকটা সেই কাটারি দিয়ে এক কোপে একটা ফল আধাআধি কেটে ভেতর থেকে নরম তুলতুলে, অনেকটা তালশাঁসের মতো দেখতে, ছোট্ট একটা পোকা বের করে হাতের তালুতে নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘এটা দেখে রাখো, আমাজনের জঙ্গলে পথ হারিয়ে শেষ পর্যন্ত এই পোকা খেয়েই মানুষকে বেঁচে থাকার লড়াই করতে হয় ৷ এই ফল এই জঙ্গলে অনেক পাবে ৷ আপাতত এগুলো রাখো ৷ বোতোকে স্মরণ করো ৷ বোতো তোমাকে রক্ষা করুন ৷ আকাশের মতো পাড়হীন এই জঙ্গলে তুমি থাকবে কী করে ৷ থাকবে কেন?’

আমার মুখে কেন কোনও কথা ফুটল না জানি না ৷

লোকটা হঠাৎই দুটো ব্যাগের যেটা একটু ছোট, যেটা গঞ্জালোর, সেটা তুলে নিয়ে তক্তার ওপর দিয়ে দুড়দাড় শব্দে হেঁটে বোটে উঠে পড়ল ৷ তারপর বোটের মুখ ঘুরিয়ে দূরের দিকে চলে গেল ৷

তার বোট যখন তারই দেওয়া ছোট্ট তুলতুলে পোকাটার মতো ছোট হয়ে এল, তারপর একেবারে মিলিয়ে গেল, আমি কাকার ব্যাগটা তুলে নিয়ে জঙ্গলের মধ্যে হাঁটতে লাগলাম ৷ কোথায় যাচ্ছি, কোনদিকে যাব, কিছুই জানি না ৷ জঙ্গলের ভিজে, পচা, ঝরা পাতার ওপর কারও হেঁটে যাবার কোনও চিহ্ন থাকে না ৷

ব্যাগটা ভারি, কী কী আছে জানি না ৷ শুকনো খাবার, জলের বোতল ছাড়াও আরও অনেক কিছু আছে ৷ তাছাড়া গঞ্জালোর লম্বা দা’টাও বোটচালক এই ব্যাগে ঢুকিয়ে দিয়েছে ৷

কাকাদের দেখা না পেলে আমার কী হবে, এই ভয়ানক জঙ্গলে কতদিন কীভাবে কাটবে ভাবতে ভাবতে আমার পা যেন আর চলে না ৷ তার ওপর বিরাট বিরাট গাছ, মস্ত মস্ত ঝুরি ৷ পাকানো তারের মতো অসংখ্য লতা ও ঝোপঝাড়ের মধ্য দিয়ে কখনও ঠেলে কখনও একটু ফাঁক করে এগনোও শক্ত ৷

হাজার হাজার মাইল লম্বা শত শত নদী বুকে নিয়ে লক্ষ লক্ষ মাইল এই জঙ্গলের পৃথিবী থেকে রিও ডি জেনেরো কত দূর, কোথায়, কে জানে? কাকাকে না পেলে রিও ডি জেনেরোয় কে আমাকে নিয়ে যাবে? সেখান থেকেই আমার দেশে যাবার প্লেন ছাড়ার কথা ৷ ভাবতে ভাবতে আমি একটা বিরাট বড় গাছের নিচে বসে পড়লাম ৷ ঘুমে আমার চোখ ঢুলে আসছে ৷

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন