বিশ্বরূপ মজুমদার
মেঘটা সেই সন্ধে থেকেই করেছিল, কেমন একটা গুমসানি ভাব চারদিকে। অবশেষে বৃষ্টিটা নামল, বেশ বড় বড় ফোঁটায়। টেবিলে কিছু দরকারি কাগজপত্র নিয়ে বসেছিল সৌমেন। ঘাড় ঘুরিয়ে দেওয়াল ঘড়িতে সময়টা দ্যাখে, দশটা চুয়াল্লিশ। ন’টা বাইশের ট্রেনটায় ফেরার কথা ছিল দোয়েলের। ওটাই শেষ ট্রেন, এরপর শিলিগুড়ি থেকে ফেরার শেষ ট্রেন। তা সে ট্রেনও তো বহুক্ষণ চলে গেছে। এরপর ফিরতে গেলে ট্রেকার ভাড়া করতে ফিরতে হয়। সন্ধের পর আবার ট্রেকার নিয়ে কেউ এদিকে আসতে চায় না। নাহ্ আর ধৈর্য্য ধরতে পারছে না সৌমেন। সেই সন্ধে থেকে দোয়েলের মোবাইলে সমানে চেষ্টা করে যাচ্ছে, প্রতিবার সেই এক উত্তর, নট রিচেবল্। কী যে হল কিছুই বুঝতে পারছে না। কী করবে সিদ্ধান্তটুকুও নিতে পারছে না সৌমেন। ধুত্তারি, মোবাইলটাতেও চার্জটা শেষ হয়ে গেল। মোবাইলটা চার্জে বসাতে গিয়ে খেয়াল করে রজনীগন্ধার ফুল ক’টা টেবিলেই পড়ে আছে। দোয়েল রজনীগন্ধা ভালোবাসে বলে, একজনকে দিয়ে শহর থেকে আনিয়েছিল। স্কুল থেকে ফেরার সময় নিয়ে এসেছিল সৌমেন। কিন্তু স্কুল থেকে ফিরতেই দ্যাখে দরজায় তালা। ফোন করতে যাবে, তখনই একটা বাচ্চা ছেলে এসে চাবিটা দিয়ে যায় সৌমেনের হাতে। কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই ছুটে পালায় ছেলেটা। মাস্টারমশাই বলে নাকি ওদের সঙ্গে ঠিকমতো মিশতে পারে না বলে কে জানে, সৌমেনের সঙ্গে এখানকার মানুষজনের তেমন সখ্যতা নেই। অথচ মাত্র দু’বছরেই দোয়েলের সঙ্গে সবার মেলামেশা আছে।
এখানকার বেশিরভাগ মানুষ-ই নিচুশ্রেণির, কাছাকাছি চা-বাগানগুলোতে খেটে খাওয়া মানুষ। শিক্ষা বা সভ্যতার আলো এখনও সেভাবে এসে পৌঁছায়নি এখানে। কপালদোষে এখানকার একটা প্রাইমারি স্কুলেই সাতবছর চাকরি করছে সৌমেন। বাপ-মা মরা, আত্মীয়স্বজনের দয়াতে বড় হয়ে ওঠা সৌমেনের অবশ্য তেমন কোনও অসুবিধাই হয় না এখানে। একলা নিরিবিলিতে দিব্যি ছিল। কিন্তু শহরে বড় হওয়া মা-বাবার আদরের মেয়ে দোয়েল এখানে এসে থাকতে পারবে, ভাবতেও পারেনি সৌমেন। শুধু থাকাই নয়, এখানকার মানুষগুলোর সঙ্গে এমনভাবে মিশে গেছে যে এরা তো ‘শহরের দিদিমণি’ বলতে অজ্ঞান।
তালা খুলে বাড়িতে ঢোকে সৌমেন। বাড়ি বলতে টিনের চালের দু’-কামরার একটু মাথা গোঁজার ঠাঁই। এখানে বাড়ি ভাড়া পাওয়ার মতো বাড়িই নেই। এটুকুই যে পেয়েছে সেই অনেক। ঘরে ঢুকে দেখেছিল টেবিলের খাবার-জল সব ঢাকা দেওয়া আছে। খিদেও পেয়েছিল বেশ। খেয়ে নিয়ে দোয়েলকে ফোন করেছিল সৌমেন। মংলুর বউকে নিয়ে শিলিগুড়ি গেছে ডাক্তার দেখাতে। খুব ভিড় ডাক্তারখানায়, ফিরতে দেরি হলে চিন্তা না করতে বলেছিল। ন’টা বাইশের ট্রেনে ফিরবে বলেছিল। স্টেশনে আনতে যাবে কিনা জিজ্ঞাসা করতেই ফোনের ও-প্রান্তে খিলখিল করে হেসে উঠেছিল দোয়েল, তোমার বউকে ভূতেও ছোঁবে না মশাই।
কিছুদিন আগে দোয়েলের মুখেই শুনেছিল, মংলুর বউটা নাকি খুব অসুস্থ। দিন দিন কেমন যেন দুর্বল হয়ে পড়ছে। অথচ এখানকার মানুষজনের ধারণা, ওকে জিনে ধরেছে। কিছুদিন আগে চা-বাগানের এক বুড়ি শ্রমিক পাহাড়ের খাদে পড়ে মারা গেছে। সেই বুড়িই নাকি এসে চেপেছে মংলুর বউয়ের ঘাড়ে। ওঝা-তাবিচ-কবজ-ঝাড়ফুঁক চলছে পুরোদমে, আর বউটা সুস্থ হওয়ার বদলে আরও নেতিয়ে পড়ছে দিনে দিনে। এখনকার দিনেও এইসব বিশ্বাসের কথা শুনে বেশ লম্বাচওড়া দু’-চারটে কথা বলেছিল সৌমেন। তারপর ভুলেই গিয়েছিল ব্যাপারটা। দোয়েল ভোলেনি। এতগুলো মানুষের অন্ধবিশ্বাসের বিরুদ্ধে গিয়েও বউটাকে শহরে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে গেছে। সত্যি দোয়েলের জন্য মাঝে মাঝে ভীষণ গর্ব হয় সৌমেনের।
টেবিলে বসে এত চিন্তার মধ্যেও, এটা-সেটা ভাবতে ভাবতে কখন যেন চোখটা এঁটে এসেছিল সৌমেনের। এক্সপ্রেস একটা ট্রেন আসার আওয়াজে ঘুমটা ভেঙে যায়। স্টেশনটা খুব কাছে হওয়াতে ট্রেনের আসা-যাওয়াটা ঘর থেকেই দিব্যি বোঝা যায়। এক্সপ্রেস ট্রেন তো থামে না এই স্টেশনে, আজ যেন থামল মনে হচ্ছে ট্রেনটা। ঠিক তখনই ভীষণ যেন আলোর রেখা খেলে যায় সারা আকাশ জুড়ে আর কী ভীষণ মেঘের আওয়াজ। দু’হাতে কান চেপে ধরে সৌমেন। কারেন্টটা চলে গেল সঙ্গে সঙ্গে। কাছাকাছি কোথাও বাজ পড়ল নিশ্চয়ই। এক্সপ্রেস ট্রেনটা জোর হুইশিল দিয়ে ছেড়ে যাচ্ছে স্টেশন থেকে। তবু হঠাৎ বুকের মধ্যেটা কেমন যেন করে ওঠে সৌমেনের।
সেদিন স্কুল থেকে এসেই দ্যাখে মৈনাক দাঁড়িয়ে আছে বাড়ির সামনে। সৌমেনের ছোটবেলার বন্ধু, সেই প্রাইমারি স্কুল থেকে কলেজ অবধি একসঙ্গে পড়াশুনো। পড়াশুনো শেষের পরেও চাকরিসূত্রে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলেও, বন্ধুত্বটুকু থেকেই গিয়েছিল। সাইকেল থেকে নেমেই মৈনাককে বুকে জড়িয়ে ধরেছিল সৌমেন। সারা সন্ধে কত গল্প — কত আড্ডা দু’জনে। সৌমেনের অগোছালো ঘরটাকে সুন্দর করে নিজে হাতে গুছিয়ে দিয়েছিল মৈনাক। দোয়েলের বাড়ির লোক সৌমেনের সঙ্গে ওর সম্পর্কটা মেনে নিতে চায়নি। মিলিটারিতে চাকরি করা এক ছেলের সঙ্গে ওর বিয়ে ঠিক করছে। দোয়েল রাজি নয়। সৌমেনকে ছাড়া সে কাউকে বিয়ে করবে না। বাড়ি থেকে পালিয়ে আসবে দোয়েল কাল সকালে। নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে সৌমেন ধরে নেবে ওকে। তারপর শুরু হবে দু’জনের একসঙ্গে পথচলা। এমন দিনে প্রিয়বন্ধুকে সঙ্গে পেয়ে মনে বেশ ভরসা পাচ্ছে সৌমেন। সন্ধে থেকে কারেন্ট নেই, মোমবাতিতে আর কতক্ষণ চলে। তাই একটু তাড়াতাড়িই রাতের খাওয়া সেরে নিয়েছিল দুই বন্ধুতে। বাইরে বৃষ্টি পড়ছে মুষলধারে। জানলার কাছে দাঁড়িয়েছিল মৈনাক। হঠাৎ কেমন যেন উদাস উদাস লাগছিল ওকে। নিজেই বলেছিল, ‘জানিস আমারও বিয়ের কথাবার্তা চলছে।’ এটুকু শুনেই লাফিয়ে উঠেছিল সৌমেন। ‘আরে কোথায়? কবে? কার সঙ্গে?’ একসঙ্গে একগাদা প্রশ্ন। মৈনাক কেমন যেন নির্লিপ্ত ভাবে বলল, ‘কিন্তু বিয়েটা হবে না রে।’
‘কেন রে?’
কেমন অদ্ভুত ভাবে সৌমেনের চোখের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, ‘ও তো তোকে ভালোবাসে…’
ব্যাপারটা বুঝে ওঠার আগেই এক ঝটকায় দরজা খুলে অন্ধকারে বৃষ্টির মধ্যেই বেরিয়ে পড়েছিল মৈনাক। কিছু না বুঝেই পিছন পিছন কোথায় যাচ্ছিস, কোথায় যাচ্ছিস করে বেরিয়ে পড়েছিল সৌমেনও। উফ্ এত জোরে হাঁটছে মৈনাক, কিছুতেই ধরতে পারছে না ওকে। দূর থেকেই বলে চলেছে, এখন কোনও ট্রেন নেই স্টেশনে যাচ্ছিস কেন? তখনই রেললাইনে একটা জোরালো আলো আর ট্রেনের আওয়াজ। এই স্টেশনে এক্সপ্রেস ট্রেন থামে না, কিন্তু সেদিন থেমেছিল। মৈনাক ট্রেনে উঠতেই ছেড়ে দিয়েছিল ট্রেনটা। চলন্ত ট্রেনের জানলা থেকে জোর গলায় বলেছিল, দোয়েলকে ভালো রাখিস। সেই রাতে কেন যে ওভাবে চলে গেছিল মৈনাক, কিছুই বুঝতে পারেনি সৌমেন। তবে দোয়েলের বাড়ির লোক যে মৈনাকের সঙ্গেই ওর বিয়ের ঠিক করেছিল সেটা পরিষ্কার। কিছুদিন পরে এক বন্ধুর কাছে শুনেছিল, মৈনাকের তখন লাদাখে পোস্টিং ছিল। বিয়ের পাকা কথা বলতে নাকি বাড়ি এসেছিল। বাড়ি থেকে লাদাখে ফেরার পথে ট্রেন অ্যাক্সিডেন্টে মৈনাক নাকি মারা গেছে। প্রিয়বন্ধুর না থাকাটাতে খুব কষ্ট পেয়েছিল সৌমেন। তারিখটা জানতে চেয়েছিল সেই বন্ধুর কাছে, সঠিক বলতে পারেনি সে। পুরনো পেপারেও খুঁজে পেতে চেষ্টা করেছিল রেল অ্যাক্সিডেন্টের খবরটা, খুঁজেও পেয়েছিল, ২১শে জুলাই ২০১৪-র পেপারে। অলৌকিক ঘটনা বিশ্বাস করে না সৌমেন, পুরোটাই কাকতালীয় ভেবে উড়িয়ে দিয়েছিল। তবে দোয়েলকে কখনও বলেনি সেই রাতের কথা। আজ হঠাৎ কেমন যেন…
দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজে চমকে ওঠে সৌমেন। এখন কে ডাকছে! বাইরে দোয়েলের গলা পেয়ে তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দেয়। পুরো ভিজে গেছে। ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলে চলেছে, “মংলুর বউটাকে ওদের ঘরে দিয়ে এলাম একবারে। জিন-ফিন ওইসব কিস্সু নয়, অ্যাকিউট অ্যানিমিয়া আন্দাজ করছেন ডাক্তারবাবু। রক্তপরীক্ষা করতে দিয়ে এসেছি কাল রিপোর্ট দেবে।”
একটু রাগ রাগ করেই জানতে চায় সৌমেন, “তা এত রাতে এলে কী করে?”
“আর বোলো না আজ উনি না থাকলে যে কী করে আসতাম কে জানে। স্টেশনে যখন পৌঁছলাম, শেষ ট্রেন ছেড়ে চলে গেছে। কী করব ভাবছি, তখনই ওনার সঙ্গে দেখা। উনি নাকি এখানেই আসছেন, তোমার কাছে। উনি বললেন, আজ নাকি এক্সপ্রেস ট্রেনও সব স্টেশনে থামবে।”
অধৈর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করে সৌমেন, “আরে উনিটা কে, সেটা তো বলো।”
মাথাটা তোয়ালেতে মুছতে মুছতে জবাব দেয় দোয়েল, “তোমার প্রাণের বন্ধু মৈনাক। আর বোলো না আমি তো প্রথমে চিনতেই পারিনি। তারপর উনি পরিচয় দিতে মনে পড়ল ওঁর ছবি তো তোমার অ্যালবামে কত দেখেছি।”
হাসি হাসি মুখে দরজা খুলে দোয়েল কাকে যেন ডাকতে যায়। “কী হল, আর কতক্ষণ লুকিয়ে থাকবেন, এবার ভেতরে আসুন।”
ততক্ষণে হাত-পা ঠান্ডা হতে শুরু করেছে সৌমেনের। সব যেন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।
বাইরে কেউ নেই। হ্যারিকেন নিয়ে বাইরে বেরিয়েও কাউকে দেখতে পায় না ওরা। দোয়েল সমানে বলে চলেছে, “তুমি বিশ্বাস করো উনি আমার সঙ্গে এসেছেন। আমাদের বাড়িই আসছিলেন উনি। কত গল্প করলেন তোমাদের ছোটবেলার, যে গল্পগুলো আমি তোমার মুখে কতবার শুনেছি। আচ্ছা আমি মিথ্যা বলব কেন বলো? তোমার বিশ্বাস না হলে তুমি মংলুর বউকে জিজ্ঞাসা কোরো সকালে।”
দরজাটা বন্ধ করে দোয়েলকে টেনে ঘরে ঢুকিয়ে নেয় সৌমেন। দোয়েল যে মিথ্যা বলছে না বেশ বুঝতে পারছে সে। কেমন যেন ভয় ভয় করছে তার। এমনটা তো আগে কখনও হয়নি। দু’হাতে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরে দোয়েলকে। আর কোত্থাও একা-একা যেতে দেবে না দোয়েলকে।
কারেন্টটা এসে পড়ে। টিউবের আলোয় চোখে টেবিলে রাখা ডিজিটাল ডেট ক্যালেন্ডারটায় জ্বলজ্বল করছে ২১শে জুলাই তারিখটা…
.
জন্ম ৬ই নভেম্বর। স্কুল জীবনের শুরু কলকাতাতে হলেও, পরবর্তী শিক্ষা এবং বড় হওয়া পূর্ব বর্ধমান জেলার কাটোয়াতে। প্রথাগত শিক্ষানুযায়ী বিজ্ঞানের ছাত্রী হলেও, সাহিত্যের প্রতি আকর্ষণ ছোট থেকেই। লেখালিখির শুরু সেই শৈশবে। প্রথম গল্প প্রকাশিত হয় “শুকতারা” পত্রিকায়। তবে বহুবছর নানা কারণে লেখার জগৎ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন থাকার পর, নতুন করে লেখা শুরু করেন ২০১৫ তে। মানুষের মনের কথা, মানুষের জীবনের কথা লিখতেই ভালোবাসেন লেখিকা।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন