হারবার্ট – ১০

নবারুণ ভট্টাচার্য

দশ

“বৃথা আসি, বৃথা যাই
কিছুই উদ্দেশ্য নাই”

–অক্ষয়কুমার বড়াল

হারবার্টের ঘর থেকে তক্তপোষ বিছানা বেরিয়ে যাওয়ার ফলে ঘরটি বড়ই ফাঁকা ও বড় লেগেছিল। কেউ যদিও সেটা দেখেনি কারণ তারপর ঐ ঘরে তালা দিয়ে দেওয়া হয় এবং অনেকদিন অবধি কেউ ঢোকেনি। এরপরে, একদিন রাতে, লোডশেডিং-এর অন্ধকারে প্রচণ্ড ঝড় হয়। যে জানালা খোলার জন্যে মাছিটা বেরোতে পেরেছিল সেই জানালাটা খোলাই ছিল। উন্মত্ত, দুর্বার ঝোড়ো বাতাস ঢুকে ১৭১ থেকে শুরু করে ‘পরলোকের কথা’-র পাতাগুলো উড়িয়ে উড়িয়ে ঘরময় ছড়িয়ে দিয়েছিল। খোঁদলের তাকে রাখা হারবার্টের আয়নায় বিদ্যুৎ চমকানোর আলো ঝলসে উঠেছিল। হাওয়ার দাপটে দুলে দুলে উঠেছিল অলেস্টার। ‘পরলোক রহস্য’, ‘ভূতের জলসায় গোপাল ভাঁড়’, হারবার্টের কবিতার খাতা, শান্তার ও পশ্চিমবঙ্গ যুক্তিবাদী সঙেঘর চিঠি তাকে থাকলেও এলোমলো হয়ে গিয়েছিল। দড়িতে ঝোলানো গামছা, শার্ট, ধুতি উড়ে মেঝেতে পড়েছিল। তার কিছুদিন পরে, ধন্‌নাদাদা, কোনো এক রবিবার, এই ঘর খুলে সব বই, বই-এর পাতা, খাতা, টিনের বোর্ড সব বিক্রিওলাকে বেচে দেয়। টেবিলফ্যান, তোরঙ্গ ও চেয়ার দোতলায় চলে যায়। তোরঙ্গের মধ্যে একটা ভাঙা ডটপেন ও কিছু খুচরো পয়সা ছিল। হারবার্টের ছাতা ও অলেস্টার যথাক্রমে বাড়ির মেথর ও এক ভিকিরিকে দিয়ে দেওয়া হয়। গরমকালে শীতের ঐ কম্বলের মতো জোব্বা নিতে তার আপত্তি ছিল কিন্তু ভবিষ্যতের কথা ভেবে সে শেষ অবধি রাজী হয়েছিল। ঐ ভিকিরিকে হারবার্টের শার্ট, ধুতি ও গামছাও দিয়ে দেওয়া হয়। সাইনবোর্ডটি কিনে বিক্রিওলা ফাঁপরে পড়েছিল। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে নতুন বাজারের এক বেলুন-বন্দুকওলা সেটি কিনে নেয় এবং এর ওপরে কাটা পেরেক বসিয়ে বেলুন ঝোলাবার এক বিশদ ব্যবস্থা রচনা করে। অতএব, হারবার্টের সাইনবোর্ড ছররার চাঁদমারি হয়ে গেল। সব বেলুন ফেটে চুপসে গেলে, কাটা পেরেকের জঙ্গলের মধ্যে, হয়তো বা চোখে পড়বে, উল্টো হরফ,

মৃতের সহিত কথোপকথন

–পোঃ হারবার্ট সরকার

হয়তো বা এরও অনেকদিন পরে, কিংবা হয়তো অনেক অনেক বছর পরে, কোনো একটি বাচ্চা ছেলে তার বাবা, মা-র হাত ছাড়িয়ে, দৌড়ে গিয়ে, কোনো অ্যান্টিকের দোকানের ধুলোমাখা কাচের ভেতরে হাতে আলো নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা পরীকে দেখে তন্ময় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে চাইবে। তাকে তার বাবা ও মা জোর করে নিয়ে আসার পর তার ঠোঁট হয়তো, থরথর করে কাঁপবে অভিমানে। এরকম অবশ্য নাও হতে পারে।

যদি হয়, তাহলে হয়তো, এরও পরে, সেই বাচ্চা ছেলেটা যদি ঘুমের মধ্যে কেঁপে কেঁপে ওঠে, তাহলেও কারও চোখে পড়বে না। এরকম তো হয়েই থাকে।

এরও পরে, কোনো একটি কাটা ঘুড়ি, হয়তো, এ আকাশ সে আকাশ ঘুরে হারবার্টের সেই চিলছাদে এসে পড়বে। কেউ হয়তো জানতেই পারবে না। ভোরের কুয়াশায় চিলছাদ বড়ই অস্পষ্ট ও অবুঝ।

অথবা, সেই বাচ্চা ছেলেটার যদি জ্বর হয়, সে ভুল বকে, ভুল বকতেই পারে, তাহলে তার কথায় কেউ পরীর হদিশ হয়তো পাবো না পাওয়ার সম্ভাবনাও থেকে গেল।

হারবার্টের ফাঁকা ঘরে, জানালাবন্ধ, ঝড় এলেও কিছু উড়বে না। তাই হয়।

লাল বেলুন, নীল বেলুন-সব ফেটে যাবে। আবার নতুন বেলুন ফুলিয়ে লাগানো হবে। আবার ফেটে যাবে। সেরকম হওয়ারই কথা।

হয়তো, ছোট্ট ছেলেটা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে ঘুমের মধ্যে কাঁদবে। তারপর হাসবে। এরকম শিশুকে দেখেই বলা হয় যে শিশুটি দেয়ালা করছে।

রোজ ঘুমের মধ্যে কথা বলে। ডাক্তার হয়তো ওষুধ দেবেন। এবং আশ্বস্ত

-কে বলবেন, ভালো করে ঘুমোক। ঘুমোলেই ঠিক হয়ে যাবে।

ভালো করে ঘুমোল যে কিছুই ঠিক হয় না সেটা সবচেয়ে ভালো করে জানতেন ললিতকুমার ও শোভারাণী। কারণ তাদের নিরবচ্ছিন্ন, সুখময় ঘুমের পরে, হারবার্টের জন্মের পরে, নানাবিধ সুখসুখের পরে, অন্তিমে, ছবিটি ফ্লপ করেছিল।

ফ্লপ ছবিতে পিকচার নেই। কেবলই সাউণ্ড। তাও কমতে কমতে অস্ফুট উচ্চারণ বা প্রায় শোনাই যায় না,

ক্যাট, ব্যাট, ওয়াটার, ডগ, ফিশ …
ক্যাট, ব্যাট, ওয়াটার, ডগ, ফিশ …
ক্যাট, ব্যাট, ওয়াটার, ডগ, ফিশ …

অধ্যায় ১০ / ১০

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন