আমাজনের জঙ্গলে – ৮

অমরেন্দ্র চক্রবর্তী

এই তিনটে নদীর কোনওটাই তেমন চওড়া নয়, আমাদের সিকিমের পাহাড়ি নদীর মতো সরু ও খরস্রোতা ৷

ভোরবেলা রওনা হয়ে আমরা যখন এই তিন নদীর কাটাকুটি খেলা দেখতে দেখতে আমাজন নদীর ধারে এসে পৌঁছলাম সূর্য তখন প্রায় আমাদের মাথার ওপরে ৷

বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না, হেলিকপ্টারের আওয়াজ আমার খুবই চেনা, তবে এখানে এত বড় নদীর ওপরে বলেই কি না জানি না দুটো মাত্র হেলিকপ্টারের শব্দে মনে হচ্ছে যেন আকাশে-নদীতে-জঙ্গলে একেবারে হুলুস্থুল পড়ে গেছে ৷

দূরে আরও দুটো হেলিকপ্টার দেখা গেল, সে দুটোও এদিকেই আসছে ৷ এই তিন নদীর মোহনার ওপরে এসে কখনও জঙ্গলের মাথায়, কখনও নিচে নদীর ঠিক ওপরে চক্কর দিচ্ছে ৷

যে দুটো নিচে নেমে এসে জলের কাছে ঘুরছিল, সেই দুটো হেলিকপ্টারেই ভেতরের লোকদের স্পষ্ট দেখতে পেলাম, কাকা বা গঞ্জালো বা পুলিশের চেহারার কেউ না ৷ দুটো হেলিকপ্টার থেকেই বড় লম্বা লেন্স লাগানো ক্যামেরায় চারদিকের ছবি তুলছে সেটা সহজেই বোঝা যায় ৷ একজনের হাতে মনে হল ভিডিও বা মুভি ক্যামেরা ৷ একটা হেলিকপ্টারে দেখলাম, যে ছবি তুলছে সে মাঝে মাঝেই ক্যামেরা থেকে চোখ নামিয়ে কোলের ওপর ঝুঁকে কোনও কাগজ বা ম্যাপ বা ওই ধরনের কিছু দেখছে ৷

ক্রমে চারটে হেলিকপ্টারই একবার করে জঙ্গলের মাথায় চলে যায় আবার আমাজন নদীর ওপরে ফিরে আসে, কখনও কখনও খুব নিচু হয়ে তিন নদীর মোহনারও ছবি তোলে ৷

উবা, আর যে লোকটা কাল এখানে এসেছিল সে আর আমি ছাড়াও আমাদের দলে আরও দুজন আছে ৷ এদের একজন উবাদের গ্রামের মোড়ল, আরেকজন অন্য একটি দূর গ্রাম থেকে এসেছে, সেও তার গ্রামের মোড়ল ৷

আমরা পাঁচজন চারটে বিরাট চেহারার ব্রাজিলনাট গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে হেলিকপ্টারগুলোর ওপর নজর রাখছি ৷ দুটো হেলিকপ্টার অনেকটা নিচে নেমে জঙ্গলের ভেতরের ছবি তুলছিল, হঠাৎই নদীতীরের জমিতে নেমে পড়ল ৷ অন্য হেলিকপ্টারগুলোও বোধহয় তাদের দেখাদেখি একে একে মাটিতে নেমে এল ৷

লোকগুলো এবার হেলিকপ্টার থেকে বেরিয়ে এসে এদিক-ওদিক দেখতে লাগল ৷ দুজন তখনও ছবি তুলে চলেছে, বাকিরা খুব বড় একটা কাগজ মাটির ওপর বিছিয়ে তার ওপর ঝুঁকে পড়ল ৷

আমরা হামাগুড়ি দিয়ে ঝোপঝাড়ের আড়ালে আড়ালে নদীর উঁচু পাড় পর্যন্ত এগিয়ে গেলাম ৷ ভালো করে ঠাহর করে দেখে মনে হল লোকগুলো যে কাগজটার ওপর ঝুঁকে মনোযোগ দিয়ে দেখছে ও মাঝে মাঝে তা নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছে সেটা খুব বড় একটা ম্যাপই ৷

উবারা হেলিকপ্টার কী জানে না ৷ এরকম অদ্ভুত ডানাওলা এতগুলো জন্তু কেন তাদের নদী আর জঙ্গলের দেশে এসেছে ভেবে পাচ্ছে না ৷ বুঝতে পারছি, তারা খুবই ভয় পেয়েছে ৷

লোকগুলোর মধ্যে দু-তিনজন মনে হয় ব্রাজিলের, বাকিরা ইউরোপীয় বা আমেরিকান বলে মনে হল ৷ আমি উবাকে বললাম, ‘তোমরা এখানে থাকো, আমি ওদের সঙ্গে কথা বলে বুঝে আসি ওরা কী চায়, কেন এসেছে এখানে?’

উবা আমাকে এভাবে একা যেতে দিতে চায় না ৷ তার কাছে আমার ইচ্ছের কথা শুনে অন্যরাও হাত মাথা নেড়ে আমাকে নিষেধ করতে লাগল ৷ উবা আরও যুক্তি দিল, ‘একে তো অতগুলো বিকট জন্তু, তার ওপর অতগুলো ভিনদেশি লোক, ওখানে গেলে ওই জন্তুগুলো ঠিক তোমাকে জাপটে ধরে একদম আকাশে উড়িয়ে নিয়ে যাবে ৷’

‘না না, ওদের সামনে যাবার আগে আমি শান্তির পতাকা দেখাব, তাছাড়া ওরা তো সবাই খারাপ লোক নাও হতে পারে ৷’

মোড়ল দুজন কিছুতেই শুনবে না, বলল, যদি আমি যেতেই চাই, তারা আগে গ্রাম থেকে সবাইকে নিয়ে আসবে ৷ গ্রামের সবাই দক্ষ শিকারি, ছেলে-বুড়ো সকলেরই তীর ধনুক আছে ৷

সে তো আমিও জানি ৷ কিন্তু শিকারি দিয়ে এ রহস্য তো ভাঙবার নয়! আমি তাই অনেক করে তাদের বুঝিয়ে, এখনই ফিরে আসব, কথা দিয়ে একটা বেশ বড় কচুগাছের ধবধবে সাদা পাতা বোঁটাসুদ্ধ ছিঁড়ে যতটা পারি উঁচু করে ধরে দোলাতে লাগলাম ৷ এই কচুপাতাগুলো ঘুড়ির কাগজের মতো পাতলা, লম্বা, বোঁটা ধরে এদিক-ওদিক দোলালে হাওয়ায় সড়সড় করে শব্দ হয় ৷

অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে আমার সাদা পতাকা ওদের চোখে পড়ল ৷ একজন আমাকে লক্ষ করে চেঁচিয়ে বলল, ‘হাই! হোয়াট আর য়ু ডুয়িং দেয়ার, বাড্ডি?’

‘হেলো’ ‘হাই’ আজকাল আমাদের দেশের ইংলিশ মিডিয়ামের ছেলেমেয়েরাও বলে ৷ বাড্ডি কথাটাও কোথাও পড়েছি, মানেটা মনে করতে পারছি না, হঠাৎই মনে পড়ে গেল— বাড্ডি মানে ঘনিষ্ঠ বন্ধু, দোস্ত ৷

আমিও যতটা সম্ভব চেঁচিয়ে ইংরিজিতে বললাম, ‘তোমরা কে? তোমরা কোথা থেকে আসছ? কীভাবে তোমাদের সাহায্য করতে পারি?’

‘কাম ডাউন, প্লিজ কাম ডাউন ৷ তুমি এই জঙ্গলে এলে কী করে? তোমার দেশ কি পাকিস্তান, না মরিশাস, নাকি শ্রীলঙ্কা?’

আরেকজন বলল, ‘আর য়ু কামিং ফ্রম বাংলাডেশ?’

‘আই অ্যাম ফ্রম ইন্ডিয়া ৷’

উবাদের আরেকবার আশ্বস্ত করে আমি ঝোপঝাড়ের মধ্যে দিয়ে নদীর চড়ায় নেমে গেলাম ৷

এবার আমি হেলিকপ্টারগুলোর দিকে এগিয়ে যেতেই ওই বিদেশি সাহেবরা আমাকে দেখে আনন্দে হইচই লাগিয়ে দিল ৷

একজন আমার কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘য়ু আর নট আ জঙ্গলি, আর য়ু?’ (তুমি তো দেখছি জংলী নও, না কী?)

আরেকজন সেই সাহেবটার দিকে ফিরে বলল, ‘হি ইজ এ জেন্টল ম্যান ৷ ইজন্ট হি?’ (এ একজন ভদ্রলোক, তাই না?)

আরেকজন অন্যদের ঠেলে আমার একেবারে সামনে এসে বলল, ‘হেই! হাউ হ্যাভ য়ু কাম হিয়ার? হাউ কুড য়ু রিচ হিয়ার?’ (এই! তুমি এখানে এলে কী করে? এখানে পৌঁছলে কী ভাবে?)

আরেক সাহেব আরও জোরে চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘বিন হিয়ার লং?’ (এখানে কি অনেকদিন আছ?)

আরেকজন বলল, ‘এই জঙ্গলে থাকো কোথায়?’

যে আমাকে জেন্টলম্যান বলেছিল, সে এবার কোকাকোলার একটা টিন একটানে মুখটা খুলে আমার হাতে দিয়ে বলল, ‘ফিলিং থার্স্ট্রি?’ (তেষ্টা পেয়েছে?)

আরেকজন এক প্যাকেট বিস্কুট এনে প্যাকেটের মুখটা ছিঁড়ে আমার দিকে এগিয়ে ধরে বলল, ‘কবে কীভাবে কোত্থেকে এখানে এসেছ, কেনই বা এসেছ, একটু খুলে বলো তো বাপু! তুমি নিশ্চয়ই একা থাকো না, কাদের সঙ্গে থাকো?’

এরা কারা, কেন এখানে এসেছে, কেনই বা নদী আর জঙ্গলের ছবি তুলছে, অত বড় ম্যাপটাই বা কিসের, এসব আমি কিছুই জানি না ৷ ম্যাপ নিয়ে দলবেঁধে এরা আমাজনের জলে জঙ্গলে কোনও গুপ্তধনের সন্ধান করছে না তো? এদের কাছে সব কথা খুলে বলা বোধহয় ঠিক হবে না ৷ আমি শুধু বললাম, কাকার সঙ্গে বেড়াতে এসে জঙ্গলে কী করে যেন আমাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল ৷ তারপর অনেক খুঁজেও কাকার দেখা পেলাম না ৷ জঙ্গলে পথ হারিয়ে একা-একা ঘুরে বেড়াচ্ছি ৷

আমার একথা শুনে সাহেবরা নিজেদের মধ্যে চাওয়া চাউয়ি করল ৷ একজন বলল, ‘তোমার কাকার নাম কী? থাকেন কোথা?’

আরেকজন বলল, ‘কাকার পুরো ঠিকানা কী?’

পাছে রিওয় কখনও পথ হারিয়ে ফেলি, তাই দেশে থাকতেই মায়ের কথা মতো আমি কাকার ঠিকানা মুখস্থ করে রেখেছিলাম ৷ ঠিকানা শুনে সাহেবরা আরেকবার নিজেদের মধ্যে দৃষ্টিবিনিময় করল ৷ তারপর তাদের একজন আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘ঠিক কোথায় তোমাদের ছাড়াছাড়ি হয়েছিল?’

‘এখানে থেকে অনেক দূরে ৷ জঙ্গলের মধ্যে, সে জায়গাটার কোনও নাম আছে কি না জানি না ৷’

‘তার কাছাকাছি, ধরো বিশ-পঞ্চাশ মাইলের মধ্যে কোনও জায়গার নাম বলতে পারো?’

‘নিগ্রো আর সোলিময়েস নামে কালো আর হলদে জলের দুটো নদী যেখানে আমাজন নদীতে এসে পড়েছে, সেখান থেকে মনে হয়, দেড়-দুশো মাইল এগিয়ে আমাজন নদীর ডান তীরে কোথাও কাকা নেমেছিলেন আর ফেরেননি ৷ সেখান থেকেই আমি কাকার খোঁজে জঙ্গলের আরও ভেতরে ঢুকে পথ হারিয়ে ফেলি ৷ সে জায়গাটাও এখান থেকে দু-তিনশো মাইল হবে হয়তো ৷’

সাহেবরা খুব মন দিয়ে আমার কথা শুনছিল ৷ একজন হঠাৎ বলল, ‘পথ হারানোর পর থেকে তুমি কতদিন এই জঙ্গলে আছ?’

‘মনে নেই, বলতে পারব না ৷’

‘একা থাকো, না কারও সঙ্গে?’

আমার মন বলছে, উবাদের কথা এদের জানানো ঠিক হবে না, মিথ্যে করে বললাম, ‘একাই থাকি ৷’

‘ঘুমোও কোথায়?’

‘কাকার খোঁজে বনের মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে যেদিন যেখানে পৌঁছে সন্ধে নামে, সেদিন সেখানেই রাতটা কাটিয়ে দিই ৷’

‘খাও কী?’

‘জঙ্গলের অনেক ফলই খেতে শিখেছি, খেতে খুব ভালো ৷ ফলের রস খেয়ে তেষ্টাও মেটাই ৷ তাছাড়া কয়েক রকম ফল আছে, খোলা ভাঙলেই ভেতরে চমৎকার বাদাম!’

বলে আমার হঠাৎই খেয়াল হল এরা এখানে কী উদ্দেশ্যে এসেছে সেটা তো এখনও জানা হল না ৷ ওদিকে উবারা আমার অপেক্ষায় নিশ্চয়ই অস্থির হয়ে পড়েছে ৷

সবচেয়ে সামনের লোকটাকে আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমরা এখানে কেন এসেছ? কী করছ এখানে?’

‘আমাজনের এই রেইন ফরেস্ট আমরা মাপ জোক করছি ৷’

‘জঙ্গলের ছবি তুলে কী করবে?’

‘জঙ্গল মাপতে হলে তার ছবি তো তুলতেই হয় ৷’

‘কেন জঙ্গল মাপছ?’

‘এই জঙ্গল কাটা হবে, তাই ৷’

‘সে কী!’ আমার মুখ থেকে প্রচণ্ড একটা আর্তনাদ বেরল, ‘এত বড় জঙ্গল, সব কেটে ফেলা হবে?’

‘সব নয়, খানিকটা ৷ এই মনে করো পর্তুগালের মতো চারটে দেশ জুড়লে যতটা হয়, তার চেয়ে আরেকটু বেশি জায়গার জঙ্গল কাটা হবে ৷’

যখন আমার ব্রাজিলে আসা ঠিক হয়ে গিয়েছিল তখন বাবা আমাকে ব্রাজিলের রেইন ফরেস্টের বাংলা শিখিয়ে দিয়েছিলেন— চিরহরিৎ অরণ্য ৷

অর্থাৎ ব্রাজিলের এই চিরসবুজ দেশ রেইন ফরেস্টের বাতাস নির্মল, এই বিশাল অরণ্য অফুরন্ত অক্সিজেনের ভাণ্ডার ৷ তা কেটে ফেলা হবে?

আমি ভাবছি দেখে সাহেবটা আমাকে বলল, ‘চলো, তোমাকে আমরা রিওয় তোমার কাকার বাড়িতে পৌঁছে দেব ৷ এসো, কপ্টারে উঠে পড়ো, দুদিনেই রিওয় পৌঁছে যাবে ৷ কতদিন জঙ্গলে আছো, তোমাকে রিওয় পৌঁছেই বা তার আগেই মানাউসে ভালো করে ডাক্তার দেখানো দরকার ৷’ বলে সাহেব আমার জামা-প্যান্টের দিকে তাকাল ৷

আরেকজন সেই সাহেবকে বলল, ‘ডাক্তার তুমি আরিয়াউতে পৌঁছেই পাবে ৷ আরিয়াউ টাওয়ার্স হোটেলে শুনেছি আমাজনের জঙ্গলের পোকার কামড় থেকে যেসব অসুখ-বিসুখ হয় সেসবের আলাদা ডাক্তার আছে!’

আমি বললাম, ‘আমি কয়েক দিন পরে যাব ৷ আরও কয়েকদিন এখানে থেকে যেতে চাই ৷’

‘সে কী! এই ভয়ানক জঙ্গলে জংলী ছাড়া কেউ ইচ্ছে করে থাকে নাকি!’

আরেকজন সাহেব বলল, ‘আর য়ু ক্রেজি? আমাদের এই সাহায্যের জন্য তোমার কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত ৷ এই সুযোগ আজ হারালে জীবনে আর কোনওদিন তুমি এই জঙ্গল থেকে বেরতে পারবে না ৷ তুমি জানো না, এখানে কী ভয়ানক হিংস্র সব উপজাতি থাকে! ইউ উইল ডাই হিয়ার, মোস্ট পেইনফুলি!’ (এই জঙ্গলে তুমি মরে যাবে, খুব কষ্ট পেয়ে পেয়ে মরবে ৷)

যে আমাকে কোকাকোলা দিয়েছিল, সে হঠাৎ আমার একটা হাত ধরে বলল, ‘ডোন্ট বি সিলি, লেটস গো!’ (ছেলেমানুষি করো না, এসো, যাওয়া যাক!)

আমি আস্তে করে আমার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললাম, ‘আমি আজ যাব না ৷’

‘ইউ মাস্ট গো! অ্যান্ড টুডে!’ (তোমাকে যেতেই হবে! আজই!) বলে লম্বা চওড়া চেহারার সাহেব হঠাৎই আমাকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে সবচেয়ে কাছের হেলিকপ্টারের দিকে হনহন করে হাঁটতে লাগল ৷

আর ঠিক তখনই পাড়ের জঙ্গল ফুঁড়ে বুকে রামধনু আঁকা অনেকগুলো পাখির সুরেলা আর্তনাদ আমার বুকে এসে বিঁধল ৷

আমি হাত-পা ছুড়ে জোর করে লোকটার দুহাতের বেষ্টনী থেকে নিজেকে ছাড়াবার চেষ্টা করছি, আরেকজন কেউ এসে আমার পা দুটো চেপে ধরল ৷ সঙ্গে সঙ্গে আরও একজন আমার দুটো হাতও শক্ত করে ধরে রাখল ৷ সেভাবেই আমাকে হেলিকপ্টারে তুলে নিয়ে পাইলট হেলিকপ্টারটাকে আকাশের অনেক উঁচুতে তুলে ফেলল ৷

আমি উবার একটা ছবি এঁকেছিলাম, সেটা আমার ব্যাগেই রয়ে গেল ৷ উবা আমাকে তাদের দিমানু গোনার কচুরিপানা ফুলের রঙের নটা পাথর দিয়েছিল, সেগুলোও আমার ব্যাগেই পড়ে রইল ৷ পাড়ের জঙ্গল থেকে পাখির সুরে তাদের বিলাপ আমার বুক ভেঙে দিচ্ছে ৷ আমার দুচোখ ফেটে জল বেরিয়ে এল ৷

যে লোকটা আমার হাত প্রায় মুচড়ে ধরেছিল সে হঠাৎ আমার কানের কাছে ঝুঁকে এসে ইংরিজিতে বলল, প্লিজ ফরগিভ আস ৷ আমাদের ক্ষমা করো ৷ তোমার ওপর জোর খাটাতে হল বলে আমরা দুঃখিত ৷ কিন্তু আমরা শুধু আমাদের কর্তব্য করেছি, সভ্য মানুষের প্রতি সভ্য মানুষের যা কর্তব্য ৷ কোনও সভ্য মানুষ কি জংলীদের সঙ্গে জঙ্গলে থাকতে পারে?

রিও ডি জেনেরোয় পৌঁছে দেখলাম কাকার বাড়ি তালাবন্ধ ৷ শেষ পর্যন্ত হেলিকপ্টারের লোকেরাই পুলিশ ডেকে দরজা খোলার ব্যবস্থা করল ৷ ফাঁকা বাড়ি, যেখানে যেমন দেখে গিয়েছিলাম সব ঠিক তেমনই আছে ৷ তার মানে কাকা আমাজনের জঙ্গল থেকে আর ফিরতে পারেনি ৷

আমি যে ঘরটায় থাকতাম, সেই ঘরে ঢুকে দেখলাম টেবিলের ওপর ‘অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইন এইট্টি ডেজ’ বইয়ের ভাঁজে আমার প্লেনের টিকিট যেমন রেখে গিয়েছিলাম তেমনই গোঁজা রয়েছে ৷

পরদিন হেলিকপ্টারের লোকদেরই দুজন আমাকে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিল ৷

কলকাতায় ফিরে আমার সমস্ত মন যেন ব্যথায় কঁকিয়ে উঠল ৷ এত লোকজন ঘরবাড়ি বাস ট্রাম ঠেলা রিকশার ভিড়ে এখানে কেউ আমরা কারও বন্ধু নই! কেউ আমাকে চেনে না, আমিও কাউকে চিনি না!

ভিড়ের বাসে গুঁতোগুঁতি করে দুবার বাস বদলে আমি বাড়ি পৌঁছে দেখি মা দরজা খুলে দাঁড়িয়ে আছেন ৷

আমি প্রায় দৌড়ে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরলাম ৷ মাও আমাকে শক্ত করে ধরে রেখে বললেন, ‘কী ব্যাপার বল তো! একটা চিঠি নেই, খবর নেই, তোর কাকার বাড়িতে ফোন করলে কেউ ফোন তোলে না, মা-বাবার কথা একেবারে ভুলে গিয়েছিলি বাবা?’

‘বাবা কোথায়?’

‘আর বলিস না ৷ সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত থানা-পুলিশ, পুলিশের বড়কর্তা, মেজকর্তা, মন্ত্রী —কার কাছে যেতে বাকি রাখছেন?’

একটু থেমে মা আবার বললেন, ‘তোর সত্যি কী হয়েছিল বল তো ৷ হারিয়ে-টারিয়ে গিয়েছিলি নাকি?’

আমার তখন উবার কথা, উবাদের গ্রামের কথা, আমাজন নদীর কথা, আকাশ-ঢাকা জঙ্গলের কথা মনে পড়ে গিয়ে দুচোখ ঝাপসা হয়ে গেছে, ভিজে চোখেই মার মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘আমি উবাদের গ্রামে যাব মা, তুমি যাবে আমার সঙ্গে, আমাজনের জঙ্গলে?’

সন্ধেবেলা বাবা বাড়িতে ঢুকেই আমাকে দেখে আনন্দে উত্তেজনায় চেঁচিয়ে উঠলেন— ‘ফিরলি? তুই ফিরেছিস? ও ভগবান!’

আমার কাছে এসে আমাকে কাঁদতে দেখে আবার বললেন, ‘কী হল? তোর কী হয়েছে? কী হয়েছিল বল তো! তোরা কোনও বিপদে পড়েছিলি নাকি? একটা খবর নেই, কিছু নেই, তোর কাকাও কিছু জানাল না! যাক, শেষ পর্যন্ত বেঁচে ফিরেছিস, এই আমাদের ভাগ্য! এখন বল তো, ঠিক কী হয়েছিল? ফিরতে কেন এত দেরি হল?’

আমাজনের জঙ্গলে আমাদের হারিয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে একা রিও ডি জেনেরোয় ফিরে আসা পর্যন্ত সব ঘটনার কথা শুনতে শুনতে মা’র দুচোখের জল আর থামতে চায় না ৷ ‘ও! কী কষ্টই না সয়েছিস! কত কষ্ট পেয়েছিস! তোর কাকার যে কোথায় কীভাবে কাটছে’ —বলতে বলতে যতই মা চোখ মোছেন, ততই আবার চোখ বেয়ে জলের ধারা নামে ৷

বাবা আর সহ্য করতে না পেরে দুঃখে রাগে হতাশায় বলে উঠলেন, ‘ও চিরকালই গোঁয়ার ৷ আর তেমনই লোভী! বহরমপুরে একবার জাল ওষুধ বিক্রি করে পুলিশের হাতে পড়েছিল ৷ এত দিনেও ওর টাকার লোভ আর গেল না ৷ কোথায় ওর খোঁজ করব, কী করব, আমি তো ভেবেই পাচ্ছি না ৷ কী সাংঘাতিক বিপদের মধ্যে আছে, কত কষ্ট পাচ্ছে ছেলেটা, হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকাও তো যায় না! তুই কী বলিস?’

‘আমার মনে হয় আমাজনে গিয়ে যেভাবেই হোক কাকাকে খুঁজে বের করা দরকার ৷ আমি ঠিক পারব ৷’

‘দূর পাগল! তোকে আর যেতে দিই?’ মায়ের এই কথায় বাবাও সায় দিয়ে বললেন, ‘তুই কি সত্যিই পাগল হলি?’

আমি এবার বেশ জোর দিয়েই বললাম, ‘উবাদের সাহায্য নিয়ে আমি একাই কাকার খোঁজ করতে পারি ৷ উবারা আমাজনের সব জানে, ওরা তো আমাজনেরই মানুষ!’

‘থাম তো!’ বলে মা আবার ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন ৷

বাবা বললেন, ‘কথাটা আর ভুলেও ভাববে না ৷ মনে থাকে যেন ৷’

***

অধ্যায় ৮ / ৮

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন