বিশ্বরূপ মজুমদার
সমুদ্রের ঢেউ ভাঙছে, সাদা সাদা ফেনা যেন নীল শাড়ির সাদা পাড়। এখন জোয়ার চলছে। তাই বেশ বড় বড় ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে সৈকতে। সন্ধে নেমেছে কিছুক্ষণ আগে। সমুদ্রের কাছাকাছি এই সৈকতেই আমি ঘোরাঘুরি করি বেশি, কী এক অদ্ভুত টান! এই জায়গাটা একটু পাথুরে। হঠাৎ নজরে পড়ল লোকটাকে। একটা পাথরে বসে আছে সমুদ্রের দিকে মুখ করে। আশ্চর্য লাগল! এই সময়ে সব পর্যটক তো সাধারণত নিজেদের হোটেল রুমে ঢুকে পড়ে। সারাদিনের দাপাদাপি সাগরবেলায়, রাত বাড়লে শ্রান্ত দেহ আরাম চায়, তাই কোটরে ঢুকে পানাহার সহযোগে ফুর্তি চলে। এই তো দেখে আসছি এতদিন ধরে। এই লোকটিই ব্যতিক্রম! কী ব্যাপার! সঙ্গে কেউ নেই, একদম একা নাকি! লোকটিকে ছাড়িয়ে অনেকটা চলে গিয়েছিলাম উলটো দিকে। ততক্ষণে চাঁদ বেরিয়ে এসেছে মেঘের আড়াল থেকে। চারপাশের অনেক কিছুই এখন দৃশ্যমান। ফিরে আসার সময় হাঁটতে হাঁটতে কখন যে লোকটির পেছনে চলে এসেছি, খেয়াল নেই। খেয়াল হল যখন সমুদ্রের গর্জন ছাপিয়ে একটা ভাঙা ভাঙা কণ্ঠস্বর আমার কানে পৌঁছল।
‘এক্সকিউস মি, আপনার কাছে কোনও লাইটার হবে?’
আমি ভাবলাম, লোকটা বাংলায় কথা বলল কী ভেবে? আমি তো বাঙালি নাও হতে পারতাম!
‘সরি, আমি স্মোক করি না।’
‘ওহ!’ লোকটা বোধহয় একটু হতাশ হল।
‘আপনি কি বেড়াতে?’
‘হ্যাঁ, ওইরকমই।’
মানেটা ঠিক বুঝলাম না। হয় বেড়াতে, না হয় কোনও কাজে, মাঝামাঝি কিছু হয় বলে তো আমার জানা নেই। আমি আবার পা বাড়াতেই লোকটি বলে উঠল – ‘আপনি?’
‘আমি এখানেই থাকি।’
‘আচ্ছা! আমি নীলাঞ্জন সান্যাল। যদি কিছু মনে না করেন, এখানে বসতে পারেন। আলাপ করা যাবে।’
প্রস্তাবটা খারাপ লাগল না। লোকটার থেকে কিছুটা দূরে একটা পাথরের ওপর বসে পড়লাম। চাঁদের সঙ্গে মেঘেদের লুকোচুরি চলছে। যেমন এই মুহূর্তে মেঘেদের হালকা চাদর সরে গিয়ে ছেঁড়া ফাটা চাঁদের আলোয় লোকটার মুখ কিছুটা হলেও স্পষ্ট। মুখে কেমন যেন উদ্বেগের ছাপ। আমার দিকে তাকিয়ে বলল – ‘আচ্ছা আপনার কি মনে হয় দাম্পত্য জীবনের দীর্ঘ সময় একসঙ্গে কাটানোর পরেও একজন আর একজনকে পুরোপুরি চিনে উঠতে পারে?’
একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম – ‘দেখুন, আমার মনে হয়, কোনও মানুষের পক্ষেই আর একজন মানুষকে সবটা জানা বোধহয় কখনওই সম্ভব না।’
‘কেন বলুন তো?’
‘কারণ, প্রতিটি মানুষের আলাদা আলাদা সত্তা, আলাদা প্রকৃতি, আলাদা মন।’
‘তবু বহুদিন একসঙ্গে পাশাপাশি থাকলে তো কিছুটা আন্দাজ করা যায়, নাকি?’
‘আন্দাজ হয়তো করা যায়, তবে তার সঙ্গে সত্যিটা মেলে না সবসময়।’
‘হুঁ, ঠিকই। সত্যিটা মেলানো খুব মুশকিল!’
লোকটির গলায় বিষণ্ণতার ছোঁয়া। এদিকে আমার কৌতূহল বাড়লেও ভদ্রতার খাতিরে কিছু জিজ্ঞেস করতে পারছি না। একজন অপরিচিতের দাম্পত্যে তো নিজে থেকে নাক গলানো যায় না। কিছুক্ষণ চুপচাপ। হঠাৎ লোকটি কেমন যেন আচ্ছন্নের মতো বলে উঠল – ‘কিন্তু আমি তো করবীকে ছাড়া অন্য কিছু ভাবিনি কখনও! বিগত পনেরো বছর ধরে, তিল তিল করে গড়ে ওঠা আমাদের সংসারে, আমি তো সারাক্ষণ শুধু ওকেই খুশি রাখতে চেয়েছি! ওর পছন্দের সব, সবকিছু এনে দিয়েছি, যতটা আমার সাধ্যে কুলিয়েছে!’
আমি নীরব থাকাই শ্রেয় মনে করলাম। লোকটি বলে চলল – ‘জানেন, এতদিন আমারও মনে হত, করবী আমাকে নিয়েই খুশি আছে। যদিও আমাদের কোনও সন্তান নেই, তবুও সেই শূন্যতা আমাদের মধ্যে কোনও দূরত্ব তৈরি করতে পারেনি। আমরা ছিলাম দু’জনেই দু’জনের পরিপূরক। অফিসের সময়টুকু বাদ দিলে, আমি সবসময়ই করবীকে সঙ্গ দেওয়ার চেষ্টা করেছি। একসঙ্গে সিনেমা দেখা, রেস্টুরেন্টে খাওয়া, বছরে দু’বার নিয়ম করে বাইরে ঘুরতে যাওয়া। কিন্তু, এত সবের পরেও, আজ আমি একজন ব্যর্থ মানুষ! আমার সমস্ত জীবন জুড়ে যে মানুষটি জড়িয়ে আছে, সে… সে যে গোপনে অন্য কারওর সঙ্গে…’
শেষের কথাগুলো ভাঙা ভাঙা স্বরে বলে লোকটা দু’হাত দিয়ে মুখ ঢাকল। আমি দেখলাম ওর নুয়ে থাকা শরীরটা কেঁপে কেঁপে উঠছে। লোকটা কাঁদছে। আমার কিছু বলা উচিত কি না বুঝতে পারছি না। মনে হল, থাক – কাঁদলে লোকটার মনটা কিছুটা হালকা হবে। কিছুক্ষণ বাদে মুখ তুলে চাইল লোকটা। একটু বিব্রত মনে হল।
‘কিছু মনে করবেন না, আমি এভাবে…’
‘না না, ঠিক আছে।’
আমি তাড়াতাড়ি বলে উঠলাম – ‘আসলে কী জানেন, বহুদিন ধরে নিজের মনেই কষ্ট গিলতে চেষ্টা করেছি, কাউকে কিছু বলতে পারিনি। কী বলব বলুন তো? নিজের থুথু ওপরের দিকে ছুড়লে তো নিজের গায়েই লাগবে, তাই না? কিন্তু, এখন দিন কে দিন সহ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে। তাই আর নিজেকে সামলে রাখতে পারছি না!’
লোকটার জন্য মায়াই হচ্ছিল। যেভাবে একজন অচেনা লোকের কাছে একান্ত ব্যক্তিগত কথাগুলো উজাড় করে দিচ্ছিল, মরিয়া না হলে মানুষ সাধারণত সেটা করে না। একসময় আমি বললাম – ‘আচ্ছা, আপনার কোথাও কোনও ভুল হচ্ছে না তো?’
‘ভুল! আমিও প্রথম প্রথম এই বলেই মনকে সান্ত্বনা দিতাম। কিন্তু, যেদিন নিজের চোখে…। নিজের চোখকে তো আর অবিশ্বাস করতে পারি না, তাই না?’
‘না, তবুও… অনেকসময় আমরা যেটা দেখি চোখের সামনে, সেটা সত্যি মনে হলেও আসল সত্যিটা থাকে আড়ালে। যখন সেটা জানা যায়, ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। এরকমও হয়।’
‘না, আমার কোনও ভুল হয়নি। বেশ কয়েকবার দেখে তবেই আমি এই সিদ্ধান্তে এসেছি।’
আবার কিছুক্ষণের নীরবতা। একসময় লোকটি বলে উঠল – ‘সেদিন অফিস থেকে একটু তাড়াতাড়িই বেরিয়ে পড়েছিলাম। ট্রামে করে ফিরছি, বেশ ফুরফুরে হাওয়া দিচ্ছে। ভেবেছিলাম অসময়ে বাড়িতে ফিরে করবীকে একটা সারপ্রাইজ দেব। বাড়িতে ঢুকে তেতলায় উঠে ডোর বেলটা বাজালাম। উত্তর কলকাতার সাবেক আমলের বাড়িতে ভাড়া থাকি আমরা। বেল বাজানোর পর কিছুক্ষণ কেটে গেল। কোনও সাড়া শব্দ নেই। মনে মনে অবাক হলাম। তাহলে কি করবী গা ধুতে বাথরুমে ঢুকেছে? আবারও বাজালাম বেলটা। এবারে দরজা খুলল করবী। আমায় দেখে নিরাসক্ত ভাবে বলে উঠল – ‘ও, তুমি?’
আমার বেশ অদ্ভুত লাগল ওর ওই নির্লিপ্ততা। বললাম – ‘হ্যাঁ, আজ আর কাজ করতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। তাই পালিয়ে এলাম। বাইরে বেশ হাওয়া দিচ্ছে, চলো কোথাও থেকে ঘুরে আসি। সাধারণত, এরকম প্রস্তাবে করবী আনন্দে উচ্ছসিত হয়ে উঠত। তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নিত বেরোবার জন্য। কিন্তু সেদিন সেসব কিছুই না করে একটু উষ্মার সঙ্গেই বলল – ‘এভাবে যখন তখন অপ্রয়োজনে টাকা ওড়ানোটা কি ঠিক হচ্ছে? ভবিষ্যতের কথাও তো ভাবা উচিত, তাই না?’ করবীর এইরকম প্রতিক্রিয়ায় আমি হতবাক হয়ে গেলাম। করবী বলল – ‘তোমার জলখাবার আনছি, তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও।’ এরপর সন্ধের দিকে ছাদে উঠব বলে সিঁড়িতে পা দিয়ে দেখি, ছাদের দরজাটা হাট করে খোলা। ভাবলাম, বিকেলে শুকনো জামাকাপড় ছাদ থেকে তুলে এনে বোধহয় দরজাটা দিতে ভুলে গেছে করবী। কিন্তু ছাদে পা দিয়েই আর একটা জিনিস আমার নজর কাড়ল। ছাদের এক কোণে সিগারেটের স্টাব ইতস্তত ছড়ানো। আমি বিস্মিত হয়ে ভাবলাম এই ছাদে তো আমি আর করবী ছাড়া আর কারওর আসার কোনও সুযোগ নেই। আর আমি তো প্রায় এক সপ্তাহ বাদে ছাদে এলাম। তাহলে!’
‘তারপর?’
এবারে আমার কৌতূহল উত্তরোত্তর বাড়ছে।
‘আমি খুব চেষ্টা করছিলাম সবকিছু ভুলে স্বাভাবিক আচরণ করতে। কিন্তু কোথায় যেন একটা কাঁটা বিঁধে রইল। অস্বস্তিটা রয়েই গেল। করবীকেও আমার দিনদিন বেশ নিরুত্তাপ লাগছিল। এরমধ্যে একদিন আমার এক আত্মীয়ের সিভিয়ার হার্ট অ্যাটাকের খবর পেয়ে অফিস থেকে সোজা ছুটলাম হসপিটালে। যাওয়ার আগে ফোনে করবীকে জানিয়েছিলাম ফিরতে দেরি হবে। আর সেইদিনই এতদিনের গোপনীয়তা আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে গেল।’
‘কীরকম?’
‘বাড়ি ফিরতে সেদিন বেশ রাত হয়ে গিয়েছিল। সদর দরজা দিয়ে ঢুকতে যাব হঠাৎ আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সক্রিয় হয়ে উঠে জানান দিল ছাদের ওপরে কারওর একটা নড়াচড়া। আবছা আলোয় খুব অস্পষ্ট হলেও আমি যেন কাউকে ছাদের পুব দিকে সরে যেতে দেখলাম। নীচ থেকে অবশ্য তেতলার ছাদের সবকিছু বোঝা সম্ভব নয়, তবুও আমি জানি আমি ভুল দেখিনি। উত্তর কলকাতার এইসব পুরনো বাড়ির ছাদ পাশের বাড়ির সঙ্গে লাগোয়া থাকে, দেখেছেন তো? তাই ছাদ টপকে পালানোটা ওখানে খুব বড় ব্যাপার নয়। তেতলায় উঠে কয়েকবার বেল বাজালাম। করবী এসে দরজা খুলেছে। আলুথালু বেশ, চোখেমুখে একটা বেশ তৃপ্তির আমেজ! বলল – ‘ইস, তুমি অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছো না? দ্যাখো কাণ্ড, আমি এমন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম…’ তারপর অনর্গল কথা বলে, এটা-ওটা জিজ্ঞেস করে, আমাকে খাবার বেড়ে দিয়ে যতই স্বাভাবিক থাকার অভিনয় করুক, আমার বেডরুমে সেদিন অন্য কারোর উপস্থিতি আমি আমার সবক’টি ইন্দ্রিয় দিয়ে বুঝে গিয়েছিলাম। বিশেষ করে, ঘরের ভেতর সিগারেটের গন্ধ!’
‘হ্যাঁ, কিন্তু সেই ব্যক্তির সঙ্গে যে আপনার স্ত্রী’র অবৈধ সম্পর্ক আছে, এমন কোনও প্রত্যক্ষ প্রমাণ তো আপনি পাননি, তাই না?’
‘আরে মশাই, আমার বেডরুমে অন্য কারওর উপস্থিতি আর কী জন্য হবে বলুন তো? নাঃ, আমার আর কোনও কিছুতেই বিশ্বাস নেই। কী করে যে এ থেকে মুক্তি পাব, বুঝতে পারি না!’ বলে মাথার চুল খামচে ধরলেন নীলাঞ্জন।
‘মুক্তি! সত্যিই মুক্তি পেতে চান?’
‘অবশ্যই! আপনার জানা আছে কোনও উপায়? থাকলে বলুন না!’ লোকটির আর্তি শুনে আমার ঠোঁটের কোণে একটু হাসি খেলে গেল।
‘মুক্তি পাওয়ার তো অনেক রাস্তা আছে, এবারে আপনি কোনটা বেছে নেবেন সেটা আপনার ওপর।’
‘হেঁয়ালি না করে খুলে বলুন না, দাদা!’
‘দূরে ওই যে একটা লাল আলো জ্বলছে, দেখতে পাচ্ছেন?’ বললাম আমি।
নীলাঞ্জন ঘাড় ঘুরিয়ে আলোটা দেখার চেষ্টা করে বলল – ‘হ্যাঁ, দেখছি। ওখানে কী আছে?’
‘ওইখানেই তো মুক্তি!’
‘মানে?’
‘এই বিচটা যে খুব রকি সেটা তো দেখছেন? তো ওই জায়গায় সমুদ্র একটা বাঁক নিয়েছে। ওখানে পাথরের একটা উঁচু টিলা মতন আছে, যেখানে লাল বাতিটা জ্বলছে। ওই টিলাটায় উঠে দাঁড়ালে অনেক নীচে দেখা যায় অসমান পাথরের সারিতে ধাক্কা খেয়ে ঢেউগুলো ভাঙছে। তার কী গর্জন! পূর্ণিমার রাতে ওই ভয়ঙ্কর সৌন্দর্য একবার নিজের চোখে দেখে আসুন স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে! মুক্তির আস্বাদ পেয়ে যাবেন।’
‘ধুর, ওর সঙ্গ আমার এখন বিষের মতো লাগে!’
‘সেইজন্যই তো বলছি, বিষাক্ত সঙ্গ পরিত্যাগ করুন, ঝেড়ে ফেলুন, মশাই! ঝেড়ে ফেলুন!’
‘আপনি যে কী বলছেন, কিছুই মাথায় ঢুকছে না!’
‘আরও খুলে বলতে হবে? নিশুতি রাত, চারপাশে কেউ নেই, টিলার মাথায় শুধু আপনারা দু’জন। দুরন্ত হাওয়ায় উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে মনে হবে। নীচে ফেনিল জলরাশি উদ্দাম গতিতে ছুটে এসে আছড়ে পড়ছে, বিন্দু বিন্দু জলকণার ঝাপটা এসে লাগছে চোখে মুখে। আকাশ জুড়ে চাঁদের আলো। এই সময়, ঠিক এই সময়…’
‘কী? এই সময় কী? থামলেন কেন, বলুন!’
‘ঠিক এই সময় আপনি আবেগে জড়িয়ে ধরতে গিয়ে আপনার স্ত্রীকে পেছন থেকে একটা মৃদু ধাক্কা…। ব্যস, মুক্তি! চিরকালের মতো!’
শুনতে শুনতে নীলাঞ্জনের চোখদুটো জ্বলে উঠল। ‘কিন্তু, করবী যদি যেতে রাজি না হয়!’
‘রাজি করাবার দায়িত্ব আপনার। আগামি পরশুই তো পূর্ণিমা! দেখুন!’
‘অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। আজ চলি।’ বলতে বলতেই হাঁটা দিল নীলাঞ্জন। এখন ও একটা ঘোরের মধ্যে আছে। আমি মনে মনে হাসলাম। ওষুধ ধরেছে!
হোটেলে ফিরল নীলাঞ্জন বেশ ফুরফুরে মেজাজে। করবী ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ছিল। নীলাঞ্জন পেছন থেকে জড়িয়ে ধরতেই চমকে উঠল। ওকে কাছে টেনে নিতে নিতে বলল – ‘করবী, একটা দারুণ জায়গার খোঁজ পেলাম। পূর্ণিমার রাতে ভীষণ সুন্দর লাগে ওখান থেকে সমুদ্র দেখতে। যাবে? পরশুই তো পূর্ণিমা! চলো যাই! এখান থেকে বেশি দূরে নয়।’ কিছুদিন ধরে যে দূরত্ব তৈরি হচ্ছিল দু’জনের মধ্যে একটু একটু করে, হঠাৎ কী এক দুরন্ত আবেগে তা মুছে গেল মুহূর্তে। করবীর মনেও কোথাও জমে থাকা অভিমান চোখের জলের সঙ্গে ধুয়ে যেতে লাগল।
দু’দিন পর রাতে তাড়াতাড়ি ডিনার সেরে নীলাঞ্জন করবীকে নিয়ে হোটেলের বাইরে এসে একটা অটো নিল। রাত তখন সাড়ে ন’টা হবে। আজ করবীও খুব উচ্ছসিত। যেন আগের দিনগুলো আবার ফিরে এসেছে এমনই মনে হচ্ছিল নীলাঞ্জনের। অভিনয়টা নিখুঁত করছে নীলাঞ্জন। করবী একটুও সন্দেহ করেনি। অবশ্য করবীও কম যায় না! নীলাঞ্জনকে যেন চোখে হারাচ্ছে এমন ভাব! যদিও অভিনয়টা করবীর মজ্জাগত!
যে পাথুরে টিলার ওপর লাল আলোটা জ্বলছে, সেটা বেশি দূরে না মনে হলেও এখন যেতে যেতে বোঝা যাচ্ছে জায়গাটা খুব কাছেও নয়। যা হোক, শেষমেশ নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে অটোর ভাড়া মিটিয়ে করবীকে নিয়ে টিলার ওপর উঠতে শুরু করল নীলাঞ্জন। পাথর কেটে সিঁড়ির ধাপ করা আছে। যদিও অসমান। করবী আজ নীলাঞ্জনের পছন্দের আকাশি নীল রঙের শাড়ি পড়েছে। কপালে লাল টিপ। খুব সুন্দর লাগছে ওকে। আর কতক্ষণই বা! এরপর তো ওকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না! আজ রাতে কেউ জানতেও পারবে না। আর কাল সকালে ভোর হওয়ার আগেই নীলাঞ্জন হোটেল লিভ করে যাবে। রাতেই তাই ও সব বিল মিটিয়ে দিয়ে এসেছে। আহা, ভাবতেই কী ভালো লাগছে! মুক্তি!
‘এই, একটু হাতটা ধরো। বেশ খাড়া আছে সিঁড়িগুলো!’ করবীর কথাতে চমক ভাঙে নীলাঞ্জনের। হাত বাড়িয়ে টেনে তোলে করবীকে। ব্যস, আর সিঁড়ি নেই। একটা পাথুরে চাতাল মতো। দু’জনে এসে দাঁড়াল ওইখানে। আজ পূর্ণিমা। আলোয় ঝলমল করছে আকাশ। আর সেই আলো প্রতিফলিত হচ্ছে অনেক নীচে সমুদ্রের ঢেউয়ে। পূর্ণ জোয়ার চলছে এখন। নীচের থেকে ফেনিল ঢেউগুলো টিলার গায়ে জেগে থাকা কর্কশ পাথরে ধাক্কা খেয়ে ফুঁসে উঠছে। তাকিয়ে থাকতে থাকতে কেমন একটা ঘোর লেগে যায় চোখে। নীলাঞ্জন আর করবীরও তখন সেইরকমই লাগছিল। খুব জোরে হাওয়া বইছে, নিচ থেকে সমুদ্রের গর্জন, সব মিলিয়ে কেমন একটা অপার্থিব অনুভব! ওরা দু’জনেই তন্ময় হয়ে দেখছিল! হঠাৎ নীলাঞ্জনের কানের পাশে কে যেন ফিসফিসিয়ে বলে উঠল – ‘কী হল, নীলাঞ্জন! মুক্তি চাই না?’ শিউরে উঠল নীলাঞ্জন।
‘এ কী? আপনি এখানে? কী করে?’
আমি বললাম – ‘আমি তো এখানেই থাকি!’
‘এখানে? মানে?’
‘এখানে মানে এখানে!’ বললাম আমি।
‘কিন্তু, আপনি কখন এলেন? আমরা তো উঠছিলাম, আপনাকে দেখিনি তো!’
‘কার সঙ্গে কথা বলছ তুমি!’ করবীর ভয়ার্ত স্বরে সচকিত হল নীলাঞ্জন। যাক, করবী তাহলে দেখেনি।
‘আর দেরি করবেন না, মুক্তি আপনার হাতের মুঠোয়!’ নীলাঞ্জন আবারও বলল – ‘কিন্তু আপনাকে দেখতে পাচ্ছি না কেন?’
‘নীলাঞ্জন, আপনি যে কাজ করতে এসেছেন, সেটা করুন। প্রশ্ন করবেন না।’
ইতিমধ্যে, হাওয়ার গতি বেড়ে ঝোড়ো হাওয়া বইতে শুরু করেছে। চাতালের ওপর নীলাঞ্জন আর করবীর দাঁড়িয়ে থাকতে বেশ অসুবিধে হচ্ছে। হাওয়ায় যেন উড়িয়ে নিয়ে যাবে যে কোনও মুহূর্তে। নীলাঞ্জনের খুব শীত করছে।
‘শুনছ, চলো আমরা নীচে নেমে যাই। এখানে থাকব না। আমার খুব ভয় করছে!’ করবীর কথাগুলো কেমন আর্ত চিৎকারের মতো শোনাল।
‘নীলাঞ্জন, আর সময় নষ্ট করবেন না! এই তো সুযোগ! তাড়াতাড়ি করুন!’
নীলাঞ্জন কেমন বিহ্বল, যেন মন্ত্রচালিতের মতো করবীর দিকে হাত বাড়িয়ে ওকে কাছে টেনে নিল। তারপর ওকে জাপটে ধরে চাতালের কিনারের দিকে এগিয়ে চলল।
‘কী করছ! ওদিকে যাচ্ছ কেন? ছেড়ে দাও আমাকে!’ করবীর ভয়ার্ত কণ্ঠস্বর সমুদ্রের গর্জন ও হাওয়ার শনশনানি ছাপিয়েও শোনা গেলো। নীলাঞ্জন কিছু না বলে ওকে আরও শক্ত করে ধরে টানতে লাগল।
‘তোমার মনে এই ছিল! ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও বলছি!’ ছাড়া পাওয়ার জন্য করবীর ঝটপটানি বেড়ে গেল। ওদিকে নীলাঞ্জনও সর্বশক্তি দিয়ে করবীকে ঠেলে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করছে, কানের কাছে ফিসফিসানি চলছে – ‘আর একটু, নীলাঞ্জন! আর একটু! এরপরই মুক্তি! চিরজীবনের মতো!’
‘আ…আ…আ…!’ একটা তীব্র আর্তনাদ বেড়িয়ে এল করবীর গলা চিরে! রাতের আকাশ বাতাসে ছড়িয়ে গেল।
নীলাঞ্জনের খুব হালকা লাগছে। শরীরটা যেন পালকের মতো, ভেসে ভেসে বেড়াচ্ছে। মুক্তি! এটাই তো চেয়েছিল ও। কিন্তু ওটা কে পড়ে আছে, ওই পাথরের খাঁজে? কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে যায় নীলাঞ্জন। সামনে গিয়ে চমকে ওঠে – ‘এ কী! এ তো নীলাঞ্জনের থেঁতলে যাওয়া দেহ! তাহলে করবী? করবী বেঁচে আছে!’
‘কী যে করলেন, মশাই! সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি!’
‘মানে? আপনি কোথা থেকে?’ চমকে ওঠে নীলাঞ্জন।
‘আরে মশাই, আপনাকে এত করে বুঝিয়ে দিলাম, তবু শেষ মুহূর্তে সেই গোলমাল করলেন?’
‘আপনি কী বলছেন, কিছুই বুঝতে পারছি না।’
‘বোঝেননি? তাহলে শুনুন। আপনার মতোই কেসটা ছিল আমার। হুবহু এক। আমার স্ত্রী কাজলও ছিল দ্বিচারিণী, প্রমাণ পেয়েছিলাম হাতে নাতে। তাই এই প্ল্যানটা করি এখানে বেড়াতে এসে। কিন্তু শেষরক্ষা হল না। কাজলকে ঠেলতে গিয়ে অসতর্ক আমিই নীচে পড়ে যাই। তারপর থেকে এখানেই ঘুরে ঘুরে বেড়াই। বহুদিন বাদে আপনাকে পেয়ে মনে মনে খুব খুশি ছিলাম, যাক এবার একটা সফল হত্যাকাণ্ড ঘটাতে পারব। কিন্তু, কোথায় কী! আপনিও তো দেখি আমারই মতো…! যাক গে, সন্ধেবেলায় বিচে আসুন, দেখা যাক নতুন শিকার পাওয়া যায় কি না।’ বলেই ফিক করে হেসে হাওয়ায় ভেসে গেলাম আমি!
.
উস্রি দে
পেশায় ভারতসঞ্চার নিগম লিমিটেড এরফাইন্যান্স এক্সিকিউটিভ ছিলেন। নেশায় সাহিত্যচর্চা। ছোটবেলা থেকেই এ বিষয়ে আগ্রহ। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখালেখির শুরু। বাংলাদেশে ভারতীয় হাই কমিশনের থেকে প্রকাশিত ‘ভারতবিচিত্রা’ ও অন্যান্য লিটল ম্যাগাজিনে লেখা প্রকাশ পেয়েছে। পরবর্তীতে ‘দেশ’ পত্রিকায় কবিতা ও আনন্দবাজারের ‘রবিবাসরীয়’তে ছোটগল্প প্রকাশ পায়। বর্তমানে কিছু ওয়েবজিন-এ লেখা নিয়মিত প্রকাশ পাচ্ছে – যেমন ‘পরবাস’ (আমেরিকার নিউজার্সি থেকে প্রকাশিত), ‘সাময়িকী’ (নরওয়ে থেকে প্রকাশিত) ইত্যাদি।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন