আমাজনের জঙ্গলে – ৫

অমরেন্দ্র চক্রবর্তী

ছেলেটার নাম উবা ৷

ঠোঁট সরু করে ভারি সুন্দর করে নিজের নাম বলল উবা ৷ তারপর উবা কথাটার মানে বুঝিয়ে দিলে মাটির ওপর কাঠকুটো দিয়ে সরু এক চিলতে একটা নৌকো বানিয়ে ৷ এখানকার ছোট নৌকোকে বলে উবা ৷ এটা অনেকটা বর্ষাকালে বাংলার গ্রামে জলে-ডোবা মাঠঘাটে বা খালে-বিলে তালগাছের ডোঙার মতো ৷

উবা হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে আমার ডান হাতটা ধরে একবার টান দিয়েই দৌড় লাগাল ৷ আমাকেও তার পিছন পিছন ছুটতে হল ৷

কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা একটা উপনদীর তীরে পৌঁছে গেলাম ৷ এরকম ঘোর জঙ্গলের মধ্যে এত কাছেই একটা নদী এত জোর বয়ে চলেছে না দেখলে আমি ধারণাও করতে পারতাম না ৷ পাড় ঘেঁসে নদীর ঢেউয়ের ধাক্কার তালে তালে নাচছে একটা উবা, সেটা আবার পাড়ের একটা গাছের সঙ্গে বাঁধা ৷

উবা দড়িটা খুলে আমার হাতে দিয়ে জলের কাছে নেমে গেল ৷ দড়িটায় অল্প টান পড়লেও মনে হচ্ছে হাত যেন কেটে যাবে ৷

আমি উবার ডাকে দড়িসুদ্ধু নিচে নেমে নৌকোয় উঠে বসলাম ৷ উবাও দড়িটা নিজের হাতে নিয়ে নৌকোয় উঠল ৷

আমি ওর হাতের দড়িটার দিকে তাকিয়ে আছি দেখে উবা জানাল, এটা নানান গাছের আঁশ দিয়ে তৈরি খুব শক্ত দড়ি ৷ কথাটা বোঝাল ওর কাঠকুটো আর হাতের ভঙ্গি দিয়ে আর মুখে এই দড়িটার নাম বলল, এনভিরা ৷

একটু এগোতেই একটা ব্যাপার দেখে আশ্চর্য হলাম ৷ নদীর পাড়ে পর পর অনেকগুলো গাছে নানা মাপের, নানা চেহারার নৌকো বাঁধা আছে ৷

উবা নামে একটা ছেলের সঙ্গে উবা নামে এক ধরনের নৌকোয় চড়ে আমাজনের একটা উপনদীতে ঘুরে বেড়াব, আমার এই চোদ্দ বছরের জীবনে একথা আমি কোনওদিন স্বপ্নেও ভাবিনি ৷ মাঝে মাঝে পাড়ের ডালপালা গাছের ঝুরি লতা গুল্ভম থেকে গা-মাথা বাঁচিয়ে তর তর করে এগিয়ে চলেছি, নানারকম লতাপাতা ফুল ফলের অচেনা গন্ধ এসে নাকে লাগছে, এর মধ্যে ভিক্স আর অন্য কী যেন একটা ওষুধের গন্ধ আমার চেনা, সব মিলিয়ে মনে একটা আনন্দের ভাব ৷

যদিও এখনও কাকার দেখা পাইনি তবু উবাকে পেয়ে জঙ্গলের সেই দম বন্ধ করা ভয় আর দুশ্চিন্তা আমার কেটে গেছে ৷ গতকালও জঙ্গলে যখন রোজকার মতো আরও একটা বিভীষিকাময় রাত নেমে এল তখন কি স্বপ্নেও ভেবেছিলাম আজ এরকম ঘটবে! মানুষের জীবনে সত্যি সত্যি যা ঘটে তা কখনও কখনও স্বপ্নকেও ছাড়িয়ে যায়!

ডোঙা আগের মতোই গাছের সঙ্গে বেঁধে রেখে উবা যখন আমাকে নিয়ে বড় বড় গাছে ঘেরা উঠোনের মতো জায়গাটায় ফিরে এল, তখন সেখানে নানা বয়সের কুড়ি-বাইশ জন মেয়ে-পুরুষ দেখে আমি অবাক হলাম ৷ তাদের বাঁ হাতে নারকোলের মালা, মালা থেকে ডান হাতে রক্ত নিয়ে নিজেদের মুখে মাখছে ৷ এরা কি পশু শিকার করে ফিরেছে— সকলের হাতের মালায় তারই রক্ত? নাকি জঙ্গলে পথ-হারানো কোনও মানুষ শিকার করে তার রক্ত মুখে মাখছে? সকলের হাতে মুখে রক্ত দেখে ভয়ে আমার বুক হিম হয়ে গেল ৷

উবা আমার মনের অবস্থা বুঝতে পেরেছে, সে একটা ছেলের কাছে এগিয়ে গিয়ে তার কাছ থেকে কয়েকটা শুকনো ফলের বিচি এনে জলে ঘষতেই টকটকে লাল রং তৈরি হয়ে গেল ৷ সেই রং তার হাতের তিন আঙুলে নিয়ে আমার মুখে মাখাতে লাগল ৷

তার কাঠকুটোর ভাষা আর মুখের কথার শব্দ মিশিয়ে সে আমাকে বলল— আমি মিথ্যেই ভয় পেয়েছি ৷ ওগুলো রক্ত নয় ৷ লাল রং ৷ উরুকু ফলের বিচি গুঁড়িয়ে কয়েক ফোঁটা জল মেশালেই ওই রং তৈরি হয় ৷ উরুকু কথাটার মানেই লাল রং ৷ উৎসবের দিনে মুখে বেশ গাঢ় করে তারা এই রং মাখে ৷ আজ সন্ধেবেলা এখানে তাদের উৎসব ৷ এই গ্রামটা শুধু এই কুড়ি-বাইশজন মানুষের ৷ গাছে ঘেরা এই জায়গাটা তাদের উৎসব প্রাঙ্গণ ৷

হঠাৎ একটা মেয়ে নারকোলের মালা হাতে আমার কাছে এসে আমার ডান হাতটা মালার রঙে চুবিয়ে দিয়ে তার মুখটা আমার দিকে বাড়িয়ে ধরল ৷ মানুষ চাইলে ভাষা ছাড়াই কত কথা বলা যায় ৷

উবা তখনও আমার মুখে রং লেপছে, মনে হয় কিছু একটা আঁকছে, আমিও কখনও মেয়েটার কপালে, কখনও উবার গালে রং লাগিয়ে দিচ্ছি ৷ শেষ পর্যন্ত মেয়েটার কপালে আমাদের দেশের শালুক ফুল আর উবার দুগালে কৃষ্ণচূড়া এঁকে দিলাম ৷

উঠোনে বড় বড় পাতায় বোনা ঝুড়িতে অনেক রকম ফল-মূল, খাবার-দাবার ৷ মাটির মস্ত মস্ত হাঁড়িতে তিন-চার রকম ফলের রস বা অন্য কোনও পানীয় ৷ কয়েকটা গাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে রাখা আছে বেঁটে বেঁটে কতগুলো ঢোল ও অচেনা কয়েকটা বাদ্যযন্ত্র ৷ একটা উঁচু মতো জায়গায় বেশ বড় একটা নৌকো প্রথম থেকেই রাখা ছিল ৷

উবার কাছে জানা গেল, আজ তাদের নৌকো উৎসব ৷

উবা আমাকে ওই বড় নৌকোটার কাছে টেনে নিয়ে গিয়ে বলল, ‘নৌকোটা একবার ভয়ানক বন্যায় ভাসতে ভাসতে আমাদের গ্রামের নদীতে এসে পড়েছিল, নৌকোয় কোনও মানুষ ছিল না, এর দাঁড়টি ভারি সুন্দরভাবে চিত্রিত, জঙ্গলের কোনও চিত্রকর ছাড়া আর কেউ এরকম দাঁড় বানাতে পারবে না ৷ নৌকোটি আপনা আপনি ভেসে এসেছে বলে উৎসবের দিন প্রথমেই এটাকে আনা হয়, এটা আমাদের গ্রামের বা আমাজনের এই দিককার নয় ৷ সারা বছর এটাকে ভারি যত্ন করা হয় ৷ উৎসবের দিনে সবচেয়ে উঁচু বেদির ওপর রাখা হয় ৷’

নৌকোর কথা বলতে উবার দেখলাম ভারি উৎসাহ ৷ নৌকোটার চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে সে বলে চলল, ‘এই নৌকোকে বলে কাসকো, আমাদের উবার থেকে কাসকো আলাদা ৷ একটা আস্ত গাছের গুঁড়ি থেকে কাসকো তৈরি করতে হয় ৷ কুড়ুল দিয়ে গুঁড়ির ভেতরটা চেঁছে ফেলে তারপর আগুনের তাতে জায়গাটাকে অনেক চওড়া করা হয় ৷ একটা আস্ত গুঁড়ি থেকে তৈরি বলে সাধারণ ক্যানোর চেয়ে কাসকো অনেক বেশি মজবুত ৷ সাধারণ ক্যানো তৈরি হয় কাঠ জোড়া দিয়ে ৷’

উবা আমাকে আরও অনেক রকম নৌকোর কথা শোনায় ৷ নদীর দেশের মানুষ, জল-জঙ্গলের বাসিন্দা, নৌকোর বিষয়ে এরা বলবে না তো কে বলবে! নৌকো উৎসব এদের একটা বড় উৎসব ৷ নৌকোর নামে এরা ছেলের নাম রাখে ৷

মুখ রাঙানো, মুখ চিত্র-বিচিত্র করা শেষ হবার আগেই আরও দশ-বারো জনের একটা দল এল ৷ তাদেরও মুখে লাল রং দিয়ে নানা নকশা করা ৷ কেউ কেউ গালে-কপালে শুধু লাল রং লেপে দিয়েছে ৷ তাদের সঙ্গেও খাবারের ঝুড়ি ও কয়েকজনের ঘাড়ে, কাঁধে বেঁটে বেঁটে ঢোল ও কয়েকটা অদ্ভুত চেহারার বাদ্যযন্ত্র ৷

মেয়ে-পুরুষ, ছোট-বড় সকলের মুখেই লাল রং, কারও কম, কারও বেশি ৷ মেয়েদের কোমরের মালা আরও চওড়া, তাতে কাঠের মূর্তি, ফল-মূল, লতা-পাতার বৈচিত্রও বেশি ৷ তাছাড়া তাদের কানে রঙিন ফুল, সেও লাল রঙের, বাহুতে লতা-পাতা ৷ এইসব লতা-পাতার আকার এতই সুন্দর যে যতই দেখি যেন তৃপ্তি হয় না ৷ মনে হয় আমাদের দেশের গুণী স্বর্ণকাররা দিনের পর দিন একমনে বসে বসে এইসব লতা-পাতা গড়িয়ে দিয়েছে ৷

সূর্য অস্ত যাবার সময় হয়ে আসছে ৷ সকলে তাদের আনা ফল-মূলের ঝুড়ি, ফলের রস আর সরবতের হাঁড়ি কাসকোয় সাজিয়ে রাখছে ৷ উবা এক ফাঁকে এসে আমাকে মেয়েদের কোমরে ঝোলানো পুঁতির মালার মতো দেখতে পাঁচ-সাত ছড়া একটা ফল দেখিয়ে জানিয়ে গেল, এর নাম আশাই ৷ একেকটা ছড়ায় পঞ্চাশ-ষাটটা আশাই রয়েছে ৷ ওরকম অনেক ছড়া নিয়ে আশাইয়ের এক-একটা গুচ্ছ হয় (এক বিদিমানুতে যত ইমানু তত বা তার চেয়ে বেশি) ৷

একটা সরবতের হাঁড়ি দেখিয়ে শুধু হাতের নাড়াচাড়ায় আর গলার স্বরে উবা বলল, ওটা হল বিরাট চেহারার সাদা রঙের গাছ তাপেরবা-র ফলের রসের সরবত, ফলগুলো হলদে রঙের ৷

উৎসবের ভিড়েও উবা আমার কথা একবারও ভোলেনি ৷ অচেনা মানুষ অজানা ভাষা সত্বেও আমি যাতে নিজেকে একা ভেবে কষ্ট না পাই সেজন্য সে বার বার এসে আমাকে এখানকার নানা জিনিসের পরিচয় বলে দিয়ে যাচ্ছে ৷

চারজনে মিলে মস্ত বড় একটা কাঠের ডালায় ছোটছোট ভাজা মাছ বয়ে এনে নৌকোটার ওপর রাখছে দেখে উবা আমাকে জানাল, ‘এর নাম টাম্বাকি, বড় সুগন্ধি মাছ, এরা শুধু ফল আর বীজ খেয়ে থাকে ৷ খেয়ে দেখো, তোমার ভালো লাগবে ৷’ কাছে গিয়ে দেখি অনেকটা আমাদের খয়রা মাছের মতো দেখতে, চওড়ায় হয়তো একটু কম ৷

উবার মা (উবাই বলে গেল, ওই ওর মা) এক ঝুড়ি পাকা পেঁপে হাতের লম্বা ছুরি দিয়ে মাঝখান থেকে দু-টুকরো করে বড় একটা ডালায় এমনভাবে সাজিয়ে রাখছিল যে দূর থেকে দেখে হঠাৎ মনে হয় একসঙ্গে অনেকগুলো সূর্যমুখী ফুটেছে ৷ অবশ্য বেশকিছু পেঁপে দেখলাম ভেতরটা একদম লাল ৷

উবা আমাকে দু-টুকরো পেঁপে দিয়ে গিয়েছিল, খেয়ে দেখি আমের মতো মিষ্টি ৷

আটজন ছেলে বুড়ো (ওদের মধ্যে উবাও আছে) কাঠের ডালায় একটা তিন-চার ফুট লম্বা রোদে-শুকনো আস্ত মাছ বয়ে এনে ডালাসুদ্ধ নৌকোর মধ্যে নামিয়ে রাখতেই উবা আমাকে হাত নেড়ে ডাকল ৷ কাছে গিয়ে দেখি, মাছটার শিরদাঁড়াটা বের করে নিয়েছে, ফলে ল্যাজা থেকে মুড়ো পর্যন্ত মাছটা দু-ফালি করা ৷ একটা ফালির ওপর আরেকটা ফালি এমনভাবে রাখা যে মনে হয় মাছটা আস্তই আছে ৷ উবা এর নাম বলল— পিরারুকু, খুব নাকি স্বাদ ৷

জঙ্গলের এক কিনারে সূর্য ডুবে গিয়ে আরেক কিনারে পূর্ণিমার চাঁদ উঠতেই সমস্ত জায়গাটা জুড়ে নাচ গান পান ভোজন শুরু হল ৷ এদের বাজনার মধ্যে জঙ্গলের পশু-পাখি কীটপতঙ্গের ডাক আর আওয়াজ শুনতে শুনতে আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল ৷ সেই রোমাঞ্চকর আওয়াজ ভারি সুন্দর ছন্দে-তালে বেজেই চলেছে ৷

এবার আর শুধু উবা নয়, আরও অনেক ছেলেমেয়ে, বুড়ো বুড়ি আমাকে হাত ধরে তাদের মধ্যে টেনে নিয়ে গেল ৷ নাচগানের মধ্যেই কেউ কেউ আমার হাতে নানা রকম খাবার তুলে দিল, কেউ দিল হাতির কানের মতো খোদলওলা পাতায় ফলের রস ৷ সত্যি বলতে কী, আমার সমস্ত দুশ্চিন্তা দুর্ভাবনা ভুলে আমি যেন একটা আনন্দের নদীতে একটা ক্যানো চড়ে ভেসে চললাম ৷ এত মানুষের এমন আনন্দ আর কোথাও আমি দেখিনি ৷ এ যেন শুধু এই জঙ্গলেই সম্ভব, শুধু এই জঙ্গলের মানুষের পক্ষেই সম্ভব ৷ সুগন্ধি টাম্বাকি মাছ আর পাকা পেঁপে আর নানারকম অচেনা কিন্তু সুস্বাদু ফলমূল খেয়ে আমার মন ভরে গেল ৷ খাওয়াও এমন আনন্দের হয়!

সকলের খাওয়া হয়ে গেলে সবাই মিলে গাইতে গাইতে, নাচতে নাচতে, পশুপাখি কীটপতঙ্গের ডাক আর আওয়াজ সুরে-তালে বাজাতে বাজাতে নদীর দিকে চলল ৷ নদীতীরে পৌঁছে সকলে নদীর পাড় বরাবর ছড়িয়ে গিয়ে গাছে-বাঁধা নানা মাপের নানা ধরনের নৌকো খুলে নিয়ে তাতে চড়ে বসল ৷ উবা আমাকে তাদের নৌকোয় তুলে নিল ৷ এবার আর সে দুপুরের উবাটা নেয়নি, অন্য একটা ক্যানোয় চড়েছি ৷

নৌকোগুলো অনেকটা যেন আকাশে বকের সারির মতো এগিয়ে চলেছে ৷ অনেক নৌকোতে গান-বাজনাও চলছে ৷ হঠাৎ চাঁদের ওপর চোখ পড়তেই আমি চমকে উঠলাম— এত বড় চাঁদ আমি কোথাও কখনও দেখিনি ৷ মনে হয় যেন আমাজনই চাঁদের নিজের দেশ ৷

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন