নিশুত রাতে একা ● দেবব্রত দাশ

বিশ্বরূপ মজুমদার

নিশুত রাতে একা – দেবব্রত দাশ

বহু বহু বছর আগের কথা, শতাব্দী পার হয়ে গিয়েছে… কিন্তু মনে হচ্ছে, এই তো সেদিন। যখন আমি দুধের শিশু… মোটে তিন মাস বয়েস, তখন আমাকে ছেড়ে আমার মা চলে গেছে না-ফেরার দেশে। বাবা অনন্যোপায় হয়ে আমার জন্যে দেশের বাড়ি থেকে তার বিধবা দিদিকে নিয়ে এসেছিল নিজের সংসারে। মুখে কথা ফুটতেই পিসিমাকে আমি ‘মা’ ডাকতে শুরু করেছিলাম। পিসিমাও সন্তান স্নেহেই আমাকে প্রতিপালন করতে লাগল, কিন্তু মুশকিল হয়েছিল এটাই যে, মা-হারা ছেলে বলে পিসিমা প্রয়োজনেও আমার গায়ে হাত তুলত না। বেয়াড়া বেমক্কা সব আবদার করলেও, তা পূরণের চেষ্টা চালিয়ে যেত হাসিমুখে। ফলে, আদরে বাঁদর তৈরি হচ্ছিলাম আমি। তিন বছর বয়েসের কথা একটু একটু মনে আছে আমার, পরে পিসিমার মুখ থেকে বিশদে শুনেছি — যখন আমি বায়না করতাম কিংবা আমাকে যা করতে বলা হত, জেদের বশে তা করতে চাইতাম না, তখনও পিসিমা বকাঝকা করত না… ভাবত — আহা রে বেচারির মা নেই, ওকে বকুনি দেওয়া কিংবা পিঠে দু’ঘা বসিয়ে দেওয়া কি উচিত হবে? চুপ করে থাকতে থাকতে যখন সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যেত, তখন পিসিমা ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ করত, মানে বাধ্য হত আর কী। যেমন একদিন, আমি বায়না ধরেছিলাম… কী? না, ভাত আরও শুকনো করে মেখে দাও, না হলে খাব না — বলে আমি মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছি। পিসিমা মাছের ঝোল দিয়ে ভাত মেখেছিল। হাঁড়ি থেকে আর খানিক ভাত তাতে নিয়ে শুকনো করে মেখে যখন আমার মুখের কাছে এনে ধরেছিল, আমি আবার ঘ্যানঘ্যান করে মুখ সরিয়ে নিয়ে বলেছিলাম — হয়নি শুকনো… আরও শুকনো করে মাখো।

তিনবারের বার প্রয়োগ হল সেই ব্রহ্মাস্ত্র। পিসিমা করল কী? — মুগুরের মতো দেখতে একটা ভারী কাঠের টুকরো, যাকে বলে ‘খেটে’… সেই খেটে বাঁ হাত দিয়ে তুলে নেওয়ার ভঙ্গি করে বলে উঠল — আর তো সহ্য হয় না বাপু… আমি এই খেটের বাড়ি নিজের মাথায় মেরে মরব এবার, তবে যদি তুই সিধে হোস!

ব্যস, ঠিক যেন জোঁকের মুখে নুন পড়ল। সুড়সুড় করে মুখ বাড়িয়ে লক্ষ্মী ছেলের মতন ভাতের গ্রাসগুলো পরপর মুখে তুলে নিয়েছিলাম আমি।

এ ছাড়াও আমাকে শায়েস্তা করার জন্যে পিসিমা আরও একটা অস্ত্র প্রয়োগ করত কখনও সখনও। বলত — কথা শুনছিস না তো… এবার কিন্তু তোকে রেখে দিয়ে আসব বাঁশঝাড়ের নীচে, ওখান দিয়ে রাত-বিরেতে যাওয়ার সময় কত লোককেই ভূতে ধরেছে… ঘাড়-মটকে দিলে আমি কিন্তু… বাক্য শেষ করার আগেই পিসিমার আঁচলের তলায় মুখ-লুকিয়ে আমি দু’হাত দিয়ে তাকে আঁকড়ে ধরেছি।

দেখতে দেখতে এভাবেই পার হয়ে যাচ্ছিল সময়। তারপর যখন আমার বয়েস সাত কি আট, তখন এক রাত্তিরে ঘটল অদ্ভুত ঘটনা। আমি ঘুমের মধ্যে বিছানা থেকে উঠে নাকি হাঁটতে শুরু করে দিয়েছিলাম। দেখতে পেয়ে পিসিমা আমাকে ধরে নিয়ে এসে বসিয়ে দিয়েছিল চৌকিতে। ঘোলাটে দৃষ্টি মেলে একবার চেয়ে আমি তক্ষুনি শুয়ে পড়েছিলাম। সকালে যখন আমার ঘুম ভাঙল, তখন কিন্তু কিছুই মনে করতে পারলাম না।

এরপর মাসখানেকও পার হয়নি, ঘটল আবার একইরকম ঘটনা। তখনও ভালো করে আলো ফোটেনি, পিসিমার ঘুম ভেঙে গেল হঠাৎ। কাত হয়ে পাশ ফিরে আমাকে দেখতে না-পেয়ে পিসিমা খোলা দরজার বাইরে এসে দ্যাখে — আমি নিশ্চিন্তে ছাদে ওঠার সিঁড়ির প্রথম ধাপে মাথা রেখে ঘুমোচ্ছি। এবারেও আমি মনে করতে পারিনি — কখন দরজা খুলে বাইরে এসেছি আর কখনই বা ওইভাবে ঘুমিয়ে পড়েছি।

এই ঘটনার পর নির্বিঘ্নে প্রায় মাস দুই পার হয়ে গেল। ত্রস্ত আতঙ্কিত পিসিমা নাকি ওই সময় রাতের পর রাত ভালো করে ঘুমোতে পারত না। আমার সামান্য নড়াচড়ার শব্দে কিংবা অন্য যে কোনও শব্দ কানে এলে উঠে বসে আমার দিকে নজর রাখত। তবু এত সতর্কতা সত্ত্বেও ঘটে গেল অঘটন। এক কাকভোরে উঠে পিসিমা আমাকে বিছানায় দেখতে না-পেয়ে সদর দরজার বাইরে বেরিয়েও যখন আমার সন্ধান পেল না, তখন খিড়কি খুলে বাইরে গেল। না, সেখানেও পেল না আমায়। বাবাকে খবর দেওয়ার আগে নিজে পাগলের মতো ছুটে গিয়েছিল আমবাগানের ভিতর। সেখানে অনেক অনেক দূর গিয়ে শেষমেশ দেখতে পেল আমায়। আমি নাকি এক আমগাছের গোড়ায় শুয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছি। আমার এটাই শুধু মনে আছে যে, সেই আমবাগানে আমাকে জড়িয়ে ধরে হাপুস নয়নে কাঁদছিল পিসিমা। আমাকে জাগিয়ে তোলার পর এই তৃতীয়বারেও আগের দু’বারের মতনই আমি মনে করতে পারিনি — কখন কীভাবে ওই আমবাগানে আমি গিয়েছিলাম।

এরপর… পিসিমা বাবাকে বলেছিল — ভগবানের অসীম করুণা যে, সাপের কামড় খায়নি খোকন! রোজ রোজ তো আর বরাত জোরে বাঁচবে না! কীভাবে ওর এই ঘুমের মধ্যে হাঁটা বন্ধ করবি ভাব।

বাবা আর পিসিমা উপায় বের করেছিল। রাতে ঘরের বাইরে যাতে আমি বেরোতে না-পারি, সেজন্যে শোওয়ার ঠিক আগে ভিতর দিক থেকে দরজায় তালা ঝুলিয়ে চাবি অন্যত্র সরিয়ে রাখত পিসিমা।

এই যে ঘটনাগুলো ঘটেছিল… পরে কলেজ-জীবনে ঢুকে বইপত্র ঘেঁটে আমি এই বিষয়ে অনেক অনেক তথ্য জেনেছি। সাধারণত কিশোর-বয়েসের ছেলেমেয়েদের ক্ষেত্রেই এমন অদ্ভুত আচরণ পরিলক্ষিত হয় এবং একে বলে SOMNAMBULISM বা SLEEP WALKING। কারণ-উদঘাটনে বহু বহু গবেষণা হয়েছে এযাবৎ, কিন্তু আজ পর্যন্ত নির্দিষ্ট করে বলার মতো তেমন কিছু তথ্য পাওয়া যায়নি। বলা হয়েছে — ঘুমের মধ্যে হাঁটার ব্যাপারটা যদি ঘন ঘন ঘটতে থাকে, তবেই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। এইসব কিশোর-কিশোরীদের ক্ষেত্রে প্রয়োজন স্ট্রেস-ফ্রি জীবন আর প্রয়োজন সঠিক সময়ব্যাপী ঘুমের বিষয়টা নিশ্চিত করা। অবশ্য, তা সত্ত্বেও ঘুমের মধ্যে হাঁটার ঘটনা ঘটতে পারে বলে সতর্ক-বার্তা দেওয়া হয়েছে :-ধারেকাছে যেন না-থাকে বিপজ্জনক কোনও অস্ত্র, যেমন — ছুরি, কাঁচি, ব্লেড, দা, কাটারি ইত্যাদি এবং আগুন কিংবা স্লিপিং পিল জাতীয় মেডিসিন বা ধাক্কা লেগে আহত হওয়ার মতো কোনও আসবাব। হ্যাঁ, আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হল — সাধারণত ‘স্লিপ ওয়াকিং’ কিশোর-বয়সিদের মধ্যে দেখা গেলেও বড়রাও যে কোনও বয়সে এর পাল্লায় পড়তে পারে। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে যাচ্ছে জরাসন্ধর (যাঁর আসল নাম চারুচন্দ্র চক্রবর্তী) লেখা উপন্যাস “লৌহকপাট”-এ বর্ণিত একটি ঘটনা। আলিপুর সেন্ট্রাল জেলের জেলর এক রাতে সারপ্রাইজ ভিজিটে বেরিয়ে দেখছেন — টহল দিচ্ছে এমন একজন পুলিশ কনস্টেবল, যে ঘুমের মধ্যে হেঁটে চলেছে অবিরাম। আশ্চর্যের ব্যাপার হল — ওই কনস্টেবল প্রতিবার ঠিক জায়গা পর্যন্ত গিয়ে ‘অ্যাবাউট টার্ন’ করে উলটো মুখি হচ্ছে, যা কিনা একজন ঘুমন্ত মানুষের পক্ষে অসম্ভব বলে মনে হতে পারে। জেলর নিশ্চিত হয়েছেন এ জন্যেই যে, ওই কনস্টেবলটির খোলা চোখের সামনে হাত নাড়ালেও সে ছিল একেবারে প্রতিক্রিয়াহীন। যাই হোক, এবার ফিরে আসি আমার কথায়।

আমবাগানের ঘটনার পর পার হয়ে গিয়েছে তিন তিনটে বছর। এতখানি দীর্ঘ সময়ে যেহেতু ‘স্লিপ ওয়াকিং’-এর আর কোনও ঘটনা ঘটল না, তাই স্বাভাবিক ভাবেই নিশ্চিন্ত হয়ে টেনশন-মুক্ত ছিল পিসিমা আর বাবা। যে ঘরে আমি পিসিমার সঙ্গে শুতাম, সে-ঘরে তখন আর ভিতর দিক দিয়ে দরজায় তালা লাগানো হত না। সেই অসাবধানতার পথেই এল বিপদ। আজ এত বছর পরেও সে-রাতের যেটুকু স্মৃতি আমার মনের মধ্যে রয়ে গেছে, তা মনে পড়লে আমি শিউরে উঠি… অবশ্য, তারপরেই মন ভরে যায় আশ্চর্য উষ্ণ এক অনুভবে।

ঠিক কী ঘটেছিল সে-রাতে? আমি বলব পিসিমার মুখ থেকে শোনা কথা অনুসারে। শুধু সামান্য কিছু সময়ের ঘটনা আমি নিজেই স্মৃতি থেকে বলব।

সে-সময়কার গ্রাম-গঞ্জের মানুষজন রাত ন’টা…বড়জোর দশটার মধ্যেই খাওয়াদাওয়ার পাট চুকিয়ে শুয়ে পড়ত। আমরাও ব্যতিক্রম ছিলাম না। একটা মাত্র দেয়াল ঘড়ি ছিল বাবার ঘরে। পিসিমা তাই সময় বলতে পারেনি। তবে, আন্দাজ করে বলেছিল — রাত দুটো আড়াইটেয় হঠাৎ ঘুম ভেঙে গিয়েছিল তার। চোখ মেলে তাকিয়ে নিভু নিভু হ্যারিকেন-এর ক্ষীণ আলোয় আমাকে দেখতে না-পেয়ে পিসিমা মুহূর্তে খাট থেকে নেমে পড়েছিল। তারপর, ঘরের খোলা দরজা দিয়ে বেরিয়ে প্রথমে ছুটে গিয়েছিল সদর দরজার দিকে। সেটা বন্ধ দেখে দ্রুত পা চালিয়ে চলে গিয়েছিল খিড়কিতে। খিড়কিও বন্ধ থাকায় ফিরে এসে ছাদে ওঠার সিঁড়ির দিকে গেল। অনেক দেরিতে ওঠা কৃষ্ণপক্ষের দশমীর চাঁদের ফালি ছিল পুব আকাশে নারকেল গাছের মাথায়। সিঁড়ির শেষ ধাপে পৌঁছে পিসিমা দেখতে পেয়েছিল আমায়। আমি ছিলাম রেলিং না-থাকা ন্যাড়া ছাদের একদিকে… একেবারে ধারে পা ঝুলিয়ে বসে।

পিসিমা ছুটে গিয়ে প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে আমাকে নিরাপদ দূরত্বে টেনে এনেছিল, বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল — আমার যদি ঘুম না-ভাঙত এসময়, তবে তো তুই শেষ হয়ে যেতিস রে খোকন!

পিসিমার এই কথাগুলো আমি স্পষ্ট শুনেছিলাম, কারণ, তার বেশ কিছুক্ষণ আগেই সংবিৎ ফিরে এসেছিল আমার। আমি যখন শূন্যে পা বাড়াতে যাচ্ছি, ঠিক তখনই কীভাবে যে আমি জেগে উঠে শুনতে পেয়েছিলাম — থাম খোকন, থাম… ভাবলে অবাক হয়ে যাই। ওই গলা তো পিসিমার গলা ছিল না! এর কোনও ব্যাখ্যা নেই আমার কাছে। আর তার পরের অনুভূতি তো অলৌকিক। কোমল দু’টি হাত আমাকে যেভাবে টেনে নিয়ে উষ্ণ অনুভবে জারিত করেছিল, সেভাবে মায়েরা সন্তানকে বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করে। তারার দেশে চলে যাওয়া আমার মায়ের পরশই যেন আমি পেয়েছিলাম সেদিনের সেই নিশুত রাতে।

.

দেবব্রত দাশ

জন্ম ১৯৪৪। পদার্থবিদ্যায় স্নাতকোত্তর। প্রথমে অধ্যাপনা। ১৯৭৭ থেকে কর্মজীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ছিলেন ডব্লিউ বিসিএস অফিসার। বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত। লেখালেখির জীবন। লিখেছেন “কিশোর ভারতী”, “শুকতারা”, “নবকল্লোল”, “আনন্দমেলা” প্রভৃতি পত্র-পত্রিকায়। এছাড়া “ম্যাজিক ল্যাম্প, “জয়ঢাক”, “অপার বাংলা”, “ভো-কাট্টা” প্রভৃতি ওয়েব ম্যাগাজিনেও নিয়মিত লেখকের গল্প প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত একক বই – ‘জীবনের জলতরঙ্গ’, ‘জীবনের যত রঙ’, ‘জীবনের ঝরাপাতা’, মহাকাশে হীরকবৃষ্টি’, ‘কেল্লাফতে’ ইত্যাদি।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন