লিজা ম্যাকলিন ● শংকর ব্রহ্ম

বিশ্বরূপ মজুমদার

লিজা ম্যাকলিন – শংকর ব্রহ্ম

একদিন বিকেলবেলা বাংলো থেকে বেরিয়ে করলা নদীর পার ধরে অলস মনে হাঁটতে হাঁটতে শ্মশান পার হয়ে অনেকটা সামনে এগিয়ে গেলাম। এদিকটা খুব নির্জন। আস্তে আস্তে হাঁটছি আর দু’পাশে দেখছি। এমন সময় দেখতে পেলাম অদূরে প্রাসাদের মতো এক পোড়ো বাড়ি। ভেঙেচুরে যাওয়া লোহার গেটটা দিয়ে ভিতরটা দেখা যাচ্ছে। বিশাল ঘেরা জায়গার মাঝখানে দোতলা বাড়িটা। সামনে বাগান। যদিও এখন বুনো দুই একটা ফুল গাছ ছাড়া আর কোনও গাছ নেই। বাগানটার পরেই বাড়িটার সামনে উঁচু উঁচু কয়েকটা দেবদারু গাছ। এত সুন্দর বাড়িটা বাইরে থেকে দেখে ভিতরে যাওয়ার লোভটা আর সামলাতে পারলাম না। আমি আস্তে আস্তে গেট পেরিয়ে, ক্ষয়ে যাওয়া ইটের রাস্তা দিয়ে ভিতরে ঢুকলাম। বাড়িটার সামনে বিশাল লম্বা বারান্দা। বারান্দার পরে সেগুন গাছের তিনটা দরজা। দুই পাশের দুটি দরজা, মাঝখানের দরজাটির চেয়ে ছোট।

মাঝখানের দরজাটি প্রায় দশ বারো ফুট উঁচু। দরজায় চমৎকার নকশা কাটা। ঝড় বৃষ্টিতে দরজার রংগুলো ম্লান হলে গেলেও, দেখে বোঝা যায় দরজাগুলো এখনও খুব মজবুত। বিশাল বিশাল আটটা জানালা। সেগুলো বন্ধ। দোতালায়ও বারান্দা আছে সেখানে কাঠের নকশাদার রেলিং। রেলিংগুলো কালো রঙের দেখে বোঝাই যায় ওগুলো গর্জন গাছের। এগুলো দারুণ শক্ত। বাড়ির ছাদটা টিনের চালের লাল রঙের সিরামিক ইটের টালি দিয়ে ছাওয়া। ইটের লাল রঙের জৌলুসটা এখন আর নেই। আমি একমনে দেখছি আর ভাবছি, কী সুন্দর বাড়িটা!

একটু বাঁয়ে ঘুরে সামনে এগিয়ে যেতেই বুকের ভিতর হৃৎপিণ্ডটা হঠাৎ লাফ দিয়ে উঠল। নারী কন্ঠে কে যেন প্রশ্ন করল, “কাউকে খুঁজছেন?”

পিছনে ফিরতেই দেখি বরফ রঙের শাড়ি পরা লম্বা, পাতলা নমনীয় চেহারের এক অপূর্ব সুন্দরী তরুণী। আমি অনেকটা হতবাক হয়ে চেয়ে রইলাম তার দিকে।

তরুণীটি আবার আমাকে জিজ্ঞেস করল, “কাউকে খুঁজছেন?”

আমি দ্রুত নিজেকে সামলে নিলাম। হেসে বললাম, “না, কাউকেই না।”

“তবে?”
“রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে এই সুন্দর নির্জন বাড়িটা চোখে পড়ল। তাই ভিতরটা একটু ঘুরে দেখতে এসেছি।”

তরুণীটি এবার ফিক করে হেসে ফেলল। বলল, “আপনি যেভাবে বাড়িটা মনোযোগ দিয়ে দেখছিলেন। এই পুরাতন বাড়িতে তেমন আর কী দেখার আছে? আমি অনেকক্ষণ এসেছি, আপনার তন্ময়তা দেখে আর ডাকিনি।”

“আপনি?”
“আমি? আমি এই বাড়িতে থাকি। নাম লিজা ম্যাকলিন।”

আমি অবাক হয়ে গেলাম। বললাম, “যতটুকু শুনেছি, এই বাড়িতে কেউ থাকে না।”

“আপনি ঠিকই শুনেছেন। আমি দু’দিন আগে লন্ডন থেকে এসেছি বাড়িটা বিক্রির ব্যাপারে। আপনি?”
“আমি আপনাদের স্থানীয় কেউ না, থাকি কলকাতায়। আমার নাম শংকর ব্রহ্ম।”
“সে আপনার ভাষার উচ্চারণ শুনেই বুঝেছি আপনি শহরের লোক।”
“আপনিও তো সুন্দর বাংলা বলেন।”
“হ্যাঁ, এখানে তো আমি বহুদিন ছিলাম। তা কী উদ্দেশ্যে এখানে এলেন?”
“বেড়াতে।”
  —‘ও। চলুন ওদিকটায় যাওয়া যাক।”
“কোথায়?”
“বাহ! বাড়ির সামনেটাই দেখবেন আর পিছনের দিকটা দেখবেন না?”
“পিছনটাও দেখা যাবে! বেশ বেশ, চলুন তাহলে…” উৎসাহিত হয়ে বললাম আমি।

তরুণী আগে আগে চলতে লাগল, আমি তার পিছনে পিছনে।

সাদা শাড়িতে মোহনীয় দেখাচ্ছে তাকে। সরু কোমরের নীচে শাড়ির আঁচল বাতাসে উঠছে আর নামছে। শাড়িটি এমন ভাবে পরেছে যাতে তার পা দু’টি এতটুকুও না দেখা যায়। বাড়ির পিছন দিকে এসে আমি তো আরও অবাক হয়ে গেলাম। বিশাল এক দিঘি। টলটলে স্বচ্ছ তার জল। পাড়ের চারদিকে বড় বড় অনেক উঁচু নারকেল গাছ, দু’-একটা তাল গাছও আছে। দিঘির পাড়ে শানবাঁধানো একটি বড়সড় ঘাট, বসার ব্যবস্থা আছে। তবে সেখানে এখন পুরো শ্যাওলার আস্তরণ পড়ে আছে।

“চলুন একটু ঘাটে বসি। এখানে দিঘির হিমেল বাতাসে শরীর জুড়িয়ে নিয়ে তারপর ভিতরে যাব।” বলেই সম্মোহনী হাসি হাসল তরুণী। আমি মনে মনে তা-ই চাইছিলাম। কোনও কথা না বাড়িয়ে ঘাটের সিঁড়িতে গিয়ে বসলাম। তরুণী পাশে এসে বসল। প্রথম দেখাতেই সে যেভাবে নিঃসংকোচে আমাকে তার এতটা কাছে আসার সুযোগ করে দিয়েছে, তা দেখে আমি অবাক হয়ে গেলাম। বিস্ময়বোধ জাগছে মনে। হয়তো এটা সম্ভব হয়েছে ইউরোপের মতো পরিবেশে থাকার ফলে, মনে মনে ভাবলাম।

“কী ভাবছেন? আমাকে নিয়ে কিছু ভাবছেন না তো আবার?”

আমি চমকে উঠলাম। আমার চমকে ওঠা দেখে লিজা চুড়ি ভাঙা শব্দে রিনঝিন সুরে হেসে উঠল।

“কি? আমি ঠিক বলেছি, তাই না?”

আমি অস্বীকার করতে পারলাম না। মাথা নেড়ে বললাম, “হুম।”

তরুণী কপট রাগ দেখিয়ে বলল, “কাজটা আপনি ঠিক করেননি।”

“কেন?”
“কারণ আমাকে নিয়ে যারাই ভাবে, তারা ডুবে মরে।”

আমি অবাক হয়ে বললাম, “ঠিক বুঝলাম না।”

“মানে আমার প্রেমে হাবুডুবু খেয়ে ডুবে মরে।” বলে লিজা আরও লাস্যময়ী ভঙ্গিতে হাসতে লাগল।

নির্জন এই দিঘির পাড়ে তার হাসির তরঙ্গে আমি মোহগ্রস্ত হয়ে ভেসে যেতে যেতে, যেন এক অশুভ ইঙ্গিত পেলাম। হাসি থামিয়ে লিজা সিঁড়ি বেয়ে নীচে দিঘিতে নামতে নামতে বলল, “আসুন হাত মুখ ধুয়ে নিন। তারপর বাড়ির ভিতরটা গিয়ে দেখবেন।”

আমি সিঁড়ি দিয়ে নেমে, পায়ের গোড়ালি ডুবিয়ে জলে দাঁড়ালাম। নীচে জলে ডোবা পায়ের দিকে তাকাতে গিয়ে দেখতে পেলাম লিজার শাড়ি জলে ভেসে উপরে উঠে গেছে, ওর পায়ের পাতা দেখা যাচ্ছে স্পষ্টভাবে। ওর পা দেখে ভয়ে চমকে উঠলাম। লিজার পায়ের গোড়ালি দেহের সামনের দিকে, আর পায়ের আঙ্গুলগুলো দেহের পিছন দিকে। আমার চমকে ওঠা দেখেই লিজা বুঝে ফেলল আমি ওর পায়ের আকৃতিটা দেখে ফেলেছি। তখন সঙ্গে সঙ্গে ও আমাকে জাপটে ধরল। আমি দেখতে পেলাম ওর দু’চোখ দিয়ে নির্মম নৃশংসতা ঠিকরে বেরোচ্ছে। তীক্ষ্ণ এক অপার্থিব কণ্ঠে চিৎকার করে সে আমাকে নিয়ে দিঘির জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। জলে ডুবে যাওয়ার শেষ মূহূর্তে আমি দেখতে পেলাম কে যেন ঘাটে এসে দাঁড়িয়েছে।

প্রায় তিনদিন পর হুঁশ ফিরল আমার। দেখতে পেলাম একটি মাটির ঘরে শুয়ে আছি আমি। চোখ খুলতেই দেখতে পেলাম এক বুড়িকে। যে আমাকে বাঁচিয়েছে। গরু খুঁজতে বেরিয়ে গরু না পেয়ে, ঘাটের দিকে যেতেই আমাকে সে ডুবতে দ্যাখে, নিজেই জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে আমাকে উদ্ধার করে। পরে আমাকে নিয়ে এসে তার ঘরে তুলেছে। উঠে বসতে চাইলেই আমাকে জোর করে আবার শুইয়ে দিল সে। আবার কখন আমি ঘুমিয়ে পড়লাম।

তার পরদিন সকালে মোটামুটি সুস্থ বোধ করলাম। আমি এবার আর নিজের কৌতূহল ধরে রাখতে পারলাম না। বুড়িকে জিজ্ঞাসা করলাম, “কী হয়েছিল আমার?”

বুড়ি বলল, “আপনি এক পিশাচিনীর পাল্লায় পড়েছিলেন। পিশাচিনী মানে এক নারী প্রেতাত্মা। এরা গভীর জঙ্গল, নদী কিংবা দীঘির ধারে থাকে। এরা বেশিরভাগ সময় উলঙ্গ নারীর বেশ ধরে যুবক পুরুষদের আকৃষ্ট করে। এরা খুবই নিষ্ঠুর প্রকৃতির। এরা পুরুষদের নৃশংসভাবে হত্যা করে। আপনার আগেও অনেক লোক ওই দিঘির জলে ডুবে মারা গেছে। কিন্তু আমরা এলাকার লোকেরা কেউ জানতে পারিনি কীভাবে মারা গেছে তারা। এখন আপনার এই ঘটনায় সব ব্যাপারটা পরিষ্কার ভাবে বোঝা গেল। আপনি খুব জোর বাঁচা বেঁচে গেছেন।”

আমি বুড়ির দিকে তাকিয়ে কৃতজ্ঞতার হাসি হাসলাম। কিন্তু লিজা ম্যাকলিনকে ভুলতে পারলাম না!

.

 শংকর ব্রহ্ম

জন্ম ১৯৫১ সালের ২রা মার্চ, কলকাতায়। ১৯৭০ সাল থেকে লেখালেখি শুরু। প্রায় শতাধিক পত্রিকায় লিখেছেন। “দৈনিক বাংলা স্টেটসম্যান”, “প্রসাদ”, “বিকল্প বার্তা” (শারদীয়া সংখ্যা – ১৪২৮ এবং ১৪২৯), “শব্দ সাঁকো”, “সয়ংসিদ্ধা”, “দৈনিক দেশজগত”, “বঙ্গীয় সাহিত্য দর্পণ”, “সাময়িকি” (নরওয়ে থেকে প্রকাশিত) প্রভৃতি। এছাড়াও লিখেছেন সমরেশ বসু সম্পাদিত “মহানগর”, শিবনারায়ণ রায় সম্পাদিত “জ্ঞিসাসা”, কিরণ শংকর সেনগুপ্ত সম্পাদিত “সাহিত্য চিন্তা”, পবিত্র মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত “কবিপত্র” দীপেন রায় সম্পাদিত “সীমান্ত সাহিত্য” প্রভৃতি পত্রিকায়। পেয়েছেন বহু সাহিত্য-পুরস্কার। তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ – “তোমাকে যে দুঃখ দেয়”, “স্মৃতি তুমি আমাকে ফেরাও”, “যাব বলে এখানে আসিনি”, “আবার বছর কুড়ি পরে” ইত্যাদি।

অধ্যায় ১২ / ১২

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন