পদ্মাবতী – চতুর্থাঙ্ক—প্রথম গর্ভাঙ্ক

মাইকেল মধুসূদন দত্ত

চতুর্থাঙ্ক

প্রথম গর্ভাঙ্ক

বিদর্ভ নগর-তোরণ।

(সারথিবেশে কলির প্রবেশ।)

কলি। (স্বগত) আমি কলি; এ বিপুল বিশ্বে কে না কাঁপে
শুনিয়া আমার নাম? সতত কুপথে
গতি মোর। নলিনীরে সৃজেন বিধাতা—
জলতলে বসি আমি মৃণাল তাহার
হাসিয়া কণ্টকময় করি নিজবলে।
শশাঙ্ক যে কলঙ্কী—সে আমার ইচ্ছায়!
ময়ুরের চন্দ্রক-কলাপ দেখি, রাগে
কদাকারে পা-দুখানি গড়ি তার আমি!(পরিক্রমণ।)
জন্ম মম দেবকুলে; অমৃতের সহ
গরল জন্মিয়াছিল সাগর-মথনে।
ধর্ম্মাধর্ম্ম সকলি সমান মোর কাছে।
পরের যাহাতে ঘটে বিপরীত, তাতে
হিত মোর; পরদুঃখে সদা আমি সুখী।
(চিন্তা করিয়া) এ বিদর্ভপুরে,—
নৃপতি রাজেন্দ্র ইন্দ্রনীল; তার প্রতি
অতি প্রতিকূল এবে ইন্দ্রাণী সুন্দরী,
আর মুরজা রূপসী, কুবের-রমণী;—
এ দোঁহার অনুরোধে, মায়া-জালে আমি
বেড়িয়াছি নৃপবরে, নিষাদ যেমতি
ঘেরে সিংহে ঘোর বনে বধিতে তাহারে।
মাহেশ্বরীপুরীর ঈশ্বর যজ্ঞসেন—
পদ্মাবতী নামে তার সুন্দরী নন্দিনী;
ছদ্মবেশে বরি তারে রাজা ইন্দ্রনীল

আনিয়াছে নিজালয়ে; এ সংবাদ আমি
ভাটবেশে রটিয়া দিয়াছি দেশে দেশে।
পৃথিবীর রাজকুল মহারোষে আসি
থানা দিয়া বসিয়াছে এ নগর-দ্বারে—

 নেপথ্যে। (ধনুষ্টঙ্কার ও শঙ্খনাদ।)

কলি। (স্বগত) ঐ শুন—
বীর দর্পে তা সবার সঙ্গে যুঝে এবে
ইন্দ্রনীল। (চিন্তা করিয়া) এই অবসরে যদি আমি
রাণী পদ্মাবতীরে লইতে পারি হরি—
তা হলে কামনা মোর হবে ফলবতী।
প্রেয়সী-বিরহ শোকে ইন্দ্রনীল রায়
হারাইবে প্রাণ, ফণী মণি হারাইলে
মরে বিষাদে। এ হেতু সারথির বেশে
আসিয়াছি হেথা আমি। (পরিক্রমণ।) কি আশ্চর্য্য!
অহো—
এ রাজকুলের লক্ষ্মী মহাতেজস্বিনী!
এর তেজে এ পুরীতে প্রবেশ করিতে
অক্ষম কি হইনু হে? (সহাস্য বদনে) কেনই না হব?
অমৃত যে দেহে থাকে, শমন কি কভু
পারে তারে পরশিতে? দেখি, ভাগ্যক্রমে
পাই যদি রাণীরে এ তোরণ সমীপে।
(চতুর্দ্দিক্ অবলোকন করিয়া সপুলকে) এ কি?
ওই না সে পদ্মাবতী? আয় লো কামিনি—
এইরূপে কুরঙ্গিনী নিঃশঙ্কে অভাগা
পড়ে কিরাতের পথে; এইরূপে সদা
বিহঙ্গী উড়িয়া বসে নিষাদের ফাঁদে। (চিন্তা করিয়া)
কিঞ্চিৎ কালের জন্যে অদৃশ্য হইয়া
দেখি কি করা উচিত। (অন্তর্ধান।)

(অবগুণ্ঠিকাবৃতা পদ্মাবতী এবং সখীর প্রবেশ।)

 সখী। প্রিয়সখি, এ সময়ে পাঁচীরের বাইরে যাওয়া কোন মতেই উচিত হয় না। তা এসো আমরা এখানেই দাড়াই। আর এ তোরণ দিয়েও কই কেউ ত বড় যাওয়া আসা কচ্যে না? এ এক প্রকার নির্জ্জন স্থান।

 পদ্মা। (দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ করিয়া) সখি, সখি, আমার মতন হতভাগিনী কি আর দুটি আছে? দেখ, প্রাণেশ্বর আমার জন্যে কি ক্লেশই না পেলেন! আর এই যে একটা ভয়ঙ্কর সমর আরম্ভ হয়েছে, যদি ভগবতী পার্ব্বতীর চরণপ্রসাদে এ হতে আমরা নিস্তার পাই, তবুও যে কত পতিহীনা স্ত্রী, কত পুত্রহীনা জননী, কত যে লোক আমার নাম শুনলেই শোকানলে দগ্ধ হয়ে আমাকে যে কত অভিসম্পাত দেবে, তা কে বল্তে পারে? হে বিধাতঃ, তুমি আমার অদৃষ্টে যে সুখভোগ লেখো নাই, আমি তার নিমিত্তে তোমাকে তিরস্কার করি না, কিন্তু তুমি আমাকে পরের সুখনাশিনী কলো কেন? (রোদন।)

 সখী। প্রিয়সখি, তুমি এমন কথা মনেও কর‍্যো না। তোমার জন্যেই যে রাজারা কেবল যুদ্ধ করো মর্চ‍্যে তা নয়। এ পৃথিবীতে এমন কর্ম্ম অনেক স্থানে হয়ে গেছে। দ্রৌপদীর স্বয়ম্বরে কি হয়েছিল তা কি তুমি শোন নি?

 পদ্মা। সখি, তুমি পাঞ্চালীর কথা কেন কও? শশীর কলঙ্কে তাঁর শ্রীর হ্রাস না হয়্যে বরঞ্চ বৃদ্ধিই হয়।—

 নেপথ্যে। (ধনুষ্টঙ্কার হুঙ্কারধ্বনি এবং রণবাস্থ্য।)

 পদ্মা। (সত্রাসে) উঃ! কি ভয়ঙ্কর শব্দ। সখি, তুমি আমাকে ধর। এই দেখ বীরদলের পায়ের ভরে বসুমতী যেন কেঁপে কেঁপে উঠ্ছেন।

 সখী। (আকাশমার্গে দৃষ্টিপাত করিয়া) কি সর্ব্বনাশ! প্রিয়সখি, দেখ আকাশ থেকে যেন অগ্নিবৃষ্টি হচ্যে! এমন অদ্ভুত শরজাল ত আমি কখনও দেখি নাই ।

 পদ্মা। কি সর্ব্বনাশ! সখি, আমার কি হবে (রোদন।)

 সখী। প্রিয়সখি! তুমি কেঁদো না! আর ভয় নাই, ঐ দেখ, যখন রাজসারথি এই দিকে আস্চে তখন বোধ হয় মহারাজ অবশ্যই শত্রুদলকে পরাভব করে থাক্‌বেন।

 পদ্মা। (নেপথ্যাভিমুখে অবলোকন করিয়া) কি সর্ব্বনাশ! সারথি যে একলা আস্চে?

(সারথি-বেশে কলির পুনঃপ্রবেশ।)

সারথি, তুমি যে রাজরথ ত্যাগ করে আস্চো?

 কলি। মহিষি, আপনি এত উতলা হবেন না। মহারাজ এ দাসকে আপনার নিকটেই পাঠিয়েছেন।

 পদ্মা। কেন? কি সংবাদ, তা তুমি আমাকে শীঘ্র করে বল।

 কলি। আজ্ঞা—সকলই সুসংবাদ, মহারাজ অন্য এক রথে আরোহণ করে আমাকে এই বল্যে আপনার নিকট পাঠিয়েছেন, যে আপনি কিঞ্চিৎ কালের জন্যে রাজপুরী ছেড়ে ঐ পর্ব্বতের দুর্গে গিয়ে থাকুন। আর এ দাসও নরবরের আজ্ঞায় এই রথ এনেছে। তা দেবীর কি আজ্ঞা হয়?

 সখী। প্রিয়সখি, তুমি যে চুপ্ করে রৈলে?

 পদ্মা। (দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ করিয়া) সখি, আমি এ নগর ছেড়ে কেমন করে যাই?—

 নেপথ্যে। (ধনুষ্টঙ্কার হুঙ্কারধ্বনি ও রণবাদ্য।)

 সখী। উঃ! কি ভয়ঙ্কর শব্দ! সারথি, কৈ, রথ কোথায়? তুমি আমাদের শীঘ্র নিয়ে চল।

 কলি। (স্বগত) এ হতভাগিনীরও মরণেচ্ছা হলো না কি? তা যে শিশিরবিন্দু পুষ্পদলে আশ্রয় লয়, সে কি সূর্য্যের প্রচণ্ড কিরণ হতে কখন রক্ষা পেতে পারে? (প্রকাশে) দেবি, তবে আসুন।

 পদ্মা। (স্বগত) হে আকাশমণ্ডল, তোমাকে লোকে শব্দবাহ বলে। তা তুমি এ দাসীর প্রতি অনুগ্রহ কর‍্যে আমার এই কথাগুলিন্ আমার জীবিতনাথের কর্ণকুহরে সাবধানে লয়ে যাও। হে রাজন্, তোমার পদ্মাবতী তোমার আজ্ঞা পালন কল‍্যে; কিন্তু তার প্রাণটি এ রণক্ষেত্রে তোমার নিকটেই রৈল। দেখ, চাতকিনী বজ্র বিদ্যুৎ আর প্রবল বায়ুকেও ভয় না কর‍্যে, জলধরের প্রসাদ প্রতীক্ষায় কেবল তার সঙ্গেই উড়তে থাকে।

 সখী। প্রিয়সখি, চল। আমরা যাই।

 পদ্মা। (দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ করিয়া) তবে চল।

 কলি। (স্বগত) গরুড় ভুজঙ্গিনীকে ধরে উড়লেন।

[ সকলের প্রস্থান।

(রক্তাক্ত বস্ত্র পরিধানে ও রক্তার্জ অসি হস্তে বিষকের প্রবেশ।)

 বিদূ। (চতুর্দ্দিক্ অবলোকন করিয়া স্বগত) রাম বল, বাঁচলেম। বেশ পালিয়েছি। আরে, আমি দরিদ্র ব্রাহ্মণ, আমার কি এ সকল ভাল লাগে? তবে করি কি? তুষ্ট ক্ষত্রদলের সঙ্গে কেবল এ পোড়া পেটের জ্বালায় সহবাস কত্যে হয়। তা একটু আদ্টু সাহস না দেখালে বেটারা নিতান্ত হেয়জ্ঞান করবে বল‍্যে, আমি এই খাঁড়াখানা নিয়ে বেরিয়েছি—যেন যুদ্ধ কত‍্যেই গিয়েছিলেম। আর এই যে রক্ত দেখ্ছো, এত রক্ত নয় । এ—আল্‌তা-গোলা। (উচ্চহাস্য।) এই যুদ্ধের কথা শুনে ব্রাহ্মণীর সিঁদুর-চুপড়ী থেকে খানকতক আল্তা চুরি করে টেঁকে গুঁজে রেখেছিলাম। আর কেন যে রেখেছিলেম তা সামান্য লোকের বুঝে উঠা দুষ্কর। ওহে, যেমন সিংহের অস্ত্র দাঁত, ষাঁড়ের অস্ত্র শিঙ্, হাতীর অস্ত্র শুঁড়, পাখীর অস্ত্র ঠোঁট আর নখ, ক্ষত্রকুলের অস্ত্র ধনুর্ব্বাণ, তেমনি ব্রাহ্মণের অস্ত্র—বিদ্যা আর বুদ্ধি। তা বিদ্যা বিষয়ে ত আমার ক অক্ষর গোমাংস; তবে কি না একটু বুদ্ধি আছে। আর তা না থাক্‌লে কি এত করে উঠ্তে পাত্যেম? বল দেখি, আমার কাপড় আর এই খাঁড়া দেখে কে না ভাব্‌বে যে আমি শত শত হাতী আর ঘোড়া আর যোদ্ধাদেরকে যমের বাড়ী পাঠিয়ে এসেছি? (উচ্চহাস্য।) তা দেখি আজ মহারাজ এ বেশ দেখে আমাকে কি পুরস্কার করেন? হে দুষ্টে সরস্বতি, তুমি এসে আমার কাঁধে ভর কর, তা না কল‍্যে কর্ম্ম চলবে না। আজ যে আমাকে কত মিথ্যা কথা কইতে হবে তার সংখ্যা নাই।

(কতিপয় নাগরিকের প্রবেশ।)

 প্রথম। এই যে আর্য্য মানবক এখানে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। মহাশয়, প্রণাম করি। (নিকটবর্ত্তী হইয়া সচকিতে) ইঃ, এ কি?

 বিদূ। কেন, কি হলো?

 প্রথম। মহাশয়, আপনার সর্ব্বাঙ্গে যে রক্ত দেখ্ছি।

 বিদূ। দেখ্‌বে না কেন? ওহে, দোল্ দেখ্তে গেলে কি গায়ে আবীর লাগে না?

 দ্বিতীয়। তবে মহাশয় রণক্ষেত্রে গিয়েছিলেন নাকি?

 বিদূ। যাব না কেন? কি হে, তুমি কি ভেবেছো যে আমি একটা টোলের ভট্চার্য্য—দেড়গজী সমাস ভিন্ন কথা কই না, আর বিচারসভাতেই কেবল দ্রোণাচার্যের বীর্য‍্য দেখাই, কিন্তু একটু মারামারির গন্ধ পেলেই ব্রাহ্মণীর আঁচল ধর‍্যে তার পেছন দিকে গিয়ে লুকুই! (উচ্চহাস্য।)

 দ্বিতীয়। না, না, তাও কি হয়? আপনি এক জন মহাবীরপুরুষ। তা কি সংবাদ, বলুন দেখি শুনি?

 বিদূ। আর কি সংবাদ? দেখ, যেমন জমদগ্নির পুত্র ভীষ্ম—

 প্রথম। মহাশয়, জমদগ্নির পুত্র ভৃগুরাম।

 বিদূ। তাই ত! তা এ গোলে কি কিছু মনে থাকে হে? দেখ, যেমন জমদগ্নির পুত্র ভৃগুরাম পৃথিবীকে নিঃক্ষত্রিয়া করেছিলেন, এ ব্রাহ্মণও আজ তাই করেছে।

 নেপথ্যে। (জয়বাদ্য।)

 প্রথম। এই যে মহারাজ, শত্রুদলকে রণস্থলে জয় করে ফিরে আস্চেন।

 নেপথ্যে। (মহারাজের জয় হউক।)

 তৃতীয়। চল হে, রাজদর্শনে যাওয়া যাউক।

 নেপথ্যে। (বৈতালিকের গীত।)

মাজসুরট—একতালা।
কি রঙ্গ রাজভবনে, কি রঙ্গ আজ—
করিয়া রণ, শত্রুনিধন, রাজনবর রাজে ।
পুলকে সব হইল মগন,উৎসবরত যত পুরজন,
জয় জয় রবপূর্ণ গগন, নৌত ঘন বাজে॥
সৈন্যসকল সমরকুশল,নিরখি ভীত অরিদলবল,
কম্পিত হয় ধরণীতল, বালুকি নত লাজে।
ভূপতি অতি বীর্য্যবান,বিভব নিবহ স্মরসমান,
ইন্দ্র যেন শোভমান, মর্ত্তভুবন মাজে॥ নেপথ্যে। ওরে, একজন দৌড়ে গিয়ে আর্য্য মানবককে শীঘ্র ডেকে আন্গে তো। মহারাজ তাঁর অন্বেষণ কচ‍্যেন।

 বিদূ। ঐ শোন। দেখি মহারাজ আমাকে আজ কি শিরোপা দেন।

[ প্রস্থান।

 প্রথম। এ ব্রাহ্মণ বেটা কি সামান্য ধূর্ত্ত গা?

 দ্বিতীয়। এমন নির্লজ্জ পুরুষ কি আর পৃথিবীতে দুটি আছে?

 তৃতীয় । তবে ও আল্তা-গোলা বটে?

 প্রথম। তা বই কি? ও কি আর যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়েছিলো?

 দ্বিতীয়। মহাশয়, চলুন রাজদর্শন করিগে।

 প্রথম। চল।

[ সকলের প্রস্থান।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন