আমাজনের জঙ্গলে – ৭

অমরেন্দ্র চক্রবর্তী

উবাদের গ্রামে এরমধ্যে আমার বেশ কয়েক দিন কেটে গেছে ৷ বেশ সুখেই কাটছে ৷ তাছাড়া প্রতিদিনই এদের জীবনের কত নতুন কথা জানছি, নতুন দিক দেখছি, সেও এক মস্ত আনন্দ!

একদিন ভোরে ঘুম ভাঙতেই উবা বড় বড় ঝরা পাতার শক্ত শিরায় বোনা থলে থেকে কচুরিপানা ফুলের রঙের নটা স্বচ্ছ পাথর বের করে আমাকে দেখিয়ে বলল, ‘আমাদের গ্রামে তোমার তিন দিমানু হল ৷ পুরো একটা ইদিমানু এখানে থাকবে তো?’

এক ইদিমানু মানে? মনে পড়েছে, ৯ X ৯ X ৯ = ৭২৯ দিন, আমাদের দুবছর! তার অনেক আগেই তো আমার মাধ্যমিক! তাছাড়া ততদিন আমাকে না দেখে, আমার কোনও খোঁজখবর না পেয়ে আমার মা-বাবার কী হবে? একটা কোনও খবর পাঠাতে পারলেও না হয় কথা ছিল, তাহলে অন্তত আরও সাত-আট দিমানু (৬৩ বা ৭২ দিন) থেকে যেতাম! অবশ্য উবার কথা মতো যদি এক ইদিমানু থেকেও যাই, তার পরেই বা দেশে ফেরার কী উপায় হবে? চিঠি টেলিগ্রাম টেলিফোন ফ্যাক্স ই-মেলের জগতের বাইরে উবাদের জগৎ!

একদিন আমি উবাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘তোমাদের ন-দিনে এক দিমানু হয় কেন?’

আমি ধরে নিয়েছিলাম, আমাদের যেমন সপ্তাহ ওদের তেমনই দিমানু ৷ তাহলে ন’দিন কেন?

উবা অদ্ভুতভাবে কাঠকুটো সাজিয়ে প্রথমে একটা তারা ভরা আকাশ আঁকল, তারপর সেখানে ন’টা শূন্য এঁকে সেই ন’টা শূন্যের মধ্যে হালকা বেগুনি রঙের ন’টা পাথর রেখে প্রত্যেকটা শূন্যের একেকটা নাম বলে গেল ৷ উবার কাঠকুটোর ছবি দেখে আর তার মুখের কথা শুনে আমি বুঝতে পারলাম, আকাশে ন’টি গ্রহ বলে ন’দিনে তাদের সপ্তাহ ৷ তাদের সপ্তাহের ন’দিনের নামও ন’টি গ্রহের নামে ৷ নামগুলো উবার মুখে পরে আরও কয়েকবার শুনে আমি একটা মোটা লতার শুকনো মোলায়েম পাতায় কী-একটা ফলের রঙিন রস দিয়ে লিখে আমার ব্যাগে রেখে দিয়েছি ৷

যতই এদের জগৎ দেখছি, এদের জীবন দেখছি, ততই যেন এই রহস্যময় জলজঙ্গল আমাকে গভীর ভাবে টেনে নিচ্ছে ৷

সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত উবাদের সঙ্গে জলে-জঙ্গলে ঘুরি আর এদের মতোই এখানকার কীটপতঙ্গ পশুপাখি গাছপালা লতাগুল্ভমের খোঁজখবর নিই ৷ খাবার, সাজবার ফল ও বীজ, ওষধি গাছের শেকড়-বাকড়, ফুলের পাপড়ি, গাছের ছাল, কীটপতঙ্গের পালক পাখনা কুড়িয়ে বেড়াই ৷ এখানে গাছ ফুল লতা পাতা কীটপতঙ্গ দেখেই দিনের পর দিন কাটিয়ে দেওয়া যায় ৷ জঙ্গলে এদের জীবনযাত্রা দেখে কত কী যে শেখা যায় তারও কোনও শেষ নেই ৷ বড় বড় পশুপাখির তো কথাই নেই, ছোট্ট ছোট্ট পোকাদের বাসা বাঁধা, খাবার জোগাড় করা, তাদের বাচ্চা বড় করা, বিপদে আপদে আত্মরক্ষার দক্ষতা দেখলে অবাক হয়ে যেতে হয় ৷ আর, কত রকম তাদের রং আর গড়ন, শুঁড় বা পাখনা! আমি শুধু প্রজাপতিই দেখেছি পঁচিশ রকম ৷ অদ্ভুত আশ্চর্য ফুল যে কত দেখেছি তা গোনাই অসম্ভব ৷

উবাদের দেখে মনে হয়, তারাও যেন এই বনের কীটপতঙ্গ লতা-গুল্ভমের মতোই আরেকটা প্রাণী ৷ তাদের জীবনে যা কিছু দরকার সব তারা এই অরণ্য থেকেই পায়, অরণ্যই তাদের পিতা মাতা ৷ এদের সবচেয়ে বড় উৎসবের নাম অরণ্য-উৎসব ৷ নৌকো-উৎসবের চেয়ে এই উৎসব অনেক বড়, ভোর থেকে শুরু হয়ে সন্ধে পর্যন্ত আনন্দের বন্যা বয়ে যায় ৷ অরণ্য-উৎসবে বহু দূর দূর গ্রামের মানুষ একসঙ্গে মিলেমিশে যায় ৷

দিনের শেষে রোজই সবাই গ্রামে ফিরে নানা রকম ফলের রস থেকে তৈরি সরবত খেয়ে খানিকক্ষণ নাচ গান করে, তারপর খাওয়াদাওয়া সেরে শুয়ে শুয়ে সারাদিনের ঘটনা বা অভিজ্ঞতা নিয়ে নিজেদের মধ্যে বলাবলি করে ৷

আমার শোবার জায়গা উবার পাশে ৷ এদের এই শুয়ে শুয়ে গল্প করার বিষয়ে উবা আমাকে বলেছিল, এরা সারাদিন এই অরণ্যের কোথায় কী দেখেছে, কোথাও কোনও অদ্ভুত কিছু ঘটেছে কি না এইসব বিষয়েই নিজেদের মধ্যে কথা বলে ৷

একদিন এইরকম নাচ গান খাওয়া দাওয়ার পর শুয়ে শুয়ে গল্প হচ্ছে, হঠাৎ আমার পাশের ছেলেটি উবাকে কী সব বলল, তারপর দুজনেই উঠে দাঁড়াল ৷ ইতিমধ্যে অন্যরাও উঠে দাঁড়িয়েছে ৷ সকলেই ব্যস্ত-ত্রস্ত হয়ে উবাদের দুজনের কথা শুনছে, নিজেরাও কিছু বলাবলি করছে ৷ মনে হল, যেন একটা জরুরি সভা শুরু হয়েছে ৷

হঠাৎ সকলে হাঁটু গেড়ে বসে বুক চাপড়াতে চাপড়াতে গলা দিয়ে অদ্ভুত সুরেলা গোঙানির মতো আওয়াজ করতে লাগল ৷ সুরটা আমার চেনা লাগল, এখানকার কী যেন একটা বড় আকারের পাখি, তার গলা ও বুকের মাঝখানে রামধনুর রং নিচ থেকেও আমার চোখে পড়েছিল, সেই পাখিটার গলায় আমি ঠিক এই সুরে এইরকম গোঙানি শুনেছি ৷ উবা আমাকে বলেছিল, সাপ এসে পাখিটার ডিম খেয়ে গেছে দেখে সে এইরকম সুরে ডাকছে ৷ অন্য সময় তার ডাক একেবারে আলাদা, এখন তুমি কিছুতেই তা শুনতে পাবে না ৷

এদের গলায়ও সেদিনের সেই পাখির সুর, তার মানে এদেরও কি তবে বড় কোনও বিপদ হয়েছে?

এরই মধ্যে দূর থেকে ঠিক একই সুরে একই বিলাপ ধ্বনি ভেসে এল ৷ তারপর আরেক দিক থেকে আরও অনেক দূরে এরকম শোনা গেল ৷ ক্রমে বহু দূরে দূরে এই সুরেলা গোঙানির শব্দ জেগে উঠল ৷ যেমন আমাদের দেশে ভূমিকম্পের সময় প্রথমে কাছাকাছি বাড়ি থেকে শাঁখ বাজে, পরে অনেক দূর দূর সব জায়গা থেকেই শাঁখ বাজতে শোনা যায়, এও যেন অনেকটা তেমনই ৷

উবা তার কাঠকুটো দিয়ে, হাত নেড়ে, আঙুলের ওঠা-নামা, মুখ-চোখের ভাব ভঙ্গিতে, গলার স্বরে আমাকে যা বলল, তা এইরকম— আজ উবাদের গ্রামের একজন অনেক দূরের জঙ্গলে, যেখানে তিন নদী জড়াজড়ি করতে করতে আমাজন নদীতে এসে পড়েছে সেখানকার আকাশে মস্ত বড় আর বিকট চেহারার পাঁচ-ছটা পাখিকে অনেকক্ষণ ধরে ঘুরে ঘুরে উড়তে দেখা গেছে ৷

‘আকাশে যাদের উড়তে দেখেছে তারা কি এত বড়?’ বলে আমি হাত দিয়ে এই ঘরটাকে দেখাই ৷

যে লোকটা তিন নদী আমাজনে পড়বার জায়গাটায় গিয়েছিল সে বলল, ‘সেই উড়ন্ত প্রাণীগুলো একেকটা এই ঘরটার মতো তো নিশ্চয়ই!’

‘তাদের পিঠে কি কিছু ঘুরতে দেখেছ?’

সে বলল যে সেই পাখির পিঠে মস্ত বড় মাকড়শার জাল দেখেছে ৷

কথা হচ্ছিল উবার মধ্যস্থতায় ৷ সব শুনে আমার মনে হল, এ কি তবে হেলিকপ্টার দেখেছে?

আমি মাটিতে বেশ বড় করে একটা হেলিকপ্টার এঁকে উবাকে বললাম, ‘ও কি এইরকম কিছুকে দেখেছে?’

উবা কিছু বলবার আগেই সেই লোকটা এক লাফে আমার কাছে এসে ছবিটার ওপর প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে বেশ খানিকক্ষণ মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সেটা দেখল, তারপর মুখ তুলে মাথা নেড়ে জানাল যে অনেকটা এরকম কয়েকটা প্রাণীকেই সে দেখেছে ৷

এত দূরে আমাজনের জঙ্গলে হঠাৎ পাঁচ-ছটা হেলিকপ্টার কেন?

দেখলাম সকলেই বেশ ভয় পেয়েছে ৷ এই উড়ন্ত প্রাণী যে আসলে হেলিকপ্টার সেটা বুঝে আমারও মনটা দমে গেছে ৷ হঠাৎ মনে হল, কাকারা আমাকে না পেয়ে মানাউস বা রিওয় ফিরে গিয়ে হেলিকপ্টার নিয়ে জঙ্গলে আমার খোঁজে আসেনি তো?

আমি উবাকে বললাম, ‘তিন নদী যেখানে জড়াজড়ি করে আমাজন নদীতে পড়েছে, কাল আমাকে সেখানে নিয়ে চলো ৷’

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন