নবারুণ ভট্টাচার্য
“তোরা না করিলে এ মহাসাধনা,
এ ভারত আর জাগে না জাগে না।”
–দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়
ধন্না মারফতই অলৌকিকভাবে স্বপ্নের মাধ্যমে বিনুর ডায়রি পাওয়ার ঘটনাটি পাড়ায় ছড়িয়ে পড়েছিল। করপোরেশন পার্কের ধারে রবিবার সন্ধেবেলার আড্ডায় ধনা কথাটা বলতে বড়িলাল, ক্ষেত্র, গোবী, উঞ্জে, হরতাল ইত্যাদি পাড়ার সিনিয়াররা তাজ্জব হয়ে গেল।
গোবী পাঁড়মাতাল। সে লাল চোখে জলের দিকে তাকিয়ে ভাবুকভাবে বলল, আসলে কী জানিস। সবই মায়ের খেলা। কাকে যে কখন কোথায় মাথায় একটু টুক করে ছুঁয়ে দেবে তা কে বলতে পারে! হারবার্ট এ করতে পারে কেউ ভেবেছিল কখনও?
-অনেকে বলে তারাপীঠে এক কী যেন বাবার সমাধি আছে। সেখানে এক বোতল মাল ঢাললে নাকি দেবদিষ্টি পাওয়া যায়।
-অতদূরের কী দরকার। যা না, ঐ ঘুটিয়ারি শরিফ ঘুরে আয়না। দেখবি কত রকমের কাও।
বড়িলাল বলেছিল-হারবার্টের কাছে যাব তত একবার। নিজের কানে শুনতে হবে গোটাটা।
আসলে বড়িলাল অন্য কারণে যাবে, ভেবেছিল। তার ভাই গামা গত বছর লিভার পচে মরেছে চোলাই খেয়ে খেয়ে। মরেছে, মরেছে, তারপর থেকে বাড়িতে আজ এর জ্বর, কাল ওর পেটখারাপ, পরীক্ষায় ফেল লেগেই আছে। হারবার্ট কি কোনো হদিশ দিতে পারবে?
হারবার্টের ঘরে তখন পাড়ার অন্য ছেলেরাও ছিল। হারবার্ট মনে অন্য জোর পেয়ে গেছে তখন। একদৃষ্টে সে কিছুক্ষণ বড়িলালের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকল। তারপর বলল–একবছর হল, না?
–ঠিক ঠিক ধরলে এগারো মাস। শ্রাদ্ধশান্তি তো সবই করেচি। বাৎসরিকও হবে।
-সে সব তো করলে বুঝলাম, কিন্তু জল না পেয়ে যে মরাপানা হয়ে যাচ্চে গো …
–কে?
–কে আবার? চাঁপাগাছ গো, চাঁপাগাছ।
বড়িলাল বেজায় ঘাবড়ে যায়। ছাদের বাগান ছিল গামার একমাত্র শখ। সেখানে কাঠের বাক্সে চাঁপাগাছ লাগিয়েছিল গামা। সত্যিই তো।
হারবার্টও ছাদ থেকে দেখত গামা সারা বিকেল গাছের যত্ন করছে, মাটি খুঁচোচ্ছে, জল দিচ্ছে।
এটাও হারবার্ট দেখেছিল যে ডাগরভোগর চাঁপাগাছটা হাড়কাঁটা হয়ে যাচ্ছে। বডিলাল তড়িঘড়ি উঠে রওনা দেয়। এবারে মোক্ষম খেলাটা খেলে দেয় হারবার্ট।
-যদি দেখ গাছটা মরে গেছে তাহলে ওটাকে তুলে ফেলে ভালো একটা ডাল সামনের বর্ষায় পুঁতে দিও। আর বেঁচে থাকলে কতাই নেই। দিনকয়েক গোড়া ভিজোলেই জানান দেবে।
বড়িলালের পা কাঁপছে। হারবার্ট থামে না, থামলে এখন চলবে না, থামা যায় না।
-আসলে কী জানো? টান! টান! মরে গেলাম। পুড়িয়ে দিল। কিন্তু যেখানে টাক সেখানে তো মন সারাক্ষণ পড়ে থাকবে। যাবে কোথায়। সবই অন্তরালের খেলা। অন্তরালের লীলা! কতরকমের যে বন্দোবস্ত। পরে একদিন বলবোখন বড়িদা। এখন যা বললাম করো দিকিনি।
বড়িলালের সেবায় শুকনো ডালে কয়েকদিন পরে পাতা বেরোল। নতুন ডাল ছাড়ল ফেকড়ি দিয়ে। ধন্না আর ক’জনকে বলেছিল। বড়িলালের অক্লান্ত প্রচার, নানাদিকে ছড়াতে শুরু করল। থানার বড়বাবু অবধি শুনে বিস্ময় প্রকাশ করলেন,
-বলো কী? এ যে দেখছি প্রায় নস্ত্রাদামুস। মালটাকে তো দেখতে হচ্ছে একবার।
কোটন আর সোমনাথ একদিন সকালে রিক্সা করে বাটম-বাঁধানো টিনে হলদের ওপরে লাল দিয়ে লেখা ঝর্মকে একটা সাইনবোর্ড নিয়ে এল—’মৃতের সহিত কথোপকথন’–প্রোঃ হারবার্ট সরকার।
কৃষ্ণদাদা বিনুর ডায়রি নিয়ে ফিরে যাবার সময়ে হারবার্টকে একশো টাকা দিয়ে গিয়েছিলেন। তাই দিয়েই হারবার্ট ব্যবসা শুরু করে। কৃষ্ণদাদাও হারবার্টের স্বপ্নের ব্যাপারটা অনিচ্ছা ও ঘোর আপত্তি থাকলেও বিশ্বাস করতে, বলতে গেলে, বাধ্য হয়েছিলেন। সত্যি বলতে বিনু যে হাসপাতালে তাকে ঐ কথাগুলো বলেছিল সেটা হারবার্টের মনে ছিল না। বিনুকে দাহ করার সময় অত পুলিশ, ভ্যান, বন্দুক দেখে তার ভয়েতে প্রাণ উড়ে গিয়েছিল।
‘শ্রীমৃণালকান্তি ঘোষ ভক্তিভূষণ প্রণীত “পরলোকের কথা” পাঠ করিলে পরলোক-তত্ত্ব ও আত্মার অস্তিত্ব সম্বন্ধে বিশ্বাস বদ্ধমূল হইবে, এবং পরলোকগত প্রিয়জনের সহিত কথাবার্তা বলিবার এবং তাহাদের দর্শনলাভের উপায় জানা যাইবে।
মৃত ব্যক্তিদের সঙ্গে কথাবার্তা ও ভাবের আদান-প্রদানের জন্য হারবার্টের অনুসৃত পদ্ধতিটি স্পিরিচুয়ালিস্ট দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিচার করলে একটি জগাখিচুড়ি বলে মনে হতে পারে। টক্ টক শব্দ দ্বারা আত্মার সঙ্গে যোগাযোগের যে পদ্ধতি আমেরিকার ফক্স ভগিনীরা অবলম্বন করে সবিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন অর্থাৎ ব্যাপিংস’ নামে যে পদ্ধতি পরিচিত তার কোনো প্রভাব হারবার্টের মূতের সহিত কথোপকথনে পড়েনি। শ্লেট বা কাগজে অদৃশ্য হস্তে লেখা যে পদ্ধতি এগলিন্টন সাহেব ১৮৮১ সালে কলকাতায় দেখিয়েছিলেন বলে শোনা যায় তাও হারবার্ট কখনো করেনি। বা সোজা বাংলায় করতে পারেনি। একদিক দিয়ে হারবার্টকে আমরা একধরনের মিডিয়াম বলতে পারি। এ বিষয়ে পরলোকের কথা’ থেকে হারবার্ট জেনেছিল, “এতদ্ভিন্ন অপর যে সকল উপায়ে মৃতব্যক্তির আত্মার সহিত কথাবার্তা বা ভাবের আদান-প্রদান চলিতে পারে, তাহাতে একজন মধ্যবর্তী লোকের আবশ্যক। এই মধ্যবর্তী লোককে ইংরাজীতে মিডিয়াম বলে। মিডিয়াম হইবার শক্তি সকলের আছে কিনা ঠিক বলা যায় না। তবে সকলের যে সমান শক্তি নাই, তা প্রমাণিত হইয়াছে। এরূপ দেখা গিয়াছে, বিশেষ বিদ্যাবুদ্ধি না থাকিলেও কেহ কেহ শৈশবাবধি, সম্ভবত জন্মাবধি, এই ক্ষমতা লাভ করিয়াছেন। আবার কেহবা বিশেষ চেষ্টা করিয়াও কৃতকাৰ্য্য হইতে পারেন নাই। কাহারও কাহারও মতে, যাঁহারা তুলারাশির ও শান্ত প্রকৃতির লোক, যাঁহাদিগের মন-সংযম করিবার ক্ষমতা আছে, তাহারাই ভালো মিডিয়াম হইতে পারেন, অর্থাৎ তাহাদিগকে মৃতব্যক্তির আত্মা স্ববশে সহজে আনিতে সমর্থ হন। এইজন্য স্ত্রীলোকদিগের মধ্যেই মিডিয়ামের সংখ্যা অধিক দেখা যায়।” সহসা, এক স্বপ্নে, হারবার্টের মতো পরলোকের সহিত যোগাযোগ স্থাপনের ক্ষমতা অর্জনের উদাহরণ স্পিরিচুয়াল বিশ্বে বিরল। হারবার্ট কখনো প্ল্যানচেটে লেখার চেষ্টা করেনি। বরং বলা যায় যে কিয়দংশে সে স্বৈরলিপি বা অটোমেটিক রাইটিং পদ্ধতি কাজে লাগিয়েছিল। অবশ্য হারবার্টের কখনো কখনো খাপছাড়াভাবে ব্যবহৃত অটোমেটিক রাইটিং-এর উদাহরণ যদি কেউ স্টেড সাহেবের বর্ডারল্যাণ্ড’ পত্রিকার রচনাবলী (বিশেষত মিস জুলিয়াসের আত্মার লেখাপত্র) বা ডবলিউ স্টেনটন মোজেজ সাহেবের কর্মকৃতির সঙ্গে তুলনা করতে যান তাহলে অবশ্যই হাস্যরসের উদ্রেক ঘটবে। হারবার্ট কখনো কখনো অবশ্য ট্রান্স মিডিয়াম বা মোহাবিষ্ট মিডিয়ামের ভাব দেখিয়েছিল। দিব্যদৃষ্টি বা ক্লেয়ারভয়্যান্স তার মধ্যে কখনো দেখা যায়নি। আরোগ্যকারী মিডিয়াম বা হিলিং মিডিয়াম সে কখনো হতে পারেনি। মেসমেরাইজ করার ক্ষমতা তার ছিল না। আত্মার জড়ীয় মূর্তিধারণ বা মেটেরিয়ালাইজেশন ছিল তার সাধ্যের অতীত। রিচেট, ক্রুকস, কোনান ডয়েল, মায়ার্স–এই মহান ঐতিহ্যের মধ্যে হারবার্টকে স্থান দেওয়ার চেষ্টা করা যায় না। সে একটি ‘ফ্রিক’। কলকাতায় যাঁরা গভীরভাবে প্রেতযোনি ও মুক্তাত্মা নিয়ে চর্চা করেন, যাঁদের মধ্যে সংস্কৃতি জগতের এক প্রবাদ-পুরুষও ছিলেন, তাদের সঙ্গে ও হারবার্টের কোনো যোগাযোগ ছিল না। সর্বোপরি, ব্যবসা জমে ওঠার পরে তার সাধারণ জ্ঞান লোপ পেয়েছিল। টাকার লোভে যা খুশি তাই সে করত। কখনো মৃতের ব্যবহৃত কোনো জিনিস বা হস্তাক্ষর কিছু নিয়ে ভাব দেখাত যে সাইকোমেট্রির সহায়তা নিয়ে হদিশ চালাচ্ছে। এ ছাড়াও অনেকেই জানেন যে প্রকৃত স্পিরিচুয়ালিস্টরা ঠিক দুপুরে বা গভীর রাতে, অতিরিক্ত ঠাণ্ডায় বা গ্রীষ্মে কিংবা ঝড়, বৃষ্টি, বাজ পড়ার সময় অপরলোকের সঙ্গে যোগাযোগ করা পছন্দ করেন না কারণ এরকম সময় ভূত-প্রেতই বেশি আসে। মুক্ত আত্মারা প্রায় আসে না বললেই চলে। কিন্তু কে শোনে কার কথা। তাছাড়া হারবার্টের তখন থামার সময় ছিল না।
একেবারে প্রথম দিকেই এসেছিলেন বিনয়েন্দ্র চৌধুরী, সঙ্গে তাঁর স্ত্রী অতসী। বিনয়েন্দ্রবাবুর একমাত্র ছেলে ছিল পাইলট। এয়ারবাস দুর্ঘটনায় হায়দরাবাদে মারা যায়। বছরখানেক হয়েছে। ছেলে রাহুলের বিয়ের কথা হচ্ছিল। সেই থেকে অতসী প্রায় উন্মাদ। বিনয়েন্দ্রবাবু একের পর এক সিগারেট খাচ্ছিলেন। অতসী অপলকভাবে হারবার্টের দিকে তাকিয়ে ছিলেন এবং হারবার্ট শিরদাঁড়া সোজা করে বসে অপলকভাবে রাহুলের ফটোটি অনেকক্ষণ দেখার পর চোখ বন্ধ করেছিল। দরজার বাইরে কোটনরা দাঁড়িয়েছিল। একবার চোখ খুলে হারবার্ট সামনে রাখা কাগজে ডটপেন দিয়ে লিখলম, ৪-তারপর স্মিত হেসে ফটোটা বিনয়েবাবুর দিকে এগিয়ে দিল। হারবার্ট বলতে থাকে,
-অকালমৃত্যু, আয়ু ছিল, কর্মশক্তি ছিল কিন্তু কী করে কী হল, উপচ্ছেদ • হয়ে গেল। শোক! দুকখু! হুতাস। শুধু তাই নয়। সমষ্টি মৃত্যু! উঃ কী করে যে এ সহ্যশক্তি পেলেন আপনারা! গড় করি! অমন সহ্য শক্তিতে গড় করি।
অতসী সরবে কেঁদে ওঠেন। হারবার্টও নিজের চোখের জল মোছে। স্মিত হাসি ফুটে ওঠে তার মুখে।
-তবে আর তো দুঃখের কিছু নেই। দুঃখের কী আছে। কালরাজ্য, মৃত্যুরাজ্য এ তো থাকবেই। ছেলেটির মন বড় ধার্মিক ছিল দেখছি।
বিনয়েন্দ্র ও অতসী চমকে উঠেছিলেন কারণ দোতলা থেকে গর্জন শোনা গিয়েছিল-পিউ কাঁহা! পিউ কাঁহা।
বিনয়েই বললেন—আমি তো যতদুর জানি ধর্ম-কর্ম নিয়ে খোকা একেবারেই মাথা ঘামাত না।
-ঘামাত না?
-বরং তর্কই করত। উনি তো আবার সাঁই বাবার…
হারবার্ট চেঁচিয়ে ওঠে,-থাক, আর বলতে হবে না। আমি শুনব না, শুনব না, শুনব না … (কানে হাত চাপা দেয়)।
দুজনেই অপ্রস্তুত। কী করবেন ভেবে উঠতে পারেন না। কান থেকে হাত সরিয়ে হেসে ফেলে হারবার্ট।
-মাপ করবেন। মুখ মানুষ তো, রেখে ঢেকে কতা আসে না। আচ্চা, ধরুন আপনার কতাই ঠিক। তা যদি হবে তাহলে এমনটি কী করে হল বলুন তো?
-কী হল?
হারবার্ট কাগজের দিকে দেখায় যেখানে ম, ৪ লেখা।
-এর মানে?
-মানে? মানে শুনলেই তো আমার খেলা শেষ, ওফ্ ঐ ঐ শিবদুর্গা আসছে, কতবড় বন্দোবস্ত। আমি বলি এই হালফ্যাশানের যুগে কজন মধ্যমধার্মিক হয়? কজন চতুর্থ স্তরে থাকতে পারে? আমি মরলে পারব? স্থূলপাপী হব, নরকের কীট কেন্নো চিবিয়ে চিবিয়ে খাবে। আপনাদের ছেলের তো আনন্দ এখন, নন্দনকাননাদি স্থান, যক্ষকিন্নরাদি শরীর ও তদুপযুক্ত সুখ-দুখ ভোগ।
অতসী যেন ভাবের ঘোরে শুনে যান।
-বলেচে কি জানেন, বলেচে-জপ-তপ সবই বৃথা মরতে জানলে হয়। মূরণকালে ভালো চিন্তা ছিল, তারই সুফল ভোগ করছে। কী আনন্দ, কী আনন্দ মা, মাগো, কেন লুকিয়ে রেখেছিলি মা …. কেন?
মৃত বৈমানিক পুত্র মধ্যমধার্মিক অবস্থায় চতুর্থ স্তরে প্রভূত সুখে বিরাজ করছে। জেনে শান্ত, নিথর অতসীকে নিয়ে বিনয়েন্দ্রবাবু গম্ভীরমুখে অ্যাম্বাসাডরের পেছনে বসে বাড়ি গেলেন এবং ওয়ালেটে দুটি পঞ্চাশ টাকার নোট কম ছিল।
-আপনার …
-কী আপনার?
-মানে কী দেব।
-দেবেন? দেবেন। দেবেন না? দেবেন না। ভিক্ষে যার সম্বল, লাতিঝাটা যার মাথায় নিত্যি ঝরচে সে কি দরদাম করবে। তাও যদি দুটো ডিগ্রি থাকত, বলতে পারতুম।
বিনয়েন্দ্রবাবু নোট দুটো বালিশের তলায় খুঁজে রেখে চলে গিয়েছিলেন। সেই দিনই রাতে কুড়ি টাকার বিনিময়ে এক বোতল বাংলা আসে এবং আশি টাকা তোরঙ্গে সঞ্চিত হয়।
এর কিছুদিন পরে হারবার্ট দোতলায় গিয়ে জ্যাঠাইমার কাছে একশো টাকা ও ধনাবৌদিকে এক বাক্স মিষ্টি দিয়ে এল–বলল, ফুচকা-বুলানকে দিও। কাকা হয়ে কখনও কি খাওয়াতে পেরেছি?’ ঘুষির জবাবে বড় বড় সন্দেশ। পরে ধনাকেও জুতোতে ছাড়েনি। ‘দাদা, মিষ্টি খেয়েছিলে?’ ধনা বলল। কিছুদিন পরে ধবৌদি বলল,-ঠাকুরপো, বাইরের কাজের লোক আসে। তুমি বরং ভেতরের কল-বাথরুমটাই ইউজ করো না। কেউ কি বলেছে কিছু কোনোদিনও তোমাকে?
-না, বৌদি। অব্যেস হয়ে গেছে তো। আর আমার তো সময়ের ঠিক নেই। আমার তো কোনো অসুবিদে হচ্ছে না।
-মানে, তোমার দাদাই বলছিল বলে কথাটা বল্লুম।
সবচেয়ে খুশি হয়েছিলেন জ্যাঠাইমা। হারবার্টের মাথায় হাত রেখে বলেছিলেন প্রাণটা যেন জুড়িয়ে দিলি যে হারু। অত অত্যেচার, অত অনাচার, ভাবিসনি আমার কিছু নজর এড়ায়। মুখ বুজে থাকলে কী হবে, আমি সব জানি। পুণ্যকাজ করচ বাবা, সবই মায়ের আশীৰ্বাদ।
-জ্যাঠাইমা।
-উঃ।
-সেই গপ্পোটা বলো না?
-কোনটা?
-তোমার বিয়ের সেই ..
-কদমা। হিহিহিহি। সে তো বাসররাতের আগে। নতুন জামাই তো কুঁতে কুঁতে খেল–এই লুচিটা ধরে তো ঐ আলুটা পড়ে যায়। ঢলে ঢলো ভাব।
-কেন গো?
-ওমা, সঙ্গে যে বন্দুগুলো গিয়েছিল ওগুলো তো লুকিয়ে মদ নিয়ে গিয়েছিল। নিত্যি খেত তো৷ পলকাটা কত রকমের বোতল। তারপর বুজলি,
–ও জ্যাঠাইমা, ঢুলচ কেন?
-হ্যাঁ, তারপর হল কী এয়োরা খিলখিল করচে। কেন? জামাইকে একটা কদমা দিয়েচে খেতে সে একেবারে হাতির মাতার মতো।
-তারপর?
-তোর জ্যাঠা তো তকন রসে টইটম্বুর। তবে হ্যাঁ, আড়াখানা ছিল বলরামের মতো। যেই না কামড় দেওয়া, অমনি, ছিছি কী কাণ্ড, হিহিহিহি।
-কেন গো জ্যাঠাইমা?
-কদমার ভেতরে জুতো। একপাটি জুতো গো। জুতো পাতে। চোখ গোল্লা গোল্লা করে এদিক ওদিক তাকাচ্চে। আর মেয়েরা চেঁচাচ্চে–‘জামাই, জুতো কামড়াচ্চে গো। এ কেমন জামাই গো। সে যে কী বটকেরা হয়েছিল!
নিজের বাসররাতের স্মৃতি কি মনে পড়ে যায় গিরীশকুমারের? তাই কি তারস্বরে স্বগতোক্তি করে ওঠেন তিনি—’পিউ কাঁহা! পিউ কাঁহা!’
জ্যাঠাইমা বলেন,-ঐ এক হয়েছে বাবা পিউ কাঁহা। ধনা, কেষ্ট-ছোটবেলা। অশৈলপনা করলে বলতেন শূয়ার কাহাকার! ওরা নীচু গলায় জবাব দিত কলকাতাকার। সব বিস্মরণ। ঐ দাপট, ঐ ঝাঁপট। সব গিয়ে ঐ পিউ কাহা, পিউ কাঁহা! একটা গান মনে এল রে হারু, গাইব?
-গাও না। তুমি তো ভালো গাইতে আগে।
-শো। সুর ধরতে পারব?
-পারবে। ঠিক পারবে।
চাঁদের আলোয় জ্যাঠাইমা গান ধরেন,
সখি!
কেমনে যমুনাজলে যাই!
জল আনিবার পথে, যে রূপ দেখিনু লো,
তুলনা তাহার কোথা নাই।।
জিনি নব জলধর, কান্তি মনোহর লো,
শুন শুন পরাণের সই।।
মনে মন নাহি মোর, হরে নিল মনচোর,
সরমের কথা কারে কই।।
অবলা রমণী আমি, সে, রূপ হেরিয়ে লো
হই যেন আপনারে হারা।।
জল নিতে ভুলে যাই, শুধু তারি পানে চাই,
বল সই এ কেমন ধারা।।
ঘরে মন নাহি সরে বাঁশীরব শুনে লো,
ঘটিল যে এ বড় বালাই।।
শাশুড়ী ননদী সবে, গঞ্জনার কথা কবে,
কেমনে যমুনা জলে যাই!!
গান শেষ হয় না। জ্যাঠাইমা ফুলে ফুলে কাঁদতে থাকেন। তেরচা চাঁদের আলো ঢুকে আলমারির এক পাল্লায় পড়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে। তার সঙ্গে ধনার ঘরের টিভির আলো বারান্দায় মিলেমিশে নীলছে একটা দপদপে আলেয়া তৈরি করেছে। সেই আলোয় জ্যাঠাইমাকে রেখে চলে আসতে গিয়ে হারবার্ট দেখেছিল দেওয়ালে ঠেস দিয়ে গভীর মমতার সঙ্গে গান যেখান থেকে আসছিল সেদিকে চেয়ে আছেন জ্যাঠামশাই। কাঁদতে কাঁদতে নেমে এসেছিল হারবার্ট।
মন কেমন করে। চিলছাদ, ছায়া, রাত, সকাল, কাকের ডাক সব কিছুর জন্যে মন কেমন করে। বাবার জন্যে মন কেমন করে। মার জন্যে মন কেমন করে। জ্যাঠামশাই-এর জন্যে মন কেমন করে। জ্যাঠাইমার জন্যে মন কেমন করে। সব কিছুতে মায়া, টান থেকে যায়। সব কিছুর জন্যে মন কেমন করে।
নিজের ঘরে খাটের ওপরে উপুড় হয়ে বালিশ ভিজিয়ে হাউ হাউ করে কাঁদে হারবার্ট। বিনুর জন্যে কাঁদে। নিজের জন্যে কাঁদে হারবার্ট। বুকির জন্যে কাঁদে। মিথ্যে কথা বলার জন্যে কাঁদে। কাঁদতে কাঁদতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুমের মধ্যে ফেঁপায়। চিৎ হয়ে শোয়। ঘুমের মধ্যে হাসতে থাকে। আবার ফোপায়। হাসে।
পিতা ললিতকুমার ও মাতা শোভারাণী শিশুপুত্রের এই বিচিত্রভাব দেখিতেছিলেন। বিস্মিত ললিতকুমার জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে শোভারাণীর দিকে তাকাইতে শোভারাণী ঈষৎ মায়াময় হাসি হাসিয়া বলিলেন—’দ্যায়লা করচে।’
হারবার্টের ব্যবসা চলতে শুরু করল। একজন ডাক্তার এসেছিলেন তার ভাই এর বৌকে নিয়ে। ভাই আমেরিকায় ক্যানসারে মারা গেছে। একজন এয়ার হোস্টেস এসেছিল। সে তার বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করতে চায়। দোহারা চেহারার একটি ছেলে এসেছিল একদিন। তার মা-র জন্যে। সদ্য বোধহয় কলেজে ঢুকেছে। যাবার সময় বলে গেল–যা কিছু আপনি বলছেন সবই ভেগ। একটা কংক্রিট কথাও বলতে পারেননি। আসলে আমার আসাটাই উচিত হয়নি।
ছেলেটিচলে যাবার পরে হারবার্ট কিছুক্ষণ চুপ করেছিল। তারপর বলেছিল,–আসাটাই উচিত হয়নি! বাপের বানচোৎ ছেলে। আমি আসতে বলেছিলুম?
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন