হারবার্ট – ২

নবারুণ ভট্টাচার্য

দুই

“বিদেশে, প্রাণেশ, তুমি করিয়া ভ্রমণ,
দেখিবে নূতন দৃশ্য প্রত্যেক দিবস।”

–বলদেব পালিত

হারবার্ট জ্যাঠাইমার সঙ্গে পুরী বেড়াতে যাবার সময় যে খাতাটি কিনেছিল তার থেকে জানা যায়,

হারবার্ট

যা হারবার্টের খাতা থেকে জানা যায়নি তা মোটামুটি,

হারবার্ট সরকার। পিতা ললিতকুমার। মাতা শোভারাণী। হারবার্টের আবির্ভাব ১৬ সেপ্টেম্বর ১৯৪৯। ললিতকুমার যুদ্ধের বাজারে কামানো টাকা ফিল্মে লড়িয়ে বুরক বনে যান। ১৯৫০এ হারবার্টের এক বছরের জন্মদিনের পরে পরেই চলচ্চিত্রে ব্যর্থ নায়িকা মিস রুবীর সঙ্গে দার্জিলিং-কার্শিয়াং রুটে জিপ দুর্ঘটনায় আরও দুই আরোহী ও ড্রাইভার সমেত খতম। মা শোভারাণী শিশু হারবার্টকে বিডন স্ট্রিটে মাতুলালয়ে নিয়ে যান। সেখানে মাস আটেক পরে ছাদে ধাতব তারে ভিজে কাপড় মেলার সময় শোভারাণী বিদ্যুৎস্পৃষ্টা হন। শিশু হারবার্ট ‘মা যাব, মা যাব’ বলে যেতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে কাঁদতে থাকে এবং চিত হবার সঙ্গে সঙ্গে আকাশে একটি মুখপোড়া ও একটি পেটকাট্টির মারাত্মক টিলি প্যাঁচ দেখে বিভোর হয়ে থাকে এবং এই ভাবেই তার প্রাণরক্ষা পায়। শিশু হারবার্ট পুনরায় পিতৃগৃহে ফিরে আসে এবং যেনতেন প্রকারেণ বড় হতে থাকে-জ্যাঠাইমাই যা কিছুটা আদর দিত।

জ্যাঠামশাই গিরীশকুমার বেশ্যাসক্ত ছিলেন। ফলে তার অবশ্যম্ভাবী ব্যাধি হয় যার পরিণতি জেনারেল প্যারালিসিস অফ দা ইনসেন। ইনি, ছোটবেলা থেকেই হারবার্ট দেখে আসছে, দোতলায় থাকেন, ঘরবারান্দা করেন এবং ঘন্টাখানেক পরে পরে মোরগ যেমন ডাকে তেমনই নিয়মিতভাবে পিউ কাঁহা! পিউ কাঁহা!’ বলে চেঁচান। আগে আগে রান্নাঘরে বা একতলার উঠোনের পাশে সদর কলঘরে জ্যাঠাইমা থাকলে ‘এখেনে, আসছি গো!’ বলে সাড়া দিতেন। গিরীশকুমারের দুই পুত্র–ধর্মনাথ, হারবার্টের ধন্‌নাদাদা ও কৃষ্ণলাল। কৃষ্ণলাল ইংরিজির অধ্যাপক, প্রগতিশীল ও অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির অতীব নিকট ছিলেন এবং এখনও তাই বিশ্বাস করেন-বহরমপুর কে. এন. কলেজে পড়াতেন। ওখানেই ছোটখাটো বাড়ি করেছেন। পৈতৃক বাড়ির অংশ ছেলে বিনুর মৃত্যুর পরে ধন্‌নাদাদাকে লিখে দেন। ধন্‌না শিশুকাল থেকেই খচ্চরের আঁদি ও লোভী। মিন্টে অর্থাৎ টাকশালে চাকরি জুটিয়েছিল। আগে তো এত কড়াকড়ি ছিল না, হয়তো ঘুষও কিছু দিত-বোজ ধনা টিফিনবাক্স ভরে সিকি, আধুলি ঝেড়েআনত। ধরা যখন পড়ল তখন ক’বছর ধরে ঝেড়েছে বোঝার উপায় নেই। চাকরি গেল, জেলে গেল–যদিও সাজা কিছুটা : মকুব হয়। বেরিয়ে ধন্‌না নাদুবাবুর বাজারে তালাচাবির মস্ত দোকান দিল, বিয়ে–করল। তিন ছেলের বাপ হল। তিনটির মধ্যে বড়টি গৌহাটিতে থাকে। ভ্যাবলা। গোবলা, বৌ-এর ন্যাওটা। ঐটে তাও ভালো। বাকি দুটো লাফাঙ্গা–কেঁদো কেঁদো, হাড়বদমাইশ। মেজটি বাড়ির চিল ছাদে কেবল টিভির অ্যান্টেনা বসিয়েছে-স্টার টিভি, এম. টিভি, বিবিসি এইসব লোকে তো আজকাল হামলে দেখছে। ছোটটি এক ব্ল্যাক বেল্টকেকাবু করে তার সঙ্গে শেয়ারে কারাটে–কুংফু-র ইস্কুল খুলেছে যদিও নিজে ধুড়ের ধুড়–এসবের কিছু জানে না। ধনাদাদার বৌ কাজের লোক, ইংরিজি ইস্কুলে পড়া। বাড়িতে রান্না শেখায়–তিন মাসের কোর্স স্ন্যাক-এর যার মধ্যে পার্টি লোফ থেকে রিবন স্যাণ্ডউইচ এইসব আছে আর আছে মোগলাই, সেটাও তিন মাসের কোর্স-রেইনবো পোলাও, মুর্গ ইরানী ও আরও কত কি! আগে অর্ডার দিলে বার্থডে কেকও পাওয়া যায়। ধন্‌নাদাদার বৌ এর ক্লাসে অনেক বৌ আসে। হারবার্ট গলির ওপরে, বলতে গেলে বাড়ির বাইরে, যে ঘরটায় থাকে সেখান থেকে এই বৌদের আসা যাওয়া দেখা যায় না। হারবার্টের খাতায় এই গোটা ব্যাপারটা সম্বন্ধে দুটি লাইন রয়েছে,

ধন্‌নাদাদার হলঘরে
কেন্নীরা খলবল করে।

হারবার্ট সরকার। নন্দকুমার ইনস্টিটিউশনে ক্লাস থ্রি-তে ভর্তি এবং ক্লাস ফাইভ থেকে সিক্সে ওঠার পর যায়নি। বাড়িতেই যা টুকটাক পড়ত। হারবার্ট যে স্কুলে যাচ্ছে না সেটা প্রথম কয়েকমাস কারো চোখেও পড়েনি। যখন জ্যাঠাইমার চোখে পড়ল তখন বেশ কিছুদিন ধরে নিজেই তার হারবার্টকে মুদির দোকানে ও বাজারে পাঠানো হয়ে গেছে। অবশ্য ইস্কুলে তাকে ধাদাদার টিফিন, পরীক্ষার সময় চোতা, বই এইসব নিয়ে যেতে হত। ধন্‌না যেহেতু সব সাবজেক্টে টুকত তাই তার বই লাগত বেশি। বাইরে থেকে অঙ্ক করে পাতা সাপ্লাই দেওয়াটা এ পাড়ার রেওয়াজ। সবাই ঘরের ছেলে বলে মাস্টাররাও এ ব্যাপারে মাথা ঘামাতেন না। গত একত্রিশ বছরে নন্দকুমার ইনস্টিটিউশন থেকে মাত্র তিনজন সেকেন্ড ডিভিশন পেয়েছে।

হারবার্টের বয়স যখন আঠারো তখন জ্যাঠাইমা তাকে নিয়ে পনেরো দিনের জন্য পুরী গিয়েছিলেন। হারবার্ট সঙ্গে একটি খাতা ও কলম নিয়েছিল। ওরা উঠেছিল ভারত সেবাশ্রম সঙেঘর আশ্রমে। সেখানে হারবার্টের কবি-প্রতিভা জাগ্রত হয় ধাপে ধাপে। যে হারবার্ট পুরীতে নেমেই লিখেছিল,

বাংলার পরে আছে উড়েদের দেশ
রোজ রাতে যায় তথা পুরী এক্সপ্রেস

সেই হারবার্টই চারদিন পরে লেখে,

ঐ এল ঢেউ
ঐ গেল ফিরে
অবিরাম আসা যাওয়া
সাগরের তীরে

এবং তারই তিনদিন বাদে, জটিলতর,

স্থলবায়ু বহে বেগে
জলবায়ু ভালো নয়
অক্টোপাসের ভয়,
কি হয়, কি হয়

হারবার্ট পাড়ার দর্জির দোকানে গিয়ে নিয়মিত বাংলা কাগজ পড়ত। সেলুনে ‘শুকতারা’ ও ‘নব কল্লোল’ পড়ত। হারবার্ট-এর ছন্দজ্ঞান ও উপলব্ধি উজ্জ্বল ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দিয়েছিল যদিও শেষ অবধি কিছুই ঘটেনি। পুরী থেকে ফিরে হারবার্ট লিখেছিল,

টুপিধারী নুলিয়ার রগুড়ে জীবন
কোনোই খরচ নাই প্যান্ট ও জামায়
সারাদিন জলে নেমে করে হুটোপুটি
লুটোপুটি করে আর পয়সা কামায়

কাব্যবোধ ও কাব্যদক্ষতা যে কিভাবে হ্রাস পেতে পারে তারও এক মৃত উদাহরণ হারবার্ট। যার কলম দিয়ে এইসব বেরিয়েছে তারই লেখা এগুলি পড়লে কে না মর্মাহত হবে–

ফুটপাথে ফুটফাট
ভুট-ভাট-ভুট
ধন্‌না অপিসে যায়
পায়ে গামবুট

বা,

কী গরম পড়েছে যে উঃ
আরশোলা কানে করে কুঃ

এই হাস্যকর স্টুপিডিটির পর, ভালগারধর্মী হলেও, ঝি-দের দলবদ্ধ বৃষ্টি ভেজা দেখে লেখা এই গানের মধ্যেও যেন ভরসা পাওয়া যায়, হয়তো বা কিছুটাই,

–তোমরা ভিজচ কেন গা
ভিজে গা
তোরা ভিজবি কেন লো
গা এলো

কিন্তু শেষটায় যা হতাশাই শুধু নয়, করুণারও উদ্রেক করে, তা হল, আর কিছু না পেরে, অমৃক সিং অরোরার গানের লাইন টুকে দেওয়া (এটিই হারবার্টের খাতায় তার শেষ হাতের লেখা)–

আমায় তোমার
কাজললতার কালি করো।

ধন্‌নাদাদাদের বাড়িটা খুব বড়ও নয়, ছোটও নয়। দোতলার ওপরে ছাদ। সেখানে ঠাকুরঘরের ওপরে চিলছাদ। তার ওপরে গঙ্গাজল আসার ট্যাঙ্ক ছিল। এখন যেখানে স্টার টিভির অ্যান্টেনা। বাড়ির সদর গেটের দিকে নয়, গলির মধ্যে একটা ছোট ঘর আছে। এই ঘরটি একাধারে পুরনো বইপত্র, সেভেন্টি এইট রেকর্ড, দলিল দস্তাবেজ এবং ইলেকট্রিক মিটারের ঘর। এই ঘরটিতে যখন কলকাতায় বিনু পড়তে আসে, ১৯৬৯ সালে, তখন একটি ছোট তক্তপোষ ও টেবিলফ্যানের ব্যবস্থা করা হয়। বিনুর মৃত্যুর পরে ঘরটি কয়েকবছর বন্ধ ছিল। পরে এটি হারবার্টের অফিস এবং শেষ রাত অবধি তারই ঘর ছিল।

এর আগে হারবার্ট দোতলার ভেতরের বারান্দায় শুত। ওখানে বৃষ্টির ছাট আসত না। হারবার্টের জামা কাপড় থাকত ছাতে ওঠার সিঁড়ির পাশে দড়িতে ঝোলানো। চিলছাদে ওঠার জন্য আগে একতলা থেকে সটান একটা ধচাপচা কাঠের সিঁড়ি ছিল। কিন্তু সেটা দিয়ে উঠলে পাশের বাড়ির ভাড়াটেদের শোবার ঘর দেখা যেত। ওরা চেঁচামেচি করাতে সিঁড়িটির ব্যবহার প্রায় বাতিল হয়ে যায়। বিনুর মৃত্যুর কয়েকদিন পরে একদিন খুব ঝড়জল হয়। সেই বৃষ্টির রাতেই সিঁড়িটার নীচের দিকটা ভেঙে পড়ে। ওপর দিকটা তখনও চিলছাদে আটকে ঝুলছিল। ওপর থেকে

খুঁচিয়ে তখন বাকিটা ফেলে দেওয়া হয়।

ধন্‌নাদাদাদের বাড়ির সামনের মোড়ে পাড়ার কালীপুজো হয়। দুর্গাপুজোটা হয় একটু এগিয়ে, বারোয়ারি মোড়ে। ওখানে ব্যাচাদার মিষ্টির দোকান আছে। সারাবছর একই খাবার কিন্তু দোলের সময়ে ওখানে দোলবড়া বানানো হয়।

ললিতকুমারের একটি ফটো এলবাম উত্তরাধিকার সূত্রে হারবার্টের পাওয়ার কথা ছিল। এতে ছিল প্রথম দিকে, রুডল ভ্যালেন্টিনো, লন চ্যানি (নানা ধরনের চরিত্রে), ডগলাস ফেয়ারব্যাংকস, চ্যাপলিন, গ্রেটা গার্বো, লিলিয়ান গিশ, মেরি পিকফোর্ড, এরল ফ্লিন থেকে শুরু করে পরবর্তী সময়ের ক্লার্ক গেবল, রবার্ট টেলর, ভ্যান হেফলিন, হামফ্রে বোগার্ট, বেটি ডেভিস, ভিভিয়ান লেই, ক্যাথরিন হেপবার্ন প্রমুখের রঙীন ফটো। একটি ফটোতে দেখা যায় ললিতকুমার ও শোভারাণী একটি সানবিম ট্যালবট মোটরযানের সামনে। মধু বোস ও সাধনা বোসের মধ্যে ললিতকুমার। ব্যর্থ নায়িকা মিস রুবী ও ললিতকুমার। শিশু হারবার্ট কোলে শোভারাণী। শিশু হারবার্ট।

এলবামটি হারবার্ট কোনোদিন চোখেও দেখেনি। কারণ ধনা এলবামটি মেরে দেয় এবং তার আলমারির তলায় পুরনো জামাকাপড়ে জড়িয়ে রেখে দেয়। ললিতকুমারের আর একট সংগ্রহ ছিল–নানা ধরনের সিগারেট হোল্ডার। সেটি অবশ্য ধ নয়, অন্য কেউ লোপাট করেছিল। বহু সন্ধান করেও ধনা সেই চুরুটের বাক্সটি খুঁজে পায়নি যার মধ্যে ললিতকুমার তার সিগারেট হোল্ডারগুলি রাখতেন। ললিতকুমারের সাহেবিয়ানার দৌলতে ধনাও মাঝে মধ্যে বিলিতি সিগারেট ও স্কচ হুইস্কি ঝেড়ে মেরে দিত। টাকাও সরাত। হিসেব করে কিছু করার লোক ললিতকুমার ছিলেন না। অতএব ওসব ছুটকো-ছাটকা ব্যাপার কোনোদিন তার চোখেও পড়েনি। ললিতকুমার যুদ্ধের বাজারে ছাঁট লোহা ও তামার কারবার করে যে বিপুল অর্থ কামিয়ে ছিলেন তা সিনেমার মাধ্যমে ভোগে না গেলে হারবার্টের জীবনকাহিনী যে অন্যবিধ হত সে বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশই থাকতে পারে না।

হারবার্ট সরকার। পাঁচ ফুট ছয় ইঞ্চি লম্বা। ফরসা। চোখা, সাহেবি গড়ন। রোগা। ললিতকুমার নিশ্চয়ই ভেবেছিলেন ছেলের চেহারার সঙ্গে কোথাও একটা লেসলি হাওয়ার্ড মার্কা হলিউডী চেহারার মিল আছে। সাহেবি নাম হয়ে গেল হারবার্ট। হারবার্টের মা উত্তর কলকাতার ছায়া ছায়া বাড়ির প্রায় শ্বেতাঙ্গিনী সুন্দরী। ললিতকুমারও কম সুপুরুষ ও কেতাদুরস্ত ছিলেন না। যেভাবেই হোক হারবার্টের চলাফেরা ও কানোর মধ্যে সুন্দর একটা হিরো হিরো ভাব বরাবরই ছিল। তাকে আরও সাহেবি লাগত কারণ বেশির ভাগ সময়েই তার ভয় করত। ভয়ের ফ্যাকাশেটা ফরসা ভাবটা আরও বাড়িয়ে দিত। বাবা মার কারণে মোটরগাড়ি ও বিদ্যুতের ভয় তো ছিলই। পরে এর সঙ্গে ধনার মারের ভয় ছিল। জ্যাঠামশাই-এর যখন তখন পিউ কাহা, পিউ কাহা’ চিৎকারের ভয় ছিল। বিনু আবার নতুন এক ধরনের ভয় নিয়ে এসেছিল।

এর মধ্যে অবশ্য বছর চোদ্দ বয়সে হারবার্টের এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতা হয়। পুরনো বই ঘাঁটতে ঘাঁটতে তার তলার, ঐ শেষ ঘরেই, একদিন দুপুরে সে একটি টিনের ভোরঙ্গ পায়। সেই তোরঙ্গের মধ্যে একটি মড়ার মাথা ও কয়েকটা লম্বা হাড় পেয়েছিল হারবার্ট। এ বাড়ির ঝাড়েগুষ্টিতে কেউ কখনও ডাক্তারি পড়েনি। ম্যাজিকও দেখায়নি। আচমকা তোরঙ্গ খুলে ঐ খুলি, চোখের কন্দর ও দাঁত দেখে প্রথমটায় ভয় তো পেয়েইছিল হারবার্ট। পরে বারবার, যেন নেশার ভরে, এসে তোরঙ্গটা খুলে খুলি আর হাড়গুলো দেখত হারবার্ট। ভাবতে চেষ্টা করত এটা যার খুলি সেই লোকটা কে হতে পারত। যেই হোক, তার জন্যে অসম্ভব কষ্ট পেত হারবার্ট। বছর দুয়েক পরে একদিন হাড়গুলো আর ঐ কঙ্কালের মুণ্ডুটা হারবার্ট একটা থলিতে ভরে ভোরবেলা কেওড়াতলায় আদিগঙ্গাতে ফেলে দিয়ে এসেছিল। ঐ তোরঙ্গটিতে সে তার জিনিসপত্র রাখত। পরে টাকাপয়সাও রাখত।

গঙ্গায় সেই হতভাগ্য অজ্ঞাতপরিচয় মানুষটির অবশেষ বিসর্জন দেওয়ার পরে। হারবার্টের মধ্যে চরম দুর্মদ মৃত্যুচেতনা জেগে ওঠে। তার মনে হত সে ঐ ফাঁকা দুটি চোখের কোটরের মধ্যে যেন তলিয়ে যাচ্ছে আর তার চারপাশে নাগরদোলার মতো তারা বা জোনাকির আলো ঘুরছে।

… এবং এরই পরে সে পূর্বকথিত “অতীব প্রয়োজনীয়” দুটি বই আদ্যোপান্ত খুঁটিয়ে পড়া শুরু করে।

এরপর হারবার্টের কমবয়সী বন্ধুদের মধ্যে সুইসাইড করে খোড়োরবি। তখন হারবার্টের বয়স উনিশ। খড়কাটার কল বাড়িতে ছিল বলে নাম ছিল খোড়োরবি। খোড়োরবি ছেলেটা ছিল ভালো। পেছনের পাড়ার জয়া বলে একটা বেঁটে মেয়েকে খুব ভালোবেসে ফেলেছিল খোড়োরবি। জয়ারা রোজ বিকেলে দল বেঁধে পাক মারতে বেরোত, এসে এপাড়ার মেয়েদের সঙ্গে গল্প করত। জয়াকে দেখলেই খোড়োরবি যে কেমন একটা করত সেটা সবাই জানত। অবশ্য খোলোরবির সাহস ছিল না। দঙ্গল ছেড়েও বেরোত না। কিন্তু পুজোর অষ্টমীর দিন মাথায় যে কী খেয়াল চাপল খোড়োরবির তা সেই একা জানত। পুজোর বেমক্কা ভিড়ে, ওদের পাড়ার প্যাণ্ডেলে গিয়ে খোড়োরবি, তখন পুঁচকে পুঁচকে ফাউন্টেন পেন বাজারে এসেছিল, সেই একটা কলম আর একটা কাগজ জয়াকে ধরিয়ে দিল। কাগজে এঁকাবেঁকা কাগের ঠ্যাং বগের ঠ্যাং হাতের লেখায়—”জয়া, দেবীর পদতলে ভক্তের এ ক্ষুদ্র পূজা উপহার-ইতি রবি।” ওপাড়ার ছেলেরা হাতেনাতে ধরল রবিকে। জয়া হুড়মুড় করে বাড়িতে পালাল। রবি ওদের হাত ছাড়িয়ে পালাল। জাপটাজাপটিতে রবির পুজোর জামা ছিঁড়ল। রাতে খোড়োরবির বাড়িতে জয়ার কাকা এল। দুই পাড়াতে টেনশন হল। নবমী, দশমী খোড়োরবি বেপাত্তা। ভাসানের জের কাটেনি, একাদশীর দিন শেষদুপুরে হৈহৈ কাণ্ড। করপোরেশনের ঘেরা পুকুরে আত্মঘাতী খোড়োরবির মড়া ভাসছে।

খোড়োরবির মৃতদেহ পশ্চিমপাড়ের কাছে, দু-মানুষ জলে ভাসছে আর দুলছে। পাড়ে পাড়ার সব ছেলেরা, হারবার্ট। বরাদুর কিছুটা স্বচ্ছ করেছে, তলায় দামের ঝক দেখা যায়, তারপরে গাঢ় শ্যাওলার সবুজ হয়ে অন্ধকার। পাড়ের কাছে একটা সাইকেল দাঁড় করানো। লম্বা বাঁশ বাড়াচ্ছে কেউ। সুইমিং ক্লাবের দুজন ছেলে সাঁতরে এগোয়। ডাইভিং বোর্ডের কাছ থেকে বাঁশের খোঁচা খেয়ে উল্টোনো খোড়োরবি ঘোলা জলে আসে। রোদ্দুর দ্রুত পালাচ্ছে। পুলিশ এসে গেছে। সার্জেন্ট এগোতে এগোতে বলে—”লাশ উঠেছে?” কেউ জবাব দেয় না। দুই সাঁতারু খোড়োরবির কাছে এসে ছুঁতেই সে যেন ছোট ছোট ঢেউতে ভর করে সরে যেতে চায়। ওরা দুপাশ থেকে কাঁধের কাছে জামা খামচে ধরে ফেলে। খোড়োরবি আটকা পড়ে যায়। ওরা পা দিয়ে জল কেটে কেটে পাড়ের দিকে এগোয় আর খোড়োরবির একমাথা চুল জলে টান টান হয়ে যায়। খোড়োরবিকে হারবার্টের শেষ রোদে মনে হয় এক ঝাক বাধ্য মাছ হয়ে ফিরে আসছে। এই দৃশ্যটি একটি ফটো হতে পারত। হলেও কবে হলদেটে কোনা খাওয়া হয়ে শেষে তুলোটে অস্পষ্ট হয়ে গেছে। অথচ শত শত বছর ধরে চাঁদের আলোয় বা শীতের ভোরে কুয়াশায় তার প্রেম নিয়ে খোড়োরবি ঐ মরণজলে ভেসে থাকবে। তাকে ঘিরে মৎস্যকন্যারা ওলটপালট করবে যারা কাঁদলেও তাদের চোখের জল কেউ দেখতে পাবে না।

“আমার নাম হারবার্ট। আমি বাঁট। বাঁট দেখেচো। এবার লাট দেখবে।”

“মখমোলায়েম ঘাসফুলেল মাঠে বিপরীদের খেলা।”

“ঘুড়ি, এরোপ্লেন, বেলুন, ঝুলঝাড়ু, মানুষ, প্যারাসুট, পাখি–সবই একসময় নেমে আসে। অথচ তার আগে ওঠে। ওটাও ওঠে। নেমে আসে।”

“মানুষ যদি ১ হয় তাহলে ০ হল মরা মানুষ। মানুষ + মরা মানুষ = ১+০= ১=খোড়োরবি।”

“ফাঁকফোকরে জলের হেঁয়ালি
ঢাকনাপেড়ে শাড়ির খেয়ালী।”

-হারবার্ট

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন