পদ্মাবতী – পঞ্চমাঙ্ক—প্রথম গর্ভাঙ্ক

মাইকেল মধুসূদন দত্ত

পঞ্চমাঙ্ক

প্রথম গর্ভাঙ্ক

শক্রাবতারাভ্যন্তরে শচীতীর্থ।

(শচীর প্রবেশ।)

 শচী। (স্বগত) আমি বসন্তকালে এই তীর্থের নির্ম্মল জলে গাত্র প্রক্ষালন করি, আর এই নিকুঞ্জে যে সকল ফুল ফোটে তা দিয়া কুন্তল সাজিয়ে দেবেন্দ্রের শয়নমন্দিরে যাই,—এই নিমিত্তেই লোকে এ সরোবরকে শচীতীর্থ বলে। এই জলে অবগাহন কল্যে বামাকুলের যৌবন চিরস্থায়ী হয়, আর তাদের অঙ্গের রূপলাবণ্য রসানে মার্জ্জিত হেমকান্তির মতন শতগুণ বৃদ্ধি হয়। (চতুর্দ্দিক্ অবলোকন) আহা, ঋতুরাজ বসন্তের সমাগমে এ কাননের কি অপূর্ব্ব শোভাই হয়েছে!

 নেপথ্যে ।

(গীত)
[ বাহারভৈরবী যৎ। ]

মধুর বসন্ত আগমনে,
মধুপ গুঞ্জরে সঘনে,
করি মধুপান সুখে ফুলকাননে।
কত পিকবরে,
পঞ্চম কুহরে,
মনোহর সে ধ্বনি শ্রবণে।
উপবন যত,
সৌরভ রসিত,
সতত মলয় সমীরণে।
সুখের কারণ,
বসন্ত যেমন,
না হেরি এমন ত্রিভুবনে।
রতিপতি রসে,
মোদিত হরষে,
যুবক যুবতি সুমিলনে॥ শচী। আমার সহচরী অপ্সরীরা ঐ তরুমূলে সুখে গান কচ্যে। মধুকালে কার মন আনন্দ-সাগরে মগ্ন না হয়। (পরিক্রমণ করিয়া) সে যা হৌক, এত দিনের পর দুষ্ট ইন্দ্রনীল সর্ব্বপ্রকারেই সমুচিত দণ্ড পেলে। কি আহ্লাদের বিষয়! কয়েক মাস হলো আমি কলিদেবের সহকারে তার মহিষী পদ্মাবতীকে রাজপুরী হতে অপহরণ করে বনবাস দিয়েছি। এখন ইন্দ্রনীল কান্তার বিরহে শোকার্ত্ত হয়ে আপন রাজ্য পরিত্যাগ করেছে, আর উদাসভাবে দেশদেশান্তর ভ্রমণ কচ্যে। (সরোষে) আঃ পাষণ্ড দুরাচার! তুই শৃগাল হয়ে সিংহীর সঙ্গে বিবাদ করিস্। তা তুই এখন আপন কুকর্ম্মের ফল বিলক্ষণ কর‍্যে ভোগ কর্। তোকে আর এখন কে রক্ষা কর্‌বে?

(পুষ্পপাত্র-হস্তে রস্তার প্রবেশ।)

 রম্ভা। দেবি, এই মালা ছড়াটা একবার গলায় দেন দেখি?

 শচী। কৈ? দে দেখি। (পুষ্পমালা গ্রহণ করিয়া) বাঃ! বেশ গেঁথেছিস্। তা তোর এত বিলম্ব হলো কেন?

 রম্ভা। (সহাস্য বদনে) দেবি, আজ যে আমি কত শত শত্রুকে সমরে হারিয়ে এসেছি, তা শুনলে আপনি অবাক্ হবেন।

 শচী। সে কি লো?

 রম্ভা। (সহাস্য বদনে) যখন আমি এই সকল ফুল তুল্তে আরম্ভ কল‍্যেম, তখন যে কত অলি সরোষে এসে আমার চার দিকে গুনগুন কত্যে লাগ্‌লো, তা আর আপনাকে কি বল্‌বো। দুষ্ট দৈত্যকূল এইরূপেই শঙ্খধ্বনি কর‍্যে স্বর্গপুরী ঘেরে।

 শচী। (সহাস্য বদনে) তা তুই কি কর্‌লি?

 রম্ভা। আর কি করবো? আমি তখন আমার একাবলীর আঁচল নেড়ে এমন পবনবাণ ছাড়্লেম, যে বীরবরেরা সকলেই যুদ্ধে বিমুখ হয়ে বেগে পালালেন।

(ক্রন্দন করিতে করিতে মুরজার প্রবেশ।)

 শচী। (ব্যগ্রভাবে) সখি যক্ষেশ্বরি, এ কি?

 মুর। শচী দেবি, তুমিই আমার সর্ব্বনাশ করেছো!

 শচী। কেন? কেন? কি করেছি?

 মুর। আর কি না করেছো? (রোদন) হায়! হায়! বাছা! আমি কি পৃথিবীর মতন নিষ্ঠুর হয়ে যাকে গর্ভে ধরেছিলেম তাকেই আবার গ্রাস কল্যেম। আমি কি সিংহী আর বাঘিনী অপেক্ষাও মমতাহীন হলেম। হে বিধাতঃ, এ কি তোমার সামান্য লীলাখেলা। (রোদন) হায়! এমন কর্ম্ম মা হয়ে কে কোথায় করেছে? (রোদন।)

 শচী। সখি, বৃত্তান্তটা কি তা তুমি আমাকে ভাল করেই বল না কেন?

 মুর। সখি, আর বল্‌বো কি? ইন্দ্রনীলের মহিষী পদ্মাবতীই আমার বিজয়া। (রোদন।)

 শচী। বল কি? তা এ কথা তোমাকে কে বল্‌লে?

 মুর। আর কে বল্‌বে। স্বয়ং ভগবতী বসুমতীই বলেছেন। (রোদন।)

 শচী। সখি, তুমি না কেঁদে বরং এ সকল কথা আমাকে খুলে বল। ভাল, যদি পদ্মাবতীই তোমার বিজয়া হবে, তবে মাহেশ্বরীপুরীর রাজা যজ্ঞসেন তাকে কোথ্থেকে পেলে?

 মুর। (দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ করিয়া) ভগবতী বসুন্ধরা বিজয়াকে প্রসব কর‍্যে শ্রীপর্ব্বতের উপর কমলকাননে রেখেছিলেন, পরে রাজা যজ্ঞসেন ঐ স্থলে মৃগয়া কত্যে গিয়ে, তাকে পেয়ে আপনার পাটেশ্বরীর হাতে লালন পালনের জন্যে দিয়েছিল। হায়! হায়! বাছা, চিত্রকূটপর্ব্বতের উপর তোমার চন্দ্রানন দেখে আমার স্তনদ্বয় দুগ্ধে পরিপূর্ণ হয়েছিল, তা আমি তোমাকে তাতেও চিন্লেম না? (রোদন।)

 শচী। সখি, তুমি শান্ত হও।

 আকাশে। (বীণাধ্বনি।)

 শচী। এ কি? (আকাশমার্গে দৃষ্টিপাত করিয়া) এই যে দেবর্ষি নারদ এই দিকে আস্চেন। সখি, তুমি সাবধান হও, এই ধূর্ত্ত ব্রাহ্মণই এ বিপদের মূল; দেখো—ও যেন আবার কন্দল বাধাতে না পারে।

(নারদের প্রবেশ।)

 উভয়ে। ভগবন্, আমরা আপনাকে অভিবাদন করি।

 নার। আপনাদের কল্যাণ হউক।

 শচী। দেবর্ষি সংবাদ কি? আজ্ঞা করুন দেখি?

 নার। দেবি, সকলই সুসংবাদ। ভগবতী পার্ব্বতী আমাকে অদ্য আপনাদের সমীপে প্রেরণ করেছেন।

 শচী। কেন? ভগবতীর কি আজ্ঞা?

 নার। তিনি শুনেছেন যে আপনারা নাকি বিদর্ভনগরের রাজা পরম শিবভক্ত ইন্দ্রনীল রায়কে কলিদেবের সাহায্যে নানা ক্লেশ দিতে প্রবৃত্ত হয়েছেন।—

 শচী। ভগবন্, তা ভগবতী পার্ব্বতীকে এ কথা কে বল্‌লে?

 নার। ভগবতী এ কথা রতি দেবীর মুখেই শ্রবণ করেছেন।

 শচী। (স্বগত) কি সর্ব্বনাশ! এ দুষ্টা রতির কি কিছুমাত্র লজ্জা নাই? এমন কথাও কি মহেশ্বরীর কর্ণগোচর করা উচিত? (প্রকাশে) দেবর্ষি, তা ভগবতী এ কথা শুনে কি আদেশ করেছেন?

 নার। ভগবতীর এই ইচ্ছা যে আপনারা এ বিষয়ে ক্ষান্ত হয়েন।

 শচী। ভাল, তা যেন হলেন। কিন্তু এখন পদ্মাবতীই বা কোথায় আর ইন্দ্রনীলই বা কোথায়—তা কে জানে?

 নার। (সহাস্য বদনে) তন্নিমিত্তে আপনি চিন্তিত হবেন না। রাজমহিষী পদ্মাবতী এক্ষণে তমসা নদীতীরে মহর্ষি অঙ্গিরার আশ্রমে বাস কচ‍্যেন।

 শচী। (স্বগত) হায়! আমার এত পরিশ্রম কি তবে বৃথা হলো? আর অবশেষে রতিই জিত্‌লে! তা করি কি? ভগবতী গিরিজার আজ্ঞা উল্লঙ্ঘন করা কার সাধ্য। স্রোতস্বতীর পথ রুদ্ধ কত্যে কে পারে?

 নার। আমি মহাদেবীর আজ্ঞানুসারে যতীন্দ্র অঙ্গিরার আশ্রমে গমন কত্যে আকাঙ্ক্ষা করি, অতএব আপনারা আমাকে এক্ষণে বিদায় করুন।

 মুর। ভগবন্, আপনি আমাকে সেখানে সঙ্গে লয়ে চলুন।

 শচী। চলুন, আমিও আপনাদের সঙ্গে যাই। (রম্ভার প্রতি) রম্ভা, তুই এখন অমরাবতীতে যা। আমি একবার যোগিবর অঙ্গিরার আশ্রম থেকে আসি।

 রম্ভা। যে আজ্ঞে।

[ নারদ, শচী এবং মুরজার প্রস্থান।

আমি আর এখানে একলা থেকে কি কর্‌বো? যাই, দেখিগে নন্দনকাননে এখন কি হচ্যে।

[ প্রস্থান।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন