অমরেন্দ্র চক্রবর্তী
একেকটা গাছ এখানে এত লম্বা যে মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে না গিয়ে কী করে আকাশে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে কে জানে! গাছ থেকে মস্ত মস্ত ঝুরি নেমে এসেছে নদীর জল পর্যন্ত ৷
হঠাৎ দেখি মোটাসোটা মস্ত একটা হনুমান গাছের একটা ঝুরি শুধু লেজ দিয়ে আঁকড়ে ধরে খুব জোরে জোরে দোল খাচ্ছে ৷ একেকবার বোটের প্রায় মাথা পর্যন্ত চলে আসছে দেখে আমার গায়ে কাঁটা দেয় ৷ বোটে নেমে পড়বে নাকি!
কাকা আমার মনের ভাব বুঝতে পেরে বললেন, ‘ভয় পেয়ো না, এদের বলে উলি মাঙ্কি ৷ উলের পুরু কম্বলের মতো গায়ের লোম ৷’
কাকার কথা শেষ হয়েছে কি হয়নি, হনুমানটা হঠাৎ ঝুরি ছেড়ে আমাদের বোটের ওপর লাফিয়ে নামল ৷ কেউ কিছু বোঝবার আগেই আরেক লাফে কাকার গায়ের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে দুহাতের হ্যাঁচকা টানে কাকার কোল থেকে তাঁর ব্যাগটা নিয়ে প্রথমে বোটের ছাদে উঠে গেল, সেখান থেকে আরেক লাফে একটা মস্ত ঝুরিতে ঝুলে পড়ল ৷
পরপর চার-পাঁচটা গুলির শব্দে চমকে উঠে দেখলাম কাকা ও গঞ্জালো দুজনের হাতেই রাইফেল ৷ রাইফেলের গুলি হনুমানটার গায়ে লাগেনি ৷ দুজনেই তখনও গুলি ছুড়ে চলেছেন ৷ হনুমানটাও ততক্ষণে বিদু্যৎ গতিতে এক ঝুরি থেকে আরেক ঝুরিতে লাফিয়ে, এক গাছ থেকে আরেক গাছে চড়ে জঙ্গলের মধ্যে হারিয়ে গেল ৷
গঞ্জালোর চোখ দিয়ে আগুন বেরচ্ছে, কাকা রাইফেল হাতেই বুক চাপড়ে হা হা করে কেঁদে উঠলেন ৷ গলা চিরে এই প্রথম বাংলায় বলে উঠলেন, ‘ওরে আমার সর্বস্ব গেল রে!’
ছোট একটা ব্যাগে কী করে মানুষের সর্বস্ব থাকে আমি জানি না ৷ আমার সবচেয়ে প্রিয় পঁচিশটা গল্পের বইও ওতে ধরবে না! ব্যাগটা চামড়ার, বেশ পুরনো, তবে তিন-চার ইঞ্চি লম্বা তালাটা খুব চকচক করছিল মনে আছে ৷ ব্যাগে কাকার সবকিছু ছিল বলেই হয়তো অত বড় তালা!
গঞ্জালো কাকাকে পর্তুগিজ ভাষায় খুব উত্তেজিত স্বরে কিছু বললেন, কাকাও এক ঝটকায় উঠে দাঁড়িয়ে আমাকে বললেন, ‘আমরা জঙ্গলে ঢুকছি, বোট এখানেই থাকবে, যত তাড়াতাড়ি পারি ব্যাগটা নিয়ে ফিরে আসব ৷’
বোটের চালককেও সেইমতো কিছু বললেন ৷ নদীর ধার ঘেঁসে যাবার সময়ই বোটের গতি বোধহয় প্রায় অর্ধেক কমানো হয়েছিল, এখন আরও আস্তে চালিয়ে চালক বেশ কৌশল করে বোটের একটা মুখ তীরের আরও কাছে নিয়ে গিয়ে বোট থামাল ৷ তারপর বড় একটা তক্তা পেতে দিল, তার এক মাথা বোটে, আরেক মাথা নদীর পাড়ের জঙ্গলে ৷ কাকা আর গঞ্জালো শুধু রাইফেল নিয়ে প্রায় দৌড়ে নেমে গেলেন, এক মিনিট পরে অনেক চেষ্টা করেও তাঁদের কাউকেই আর দেখতে পেলাম না ৷
তক্তা পাতাই রইল ৷ বোটে শুধু আমি আর চালক (ওর নামটা পর্যন্ত এখনও জানি না) ৷ চোখের সামনে শুধু সীমাহীন ঘন জঙ্গল ৷ ‘ভ্রমণ’ পত্রিকায় পড়েছিলাম দক্ষিণ আমেরিকার ন’টা দেশে ষাট লক্ষ বর্গকিলোমিটার জুড়ে এই আমাজন ৷ এর গভীরে এখনও এমন অনেক আদিম মানুষ আছে কেউ যাদের কোনওদিন চোখেও দেখেনি, যারা নিজেরাও তাদের আদিম অরণ্যের বাইরে আমাদের এই পৃথিবীর কথা, সভ্য মানুষ জাতির কথা কিছুই জানে না!
কয়েক ঘণ্টা আগে ভীষণ রোদ্দুরে নদী ঝকঝক করছিল, এখন আকাশে জলে আশ্চর্য রং ছড়িয়ে আমাজন নদীতে সূর্য অস্ত যাচ্ছে, এমন সূর্যাস্ত আমি কোথাও কখনও দেখিনি, কিন্তু বুক যখন ভয়ে ঢিবঢিব করে তখন সাত রঙের খেলাও চোখের মধ্যে দিয়ে মনের মধ্যে ঢুকতে চায় না ৷ আকাশ অন্ধকার হয়ে আসছে, নদীর জল অন্ধকার হয়ে আসছে, সামনের জঙ্গল যেন একটা জমাট বাঁধা অন্ধকার, এমন আগাগোড়া অন্ধকারে কাকারা পথ চিনে বোটে ফিরে আসবে কী করে, কখন ফিরবে, কিছুই ভেবে পাচ্ছি না ৷ জঙ্গলে নেমে যাওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত একবারও তাঁদের রাইফেলের শব্দও শুনিনি ৷
এদিকে বোটের চালকের ভাষাও জানি না, সারাদিনে তাকে একবারই কথা বলতে শুনেছি, কাকারা নেমে যাবার সময়, তার ভাষাও মনে হয় পর্তুগিজ ৷
আমি আর চুপ করে থাকতে না পেরে আমাদের ক্লাসের ইংরিজি বইয়ের মতো খুব সরল ইংরিজিতে বললাম, ‘কাকাদের এত দেরি হচ্ছে কেন? আপনি কি কিছু অনুমান করতে পারছেন?’
লোকটা কি ঘুমিয়ে পড়েছিল? ঘুম ভাঙা গলায় থেমে থেমে বলল, ‘রিপিত, অ্যান্দ স্পিক লিতিল স্লোলি’ (আবার বলো, আর একটু ধীরে ধীরে বলো) ৷
আমিও থেমে থেমে কথাটা আবার বললাম ৷
লোকটা এবারে তার অদ্ভুত উচ্চারণে যা বলল, তার মানে হল— আমাজনের জঙ্গলে যে কেউ যেতে পারে, ফিরতে প্রায় কেউই পারে না ৷ তবে ওই দুজনের একজন, যার নাম গঞ্জালো, সে খুব ওস্তাদ লোক, সে পথ চিনতে পারবে মনে হয় ৷ কিন্তু হনুমানের কাছ থেকে ব্যাগ ফেরৎ না পেলে তারা ফিরবে কি না তা শুধু বোতোই জানে!
‘বোতো কে?’
‘আমাজনে এসেছ আর জিজ্ঞেস করছ, বোতো কে? বোতো ভারমেলোর কথা তুমি শোনোনি?’
লোকটার গলার স্বরে কিছুটা রাগ আর বিরক্তি ৷ আমি খুব বিনীতভাবে থেমে থেমে তাকে বোঝালাম যে আমি তো আজই প্রথম আমাজনে এসেছি, বোতো ভারমেলোর কথা তাই এখনও জানা হয়নি, তুমি আমাকে বলো ৷
বোটে কি আলো জ্বলে না নাকি? অন্ধকারে লোকটার গলা শুনতে পেলাম— বোতোই এই আমাজন রাজ্যের রাজা, আমাজন নদীর নিচে সেই কোন প্রাচীনকাল থেকে তার ঝকঝকে বিরাট শহর ৷ নানা রঙের পাথরে তৈরি মস্ত রাজপ্রাসাদ ৷ বোতোর ব্রেন মানুষের ব্রেনের চেয়ে অনেক বড় ৷ এদের বুদ্ধি, দয়া-মায়া, সাঁতারের ক্ষমতা সবই মানুষের চেয়ে বেশি ৷ রহস্যময় আমাজনের কথা শুধু এরাই জানে ৷ আজকালকার সাহেবরা দু-চার দিনে আমাজনে ঘুরে বলে বেড়ায়— বোতো নাকি অনেকটা ডলফিনের মতো একটা প্রাণী, আমাদের লাল বোতোর রংও নাকি লাল নয়, গোলাপি! আমাজন একটা আলাদা জগৎ, বাইরের জগতের লোকেরা তার কীই বা জানতে পারে!
কাকা এখনও ফিরল না, আমার সেই বিপদ দেখে অথবা বোতোর কথা বলতে পেরে, যে কোনও কারণেই হোক লোকটার মনে একটু দয়া হয়েছে মনে হল ৷ এবার বেশ নরম গলায় বলল, ‘তোমরা অন্য পৃথিবীর লোক, শুনলে হয়তো বিশ্বাস করবে না, আমাজনের জঙ্গলে, দ্বীপে, নদীতীরে, এমনকী নদীর বুকে যারা ঘর বেঁধে থাকে, তাদের অনেকেই তাদের ছেলে বা মেয়েকে দেখিয়ে বলে— এটা বোতোর ছেলে, এটা বোতোর মেয়ে ৷ আমাজনে তুমি বোতোর গল্প শুনে শেষ করতে পারবে না ৷’
এই গাঁজাখুরি গল্প কেই বা এখন শুনতে চায়! তবে জলের নিচে রঙিন পাথরের রাজপ্রাসাদ শুনে ভাবনা হল, কাকারা ডুবুরি নামিয়ে অথবা নিজেরাই ডুবুরির মতো নিচে নেমে নদীগর্ভ থেকে রঙিন পাথর নেবার জন্য আমাজনে আসেনি তো? কাকার তো রঙিন পাথরেরই ব্যবসা! পর মুহূর্তেই মনে হল, এ অসম্ভব! কাকাদের মতো শিক্ষিত বুদ্ধিমান মানুষ নিশ্চয়ই নদীগর্ভে বোতোর রাজপ্রাসাদের গল্পে বিশ্বাস করবে না ৷
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন