বিশ্বরূপ মজুমদার
“এই যন্ত্রণা থেকে আমার মুক্তি হবে তো? আমি আর পারছি না। চিরমুক্তি চাই জীবনের এই যন্ত্রণা থেকে।” – কাঁদতে কাঁদতে বললেন অনিমেষ বন্দ্যোপাধ্যায়। তার দুই হাত জড়ো করে ধরা, চোখে যন্ত্রণামাখা কাতর অনুনয়।
“পাবি পাবি।” হুঁকোতে দুটো টান দিয়ে লম্বা দাড়িতে হাত বুলোতে বুলোতে বললেন কাপালিক। “শরীর তো খুবই জটিল যন্ত্র রে। আর তুই, মানে তোর মন সেই শরীরের বাহক। তোরা সারা জীবন যখন যা খুশি শরীরকে নিয়ে করবি আর করাবি তাকে দিয়ে! কখনও না কখনও তো সেই যন্ত্র তোকে যন্ত্রণা ফিরিয়ে দেবেই রে।” মুখ দিয়ে ধোঁয়াটা বের করে কুটিল হাসি হাসলেন তিনি। তাঁর এই হাসি দেখলেই বোঝা যায়, অনেক ঘাটের জল খাওয়া ধুরন্ধর এক মানুষ তিনি। জীবনের আলো ও অন্ধকারময় বিভিন্ন অভিজ্ঞতা যেন লিপিবদ্ধ হয়ে আছে তাঁর মুখমন্ডলের ভাঁজে ভাঁজে, শুধু পড়ার ও বোঝার লোকের অভাব।
“আর নয় গো ঠাকুর, বয়ে বেড়াতে পারছি না আর এ ব্যথা। এবার রেহাই চাই৷ যন্ত্রণাহীন মুক্তির ব্যবস্থা করে দাও।” অনিমেষবাবু হাতজোড় করে কাতরস্বরে প্রার্থনা করলেন।
কাপালিক অভয়ের হাসি হাসলেন, “ঠিক আছে। চিন্তা নেই। তুই যখন আমার শরণে এসেছিস, তখন তোর মুক্তির দায়িত্বও আমিই নিলাম। আজ রাত্রির দ্বিতীয় প্রহরের শেষের দিকে তুই আয় শ্মশানের পাশে আমার কুটিরে।” তারপর সামনের নিমগাছটার দিকে তাকিয়ে নিজের মনেই স্বগতোক্তি করে উঠলেন, “তুই এলে তাকে আজ ডেকে নিয়ে আসব। সে-ই মুক্তির ব্যবস্থা করবে তোর।”
“তিনি কে ঠাকুর? আরও বড় কোনও সাধুপুরুষ বুঝি?” অনিমেষবাবু একটু কৌতূহলী স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন।
“হুমম?” কাপালিক যেন ঘোরের মধ্যে থেকে জেগে উঠলেন, “হ্যাঁ। সাধু পুরুষই বটে।” তারপর অনিমেষবাবুর কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে ফিস ফিস স্বরে বললেন, “সে এ জগতের নয়। তাকে নিয়ে আসতে হবে অন্য এক জগৎ থেকে। সে এক অন্ধকারের জগৎ। জীবনের সমস্ত যন্ত্রণা থেকে মানুষকে মুক্তি দেওয়াই তার কাজ।” তারপর কান থেকে মুখ সরিয়ে একটু হেসে বললেন, “কিন্তু তুই আদার ব্যাপারি, জাহাজ নিয়ে এত খুঁটিনাটি জেনে তোর কোনও লাভ কি আছে? তোর চাই এক ঝটকায় মুক্তি। আর আমি তোকে সেটাই দেব। তুই আয়, যেমন বললাম…”
“ঠাকুর, আপনার অসীম কৃপা। কিন্তু ব্যথা লাগবে না তো? সারা জীবন ব্যথা পেতে পেতে পারছি না আর।”
“উঁহু। বললাম তো, চিন্তা নেই। অসীম শক্তি আর অপার্থিব জ্ঞান তাঁর। আসবে, ঘাড় মটকাবে আর চলে যাবে। চোখের পলক ফেলার আগেই দেখবি তুইও পৌঁছে গেছিস অন্য পৃথিবীতে।”
“জয় প্রভু। আমি অবশ্যই আসব।” আবার হাতজোড় করলেন অনিমেষবাবু, বেশ কষ্ট হচ্ছে, তবু।
“জয় ভৈরব।” কাপালিকও হাত তুলে আশীর্বাদ করলেন। তারপর গ্রামের কাঁচা রাস্তা বেয়ে অদ্ভুত দ্রুত পদচারণায় হারিয়ে গেলেন চোখের আড়ালে। দুপুর রোদের প্রবল তেজকে সজ্ঞানে উপেক্ষা করল তাঁর নগ্ন দুই শীর্ণ কিন্তু শক্তিশালী পা দু’খানি। কিছুক্ষণ সেদিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে ধীরে ধীরে অনিমেষবাবু বাড়ির অন্দরমহলে ঢুকে পড়লেন। কেন কে জানে তাঁর বুক কাঁপছে এক অজানা আশঙ্কায়।
|| ২ ||
শ্মশান জিনিসটাকে অনিমেষ বন্দ্যোপাধ্যায় কখনওই ভালো চোখে দেখেননি। সাধারণত কেউই দেখে না। শ্মশানে যে আসে, সংসারে আর ফেরে না স্বেচ্ছায়। সে কোনও মৃতদেহ হোক, বা কাপালিক বা তান্ত্রিকদের মতো মানুষেরা। শ্মশানে যদিও মৃতদের আস্তানা, কিন্তু তারও মনে হয় প্রাণ থাকে। সমস্ত মৃতদের প্রাণকে শুষে নিয়ে তৈরি হয় সেই অন্ধকারময় অস্তিত্ব। নিষিদ্ধ খাবারের মতোই কী যেন এক নিষিদ্ধ মোহ থাকে সেই নিঃসঙ্গ প্রাণের। যারা সেই মোহে আটকে পড়ে, সেই অস্তিত্ব যেন তাদেরকে মাকড়সার জালের মতোই আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে। জোর করে সেই জাল ছিঁড়ে তাদেরকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করলে অনর্থ হয়। অনিমেষবাবু শুনেছিলেন এমনই এক তান্ত্রিকের সংসারে ফেরার গল্প। গল্প নয়, এই তল্লাটেরই পুরনো এক ঘটনা। বহুদিন তান্ত্রিক জীবনযাপনের পর বয়স্ক অসহায় বাবা-মায়ের চাপে পড়ে ছেলের তন্ত্রসাধনা ছেড়ে, বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে সংসারে ফেরার এক কাহিনি। স্ত্রী’র রূপে মুগ্ধ সেই ছেলে প্রথম কিছুদিন সব ভুলে প্রবল সংসারী হয়ে উঠেছিল৷ কিন্তু শ্মশান যার ভেতরে ঢুকে পড়েছে, মৃত মানুষের শরীর নিয়ে সাধনা করা যার বাঁ হাতের খেলা হয়ে উঠেছে, তাকে জীবিত মানুষের সীমিত জীবনের মায়া কতদিন আর আটকে রাখতে পারে? শেষ পর্যন্ত সে শ্মশানেই ফিরে যায়, কিন্তু ভয়ংকর এক কাণ্ড ঘটিয়ে। তার পরিবার তাকে বাধা দিয়েছিল, তাই তার পরিবারের সকলকেই হত্যা করে সে। সে বাদে তার পরিবারের বাকি সকলেই ঘুমের মধ্যে মারা যায়, এমনকি তার কয়েকমাসের ছোট্ট শিশুকন্যাটিও। আর সে হয়ে যায় নিরুদ্দেশ। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার, কারও শরীরেই কোনও আঘাত বা যন্ত্রণার চিহ্নমাত্র ছিল না। শুধু সবারই ঘাড় মটকে দেওয়া হয়েছিল সুনিপুণ ভাবে, মাত্র এক মুহূর্তের মধ্যেই। অথচ কারওর শরীরেই কোনও হাতের ছাপ ছিল না। সবাই বলে, এটা ওই পিশাচসিদ্ধ তান্ত্রিকই করিয়েছিল, তার অনুগত কোনও প্রেতাত্মাকে দিয়ে।
পুরো গল্পটা মনে পড়তেই অনিমেষবাবুর গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। আরও বেশি করে, কারণ এই কাপালিকও তো সেরকমই কোনও অস্তিত্বকে ডেকে আনার কথা বলেছিল। তাহলে কি এই কাপালিক আর সেই তান্ত্রিক একই লোক? অনিমেষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বুক কেঁপে উঠল। আর তখনই তিনি হেসে উঠলেন একটা কথা মনে করে। তাঁর তো মুক্তিই দরকার। তা হলে আর ভয় কীসের?
চারদিক প্রবল অন্ধকারে আচ্ছন্ন। আজ অমাবস্যা। তার মধ্যেই একটা বড় টর্চ হাতে নিয়ে অনিমেষবাবু চলেছেন শ্মশান লাগোয়া জঙ্গলের মধ্য দিয়ে কোনওরকমে। টর্চের আলো যেন তার চারপাশের অন্ধকারকেই গাঢ়তর করে তুলেছে।
কাছেই কোথাও একটা শেয়াল ডেকে উঠল, আর সঙ্গে সঙ্গে আরও কয়েকটা। অনিমেষবাবুর চমকে উঠলেন। সেই ডাক যেন কোনও এক অশনি সংকেতকে ইঙ্গিত করছিল। অন্ধকার ভেদ করে যেতে যেতে এক জায়গাতে হালকা একটা আলোর অভাস দেখতে পেলেন তিনি। সামনে একটা ছোট্ট কুটির। দরজা বন্ধ। সেই বন্ধ দরজা আর জোড়াতালি দেওয়া দেওয়ালের ফাঁকফোকর দিয়ে হালকা একটা আলো বেরিয়ে আসছে। এখানেই কাপালিকের বাস। অনিমেষবাবু দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। ভেতরে একটা কেমন যেন আওয়াজ হচ্ছে। কোনও মানুষ যেন মৃদুস্বরে গোঙাচ্ছে। অনিমেষবাবু ভালো করে শোনার চেষ্টা করলেন। না গোঙানোর শব্দ নয়, কাপালিক বিড়বিড় করে মন্ত্র উচ্চারণ করছেন। উনি একটা গলাখাঁকারি দিলেন। তারপর ডাক ছাড়লেন, “ঠাকুর, ও ঠাকুর।”
কোনও পরিবর্তন হল না কোথাও। বুঝলেন ওঁর গলার আওয়াজ খুব একটা জোরালো হয়নি। তাই আরও জোরে এবার ডেকে উঠলেন “ঠাকুর, ও ঠাকুর।” এবার ভেতরের আওয়াজ থেমে গেল। একটু পরে দরজার ফাঁক দিয়ে আসা আলো একটু ঢাকা পড়ল আর পরক্ষণেই দরজা খুলে গেল। সঙ্গে সঙ্গে অনিমেষবাবুর মুখ থেকে একটা চিৎকার বেরিয়ে আসতে চাইল। এ কী দেখছেন তিনি? হঠাৎ দরজা খোলাতে পেছনের আলোয় সামনের মানুষটি যেন এক কালো ছায়ামূর্তি রূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন, আর সেই মুর্তির চোখ দুটো যেন একবার হঠাৎই জ্বলে উঠেছিল দপ করে, কোনও শ্বাপদের মতো। কিন্তু পরক্ষণেই আবার সব স্বাভাবিক। অনিমেষবাবু কোনওরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে হাত জোড় করে কাঁপা কাঁপা স্বরে বললেন, “আমি এসেছি ঠাকুর।”
|| ৩ ||
রাত্রি তখন এগারোটা বেজে পঁয়ত্রিশ। অনিমেষবাবু আর কাপালিক মুখোমুখি বসে, তান্ত্রিকের ছোট্ট কুটিরের মধ্যে। একপাশে একটা ছোট্ট অগ্নিকুণ্ড, আবছা আলো আর উত্তাপে যা যথাসাধ্য ভরিয়ে তুলেছে কাপালিকের ছোট্ট অগোছালো বাসস্থানটিকে। গ্রামের একপ্রান্তে জঙ্গলঘেরা এই বিশাল শ্মশান। আর তারই একধারে এই কুটির। একটু আগেই একটা শবদাহ সাঙ্গ হয়েছে শ্মশানে। লোকজনের আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল তখন দূর থেকে। কিন্তু এখন আবার শশ্মান যেন অন্ধকারের চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক যেন তার মৃদু নাক ডাকার আওয়াজ। আর মাঝে মধ্যে সে আড়মোড়া ভাঙছে কিছু রাতচরা পাখির শব্দে।
অনিমেষবাবু ও কাপালিকের মাঝে একটা ছোট্ট চৌকি৷ চৌকির ওপর একটা মোমবাতি জ্বলছে মৃদুমন্দ শিখায়। কাপালিকের পাশে রাখা একটা পুরনো চামড়ার থলি। সেটা যে কত পুরনো বলা মুশকিল, কিন্তু সে জিনিস যে বাজারে এখন পাওয়া সম্ভব নয়, তা যে কেউ একবার দেখেই বলে দিতে পারে। সম্ভবত তা সাধারণ বাজারে কখনওই পাওয়া সম্ভব ছিল না। হয়তো কোনও পশুর চামড়া থেকে নিজের হাতেই বানিয়েছেন কাপালিক। ধীরে ধীরে সেই থলে থেকে কিছু জিনিস বের করে সামনের চৌকিতে রাখলেন তিনি। কিছু পুরনো শুকিয়ে যাওয়া ফুল, কিছু শুকনো পাতা আর গাছের ডাল। তারপর বেরিয়ে এল কিছু হলুদ হয়ে যাওয়া হাড়, আর একটা করোটি। হাড় আর করোটি গুলো যে মানুষের, তা দেখলেই স্পষ্ট বোঝা যায়। তারপর বেরোল কিছু পাখির পালক। সেগুলো কোন পাখির তা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। আগের সব জিনিসকে গোল করে সাজিয়ে রাখলেন কাপালিক, মাঝখানে একটু ফাঁকা জায়গা রেখে। তারপর পালকগুলোকে ছড়িয়ে দিলেন চৌকির ওপরে৷ অনিমেষবাবু কিছুটা ভীতসন্ত্রস্ত চোখে তাকিয়ে রইলেন চৌকির ওপর রাখা সেই জিনিসগুলির দিকে। এরপর কাপালিক তার চামড়ার থলিটি থেকে বের করে আনলেন একটা ছোট চৌকোনা কাগজ। চৌকির মাঝখানের শূন্যস্থানটিতে রাখলেন সেটা। সেটা আসলে একটা ছবি, একটা লোকের। একটা পুরনো, দাগ পড়ে নষ্ট হতে বসা ফটো। তবে তার মধ্যেও ব্যক্তিটির মুখখানা বেশ পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। আর সেটাই আসলে দরকার এখন। ছবির সেই মুখ অত্যন্ত ভয়ঙ্কর, আর মুখের হাসিটিও চেহারার সঙ্গেই মানানসই। তার প্রথম দর্শনেই যে কথাটা মাথায় আসবে, তা হল, লোকটি মোটেই সুবিধের নন।
কাপালিক এবার গম্ভীর গলায় বললেন, “নে এবার ছবিটা ছুঁয়ে চোখ বন্ধ করে বসে থাক চুপচাপ। ছবিটার কথাই ভাববি শুধু দু’চোখ বুজে।” দু’জনে চোখ বন্ধ করে চৌকির ওপর রাখা ছবিটিকে স্পর্শ করলেন। এক মনে ছবির ব্যক্তিটিকে স্মরণ করে চলেছেন দু’জনেই। অনিমেষবাবু বুঝতে পারছেন, এই আয়োজন কিছুটা প্ল্যানচেটের মতোই, তবে অনেকটা পার্থক্যও আছে। কাপালিক বিড় বিড় করে মন্ত্রোচ্চারণ করছেন কিছু একটা। মোমবাতির আলো অল্প অল্প কাঁপছিল তাঁদের নিশ্বাস প্রশ্বাসের বাতাসে। কিন্তু হঠাৎই তা স্থির হয়ে গেল। একটা খুট করে শব্দ হল। কাপালিক থামলেন। দু’জনেই চোখ খুললেন। অনিমেষবাবু অবাক হয়ে দেখলেন, চৌকির ওপর রাখা মোমবাতির শিখার আয়তন দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর তা তৈরি করছে প্রচুর প্রচুর ধোঁয়া। তার সঙ্গে একটা কেমন গোঁ গোঁ শব্দ। সেটা যেন সেই ধোঁয়ার মধ্য থেকেই আসছে। মনে হচ্ছে কোনও এক অন্ধকার জগৎ থেকে কেউ তীব্র হাহাকার করে চলেছে, প্রকাশ করতে চাইছে তার প্রবল দুঃখের কাহিনি। ধোঁয়ার পরিমাণ যত বেড়ে চলেছে, শব্দটার তীব্রতাও তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বেড়ে চলেছে ক্রমশ। ধীরে ধীরে সেই শব্দময় ধূম্রের চাদর তাঁদের দু’জনকে চারপাশ থেকে ঘিরে ধরেছে বলয়ের মতো। ঘন হচ্ছে তা ক্রমে। গোলাকার ধোঁয়ার কুন্ডলীর মাঝে তাঁরা দু’জন। শব্দটাও বাড়তে বাড়তে এখন কানে প্রায় তালা ধরে যাওয়ার জোগাড়। মনে হচ্ছে এই মূহুর্তে জগৎসংসার থেকে সম্পুর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন তাঁরা। সমগ্র অস্তিত্ব জুড়ে আছে শুধু এই চৌকি, মোমবাতি, ছবি, তাঁরা আর তাঁদের ঘিরে থাকা এই ধূম্রবলয়, যা আরও ঘন হচ্ছে দ্রুত।
এবার সেই বলয়ের ভেতরের গায়ে ফুটে উঠল একটা অবয়ব। প্রথমে একটা চোখ, তারপর আরেকটা, দুটি চোখই লাল হয়ে আগুনের মতো জ্বলছে তার। তারপর একটা নাক, দুটো কান, একজোড়া ঠোঁট। ধোঁয়ার দেওয়ালে ফুটে উঠেছে একটা মুখ, একটা ভয়ঙ্করদর্শন মুখ। ধীরে ধীরে তা স্পষ্ট হল। অনিমেষবাবু চিনতে পারলেন, ছবিতে দেখা সেই মুখই অবিকল ফুটে উঠেছে ধোঁয়ার দেওয়ালে। আর সেটা তাদেরকে প্রদক্ষিণ করছে দ্রুত, ধোঁয়ার প্রাচীরের গা বেয়ে। একবার কাপালিকের দিকে, একবার অনিমেষবাবুর দিকে তাকাচ্ছে সেটা পর্যায়ক্রমে, যেন অপেক্ষা করছে কোন আদেশের। অনিমেষবাবুর চোখেমুখে প্রবল আতঙ্ক, যদিও কাপালিক তাঁকে আগেই পুংখানুপুংখ ভাবে জানিয়ে রেখেছিলেন যে কী কী হতে চলেছে। যদিও জীবন যন্ত্রণায় কাতর মুক্তিপ্রত্যাশী মানুষের এত ভয় যে কীসের, তা অনিমেষবাবু নিজেও ঠিক বুঝতে পারছেন না।
বিড়বিড় করে কাপালিক কিছু একটা বলতে বলতেই আঙুল তুলে দেখালেন অনিমেষবাবুর দিকে। যেন লক্ষ্য স্থির করে দিলেন সেই অলৌকিক অস্তিত্বটির। অবয়বটির ভয়ংকর দুটি লাল জ্বলন্ত চোখ মুহূর্তের মধ্যে ঘুরে গেল অনিমেষবাবুর দিকে। কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে সে জরিপ করল অনিমেষবাবুকে। তারপর ধোঁয়ার দেওয়ালের গা বেয়ে সেটা চলে গেল অনিমেষবাবুর ঠিক পেছনে। ধোঁয়ার প্রাচীর ফুঁড়ে বেরিয়ে এল ধোঁয়া দিয়েই তৈরি ঘোর কৃষ্ণবর্ণ দু’খানা পেশিবহুল হাত। সেই হাতজোড়া শক্ত করে ধরল অনিমেষবাবুর মাথা। তিনি নিজের মাথা আর ঘাড়ে অনুভব করলেন এক প্রবল চাপ। সেটা বাড়ছে দ্রুত। প্রবল যন্ত্রণা সত্ত্বেও অনিমেষবাবু দাঁতে দাঁত চেপে রাখলেন। এরকম চলল কিছুক্ষণ। তারপর হঠাৎ একটা খট করে আওয়াজ। সঙ্গে সঙ্গে অনিমেষবাবু মুখ দিয়ে একটা অদ্ভুত শব্দ করে লুটিয়ে পড়লেন মেঝেতে। আর মুহূর্তের মধ্যেই সেই অবয়ব সহ ধোঁয়ার প্রাচীর অন্তর্হিত হল শূন্যে কোথাও। মোমবাতির শিখাও ফিরে গেল তার পুরনো মৃদুমন্দ চালে।
কাপালিক কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন মাটিতে পড়ে থাকা অনিমেষবাবুর শরীরটার দিকে। ধীরে ধীরে শরীরটা নড়ে উঠল। তারপর একটু সময় নিয়ে তা উঠে বসল আবার। চোখে মুখে এক অদ্ভুত আরামের আভাস তার। কাপালিক জিজ্ঞাসা করলেন, “কী রে? কেমন লাগছে?”
উত্তরে শরীরটার মুখ নড়ে উঠল, যেন স্বর্গলোক থেকে প্রবল স্বর্গসুখে তা বলে উঠল, “অদ্ভুত সুন্দর! এক অপার্থিব অনুভূতি।”
কাপালিক প্রবল আনন্দে চৌকির ওপর থাপ্পড় মেরে বলে উঠলেন, “হবে না? কে এসেছিল জানিস? জলধর প্রামাণিক। জীবিত অবস্থায় ওকে সবাই বলত সাক্ষাৎ ধন্বন্তরী। ওই যে যার ছবি দেখছিস চৌকিতে! কেউ দেখে বলবে যে দূর দূর গ্রাম থেকে লোক আসত ওঁর হাতের একটু ছোঁয়া পেতে? পায়ে চোট, হাতে ব্যথা, মেরুদণ্ডে সমস্যা বা তোর মতো ঘাড়ে মারাত্মক আঘাত, সব চোখের পলকে হাওয়া করে দিতেন। শরীরের সব খুঁটিনাটি জানতেন তিনি। রোগীর সমস্যা সব শুনে বুঝে নিয়ে এদিক ওদিক একটু ঘুরিয়ে দিতেন, অথবা কোথাও একটু চাপ বা আঘাত। একটু ক্যাট, একটু মট আওয়াজ। ব্যস সব ব্যথা চোখের পলকে হাওয়া। এখনকার দিনে ওই কীসব আধুনিক চিকিৎসা বেরিয়েছে না, চিরোপ্র্যাকটিস না কি, এঁদের চিকিৎসাপদ্ধতি তো তারই পূর্বপুরুষ রে, আদি রূপ।”
অনিমেষবাবুর মুখ থেকে আওয়াজ বেরোতে গিয়েও আটকে গেল যে ওটা কাইরোপ্র্যাকটিক। তান্ত্রিকের ইগোতে আঘাত করে কী লাভ? অনিমেষবাবু একবার নিজের চারপাশ দেখে নিলেন। না, তার নিজের ছায়া পড়ছে। তার মানে তিনি বেঁচে থেকেই সুস্থ হয়েছেন। যন্ত্রণাহীন মৃত্যু হয়েছে তাঁর যন্ত্রণার, আর তিনি পৌঁছে গেছেন সুখের অন্য এক জগতে। নীলকন্ঠ কাপালিককে বিদায় জানিয়ে আর জলধর প্রামাণিকের আত্মার গুণগান করতে করতে, টর্চের আলোয় প্রায় নাচতে নাচতে তিনি পা বাড়ালেন বাড়ির দিকে। পিছনে নীলকন্ঠ কাপালিক তখন হুঁকোয় টান দিয়ে গর্জন করে উঠছেন মাঝে মাঝে, “ব্যোম ভোলে”। তাঁর চোখদুটো মাঝেমধ্যেই জ্বলে উঠছে। সে চোখে কারও দুঃখ দূর করার অনাবিল আনন্দ আছে, কিন্তু কখনও কারও ক্ষতি করার নিষ্ঠুর কোনও স্মৃতির ক্রূর উদ্ভাস নেই।
জন্মসূত্রে বাঁকুড়ার মানুষ, কর্মসূত্রে আপাতত কলকাতার বাসিন্দা। ইচ্ছে থাকলেও পড়াশোনার চাপে ও কেরিয়ার গড়ার লক্ষ্যে খুব বেশি লেখালেখি করতে পারেননি। তবে সময় পেলে যথাসম্ভব লেখার চেষ্টা করেন। মূলত অলৌকিক, কল্পবিজ্ঞান, রোমাঞ্চ ও সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার লিখতেই বেশি পছন্দ করেন, আর ভালোবাসেন রম্যরচনা লিখতে। ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপে প্রকাশিত হয়েছে বেশ কয়েকটি গল্প ও রচনা।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন