পদ্মাবতী – তৃতীয়াঙ্ক—প্রথম গর্ভাঙ্ক

মাইকেল মধুসূদন দত্ত

তৃতীয়াঙ্ক

প্রথম গর্ভাঙ্ক

মাহেশ্বরীপুরী—রাজনিকেতন-সন্নিধানে মদনোদ‍্যান।

(ছদ্মবেশে রাজা ইন্দ্রনীল এবং বিদূষকের প্রবেশ।)

 রাজা । সখে মানবক!

 বিদূ। মহারাজ—

 রাজা। আরে ও আবার কি? আমি একজন বণিক্; তুমি আমার মিত্র; আমরা দুজনে এই মাহেশ্বরীপুরীর রাজকন্যা পদ্মাবতীর স্বয়ম্বর-সমারোহ দেখবার জন্যেই এ রাজ্যে এসেছি—

 বিদূ। আজ্ঞা—আর বল্তে হবে না।

 রাজা। তবে তুমি এই শিলাতলে বসো, আমি ঐ দেবালয়ের নিকটে সরোবর থেকে একটু জল পান কর‍্যে আসি। আঃ, এই নগর ভ্রমণ করে আমি যে কি পর্যন্ত ক্লান্ত হয়েছি তার আর কি বল্‌বো।

 বিদূ। তবে আপনি কেন এখানে বসুন না, আমিই আপনাকে জল এনে দিচ্চি। ব্রাহ্মণের জল খেলে ত আর বেণের জাত যায় না।

 রাজা। (সহাস্য বদনে) সখে, তা ত যায় না বটে, কিন্তু জল আন্‌বে কিসে করে? এখানে পাত্র কোথায়? তুমি ত আর পবনপুত্র হনুমান্ নও, যে ঔষধ না পেয়ে একবারে গন্ধমাদনকে উপ্ড়ে এনে ফেল্‌বে! তুমি থাক, আমি আপনিই যাই।

[ প্রস্থান।

 বিদূ। (স্বগত) হায়! আমার কি দুরদৃষ্ট! দেখ, এই মাহেশ্বরীপুরীর রাজার মেয়ের স্বয়ম্বর হবে বল্যে, প্রায় এক লক্ষ রাজা এখানে এসে উপস্থিত হয়েছে; আর এই নগরের চারি দিকে যে কত তাম্বু আর কানাত পড়েছে তার সংখ্যা নাই । কত হাতী, কত ঘোড়া, কত উট, কত রথ আর যে কত লোকজন এসে একত্র হয়েছে তা কে গুণে ঠিক কত‍্যে পারে? আর কত শত স্থানে যে নট নটীরা নৃত্যগীত কচ্যে তা বলা দুষ্কর। আর যেমন বর্ষাকালে জল পর্ব্বত থেকে শত স্রোতে বেরিয়ে যায়, রাজভাণ্ডার থেকে সিদেপত্র তেম্‌নিই বেরুচ্যে। আহা! কত যে চাল, কত যে ডাল, কত যে তেল, কত যে লবণ, কত যে ঘি, কত যে সন্দেশ, কত যে দই, কত যে দুধ ভারে ভারে আস্চে যাচ্যে তা দেখ্লে একেবারে চক্ষুঃ স্থির হয়। রাজাবেটার কি অতুল ঐশ্বর্য‍্য! (দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ করিয়া) তা দেখ, এ হতভাগা বামণের কপালে এর কিছুই নাই । আমাদের মহারাজ কল‍্যেন কি, না সঙ্গে যত লোকজন এসেছিল তাদের সকলকে দূরে রেখে কেবল আমাকে লয়ে ছদ্মবেশে এ নগরে এসে ঢুকেছেন। এতে যে ওঁর কি লাভ হবে তা উনিই জানেন। তবে লাভের মধ্যে আমি দরিদ্র ব্রাহ্মণ আমার দক্ষিণাটি দেখ্চি লোপাপত্তি হবে। হায়! এ কি সামান্য দুঃখের কথা? (চিন্তা করিয়া) মহারাজ একটা মেয়েমানুষকে স্বপ্নে দেখে এই প্রতিজ্ঞা করে বসেছেন, যে তাকে না পেলে আর কাকেও বিয়ে কর্‌বেন না। হায়! দেখ দেখি, এ কত বড় পাগ্‌লামি। আর—আমি যে রাত্রে স্বপ্নে নানা রকম উপাদেয় মিষ্টান্ন খাই তা বল‍্যে কি আমার ব্রাহ্মণী যখন থোড় ছেঁচ্কি, কি কাঁচকলা ভাতে, কি বেগুন পোড়া এনে দেয়, তখন কি সে সব আমি না খেয়ে পাতে ঠেলে রেখে দি? সাগর সকল জলই গ্রহণ করেন। অগ্নিদেবকে যা দাও তাই তিনি চক্ষুর নিমিষে পরিপাক কর‍্যে ভষ্ম করে ফেলেন।

(রাজার পুনঃপ্রবেশ।)

 রাজা। কি হে সখে মানবক, তুমি যে একেবারে চিত্তাসাগরে মগ্ন হয়ে রয়েছো?

 বিদূ। মহারাজ—

 রাজা। মর্ বানর। আবার?

 বিদূ। আজ্ঞা—না। তা আপনার এত বিলম্ব হলো কেন?

 রাজা। সখে, আমি এক অদ্ভুত স্বয়ম্বর দেখতেছিলেম।

 বিদূ। বলেন কি? কোথায়?

 রাজা। সখে, ঐ সরোবরে কমলিনী আজ যেন স্বয়ম্বরা হয়েছে। আর তার পাণিগ্রহণ লোভে ভগবান্ সহস্ররশ্মি, মলয়মারুত, অলিরাজ, আর রাজহংস—এঁরা সকলেই এসে উপস্থিত হয়েছেন। আর কত যে কোকিলকুল মঙ্গলধ্বনি কচ্যে তা আর কি বল্‌বো। এসো সখে, আমরা ঐ সরোবরকূলে যাই।

 বিদূ। ভাল—মহাশয়, আপনি যে আমাকে নিমন্ত্রণ কচ‍্যেন, তা বলুন দেখি, আমার দক্ষিণা কে দেবে?

 রাজা। কেন? কমলিনী আপনিই দেবে। তার সুরভি মধু দিয়ে সে যে তোমার চিত্তবিনোদ কর্‌বে তার কোন সন্দেহ নাই।

 বিদূ। হা! হা! হা! (উচ্চহাস্য) মহাশয়, আমি ব্রাহ্মণ, আমার কাছে কি ও সব ভাল লাগে? হয় টাকাকড়ি—নয় খাদ্য দ্রব্য—এই দুটার এক্‌টা না এক্‌টা হলে কি আমি উঠি।

 রাজা। চল হে, চল, না হয় আমিই দেব।

 বিদূ। হাঁ—এ শোনবার কথা বটে। তবে চলুন।

[ উভয়ের প্রস্থান।

(সখী এবং পরিচারিকার প্রবেশ।)

 সখী। মাধবি, আমি ত আর চল্তে পারি না। উঃ, আমার জন্মেও আমি কখন এত হাঁটি নাই। আমার সর্ব্বাঙ্গে যে কত বেদনা হয়েছে, তার আর বল্‌বো কি? বোধ করি, আমাকে এখন চারি পাঁচ দিন বুঝি কেবল বিছানাতেই পড়ে থাক্‌তে হবে।

 পরি। ও মা! সে কি? রাজনন্দিনীর স্বয়ম্বরের আর ছুটি দিন বই ত নাই! তা তুমি পড়ে থাক্‌লে কি আর কর্ম্ম চল্‌বে?

 সখী। না চল্‌লে আমি কি কর্‌বো? আমার ত আর পাষাণের শরীর নয়।

 পরি। সে কিছু মিছে কথা নয়।

 সখী। (পট অবলোকন করিয়া) দেখ্, আমি প্রিয়সখীকে না হবে ত প্রায় সহস্র বার বলেছি যে এ প্রতিমূর্ত্তি কখনই মনুষ্যের নয়, কিন্তু আমার কথায় তিনি কোন মতেই বিশ্বাস করেন না।

 পরি। কি আশ্চর্য‍্য! এই যে আমরা আজ সমস্ত দিন বেড়িয়ে বেড়িয়ে প্রায় এক লক্ষ রাজা দেখে এলেম, এদের মধ্যে এমন একটি পুরুষ নাই যে তাকে এঁর সঙ্গে এক মুহূর্ত্তের জন্যেও তুলনা করা যায়। হায়, এ মহাপুরুষ কোথায়?

 সখী। সুমেরুপর্ব্বত যে কোথায় তাকে বল্তে পারে? কনকলঙ্কা কি লোকে আর এখন দেখ্তে পায়?

 পরি। তা সত্য বটে। তবে এখন কি কর্‌বে?

 সখী। আর কি কর্‌বো! আয়, এই উদ‍্যানে একটুখানি বিশ্রাম করে প্রিয়সখীর কাছে এ সকল কথা বলিগে। (শিলাতলে উপবেশন।)

 পরি। আহা! রাজনন্দিনীকে এ কথা কেমন করে বল্‌বে? এ কথা শুনলে তিনি যে কত দুঃখিত হবেন, তা মনে পড়লে আমার চখে জল আসে।

 সখী। তা এ মায়ার হেমমৃগ ধরা তোর আমার কর্ম্ম নয়। এ যে একবার দেখা দিয়ে, কোন্ গহন কাননে গিয়ে পালিয়ে রইলো, তা কে বলতে পারে? জগদীশ্বর এই করুন, যেন প্রিয়সখী এর প্রতি লোভ কর‍্যে অবশেষে সীতা দেবীর মতন কোন ক্লেশে না পড়েন । এ যে দেবমায়া তার কোন সন্দেহ নাই। (পরিচারিকার প্রতি) তুই যে বসছিস্ না? তোর কি এত হেঁটেও কিছু পরিশ্রম হয় নাই?

 পরি। হয়েছে বইকি! কিন্তু রাজনন্দিনীর দুঃখের কথা ভাব্‌লে আর কোন দুঃখই মনে পড়ে না। যে গায়ে সাপের বিষ প্রবেশ করেছে, সে কি আর বিছের কামড়ে জ্বলে। (সখীর নিকটে ভূতলে উপবেশন) এখন এ স্বয়ম্বরটা হয়ে গেলেই বাঁচি।

 সখী। তুই দেখিস্ এ স্বয়ম্বরে কোন না কোন একটা ব্যাঘাত অবশ্যই ঘটে উঠবে।

 পরি। বালাই! এমন অমঙ্গল কথা কি মুখে আন্‌তে আছে?

 সখী। তুই প্রিয়সখীর প্রতিজ্ঞা ভুলে গেলি নাকি? তোর কি মনে নাই যে যদি এ লক্ষ রাজার মধ্যে, তিনি যে মহাপুরুষকে স্বপ্নে দেখেছেন, তাঁর সেই প্রাণেশ্বরকে না পান তবে তিনি আর কাকেও বরণ কর্‌বেন না?

 নেপথ্যে। (উচ্চহাস্য।)

 সখী। (নেপথ্যাভিমুখে অবলোকন করিয়া সচকিতে) ও আবার কি?

 পরি। কেন, কি হলো? (উভয়ের গাত্রোত্থান।)

 পরি। (সত্রাসে) ও মা! চল আমরা এখান থেকে পালাই। এ মহাস্বয়ম্বরে যে কত দেব, দানব, যক্ষ, রক্ষঃ এসে উপস্থিত হয়েছে, তা কে বল্তে পারে? এ নির্জ্জন বনে—

 সখী। চুপ্ কর্ লো। চুপ্ কর্। আর ঐ দেখ্—

 পরি। (নেপথ্যাভিমুখে অবলোকন করিয়া) কি আশ্চর্য্য! ঐ না পুষ্করিণীর ধারে দুই জন পুরুষমানুষ বসে রয়েছে? আহা! ওদের মধ্যে একজনের কি অপরূপ রূপলাবণ্য!

 সখী। (পট অবলোকন করিয়া) মাধবি, এতক্ষণের পর, বোধ করি, আমাদের পরিশ্রম সফল হলো। ঐ সুন্দর পুরুষটির দিকে একবার বেশ করে চেয়ে দেখ্ দেখি।

 পরি। তাই ত। কি আশ্চর্য! এ কি গগনের চাঁদ ভূতলে এসে উপস্থিত হলেন?

 সখী। (সপুলকে) এ ত গগনের চন্দ্র নয়, এ যে আমার প্রিয়সখীর হৃদয়াকাশের পূর্ণচন্দ্র।

 পরি। (পট অবলোকন করিয়া) তাই ত? এ কি আশ্চর্য্য। তা ওঁকে যে রাজবেশে দেখ্চি না।

 সখী। তাতে বয়ে গেল কি? (চিন্তা করিয়া) মাধবি, তুই এক কর্ম্ম কর্। তুই অন্তঃপুরে দৌড়ে গিয়ে, প্রিয়সখীকে একবার এখানে ডেকে আন্গে। যদিও ঐ মহাপুরুষ মনুষ্য না হন, তবু প্রিয়সখী ওঁকে একবার চক্ষে দর্শন কর‍্যে জন্ম সফল করুন্।

 পরি। রাজনন্দিনী কি এখন অন্তঃপুর হতে একলা আস্‌তে পার্‌বেন?

 সখী। তুই একবার যেয়ে দেখেই আয় না কেন। যদি আস্‌তে পারেন ভালই ত, আর না পারেন আমরা ত দোষ হতে মুক্ত হলেম।

 পরি। বলেছ ভাল, এই আমি চল্‌লেম।

[ প্রস্থান।

 সখী। (নেপথ্যাভিমুখে অবলোকন করিয়া স্বগত) ইনি কি মনুষ্য, না কোন দেবতা, মায়াবলে মানবদেহ ধারণ করে এই স্বয়ম্বর দেখ্তে এসেছেন? হায়, এ কথা আমি কাকে জিজ্ঞাসা কর্‌বো? এখন প্রিয়সখী এলে বাঁচি। আহা! বিধাতা কি এমন সুন্দর বর প্রিয়সীর কপালে লিখেছে?

(পদ্মাবতীর সহিত পরিচারিকার পুনঃপ্রবেশ।)

 পদ্মা। সখি, তুমি আমাকে ডেকে পাঠিয়েছ কেন? কি সংবাদ, বল দেখি শুনি!

 সখী। সকলই সুসংবাদ। তা এসো, এই শিলাতলে বসো।

 পদ্মা। সখি, আমার প্রাণনাথ কি তোমাকে দর্শন দিয়েছেন? (উপবেশন।)

 সখী। (পদ্মাবতীর নিকটে উপবেশন করিয়া) হ্যাঁ—দিয়েছেন।

 পদ্মা। (ব্যগ্রভাবে সখীর হস্ত ধারণ করিয়া) সখি, তুমি তাঁকে কোথায় দেখেছ?

 সখী। (সহাস্য বদনে) প্রিয়সখি, তুমি স্থির হয়ে ঐ অশোকবনের দিকে একবার চেয়ে দেখ দেখি।

 পদ্মা। কেন? তাতে কি ফললাভ হবে?

 সখী। বলি দেখই না কেন?

 পদ্মা। (নেপথ্যাভিমুখে অবলোকন করিয়া) ঐ ত ভগবান্ অশোকবৃক্ষ বসন্তের আগমনে যেন আপনার শতহস্তে পুষ্পাঞ্জলি ধারণ কর‍্যে, ঋতুরাজের পূজা করবার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন।

 সখী। ভাল, বল দেখি, ঋতুরাজ বসন্ত কোথায়?

 পদ্মা। সখি, এ কি পরিহাসের সময়!

 সখী। পরিহাস কেন? ঐ বেদিকার দিকে একবার চেয়ে দেখ দেখি?

 পদ্মা। (নেপথ্যাভিমুখে অবলোকন করিয়া) সখি, আমি কি আবার নিদ্রায় আবৃত হয়ে স্বপ্ন দেখ্তে লাগ্‌লেম? (আত্মগত) হে হৃদয়, এত দিনের পর কি তোমার নিশাবসান কত্যে তোমার দিনকর উদয়াচলে দর্শন দিলেন! (প্রকাশে) সখি! তুমি আমাকে ধর—(অচেতন হইয়া সখীর ক্রোড়ে পতন।)

 সখী। হায়! এ কি হলো? প্রিয়সখী যে সহসা অচেতন হয়ে পড়লেন। (পরিচারিকার প্রতি) মাধবি, তুই শীঘ্র গিয়ে একটু জল আন্ ত।

 পরি। এই যাই।

[ বেগে প্রস্থান।

 সখী। (স্বগত) হায়! আমি প্রিয়সখীকে এ সময়ে এ উদ্যানে ডাকিয়ে এনে এ কি কল্যেম?

(বেগে রাজার পুনঃপ্রবেশ।)

 রাজা। এ কি? সুন্দরি! এ স্ত্রীলোকটির কি হয়েছে?

 সখী। মহাশয়, এঁর মূর্চ্ছা হয়েছে।

 রাজা। কেন?

 পদ্মা। তা আমি এখন আপনাকে বল্তে পারি না।

 রাজা। (স্বগত) লোকে বলে যে পূর্ণশশীর উদয় হলে সাগর উথলিত হন, তা আমারও কি সেই দশা ঘট্লো! (পুনরবলোকন করিয়া) এ কি? এই যে আমার মনোমোহিনী, যাকে আমি স্বপ্নযোগে কয়েক বার দর্শন করেছিলেম। তা দেবতারা কি এত দিনের পর আমার প্রতি সুপ্রসন্ন হয়ে আমার হৃদয়নিধি মিলিয়ে দিলেন।

 পদ্মা। (চেতন পাইয়া দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ।)

 রাজা। (সখীর প্রতি) শুভে, যেমন নিশাবসানে সরসীতে নলিনী উন্মীলিতা হয়, দেখ, তোমার সখীও মোহান্তে আপন কমলাক্ষি উম্মীলন কল্যেন। আহা! ভগবতী জাহ্নবী দেবী, ভগ্নতট-পতনে কিঞ্চিৎ কালের নিমিত্তে কলুষা হয়ে, এইরূপেই আপন নির্মল শ্রী পুনর্ধারণ করেন।

 পদ্মা। (গাত্রোত্থান করিয়া মৃদুস্বরে সখীর প্রতি) সখি, চল, আমরা এখন অন্তঃপুরে যাই। এ উদ্যানে আমাদের আর থাকা উচিত হয় না ।

 রাজা। (স্বগত) আহা! এও সেই মধুর স্বর। আমার বিবেচনায় তৃষ্ণাতুর ব্যক্তির কর্ণে জলস্রোতের কলকল ধ্বনিও এমন মিষ্ট বোধ হয় না। (প্রকাশে সখীর প্রতি) সুন্দরি, তোমার প্রিয়সখী কি আমার এখানে আসাতে বিরক্ত হলেন?

 সখী। কেন? বিরক্ত হবেন কেন?

 রাজা। তবে যে উনি এখান থেকে এত ত্বরায় যেতে চান?

 সখী। আপনি এমন কথা কখনই মনে কর্‌বেন না। তবে কি না আমরা এখন সকলেই ব্যস্ত।

 রাজা। শুভে, তবে তুমি তোমার এ পরমসুন্দরী সখীর পরিচয় দিয়া আমাকে চরিতার্থ করে যাও।

 সখী। মহাশয়, ইনি রাজনন্দিনী পদ্মাবতীর একজন সখী মাত্র।

 রাজা। কি আশ্চর্য্য! আমরা জানি যে বিধাতা কমলিনীকেই পুষ্পকুলের ঈশ্বরী কর‍্যে সৃষ্টি করেছেন। তা তাঁর অপেক্ষা কি আরও সুচারু পুষ্প পৃথিবীতে আছে?

 পদ্মা। (স্বগত) আহা! প্রাণনাথ কি মিষ্টভাষী! তা ভগবান্ গন্ধমাদন কি কখন সৌরভহীন হতে পারেন?

 সখী। মহাশয়। আপনি যদি এ দাসীর অপরাধ মার্জনা করেন তবে আমি আপনাকে একটি কথা জিজ্ঞাসা করি।

 রাজা। তাতে দোষ কি? যদি আমি কোন প্রকারে তোমাদের মনোরঞ্জন কত‍্যে পারি, তবে তা অপেক্ষা আমার আর সৌভাগ্য কি?

 সখী। মহাশয়, কোন্ রাজধানী এখন আপনার বিরহে কাতরা হয়েছে, এ কথা আপনি অনুগ্রহ করে আমাদের বলুন।

 পদ্মা। (স্বগত) এতক্ষণের পর বসুমতী আমার মনের কথাটিই জিজ্ঞাসা করেছে।

 রাজা। (সহাস্য বদনে) সুন্দরি, আমার বিদর্ভনাম্নী মহানগরীতে জন্ম। সে নগরের রাজা ইন্দ্রনীলের সঙ্গে আমি তোমাদের রাজনন্দিনীর স্বয়ম্বর-মহোৎসব দেখবার নিমিত্তেই এ দেশে এসেছি।

 পদ্মা। (স্বগত) এ কি অসম্ভব কথা! এঁর কি তবে রাজকুলে নয়?

(জল লইয়া পরিচারিকার পুনঃপ্রবেশ।)

 সখী। তোমার এত বিলম্ব হলো কেন?

 পরি। আমাকে ঘটীর জন্যে অন্তঃপুর পর্য‍্যন্ত দৌড়ে যেতে হয়েছিল।

 সখী। তা সত্য বটে। তা এ কথা ত অন্তঃপুরে কেউ টের পায় নাই!

 পরি। না, এ কথা কেউ টের পায় নাই, কিন্তু ওরা সকলে মদনের পূজা কত্যে আস্চে।

 সখী। তবে চল, আমরা যাই।

 রাজা। (সখীর প্রতি) সুন্দরি, আমি কি তবে তোমাদের চন্দ্রাননের আর এ জন্মে দর্শন পাব না?

 পদ্মা। (সখীর প্রতি লক্ষ্য করিয়া ব্রীড়া সহকারে) প্রিয়সখি, তুমি এ মহাশয়কে বল যে যদি আমাদের ভাগ্যে থাকে, তবে আমরা এই উদ্যানেই পুনরায় ওঁর দর্শন পাব।

 নেপথ্যে। কৈ লো কৈ? রাজনন্দিনী আর বসুমতী কোথায়?

 সখী। চল, আমরা যাই।

 পদ্মা। কিঞ্চিৎ পরিক্রমণ করিয়া) উহু। এ কি—

 সখী। কেন? কেন? কি হলো?

 পদ্মা। সখি, দেখ, এই নূতন তৃণাঙ্কুর আমার পায়ে বাজতে লাগ্‌লো। উহু, আমি ত আর চল্তে পারি না, তোমরা এক জন আমাকে ধর। (রাজার প্রতি লজ্জা এবং অনুরাগ সহকারে দৃষ্টিপাত।)

 সখী। এই এসো।

[ পদ্মাবতীকে ধারণ করিয়া সখী এবং পরিচারিকার প্রস্থান।

 রাজা। (স্বগত) হে সৌদামিনি, তুমি কি আমার এ মেঘাবৃত হৃদয়াকাশকে আরও তিমিরময় করবার জন্যে আমাকে কেবল এক মুহূর্ত্তের নিমিত্তে দর্শন দিলে! (দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ করিয়া) হায়! তা এ ঘোর অন্ধকার তোমার পুনদর্শন ব্যতীত কি আর কিছুতে কখন বিনষ্ট হবে?

 নেপথ্যে। (বহুবিধ যন্ত্রধ্বনি।)

 রাজা। (নেপথ্যাভিমুখে দৃষ্টিপাত করিয়া স্বগত) এই যে রাজকুলবালারা গানবাদ্য কত্যে কত্যে ভগবান্ কন্দর্পের মন্দিরের দিকে যাচ্যে।

 নেপথ্যে। নাচ্ লো, নাচ্। এই দেখ্ আমি ফুল ছড়াচ্যি ।

নেপথ্যে।  (গীত।)
রাগিণী—খাম্বাজ, তাল যৎ।
চলস কলে আরাধিব কুসুমবাণে।
সঘনে করতালি দেহ মিলিয়ে,
যতনে পূজিব হরিষ মনে॥
বাছিয়া তুলিয়াছি নানা কুসুম,
অঞ্জলি পূরিয়া দিব চরণে।

সখীর পরিণয়ে শুভ সাধিতে,
তুষিব দেবেরে মঙ্গলগানে॥

 রাজা। (স্বগত) আহা কি মধুর ধ্বনি! তা আমার আর এ স্থলে বিলম্ব করা উচিত হয় না। আমি এ নগরে ছদ্মবেশে প্রবেশ কর‍্যে উত্তমই করেছি। আহা! এই পরম সুন্দরী বামাটি যদি রাজদুহিতা পদ্মাবতী হতো, তবে আর আমার সুখের সীমা থাক্‌তো না।

[ প্রস্থান।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন