হারবার্ট – ৩

নবারুণ ভট্টাচার্য

তিন

“মানব-জীবন ছাই বড় বিষাদের!”

–মানকুমারী বসু

রাব্বা! রাব্বা! রোদ পেটে মেখে যে ঘুড়িটা উঠছে তো উঠছেই তার গোঁত্তা খাওয়ার সময় চোখ সরিয়ে নিলে ঐ, ও ….ই তেরোতলা বাড়ির ওপারে সেদিন অব্দি হাওড়া ব্রিজ দেখা যেত …ভিক্টোরিয়ার চূড়া ….ঐ সাহেবপাড়া ….সিনেমাপাড়া …. নতুনবাজার টেলিফোন অপিস ….আরও কাছে শীলদের ছাদ, তারপর হাঁড়িফাটা পালদের ….. কেষ্টান বাড়ির পাঞ্জাবি ভাড়াটেদের জামাকাপড় শুকোচ্চে …. তারপর দীর্ঘনিঃশ্বাস মাখা হালদারদের ছাদ যেখানে বুকি, সুন্দর, রং ময়লা, নরম, ঈষৎ উদ্ধতবুক বুকি আর কখনও বিকেলে ইস্কুল থেকে ফিরে এমাথা ওমাথা হেঁটে হেঁটে পড়বে না, হাতে ভোলা বই, জোরে হাওয়া দিলে ওদের ছাদের টবের গাছগুলো নুয়ে পড়ছে, বুকির চুল এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে, বই-এর পাতা উড়ে যাচ্ছে …

চিলছাদটাই ছিল হারবার্টের জায়গা। ঐ চিলছাদেই হারবার্ট সবকিছু উপলব্ধি করেছিল। যে আশ্চর্য স্বপ্ন তাকে সামাজিক প্রতিষ্ঠা ও খ্যাতি দিয়েছিল অথচ প্রকারান্তরে যা ছিল তার সমূহ বিনাশের কারণ সেই স্বপ্নও হারবার্ট দেখেছিল এই চিলছাদেই। চিলছাদে ছিল গঙ্গাজলের ট্যাংক। আগে হারবার্ট এই ট্যাংকের ভেতরে নেমে মিহি কাদা সাঁতলে সাঁতলে জ্যান্ত সাদা কুচো চিংড়ি ধরত-তিরতির করে ঠ্যাংগুলো ছুঁড়ছে। ট্যাংকের ভেতরের গায় গোল গোল পেঁড়ি লেগে থাকত। পরে জল আসা বন্ধ হয়ে গেল। তলার কাদা শুকিয়ে গেল। পাইপটা ভেঙে গেল। পরে বৃষ্টির জল জমত। তখন ভেতরে একটু হয়তো শ্যাওলার মতো হত বা জলে ফেনা জমে দু-একটা ডিগবাজি খাওয়া জলপোকা বা মশার বাচ্চা জন্মাতো কিন্তু ঐ পর্যন্তই। গঙ্গাজল আসা বন্ধ হয়ে গেল বলে ট্যাংকটাও মরে গেল। তখন কিন্তু হারবার্টের কাছে মরা ট্যাংকটা অন্যভাবে প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছিল। হারবার্ট তখন হেঁচড়ে ছেচড়ে ট্যাংকের তলায় ঢুকে ঠাণ্ডা ছায়ায় গরমকালে ঘুমোত। আচার বা লজেন্স পেলে নিয়ে যেত। লজেন্সটা কয়েকবার চুষে একটা কাগজের ওপর রেখে ‘পরলোকের কথা’ পড়ত। পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়ত। ঘুম থেকে উঠে যদি দেখত গোটা তিন বা চার (তার চেয়ে বেশি পিঁপড়ে চিলছাদে উঠত না) পিঁপড়ে লজেন্সটা খাচ্ছে তাহলে টোকা দিয়ে দিয়ে তাদের তাড়াত। আর একরকম ছোট ছোট অনেক পা-ওলা নিরীহ পোকা চিলছাদের ফাটলে থাকত-এদের মতো নির্বিরোধী ও অহিংস পোকা ভূভারতে আর আছে কিনা সন্দেহ। কলকাতায় যেবার আকাশপথে লক্ষ লক্ষ পঙ্গপাল আসে তখন ট্যাংকের গায়ে তাদের ক্রমাগত ঠোক্কর খাওয়ার শব্দ হারবার্টকে বিস্মিত করেছিল। বৃষ্টির শব্দের থেকে একদম আলাদা। শীতকালে কৃষ্ণদাদার দেওয়া সোয়েটার আর জ্যাঠাইমার দেওয়া ব্যাপার নিয়ে বোদগরম চিলছাদে উঠে যেত হারবার্ট। বিশ্বকর্মার আগে থেকে চলতে থাকে ঘুড়ির মরশুম। সে সময়ে একদিন বিকেলে হারবার্ট ফাঁকা ছাদে ঘুমোচ্ছে, হঠাৎ পেটে সুড়সুড়ি। জেগে দেখে পেটের ওপর দিয়ে কাটা ঘুড়ির হাপতা সুতে চলেছে। শিশুকালে মৃতা মার অনতিদূরে শুয়ে দিলি প্যাঁচ দেখেছিল হারবার্ট। সে কথা তার মনে না থাকলেও ঢিলি প্যাঁচের প্রতি তার অদম্য এক আকর্ষণ ছিল। কিন্তু চিলি প্যাঁচ খেললে লাটাইতে অনেক সুতো রাখতে হয় কারণ দেদারে সুতো ছাড়তে হয়–ছাড়তে ছাড়তে সাদা সুতো এসে গেলে বিপদ। টেনে প্যাঁচ খেলাতে ভায়োলেন্স : বেশি। ঘুড়িও তখন বেহাওয়া না থাকলে ওড়নদারের মনের কথা কিড়মিড় করে বলে। হারবার্টের হতভম্ব লাগত অসভ্য টানামানি দেখতে-আকাশ পথে ঘুড়ি ছিনতাই-এর ধান্দা, এর মধ্যে যে করে সে সম্ভবত বলাৎকারের আনন্দ পায়। হারবার্টের সবচেয়ে ভলো লাগত হাই অলটিচুড দিয়ে আপনমনে কোনো কাটা ঘুড়িকে চলে যেতে দেখতে। ঘুড়িটা যদি একটু বেশি নাচানাচি করে, ওলট-পালট করে তাহলে বুঝতে হবে প্রায় কলের তলা দিয়ে কাটা পড়ায় সুতো খুবই কম। আর যদি মন্দ্র গম্ভীর ঢঙে পয়সার মতো ভারি হয়ে যায় তাহলে বোঝা যাবে বিস্তর সুতো তলায় রয়েছে–ঐ ঘুড়ি যে ধরবে তার লাটাই-এরও সুদিন। ধন্‌না র তিন ছেলে বড় ছাদ থেকে ঘুড়ি ওড়াত। ওদের চিলছাদে ওঠা ছিল বারণ। চিলছাদে ঘুড়ি পড়লে হারবার্ট জমিয়ে রেখে ওদের দিয়ে দিত।

ঘয়লা, মোমবাতি, পঙ্খীরাজ, চৌরঙ্গি, পেটকাট্টি, চাপরাস, সতরঞ্চি, মুখপোড়া, পান ও অন্যান্য বেনামা ঘুড়ির নক্সাদার জেল্লা যতই হোক না কেন গাঢ় রঙের বুলুম হল ঘুড়ির রাজা। মেঘলা আকাশে অনেক ওপর দিয়ে কেটে যাওয়া একটা কালো বুলুম দেখে হারবার্টের প্রায় ভয় করেছিল। এত গম্ভীর শেষযাত্রা হারবার্ট আগে বা পরে কখনও দেখেনি। এমনকি তার নিজের শেষ যাত্রায়ও এতটা গাম্ভীর্য ছিল না।

এই চিলছাদেই হারবার্ট তার কিশোর জীবনে একদিন নিজের শরীরের মধ্যে থেকেই আশ্চর্য আনন্দ ও ইন্দ্রিয়সুখের সন্ধান পেয়েছিল। তখন তার চোখে কালো রোদ্র, চারপাশে দেড় হাত উঁচু পাঁচিলের গায় উজ্জ্বল সবুজ শ্যাওলার ঢল। এখান থেকে কত কত বছর ধরে হারবার্ট দেখেছিল বিকেল হলে ওপর দিয়ে বকেরা লাইন দিয়ে ফিরে যায় ঘরে। সন্ধ্যার মুখে চামচিকে ও সন্ধ্যার পরে বাদুড় ওড়ে। এরোপ্লেনের আলো জ্বলে নেভে। চোখের পলক পড়ার আগে অগণিত তারার মধ্যে একটি খসে পড়ে। ফানুস ভেসে যায়। হারবার্টঘুড়িলণ্ঠনও দেখেছিল–ঠোঙার মধ্যে কাঠির ফ্রেম করে মোমবাতি বসিয়ে ঘুড়িতে বেঁধে ওড়ানো। একবার ফানুসে টান আসা অব্দি ধরেছিল সে।

ছোটবেলা রাস্তায় কমিউনিস্ট পার্টির অনুষ্ঠানে কৃষ্ণদাদার সঙ্গে গিয়ে হারবার্ট ‘ফল অব বার্লিন’, আরও কি সব যুদ্ধের ডকুমেন্টারি দেখেছিল। একবার দেখেছিল বরফের চাঙড় উল্টে যোদ্ধাদের অতল জলে তলিয়ে যেতে। হারবার্টকে কেউ বলেনি যে ওটা আইজেনস্টাইনের ‘আলেকজান্দার নেভস্কি’। আর অনেক আগে একবার ইন্দিরা হলে দেখেছিল একটা বাংলা বই যাতে শ্বশুরবাড়ির উঠোনে সাবিত্রী চ্যাটার্জি মাথায় চটি নিয়ে দাঁড়িয়েছিল। আর পাড়ার পুজোয় অন্যান্য সিনেমার মধ্যে দেখেছিল ‘ফির সুবাহ হোগী’। পরে পয়সা কামাবার পরে ক্যাওড়া পাব্লিকের অনুরোধে ভাড়া করা ভিডিও-তে অবশ্য অনেক ছবি দেখেছিল হারবার্ট। কিন্তু তার যা কিছু শেখার তার অর্ধেকটা যদি পূর্বকথিত দুটি বই থেকে হয় তাহলে বাকিটা ঐ চিলছাদে। চিলছাদ থেকেই হারবার্ট ও বুকি পরস্পর আকৃষ্ট হয়। রোজ বুকি বিকেলে ছাদে আসত। হারবার্ট তো চিলছাদে থাকবেই। এই সময়ে দুজনে দুজনকে নিবিড়ভাবে পেত যদিও মধ্যে দুটো বাড়ির ফারাক থাকত। বুকি যতক্ষণ না আসত ততক্ষণ রোদে মেলা বুকির ফ্রকগুলো হারবার্টকে সঙ্গ দিত। বুকি ইস্কুলে যেত-আসত রিক্সায়। বুকিরা হালদার বাড়িতে ভাড়া এসেছিল। বছর দুয়েক ছিল। তারপর চলে যায়। হারবার্টের তখন ষোলো-বুকির বছর এগারো হবে। চলে যাবার আগের সরস্বতী পুজোয় পাড়ার লাইব্রেরি ঘরের পাশে ওদের প্রথম কথা হয়। ব্যানার্জিদের গেটের থামের পাশে প্রায় লুকিয়ে ফিসফিস করে হারবার্ট বলেছিল,-আমি চিঠি দিলে নেবে?

বুকি মাথা নেড়ে বলেছিল, হ্যাঁ।

–তুমি কোন ক্লাসে পড়?

–সিক্স। তুমি?

–আমি পড়ি, তবে ইস্কুলে পড়ি না

–বাড়িতে মাস্টার আসে?

হারবার্ট মাথা নেড়ে বলেছিল, হ্যাঁ। যদিও এটা বলতে তার ভালো লাগেনি। বুকিরা চলে যাবার পরে হারবার্ট কয়েক মাস চিলছাদে ওঠেনি। পরে গিয়েছিল ঠিকই। হারবার্ট দেখতে পেত বিকেল ফুরিয়ে গেলে যখন ছায়া ছায়া হতে থাকে, একটা দুটো করে আলো জ্বলে, উনুনের ধোঁয়া নদীর মতো ভেসে যায়, তারও একটু পরে ঐ ছাদটাকে আর কঁকা বলে মনে হয় না। হয়তো ঐ অস্পষ্ট অবুঝের মধ্যে বুকি দাঁড়িয়ে আছে, হাসছে, হাত নাড়ছে। চোখ কচলে দেখলে ঠিক যেন মনে হয় তাই। চোখটাও তো তখন একটু ঝাপসা থাকে। পরে তো ঐ ছাদটুকুও চলে গেল যখন হালদাররা দোতলা ওঠাল। চিলছাদের পাঁচিলের গায় হারবার্ট ইট দিয়ে ঘষে ‘ব’ লিখে রেখেছিল। গভীর করে। লেখাটার ওপরে শ্যাওলা হয়ে গেলেও হারবার্ট বুঝতে পারত যে ওর তলায় সেই অক্ষরটা তাকে মাথা নেড়ে নেড়ে বলছে, হ্যাঁ।

চিলছাদ কোনোদিনও হারবার্টের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেনি। কিন্তু দুটো ঘটনা ঘটেছিল যার থেকে বিপদ হতে পারত। একবার সন্ধেবেলা তুমুল বৃষ্টিতে আটকে গিয়েছিল হারবার্ট। সে জলের কী ভোড়। তার ওপরে ট্যাংকের ওপরে শিল পড়ার শব্দ। ট্যাংকের তলায় ঢুকে গিয়েছিল হারবার্ট। কয়েকটা শিল ধাক্কা খেয়ে ছিটকে তার কাছে আসছিল। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল। মেঘের গর্জন। বাজ পড়েছিল কয়েকটা। হারবার্ট ভেবেছিল সে আর নামতে পারবে না। নামতে পারছিলও না। এত বৃষ্টি। দিক ভুল হয়ে যদি রাস্তার দিকে বা গলির দিকের ফঁকাতে পা রাখে। আর একবার কালীপুজোর আগে দিনেরবেলায় কেউ উড়ন তুবড়ি টেস্ট করছিল। তার তেতে ওঠা খোলটা ফেটেছিল চিলছাদে। হারবার্টের গলায়, চিবুকের সটান তলায়, কণ্ঠার ওপরে একটা সাদা দাগ ছিল।

ধন্‌নাদাদা, ধনাবৌদি, তাদের তিনটে বাড়ন্ত ছেলে–এদের সঙ্গে হারবার্টের মানসিক দূরত্ব বাড়তেই থাকল। সাহেবপাড়ায় অর্থাৎ আধাঘন্টা হেঁটে ভিক্টোরিয়া স্কোয়ার থেকে গভীর অভিনিবেশময় ভ্রমণ ও তৎসহ সাহেবি হাবভাব পরের ব্যাপার। এই ভ্রমণ আশি দশকের মধ্যভাগে শীত থেকে শুরু হয় যখন হারবার্টকে জ্যাঠাইমা জ্যাঠামশাইয়ের অলেস্টারটি দিয়েছিলেন। যদিও এতে কয়েকটি জায়গা পোকা খাওয়া ও রোঁয়াওঠা ছিল এবং কোমরের বেল্ট ছিল না তবু ধন্‌নাদাদা তার মা অর্থাৎ জ্যাঠাইমাকে শুনিয়ে বলল–বাড়ির সব পুরনো, ভালো ভালো জিনিশ, সব ঐ বসে খাওয়াটার পেটে পুরচে। বাপের একটা জিনিশ। বড় ছেলেকে একটিবার জিজ্ঞেস অব্দি করলে নাকো।

জ্যাঠাইমাও. দুকথা শুনিয়ে দিলেন। “দ্যাখ ধন, আধবুড়ো হলি তবু হিসকুটেপনা গেল না। হেয্যাহেয্যির জ্ঞান তো খুব দেখছি, কী হয়েছে ওকে একটা গরম কাপড় দিলে? ঐ কি তুই পরতিস।

-দ্যাকো মা, যা বোজো না তাই নিয়ে কই কই মোট্টে করবে না। আমি কি স্বার্থ থেকে বলছি। আমি বলচি অব্যেসের কথা। খেতে পরতে পাচ্ছে। তার ওপর এটা ওটা তো আছেই। তার ওপর যদি ওপরঝোঁকা হয়ে আজ টিয়া, কাল কাকাতুয়া এনে দাও পরে সামলাবে কে? এরপর বাড়ির ভাগ চাইবে, ঘরদালান চাইবে।

-সে ওতো ভালো বলে কখনও বলে না। চাইলে কী দোষেরটা শুনি? ওর বাপের ভাগ কি নেই?

-এই দ্যাকো, মাতাগরম করে দিলে তো। বাপের ভাগ মারাচ্চে। বলি বিষয়সম্পত্তি সাইজ করার মতো বুদ্ধি আছে ঐ ঘটে? ভাগ চাইবে। ভাগ চাচ্চে।

-চাইলে কী বলবিটা কী শুনি।

-পেঁদিয়ে তাড়াব, বলব কী? এত বছরের ভাতকাপড়-হিসেবটা হোক না! খাল খিচে দেব না বাঞ্চতের।

“ইন্দ্রিয়ারাম দেহাত্মবাদীদিগের মন পরলোক বুঝিতে অক্ষম। পরলোক কেন, ইহলোকেরও অনেক সূক্ষ্ম বিষয় বুঝিতে অক্ষম। ইহাদের মনে শরীর, ইন্দ্রিয় ও ভোগ্য বিষয় লইয়াই সর্বদা ব্যতিব্যস্ত ও ব্যাসক্ত অবস্থায় অবস্থান করে; সেই কারণে ইহাদের মনে পরলোক বিষয়ক প্রমাদজনিত নির্মল সত্যজ্ঞান জন্মে না। মন যে বিষয়ে একাগ্র হয়, সে বিষয় তাহাদের নিকট স্ফূর্তি পায় এবং যে বিষয়ে একাগ্র না হয়, সে বিষয় স্ফূর্তি পায় না। মনের এই স্বভাবশক্তি বা স্বধর্ম, আবালবৃদ্ধবণিতা সকলেরই নিকট পরিচিত রহিয়াছে।”

অলেস্টার পর্বের পর হারবার্টের দুই ভাইপো প্রসেনজিৎ (ফুচকা) ও ইন্দ্রজিৎ (বুলান) একতলায় খাওয়ার জায়গায় অতর্কিতে হারবার্টকে আক্রমণ করে। অজুহাত ছিল হারবার্ট নাকি তাদের পড়ার সময় পুরনো ডাবের খোলা কেটে জ্বালানী বানাবার অছিলায় শব্দ করে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছিল। জ্যাঠাইমা তখন পুজোয় বসেছেন। ওপরে আওয়াজ যায়নি। ধনা দোকানে। বৌদিও বাড়িতে ছিল না। বড় ছেলে অর্থাৎ প্রিয়জিৎ তখন স্নানের ঘরে। হারবার্টের আর্তচিৎকার শুনে সে গামছা পরে বেরিয়ে আসে এবং চেঁচিয়ে ভাইদের থামতে বলে। হারবার্টের তখন ঠোঁট ফেটে গেছে। রক্ত পড়ছে। চোখের তলায় ফুলে গেছে। দাঁত ব্যথা করছে। এই ঘটনার আর এক সাক্ষী ছিল ধাদাদার ঝি নির্মলা। হারবার্ট, মার খাওয়ার পরে যখন উঠোনে নেমে মুখ থেকে রক্ত ধুচ্ছে, প্রিয়জিৎ ঘটি থেকে জল ঢেলে দিচ্ছে, মাথা ঘুরছে হারবার্টের তখন মনে আছে ওপর থেকে জ্যাঠামশাই-এর গর্জন শোনা যাচ্ছে

“পিউ কাঁহা, পিউ কাঁহা’!

এই ঘটনার ফলে মর্মাহত হারবার্ট কিন্তু স্বর্গের চাবি পেয়ে গেল। দর্জির দোকানে দুলাল, রাখালবাবু ওদের তো বলেছিল উঠোনে পা পিছলে পড়ে এই কাণ্ড। কিন্তু নির্মলা মারফত সারা পাড়ায় ছড়িয়ে পড়তে বেশি সময় লাগেনি। নির্মলা টিউবওয়েল, মুদির দোকান, মিষ্টির দোকান–সর্বত্রই বলেছিল–কী নিদয়া গো ছেলেগুলো! ভালোমানুষ কাকাটাকে অমন করে মারতে পারল! ধনাকে অব্দি গাঙ্গুলী বাড়ির বড় ভাই, বড়িলাল একদিন অনেকের সামনেই বলে বসল, ধনা! বাড়িতে এসব কী হচ্ছে শুনচি! এপাড়ায় তো বাবা এমন ঘটনা শুনিনি। ভাইপোরা শেষে কাকাকে ধরে পেটাচ্ছে!

পাড়ার যুবক ও হারবার্টের জুনিয়ার যে গ্যাংটি একদিন তাকে দেখলেই “বাঁটপাখি! বাঁটপাখি”! বলে ক্ষেপাত তারাও আর না ক্ষেপিয়ে ও কাছে ঘেঁষে এসে তাদের সমবেদনা জানাল। এবং এরা হারবার্টের কাছে এসেছিল বলে দুই ভাইপো বেজায় কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল।

এভাবে হারবার্ট যেমন অনেকের কাছে আপন হয়ে উঠল তা ছাড়াও একটি ঘটনা ঘটেছিল যার কারণ অবশ্যই বিশদ বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে। সামনে পেছনে ঘুষি খেয়ে হারবার্টের অপরিণত ব্রেন বোধ হয় নড়ে গিয়ে থাকবে কারণ তা না হলে পনেরো বছর আগের ঘটনা আশ্চর্য এক স্বপ্নের মধ্যে দিয়ে ফিরে আসবে কী করে? লৌকিকের এই হস্তক্ষেপের ফলে হারবার্টের জীবনচরিত নতুন একদিকে মোড় নিল এবং কাকতালীয় হলেও যা অধিকতর আশ্চর্যের বিষয় যে ১৯৭১-এ পুলিশের গুলিতে নিহত নকশালপন্থী ভাইপো বিনুর বাবা, হারবার্টের কৃষ্ণদাদা তখনই কলকাতায় কাজে এসেছিলেন এবং ঐ বাড়িতেই ছিলেন।

“আমি বললাম দেখ দীননাথ, কল্যকার ব্যাপারটাই মনে মনে আলোচনা করেছ কিনা-তাই বোধহয় স্বজ্ঞানে এরকম বিভীষিকা দেখেছ। এখন সকলে নিশ্চিন্ত। মনে ঘুমাবার চেষ্টা কর।

“গর্জন করিয়া দীননাথ বলিয়া উঠিল কী বলছেন মশাই? আমার কথা আপনি মিথ্যে বলে উড়িয়ে দিচ্ছেন? আমি মিথ্যা বলিনি, আমি স্বপ্ন দেখিনি-চোখের ওপর যা যা দেখেছি, তাই আপনাকে বললুম; আমার কথা বিশ্বাস না হয়, ওঁদের সকলকে জিজ্ঞাসা করুন, সকলে তো আর এক সঙ্গে স্বপ্ন দেখিনি।”

এই অংশটি ‘সার্কাসে ভূতের উপদ্রব’ ও আগেরটি ‘পরলোক রহস্য’ থেকে। হায়, সেই বুকি আজ কোথায়? সেই চিলছাদে শোভা পাচ্ছে ডিশ অ্যান্টেনা। হারবার্ট নেই। সোভিয়েত ইউনিয়ন নেই। হিপোড্রোম সার্কাস নেই। সিমলা স্ট্রিটে প্রসিদ্ধ গোঁসাই বাড়ির পাশে দীনুর হোটেল নেই। “শ্রীযুক্ত সুরেশচন্দ্র বসুর চক্ষুদ্বয় প্রায় সর্বক্ষণ মুদিত থাকিত বলিয়া সকলে তাহাকে আঁজুবাবু বলিত।” তিনিও নেই।

রাব্বা! রাব্বা!

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন