একটি ত্রিভুজ প্রেমের গল্প ● অনন্যা দাশ

বিশ্বরূপ মজুমদার

একটি ত্রিভুজ প্রেমের গল্প – অনন্যা দাশ

রজতই প্রথম আমার সঙ্গে মেলানির পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল মিস্টার রথম্যানের ফেয়ারওয়েল পার্টিতে। আমার অদম্য কৌতূহল তাই আমি যেচে ‘হাই’ বলে ওদের কাছে গিয়ে পড়তে ও ইংরেজিতে বলেছিল, “মিট মেলানি। ও এখানে এক বছরের জন্যে রিসার্চ করতে এসেছে গ্রিস থেকে।”

আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে মেলানিকে দেখেছিলাম। নীল চোখ, ফর্সা টুকটুকে গাল, আর কুচকুচে কালো ঘন চুল। ডানা থাকলেই ওকে পরি বলে ডাকা যেত! কানাঘুষোতে শুনলাম মেলানি আর রজত নাকি লিভ টুগেদার করছে। রজত আমাদের সঙ্গে এক অফিসেই কাজ করে আর ওকে আমরা আড়ালে ক্যাসানোভা বলে ডাকি। ওর স্বভাব হল যে মেয়েকে দেখে সেই মেয়েরই প্রেমে পড়ে যায়। তা বলে মেলানির মতন মেয়ে কী বলে… আমার স্থির বিশ্বাস পার্টিতে যে ক’জন পুরুষ ছিল সবার মনেই ওই এক প্রশ্ন ছিল। ফেয়ারওয়েল পার্টি, যথেচ্ছ পানীয় তাই অভিজিৎ একটু বেশিই পান করে ফেলেছিল। সে আমাকে বলল, “আমি যা ভাবছি তুইও কী তাই ভাবছিস? মেলানির মতন মেয়ে কী বলে ওই ক্যাসানোভার সঙ্গে গিয়ে জুটল? জানিস আমি মায়াকে জিজ্ঞেস করেছিলাম ‘রজত তো না হয় ব্যাটা ক্যাসানোভা তাই সব মেয়েদের প্রেমে পড়ে কিন্তু মেয়েগুলো কীভাবে ওর প্রেমে পড়ে সেটা বুঝতে পারি না!’ তাই শুনে মায়া কী বলেছিল জানিস? বলেছিল, ‘রজতের একটা বিশেষ গুণ আছে। ও যখন কোনও একটা মেয়ের সঙ্গে মেলামেশা করে তখন মেয়েটার সঙ্গে এমন ব্যবহার করে যে তার মনে হয় সেই যেন পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মেয়ে। লাইক শি ইজ দি ওনলি গার্ল ইন দা ইউনিভার্স! সেই অনুভূতিটা মেয়েরা খুব পছন্দ করে তাই মেয়েগুলোও ওর সঙ্গ ছাড়তে চায় না!’ কী ধুরন্ধর ছেলে রে বাবা!”

অভিজিতের রজতের প্রতি কিছুটা রাগ আছে আমি জানি কারণ ওর স্ত্রী মায়া এক সময় রজতের গার্লফ্রেন্ড ছিল। অভিজিতের সঙ্গে বিয়ের পর অবশ্য সে স্বামী কন্যা নিয়ে ঘোরতর সংসারী তাও অভিজিতের রাগ যায় না। আমি কিছুক্ষণ রজত আর মেলানিকে লক্ষ করে দেখলাম মায়ার কথাটা সত্যি। রজত এক মুহূর্তের জন্যেও মেলানির সঙ্গ ছাড়েনি। ওর সঙ্গেই হাসিঠাট্টা গল্প করে চলেছে। পার্টিতে এত লোক তাও ওর ভাবখানা এমন যেন পৃথিবীতে মেলানি ছাড়া আর কেউ নেই! ওরা দেখলাম পার্টি শেষ হওয়ার আগেই বেরিয়ে গেল। তা যাক। তবে আমি জানতাম মেলানির সঙ্গে আমার আবার দেখা হবে কারণ ওরা তো লিভ টুগেদার করছে, আর রজত আমার দুটো বাড়ি পরেই থাকে।

হলও ঠিক তাই। কয়েকদিন পর আমি অফিস থেকে ফেরার সময় দেখলাম মেলানি ঠান্ডার মধ্যে বাইরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আমি এগিয়ে গিয়ে বললাম, “আরে এই ঠান্ডায় বাইরে দাঁড়িয়ে রয়েছ কেন? আমার এখানে এসে বসো। আমি রজতকে জানিয়ে দিচ্ছি। ও এসে পড়লে একটা ফোন করে দেবে না হয়।”

মেলানি হাত দুটো ঘসতে ঘসতে বলল, “বাঁচালে বাবা তুমি! কতবার বলেছি এক্সট্রা চাবিটা আমাকে দাও তা খুঁজে পেলে তো দেবে! কোথায় হারিয়ে ফেলেছে! এমনিতে ও চেষ্টা করে আমার আগেই চলে আসতে কিন্তু আজকে মনে হয় কাজ পড়ে গেছে।”

আমি জানি ওসব চাবি হারিয়ে যাওয়া বাজে কথা। রজত প্রথম দিকে একটা মেয়েকে চাবি দিয়েছিল তারপর তার সঙ্গে ব্রেকআপ হওয়ার পর দরজার চাবি বদল করতে হয়। সেটা ভালোই খরচ সাপেক্ষ, তাই এখন সে সাবধান হয়ে গেছে। কোনও মেয়েকে বাড়ির চাবি দেয় না। তা তাতে আমার কিছু ক্ষতি হয়নি। মেলানি বেশ মিশুকে মেয়ে দেখলাম। দিব্যি গল্প জুড়ে দিল আমার সঙ্গে। মোবাইলে ছবি দেখাতে লাগল নয়নাভিরাম গ্রিসের সমুদ্র সৈকতের।

মুক্ত কুচি ঝড়িয়ে হেসে বলল, “এখানকার শীতে যখন আমি বোর হয়ে যাই, মন খারাপ করে তখন আমি এই সব ছবিগুলো দেখে মনকে শান্ত করি। আমাদের ওখানে কী সুন্দর আবহাওয়া! এই একটা বছর কোনও রকমে টিকে আছি তারপর আমি পালাব!”

“আর রজতের কী হবে?”
“ওকে তো আমি বলছি আমার সঙ্গেই যেতে। ওখানেও এখন অনেক রকম কাজের সুযোগ হয়েছে। খুব আনন্দে থাকব আমরা।”

আমার মনে হয়নি রজত কখনও যাবে, তাও আমি কিছু বলিনি।

যাইহোক এর পর থেকে মেলানি প্রায়ই আমার এখানে আসত। কখনও খাবার নিয়ে, কখনও বা এমনি গল্প করতে বা চিনি ফুরিয়ে গেছে, কফি ফুরিয়ে গেছে বলে আমার কাছ থেকে ধার নিতে। রজতের ফিরতে দেরি হলেই ও এসে হাজির হত। কলকাতায় আমার এক প্রেমিকা আছে সেটা এখানে সবাই জানে। তবে সেই প্রেমিকার যে অন্য একজনের সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেছে এতদিনে সেটা আর কাউকে বলিনি। দরকার কী ওইসব বলার? সবাই একেবারে গ্যাদগ্যাদে সহানুভূতির চোখে দেখবে। তার চেয়ে এই বেশ ভালো। মানিব্যাগে আর মোবাইলের ওয়ালপেপারে অন্যের বউয়ের ছবি লাগিয়ে রেখেছি তাতেই কাজ হয়ে যায়। মেয়েরাও বেশ নির্দ্বিধায় আমার সঙ্গে মিশতে পারে। মেলানিও মনে করে আমার গার্লফ্রেন্ড কলকাতায় বসে। প্রায়ই আমাকে জিজ্ঞেস করে, “ঋতু কবে আসবে?”

আমি যে বানানো মিথ্যেটা সবাইকে বলি সেটা ওকেই বলি, “ও এখন পড়ছে। পড়া শেষ হলে তবে বিয়ে তারপর ও আসতে পারবে।”

শুনে মেলানি বলে, “উফ কী কষ্ট তোমাদের! আমি তো রজতকে ছেড়ে কিছুতেই এতদিন থাকতে পারব না!”

একটু আধটু গল্প হত এমনি করে আমাদের। মেলানিকে আমার ভালোই লাগত কিন্তু কোনওদিন ওকে বুঝতে দিইনি। ভাইয়ের মতন আচরণ করে গেছি। ও তো রজতের প্রেমিকা। কমপ্লিকেশান বাড়িয়ে লাভ কী?

ক্রমে শীত কেটে গিয়ে বসন্তের আগমন ঘটল। মেলানির আনন্দ তখন দ্যাখে কে। শীতকালটা যে ওর একদম ভালো লাগে না! ওর উৎসাহ দেখেই আমরা অফিস থেকে একটা পিকনিকের আয়োজন করে বসলাম। যে জায়গাটায় যাওয়া হল সেটা বেশ সুন্দর। শহর থেকে কিছুটা দূরে। জঙ্গল, পাহাড়, ঝরনা সব আছে। পাহাড়ি পথ ধরে হাইকিং করার ব্যবস্থাও রয়েছে।

দারুণ কাটল দিনটা। আমরা বেশ কিছুটা হাইকিং ট্রেকিং করলাম। পথে একটা গুহা পড়ল। সেখানে ভাল্লুক আছে বলে ভিতুদের ভয় পাওয়ানো হল! তারপর একজন বলল, “কেউ যদি ওই গুহায় ঢুকে বেরিয়ে আসতে পারে সাহস করে তাহলে তাকে আমি কুড়ি ডলার দিতে রাজি!”

মেলানি তাই শুনে বলল, “সত্যিই দেবে তো? মিথ্যে বলছ না তো?”

লোকটা বলল, “এই রাখলাম কুড়ি ডলারের নোট! পাঁচ মিনিট গুহার ভিতর ঢুকে দেখাও তো দেখি!”

ওমা মেলানি ঠিক ঢুকে গেল! আমি বেশ অবাক হলাম। মেয়েটার কোনও ভয় নেই নাকি! এখন শীত সবে কেটেছে, ভাল্লুকরা খাবার খোঁজে বেরিয়েছে সেই সব খবরেও বলছে তার মধ্যে মেয়েটা…

কিন্তু মেলানির কিছু হল না। মিনিট পাঁচেক পর সে বেরিয়ে এসে মিটিমিটি হেসে কুড়ি ডলারের নোটটাকে পকেটস্থ করল! পরে অবশ্য কথা দিল সবাইকে আইসক্রিম খাওয়াবে ওটা দিয়ে।

হাইকিং শেষ হওয়ার পর প্রচুর হই হুল্লোড়, অনেক খাবারদাবার, গান বাজনা হল। একেবারে ফাটাফাটি। মেলানি রজতকে খুশি করার জন্যে আমার কাছ থেকে কিছু বাংলা গানের ইউটিউব ভিডিয়ো নিয়েছিল তার থেকেই ‘মম চিত্তে’ গানটা তুলে ফেলেছিল সে। বেশ ভালোই গাইল। সবাই তো মোহিত তবে একটা ঘটনাতে আমার একটু খটকা লাগল। হয়তো কিছুই নয় আবার হয়তো অনেক কিছুই। রজতদের ডিপার্টমেন্টে মুম্বাই থেকে একটা মেয়ে এসেছে। সে ‘ঢোলিদা’ গানটা চালিয়ে দিয়ে ধুম নাচ নাচল। মেয়েটাকে দেখতে বেশ ভালো আর নাচছিল বেড়ে তাই আমার কেন জানি না মনে হল রজত আর চোখ ফেরাতে পারছে না। ফেরার পথে বাসে মেয়েটা সুট করে রজতের পাশে গিয়েই বসে পড়ল। রজতও তাকে কিছু বলল না। দিব্যি গল্প করছিল তারপর মেলানি উঠে এসে মেয়েটাকে তাড়িয়ে রজতের পাশে বসল। রজতকে আমি চিনি বলেই অশনি সঙ্কেতের আভাস পেলাম। কেন জানি না মনটা খারাপ হয়ে গেল এত আনন্দের একটা দিনের পরও।

|| ২ ||

যা ভেবেছিলাম সেটা সত্যি হতে বেশিদিন লাগল না। পিকনিকের সপ্তাদুয়েক পর একদিন অফিস থেকে ফিরে চা বসিয়েছি এমন সময় দরজায় টোকা। ওই টোকাটা কার আমি জানি। মেলানিই ওইরকম টোকা দেয়, বেল বাজায় না কখনও। আমি গিয়ে দরজা খুলে ওকে দেখে চমকে উঠলাম। কী চেহারা হয়েছে মেলানির! চুল অবিন্যস্ত, চোখ মুখ কেঁদে কেটে ফুলে ঢোল! একেবারে অন্যরকম লাগছে ওকে। সঙ্গে আবার একটা সুটকেস।

আমি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কী হয়েছে?”

মেলানি সাপের মতন হিসহিস করে বলল, “ওই মেয়েটা! যে মেয়েটা পিকনিকে নাচল আর তারপর এসে রজতের পাশে বসেছিল সেই মেয়েটার প্রেমে নাকি পড়েছে রজত! আমাকে ওর আর ভালো লাগছে না!”

আমি বললাম, “কে? আভা?”

“হ্যাঁ! সেই!”
“তা তুমি কোথায় চললে?”
“আমার এক বান্ধবী আছে তার সঙ্গে থাকতে। আমার আর ক’টা মাস বাকি প্রোজেক্টের তারপর আমি গ্রিসে ফিরে যাব।”
“ও!” আমি আর কী বলব ভেবে পেলাম না।

মেলানি আবার কাঁদতে শুরু করে দিয়েছে দেখে আমি বললাম, “দ্যাখো আমি রজতের সঙ্গে কথা বলে দেখতে পারি…”

“কোনও লাভ হবে না। আমি অনেকের সঙ্গে কথা বলেছি। রজত নাকি বরাবরই ওইরকম, কোনও একটা মেয়ের সঙ্গে বেশিদিন থাকে না। তুমিও নিশ্চয়ই জানো ব্যাপারটা, সবাই তো জানে!”

আমি মাথা নাড়লাম, “হ্যাঁ, জানি কিন্তু ভেবেছিলাম তোমার ব্যাপারটা অন্যরকম হবে…”

মেলানি বলল, “আমিও তো সেই একই কথা ভেবে বসেছিলাম… খুব বোকা ছিলাম…”

এরপর চা আর বিস্কুট খেয়ে মেলানি বলল, “এবার আমি যাই। রজতের সঙ্গে আর দেখা করতে চাই না।”

হাত ধুয়ে সুটকেস নিয়ে দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল মেলানি। আমি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রইলাম।

দু’পা গিয়ে পিছন ফিরে মেলানি হঠাৎ বলল, “রজতের সঙ্গে দেখে হলে একটা কথা ওকে বলে দিও যে আমি কিন্তু এই অপমানের বদলা নেব!” ওর নীল চোখে কীসের একটা ঝিলিক খেলে মিলিয়ে গেল। সেই চাহনি আমি কোনওদিনও ভুলব না। অসম্ভব কঠিন সে চাহনি।

পরদিনই রজতের সঙ্গে দেখা হতে ওকে বললাম, “কাজটা কিন্তু তুই ঠিক করিসনি রজত! মেয়েটা ভালো ছিল!”

রজত খ্যাক খ্যাক করে হেসে বলল, “তোর খুব দরদ উথলে উঠছে মনে হচ্ছে তা তুই-ই রেখে নিতে পারতিস! বিলিতি মাল খারাপ হবে কেন?”

আমি বিরক্ত হয়ে সেখান থেকে সরে গেলাম। কী অসভ্য ছেলে রে বাবা!

|| ৩ ||

কিছুদিনের মধ্যেই আভা তার দুটো বিড়াল নিয়ে রজতের বাড়িতে এসে থাকতে শুরু করল। আভা মেয়েটাকে আমার একদম পছন্দ হল না। হয়তো মেলানিকে ভালো লাগত বলে আমি ওর দুঃখে কাতর হয়ে পড়েছিলাম তবে আরেকটা কারণ হল আভা মেয়েটা অসম্ভব নেকি। ওইরকম নেকি মেয়েদের আমার পছন্দ হয় না। অথচ রজতের মতন অনেক ছেলেরাই ওইরকম নেকা নেকা আচরণ উপভোগ করে দেখেছি। যাইহোক সপ্তাখানেক পরে একদিন রজত অফিসে আসতে বেশ দেরি করল।

ওর একটা কাজ করার কথা ছিল যেটার জন্যে আমি অপেক্ষা করছিলাম। ও আসতে তাই আমি ওর কিউবিকালে গিয়ে বললাম, “কি রে ওই কাজটা আজকে হবে তো? তুই তোর অংশটা করলে তবে আমি হাত দিতে পারব। তোর আজ এত দেরি হল যে?”

রজত চুলগুলোকে আঙুল দিয়ে ঘসতে ঘসতে বলল, “আর বলিস না। আজ সকাল থেকে আভার একটা বেড়ালকে পাওয়া যাচ্ছে না। সে মাঝে মাঝে পিছনের দরজাটা দিয়ে বেরিয়ে যায় তবে আবার ফিরে আসে। এই রকম আগেও দু’দিন হয়েছে। কাল রাতেও মনে হয় কোনও এক সময় বেরিয়ে গিয়েছিল তারপর আর ফেরেনি। আভা তো শুনবে না। সারা সকাল ধরে আমাকে পাড়াময় ঘুরে ঘুরে বেড়ালের খোঁজ করতে হল কিন্তু কোনও লাভ হল না। ব্যাটা কোথায় পালিয়েছে কে জানে। বা কেউ ধরে নিয়েছে। যাই হোক, হ্যাঁ, কাজটা এবার ধরছি তিনটে নাগাদ তোকে দিয়ে দেব।”

সেদিন বিকেলে বাড়ি ফেরার পথে আভাকে দেখতে পেলাম। ওকে জিজ্ঞেস করলাম, “কী বেড়ালটাকে পাওয়া গেল?”

সে হিন্দিতে বলল, “না, পাওয়া যায়নি। কী হল কে জানে। অ্যাক্সিডেন্ট কিছু হলে তো জানা যেত সেইরকম কিছুই হয়নি।”

তারপর হঠাৎ বলল, “আচ্ছা আজকে আমি হোয়াটসঅ্যাপে একটা অদ্ভুত ছবি পেয়েছি। রজতকে জিজ্ঞেস করলাম কিন্তু ও বলল ও কিছু জানে না। দাঁড়াও তোমাকে দেখাচ্ছি। তুমি জানো এটা কী?”

বলে ফোনটা বার করে আমাকে ছবিটা দেখাল।

আমি ছবিটা দেখে একটু চমকেই উঠলাম, একটা ভয়ঙ্কর মুখের ছবি, লম্বা দাঁত, মাথায় মুকুট। কোনও মিউজিয়ামে বা কোথায় রাখা আছে মনে হল। কিছু অংশ ভাঙা। ছবিটাকে দেখে আমার মনে হল কোথায় যেন দেখেছি কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারলাম না কোথায়।

সেদিন রাতে কীসের একটা খুট খুট শব্দে আমার ঘুমটা ভেঙে গেল। আমার সারা হাত পা যেন পাথর হয়ে গেছে। আমি বিছানা থেকে নড়তেই পারছি না। হাত বাড়িতে যে আলো জ্বালাব সেই ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেছি। ওমা ঘরের কোণে অন্ধকারে ওটা কী? কী একটা নড়ছে, না, কে একজন এগিয়ে আসছে আমার দিকে। জ্বলন্ত দৃষ্টি দিয়ে এক জোড়া চোখ আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে! একটা ঠান্ডা প্রবাহ, একটা বিশ্রী আঁশটে গন্ধ! হঠাৎ মনে হল আমার বুকের গাদা গাদা হিসহিসে সাপ! প্রচণ্ড ভয়ে আমার দম আটকে আসতে লাগল। আমি জ্ঞান হারালাম।

সকালে যখন ঘুম ভাঙল তখন দেখলাম আমার গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। জ্বর কমানোর বড়ি খেয়ে শুয়ে পড়লাম। অফিসে বলে দিলাম যেতে পারব না। রাতের ব্যাপারটা জ্বরের ঘোরের স্বপ্নই হবে।

তিনদিন পর রবিবার সকাল এগারোটা নাগাদ দরজায় বেল। আমি তখন সবে ঘুম থেকে উঠে চা করে খাচ্ছি আর নেটে দেশের নিউজগুলোতে চোখ বোলাচ্ছি। দরজা খুলে দেখি রজত আর আভা।

“কী ব্যাপার?”
“আর বলিস না। অন্য বেড়াল ম্যাক্সকেও পাওয়া যাচ্ছে না। আভা তো কেঁদে কেঁদে অবস্থা খারাপ করে ফেলছে। তুই কিছু সাহায্য করতে পারবি?”
“কী করতে হবে বল?”
“একটু এদিক ওদিক খুঁজে দেখা আর কী।”

আমি রাজি হলাম।

আভা বলল, “আরেকটা ছবি এসেছে আমার ফোনে। এটাকে চিনতে পারছ কী?”

বলে ফোনটা এগিয়ে দিল। এই ছবিটাকে আমি বিলক্ষণ চিনি, মুখ হাঁ করা একটা মেয়ের মুখ। মাথায় চুলের বদলে সাপ, কালো কুচকুচে চোখগুলো আগুনের মতন জ্বলছে। সাপ! এই সাপই স্বপ্নে দেখেছিলাম আমি, স্বপ্ন না সত্যি?

আমার বুক ঢিপঢিপ করছিল, কোনও রকমে বললাম, “আরে এটা তো মেডুসা!”

আভা বলল, “মেডুসা আবার কে?”

আমি বললাম, “মেডুসা গর্গন সিস্টারদের একজন। এক মিনিট!” বলে ট্যাবলেটে উইকিপিডিয়ার পাতাটা খুলে ওদের দেখালাম। সেখানেই দেখতে পেলাম আগের ছবিটাও। আজকের ছবিটা কারাভাজিও বলে একজন শিল্পীর আঁকা সেই ১৫৯৫ সালে।

গর্গনদের নিয়ে সব চেয়ে প্রচলিত গল্পটাই ওদের বললাম। সমুদ্রের দেবতা কিটো আর ফরসিসের তিন মেয়ে ছিল স্থেনো, ইউরিয়েল আর মেডুসা। তারা ছিল খুব সুন্দরী কিন্তু খুব গর্ব ছিল তাদের। সেই গর্বের জন্যেই তাদের শাপ দিয়ে বীভৎস দানবে পরিণত করা হয়েছিল। মেডুসার ছিল খুব সুন্দর সোনালি চুল আর সেই চুলের জন্যেই তার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন পোসেইডন এবং অ্যাথিনার মন্দিরেই তাঁরা মিলিত হল। অ্যাথিনা তাই রেগে গিয়ে মেডুসার চুলগুলোকে সাপে পরিণত করে দেন। স্থেনো আর ইউরিয়েল ছিল অমর কিন্তু মেডুসা অমরত্বের বর পায়নি। গর্গনরা ছিল এতটাই ভয়ানক যে কোনও মানুষ বা জন্তু এদের চোখের দিকে তাকালেই পাথরের মূর্তিতে পরিণত হয়ে যেত। পারসিয়াসকে রাজা পলিডেকটাস গর্গনের মাথাটা কেটে আনতে বলেছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন পার্সিয়াস পারবে না আর উনি ওর মা ড্যানিকে বিয়ে করবেন। দেবতা হার্মেসের কাছে ধারাল তলোয়ার আর অ্যাথিনার কাছে আয়না দেওয়া ঢালের সাহায্যে পার্সিয়াস মেডুসাকে হত্যা করে তার মাথাটা কেটে নিয়ে এসে পলিডেকটাসকে দেখায়। সেই মাথা তখনও কাজ করেছে তাই পলিডেকটাসও পাথর হয়ে যায়। এর পর মেডুসার মাথাটার কী হল সে নিয়ে কয়েকটা গল্প আছে। কেউ কেউ মনে করেন সেটা পার্সিয়াস অ্যাথিনাকে দিয়ে দিয়েছিল, তিনি সেটাকে একটা ঢালের উপর লাগিয়ে জিউসকে উপহার দিয়ে দেন। অন্য আরেক সূত্রে বলা হয় যে পার্সিয়াস মেডুসার সাপ দেওয়া মুণ্ডুটা আর্গোসের এক ব্যস্ত বাজার এলাকায় মাটি খুঁড়ে মাটির নীচে পুঁতে দেয়।

আভা সব শুনে বলল, “সবই তো বুঝলাম কিন্তু এই ছবি আমাকে কেন পাঠানো হয়েছে?”

আমি কিছুটা আন্দাজ করছিলাম কিন্তু কিছু বললাম না। আমার মাথায় তখন দুটো জ্বলন্ত নীল চোখ ঘুরছে।

রজত হঠাৎ বলল, “কোথাকার গল্প এটা? মানে কোন দেশের?”

আমি অস্ফুট স্বরে বললাম, “গ্রিস!”

রজত এবার তড়াক করে উঠে দাঁড়াল, “বুঝতে পেরেছি! এটা মেলানির কাজ! সেই এই সব করে আভাকে ভয় দেখাবার চেষ্টা করছে! আমি এখুনি গিয়ে পুলিশে রিপোর্ট লেখাচ্ছি! মেয়েটা ভেবেছে কী নিজেকে? ওই সব মাইথলজির ছবি দিয়ে আমাদের ভয় দেখাবে! চলো আভা!”

আমি বলতে চেষ্টা করলাম, “না মানে গর্গনের গল্প রোমান মাইথলজিতেও আছে… পুলিশের ঝামেলা…”

রজত বলল, “আরে আমি মেলানিকে খুব চিনি! হাড় বজ্জাত মেয়ে! আভাকে ভয় পাওয়ানোর জন্যে এই সব স্কিম করেছে! আমি আইন কানুন নিজের হাতে নিতে চাই না। পুলিশই ওকে উপযুক্ত শাস্তি দেবে!”

রজত আভাকে নিয়ে চলে গেল। আমার একটু ভয়ই হচ্ছিল মেলানির জন্যে। ওর ফোন নম্বরটা আমার কাছে ছিল। আমি তাই ওর নম্বরে একটা ফোন করলাম ওকে ব্যাপারটা জানিয়ে দেওয়ার জন্যে। কিন্তু মেলানি ফোন ধরল না। আমি একটা মেসেজ ছেড়ে দিলাম আমাকে ফোন করার জন্যে।

দু’দিন পর রজত অফিসে এল না। ফেরার পথে তাই ওদের বাড়িতে ঢুঁ মারলাম। আমি ভেবেছিলাম ও হয়তো অসুস্থ কিন্তু ওর বাড়িতে গিয়ে যেটা শুনলাম তাতে বেশ ঘাবড়েই গেলাম। আভা জানত না যে রজত অফিসে যায়নি। আভা নিজে কিছুদিন হল ওয়ার্ক ফ্রম হোম করছে।

আমার কাছে শুনে সেও বেশ চিন্তিত হয়ে রজতের মোবাইলে ফোন করল কিন্তু কলটা মেসেজে গেল।

আভা বলল, “আজ সকালে পুলিশ স্টেশন থেকে ফোন এসেছিল। কী একটা ব্যাপারে ওরা রজতকে ডেকেছিল ওই কালকের রিপোর্টের জন্যে। রজত আমাকে বলেছিল ও পুলিশ স্টেশন হয়ে অফিসে চলে যাবে কিন্তু তাহলে ও কোথায়? আমাদের গত তিন রাত ধরে ঘুম হচ্ছে না। বাড়িতে খুটখাট শব্দ শুনতে পাই। মনে হয় ঘাড়ের ওপর কার যেন নিঃশ্বাস। ঘরটা অস্বাভাবিক ঠান্ডা হয়ে যায়, বিকট গন্ধ। অথচ দু’জনের কেউ যে উঠে আলো জ্বালিয়ে দেখব সেটাও পারি না। শরীর যেন পাথর হয়ে গেছে এমন মনে হচ্ছিল। কী হচ্ছে কিচ্ছু বুঝতে পারছিলাম না।”

আমি বুঝলাম আমার যা হয়েছিল রজত আর আভারও তাই হয়েছে।

|| ৪ ||

আমি আর আভা পুলিশ স্টেশনে গিয়ে খোঁজ নিয়েছিলাম সেদিন। পুলিশ বলেছিল রজত ওদের সঙ্গে দেখা করেছিল সকালে। মেলানি নাকি গ্রিসে ফিরে গেছে এক সপ্তা আগে সেটাই ওরা রজতকে জানিয়েছিল। সেটা শুনে আমি কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়েছিলাম, যে যাক বাবা মেলানির তাহলে কোনও হাত নেই বেড়ালের হারিয়ে যাওয়ার সঙ্গে। আর ছবি যদি পাঠিয়েও থাকে তাহলে কী-ই বা এসে যায়? বাকি সব মনে হয় আমাদের কল্পনার ফল।

কিন্তু রজতকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। অদ্ভুতভাবে নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিল ছেলেটা!

এর পরের ঘটনাটা ভাবলে আমার গায়ে এখনও কাঁটা দেয়, হাত পা অবশ হয়ে পড়ে। কাউকে বলতে পারিনি আমি, কিন্তু মনে ভাবি আর শিউরে উঠি।

এ বছরের পিকনিকটাও ওই একই জায়গায় হল, জায়গাটা সবার খুব ভালো লেগে গিয়েছিল বলে। এবারেও গতবারের মতন একজন হাইকের সময় গুহাতে ঢোকার জন্যে কুড়ি ডলার বাজি রাখল। পিকনিকের কয়েকদিন আগেই এই এলাকাতে ভাল্লুক বেরিয়েছে বলে খবর বেরিয়েছিল তাই কেউ খুব একটা সাহস করছিল না। আমার কেবল গতবার মেলানির গুহায় ঢোকার কথাটা মনে পড়ছিল, মেয়েটা যদি সাহস করে ঢুকতে পারে তাহলে আমি পারব না কেন ভেবে আমি যা থাকে কপালে বলে গুহার ভিতরে ঢুকে পড়লাম।

পাঁচ মিনিট থাকতে হবে ভেবে একটু এগিয়ে গেলাম। কিছুটা গিয়েই দেখি আরেকটা গুহা মুখ। সেখানে হোঁচট খেলাম বলে পকেটের মিনি টর্চটা বার করে জ্বলালাম। যা দেখলাম তা আমি জীবনে ভুলব না। সেদিন কোনও রকমে গুহা থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম। বাইরে এসেই নাকি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম আমি। সবাই ভেবেছিল ভাল্লুক দেখেছি। আমার মুখে জল টল দিয়েছিল ওরা তারপর সবাই পালিয়েছিলাম ওই জায়গাটা থেকে।

ইদানীং আমার মনের অবস্থা বিশেষ ভালো নয়। শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। কোম্পানিতে বলে দেশে ফিরে যাওয়ার জন্যে দরখাস্ত করেছি। এখন দিন গুনছি। আসলে সেদিন পিকনিকে আমি সবাইকে ভাবতে দিয়েছিলাম যে গুহার ভিতরে আমি ভাল্লুক দেখেছি কিন্তু আমি তো ভাল্লুক দেখিনি। আমি দেখেছিলাম তিনটে পাথরের মূর্তি, দুটো বেড়াল আর একটা মানুষ।

.

অনন্যা দাশ

বাংলা সাহিত্যে একটি উল্লেখযোগ্য নাম। ছোটবেলা কেটেছে জয়পুর শহরে। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভেনিয়া নিবাসী এবং পেন স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত। ইংরাজি ও হিন্দি ভাষায় সৃজনশীল রচনার সঙ্গে বাংলা থেকে অনুবাদও করেন। শিশু-কিশোরদের জন্যে লেখা গল্প এবং উপন্যাস কলকাতার প্রায় সব নামকরা পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। ‘ইন্দ্রজালের নেপথ্যে’, ‘মার্কিন মুলুকে নিরুদ্দেশ’, ‘রুজভেল্টের পাণ্ডুলিপি’, ‘ফুলের দেশের বিভীষিকা’, ‘হিরের চেয়ে দামি’, ‘মৎসকন্যার অভিশাপ’, ত্রি-তীর্থঙ্করের অন্তর্ধান’, ‘উত্তরাধিকার এবং’ তাঁর বিখ্যাত কিছু বই।

অধ্যায় ১ / ১২

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন