নবারুণ ভট্টাচার্য
“ওই শোন সমস্বরে বলিছে হেথায় নাহি
বিলাপের স্থান।”
–হিরন্ময়ী দেবী
নিষ্ঠুরতম এপ্রিলে কলকাতায় পুঞ্জ পুঞ্জ হিংস্র ভাইরাস দাপিয়ে দাপিয়ে ঘুরে বেড়ায়। একেবারে রাস্তায় বা ঝোঁপড়িতে যারা থাকে তারা এইসব ভাইরাসের সঙ্গে মহাযুদ্ধ করে, নিগুঢ় দক্ষতায় প্রতিষেধক অ্যান্টিবডি তৈরি করতে পেরেছে বলে বিশ্বাস কারণ তা না হলে এদের স্টোনম্যানের হাতে পাঁচ-সাতটি করে মরতে হত না, ভাইরাসের কামড়েই তারা বাল-বাচ্চা সমেত ঝাড়েগুষ্টিতে ফৌত হয়ে যেত। এই অজানা, বিকট, পিশাচসিদ্ধ ভাইরাসেরা অক্লেশেই ফতে করে মধ্যম বর্গকে, যাদের ঋতু পরিবর্তনের সময় শরীরে ভিটামিন-সি কমে যায়। যে যুবতীরা বসন্ত সমাগমে পুংকেশরের রোঁয়ার সুখময় স্পর্শের কথা ভেবে দেহবল্লরীতে টক আগুন জ্বালিয়েছিল তারাও অশ্লীল স্বপ্নের মধ্যে ফুলে ফুলে এই ভাইরাসকে “নাথ, নাথ?” বলে ডাকে এবং সেই ভাতঘুম থেকে প্রভূত শ্লেষ্ম-বিজড়িত অবস্থায় জেগে ওঠে। যুবকেরা জাগরণেই ভাইরাল কুস্তির বগলী প্যাঁচে অজান্তে কোতল হয়। এই ভাইরাসপুঞ্জই নির্ভাবনায় বসে থাকা হাঁসের মতো হারবার্টকে পেয়ে গেল। সবাই জানে যে দারোগারাই ডিম খায় হাঁসের অক্লান্ত ফাকিং-এর পরিশ্রম থেকে। এক্ষেত্রে কিন্তু ডিম খায় ডাক্তাররা। কারণ এই ভাইরাস মারার অস্ত্র তাদেরই কুক্ষিগত।
শুরু হয়েছিল পিঠ কোমর ঘাড়ে ব্যথা আর নাক দিয়ে জল ঝরা দিয়ে। ভেবেছিল ঝাল চর্বির বড়া আর বাংলা (“খালি বোতল আস্ত অবস্থায় ফেরৎ দিলে বোতলের দাম ২০৫ পয়সা ফেরত দেওয়া হইবে”) কড়া করে মেরে দিলে ম্যাজম্যাজানি পালাতে পথ পাবে না কিন্তু রেজাল্ট হল একেবার উল্টো। অঘোর জ্বর এল। সঙ্গে বমি। দুদিনের পর অচৈতন্য হারবার্টকে দেখে জ্যাঠাইমা ধনাকে বলল। ধনা গজগজ করতে করতে সেলুনের পাশে হোমিওপ্যাথ শেতল ডাক্তারকে ডাকল। ফল কী হল বোঝা গেল না। জ্বর আরও বেড়ে গেল। শুরু হল ভুল বকা।
-“আধলা ঝাড়ব। আধলা ঝাড়ব।” চেঁচিয়ে উঠে হারবার্ট আবার অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিল। তখন সে দেখছিল একটা জায়গায় সে আটকে গেছে। গলির মধ্যে। ওখানে ভীষণ নোংরা আর পেছল। কিন্তু ফিরতে পারছে না। কারণ ময়লার মধ্যে এক চোখ কানা একটা ঘেয়োবেড়াল বসে আছে। গেলেই কামড়াবে। তাকে মারবে বলে হারবার্ট একটা আধলা ইট তুলে চেঁচায়,-ঘেয়োবেড়াল কামড়ালে আধলা মারব। আধলা ঝাড়ব।
ডাক্তার, সোমনাথ ওরা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে। কোকা জলপট্টি দেয়। কী আরাম। দোতলায়, কাঠের সিঁড়ি দিয়ে উঠে, ওপরের কোথায় ঘরে, মোমবাতি নিভিয়ে দেবার জন্যে যে নিচু হয়েছিল সে ঝুঁকে দেখছে কিন্তু তাকে দেখা যাচ্ছে না..আবার ঘেয়োবেড়ালটা তেড়ে আসে …
-আধলা ঝাড়ব! আধলা! ঝাড় …
একবার জ্ঞান ফেরে হারবার্টের। যেন জলের তলা থেকে ঘরটাকে দেখছে। জ্যাঠাইমা, সোমনাথ, বুলান, কোকা … জানলা …
-জ্যাঠাইমা, জ্যাঠাইমা!
-বল বাবা। আমি শুনছি।
-বড় দুব্বল লাগচে।
-জ্বর হয়েছে তো। সেরে যাবে বাবা।
-বার বার ঘেয়োবেড়াল কামড়াতে আসছে।
-আর আসবে না। আমি তাড়িয়ে দেব এলেই।
-আসবে না?
-না, আসবে না।
ঘেয়োবেড়াল আর আসেনি। কিন্তু সেই রাতেই হারবার্টের চোখে শুধু তলার দিকের আধখানা আছে এরকম কয়েকটা মানুষ চিৎকার করে দৌড়ে বেড়াচ্ছিল। কোমরের ওপর থেকে কিছু নেই। ঘরে চেয়ারে বসে ঢুলছিল সোমনাথ। হারবার্টের গোঙানি শুনে সে আলো জ্বেলেছিল। হারবার্টের চোখগুলো এদিক ওদিক করছিল। পরে একটু ঘাম হল। হারবার্ট আবার ঘুমিয়ে পড়ল। সোমনাথও ঘুমিয়ে পড়ল। বাকি রাতটুকু শোভারাণী ছেলের কপালে হাত বুলিয়ে দিয়েছিলেন। বিলিতি ইউডিকোলনের কী সুগন্ধ!
পরের দিন সুধীর ডাক্তারকে খবর দেওয়া হল। বাড়িতে এলে কুড়ি টাকা ভিজিট। অনেকক্ষণ ধরে দেখলেন। শেষে বললেন, বিশ্রী একজাতের ডেঙ্গু খুব হচ্ছে আজকাল। অবস্কিওর ভাইরাল অরিজিন। ধরে যাবে, টাইম নেবে। একটা অ্যান্টিবায়োটিক ক্যাপসুল দিলাম। দিনে তিনবার করে অন্তত দশ দিন চলবে। সঙ্গে একটা ভিটামিনও দিলাম। তা না হলে আরও দুর্বল হয়ে পড়বে। হাল্কা খাবার চলবে। ম্যাক্সিমাম রেস্ট।
ধন্না জিজ্ঞেস করল, ভাত খাবে কবে ডাক্তারবাবু?
-এখনই খাক না। একটু পেস্ট করে খাইয়ে দিন না। লাইট খাবার, সুপ … দিন সাতেক পরে হারবার্ট একটু সুস্থ বোধ করতে শুরু করল। অসম্ভব ঘুমোত। গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি হয়ে গিয়েছিল। ওষুধ, তারপর মাগুরমাছ, মুসাম্বি–এসবের খরচ জ্যাঠাইমাই দিয়েছিল। হারবার্টের তোরঙ্গ খুলতে হয়নি। হারবার্ট যখন অচেতন তখন একদিন সুরপতি মারিক এসেছিল। তার কাজ কিছুটা এগিয়েছে সেটা জানাতে। হারবার্টের শরীরের খোঁজখবর ছেলেদের কাছ থেকে নিয়ে গিয়েছিল। ভালো ডাক্তার দেখেছেন শুনে আশ্বস্তও হয়েছিল। ছেলেদের বলেছিল–যাই হোক, একটু সুস্থ হলে বলবেন একেবারে চিন্তা না করতে একদম প্ল্যানমাফিক কাজ এগোচ্ছে। ওঁর বিষয়ে দুটো ইংরিজি লেখা বেরোবার কথা আছে। কিছুদিনের জন্যে আমি একটু সাউথে যাচ্ছি। সেই সময় যদি লেখাগুলো বের হয় তাহলে ফিরে এসে, সেগুলোর কাটিং নিয়ে আমি আসব বলবেন। চলি ভাই। খুব করছেন আপনারা যা হোক। এরকম আজকাল তো দেখাই যায় না। পাড়ার ব্যাপারটাই তো লোপাট হয়ে যাচ্ছে। কলকাতা থেকে। বড় ভালো লাগল ভাই। বলবেন কিন্তু মনে করে। গুড নাইট। গুড নাইট।
ওদের সকলকে ক্লাসিক সিগারেট খাইয়েছিল মারিক। এবং কথাগুলোও সে ফালতু বলেনি। এপ্রিলের শেষ রবিবার আর তার আগের সপ্তাহের শনিবার দুটো ইংরিজি কাগজে দু-দুটো লেখাই বেরোল-ডেড স্পিকন্স ইন দা ডিভাইন সুপারমার্কেট এবং মেসেজেস ফ্রম দা আদার সাইড। ঠিক লোকদের নজরে লেখাগুলো ঠিকই পড়েছিল। এ ছাড়াও হারবার্ট সম্বন্ধে আরও বিশদ খবরাখবর চেয়ে ঐ দুটি কাগজের দপ্তরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘ফেট’, ‘জেটেটিক স্কলার’ ও ইংল্যাণ্ডের ‘ফর্টিয়ান টাইমস’ এবং ‘আনএক্সপ্লেইন’ পত্রিকা থেকে চিঠি এসেছিল।
সারাদিন প্রায় অকাতরে ঘুমোত হারবার্ট। জেগে থাকলে যদি পড়তে ভালো লাগে তাই ডাক্তার ওকে কান্তি পি. দত্তের লেখা ভূতের জলসায় গোপাল ভাঁড় দিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু কয়েকটা লাইনের বেশি ও পড়তে পারত না। ঘুমিয়ে পড়ত। ঘুম ভাঙতে দেখত বিকেলের আধমরা আলো বন্ধ জানালার শার্সিতে লেপটে আছে। ঘরের মধ্যে তারপর আলো আরও কমত। কোনো বাড়ি থেকে রেডিওর গান হয়তো আসছে না আসছে না। শালিখ পাখিগুলো গলির কার্নিসের ফাঁকফেঁকরে ফিরে আসছে। ঘরে আলো জ্বালিয়ে দিয়ে যেত কেউ। আবার ঘুম। ঘুম ভাঙতে দেখল ঘরে দু-চারজন পাড়ার ছেলে। চুপ করে বসে আছে।
-রোজগারপাতি তত বন্ধ হয়ে গেল রে! এ শালা কী জ্বররে বাবা। হাড়মজ্জা সব যেন কাঁকলাসে শুষে খেয়েছে।
-কদিনের মধ্যেই তাগড়া হয়ে যাবে হারবার্টদা। আর আমরা তো আচি।
-হারবার্টদা, একটা কতা, সাহস করে বলব গুরু? আগে বলো রাগ করবে ।
হারবার্ট জানত ওরা কী বলবে। বলত, তোরঙ্গ খুলে নে না। তবে হ্যাঁ, উকিলের ছেলেকে চাইলেও কোনো পয়সা দিবিনি।
-না, গুরু। আমরা শুধু নিজেদের জন্যে কুড়ি নেব।
-নে না। কুড়ি, পঁচিশ যা দরকার নে। ওঃ শীত করচে রে।
-চাদরটা টেনে দিচ্চি।
-কেউ ঘরে থাকবি তো?
-সে কি গুরু! একজন শুদু যাবে আর আসবে।
যাবে আর আসবে। সে বরং ভালো যাবে আর আসবে। .. যাবে… আর… হারবার্ট আবার ঘুমিয়ে পড়ে।
“যাঁহারা সামুদ্রবিদ্যায় বিশারদ, ভঁহারা বলেন, প্রত্যেক মানুষই আপন আপন কর্তব্যকর্মের ও কর্মফলভোগের তালিকা বা বিবরণসহ জন্মগ্রহণ করে। সে তালিকা তাহাদের পূর্বকর্মানুসারে বিধাতা কর্তৃক অথবা নিয়তি কর্তৃক প্রস্তুত হয়। সে তালিকা কী?”
ঘুমন্ত হারবার্টকে দেখতে অপূর্ব লাগে। সে যদি জলেও নিমজ্জিত থাকে সেই জলাকাশেও চাঁদ ও সূর্য ওঠে। তারকারা বিস্ফারিত চোখে আলোকবর্ষ দূরে আলো পাঠায়। সেই আলো চোখের পাতায় লাগলে জন্মান্ধও চমকিত ও শিহরিত হয়।
“যেমন মনুষ্য এক জাতি, ইহার অবান্তরজাতি অনেক, তেমনি, ভূত এক জাতি, ইহার অবান্তরজাতি অনেক। অপিচ, ভূত জাতীয় জীব সমস্তই যে তুল্যধর্মা বা তুল্য স্বভাবসম্পন্ন, তাহা নহে। ইহাদের মধ্যেও বিশেষ ভাব বা তারতম্য ভাব প্রচুর পরিমাণে আছে। উহাদের মধ্যে জ্ঞানী ভূত ও মুখ ভূত, শান্ত ভূত ও অশান্ত ভূত, সমস্ত ভেদই আছে, ইহা ভূতবিদ্যাবিশারদদিগের মধ্যে অত্যন্ত প্রসিদ্ধ।”
(পঃ রঃ)
জাহাজের আলো জ্বলে ওঠে। পেছন ফিরে থাকা কাঠের হাতি এপাশে মুখ ঘুরিয়ে শুড় দোলায়। ঘেয়োবেড়াল আসতে চেষ্টা করেছিল, হাতি পা ঠোকাতে পালিয়ে যায়। মামদো ভূতের সঙ্গে গোপালের মোলাকাৎ হয়। হারবার্ট কাচের মিছরি চেটে চেটে গলিয়ে দেয়। ‘গোপাল কাঁপতে কাঁপতে জিগ্যেস করল : আপনি কে? আমি মামদো ভূত।’ পাথরের চেয়ারটেবিল হাওয়ায় ওড়াউড়ি করে। পরী প্রজাপতি বা মথের মতো কাচের ঘরে উড়ে বেড়ায়। ঘুমের মধ্যে চমকে, চমকে জেগে উঠেছিল হারবার্ট। ১৯৯২ সালের মে দিবস। রাশিয়াতে বরিস ইয়েলৎসিন জব্বর ভুতের জলসা বসিয়েছেন। লাখ লাখ কমিউনিস্ট ক্যাপিটালিজমের ভূত দেখছে। সলঝেনিৎসিনের ছদ্মবেশে রাসপুটিন ফিরে আসছে। যুগোশ্লাভিয়া ভেঙে পড়ছে। ক্রোশিয়ান টেনিস খেলোয়াড় গোরান ইভনিসেভিচ ভাবছে প্রচণ্ড গতিতে সার্ভ করে জিম কুরিয়ার বা আন্দ্রেই আগাসিকে পুঁতে ফেলবে। শেষবার এক দেশের দল হিসেবে সুইডেনে খেলতে যাবে বলে তৈরি হচ্ছিল কমনওয়েলথ অফ ইণ্ডিপেনডেন্ট স্টেটস বা প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন। একীভূত জার্মানি ভেবে পাচ্ছে না কাদের দিয়ে দল গড়বে-পূর্ব না পশ্চিম? বম্বেতে বসে হরশদ মেহতা বলে একটা লোক দিল্লি থেকে ছক অনুমোদনের টেলিফোন পাবে বলে অপেক্ষা করছিল। পোল্যাণ্ড, চেকোশ্লোভেকিয়া, বুলগেরিয়া, রুমানিয়া, আলবেনিয়া জুড়ে মহা হট্টগোল। কমিউনিজম কেলিয়ে পড়েছে। এরকম সময়েই হারবার্ট, কলকাতায়, ১৯৯২ সালের মে দিবসের রণধ্বনি শুনে ভেবেছিল যে রায়ট লেগেছে না দেশ স্বাধীন হল না তেরো জন অশ্বারোহী অবলীলাক্রমে …।
১৬ মে হারবার্ট অপেক্ষাকৃত সুস্থ বোধ করে ছাদে উঠেছিল এবং সন্ধ্যায় ছাদে সে অবসন্ন ও আধা-অজ্ঞান হয়ে পড়ে। সে সময় আকাশে সপ্তর্ষি, মৃগশিরা, কোয়াসার, পালসার, ব্ল্যাক হোল, হোয়াইট ডোয়ার্ফ, রেড জায়েন্ট-সব শালাই ছিল। ঈষৎ চৈতন্য ফিরতে হারবার্ট দেখেছিল যে দশটি নখ সহ দুটি বিশাল পা এর সামনে নতজানু হয়ে আছে যাঁর হাঁটু তিন তলা, তারও ওপরে তার বিশাল লিঙ্গ, দোদুল্যমান অণ্ডকোষ, জাম্বো যৌনকেশ ও তারও ওপরে, এতই গগনচুম্বী যে প্রায় ধোঁয়া ধোঁয়া। সে গগনবিদারী স্বরে বলেছিল, হাঃ হাঃ হারবার্ট, ললিতকুমারের ঔরসে ও শোভারাণীর গর্ভে নির্মিত, স্কাউন্ডেল, হতভাগ্য বানচোৎ হারবাট গড় কর, গড় কর …
-আপনি কে?
-শূওরের বাচ্চা! আমি কে? আমি ধুঁই।
-আপনি ধুঁই? আপনিই।
-চোপ। একটা কথা বললে মুখে পা ভরে দেব। ঐ দেখ আমার বাপ লম্বোদর। মেঘ নয় রে, ঐটাই। ঐ দ্যাখ, নিশাপতি। তার পেছনে ঐ যে চিল্লোচ্চে, ঐটে শ্ৰীধর।
-আজ্ঞে, চিল্লোচ্ছে কেন?
-কর্মদোষে ভগন্দর। চিল্লোবে না তো কী গান করবে? যা হোক, অ্যাণ্ডায়। গণ্ডা মেরে তো ভালোই চালাচ্চিস! শালা খচ্চর!
ধুঁই হুহুংকার করে। হারবার্ট গড় করে কিন্তু পরপর অন্য কত ফটো মানুষ ত্রিমাত্রিক হয়ে তাকে নিয়ে লোফালুফি করে যেন সে বল। অপুত্রক কেশব ও হরিনাথ অবিরাম রক্তবমন প্রতিযগিতায় মেতে ওঠে। ধুঁই বলেন, এ বলে চাপার গন্ধওলা মদ এক হাঁড়ি খাব তো ও বলে কলার সেন্ট ওলা মদ দু হাঁড়ি খাব। ওদের মদ আসত চন্দননগর থেকে। লিবার্টি, ইকুয়্যালিটি, ফ্র্যাটানিটি।
-তারপর?
-চোপ। মালের কম্পিটিশন একবার শুরু হলে কখনও থামবে না। কল্পান্ত অবদি চলবে। কপাৎ।
-দোহাই আপনার, কপাৎ বলে মুখ বন্ধ করবেন না।
-তোর তো দেখছি খুব জানার ইচ্ছে। তবে দ্যাখ-ঐ যে সাধুঁকে দেখছিস, লিঙ্গে লোহার কড়া পরে লাফাচ্ছেন, ওঁকে চিনিস?
-আজ্ঞে না তো!
-তা চিনবে কেন? চিনবে তো যত নষ্টা বেবুশ্যে লেডি ডাক্তার। ও হল সংসারত্যাগী গোপাললাল। প্রশ্ন থাকলে কর!
-উনি সংসারত্যাগ করলেন কেন?
-কেন? কেন? শুনবি?
-শুনব।
–গৃহে আশ্রিত পাচকের মেয়ের পেট হয়েছিল বলে।
মুণ্ডহীন কেউ হা হা রবে রোদন করতে করতে এসে সরবে পর্দন ও বিষ্ঠাত্যাগ করে।
-উনি কে?
-উনি নয়। ঐ বানচোৎ কে বল্। ঐ হল পুষ্যিপুত্তুর ঝুলনলাল। ওরই গলা কেটে তো বিহারীলাল পিউ কাহা আর তোর বাপের জন্ম দিয়েছিল। আর ঐ যে দেখছিস দূরে বসে রানী ভিক্টোরিয়ার সঙ্গে একমনে লুডো খেলছে ওর ঠ্যাঙের নখগুলো একবার মাথায় ঠেকা। এ হল বারাণসীলাল। ব্যবসায় মেতেছিল ফিরিঙ্গিদের সঙ্গে। কামুক সাহেবদের নেটিভ মাগী সাপ্লাই দিত।
-তারপর?
-তারপর? তারপর সব বোকাচোদা। তবে হ্যাঁ আমাদের গিন্নিগুলো ভালো ছিল। শনিী বা পদ্মিনী কম, দু-একটা, হস্তিনীই বেশি। ওদের আর একদিন দেখাব।
লম্বোদর হঠাৎ লাফিয়ে নামে। সে উদরই শুধু। হারবার্ট গড় করে।
-মুক্তি চাস? হারবার্ট। হারা! আত্মহারা! শ্যামা বা দক্ষিণা কালিকার ধ্যান কর। ক্রীং ক্রীং ক্রীং হুঁ হুঁ হ্রীং হ্রীং …
শ্রীধর বলে, ওসব ভাট বুকনি ছাড়। আদ্যকালী বাদে কেউ নেই রে। হারু, হারাধন … ।
হ্রীং ক্রীং ক্রীং পরমেশ্বরী স্বাহা!
হারবার্ট টাল খায়। ক্রীং ক্রীং, গুহ্যকালিকে ক্রী দ্রুী শ্রী শ্মশানকালিকে ওঁ কালী করালবদনা নিমগ্নরক্তনয়না চামমাংসচব্বণ তৎপরম! পোষ্যপুত্র, নিহত ঝুলনলাল হেগো পোঁদে মুণ্ডহীন নাচ নেচে চলে। কোথা হতে আবার সুট পরা ললিতকুমার এসে ‘লাইট! লাইট!’ বলে চেঁচায় এবং দোতলায় জ্যান্ত জ্যাঠামশাই যথারীতি ‘পিউ কাঁহা, পিউ কাঁহা’ বলে যেতে থাকেন এবং এই পর্ব যখন শেষ হয় তখন গগনচুম্বী ধুঁই ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হয়ে মারাত্মক পরমাণুতে পরিণত হচ্ছেন অথচ তাঁর কণ্ঠস্বর ক্রমেই কানের সহ্য করার ডেসিবেল সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে-
-হারবার্ট, তুই কাঠের চিতায় পুড়বি… হারবার্ট, তুই কাঠের চিতায় পুড়বি … হারবার্ট, তুই কাঠের চিতায় পুড়বি …
১৭ মে, ১৯৯২, হারবার্ট একটি চিঠি পেয়েছিল। চিঠিটি সাদা কাগজে টাইপ করা। তার বয়ান ছিল এইরকম :
মহাশয়,
সংবাদপত্র ও লোকমুখে আপনার ‘অলৌকিক’ ক্ষমতার সম্বন্ধে জানতে পেরে এই চিঠি আপনাকে দেওয়া হল। আমরা, যুক্তিবাদী সঙেঘর কর্মীরা, বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে বহু জ্যোতিষ ও বাবাজী-র লোক ঠকানো ভণ্ডামির মুখোশ খুলে দিয়েছি। এ বিষয়ে আপনি কতদূর জানেন আমরা খবর রাখি না। তবে আপনার ব্যাপারে আমাদের বক্তব্য এই যে মৃত আত্মার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন নিছকই ভণ্ডামি, মানুষের দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে আপনি যেটা করছেন সেটা জালিয়াতির ব্যবসা ছাড়া আর কিছুই নয়। আগামী ২৫মে, আমি ও আমাদের সঙেঘর কর্মীরা বেলা ২টো নাগাদ আপনার দপ্তরে যাব। যে সংবাদপত্রে আপনার সম্বন্ধে রচনাদি প্রকাশিত হয়েছে সেই সংবাদপত্রের সাংবাদিক প্রতিনিধিরাও থাকবেন। এই চিঠি পাওয়ার পরে, তিন দিনের মধ্যে আপনি যদি আমাদের দপ্তরে যোগাযোগ করে অবিলম্বে এই জাল ব্যবসা বন্ধ করার প্রতিশ্রুতি না দেন এবং আপনার ‘অলৌকিক’ কার্যকলাপ যে নিছক ভণ্ডামি তা লিখিতভাবে স্বীকার না করেন তাহলে ধরে নেওয়া হবে যে আমাদের চ্যালেঞ্জ আপনি গ্রহণ করছেন।
ইতি
প্রণব ঘোষ
সাধারণ সম্পাদক, পশ্চিমবঙ্গ যুক্তিবাদী সঙঘ
হারবার্ট চিঠিটা ছুঁড়ে তাকে ফেলে দিয়েছিল।
-ইল্লি! বইতে সব বড় বড় লোক, কত উকিল মোক্তার মেনে নিল আর কোত্থেকে উড়ে এসে বলচে কিনা এসব ঢপবাজি। আবার কোতাকার কে আঁটের লোম, তার কাছে গিয়ে কিনা বলতে হবে। মামাবাড়ির আবদার-রে আমার! ওরে কেরে? দুটো আমড়া ভাতে দেরে! হরিনাম খাবলা খাবলা। আয় না গুখেকোরা, এমন বেত্তান্ত শুনিয়ে দেব যে ধুড়ধুড়ি নড়ে যাবে। কোনো ঝামেলায় নেই, ঘর থেকে বেরোচ্চি না, কাউকে খুঁসলোচ্চি না, স্বপ্ন পেয়ে কারবার খুলেচি আর শালাদের জ্বালা ধরেছে খুব। এই করে বাঙালিরা মরল। মরগে যা।
হারবার্ট সোৎসাহে ‘ভূতের জলসায় গোপাল ভাড়’ পড়তে থাকে।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন