হারবার্ট – ৬

নবারুণ ভট্টাচার্য

ছয়

“আপনারে গেছি ভুলে, চাও গো মুখানি তুলে
ধর সখি দুইটি চুম্বন”।

–সরাজকুমারী দেবী

১৯৯১-এর শীতে, কোনো এক বিকেলে, কালো অলেস্টার ও বিনুর দেওয়া প্যান্ট পরে, গত তিন-চার বছরের শীতকালে যেমন হয়েছিল আয়নায় নিজেকে দেখে মোহিত হয় হারবার্ট ও বলে ক্যাট, ব্যাট, ওয়াটার, ডগ, ফিশ!

কী করবে এখন হারবার্ট? সেই অ্যাডভেঞ্চার সম্বন্ধেও একটা অস্পষ্ট ধারণা ছিল তার। এদিক থেকে মিনিট কুড়ি হাঁটলে সায়েব পাড়ার এলাকা-রাস্তার নামগুলো শুনলেই কেমন লাগে-লাউডন, রডন, রবিনসন, শর্ট, উট্রাম, উড, পার্ক…

উপর্যুপরি কয়েকদিন এভাবে অদ্ভুত চেহারার এই মানুষটিকে দেখে দারোয়ান বা কোনো আয়ার হয়তো মনে হয়ে থাকবে নোকটা পাগল এবং চেহারাটা ভালো করে দেখলে মনে হয় ওর গায়ে হয়তো সত্যি সায়েবের রক্ত আছে। তা না হলে ওরকম রং, ওরকম তাকানো, একটু নীলচে চোখে….

হারবার্ট হাঁটছে। হঠাৎ ‘প্যাকার্স এণ্ড মুভার্স’-এর দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে গেল। কিছু বলবে? কী যেন বলার ছিল। থাক, এখন না বললেও চলে। হারবার্ট বিড়বিড় করে ক্যাট, ব্যাট, ওয়াটার, ডগ, ফিশ!

কেকের দোকান থেকে গন্ধ বেরোচ্ছে। কালো কাচ দিয়ে দোকানটা সাজানো। ঢুকবে? উরে বাবা, কতটা জায়গা নিয়ে বাড়িটা।বিরাট গেট। ভেতরে একটা মারুতি ব্যাক করছে পেছনে সাদা আলো জ্বেলে। যারা গাড়িতে তাদের থেকেও কিন্তু বাড়িটাকে ভালো চেনে হারবার্ট। ভেতরে একটা কাঠের সিঁড়ি থাকতেই হবে। সিঁড়িটা উঠে দুভাগে ভাগ হয়ে ডানদিকে বাঁদিকে উঠে গেছে। যেখানে ভাগ হয়েছে সেখানে একটা আয়না কালো কাঠের ফ্রেমে আটকানো, ফ্রেমটা আটকানো একটা স্ট্যাণ্ডে যার পা-গুলো বাঘের থাবার মতো ডুমোডুমো। দুপাশে দুটো পেতলের বড় ফুলরাখার পাত্র। ডানদিকের সিঁড়িটা দিয়েই হারবার্টের ওপরে ওঠার অভ্যেস। কিন্তু ওপরের ঘরগুলো কী রকম, কটা ঘর আছে, সেই ঘরে কী হয়েছিল, কে থাকত? মাথাটা ব্যথা করে হারবার্টের। একটা সিগারেট ধরায়। ফুটপাথে একটা পুরনো দিনের ঘোড়ার জল খাবার লোহার চৌবাচ্চা। তার কিনারে বসে। মুখে যদিও বলে-ক্যাট, ব্যাট, ওয়াটার, ডগ, ফিশ।

কিন্তু আবছা করে যেন সাদা পোশাকের, ফিনফিনে, সাদা গা দেখা যাচ্ছে, সোনালী চুল ….. চোখ বন্ধ করে ভাবতে থাকে হারবার্ট … মোমবাতি জ্বলছে আর সেটা নিভিয়ে দেবার জন্যে ফুঁ দিতে, এগিয়ে আসছে কেউ নিচু হয়ে, কাচের গেলাসের শব্দ …..হারবার্ট চোখ খোলে। অন্ধকার ছড়িয়েছে। রাস্তায় আলোগুলো জ্বলেনি। গাড়ির আলো। হারবার্টের একই সঙ্গে মনে হয় কিছু একটা যেন বলার ছিল আর এই বাড়িতে ঐ চিলছাদটা নেই।

বিখ্যাত জুয়েলারের ছেলে তার কর্মচারিদের নিয়ে এসেছিল এবং হারবার্টের কথায় সে বেজায় অপ্রস্তুত হয়ে যায়। মুখ লাল হয়ে ওঠে।

-কী এসব বলছেন। আমার বাবা দেবতুল্য লোক ছিলেন। এঁদের-ই বলুন না, দীর্ঘদিন বাবার কাছে কাজ করেছেন এঁরা-বলুন না, দাসবাবু …।

-কী বলেছি যে আমায় ওদের কাছে জানতে হবে। কী বলেচি যে গিলতে পাচ্ছেন না। বিষম ঠেকচে। গালাগালমন্দ কিছু করেছি?

-ঐ যে বললেন বাবা পাপী।

হারবার্ট হা হা করে হেসে ওঠে–বলেচি যে সামান্য পাপী, তৃতীয় স্তরে বিরাজমান। মানে কিছু বোজেন যে প্যাক প্যাক করছেন?

ছেলেটি এবার চুপ করে থাকে। শুনে যায়-ব্যবসায়ী লোক। বিস্তর বড় জাল ফেলচে, জাল গুটোচ্চে, মাছ খামচাচ্চে, আবার এ পুকুরের এঁড়ে মাছ ও পুকুরে ছেড়ে দিচ্চে-কী বুঝলেন?

-আজ্ঞে, ওঁর তো মাছ-ফাছের ব্যবসা কখনও ছিল না, আমাদের তো জুয়েলারি…

-আরে বাবা, এগুলো হল হেঁয়ালি। বুঝতে হবে। বলচি যে ব্যবসায়ী মানে বিষয়-সম্পত্তির বন্দোবস্ত তো, মরণমূছা কাটতে একটু সময় লাগে। তবে খুব বেশি টানলে ঐ দেড় বছর … তারপর ছাড়া পেয়ে যাবে। দিব্যি উড়ে বেড়াবে। ওঃ কী যে লীলা।

-আমাদের কী করণীয় তাহলে?

-আপনাদের? কিচ্ছু না। মন দিয়ে ব্যবসা করুন। তবে হ্যাঁ, জমির ব্যাপারটা নিয়ে অতিপ্তি একটা আচে?

-জমি?

-হ্যাঁ, হ্যাঁ, জমি। বলচে বড় দুশ্চিন্তা, বড় অতিপ্তি। কী লটঘট আচে নাকি কোথাও?

-আজ্ঞে, ঐ বারাসাতের একটা জমি নিয়ে যে মামলাটা চলছিল ..

-থাক থাক ও আমার শুনে কাজ নেই। পারলে মিটিয়ে নিন। আমার কী!

-আমরা তাহলে আসি। আপনার দক্ষিণাটা …।

-রাখুন না, এখানেই রেখে দিন। আপনাদের আর কী, পাপ জমচে তো আমার। আসুন ভাই। দুগগা দুগগা।

আর একটা লোক বাইরে দাঁড়িয়েছিল। বড় বড় চুল। চশমা। বেশ স্মার্ট। ঘিয়ে ঘিয়ে রঙের র-সিল্ক-এর বুশ শার্ট আর চকোলেট রঙের ফুলপ্যান্ট-লোকটা জুয়েলাররা চলে যাবার পর ভেতরে এল কবে আপনাকে একটু ফাঁকায় পাওয়া যাবে বলুন তো।

-বলুন না। এখন তো ফাঁকাই আচি।

-না, এখন আবার আমার সময় নেই। ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে। বিকেলে আপনি কেস দেখেন?

-আজ্ঞে না, বিকেলে একটু বেড়াই।

-বেড়ান? একদিন না হয় নাই বেড়ালেন। ব্যাপারটা ইমপরট্যান্ট।

হারবার্ট ঘাবড়ে যায়, ঝামেলাটামেলা কিছু নয় তো?

-ঝামেলা। একভাবে দেখলে ঝামেলা বৈকি। হেভি ঝামেলা। ঠিক আছে, আমি একসময় ঠিক এসে যাব। সন্ধেবেলা কী করেন।

-চলে আসি সাড়ে সাতটার মধ্যে।

-তারপর পাড়ার ঐ লুম্পেনগুলোর সঙ্গে ড্রিংক করেন। দেখুন, আমি সব জানি। ঠিক আছে, দেখা হবে। চলি।

-খোলসা করে কিছু বললেন না। খটকা লাগচে কেমন।

-লাগুক। আমি আসব। এসে খটকাটী ভাঙব। চলি।

রবিনসন স্ট্রিটের নার্সিং হোম থেকে একটা গাড়িবেরোচ্ছিল। ড্রাইভারের মাথায় সাদা টুপি। সেই গাড়িটাতে সুন্দরী ববচুল এক লেডি ডাক্তাকে দেখে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল হারবার্ট। গাড়িটা বিদেশি। টয়োটা বা ডাটসুন কিছু হবে। এইসব গাড়িতে সাসপেনশন এত ভালো যে ঝকানি প্রায় হয় না, ঢেউএর মতো গাড়িটা চলে যায়। এরকমই একটা ঢেউ-তে লেডি ডাক্তার যখন মাথাটা একটু ঝাঁকি দিয়ে চুল ঠিক করছিল তখনই হারবার্ট তাকে দেখে হাঁ-মুখ স্ট্যাচু হয়ে যায়। কাচের মধ্যে দিয়ে দেখা ঐ মুখ। চেনা তো বটেই। কিছু অসম্ভব দরকারি কথা বলার ছিল। লেডি ডাক্তার শুনল না। ড্রাইভার গাড়ি চালিয়ে দিল। চলে গেল লেডি ডাক্তার। কাঠের সিঁড়ি দিয়ে কে নেমেছিল?

ফ্রেমে বাঁধানো আয়নার ডানদিকের সিঁড়ি দিয়ে হারবার্ট নামছিল আর বাঁদিকের সিঁড়ি দিয়ে যে উঠছিল, যার পিঠ, ববচুল, কাধ, কোমর, সাদা পোশাক পরা, জামার সঙ্গে ঝালর, গাড়ির মধ্যে লেডি ডাক্তারকে পাশ থেকে দেখা ১৯৯১-এর শীতে হারবার্টের এক আশ্চর্য আবিষ্কার, লেডি ডাক্তার, দাঁড়াও, ওভাবে চলে যেও না। হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে ছুটলেও আমি তোমার গাড়ির নাগাল পাব না–দাঁড়াও শোনো-কথাটা শুনলে কী এমন দোষ হবে, যদি একবার আয়নাটার সামনে গেলে একটাও কথা মনে পড়ে যায়–উঃ।

মাথাটা দপদপ করছে। অলেস্টারের মধ্যে গরম লাগছে। বড় বড় বোতাম। হঁচকা মেরে খুলতে গিয়ে একটা বড় কালো মেডেলের মতো বোম ছিঁড়ে ছিটকে পড়ে গেল। হাতড়ে কুড়িয়ে নেয় হারবার্ট। বোতামটা পকেটে রাখে। লেডি ডাক্তারকে কী বলবে হারবার্ট? হারবার্ট হাঁটতে থাকে। ফিসফিস করে বলে যায় ক্যাট, ব্যাট, ওয়াটার, ডগ …।

বেড়ানোর সময় বার বার, বিকেলের পর বিকেল ঐ নার্সিং হোমের সামনে এসে অনেকবার দাঁড়ালেও হারবার্ট আর ঐ লেডি ডাক্তারকে দেখতে পায়নি। খুব রাগ হয়েছিল। অভিমান হয়েছিল। শুনছে কে? লেডি ডাক্তার তো চলে গেল। শুনলই না। হারবার্ট হাঁটতে থাকে। মুখ দিয়ে মেশিনগানের শব্দ করে। মেশিনগান দেখেছিল হারবার্ট। সিনেমায়। রাষ্ট্রটাটাইটাট!

একটা আধপাগলা লোক এসে হাজির। তার বোন পালিয়ে যায়। কয়েকমাস পরে হাওড়া স্টেশনে ট্রাংকের মধ্যে বোনের টুকরোগুলোকে সনাক্ত করার পর তার মাথা বিগড়ে গেছে। সে এসেছিল হারবার্টের কাছে।

-আমি ট্রাংক, সুটকেস, কোনো বন্ধ বাক্স দেখতে পারি না। আমার শুধু মনে হয় বন্ধ ডালার ফাঁক দিয়ে চুল বেরিয়ে ঝুলছে। ডালাটা খুললেই দেখতে পাব..

লোকটা ময়লা শার্ট আর প্যান্ট পরা। ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে আর ‘না’ বলার ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে-পারছি না। কিছুতেই স্ট্যাণ্ড করতে পারছি না, একটু হেলপ করুন, আই শ্যাল ডাই, দোহাই আপনার, একটু হেলপ করুন, আপনি তো পারেন ডেডদের সঙ্গে কমিউনিকেট করতে, আমার বোনটা …

এবার প্রায় চিৎকার করে কাঁদতে থাকে নোকটা। অনেকক্ষণ ধরে কাঁদে। পকেট থেকে নোংরা রুমাল বের করে মুখ মোছে, চশমা মোছে।

-আপনার বোনের নাম কী ছিল?

-শান্তা।

-হারবার্ট কাগজে লেখে–সানতা। তারপর নামটার তলায় একটা লাইন দেয়।

-ফটো-টটো কিছু আছে আপনার বোনের?

-ফটো তো আনিনি। তবে চলে যাবার পরে একটা চিঠি এসছিল ওর। তার জেরক্সটা আছে। দেব?

-জেরক্স কেন?

-ওরিজিনালটা লালবাজারে।

-বাবা! পুলিশ, ফৈজত, আচ্ছা দিন। আমার পড়ার দরকার নেই। একটু ছুঁয়ে থাকতে হবে। বসতে হবে কিন্তু আপনাকে। একটু ঘুরে আসুন না বরং। একা থাকলে কাজটা আর কী ভালো হয়।

-হ্যাঁ, ঘুরে আসছি। আপনি দয়া করে আমাকে হেলপ করুন। বিশ্বাস করুন আমি পাগল হয়ে যাব।

একে কি বলবেহারবার্ট ভেবে পায়নি। ঘরের দরজা বন্ধকরে জানালা দিয়ে আসা আলোয় হাঁচড়-পাঁচড় করে ‘পরলোকের কথা’ খুলেছিল। ভেবেছিল ‘ভ্রাতৃস্নেহেমৃতা ভগিনীর আবির্ভাব’ থেকে কিছু একটা দাঁড় করাতে পারবে—’সে ১৮৭২ সালের কথা। যশোহরের চাঁচড়ারাজ সরকারের প্রধান কর্মচারি ঁনবীনচন্দ্র বসু মহাশয় তখন সপরিবারে কলিকাতা সুকিয়া স্ট্রীটের ৩নং বাড়িতে বাস করিতে ছিলেন …তবে কি সে পেত্নী হইয়াছে?” এর থেকে কিছু পাওয়া সম্ভব নয়। ‘মৃতপত্নীর প্রতিহিংসা’ বা ‘সতীনের উপর আবির্ভাব’ থেকেও কোনো রাস্তা বেরোল না। ‘আমার হারানো মেয়ে জ্যোৎস্না’ থেকে বরং পাওয়া গেল উচ্চস্তরের আত্মা উজ্জ্বল হয়। তাতেই বা কী? হারবার্টের ভয় ভয় করেছিল। গোটাটাই। এ কী এলরে বাবা। হঠাৎ দরজায় টক্ টক শব্দ। দুরু দুরু বুকে দরজা খুলে দেখে চায়ের দোকানের ছেলে পাঁচু গেলাস নিতে এসেছে। পাঁচ বলল যে চায়ের দোকানে কেউ তো বসে নেই। তখন চটি গলিয়ে বেরিয়ে হারবার্ট সিগারেটের দোকান, বাস স্টপ সব দেখল। কোথাও নেই। লোকটা আর আসেনি। হারবার্টের কাছে অন্যান্য ঠিকানা লেখা কাগজের সঙ্গেশান্তার চিঠির জেরক্স কপিটা থেকে গিয়েছিল।

লোকটিকে যা বলা যেতে পারত সেইগুলো বরং কাজে লেগে গেল। এক ছোকরা ডাক্তার, বাচ্চাদের স্পেশালিস্ট, সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল বেলজিয়ামের সুন্দরী অভিনেত্রী টিনাকে। টিনা ইন্ডিয়া দেখতে এসেছে। টিভি ও স্টেজে অভিনয় করে। ওকে দেখার জন্য হারবার্টের ঘরের সামনে ভিড় জমে গিয়েছিল। ডাক্তারটি হারবার্টের কথা ইংরিজি করে বলে দিচ্ছিল। টিনার মা-ও অভিনেত্রী ছিলেন। কিন্তু গাড়ির একসিডেন্টে পঙ্গু হয়ে যান। টিনার বাবা আবার বিয়ে করেছে। সেই মা মারা গেছেন। বড় দুঃখ টিনার। সস্নেহ মাতার আত্মার অনেক কার্যকলাপ হারবার্টের জানা-বিদেশী বলে একটু বেসিক থিওরিও প্রয়োগ করেছিল অব্যর্থ-মৃত্যুর পরে ছ’রকম প্রেত হয়–সেগুলো কী কী-কে কোন স্তরে থাকে-মার স্নেহ কীভাবে বিপদ আপদ থেকে রক্ষা করে। টিনা বলেছিল সে একজন তিব্বতী লামার কাছে গিয়েছিল, লণ্ডনে। সেও বলেছিল-প্রেত ছয় রকমের কিন্তু তার মা কোথায় থাকতে পারে, কীভাবে আছে কিছুই বলতে পারেনি। মেমসাহেব একশ টাকা দিয়ে গিয়েছিল হারবার্টকে। পাড়ায় হারবার্টের ইজ্জৎ আরও দশগুণ বেড়ে গেল। ডাক্তার একটা রসিদেও সই করিয়েছিল হারবার্টকে।

-গুরু! তুমি তো ক্যান্টার করে দিচ্চ। মেমটা আবার কবে আসবে গো?

-দরকার পড়লেই আসবে। যা ডোজ দিয়েছি।

-বস্, তুমি নাকি মেমটাকে নিয়ে দরজা বন্ধ করে ভূত দেখিয়েচ।

-এই এক ক্যাওড়ামি তোদের গেল না। ওসব ফুটি মারার ধান্দা জানবি হারবার্ট করে না। মেম দেখাচ্চে! কত মেম বলে দেখলাম।

লেডি ডাক্তারের দেখা না পেলেও হারবার্ট পার্ক স্ট্রিটের এক বন্ধ অ্যান্টিকের দোকানে কাচের মধ্যে পরীকে দেখেছিল। এবং সঙ্গে সঙ্গে সে বুঝতে পেরেছিল যে ঐ পরীই লেডি ডাক্তার বা সিঁড়ি দিয়ে যে উঠে গিয়েছিল তার ছোটবেলা। পরীর থেকে একটু বড়ই ছিল বুকি। কিন্তু চিলছাদ থেকে দেখা বুকি অন্যরকম। মেলানো যায় না। কিন্তু পরীকে দিয়েই শুরু। সোনালী চুল, হলদেটে পাথর দিয়ে তৈরি। গায়ে পাথরের কাপড় জড়ানো। বাঁ হাতটা ভাজ করে মাথার পেছনে রাখা। ডান হাতটা উঁচু করে একটা আলো ধরে আছে। আলোটা জ্বালানো যায়, কারণ একটা কালো ইলেকট্রিকের তার নেমে গেছে। ইলেকট্রিকের তারটা দেখতে অস্বস্তি হয় হারবার্টের। পরীর আশপাশে কত কী! পাথরের ফুলদানি, পাথরের চেয়ার, পেছন ফিরে থাকা কাঠের হাতি, পাথরের টেবিলের ওপরে রাখা মস্ত একটা পুরনো জাহাজের আলো।

-ক্যাট, ব্যাট, ওয়াটার, ডগ, ফিশ!

ঐ পরীর দিকে তাকিয়ে হারবার্ট কানে মৃতা পশ্চিমী নারীদের গান শুনতে পেয়েছিল। সেই গান দল বেঁধে বিলাপ করতে করতে এসে ধোঁয়াধুলো মাখা দোকানের কাচে ধাক্কা মারে। হায় নগ্ন পরী! জার্মান মেশিনগানের সামনে সেই রুশী যুবতী যেননগ্ন, দুহাত দিয়ে বুক ঢেকে দৌড়চ্ছে কালো মাটির ওপর। শুনতে সে কোনো কথাই চাইছে না। ব্যস্ত পথচারীরা দাঁড়িয়ে চুপ করে থাকলে শুনতে পেত যে হারবার্ট গুমরে গুমরে মুগ্ধ হয়ে কাঁদছে এবং সেই পরী ক্রমশ ওপরে উঠছে–তার গাল ঘষে দিচ্ছে দড়ি মইতে বাধা বিরাট বেলুন। শীতের পার্ক স্ট্রিটে এক ঝলক রেফ্রিজারেটরের হাওয়া এসে হারবার্টকে জড়িয়ে ধরে। হারবার্ট অলেস্টারের কলারটা তুলে দেয় এবং তাকে হলিউড ছাড়া এখন অন্য কিছু ভাবা অসম্ভব। এখনও বিকেল আছে। তখনও বিকেল ছিল। এরপর অন্ধকার ছেয়ে এলে পরীও লুকোতে শুরু করবে। গাড়ির আলো কখনো কখনো তাকে চমকে দেবে। মনে হবে তার ঠোঁট নড়ছে। অন্ধ দুটো চোখে হলুদ আলো জ্বলছে। হারবার্ট ফিসফিস করে বলেছিল,-জেপটে জুপটে থাকো এখন। ফের আসবখন।

ফেরার রাস্তায় গাছ, পরিচিত কুষ্ঠরোগী, বারান্দার থাম, সাইনবোর্ড, চায়ের দোকান, ডিউটি সেরে বাড়িতে ফেরা আয়া, নার্স, বেশ্যা, পার্কের রেলিং, জলাধারের গায়ে আঁকা সিংহ ও মিকিমাউসের ছবি, শহরের পাতাল থেকে উঠে আসা জল–প্রত্যেককে আলাদা করে কিছু না কিছু বলার ছিল। বিজ্ঞাপনের বিরাট হোর্ডিং এর ওপরে গাড়ির আলোর চলাফেরা দেখে হারবার্টের মনে হয় সে সিনেমার পর্দার দিকে তাকিয়ে আছে। রাস্তার ভিড়ে, কৃষ্ণদাদার পাশে দাঁড়িয়ে হারবার্ট ফল অব বার্লিন দেখেছিল। তার সঙ্গে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আরও ডকুমেন্টারি ছিল। নগ্ন একটি রুশী যুবতী দুহাতে বুক ঢেকে কালো মাটির ওপর দিয়ে দৌড়চ্ছে আর কয়েকজন জার্মান সেনা মেশিনগান তুলে ধরছে। সেই যুবতী ছুটছে তো ছুটছেই। শুনতে সে কোনো কথাই চাইছে না। রাষ্ট্র টা টা টাট..

বছরের চাকা ঘুরল। ১৯৯২ এল দেদার কেচ্ছা-ফেচ্ছা, চুরিচামারি আর হারামিপনার ফিরিস্তি নিয়ে। বছরের শুরুটা হারবার্টের খারাপ হয়নি। কয়েকটা বাংলা কাগজে দু-একটা লেখাও বেরিয়েছে। জানুয়ারিতে বিশেষ কিছু হল না, ফেব্রুয়ারিতেও না-টুকটাক কেস অবশ্য আসছিল। মার্চেও বিশেষ কিছু না। পয়সা যা আসছিল তাতে হারবার্ট খুশিই ছিল। তবে মাল, সিগারেটের খরচাটা বড় বেড়ে গিয়েছিল। হারবার্ট ঠিক করল দোল যখন ১৮ তারিখে পড়েছে তখন রংবাহারী খরচ খরচা যা হবার হয়ে যাক। এরপর সব ছেড়েছুঁড়ে, সাত্ত্বিক টাইপের হয়ে যাবে। সাহসটাও কেমন যেন কমে যাচ্ছিল হারবার্টের। আসলে গণ্ডগোল হয়েছিল মেশিনে-সাউণ্ড আছে, পিকচার নেই। পিকচার আছে, সাউণ্ড নেই। মানুষও তো টিভি। হারবার্টের শরীরটা এখানে ওখানে কাঁ কে করছিল কিছুদিন ধরে। জ্যাঠাইমা বলেছিল,-ারে পয়সাকড়ি আসছে, শরীরটা অমন মাছের কাটার মতো হচ্ছে কেন রে? বেশি নেশাভাং করচিস তাহলে।

যাঃ কী যে বলল জ্যাঠাইমা। আসলে হয়েছে কী জানো, ধকল যাচ্চে তো খুব, একেবারে হাড়কালি করা ধকল, তাই সব বসা শুকিয়ে যাচ্চে, মাসে জমচে না।

-বসা টানা তো সাধুপুরুষের লক্ষণ রে। আমার হারুর সাধু হয়ে কাজ নেই। তোকে আমি বিয়ে দেব। সংসারে বাঁধতে হবে।

-কে আমাকে বিয়ে করবে জ্যাঠাইমা।

-শোন কতা। রোজগেরে ছেলে। এমন দেবকান্তি দেকতে। কত ছুঁড়ি বলে পুঁতি খুঁজতে খুঁজতে বরের ঘরে ছুটবে

পুঁতি গড়িয়ে যায়। সেই পুঁতি খুঁজতে খুঁজতে কেউ তো হারবার্টের কাছে আসেনি। না বুকি। না লেডি ডাক্তার। আর পরী? না, পরীকে কিছুতেই হারবার্ট বৌ বলে ভাবতে পারে না। দোলের দিন খুব রং খেলা হল। মাথার চুলের মধ্যে কী একটা দিয়েছিল কেউ যত জল ঢালে ততই রং বেরোয়। ততই রং বেরোয়। গলগল করে।

দোলের পরের দিন। খোঁয়ারি কাটেনি। ভরদুপুর বেলায় ভেজানো দরজা খুলে সেই বানচোৎ এসে হাজির যে ঘিয়ে রঙের র-সিল্কের বুশ শার্ট পরে এসে বলে গিয়েছিল যে সময়মতো এসে খটকা ভেঙে দেবে। হারবার্ট তখন স্বপ্ন দেখছিল সে হাসপাতালের দরদালানে বড় বড় কাচের বয়ামে রাখা মানুষের নানা রকম শরীরের টুকরো, গাদা বাচ্চা, মুখ চোখ হয়নি, এই সবের মধ্যে দিয়ে সে একটা ন্যাংটো মেয়েকে নিয়ে পালাচ্চে। ল্যাংটো মেয়েকে নিয়ে বেরোবে কী করে? উপায় ছিল। হাসপাতালের চত্বরে ছায়া ছায়া জায়গায় খানকিরা মরা মেয়েদের কাপড় বিক্রি করছিল। সস্তায় একটা নাইলনের কাপড় হারবার্ট সেইন্যাংটো মেয়েকে কিনে দিল। কাপড়টা পরে হারবার্ট আর মেয়েটা হাসপাতালের গেট থেকে বেরিয়ে দেখল ট্রাম-ডিপো। কিন্তু ট্রামে না চড়ে তারা একটা রিকসাতে উঠল। রিকসাটা চলছে। হারবার্ট নিচে তাকিয়ে দেখে তো অবাক–আরে, মেয়েটার পায়ে একটা হাইহিল জুতো সে তো খেয়াল করেনি। মেয়েটার বগল এই তো পাশে। নাইলন ঢাকা দেওয়া বুক শুরু। সেই সময় চোখ খুলল হারবার্ট। ঝুঁকে র-সিল্ক ঘিয়ে ঘিয়ে বুশ শার্ট তাকিয়ে।

-ঘুম হচ্ছে? ঘুমিয়ে থাকলে খটকা ভাংবে?

হারবার্ট ধড়মড় করে উঠে বসে।

-বলেছিলাম না, সময়মতো আসব। ওঠো, জাগো, হারবার্ট সরকার, তোমার সঙ্গে আমার ভীষণ দরকার।

লোকটা ব্রিফকেস খুলে একটা চ্যাপটা মদের বোতল বের করেছিল। বের করেছিল দুটো ফিনফিনে গেলাশ। এক প্যাকেট ক্লাসিক সিগারেট। লাইটার। হারবার্টকে বলেছিল,–যাও পাঁচু, গিয়ে মুতে এসো, এসে, গাট হয়ে বসো। অবাধ্য গর্দভের মতো চেয়ে থেকো না। যা বলছি তাই করো। এতে তোমারও মোঙ্গল, আমারও চেংগিশ খান।

হারবার্ট ঘেবড়ে যেয়ে দুদ্দাড় করে হিসুফি সেরে ফিরে দেখল লোকটা দুটো গেলাস ভরতি করে সাজিয়ে বসে আছে। দুজনে গেলাস ধরল, সিগারেট ধরাল, লোকটি বলল,-চিয়ার্স নয়, স্কুল নয়, আমরা বাঙালি, বাংলাদেশে এখন সবাই বলছে–উল্লাস! হারবার্টও বলল,-উল্লাস!

লোকটির নাম সুরপতি মারিক। বাড়ি, জমি, ভেড়ি, কয়লা, মোপেড-নানা বিষয়ে মধ্যস্থতা করে প্রভূত অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছে। কমপিউটারাইজড় হরোস্কোপ এদেশে যাঁরা প্রথম চালু করেন তাদের মধ্যে নাকি শ্রীমারিকও ছিলেন। বড় মাপের প্রফেশনাল ফুটবল কলকাতায় চালু করার জন্যে হন্যে হয়ে যাচ্ছে সুরপতি। রুসি মোদি, রতন টাটা, ছাবারিয়া, আমবানি–এদের সকলের সঙ্গেই বিগত তিন বছরে ফুটবলের ব্যাপার নিয়ে সুরপতির কথা হয়েছে। কিন্তু এখন তার নজর হারবার্টের দিকে পড়েছে। নেক নজরে তাকিয়ে থেকে সুরপতি বলে যায়–দ্যাখো ভাই, তোমার ঐ ভূতফুৎ আমি মানি না। ওদের সঙ্গে তোমার কেমন দহরম মহরম তাতে আমার বিশ্বাসও নেই, অবিশ্বাসও নেই। আমি শুধু একটা ব্যাপার বুঝিতেলাপিয়া যদি চৌবাচ্চায় থাকে তার সাইজ বাড়ে না।

-মানে ভাই, তুমি বলতে চাই আমি চৌবাচ্চার তেলাপিয়া?

-তা নয়তো কী? ঝিলের গজাল না সাগরের তিমি। স্পেডকে স্পেড় আমি বলবই।

-তা তোমার মোদ্দা কতাটা কী সেটা ঝেড়ে কাশলেই তো হয়। এরপর নেশা চেপে ধরবে, মাথা গুলোবে।

সুরপতি মারিক চোখ বন্ধ করে। বলে চলে–গুড! গুড, ওসব গ্যাঁজাগেঁজি আমিও ডু নট লাইক! মোদ্দা কথাটা হল তোমাকে আমি টপ লেভেলে নিয়ে যাব। তাতে আমারও স্বার্থ থাকবে। মিনিমাগনা এই হুইস্কিটা তাহলে কিনতুম না। আর যাই। করো, আমাকে চোদু ভেব না। তোমার মতো কাঁড়ি কাঁড়ি হারবার্ট আমি ফেলেছি। আবার হেঁকে তুলেছি।

সুরপতি মারিক চোখ খোলে। বলে চলে,-একটা কাচফাচ লাগানো, এ.সি. লাগানো ঘ্যাম অফিস। দেওয়ালে নানা রকম ছবি। একটা মেয়ে কম্পিউটার চালাচ্ছে। তাকে ঝকঝক করছে এ লাইনের দামী দামী বই। বাজনা বাজছে আস্তে আস্তে। ঢিমে আলো। কার্পেট। পাঁচশো টাকা ভিজিট। মিনিমাম। স্পেশাল কেস হলে আরো বেশি। এরপর বম্বে, দিল্লি। মরা পলিটিশিয়ান কী মেসেজ পাঠাচ্ছে সেটা জ্যান্ত পলিটিশিয়ানের কানে একবারটি তুলে দেওয়া। এই ভাবে ফাটকার কিং পিন, বিগ বুলদের কয়েকটাকে বশ করে ফেলা। তার সঙ্গে নির্লিপ্তি, শ্মশানবৈরাগ্য। তারপর দুবাই। বাহরিন। মরা শেখ, জ্যান্ত শেখ। এয়ার ইন্ডিয়া। টাটা সিয়েরা। বলহরি হরিবোল। রাম নাম সত্য হ্যায়। আর বলতে পারছি না। দাঁড়াও, আর এক পাত্তর ঢালি। মালটা কিন্তু সুন্। কী বলো? হারবার্ট জমতে থাকা নেশার থেকে ভরসা জোটায় ঠিকই কিন্তু মনের মধ্যে কোথাও যেন হবে না হবে না ভাব, কিন্তু এসব করতে গেলে তো ইংরিজি না জানলে চলবে না। ওখানেই তো আমাকে মেরে রেখেছে কিনা।

-বাল হবে ইংরিজি দিয়ে। শালা, ইন্টারপ্রেটার থাকবে তোমার, যা বলবে স্যাটাসাট বলে দেবে। পার্টি বেগড়বাই করলে দাঁত চিপে শুনিয়ে দেবে–ফাঁক ইউ! টিট। কান্ট! প্রিক!

-তাহলে হবে বলচ, পারব? আমার ভয় একটা কেচ্ছা না করে ফেলি।

-দূর! তোমার মনে খালি ভয়। আমার আবার অভয়, বরাভয়। ব্যবস্থা তো আমার। ফিফটি-ফিফটি। মারিক সরকার এন্টারপ্রাইজ।

পেটেতে পুরিয়া পাঁট
রাজী তবে হারবার্ট …
কি ঠিকতো?

-তুমি আবার কবে আসচ ভাই।

-ঐ তো। কবে, কখন আসব সেটা আমার ব্যাপার। মারিক এলোন উইল ডিসাইড। এখন আমার কাজ তোমাকে একটু তুলে ধরা। একটু সুগন্ধ নাকে নাকে পৌঁছে দেওয়া। ওয়াশিং পাউডার নিরমা।

-মানে?

-এ শালা তো দেখছি স্প্যাসটিক। তোমাকে যে বাচ্চারা বাটপাখি! বাটপাখি! বলে, আই সাপোর্ট দেম। এখন আমার একনম্বর কাজ হবে তোমার জন্যে পাবলিসিটির ব্যবস্থা। সাঁড়াশি স্ট্রাটেজি। একদিকে চলবে হুইস্পর ক্যাম্পেন… গুজগুজ ফুশফুশ। অন্যদিকে ইংরিজি কাগজে দু-একটা মাল ভিড়িয়ে দেওয়া। যাই হোক, আমাদের কারবার শুরু হয়ে গেল। আমি চললুম। আর হ্যাঁ, সিগারেটের প্যাকেটটা রেখে দাও। আর ঐ পাড়ার বংকা-ললটো-মদনাদের সঙ্গে বাংলা খেয়ে খেয়ে লিভারটার বারোটা বাজিও না। এর পরে এ.সি. ঘরে বসে ডিম আলো জ্বেলে তুমি আর আমি ব্ল্যাক ডগ খাব!

সুরপতি মারিক যাবার আগে হারবার্টের গাল ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলে যায় গুলু গুলু গুলু গুলু!

সন্ধ্যা ঘনায়। অন্ধকারে ক্লাসিক সিগারেট ধরায় হারবার্ট। বুকি, লেডি ডাক্তার, পরী … দীর্ঘশ্বাস আসেই কিন্তু এদিকে স্বর্গের দরজা যে একটু একটু করে খুলছে। সুর করে করে হারবার্ট বলে চলে,

ক্যাট, ব্যাট, ওয়াটার, ডগ, ফিশ …
ক্যাট, ব্যাট, ওয়াটার, ডগ, ফিশ …
ক্যাট, ব্যাট, ওয়াটার ডগ, ফিশ …

অন্ধকারের মধ্যে সিগারেটের ধোঁয়া নানারকমের নকশা তৈরি করে যদিও তা দেখা যায় না। গোল আগুনটা শুধু বাড়ে, কমে।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন