নবারুণ ভট্টাচার্য
‘‘দুর্ভেদ্য দুস্তর শুন্য, ক্ষুদ্রদৃষ্টি নর;
ওই বহ্নি, ওই ধুম! কিবা তারপর?”
-অক্ষয়কুমার বড়াল
.
সকাল ন’টা। সাড়ে ন’টা। দশটা। সাইনবোর্ড-বিহীন ঘর খুলছে না দেখে ধাক্কাধাক্কি। কোকা, বড়কা, সোমনাথও খবর পেয়ে ঘুমনেশা চোখে ছুটে এসেছে মুখে গন্ধ নিয়ে।
–হারবার্টদা! হারবার্টদা!
ডাকাডাকি আর দরজা ধাক্কানোর শব্দ দোতলার থেকেও পাওয়া গিয়েছিল। ধন্না তখন ফুচকাকে বলল–নীচে গিয়ে দেখনা একবার।
ফুচকা আধখানা গালে সাবান নিয়ে নেমে এল। ব্যবসা করে। আঁচ করল কিছু গড়বড় হবে। ফুচকাই ওদের বলে দরজা ভাঙতে। দরজা ভাঙা হল। ঘরে জমে থাকা মরার গন্ধটা হুশ করে বেরিয়ে আসে। ফুচকা দৌড়ে ওপরে চলে যায়। ধনাকে বলে। হতভম্ব ধন্না দিশেহারা হয়ে চিৎকার করতে থাকে, আত্মঘাতী হয়েছে। ভাই আমার আত্মঘাতী হয়েছে।
ধন্নার বৌ আর নির্মলা নেমে এসেছিল। কাঁদতে কাঁদতে তারা ওপরে উঠে যায়। জ্যাঠাইমা বুঝতে পারেনি প্রথমে। তারপর মূর্ছা গেল। বাড়ির তলায় ভিড় জমছে দেখে কী সুখকর স্মৃতি গিরীশকুমারের মনে জাগ্রত হয়েছিল বোঝার উপায় নেই। তিনি নিজের উপস্থিতি জানান দিয়ে বললেন—”পিউ কাঁহা! পিউ কাঁহা।”
গোবি, হরতাল ইত্যাদি ধার বন্ধুরা এসে গেল।
-এই, কেউ মড়া ধরবি না। ঘরের কিছু খুঁবি না।
-জানলাটা খুলে দেব হরতালদা?
-বললাম না কুটোটা অব্দি ‘বি না। সুইসাইড কেস। যে ঘাঁটাঘাঁটি করতে যাবে পুলিশ তার হালুয়া টাইট করে দেবে।
ধন্না কাঁদতে কাঁদতে নেমে আসে। সাইকেল নিয়ে পাড়ার ছেলেদের একটা দঙ্গল ছুটল থানায়। থানার অন-ডিউটি অফিসার শুনল। শুনে বলল, যাঃ শালা। দিনটা ভোগে গেল।
হারবার্ট নির্বিকার। নির্লিপ্ত। ইহলোকের এসব ঝুটঝামেলা নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথাই আর ছিল না। লোকের ভিড় আরও বাড়তে লাগল। কোকা, সোমনাথ, গোবিন্দ–সব হাউ হাউ করে কাঁদছিল।
-কালকেই ক্লাবের টিভি কেনার টাকা দিল। কত খরচ করল। একটুও যদি বুঝতে পারতাম।
মেন্টালি কিছুটা আনস্টেবল দেখাচ্ছিল খোড়োরবির ভাই ঝাপিকে। নিজের দাদার কেসের পর থেকেই ও যেন কেমন কেমন। ও ফুটপাথে উবু হয়ে বসে থেকে থেকে চেঁচিয়ে উঠছিল, হয়ে গেল! হয়ে গেল!
একটু পরেই পুলিশের গাড়ি এল। অফিসার আর জনা তিনেক কনস্টেবল। ভিড় সরে জায়গা করে দিল।
সব দেখেটেখে অফিসার বলল, সুইসাইড নোট ফোট কিছু রেখে গেছে। কেউ কিছু বলতে পারে না। অফিসারটিই তখন কাছে গিয়ে একহাতে নাক টিপে অন্য হাতে চিত হয়ে শুয়ে থাকা হারবার্টের বুকপকেট থেকে এক টুকরো ভাজ করা কাগজ বের করল।
সেই কাগজে লেখা ছিল,
চৌবাচ্চার তেলাপিয়া গঙ্গাসাগরে চলল।
দোবেড়ের চ্যাং দেকবি? দোবেড়ের চ্যাং
দেকাব? ক্যাট ব্যাট ওয়াটার ডগ ফিশ
–হারবার্ট সরকার
পুলিশ অফিসার নোটটি পড়ে বলল, বাপের জন্মে এমন সুইসাইড নোট কেউ দেখেনি। লোকটা কি পাগলটাগল ছিল নাকি।
হরতাল বলেছিল, ঠিক পাগল নয়। একটু ছিটিয়াল বলতে পারেন।
পাড়ার সুধীর ডাক্তার কিছুতেই ডেথ সার্টিফিকেট লিখতে রাজী হল না। বলল, হ্যাঁ, আমার পেশেন্ট ঠিকই। কিন্তু সে তো ডেঙ্গুতে মরেনি। আমার ট্রিটমেন্টেও মরেনি। মরেছে সুইসাইড করে অ্যাণ্ড দ্যাট টু ইন এ ঘাস্টলি ম্যানার। পুলিশ এসেছে। কাইলি, আমাকে ভাই আর রিকোয়েস্ট করো না। পাড়ার লোক। দুলাইন লিখে দিলে যদি ল্যাঠা চুকে যেত আমি কি করতাম না।
পাড়ার ছেলেরা এরপর থেকে সুধীর ডাক্তারকে হারামী ডাক্তার বলে অভিহিত করতে শুরু করে। সব শুনে পুলিশ অফিসার বলল, ঠিক আছে। আমি থানায় গিয়ে লাশের গাড়ির ব্যবস্থা করছি। কেউ একজন সঙ্গে চলুন। কনস্টেবলরা থাকবে।
-আপনি কি সার আর আসবেন না।
–আসব না মানে? দেখি শম্ভুনাথে যদি লিখিয়ে দিতে পারি তাহলে ওখান থেকে কাঁটাপুকুর …
-সার, আমরা বডি পাব কখন?
-লাশ, এখন কটা বাজে, পৌনে বারোটা। এই ধরুন ..সাতটা নাগাদ কাঁটাপুকুরে চলে আসুন না … তবে মর্গের ব্যাপার তো, যদি টাইম লাগে আরও?
-ও আপনি আমাদের ওপর ছেড়ে দিন। কাঁটাপুকুরে আমাদের লাইন করতে অসুবিদে হবে না!
-তাহলে তো কথাই নেই!
পুলিশের কালো মুদাভ্যানে চড়ে হারবার্ট বাড়ি থেকে চলে গেল। দোতলার বারান্দায় জ্যাঠাইমাকে দুপাশ থেকে ধরে দাঁড়িয়েছিল নির্মলা আর ধার বৌ। কড়া রোদ ছিল তখন। এমন কড়া রোদ যে কাকের গলা দিয়ে শুকনো ডাক বেরোয়।
ছাদে, প্রখর রৌদ্রে দণ্ডায়মানা শোভারাণীকে ললিতমোহন বলিলেন, শোভা! ভাবচি ছবিটা লেগে যাবে না ফ্লপ করবে। তুমি যা বলবে তাই হবে। তাই আমি মেনে নেব।
উত্তরে শোভারাণী খিলখিল করিয়া হাসিয়া কুটিপাটি।
নীচে মেথর এসে বালতির বরফগলা রক্তগোলা জল নিয়ে গিয়ে নর্দমাতে ঢালল। বোতল, কাটলেটের হাড়, মরা আরশোলা, ব্লেড, সিগারেটের টুকরো, ছাই সব ফেলল। বাকি রামটুকু চুক করে মেরে দিল। ঘর ধোয়া হল। জানালা খুলে দেওয়া হল। জানালাটা খোলার পরে ভেতরে কাল থেকে যে মাছিটা আটকে ছিল সেটা উড়ে এসে প্রথমে জানালার শিকের গায়ে বসেছিল। তারপর বাইরে ঘুরপাক খেয়ে উড়ে গিয়েছিল।
পাড়ার ছেলেরা মিটিং করে ঠিক করল যে হারবার্টের খাট তোষকেই তাকে নিয়ে যাওয়া হবে। শ্মশানে সাহাদা-স্বপন কেসের পরে মড়ার বিছানা-বালিশ পোড়ানো হচ্ছে। হারবার্টদার বিছানাও তার সঙ্গে চলে যাক। কিন্তু এ ব্যাপারে ধন্নাদাদার অনুমতি নেওয়া একান্তই প্রয়োজন।
ধন্না গম্ভীর মুখে শুনল।
-আমিও অমনটিই ভাবছিলাম। ওর মায়া জড়ানো তো, ওর সঙ্গেই চলে যাওয়া ভালো।
ধন্না স্মৃতিচারণ করে।
-ঐ খাট, তোষক–সব এসেছিল বিনুর জন্যে–বিনুও চলে গেল অপঘাতে। হারুও চলে গেল। কী হবে। সব নিয়ে যা। তবে তক্তপোষটা কিন্তু শক্তপোক্ত ছিল। ওটা নিবি?
–ও কত তক্তপোষ আসবে যাবে ধাদা। ওটাকেও যেতে দাওনা। সারাক্ষণটি থাকত ওর ওপরে।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে ধা বলেছিল, নিয়ে যা। আমরাও তো শ্মশানে যাব। তা তোরা কিছু টাকাকড়ি নে, খরচ-খরচা তো হবেই।
-ও তুমি কিছু ভাববে না ধাদা। হারবার্টদা আমাদেরও তো ভাই ছিল বলল। ও আমরা গাড়িটাড়ি সব করব। দোহাই তোমার, ব্যাগড়া দিও না।
ধন্না পুনরায় কাঁদতে থাকে। ওরা ব্যবস্থাপনার কাজে মেতে ওঠে।
পাড়ার লালার লরির ব্যবসা। লরি, ড্রাইভার তুড়ি মারতে হয়ে যায়। ফুল, ধূপ, সেন্ট, কাপড় সব এসে যায়। লরির ওপর তক্তপোেষ ওঠানো হয়। তোষকটি বড়ই ভারি ছিল। হিমসিম খেয়ে যায় ওরা।
-পুরনো দিনের মাল তো। ভালো ছোবড়া দিত। ওয়েট দেখেচিস।
তক্তপোষের চারকোণে রজনীগন্ধা বাঁধা হয়। তোষকের ওপরে বালিশ দিয়ে তার ওপরে নতুন চাদর দেওয়া হয়। শেষে এত ছেলে হয়ে যায় যে আর একটা টেম্পো নিতে হয়। পাড়া থেকে আর যারা যাবে তারা সোজা শ্মশানে যাবে। এরা চলল কাঁটাপুকুর। পাড়ায় বিশাল জনতা লরি ও টেম্পোর শোভাযাত্রাকে বিদায় জানায়। চালাও পানসি-রিমাউন্ট রোড, কাঁটাপুকুর। এর মধ্যেই চুক চুক করে বাংলা খাওয়া শুরু হয়ে যায়। ফাট করে র’ মাল একটু গলায় ঢেলে বোতলটা কোমরে পেটের কাছে গুঁজে রাখা। গামছাটা ওপর দিয়ে শক্ত করে বাঁধা।
“…পরন্তু প্রেতেরা আপনদিগের দুঃখনিবারণে সম্পূর্ণ পরবশ বা অস্বাধীন। এই কারণে কোন কোন প্রেত অসহ্য যাতনা সহ্য করিতে না পারিয়া সুহৃদ স্বজনদিগকে পিণ্ডদানাদি ক্রিয়ায় উত্তেজিত করিবার জন্য দেখা দেয় এবং কেহ বা আত্মগোপন করতঃ অর্থাৎ অদৃশ্য থাকিয়া নানা আকারের সংকেত প্রদর্শন করে… ভূতের ঐ শক্তি ভূতচালকদিগের মধ্যে অতি প্রসিদ্ধ। ভূতচালক ইংরাজ ও ভূতচালক বাঙ্গ লী, সকলেই ভূতদিগের ঐ শক্তি থাকার কথা বলেন, জল্পনা করেন ও নানাপ্রকার পুস্তক লিখিয়া প্রচারিত করিতেও উদাসীন নহেন।” (পঃরঃ)
কাঁটাপুকুরে ফাঁড়াই, রক্ত শূন্যতা প্রদর্শন ও সেলাইয়ের পরে কাপড় মুড়ি দিয়ে হারবার্ট যখন বেরিয়ে এল তখন তাকে বেশ ফিটফাট দেখাচ্ছিল, অধিকাংশ আত্মঘাতীদের মতো আচাভুয়া নয়। পশ্চিমে এর আগে, সূর্য লাট খাওয়ার মনোমুগ্ধকর রক্তিমাভা মেঘে মেঘে মমতা বিস্তার করেছিল। পাশেই যে জলাভূমি তার পেছনে রেললাইন এবং মাঠ দিয়ে ওয়াগনব্রেকাররা ছিল হরিণের মতো ধাবমান। পাড়ার গোবিন্দ বড় ঘরের ছেলে। সে হারবার্টের মড়ার ওপরে এক শিশি সেন্ট ছড়ায় ও চিল্লাতে থাকে, ‘পাতি মড়া যাবে অগুরু মেখে। গুরুর জন্যে ইন্টিমেট।’
লরি চলতে থাকে। এবং সহসা স্লোগান শুরু হয়,
হারবার্টদা, যুগ যুগ জীও
যুগ যুগ জীও, যুগ যুগ জীও
হারবার্টদা, তোমায় আমরা ভুলছি না, ভুলব না
-ভুলছি না ভুলব না।
ট্রাফিকে লরি দাঁড়াতে কেউ কেউ জিজ্ঞেস করে, কোন্ পার্টির লিডার ভাই? জবাব দেয় কেউ, ব্যাণ্ড পার্টির!
হঠাৎ তালে তালে হাততালি দেওয়া শুরু হয়। সঙ্গে সিটি ও নানারকম বিদঘুঁটে আওয়াজ। এইভাবে শোক অন্তিম রিচুয়ালের মাধ্যমে ব্যাপকতর আনন্দময় কোলাহলে পরিণত হতে থাকে। কেউই খেয়াল করেনি। করবার কথাও নয়। কেওড়াতলার বড় গেটের সামনে লরি যখন এসে থেমেছিল তখন রাতের আলো জ্বলেছে। গেটের পাশেই ক্রন্দনশীলা শোভারাণীর পাশে বিমূঢ় ললিতকুমার দাঁড়িয়েছিলেন। আনন্দধ্বনি শুনে তিনি বলে উঠলেন, শোভা, তুমি কাঁদছ? এ তো দেখছি কার্নিভাল!
ধন্না, ফুচকা-বুলান, পাড়ার বড়রা–সব আগে থেকেই এসে গিয়েছিল। কাগজ লেখাতে গেল কেউ। শ্মশানে লাশের সঙ্গে যারা আসে তাদের মধ্যে কেউ কেউ অন্যান্য লাশের পেছনে কী মৃত্যুর কারণ রয়েছে সে সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল হতে চায়। এমনই একজন কোকাকে জিজ্ঞেস করেছিল এবং কিঞ্চিৎ নেশার ঘোরে কোকা জবাব দিয়েছিল এইভাবে, কী হয়েছিল দাদা?
-কিসের কী হয়েছিল?
-বলচি, কি হয়েছিল, আপনাদের দাদার?
-মার্ডার।
কোকা যে কোনো মৃত্যুরই ইংরিজি ‘মার্ডার’ বলে জানত। মানুষ বাংলায় মরে, ইংরিজিতে ‘মার্ডার’ হয়। এই বার্তা রটে যাবার ফলে, মার্ডার কেসের ভিকটিমকে দেখার জন্য ভিড় হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল। যাদের অন্যান্য লাশ ছুঁয়ে থাকতে হচ্ছিল তারাও কখন দেখতে যাবে তার জন্যে উশখুশ করছিল। ধনা, বিধ্বস্ত ও শোকস্তব্ধ ধনা বলল তার দ্বারা এ কাজ হবে না। তখন ভাইপো বুলানই কাকার মুখাগ্নি করে। শ্মশানে কড়া পুলিশী ব্যবস্থা। কিছু টুকরো সংলাপ, সজোরে স্লোগান, কান্নার শব্দ!
-হ্যাঁ, হ্যাঁ তোষক বালিশ সুষ্ঠুই যাবে!
-হারবার্টদা, যুগ যুগ জীও …
-শুরু, তুমি চলে যাচ্চো।
-যুবতক সূরজ, চাঁদ রহেগা, হারবার্ট তেরা নাম রহেগা!
-সরে যান, সরে যান, লাশ ঢুকবে।
ঘাড় ঘ্যাড় ঘ্যাড় ঘ্যাড় করে চুল্লির দরজা উঠে গেল। শেষ শয্যায় হারবার্ট কয়েক সেকেণ্ড অপেক্ষমাণ। স্লোগান তুঙ্গে উঠেছে। গমগম করছে কেওড়াতলা। চুল্লির অভ্যন্তরে অগ্নিশয্যা দেখে বিমোহিত ললিতকুমার বলিয়াছিলেন, ফ্যাসিনেটিং।
সঙ্গে সঙ্গে কড়া ধমক, চোপ্ শালা!
যুগপৎ চমকিত ও শিহরিত ললিতকুমার মাথা ঘুরাইয়া দেখিয়াছিলেন তাঁহার নিকটে ধুঁই এবং অনতিদূরে লম্বোদর, শ্রীধর, নিশাপতি, কেশব, মুণ্ডহীন ঝুলনলাল–সকলেই দণ্ডায়মান।
সশব্দে হারবার্ট চুল্লিতে প্রবেশ করল। প্রবেশ করা মাত্র তার দেহের আচ্ছাদন, চুল ও চাদর দপ্ করে জ্বলে উঠেছিল। ঘ্যাড় ঘ্যাড় ঘ্যাড় ঘ্যাড় শব্দে চুল্লির দরজা বন্ধ হয়ে গেল। তারপরে ভেতরে একটানা গোঁ করে একটা শব্দ।
ভিড়ের একটু পেছনে উদাস মুখে দাঁড়িয়েছিল সুরপতি মারিক। তার পকেটে ইংরিজি কাগজের কাটিং। সিগারেট ধরিয়ে সে মনে মনে বলেছিল ‘বিদায়, বন্ধু, বিদায়।’ ওপর থেকে লোক নামতে থাকে। নেমে আসে। গো-ও-ও-ও….
এমন সময়ে সকলকে সচকিত করে প্রথমে একটি ছোট বিস্ফোরণ শোনা যায়। বালতি চাপা দিয়ে চকোলেট বোমা ফাটালে যেমন হয় তেমন–ডুম!
এর রেশ কাটতে না কাটতে আরও বড় একটি। তারপর ক্রমাগত। আরও জোরে আরও জোরে। চুল্লির দরজা ধড়মড় করছে, লোক ছোটাছুটি করতে শুরু করে। অন ডিউটি পুলিশরা দৌড়ে আসে। …টি…গুম..
চুল্লির ওপর থেকে দেওয়ালের কিছুটা উড়ে গিয়ে ইট, বালি, চাঙড় ছিটকে বেরোয় ও সেখান দিয়ে বিস্ফোরকের গন্ধকগন্ধ মাখা নানা বর্ণের ধুম নির্গত হয়। লোকাল এক রংবাজ গজায়, মাল চার্জ করচে! মাল চার্জ করচে।
একজন পুলিশ যথোপযুক্ত উপস্থিত বুদ্ধির পরিচয় দিয়ে শেষ অবধি ঠিকই চেঁচিয়েছিল, চুল্লি অফ করে দে! ভেতরে ফাটচে!
কিন্তু তারপরেই গগনবিদারী এক বিস্ফোরণ ঘটে চুল্লির পাশের ও পেছনের দেওয়াল ধ্বসে পড়ে। গরম কয়েলের টুকরো হবিষ্যি রান্নার জলে পড়ে ভস্ করে ধোঁয়া ওঠে। পুরো শ্মশানে পাওয়ার অফ হয়ে যায়। ভাঙা চুল্লির ধকধকে লাল আভা। বিকট কাণ্ড। অন্ধকারে লোক ছোটাছুটি করে। শ্মশানের উল্টোদিকের কোনো বাড়ি থেকে হয়তো ফোন গিয়েছিল। পুলিশ আসে। আরও পুলিশ। পুরো শ্মশান কর্ডন করে ফেলা হয় সেই রাতে। অনেক পরে এমারজেন্সি লাইনে সি. ই. এস. সি কোনোমতে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু করলে দেখা যায় চুল্লিটি কেউ যেন ভেতর থেকে ফাটিয়ে চুরমার করে দিয়েছে। শেষে কড়া পুলিশ প্রহরাতেই হারবার্টের মাথা, নাড়িভূঁড়ি, পা,হাত, পেট-বুক, টুকরো–এইসব নিয়ে গিয়ে, অধিক রাত্রে, পাশে ম্যানুয়েল পদ্ধতিতে কাঠে পোড়ানো হয়।
হারবার্টের দেহাংশ একত্র করে পুড়িয়ে দেওয়ায় প্রথমদিকে ইনভেস্টিগেশনে তর্ক-বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছিল। খুবই স্বাভাবিক। কারণ ১৯৯১-এর ২১মে যে ঘটনা ঘটেছিল তার থেকে এমনভাবে যথেষ্ট ভাবার কারণ আছে যে এল, টি. টি, ই-র লাইভ হিউম্যান বম্ব্ ধানুর সঙ্গে তুলনীয় হারবার্ট ছিল একটি ডেড হিউম্যান বম্ব। অবশ্য মোটিভটা স্পষ্ট নয়। আপাতদৃষ্টিতে কোনো কারণও নেই। কারণ শ্মশানে ঐ সময় গণ্যমান্য কারও আসার কথা ছিল না। থাকলেও… এই হাইপথে সিসটি পুঁদে তদন্তকারীরা বাতিল করে দেন। আসলে, কোনো একটি ঘটনা এমনই প্রভাব বিস্তার করে যে তার পরবর্তী প্রত্যেকটি ঘটনাই অনুরূপভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা হয়। এটা মানুষের ধর্ম।
হারবার্টের সুইসাইড নোট,
চৌবাচ্চার তেলাপিয়া গঙ্গাসাগরে চলল।
দোবেড়ের চ্যাং দেকবি? দোবেড়ের চ্যাং
দেকাব? ক্যাট ব্যাট ওয়াটার ডগ ফিশ
–হারবার্ট সরকার
থেকেও মনে হয় না এর মধ্যে কোনো কোড নিহিত যদিও “চ্যাং দেকবি?” ও “চ্যাং দেকাব?”-র মধ্যে একটা শাসানি দেওয়ার মনোভাব সুস্পষ্ট। প্রকাশ থাক যে হাওড়ার কোনো এলাকায় অতীব খচ্চর ও হারামী লোকেদের ‘দোবেড়ের চ্যাং’ বলা হয়। কিন্তু ‘ক্যাট, ব্যাট, ওয়াটার ডগ, ফিশ!’ সম্ভবত নিছকই উন্মত্ততা। লোকটা তখন এক্সপোজড়। সিভিয়ার শকের পরে অবশ্যম্ভাবী ডিপ্রেশান। আর বরাবরই অ্যাবনর্মাল।
যাই হোক, কোনো বারুদগন্ধী রহস্যই শেষ অবধি অসমাধিত ও অসম্যক থাকতে পারে না। দেশ-কাল-জাতির স্বার্থে তা অভিপ্রেত নয় পরন্তু একান্তই অনভিপ্রেত।
শ্মশান-বিধ্বংসী এই হামলার জন্য দায়ী হল বিনু। হ্যাঁ, মৃত নকশালপন্থী বিনু। সেই রাতের পর রাত, তার কমরেডদের সঙ্গে তোষকের পরতে পরতে পোমিয়ার আই. সি. আই. কারখানা থেকে চোরাপথে সংগৃহীত পাথর ফাটানোর নানা মাপ ও ক্ষমতার প্রভূত ডিনামাইট স্টিক ঢুকিয়ে রেখেছিল। উন্নতমানের এই ডিনামাইট স্টিকগুলি যথেষ্ট মাত্রায় শক গ্রহণ করতে পারে; পাতি পেটো নয় যে চাপ পড়ল কী ফাটল। দেশের অগ্রগতিতে ডিনামাইটের সদর্থক ভূমিকার কথা কে না জানে?
হয়তো বিনুদের প্ল্যান ছিল বিকট প্রলয়ঙ্কর কিছু ঘটাবার। হয়তো, হয়তো কোনো মহতী প্রাণনাশের। হয়তো আরও অভাবনীয় কোনো অঘটনের। তা হতে পারেনি। হতে পারেনি ঠিকই কিন্তু গত দুই দশক ধরে এই বিস্ফোরক সমাহার তোষকের মধ্যে শীতঘুম ঘুমোচ্ছিল যা চুল্লির উত্তাপে জেগে ওঠে। এবং কী আশ্চর্য হতে হয় ভাবলে যে ১৮মে, ১৯৯২ থেকে বৈদ্যুতিক চুল্লিতে শবের সঙ্গে শয্যা পোড়ানো শুরু না হলে এ ঘটনা ঘটতেই পারত না। কী বিচিত্র এ ডিটোনেশন।
হারবার্টের রক্তহীন মৃতদেহ দাহ করার সময় যে জঘন্য ঘটনা ঘটেছিল তা অবধারিতভাবে এই ইঙ্গিতই দিয়ে চলে যে কখন, কীভাবে বিস্ফোরণ ঘটবে এবং তা কে ঘটাবে সে সম্বন্ধে জানতে রাষ্ট্রযন্ত্রের এখনও বাকি আছে।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন