পদ্মাবতী – পঞ্চমাঙ্ক—দ্বিতীয় গর্ভাঙ্ক

মাইকেল মধুসূদন দত্ত

দ্বিতীয় গর্ভাঙ্ক

তমসা নদীতীরে মহর্ষি অঙ্গিরার আশ্রম।

(পদ্মাবতী এবং গৌতমীর প্রবেশ।)

 গৌত। বৎসে, তুমি এত অধীরা হইও না। তোমার প্রাণেশ্বর অতি ত্বরায়ই তোমার নিকটে আস্‌বেন, তার কোন সন্দেহ নাই। ভগবান্ অঙ্গিরা তোমার এ প্রতিকূল দৈব শান্তির নিমিত্তে এক মহাযজ্ঞ আরম্ভ করেছেন।—

 পদ্মা। ভগবতি, আমি কি সে শ্রীচরণের আর এ জন্মে দর্শন পাব। (রোদন।)

 গৌত। বৎসে, তুমি শান্ত হও, মহর্ষির যজ্ঞ কখনই নিষ্ফল হবার নয়।

 পদ্মা। ভগবতি, আপনি যা আজ্ঞা কচ‍্যেন সে সকলই সত্য, কিন্তু আমি এ নির্ব্বোধ প্রাণকে কেমন করে প্রবোধ দি। হায়! এ কি আর এখন কোন কথা মানে? (রোদন।)

 গৌত। বৎসে, বিবেচনা করে দেখ, এ অখিল ব্রহ্মাণ্ডে কোন বস্তুই চিরকাল শ্রীভ্রষ্ট হয়্যে থাকে না। বর্ষার সমাগমে জলহীনা নদী জলবতী হয়,—ঋতুরাজ বসন্ত বিরাজমান হলে লতাকুল মুকুলিতা ও ফলবতী হয়,—কৃষ্ণপক্ষে শশীর মনোরম কান্তি হ্রাস হয় বটে, কিন্তু আবার শুক্লপক্ষে তার পূরণ হয়,—তা তোমারও এ যাতনা অতি শীঘ্রই দূর হবে।

 নেপথ্যে। ভো শার্ঙ্গবর, ভগবতী গৌতমী কোথায় হে! দেখ, দুই জন অতিথি এসে এ আশ্রমে উপস্থিত হয়েছে, অতএব তাদের যথাবিধি আতিথ্য কর।

 গৌত। বৎসে, এক্ষণে আমি বিদায় হলেম। তুমি এই তরুর ছায়ায় কিঞ্চিৎকালের নিমিত্তে বিশ্রাম কর। দেখ! ভগবতী তমসার নির্ম্মল সলিলে কমলিনী কি অনির্ব্বচনীয় শোভাই ধারণ কর‍্যে বিকশিত হয়েছে, তা তোমার বিরহ-রজনীও প্রায় অবসান হয়ে এলো।

[ প্রস্থান।

 পদ্মা। (স্বগত) প্রাণেশ্বর যে সংগ্রামে বিজয়ী হয়েছেন তার আর কোন সন্দেহ নাই, কিন্তু এ হতভাগিনীকে কি আর তাঁর মনে আছে? (দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ করিয়া) হে বিধাতঃ! আমি পূর্ব্বজন্মে এমন কি পাপ করেছিলেম যে তুমি আমাকে এত দুঃখ দিলে। তুমি আমাকে রাজেন্দ্রনন্দিনী, রাজেন্দ্রগৃহিণী করেও আবার অনাথা যুথভ্রষ্টা কুরঙ্গিণীর মতন বনে বনে ফেরালে। (রোদন।)

 নেপথ্যে। প্রিয়সখি, কৈ, তুমি কোথায়?

 পদ্মা। (নেপথ্যাভিমুখে দৃষ্টিপাত করিয়া) কেন? এই যে আমি এখানেই আছি।

(বেগে সখীর প্রবেশ।)

 সখী। প্রিয়সখি—(রোদন।)

 পদ্মা। (ব্যগ্রভাবে সধীকে আলিঙ্গন করিয়া) এ কি? কেন? কেন সখি, কি হয়েছে?

 সখী। (নিরুত্তরে রোদন।)

 পদ্মা। সখি, কি হয়েছে তা তুমি আমাকে শীঘ্র করে বল?

 সখী। প্রিয়সখি, মহারাজ আর্য্য মানবকের সঙ্গে এই আশ্রমে এসে উপস্থিত হয়েছেন।

 পদ্মা। (অভিমান সহকারে) সখি, তুমিও কি আবার আমার সঙ্গে চাতুরী কত্যে আরম্ভ কর্‌লে?

 সখী। সে কি? প্রিয়সখি, আমি কি তা কখন পারি? ঐ দেখ, ভগবতী গৌতমী মহারাজ আর আর্য্য মানবককে লয়ে এদিকে আস্চেন। কেমন, আমি সত্য না মিথ্যা বলেছি? (নেপথ্যাভিমুখে অবলোকন করিয়া) আহা! মহারাজের মুখখানি দেখলে, বোধ হয়, যে উনি তোমার বিরহে অতি দুঃখে কালযাপন করেছেন।

 পদ্মা। (নেপথ্যাভিমুখে অবলোকন করিয়া) কি আশ্চর্য‍্য! সখি, তাই ত। বিধাতা কি তবে এত দিনের পর আমার প্রতি যথার্থ ই অনুকূল হলেন। (রাজার প্রতি লক্ষ্য করিয়া) হে জীবিতেশ্বর, আপনার কি এত দিনের পর এ হতভাগিনী বলো মনে পড়লো? (রোদন।) সখী। প্রিয়সখি, চল, আমরা ঐ বৃক্ষবাটিকায় গিয়ে দাড়াই। মহারাজকে তোমার সহসা দর্শন দেওয়া উচিত হয় না ।

[ উভয়ের প্রস্থান।

(রাজা ও বিদূষকের সহিত গৌতমীর পুনঃপ্রবেশ।)

 গৌত। হে নরেশ্বর, তার পর কি হলো?

 রাজা। ভগবতি, তার পর আমি রাজমহিষীর কোনই অন্বেষণ না পেয়ে যে কি পর্য্যন্ত ব্যাকুল হলেম, তা আর আপনাকে কি বল্‌বো। আর এ দুরূহ শোকানল সহ্য কত‍্যে অক্ষম হয়ে, রাজমন্ত্রীর উপর রাজ্যভার অর্পণ করে, এই আমার চিরপ্রিয় বয়স্যের সহিত তীর্থ পর্য‍্যটনে যাত্রা কল্যেম।

 গৌত। হে নরনাথ, আপনি এ বিষয়ে আর উদ্বিগ্ন হবেন না। রাজমহিষী এই আশ্রমেই আছেন। মহর্ষি অঙ্গিরা তাঁকে আপন দুহিতার ন্যায় পরম স্নেহ করেন। আর তাঁর আগমনাবধি বহু যত্নে তাঁর রক্ষণাবেক্ষণ করেছেন।

 রাজা। ভগবতি, সে সকল বৃত্তান্ত আমি দেবর্ষি নারদের মুখে বিশেষরূপে শ্রুত আছি। কুলায়ভ্রষ্টা পারাবতী আশ্রয়-আশায় কোন বিশাল বৃক্ষের সমীপে গমন কল‍্যে, তরুবর কি শরণদানে পরান্মুখ হয়ে, তাকে নিরাশ করেন? ভগবান্ অঙ্গিরা ঋষিকুলের চূড়ামণি, তা তিনি যে এরূপ ব্যবহার করবেন, এ কিছু বড় অসম্ভব নয়।

 গৌত। হে পৃথ্বীশ্বর, আপনি এই শিলাতলে ক্ষণেক কাল উপবেশন করুন আমি গিয়ে রাজমহিষীকে এখানে লয়ে আসি।

 রাজা। ভগবতি, আপনার যা আজ্ঞা। গৌত। আর আপনার এ আশ্রমে শুভাগমনের সংবাদও মহর্ষির নিকট প্রেরণ করা উচিত। অতএব আমি কিঞ্চিৎকালের নিমিত্তে বিদায় হলেম।

[ প্রস্থান। রাজা। (উপবেশন করিয়া) সখে, যেমন তপনতাপে তাপিত জন সুশীতল তরুচ্ছায়া পেলে পূর্ব্বতাপ বিস্তৃত হয়, আমারও আজ অবিকল তাই হলো।

 বিদূ। আজ্ঞা, তার আর সন্দেহ কি? এত দিনের পর আমাদের ডিঙ্গাখানি ঘাটে এসে লাগ্‌লো। কিন্তু এ ঘাটটা আমাকে বড় ভাল লাগ্ছে না।

 রাজা। কেন, বল দেখি!

 বিদূ। বয়স্য, এ মুনির আশ্রম, এখানে সকলেই হবিষ্য করে তা আমরাও কি একাহারী হয়ে আবার মারা পড়বো?

 রাজা। কেন? তুমি ত আর সন্ন্যাসধর্ম অবলম্বন কর নাই, যে তোমাকে একাহারে থাক্‌তে হবে?

 আকাশে। (কোমল বাদ‍্য।)

 রাজা। (গাত্রোত্থান করিয়া সচকিতে) এ কি? আহা! কি মধুর ধ্বনি! সখে, আমি যে দিন মায়ামৃগের অনুসরণ করে বিন্ধ্যাচলে দেবউপবনে উপস্থিত হয়েছিলেম, সে দিনও আকাশে এইরূপ কোমল বাদ‍্য শুনেছিলাম।

 বিদূ। (নেপথ্যাভিমুখে অবলোকন করিয়া সত্রাসে) কি সর্ব্বনাশ!

 রাজা। কেন? কি হলো?

 বিদূ। মহারাজ! চলুন, আমরা এখান থেকে পালাই। ঐ দেখুন, এ আশ্রমবনে দাবানল লেগেছে। উঃ! কি ভয়ঙ্কর শিখা।

 রাজা। (অবলোকন করিয়া) সখে, ও ত দাবানল নয়।

 বিদূ। বলেন কি? মহারাজ, ঐ দেখুন, সব গাছপালা একবারে যেন ধু ধু করে জ্বলে উঠ্ছে।

 রাজা। কি হে সখে, তুমি অন্ধ হলে না কি?

 বিদূ। বয়স্য, তবে ও কি?

 রাজা। এঁরা সকল দেবকন্যা। তা ওঁরাও অগ্নিশিখার মতন তেজস্বিনী বটেন। (অবলোকন করিয়া সানন্দে) কি আশ্চর্য‍্য। এই যে শচী দেবী, যক্ষেশ্বরী, আর রতি দেবী আমার প্রেয়সীকে লয়ে এ দিকে আস্চেন। হে হৃদয়! তুমি যে এত দিন এ পূর্ণশশীর অদর্শনে বিদীর্ণ হও নাই এই আশ্চর্য্য! (অগ্রসর হইয়া) এ দাস আপনাদিগের শ্রীচরণে প্রণাম কচ্যে। (প্রণাম।)

(শচী, মুরজা, রতি, গৌতমী, পদ্মাবতী, সখী, নারদ এবং
অঙ্গিরার প্রবেশ।)

 সকলে। মহারাজের জয় হউক।

 নার। হে মহীপতে, যেমন মহর্ষি বাল্মীকির পুণ্যাশ্রমে দাশরথি ভগবতী বৈদেহীকে প্রাপ্ত হন, আপনিও অন্য তদ্রূপ মহিষী পদ্মাবতীকে এই স্থলে লাভ কল্যেন।

 অঙ্গি। হে নরশ্রেষ্ঠ, আপনার বাহুবলে ঋষিকুলের সর্ব্বত্রই কুশল। অতএব আপনি পুরস্কারস্বরূপ এই স্ত্রীরত্নটি গ্রহণ করুন।

 শচী। (রাজার হস্তে পদ্মাবতীর হস্ত প্রদান করিয়া) হে নরনাথ, আপনি অদ্যাবধি নিঃশঙ্কচিত্তে রাজসুখভোগে প্রবৃত্ত হউন।

 আকাশে।

গীত।

[ বেহাড়া—পোস্তা। ]

সুমতি ভূপতি অতি, তুমি ওহে মহারাজ।
সুখে থাক ধনে মানে, রিপুগণে দিয়ে লাজ।
পাইলে হারা নিধি,প্রিয়তমা পুনরায়,
বাসনা পূর্ণ হলো, সুখে কর রাজকাজ।
হয়ে সুবিচারে রতকর বহু যশোলাভ,
যেমন শোভে ক্ষিতি, তারাপতি দ্বিজরাজ॥

(পুষ্পবৃষ্টি)

 সকলে। রাজমহিষী চিরবিজয়িনী হউন।

 নারদ। (রাজার প্রতি) আমিও আশীষ করি, শুন নরপতি।—

সুখে সদা কর বাস অবনী-মণ্ডলে,
পরাভবি শত্রুদলে, মিত্রকুলে পালি,
ধর্ম্মপথগামী যথা ধর্ম্মের নন্দন
পৌরব। চরমে লভ স্বর্গ ধর্ম্মবলে।

(পদ্মাবতীর প্রতি) যশঃসরে চিররুচি কমলিনীরূপে
শোভ তুমি পদ্মাবতি—রাজেন্দ্রনন্দিনি,
যযাতির প্রণয়িনী দৈত্যরাজবালা
শৰ্ম্মিষ্ঠা যেমতি। তার সহ নাম ভব
গাঁথুক গৌড়ীয় জন কাব্যরত্নহারে,
মুকুতা সহ মুকুতা গাঁথে শোক যথা ।

( যবনিকা পতন। )


ইতি পঞ্চমাঙ্ক ।

গ্রন্থ সমাপ্ত।

অধ্যায় ১০ / ১০

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন