মাইকেল মধুসূদন দত্ত
দ্বিতীয় গর্ভাঙ্ক
মাহেশ্বরীপুরী—দেবালয় উচ্চান।
(পুরোহিত এবং কঞ্চুকীর প্রবেশ।)
পুরো। আহা, কি আক্ষেপের বিষয়। মহাশয়, যেমন ভগবতী ভাগীরথীকে দর্শন কর্যে জগজ্জনগণ হিমাচলকে ধন্যবাদ করে, রাজদুহিতা পদ্মাবতীকে দেখে সকলেই আমাদের নরপতিকে তদ্রূপ পরম ভাগ্যবান্ বলে গণ্য কর্তো। হায়, কোন দুর্দৈব বিপাকে এ নির্ম্মলসলিলা গঙ্গা যেন অকস্মাৎ রোধঃপতনে পঙ্কিলা হয়ে উঠ্লেন!
কঞ্চু। দুর্দৈব বিপাকই বটে। মহাশয়, দেখুন, এ বিপুল ভারতভূমিতে প্রতি যুগে কত শত রাজগৃহে এই স্বয়ম্বর কার্য্য মহাসমারোহে নিষ্পন্ন হয়েছে; কিন্তু কুত্রাপি ত এরূপ ব্যাঘাত কস্মিন্ কালেও ঘটে নাই!
পুরো। হায়! এতটা অর্থ কি তবে বৃথাই ব্যয় হলো?
কঞ্চু। মহাশয়, তন্নিমিত্তে আপনি চিন্তিত হবেন না। দেখুন, যে অকূল সাগরকে শত সহস্র নদ ও নদী বারিস্বরূপ কর অনবরত প্রদান করে, তার অম্বুরাশির কি কোন মতে হ্রাস হতে পারে? তবে কি না এ একটা কলঙ্ক চিরস্থায়ী হয়ে রৈল।
পুরো। ভাল, কঞ্চুকী মহাশয়, রাজকন্যার স্বয়ম্বর-সমাজে উপস্থিত না হবার মূল কারণটা কি তা আপনি বিশেষরূপে কিছু অবগত আছেন?
কঞ্চু। আজ্ঞা না, তবে আমি এইমাত্র জানি যে স্বয়ম্বর-সভায় যাত্রাকালে, রাজবালা, মুহুর্মুহু মূর্চ্ছা প্রাপ্ত হয়ে, এতাদৃশী দুর্ব্বলা হয়ে পড়েছিলেন, যে রাজবৈদ্য তাঁকে গৃহের বহির্গত হতে নিষেধ করেন; সুতরাং স্বয়ম্বরা কন্যার অনুপস্থিতিতে শুভলগ্ন ভ্রষ্ট হওয়ায়, রাজদল অকৃতকার্য হয়ে স্ব স্ব দেশে প্রস্থান কল্যেন।
পুরো। আহা, বিধাতার নির্ব্বন্ধ কে খণ্ডন কত্যে পারে? তা চলুন, আমরা এক্ষণে দেবদর্শন করিগে।
কঞ্চু। আজ্ঞা চলুন।
[ উভয়ের প্রস্থান।
(সথী এবং পরিচারিকার প্রবেশ)
সখী। কেমন—আমি বলেছিলাম কি না, যে এ স্বয়ম্বরে কোন না কোন একটা ব্যাঘাত অবশ্যই ঘটে উঠ্বে?
পরি। তাই ত? কি আশ্চর্য! তা রাজনন্দিনী যে একেবারে এমন হয়ে পড়বেন, তা কে জান্তো?
সখী। আহা, প্রিয়সখীর দুঃখের কথা মনে হলে প্রাণ যে কেমন করে তা আর কি বল্বো। (রোদন।)
পরি। ভাল, রাজনন্দিনী যে একেবারে এমন হয়ে পড়লেন, এর কারণ কি?
সখী। আর কারণ কি? প্রিয়সখী যারে স্বপ্নে দেখে ভাল বাসেন, তিনি ত আর রাজা নন যে তাঁকে প্রিয়সখী পাবেন!
পরি। তা সত্য বটে। (নেপথ্যাভিমুখে অবলোকন করিয়া) ও কে ও? ঐ না সেই বিদর্ভদেশের লোকটি এই দিকে আসচেন? উনিও যে রাজনন্দিনীকে ভাল বাসেন, তার সন্দেহ নাই; তা এমন ভাল বাসায় ওঁর কি লাভ হবে? বামন হয়ে কি কেউ কখন চাঁদকে ধর্তে পারে। চল, আমরা ঐ মন্দিরের আড়ালে দাঁড়ায়ে দেখি, উনি এখানে এসে কি করেন। সখী। চল।
[ উভয়ের প্রস্থান।
(ছদ্মবেশে রাজা ইন্দ্রনীলের প্রবেশ।)
রাজা। (স্বগত) আমার ত এ রাজধানীতে আর বিলম্ব করা কোন মতেই যুক্তিসিদ্ধ নয়। যত রাজগণ এ বৃথা স্বয়ম্বরে এসেছিল, তারা সকলেই আপন আপন রাজ্যে প্রস্থান করেছে। কিন্তু আমি এ পরমসুন্দরী কন্যাটিকে কি প্রকারে পরিত্যাগ করে যাই? (দীর্ঘনিশ্বাস) হে প্রভো অনঙ্গ, যেমন সুরেন্দ্র আপন বজ্রযারা পর্ব্বতরাজের পক্ষচ্ছেদ কর্যে তাকে অচল করেছেন, তুমিও কি তোমার পুষ্পশরাঘাতে আমাকে তদ্রূপ গতিহীন কত্যে চাও। (চিন্তা করিয়া) এ স্ত্রীলোকটিকে কোন মতেই আমার রাজমহিষী পদে অভিষিক্তা করা যেতে পারে না। সিংহ সিংহীর সহিতই সহবাস করে। এ রাজবালা পদ্মাবতীয় একজন সহচরী মাত্র, তা এর সহিত আমার কি সম্পর্ক? (দীর্ঘনিশ্বাস) হে রতি দেবি, তুমি যে অমূল্য রত্ন আমাকে দান কত্যে চাও, সে রত্ন শচী এবং যক্ষেশ্বরীর ক্রোধে আমার পক্ষে অস্পর্শীয় অগ্নিশিখা হলো। হায়, এ পবিত্রা প্রবাহিণী কি তাঁদের অভিশাপে আমার পক্ষে কর্ম্মনাশা নদী হয়ে উঠ্লো? তা আর বৃথা আক্ষেপ কল্যে কি হবে? (সচকিতে নেপথ্যাভিমুখে অবলোকন করিয়া) এ কি?
নেপথ্যে। তুই বেটা কি সামান্য চোর। তুই যে দ্বিতীয় হনুমান্।
ঐ। কেন! হনুমান্ কেন?
ঐ। কেন তা আবার জিজ্ঞাসা করিস্? দেখ্ দেখি—যেমন হনুমান্ রাবণের মধুবন ভেঙ্গে লণ্ডভণ্ড করেছিল, তুইও আজ আমাদের মহারাজের অমৃতফলবনে সেইরূপ উৎপাত করেছিস্। তা তোর মাথাটা কেটে ফেলাই উচিত।
ঐ। ইস্।
ঐ। বটে? দেও ত হে, বেটাকে ঘা দুই তিন লাগিয়ে দেও ত ।
ঐ। দোহাই মহারাজের—
(বেগে কতিপয় রক্ষক সহিত বিদূষকের প্রবেশ।)
বিদূ। মহারাজ, আপনি আমাকে রক্ষা করুন।
রাজা। কেন, কি হয়েছে?
বিদূ। মহারাজ, এ বেটারা সাক্ষাৎ যমদূত।
প্রথম। ধর ত হে, বেটাকে ধরে বাঁধ।
বিদূ। (রাজার পশ্চাদ্ভাগে দণ্ডায়মান হইয়া) ইস্। তোর কি যোগ্যতা যে তুই আমাকে বাঁধ্বি? ওরে দুষ্ট রক্ষক, তুই যদি কনকলঙ্কায় ঢুকতে চাস্, তবে আগে সমুদ্র পার হ। এই মহাত্মা বিদর্ভদেশের অধিপতি রাজা ইন্দ্রনীল রায়।
রাজা। আরে কর কি।
বিদূ। মহারাজ, আপনি যে কে, তা না টের পেলে কি এ পাষণ্ড বেটারা আমাকে অম্নি ছাড়বে। বাপ!
প্রথম। মহাশয়—
বিদূ। মর্ বেটা নরাধম, তুই কাকে মহাশয় বলিস্ রে?
রাজা। (বিদূষকের প্রতি) চুপ্ কর হে—চুপ্ কর। (রক্ষকের প্রতি) রক্ষক, তুমি কি বল্ছিলে?
প্রথম। মহাশয়—দেখুন। এ ঠাকুরটি আমাদের মহারাজের অমৃতফলবনে যত পাকা ফল ছিল প্রায় তা সব পেড়ে পেড়ে খেয়েছেন।
বিদূ। খাব না কেন? আমি খাব না ত আর কে খাবে? তুই বেটা আমাকে হনূমান্ বলে গাল দিচ্ছিলি। আচ্ছা, আমি যদি এখন হনূমানের মতন তোদের পুরী পুড়িয়ে ভস্ম কর্যে যাই, তবে তুই আমার কি কত্যে পারিস্?
রাজা। (জনান্তিকে বিদূষকের প্রতি) ও কি কত্যে পারে? কিন্তু অবশেষে তুমি আপনার মুখ পোড়াবে। আর কি?
(কঞ্চুকী এবং পুরোহিতের পুনঃপ্রবেশ।)
প্রথম। (কঞ্চুকী এবং পুরোহিতের সহিত একান্তে কথোপকথন।)
কঞ্চু। বল কি? (অগ্রসর হইয়া) মহারাজের জয় হউক।
পুরো। মহারাজ চিরজীবী হউন।
কঞ্চু। রক্ষক, তুমি এ সংবাদ মহারাজের নিকট অতি ত্বরায় লয়ে যাও।
প্রথম। যে আজ্ঞা। তবে এই আমি চল্লেম।
পুরো। মহারাজ, আপনার শুভাগমনে এ রাজধানী অদ্য কৃতার্থ হলো।
কঞ্চু। হে নরেশ্বর, আপনার আর এ স্থলে অবস্থিতি করা উচিত হয় না। অনুগ্রহ কর্যে রাজনিকেতনের দিকে পদার্পণ করুন।
রাজা। (স্বগত) এত দিনের পর আজ সকলই বৃথা হলো। (প্রকাশে) চলুন।
[ সকলের প্রস্থান।
(সখী এবং পরিচারিকার পুনঃপ্রবেশ।)
সখী। হ্যাঁ লো মাধবি, এ আবার কি? আমরা কি স্বপ্ন দেখ্ছি, না এ বাজীকরের বাজী?
পরি। ও মা, তাই ত! ঐ কি রাজা ইন্দ্রনীল, যাঁর কথা সকলেই কয়?
নেপথ্যে। (মঙ্গলবাদ্য ও জয়ধ্বনি।)
সখী। কি আশ্চর্য! চল্, আমরা এ সব কথা প্রিয়সখীকে বলিগে।
[ উভয়ের প্রস্থান।
ইতি তৃতীয়াঙ্ক।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন