মাইকেল মধুসূদন দত্ত
দ্বিতীয়াঙ্ক
প্রথম গর্ভাঙ্ক
মাহেশ্বরীপুরী—রাজশুদ্ধান্তসংক্রান্ত উদ্যান।
(পদ্মাবতী এবং সখীর প্রবেশ।)
পদ্মা। (আকাশে দৃষ্টিপাত করিয়া) সখি, সূর্য্যদেব অস্তে গেছেন বটে, কিন্তু এখনও একটু রৌদ্র আছে।
সখী। প্রিয়সখি, তবুও দেখ, ঐ না একটি তারা আকাশে উঠেছে?
পদ্মা। ওঁকে কি তুমি চেন না, সখি? ও যে ভগবতী রোহিণী। চন্দ্রের বিরহে ওঁর মন এত চঞ্চল হয়েছে, যে উনি লজ্জায় জলাঞ্জলি দিয়ে তাঁর আস্বার আগেই একলা এসে তাঁর অপেক্ষা কচ্যেন।
সখী। প্রিয়সখি, তা যেন হলো, কিন্তু একবার এদিকে চেয়ে দেখ। কি চমৎকার!
পদ্মা। কেন, কি হয়েছে?
সখী। ঐ দেখ, মধুকর তোমার মালতীর মধু পান কত্যে এসেছে, কিন্তু মলয়মারুত যেন রাগ করেই ওকে এক মুহূর্ত্তের জন্যেও স্থির হয়ে বস্তে দিচ্যেন না। আর দেখ, ওরও কত লোভ। ওকে যত বার মলয় তাড়াচ্যেন, ও তত বার ফিরে ফিরে এসে বস্চে।
পদ্মা। সখি, চল দেখিগে, চক্রবাকী তার প্রাণনাথকে বিদায় করে, এখন একলা কি কচ্যে।
সখী। প্রিয়সখি, তাতে কাজ নাই । বরঞ্চ চল দেখিগে, কুমুদিনী আজ কেমন বেশ করে তার বাসরঘরে চন্দ্রের অপেক্ষা কচ্যে।
পদ্মা। সখি, যে ব্যক্তি সুখী, তার কাছে গেলেই বা কি, আর না গেলেই বা কি? কিন্তু যে ব্যক্তি দুঃখী, তার কাছে গিয়ে দুটি মিষ্ট কথা কইলে তার মন অবশ্যই প্রফুল্ল হয়। আমি দেখেছি যে উচ্চ স্থলে বৃষ্টিধারা পড়লে, জলটা অতিশীঘ্র বেগে চলে যায়, কিন্তু যদি কোন মরুভূমি কখন জলধরের প্রসাদ পায়, তবে সে তা তৎক্ষণাৎ ব্যগ্র হয়ে পান করে।
(পরিচারিকার প্রবেশ।)
পরি। রাজনন্দিনি, একজন পটোদের মেয়ে পট বেচ্বার জন্যে এসেছে; আপনি যদি আজ্ঞা করেন, তবে তাকে এখানে ডেকে আনি। সে বল্ছে যে, তার কাছে অনেক রকম উত্তম উত্তম পট আছে ।
সখী। দূর্, এ কি পট দেখ্বার সময়?
পদ্মা। কেন? এখনও ত বড় অন্ধকার হয় নাই। (পরিচারিকার প্রতি) যা, তুই চিত্রকরীকে ডেকে আন্গে।
পরি। রাজনন্দিনি, সে অতি নিকটেই আছে। (উচ্চস্বরে) ওলো পটোদের মেয়ে, আয়, তোকে রাজনন্দিনী ডাক্চেন।
নেপথ্যে। এই যাচ্যি।
(চিত্রকরীবেশে রতি দেবীর প্রবেশ।)
সখী। (জনান্তিকে পদ্মাবতীর প্রতি) প্রিয়সখি, এর নীচকুলে জন্ম বটে, কিন্তু এর রূপলাবণ্য দেখ্লে চক্ষু জুড়ায়।
পদ্মা। (জনান্তিকে সখীর প্রতি) তুমি কি ভেবেচ, সখি, যে মণি মাণিক্য কেবল রাজগৃহেই থাকে? কত শত অন্ধকারময় খনিতেও যে তাদের পাওয়া যায়। এই যে উজ্জ্বল মুক্তাটি দেখ্চ, এ একটা কদাকার শুক্তির গর্ভে জন্মেছিল। আর যে নলিনীকে লোকে ফুলকুলের ঈশ্বরী বলে, তার কাদায় জন্ম। (রতির প্রতি) তুমি কি চাও?
রতি। (স্বগত) আহা! রাজা ইন্দ্রনীলের কি সৌভাগ্য। তা সে শচীর আর মুরজার দর্প চূর্ণ করে আমার যে মান রেখেছে, আমার তাকেই এই অমূল্য রত্নটি দান করা উচিত।
পদ্মা। চিত্রকরি, তুমি যে চুপ্ করে রৈলে? তুমি ভয় করো না। এখানে কার সাধ্য যে, তোমার প্রতি কোন অত্যাচার করে।
রতি। আপনি হচ্যেন রাজার মেয়ে, আপনার কাছে মুখ খুলতে আমার ভয় হয়।
পদ্মা। (সহাস্য বদনে) কেন? রাজকন্যারা কি রাক্ষসী? তারাও তোমাদের মতন মানুষ বৈ ত নয়।
রতি। (স্বগত) আহা! মেয়েটি যেমন সুন্দরী, তেমনই সরলা।
পদ্মা। (শিলাতলে উপবেশন করিয়া) চিত্রকরি, এই আমি বস্লেম, তোমার পট সকল এক একখান করে দেখাও।
রতি। যে আজ্ঞে, এই দেখাচ্যি।
পদ্মা। চিত্রকরি, তুমি কোথায় থাক?
রতি। আজ্ঞে, আমরা পাহাড়ে মানুষ।
পদ্মা। তোমার স্বামী আছে!
রতি। রাজনন্দিনি, আমার পোড়া স্বামীর কথা আর কেন জিজ্ঞাসা করেন? তিনি আগুনে পুড়েও মরেন না। আর যেখানে সেখানে পান, কেবল লোকের মন মজিয়ে বেড়ান।
সখী। প্রিয়সখি, যদি তোমার পট দেখতে ইচ্ছা থাকে, তবে আর দেরি করো না।
পদ্মা। চিত্রকরি, এস, তোমার পট দেখাও।
রতি। এই দেখুন। (একখান পট প্রদান।)
পদ্মা। (অবলোকন করিয়া সখীর প্রতি) সখি, এই দেখ, অশোককাননে সীতা দেবী রাক্ষসীদের মধ্যে বসে কাঁদ্ছেন। আহা! যেন সৌদামিনী মেঘমালায় বেষ্টিতা হয়ে রয়েছে। কিম্বা নলিনীকে যেন শৈবালকুল ঘেরে বসেছে। আর ঐ যে ক্ষুদ্র বানরটি গাছের ডালে দেখ্চ, ও পবনপুত্র হনুমান্। দেখ, জানকীর দশা দেখে ওর চক্ষের জল বৃষ্টিধারার মতন অনর্গল পড়্ছে। সখি, এ সকল ত্রেতাযুগের কথা, তবু এখনও মনে হলো হৃদয় বিদীর্ণ হয়।
রতি। (স্বগত) আহা! এ কি সামান্য দয়াশীলা। ভগবতী বৈদেহীর দুঃখেও এর নয়ন অশ্রুজলে পরিপূর্ণ হলো। (প্রকাশে) রাজনন্দিনি, আরও দেখুন। (অন্য একখান পট প্রদান।)
পদ্মা। এ দ্রৌপদীর স্বয়ম্বর। এই যে ব্রাহ্মণ ধনুর্ব্বাণ ধরে অলক্ষ্য লক্ষ্যের দিকে আকাশমার্গে দৃষ্টি কচ্যেন, ইনি যথার্থ ব্রাহ্মণ নন। ইনি ছদ্মবেশী ধনঞ্জয়। ঐ যাজ্ঞসেনী।
রতি। (পদ্মাবতীর প্রতি) রাজনন্দিনি, এই পটখান একবার দেখুন দেখি। (পট প্রদান।)
পদ্মা। (অবলোকন করিয়া ব্যগ্রভাবে রতির প্রতি) চিত্রকরি, এ কার প্রতিমূর্ত্তি লা?
রতি। আজ্ঞে, তা আমি আপনাকে—(অর্দ্ধোক্তি।)
পদ্মা। সখি—(মূর্চ্ছাপ্রাপ্তি।)
সখী। (পদ্মাবতীকে ক্রোড়ে ধারণ করিয়া) হায়, এ কি! প্রিয়সখী যে হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে পড়লেন। (পরিচারিকার প্রতি) ওলো মাধবি, তুই শীঘ্র একটু জল আন্ ত লা ।
[ পরিচারিকার বেগে প্রস্থান।
রতি। (স্বগত) ইন্দ্রনীলের প্রতি যে পদ্মাবতীর এত পূর্ব্বরাগ জন্মেছে, তা ত আমি জান্তেম না। এদের দুজনকে স্বপ্নযোগে কয়েক বার একত্র করাতেই এরা উভয়ে উভয়ের প্রতি এত অনুরক্ত হয়েছে। এ ত ভালই হয়েছে। আমার আর এখন এখানে থাকায় কোন প্রয়োজন নাই। শচী আর মুরজার ক্রোধে পদ্মাবতীর কি অনিষ্ট ঘট্তে পার্বে? আমি এ সকল বৃত্তাত্ত ভগবতী পার্ব্বতীকে অবগত করালে, তিনি যে এই পদ্মাবতীর প্রতি অনুকূল হবেন, তার কোন সন্দেহ নাই। (অন্তর্দ্ধান।)
সখী। (স্বগত) হায়! প্রিয়সখী যে সহসা অচেতন হয়ে পড়লেন, এর কারণ কি?
পদ্মা । (গাত্রোত্থান করিয়া ব্যগ্রভাবে) সখি, চিত্রকরী কোথায় গেল?
সখী। কৈ, তাকে ত দেখ্তে পাই না। বোধ করি, সে তোমাকে অচেতন দেখে মাধবীর সঙ্গে জল আন্তে গিয়ে থাকবে।
পদ্মা। (ব্যগ্রভাবে) তবে কি সে চিত্রপটখানা সঙ্গে লয়ে গেছে?
সখী। ঐ যে চিত্রপট তোমার সম্মুখেই পড়ে রয়েছে।
পদ্মা। (ব্যগ্রভাবে চিত্রপট লইয়া বক্ষঃস্থলে স্থাপন করিয়া) সখি, এ চিত্রকরীকে তুমি আর কখন দেখেচ?
সখী। প্রিয়সখি, তুমি যে চিত্রপটথানা এত যত্ন করে বুকে লুক্য়ে রাখ্লে?
পদ্মা। আমি যা জিজ্ঞাসা কচ্যি, তার উত্তর দাও না কেন? বলি, এ চিত্রকরীকে তুমি আর কখন দেখেছ?
সখী। ওকে আমি কোথায় দেখবো?
(জল লইয়া পরিচারিকার পুনঃপ্রবেশ।)
পরি। রাজনন্দিনী যে আমি জল না আন্তে আন্তেই সেরে উঠেছেন, তা বেশ হয়েছে।
সখী। হ্যাঁ লা মাধবি, এ পটো মাগী কোন্ দিকে গেল তুই দেখেচিস্?
পরি। কেন? সে না এখানেই ছিল! সে ত কই আমার সঙ্গে যায় নাই। যাই, এখন আমি এ ঘটিটে রেখে আসিগে।
[ প্রস্থান।
পদ্মা। (চতুর্দ্দিক্ অবলোকন করিয়া) কি আশ্চর্য্য! সখি, আমি বোধ করি, এ চিত্রকরী কোন সামান্যা স্ত্রী না হবে।
সখী। (চতুর্দ্দিক্ অবলোকন করিয়া) তাই ত, এ কি পাখী হয়ে উড়ে গেল?
পদ্মা। দেখ, সখি, তুমি কারো কাছে এ কথার প্রসঙ্গ করো না।
সখী। প্রিয়সখি, তুমি যদি বারণ কর, তবে নাই বা কল্যেম। (নেপথ্যে নানাবিধ যন্ত্রধ্বনি) ঐ শোন। সঙ্গীতশালায় গানবাদ্য আরম্ভ হলো। চল, আমরা যাই।
পদ্মা। সখি, তুমি যাও, আমি আরও কিঞ্চিৎকাল এখানে থাক্তে ইচ্ছা করি।
সখী। প্রিয়সখি, তুমি না গেলে কি ওরা কেউ মন দিয়ে গাবে, না বাজাবে?
পদ্মা। আমি গেলেম বল্যে। তুমি গিয়ে নিপুণিকাকে আমার বীণার সুর বাঁধ্তে বল।
সখী। আচ্ছা—তবে আমি চল্যেম।
[ প্রস্থান।
পদ্মা। হে রজনীদেবি, এ নিখিল জগতে কোন্ ব্যক্তি এমন দুঃখী আছে যে, সে তোমার কাছে তার মনের কথা না কয়? দেখ, এই যে ধুতূরাফুল, এ সমস্ত দিন লজ্জায় আর মনস্তাপে মৌনভাবে থাকে, কেন না, বিধাতা একে পরমসুন্দরী করেও এর অধরকে বিষাক্ত করেছেন, কিন্তু তুমি এলে এও লজ্জা সম্বরণ কর্যে বিকশিত হয়। জননি, তুমি পরমদয়াশীলা। (পরিক্রমণ করিয়া) হায়! আমার কি হলো। আজ কয়েক দিন অবধি আমি প্রতি রাত্রে যে একটি অদ্ভুত স্বপ্ন দেখ্চি, তার কথা আর কাকে বল্বো? বোধ হয়, যেন একটি পরমসুন্দর পুরুষ আমার পাশে দাঁড়িয়ে এই বলেন—“কল্যাণি, আমার এই হৃৎসরোবরকে সুশোভিত করবার নিমিত্তেই বিধাতা তোমার মতন কনকপদ্ম সৃষ্টি করেছেন। প্রিয়ে, তুমি আমার।” এইমাত্র বলে সেই মহাত্মা অন্তর্দ্ধান হন। আর এই তাঁরই প্রতিমূর্ত্তি। এই যে চিত্রকরী, যিনি আমাকে এই অমূল্য রত্ন প্রদান করে গেলেন, ইনিই বা কে? (পটের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ ও নিশ্বাস পরিত্যাগ করিয়া) হে প্রাণেশ্বর, তুমি অন্ধকারময় রাত্রে যে গৃহস্থের মন চুরি করেছ, সে তোমাকে এই মিনতি কচ্যে যে তুমি নির্ভয় হয়ে তার আর যা কিছু অবশিষ্ট আছে, তাও এসে অপহরণ কর।
নেপথ্যে। রাজনন্দিনী যে এখনও এলেন না? তিনি না এলে ত আমরা গাইতে আরম্ভ কর্বো না।
পদ্মা। (স্বগত) হায়! আমার এমন দশা কেন ঘট্লো? হে স্বপ্নদেবি, এ যদি তোমারই লীলা হয়, তবে তুমি এ দাসীকে আর বৃথা যন্ত্রণা দিও না। (দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ করিয়া) তা আমি এ সকল কথা কি এ জন্মে আর ভুল্তে পার্বো?
(পরিচারিকার পুনঃপ্রবেশ)
পরি। রাজনন্দিনি, আপনি না এলে ওরা কেউ গাইতে চায় না। আর নিপুণিকাও আপনার বীণার সুর বেঁধেচে।
পদ্মা। তবে চল।
[ উভয়ের প্রস্থান।
(শচী এবং মুরজার প্রবেশ।)
শচী। (সরোষে) সখি, রতিকে ত তুমি ভাল করে চেন না। ওর অসাধ্য কর্ম্ম কি আছে? দেখ, রুদ্রদেব রাগ্লে ভগবতী পার্ব্বতীও তাঁর নিকটে যেতে ভয় পান, কিন্তু রতি অনায়াসে তাঁর কাছে গিয়ে কেঁদে কেঁদে চক্ষের জলে তাঁর কোপানল নির্ব্বাণ করে। রতি ফাঁদ পাত্লে তাতে কে না পড়ে? অমরকুলে এমন মেয়ে কি আর দুটি আছে?
মুর। তাও এখানে এসে কি করেছে?
শচী। কি না করেছে? এই মাহেশ্বরীপুরীর রাজা যজ্ঞসেনের মেয়ে পদ্মাবতীর মতন সুন্দরী নারী পৃথিবীতে নাই। রতি এই মেয়েটির সঙ্গে দুষ্ট ইন্দ্রনীলের বিবাহ দেবার চেষ্টা পাচ্যে। সখি, ইন্দ্রনীলকে যদি রতি এই স্ত্রীরত্নটি দান করে, তবে আমাদের কি আর মান থাক্বে?
মুর। তার সন্দেহ কি? তাও কি প্রকারে এ চেষ্টা পাচ্যে, তার কিছু শুনেছ।
শচী। শুনবো না কেন? ও প্রতি রাত্রে এসে ইন্দ্রনীলের বেশ ধর্যে পদ্মাবতীকে স্বপ্নযোগে আলিঙ্গন দেয়, সুতরাং মেয়েটিও একেবারে ইন্দ্রনীলের জন্যে যেন উম্মত্ত হয়ে উঠেছে।
মুর। বাঃ, রতির কি বুদ্ধি?
শচী। বুদ্ধি? আর শোন না। আবার রাজলক্ষ্মীর বেশ ধারণ কর্যে ও গত রাত্রে রাজা যজ্ঞসেনকে স্বপ্নে বলেছে যে যদি পদ্মাবতীর স্বয়ম্বর অতিশীঘ্র মহা সমারোহে না হয় তবে সে শ্রীভ্রষ্ট হবে।
মুর। কি আশ্চর্য্য! স্বয়ম্বর হলেই ত ইন্দ্রনীল অবশ্যই আস্বে। আর ইন্দ্রনীলকে দেখবামাত্রেই পদ্মাবতী তাকেই বরণ করবে।
শচী। তা হলে আমরা গেলেম! পৃথিবীতে কি আর কেউ আমাদের মান্বে, না পূজা কর্বে? সখি, তোমাকে আর কি বল্বো । এ কথা মনে পড়লে রাগে আমার চক্ষে জল আসে। আর দেখ, রাজা যজ্ঞসেন মন্ত্রীদের লয়ে আজ এই স্বয়ম্বরের বিষয়ে বিচার কচ্যে।
মুর। তবে ত আর সময় নাই। তা এখন কি কর্ত্তব্য? ও কি ও? (নেপথ্যে বহুবিধ যন্ত্রধ্বনি) আহা! কি মধুর ধ্বনি! সখি, একবার কাণ দিয়ে শোন। তোমার অমরাবতীতেও এমন মধুর ধ্বনি দুর্লভ।
শচী। আঃ, তুমিও যেমন। ও সকল কি আর এখন ভাল লাগে?
নেপথ্যে। তুই, সই, আরম্ভ কর্ না কেন?
নেপথ্যে। চুপ্ কর্ লো—চুপ্ কর্। ঐ শোন্, রাজনন্দিনী আরম্ভ কচ্যেন। । (বীণাধ্বনি।)
নেপথ্যে। আহা! রাজনন্দিনি, তুমি কি ভগবতী বীণাপাণির বীণাটা একেবারে কেড়ে নেছ গা?
নেপথ্যে। মর্, এত গোল করিস্ কেন?
নেপথ্যে। (গীত।)
খাম্বাজ—মধ্যমান।
কেন হেরেছিলাম তারে।
বিষম প্রেমের জ্বালা বুঝি ঘটিল আমারে॥
সহজে অবোধ মন,না জানে প্রেম কেমন,
সাধে হয়ে পরাধীন, নিশিদিন ভাবে পরে ।
কত করি ভুলিবারে,মন তা তো নাহি পারে,
যবে যে ভাবনা করে, সে জাগে অন্তরে।
শরমে মরম ব্যথা,নারি প্রকাশিতে কোথা,
জড়ের স্বপন যথা, মরমে মরি গুমরে॥
মুর। শচী দেবি, আমরা কি নন্দনকাননে উর্ব্বশী আর চারুনেত্রার মধুর স্বর শুনে মোহিত হলেম?
শচী। সখি, তুমিও কি এই প্রজ্বলিত হুতাশনে আহুতি দিতে প্রবৃত্ত হলে? দেখ, যদি রতির মনস্কামনা সুসিদ্ধ হয়, তবে এই সুধারস দুষ্ট ইন্দ্রনীলই দিবারাত্র পান কর্বে। (দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ করিয়া) সখি যক্ষেশ্বরি, আমার মতন হতভাগিনী কি আর দুটি আছে? লোকে আমাকে বৃথা ইন্দ্রাণী বলে। আমার পতি বজ্রদ্বারা কত শত উন্নত পর্বতশৃঙ্গকে চূর্ণ করে উড়িয়ে দেন; কত শত বিশাল তরুরাজকে ভস্ম করে ফেলেন; কিন্তু আমি, দেখ, একজন অতিক্ষুদ্র মানবকেও যৎকিঞ্চিৎ দণ্ড দিতে পারলেম না। হায়! আমার বেঁচে আর সুখ কি!
মুর। তবে, সখি, তোমার কি এই ইচ্ছা যে, ইন্দ্রনীলকে শাস্তি দেবার জন্যে এ সুশীলা মেয়েটিকেও কষ্ট দেবে?
শচী। কেন দেব না? পরমান্ন চণ্ডালকে দেওয়া অপেক্ষা জলে ফেলে দেওয়াও ভাল। দেখ, দুষ্টদমনের নিমিত্তে বিধাতা সময়বিশেষে ভগবতী পৃথিবীকেও জলমগ্না করেন।
মুর। তবে, সখি, চল, আমরা কলিদেবের কাছে যাই, তিনি এ বিষয়ের একটা না একটা উপায় অবশ্যই করে দিতে পারবেন।
শচী। (চিন্তা করিয়া) হ্যাঁ, এ যথার্থ কথা। কলিদেবই এ বিষয়ে আমাদের সাহায্য কত্যে পার্বেন। তা সখি, চল, আমরা শীঘ্র তাঁরই কাছে যাই।
[ উভয়ের প্রস্থান।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন