অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
আমরা নিগ্রো নদী বেয়ে আমাজন নদীর দিকে চলেছি ৷ নিগ্রো নদীর জল এত কালো যে মনে হয় নদীর তীরে কোথাও হয়তো কয়লাখনি আছে! সত্যিই আছে নাকি? কাকাকে সেকথা জিজ্ঞেস করতে তিনি বেশ বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘ইন্ডিয়ায় আজকাল এইরকম লেখাপড়া হচ্ছে বুঝি!’
কাকা তাঁর পর্তুগিজ বন্ধুর সঙ্গে কথা বলায় বাধা পেয়েই হয়তো বিরক্ত হয়েছেন, মানাউসে মোটরবোটে উঠে থেকে দুজনে শুধু কথাই বলে যাচ্ছেন, নদীর রং, নদী তীরের রূপ একবারের জন্যও দেখছেন না ৷ কী নিয়ে এত কথা জানি না, তাঁরা কথা বলছেন পর্তুগিজ ভাষায় ৷ আমি ব্রাজিলে এসেছি মাত্র দুদিন, দুদিনে দুটো মাত্র পর্তুগিজ শব্দ শিখেছি— বনদিয়া, মানে গুড ডে অর্থাৎ শুভ দিন, ওব্রিগাদো, মানে থ্যাঙ্ক ইউ, ধন্যবাদ ৷
কাকা এদেশে আছেন প্রায় দশ-বারো বছর ৷ এখানকার আন্দিজ পাহাড়ে নাকি নানা রকম রঙিন পাথর পাওয়া যায় ৷ শুনেছি সেইসব রঙিন পাথরের ব্যবসা আছে তাঁর ৷
কাকা থাকেন রিও ডি জেনেরোয় ৷ সেখানে সমুদ্রের কাছে তাঁর মস্ত বাড়ি ৷ বাড়িতে কিন্তু কাকিমা বা তাঁদের কোনও ছেলেমেয়েকে দেখলাম না ৷ কাকিমাকে আমি একবারই দেখেছি, কানে ঝুমকো, নাকে নোলক, মাথায় মুকুট পরা নতুন বউয়ের সাজে, কাকার বউভাতের দিন ৷ বিয়ে হয়েছিল নদীয়া জেলার পলাশীতে, কাকা সেখানেই তখন কীসব ব্যবসাট্যাবসা করতেন ৷ আমি মায়ের কোলে চড়ে কাকার বিয়েতে গিয়েছিলাম ৷
বড় হয়ে স্কুলে ইতিহাসের বইয়ে পড়েছি ওই পলাশীর আমবাগানে বাংলার নবাব সিরাজদৌলাকে যুদ্ধে হারিয়ে ইংরেজরা ক্রমশ আমাদের দেশের শাসক হয়ে বসে ৷
আর দুবছর পরেই আমার মাধ্যমিক পরীক্ষা ৷ কাকা-কাকিমার সঙ্গে সেই যে পলাশীতে একবার দেখা হয়েছিল, তারপর আর কোনওদিন দেখিনি তাঁদের ৷ এবার ব্রাজিলে এসেছি কাকা এখানে আছেন বলেই ৷ সারা পৃথিবীর মধ্যে চিঠি লেখা প্রতিযোগিতায় ফার্স্ট হয়ে আমি একটা রাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড টিকিট পুরস্কার পেয়েছি ৷ এই টিকিটে কলকাতা থেকে ব্যাংকক, হংকং, টোকিও, লস এঞ্জেলেস, নিউইয়র্ক, রিও ডি জেনেরো, কোপেনহেগেন, দিল্লি হয়ে আবার কলকাতায় ফিরে আসা যাবে ৷
পৃথিবীটা এক চক্কর ঘুরে আসতে প্লেনের টিকিটের জন্য পয়সা লাগছে না ঠিকই, কিন্তু ব্যাংকক, হংকং, টোকিও, নিউইয়র্ক, লস এঞ্জেলেস —এইসব জায়গায় থাকা-খাওয়া ঘোরাঘুরি তো আর বিনাপয়সায় হয় না ৷ একমাত্র ব্রাজিলের রিও ডি জেনেরোয় কাকার বাড়ি আছে বলে টিকিটটা খানিকটা কাজে লাগাতে পারছি ৷ বাবা সেইমতো আমার এই পুরস্কারের কথা কাকাকে চিঠিতে লিখেছিলেন, উত্তরে কাকা লিখেছিলেন— ঠিক কবে কোন এয়ারলাইন্সে আসছি জানালে তিনি এয়ারপোর্টে আমাকে নিতে আসবেন ৷ আসলে সারা পৃথিবীর দেড়শোটি দেশের স্কুলের ছেলেমেয়েদের মধ্যে আমিই এই চিঠি লেখা প্রতিযোগিতায় ফার্স্ট হয়েছি বলে বাবার একটু গর্বই হয়েছিল ৷ কাকাকেও পুরস্কারের কথাটা একটু লম্বা করেই লিখেছিলেন ৷
পুরস্কার পেয়ে কার না আনন্দ হয়! বিশেষ করে প্রায় সারা পৃথিবী ঘোরার প্লেনের টিকিট পেলে মন তো নাচবেই ৷ তাছাড়া রাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড কথাটা শুনেই আমার জুল ভের্নের ‘অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইন এইট্টি ডেজ’ বইটার কথা মনে পড়েছিল ৷ আমিও যদি ৮০ দিনে সমস্ত পৃথিবীটা ঘুরে আসতে পারতাম! দেশে দেশে আমার কত বন্ধু হত তাহলে!
প্রতিযোগিতাটাও ছিল এই নতুন দেশ দেখা নিয়ে চিঠি লেখার ৷ বিদেশের কোনও বন্ধুকে তোমার দেশ বেড়িয়ে যাবার নিমন্ত্রণ করে চিঠি লিখতে হবে ৷ তাতেই আমি ফার্স্ট হই ৷ পৃথিবী ঘুরে আসার প্লেনের টিকিট পাই ৷ কিন্তু পৃথিবী দূরের কথা, কাকা না থাকলে আমার একটা দেশেও যাওয়া হত না ৷
রিও ডি জেনেরোয় কাকা সারাদিন তাঁর ব্যবসার কাজেই ব্যস্ত থাকেন, তাই প্রথম দুদিন আমি একাই শুধু সমুদ্রতীরে ঘুরলাম ৷
.
তৃতীয় দিনও সমুদ্রতীর ধরে অনেক দূর পর্যন্ত ঘুরে এলাম ৷ সমুদ্রতীর ধরে ঘুরলে রাস্তা হারাবার ভয় থাকে না, তাছাড়া সমুদ্র আমার খুব ভালো লাগে ৷
সেদিনই রাতে খাবার টেবিলে কাকা হঠাৎ বললেন, ‘আমাজনের জঙ্গলে যেতে চাও? তাহলে কাল সকাল সাতটায় এয়ারপোর্ট যাবার জন্য তৈরি থেকো ৷’
রিও ডি জেনেরো থেকে প্লেন প্রথমে এল ব্রাজিলের রাজধানী ব্রাজিলিয়ায় ৷ সেখান থেকে এক ঘণ্টা পর প্লেন আবার আকাশে উড়ল, এবার আর কোথাও না থেমে সোজা নামল মানাউসে ৷ মানাউস আমাজন রাজ্যের রাজধানী ৷ এখানেই এয়ারপোর্টে কাকার পর্তুগিজ বন্ধু গাড়ি নিয়ে কাকার জন্য অপেক্ষা করছিলেন, সেই গাড়িতে মানাউস জেটিতে এসে আমরা মোটরবোটে উঠেছি ৷
নিগ্রো নদী থেকে একটু দূরে বাঁদিকে একটা নদী চোখে পড়ল ৷ তার জল অনেকটা যেন হলদে রঙের ৷ অথবা হয়তো যেন বাদামি ৷ এত দূর থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় না ৷
নতুন নদী দেখলে তার নাম না জানলে আমার ভালো লাগে না ৷ কাকারা তখনও কথায় ব্যস্ত, তবু আমি জিজ্ঞেস না করে পারলাম না— ‘কাকা, ওই নদীটা দ্যাখো, জলের রংটা একেবারে অন্যরকম, কী নদী ওটা?’
কাকা এবার আর তত বিরক্ত হলেন না, বললেন, ‘ওটা হল সোলিময়েস— হলুদ জলের নদী ৷ নিগ্রোর মতো এও আমাজন নদীতে গিয়ে পড়েছে ৷ আমাজনের বাঁ তীরে আর ডান তীরে এরকম প্রায় হাজার-বারোশো উপনদী আছে ৷ সবাই আমাজনে গিয়ে মিশেছে ৷’
কাকার বন্ধু যেমন কাকাকে ডাকছে বারীন বলে, কাকাও তেমনই তাঁর বন্ধুকে নাম ধরে ডাকছেন ৷ এঁর নাম গঞ্জালো ৷
এঁরা কেন আমাজনের জঙ্গলে যাচ্ছেন, আমাকেই বা কেন নিয়ে যাচ্ছেন, আমি কিছুই জানি না ৷ মনে হয়, ওঁরা কোনও কাজে যাচ্ছেন, আর কাকা আমাকে আর কোথায় রেখে আসবেন, তাই সঙ্গে নিয়েছেন ৷
আরও প্রায় দু-ঘণ্টা পর আমরা আমাজন নদীতে পড়লাম ৷ এখানে একটা অদ্ভুত ব্যাপার দেখলাম, কালো জলের নদী নিগ্রো আর হলুদ জলের নদী সোলিময়েস আমাজনে পড়েও কালো আর হলুদ রঙের নদী হয়েই রয়েছে ৷ বেশ কিছু দূর পর্যন্ত জলের এইরকম আলাদা দুটো রং দেখা গেল ৷
আমাজন নদী এত বড় যে চেয়ে থাকতে থাকতে ভয় ধরে যায় ৷ হিমালয় থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত দীর্ঘ আমাদের গঙ্গা নদীর চেয়ে আমাজন দ্বিগুণ না কি তিনগুণেরও বেশি বড় ৷ কাকা বললেন মোহনার কাছে নদীটা চারশো কিলোমিটার চওড়া! আমাজনের বিশাল জঙ্গলে এত বড় নদীতে মোটরবোটে আমরা মাত্র চারটি প্রাণী ৷ কাকা, কাকার বন্ধু গঞ্জালো, আমি, আর যে বোট চালাচ্ছে সে ৷
বোট ক্রমশ মাঝনদী ছেড়ে তীরের দিকে এগোতে লাগল ৷ একটু পরেই আমরা নদীর প্রায় তীর ঘেঁসে চলতে লাগলাম ৷ নদীর তীরে বিরাট বিরাট গাছের বিশাল জঙ্গল, কোথাও তার শেষ দেখা যায় না ৷
আমাজনের নদীতে রোদ এত কড়া যে গা পুড়ে যায় ৷ এখন তীরের কাছে জঙ্গলের ঘন ছায়া পেয়ে বাঁচলাম ৷ কলকাতা থেকে কত হাজার মাইল দূরে পৃথিবীর ঠিক কোন জায়গায় আছি ভাবতে ভাবতে ঘুমে আমার চোখ জড়িয়ে আসছে, তবু, কেন জানি না, ঠিক করলাম, কিছুতেই ঘুমব না ৷
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন