পদ্মাবতী – দ্বিতীয়াঙ্ক—দ্বিতীয় গর্ভাঙ্ক

মাইকেল মধুসূদন দত্ত

দ্বিতীয় গর্ভাঙ্ক

মাহেশ্বরীপুরী—রাজনিকেতন।

(কঞ্চুকীর প্রবেশ।)

 কঞ্চু। (স্বগত) আহা! শৈলেন্দ্রের গলে শোভে যে রতন—

সে অমূল ধন কভু সহজে কি তিনি
প্রদান করেন পরে? গজরাজ-শিরে
ফলে যে মুকুতারাজি, কে লভয়ে কবে
সে মুকুতারাজি, যদি না বিদরে আগে
সে শিরঃ? সকলে জানে, সুরাসুর মিলি
মথিয়া কত যতনে সাগর, লভিলা
অমৃত—কত পীড়নে পীড়ি জলনিধি!
হায় রে, কে পারে পরে দিতে ইচ্ছা করি,
যে মণিতে গৃহ তার উজ্জ্বল সতত। (চিন্তা করিয়া)
বিধির এ বিধি কিন্তু কে পারে লঙ্ঘিতে?—
ছায়ায় কি ফল কবে দরশে তরুর?
সরোবরে ফুটিলে কমল, লোকে তারে
তুলে লয়ে যায় সুখে! মলয়-মারুত,
কুসুম কানন-ধন সুরভিরে হরি,
দেশ দেশান্তরে চলি যান কুতূহলে।
হিমাদ্রির কনক ভবন ত্যজি সতী—
ভবভাবিনী ভবানী—ভজেন ভবেশে। (পরিক্রমণ)
যার ঘরে জনমে দুহিতা, এ যাতনা
ভোগী সে! (দীর্ঘনিশ্বাস)—

প্রভো, তোমারই ইচ্ছা। যা হৌক, মহারাজ যে এখন রাজনন্দিনী পদ্মাবতীর স্বয়ম্বরে সম্মত হয়েছেন, এ পরম আহলাদের বিষয়। এখন জগদীশ্বর এই করুন যে কন্যাটি যেন একটি উপযুক্ত পাত্রের হাতেই পড়ে। (নেপথ্যাভিমুখে অবলোকন করিয়া প্রকাশে) কে ও?

(সখীর প্রবেশ।)

বসুমতী না? আরে এস, দিদি এস! আমি বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ—কালক্রমে প্রায়ই অন্ধ হয়েছি, কিন্তু তবু ও পূর্ণশশীর উদয় হল‍্যে তাঁকে চিন্‌তে পারি। এস এস।

 সখী। ঠাকুরদাদা, প্রণাম করি।

 কঞ্চু। কল্যাণ হউক্।

 সখী। মহাশয়, আমার প্রিয়সখীর নাকি স্বয়ম্বর হবে?

 কঞ্চু। এ কথা তোমাকে কে বলো?

 সখী। যে বলুক্ না কেন? বলি এ সত্য ত?

 কঞ্চু। বাঃ, কেমন করে সত্য হবে? তোমার প্রিয়সখী ত আর পাঞ্চালী নন যে তাঁর পঞ্চ স্বামী হবে। আমি বেঁচে থাক্‌তে তাঁর কি আর বিবাহ হত্যে পারে? গৌরী কি হরকে বৃদ্ধ বল‍্যে ত্যাগ কত্যে পারেন? (হাস্য।)

 সখী। (স্বগত) দূর বুড়ো। (হস্ত ধারণ করিয়া প্রকাশে) ঠাকুরদাদা, আপনার পায়ে পড়ি, বলুন না, এ কথাটা কি সত্য?

 কঞ্চু। আরে কর কি? পায়ে হাত দিও না। তুমি কি জান না, নীরস তরুকে দাবানল স্পর্শ কর্‌লে, সে যে তৎক্ষণাৎ জ্বলে যায়।

 সখী। তবে আমি চল্যেম।

 কঞ্চু। কেন?

 সখী। এখানে থেকে আবশ্যক কি? আপনার কাছে ত কোন কথাটিই পাওয়া যায় না।

 কঞ্চু। (হাস্যবদনে) আরে, আমি রাজসংসারে চাকুরী করে বুড়ো হয়েছি। আমাকে ঘুষ না দিলে কি আমার দ্বারা কোন কর্ম্ম হতে পারে? ঘানিগাছে তেল না দিলে সে কি সহজে ঘোরে?

 সখী। আচ্ছা! রাজমাতার জন্যে সোণার হামান্‌দিস্তায় যে পান মস্‌লা দিয়ে ছেঁচে, তাই আপনাকে না হয় একটু এনে দেব? তা হলে ত হবে?

 কঞ্চু। সুদু পান নিয়ে কি হবে? মিঠাই টিঠাই কিছু দিতে পার কি না?

 সখী। হাঁ! পারবো না কেন?

 কঞ্চু। তবে বলি। এ কথা যথার্থ। তোমার প্রিয়সখীর স্বয়ম্বর হবে।

 সখী। (ব্যগ্রভাবে) হ্যাঁ মহাশয়, কবে হবে?

 কঞ্চু। অতি শীঘ্রই হবে। মহারাজ মন্ত্রিবরকে স্বয়ম্বরের সমুদয় আয়োজন কত্যে অনুমতি করেছেন। আর কাল প্রাতে দূতেরা নিমন্ত্রণপত্র লয়ে দেশ দেশান্তরে যাত্রা কর্‌বে। দেখো, এ পদ্মের গন্ধে অলিকুল একবারে উন্মত্ত হয়ে উড়ে আস্‌বে। ও কি ও! তুমি যে কাঁদ্তে আরম্ভ কল‍্যে। তোমাকে ত আর শ্বশুরবাড়ী যেতে হবে না।

 সখী। (চক্ষু মুছিয়া) কৈ? আমি কাঁদছি আপনাকে কে বল্‌লে? (রোদন।)

 কঞ্চু। আরে ঐ যে। কি কি উৎপাত! তা তোমার জন্যেও না হয় একটা বর ধরে দেব, তার নিমিত্তে ভাবনা কি? তোমার প্রিয়সখী ত আর সকলকে বরণ করবেন না। আর যদি তুমি রাজকুলে বিয়ে কত্যে না চাও—তবে শর্ম্মা ত রয়েছেন।

 সখী। আঃ, যাও, মিছে ঠাট্টা করো না। (রোদন।)

(পরিচারিকার প্রবেশ।)

 পরি। কঞ্চুকী মহাশয়, প্রণাম করি।

 কঞ্চু। এস, কল্যাণ হউক্। (স্বগত) এ গস্তানী আবার কোথ্থেকে এসে উপস্থিত হলো? কি আপদ্। এ যে গঙ্গায় আবার যমুনা এসে পড়লেন। এখন ত আর জলের অভাব থাক্‌বে না।

 সখী। মাধবি, প্রিয়সখী যথার্থই এত দিনের পর আমাদের ছেড়ে চল্‌লেন। (রোদন।)

 পরি। (ব্যগ্রভাবে) কেন, কেন? কি হয়েছে?

 সখী। আমরা যে স্বয়ম্বরের কথা শুনেছিলাম, সে সকলই সত্য হলো। (রোদন।)

 কঞ্চু। (স্বগত) আহা! প্রণয়পদ্মের মৃণালে যে কণ্টক জন্মে, সে কি সামান্য তীক্ষ্ণ? আর তার বেঁধনে যে প্রাণ কি পর্য‍্যন্ত ব্যথিত হয়, তা সে বেদনা যে সহ্য করেছে, সেই কেবল বল্তে পারে। (প্রকাশে) আরে, তোরা যে কেঁদেই অস্থির হলি! এমন কথা শুনে কি কাঁদ্তে হয়? রাজনন্দিনী কি চিরকাল আইবড় থাক্‌লে তোরা সুখী হবি?

 পরি। বালাই। তাঁর শত্রু আইবড় থাকুক্, তিনি থাক্‌বেন কেন?

 কঞ্চু। তবে তোরা কাঁদিস্ কেন লা?

 পরি। তুমিও যেমন। কে কাঁদচে? তুমি কাণা হলে নাকি?

 কঞ্চু। তবে তুই, ভাই, একবার হাস্ ত, দেখি?

 পরি। হাস্‌বো না কেন? এই দেখ (হাস্য ও রোদন।)

 কঞ্চু। বেশ। ওলো মাধবি, লোকে বলে, রৌদ্রে বৃষ্টি হলে খেঁকশিয়ালীর বিয়ে হয়, তা আমি দেখ্চি তোরও বিয়ে অতি নিকট।

 পরি। কেন? আমি কি খেঁকশিয়ালী। যাও, মিছে গাল দিও না।

 সখী। ওলো মাধবি, চল্ আমরা যাই।

 পরি। চল।

[ উভয়ের ক্রন্দন করিতে করিতে প্রস্থান।

 কঞ্চু। (স্বগত) আমাদের পদ্মাবতীর রূপ লাবণ্য দেখ্লে কোন মতেই বিশ্বাস হয় না যে, এর মানবকুলে জন্ম। সৌদামিনী কি কখন ভূতলে উৎপন্ন হয়? আর এ যে কেবল সৌন্দর্য্য গুণে চক্ষের সুখকরী মাত্র, তা নয়,—এমন দয়াশীলা পরোপকারিণী কামিনী কি আর আছে? আর তা না হবেই বা কেন? পারিজাত পুষ্প কি কখন সৌরভহীন হতে পারে? আহা! এ মহার্হ রত্ন কোন্ রাজগৃহ উজ্জ্বল কর্‌বে হে?

 নেপথ্যে বৈতালিক।

গীত। পরজ কালংড়া—একতালা।

অপরূপ আজিকার রাজসভা শোভিল!
জিনি অমরাপুরী, নৃপপুর হইতেছে;
বিভবে সুরেন্দ্র লাঞ্জ পাইল॥

মোহনমুরতি অতি রাজন রাজিছে,
রতিপতি ভাতি হেরি মোহিল ।
তুলনা দিবার তবে, রজনী সে আপনি
শশীরে সাজায়ে ধনী আনিল॥

 কঞ্চু। (স্বগত) এই ত মহারাজ সভা হতে গাত্রোত্থান কল্যেন । এখন যাই, আপনার কর্ম্ম দেখিগে।

[ প্রস্থান।

ইতি দ্বিতীয়াঙ্ক।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন