আমাজনের জঙ্গলে – ৬

অমরেন্দ্র চক্রবর্তী

এমন জঙ্গল, এমন নদী, এমন চাঁদ, এমন মানুষজন— কাকারা সঙ্গে থাকলে আমার তো দেখাই হত না! আর কোনও দিন বাড়ি ফিরতে পারব কিনা সেই ভয়ানক দুশ্চিন্তা সত্বেও কী করে আমার কাকাদের কথাটা এভাবে মনে এল জানি না ৷

আমাদের একেবারে সামনের নৌকো থেকে ভারি সুরেলা বাজনা ভেসে আসছিল ৷ হঠাৎ থেমে যেতেই উবা জলের ওপর ঝুঁকে পড়ে বেশ খানিকটা জায়গায় সতর্ক চোখ বোলাতে লাগল ৷

দুয়েক মিনিটের মধ্যেই কাছে দূরে সব কটা নৌকোর গান-বাজনা থেমে গেল ৷ আকাশে বিরাট চাঁদ, নিচে বিশাল নদী, মধ্যিখানে অদ্ভুত স্তব্ধতা ৷

সেই স্তব্ধতার মধ্যে উবার ফিসফিস গলা শুনতে পেলাম— বোতো! বোতো!

তার বলার ভঙ্গি, চোখ-মুখের ভাব আর জলের দিকে আঙুল দেখানো থেকে বুঝলাম, উবা বলতে চাইছে বোতোকে দেখা গেছে!

বোতোর দেখা পাওয়া নাকি সবসময়ই ভালো, নৌকো উৎসবের রাতে দেখা পাওয়া খুবই সৌভাগ্যের লক্ষণ ৷

উবা আমাকে বুঝিয়ে দিল নৌকোয় নৌকোয় গান বাজনা থেমে যাওয়া মানে সকলে এতক্ষণে বোতোর দেখা পাওয়ার কথা জেনে গেছে ৷ একটা নৌকোয় গান বাজনা থামলেই বাকিরা যারা যত আগে সেটা খেয়াল করবে তারা তত আগে তাদের নৌকোর গান বাজনা থামাবে ৷ এভাবে কোনও একটা নৌকো থেকে বোতোর দেখা পাওয়ার দুয়েক মিনিটের মধ্যেই সব নৌকোয় সেই সুখবর ছড়িয়ে যায় ৷ তখন সকলেই গান বাজনা থামিয়ে যতটা সম্ভব নিঃশব্দে চারদিক থেকে গোল হয়ে প্রথম নৌকোটার কাছে ফিরে আসতে থাকে ৷

অন্যদের আর কথা কী, আমি নিজেও বোতোকে দেখবার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়েছিলাম ৷ বোতোই নাকি আমাজনে বিপদ আপদে মানুষকে রক্ষা করে! জলের তলায় তার মস্ত শহর, সেখানে রঙিন পাথরে তৈরি তার বিরাট প্রাসাদ!

হঠাৎ উবার ইশারায় নদীর জলে তাকিয়ে দেখি, খুব লম্বা মতো একটা প্রাণী তিন চার হাত জলের নিচে ধীরে ধীরে এঁকে বেঁকে ঘুরে বেড়াচ্ছে! তার নাক বা ঠোঁট খুব সরু, লম্বায় প্রায় এক-দেড় হাত ৷ মস্ত বড় মাথা, এর মস্তিষ্ক মানুষের মস্তিষ্কের চেয়ে বড় হলে আশ্চর্যের কিছু নেই ৷ এর ল্যাজটা শরীরের শেষ প্রান্ত থেকে দুদিকে ভাগ হয়ে ভারি সুন্দর দেখাচ্ছে ৷ রংটা ঠিক লাল কি? মনে হল যেন গোলাপীর দিকেই ৷

যদি ডলফিন হয়, তাহলে পূর্ণিমা রাতে আমাজন নদীতে ডলফিন দেখাও তো ভাগ্যের কথা, কজনের সে ভাগ্য হয়? আর যদি আমাজনের দেবতা হয় তাহলে নিশ্চয়ই আমার মনের কষ্ট আর প্রার্থনা বোতোর অজানা থাকবে না! জলের নিচে বোতোকে দেখতে দেখতে আমি মনে মনে বললাম, বোতো, তুমি কে, আমি জানি না ৷ তুমি যদি সত্যিই আমাজনের রক্ষাকর্তা হও, তুমি আমাকে আমার মা বাবা আর স্কুলের বন্ধুদের কাছে ফিরে যাবার উপায় করে দিও ৷

একটা ভারি আশ্চর্য ব্যাপার, চারদিক থেকে অতগুলো নৌকো একেবারে কাছে এসে ঘিরে ধরেছে, তবু বোতোর কোনও রাগ ভয় বিরক্তি নেই, সে আপনমনে আনন্দে মশগুল হয়ে খুব ধীরে ধীরে জলের মাত্র তিন-চার হাত নিচে ঘুরে বেড়াচ্ছে, কখনও কখনও জলের ওপরেও উঠে আসছে, সবসময়ই আনন্দে বিভোর, মনে হয় সে যেন তার মনের ভেতরের সুরে তালে ছন্দে লয়ে নেচে বেড়াচ্ছে ৷

জঙ্গলে ঘুরতে ঘুরতে উবা একেকদিন হঠাৎই হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসে পড়ে ৷ তারপর আমাকেও বসতে বলে ৷ তার গভীর চোখ দুটি আমার দুচোখের ওপর মেলে রেখে অনেকক্ষণ ধরে কী দেখে সে-ই জানে ৷ মাঝে মাঝে মনে হয় যেন আমার চোখের মধ্যে দিয়ে বহু দূরের কিছু সে দেখছে বা দেখবার চেষ্টা করছে ৷

বেশ কিছুদিন এরকম হবার পর, একদিন সকালে উবা একই ভাবে হাঁটু গেড়ে বসে আমার চোখে চোখ রেখে মাটির ওপর তার কাঠকুটোর ছবি তৈরি করতে লাগল ৷ ছবি দেখে আমি বুঝলাম, উবা আমার চোখের দৃষ্টি দেখে বুঝতে চায়, আমি কে? জানতে চায়, আমি কোথা থেকে এসেছি ৷ কোন পৃথিবীর মানুষ আমি, সেই পৃথিবীটা কীরকম?

এ প্রশ্নের উত্তর আমি কীভাবে বোঝাব জানি না ৷ ভাবলাম, যে-কলকাতায় আমরা থাকি, সেই কলকাতার কথাই ওকে বলি ৷ শেষ পর্যন্ত অনেক ভেবে চিন্তে বেশ বড় দেখে একটা জায়গা পরিষ্কার করে খুব মন দিয়ে সেখানে একটা ছবি এঁকে যতটা পারি আমার কথা, আমার বাবা-মায়ের কথা, বন্ধুদের কথা, স্কুলের কথা, কলকাতা শহরের কথা, শহর ভরা ঘর-বাড়ি, গাড়ি-ঘোড়া, দোকানবাজার, লোকজনের কথা বোঝালাম ৷ কলকাতা নামটাও তাকে বার কতক শুনিয়েছি ৷

উবা ওই মস্ত বড় ছবির ওপর ঝুঁকে পড়ে অনেকক্ষণ ধরে ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পুরো ছবিটা দেখেই আবার তার কাঠকুটো সাজাতে লাগল ৷ এই কাঠকুটো দিয়ে ছবি আঁকায় উবা ভারি ওস্তাদ ৷ এক পলক চোখ বুলিয়েই তার বলবার কথাটা আমি বুঝে নিলাম ৷

উবার মুখে কলকাতা কথাটা শুনে আমার এত আনন্দ হল যে কী বলব! দুই ঠোঁট গোল করে জিভ নেড়ে অদ্ভুতভাবে শব্দটা উচ্চারণ করে আর ছবি দেখিয়ে ও বলল, ‘কলকাতায় জঙ্গল নেই, পাখি নেই, প্রজাপতি নেই, বড় বড় নদনদী নেই, তুমি সেখানে থাকো কী করে? ও তো শুধু বালির দেশ!’

বালির দেশ অর্থাৎ মরুভূমি! কলকাতায় থাকতে, কই, একথা তো কখনও মনে হয়নি ৷ এখন আমাজনের জঙ্গলে বসে উবার মুখে শুনে মনে হল, সত্যিই তো, কলকাতায় ঘন সবুজ বনজঙ্গল, পাখি, প্রজাপতি এসব তো দেখা যায় না!

ভ্যানরিকশায়, অনেকটা টিনের বড় বাক্সের মতো দেখতে চারদিক বন্ধ গাড়িতে ছোট্ট ছোট্ট ছেলেমেয়েরা গাদাগাদি করে বসে স্কুলে যাচ্ছে— সেই ছবিটা দেখে উবা আমার দিকে তাকাল ৷ এই ছবিটার মানে সে একেবারেই বুঝতে পারেনি ৷ টিনের দেওয়ালে ছোট ছোট জানলার ফাঁক দিয়ে কেউ কেউ তার কচি মুখ তুলে বাইরেটা দেখতে দেখতে চলেছে, উবা সেই মুখের ওপর অনেকক্ষণ ঝুঁকে রইল, তারপর মুখ তুলে আমার কাছে এই ছবিটার মানে জানতে চাইল ৷

আমাজনের জঙ্গলে স্কুল কী করে বোঝাব! আরও কয়েকটি ছবি এঁকে যতটা সম্ভব স্কুলের বিষয়ে বললাম ৷ উবা বেশ খানিকক্ষণ আমার চোখে চোখ রেখে চুপ করে বসে বসে ভাবল ৷ তারপর তার কাঠকুটোর ছবি দিয়ে বলল— জঙ্গলের গাছপালা ফুল ফল কীটপতঙ্গের সঙ্গে না থেকে, গ্রীষ্ম বর্ষা শীত বসন্ত না দেখে কলকাতায় বসে তুমি কী করে এই জগৎটাকে জানবে?

এর পরই উবা হঠাৎ আমার একটা হাত নিজের দুহাতে নিয়ে, আমার দু-চোখে তার সেই গভীর দু-চোখের দৃষ্টি রেখে মুখে কোনও শব্দ উচ্চারণ না করে বলল— তুমি আর ওই দেশে ফিরে যেও না!

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন