২.৩৮ আলপথ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

আলপথ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে অতীনের বাঁ পায়ের চটি ছিঁড়ে গেল। ধান কাটা হয়ে গেছে, মাঠে মাঠে রয়ে গেছে খড়ের গোড়াগুলো, তার ওপর দিয়ে হাঁটতে গেলে পায়ে বেশ লাগে, আলের ওপর দিয়েও সব সময় হাঁটা যায় না। চটি জোড়া অতীনকে হাতে নিতে হয়েছে, এক একবার সে ভাবছে ছুঁড়ে ফেলে দেবে কি না। চটির বদলে তার সু আনা উচিত ছিল, কিন্তু মানিকদা সবাইকে বলেছিলেন, দেখিস, যেন পিকনিকের বাবুদের মতন সেজেগুঁজে গ্রামে যাস না। অতীন বা কৌশিক কেউই সে জন্য ট্রাউজার্স বা কোটও আনেনি, পা-জামা, পাঞ্জাবি আর আলোয়ান। কৌশিক অবশ্য চটির বদলে কেডস এনেছে, অতীনের কেডস নেই।

এখন খালি পায়ে হাঁটতে বেশ কষ্ট হচ্ছে তার, কিন্তু সেকথা সে কিছুতেই মুখে স্বীকার করবে না। এক সময়ে তার পায়ে আরও বেশি ব্যথা লাগলো।

অতীনরা পা-জামা পরে এলেও গ্রামের অনেক ছেলেই প্যান্ট পরে। গতকাল সন্ধেবেলা একটা হাটে গিয়ে সে রকম অনেককে দেখেছে, এমনকি যে লোকটি বিস্কুটের লটারি চালাচ্ছিল, তার পরনে প্যান্ট-শার্ট ও ঘড়ি। কৌশিক বলেছিল, ওর ঘড়িটা প্লাস্টিকের খেলনা, কাঁটা নড়ে না।

সবাইকে একসঙ্গে ঘোরাঘুরি করতে নিষেধ করেছে পমপম। এ রকম একটা শহুরে দলকে গ্রামের মধ্যে দেখা গেলে অনেক রকম কথা বলাবলি হবে। দু’জন দু’জন করে যাবে যেদিকে খুশী।

অতীন আর কৌশিক কালকের রাতটা নিরাপদ দাসের বাড়িতে কাটিয়েছে। পমপমদের গ্রাম থেকে প্রায় ন’ মাইল দূরে। অচেনা চাষীর বাড়িতে গিয়ে ভাব জমিয়ে রাত্রিবাসের ব্যাপার নয়, এই নিরাপদর সঙ্গে মানিকদার পরিচয় আছে। একবার ধান কাটার দাঙ্গায় প্রত্যক্ষ অংশ নিয়ে দেড় বছর জেল খাটতে হয়েছে নিরাপদকে, মানিকদাও সে সময় ঐ একই জেলে ছিলেন। তারপর থেকে মানিকদা এই নিরাপদ দাসের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা জাগাবার চেষ্টা করে যাচ্ছেন।

বেশ শক্ত সমর্থ, লম্বা চেহারা নিরাপদর, চোখ দুটো সব সময় খানিকটা কুঁচকে থাকে বলে তাকে নিষ্ঠুর স্বভাবের মানুষ মনে হয়, কিন্তু কৌশিকদের সঙ্গে সে কোনো খারাপ ব্যবহার করেনি। এবারে দাঙ্গা হয়নি এবং তার জমিতে ভালো ফসল হয়েছে বলে নিরাপদর মেজাজ প্রসন্ন। সারাদেশে অন্নের জন্য হাহাকার পড়ে গেলেও বর্ধমান জেলায় ধানের ফলন আশাতিরিক্ত।

নিরাপদর সংসারটি বেশ বড়, তিনজন স্ত্রীলোক ও নানা বয়েসী আট দশটি ছেলেমেয়ে দেখে অতীন বুঝতে পারেনি, কার সঙ্গে কার কী সম্পর্ক। সারা দুপুর উঠোন জুড়ে ধানমলাই হচ্ছিল, গোরু ও মানুষের পায়ের চাপে যে ধানগাছ থেকে ধান ঝরানো হয়, সে জ্ঞানই ছিল না অতীনের। কৌশিকের তবু গ্রামের সঙ্গে খানিকটা যোগাযোগ আছে, তার মামার বাড়ির গ্রামে সে মাঝে মাঝে যায়, কিন্তু অতীনের কোনো গ্রাম্য স্মৃতি নেই। গ্রামের সব কিছুই তার কাছে। নতুন। হুঁকো টানতে টানতে নিরাপদ কৌশিককে বোঝাচ্ছিল কেন সে লেভিতে ধান দেবে না, লেভিতে তার কতখানি ক্ষতি। অতীন লেভি শব্দটা প্রায়ই খবরের কাগজে দেখেছে, কিন্তু ব্যাপারটা সম্পর্কে মনোযোগ দেয়নি কখনো।

নিরাপদ দাসের বাড়িতে আলাদা ঘর নেই, তাদের থেকে কিছু কম বয়েসী তিনটি ছেলের সঙ্গে এক ঘরে শুতে দেওয়া হয়েছিল তাদের। কৌশিক চেষ্টা করেও সেই ছেলে তিনটির সঙ্গে ভাব জমাতে পারেনি, তারা কী একটা গুপ্ত কথা বলে অনবরত হি হি হো হো করে হাসছিল, আর একজন চড়ে বসছিল অন্য একজনের গায়ের ওপর। এক সময় তুতুলের বয়েসী একটি মেয়ে ঝাঁ করে সেই ঘরে ঢুকে এসে ছেলে তিনটিকে থাবড়াতে লাগলো এলোপাথারি, এও কোনো পূর্ব ঝগড়ার ব্যাপার। মেয়েটির নাম উমা, সারা দিনে ঐ ডাক অতীনরা অনেকবার শুনেছে। চূড়ো করে চুল বাঁধা, অনেকখানি ঘাড় দেখা যায় মেয়েটির, মুখখানা পান পাতার মতন, বুকে দুটি বাতাবি লেবু। এই রকম মেয়েরাই গ্রাম্য উপন্যাসের নায়িকা হয়। অবশ্য অতীন কোনো গ্রাম্য উপন্যাস পড়েনি, অচেনা মেয়েদের শরীর গঠন লক্ষ করার দিকে ঝোঁকও তার নেই।

সারারাত সে ভালো করে ঘুমোতে পারেনি। অন্যরা সবাই এক সময় ঘুমিয়ে পড়লেও অতীন কিছু একটা শব্দ শুনে চমকে চমকে জেগে উঠেছে। ঘরের মধ্যে যেন কার পায়ের আওয়াজ। তারপর সে দেখেছে দেয়ালের গায়ে দুটি জ্বলন্ত বিন্দু, যেন দু’ কুচি হীরে, অন্ধকার সেখানে ফুটো হয়ে গেছে। ভয় পেয়ে সে কৌশিককে ডেকে তুলেছিল, কৌশিক ঘুম চোখে অবহেলার সঙ্গে বলেছিল, ওঃ, ও কিছু না, ইঁদুর! কিছু করবে না!

কৌশিক আবার ঘুমিয়ে পড়লে আবার সেই শব্দ, সেই আলোর বিন্দু। ইঁদুরের চোখ ওরকম হীরের মতন জ্বলে? কত বড় ইঁদুর, যদি গায়ের ওপর এসে পড়ে? কৌশিক নিশ্চিন্ত মনে ঘুমোচ্ছে দেখে তার হিংসে হচ্ছিল। সে ভাবছিল, কৌশিক পারছে, সে কেন পারবে না? কৌশিক ঘুমের ঘোরেও চটাস চটাস শব্দে মশা মারছে, অথচ মশার পিনপিনে ডাকে অতীনের চোখ থেকে ঘুম উড়ে গেছে। তাদের বাগবাজারের বাড়িতেও মশা ছিল না। কালীঘাটের বাড়িতেও মশা নেই! অতীনের শীতও করছিল খুব, শুধু নিজের আলোয়ান দিয়ে গা ঢাকা, চ্যাঁচার বেড়ার ফাঁক-ফোকর দিয়ে সোঁ সোঁ করে ঢুকছে হাওয়া।

অতীন নিজেকে বুঝিয়েছিল, প্রথমবার তো, তাই সে সহ্য করতে পারছে না। আস্তে আস্তে সহ্য হয়ে যাবে। মানিকদা বলেছেন, প্রথমেই বেশি বাড়াবাড়ি করার দরকার নেই, একটু একটু করে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করলেই ভিত্তি মজবুত হয়।

আলপথ ছেড়ে কৌশিক আর অতীন গ্রামের রাস্তায় উঠেছে। ভাঙা শামুক কিংবা ঝিনুকের খোলায় অতীনের পায়ের তলায় কেটে গেছে অনেকটা, কিন্তু সে কথা সে কৌশিককে জানায়নি। তার প্রধান গরজ এখন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পমপমদের বাড়ি পৌঁছানো। সকালবেলার ব্যাপারগুলো সবই তার বাকি রয়ে গেছে। এমন কি এক কাপ চাও খাওয়া হয়নি। নিরাপদ দাসের বাড়িতে চায়ের পাট নেই। উমা নামের সেই মেয়েটি চ্যাঁ-চোঁ শব্দে দুধ দুইছিল, গোরুটি ছবির মতন শান্ত হয়ে দাঁড়িয়েছিল উঠোনের এক পাশে, যেন সে উমাকে খুব স্নেহ করে। পেতলের গামলায় ফেনা ওঠা দুধ দেখে খুব লোভ হয়েছিল অতীনের, দুধ তার খুব প্রিয়, আর এমন খাঁটি দুধ, কিন্তু চাওয়া তো যায় না। নিরাপদর কথা শুনে একটা নিমের ডাল ভেঙে দাঁতন করতে গিয়ে অতীনের মুখটা এখনও তেতো হয়ে আছে।

সামনেই হাটখোলা, এখানে গতকাল হাটুরে মানুষের ভিড় গমগম করছিল, এখন একেবারে শুনশান। কিছু কলাপাতা, শালপাতা ছড়িয়ে আছে এদিক ওদিক, আর কয়েকটা ঘেয়ো কুকুর। বাঁশের চালাগুলো কাল তো এমন অসুন্দর দেখায়নি।

এক কোণে একটা চায়ের দোকান, সেখানে কিছু মানুষজন রয়েছে মনে হলো। বাইরে একজন লুঙ্গি পরা লোক, রোদে দাঁড়িয়ে বেশ উপভোগ করে চা খাচ্ছে। কৌশিক বললো, চ, এখান থেকে চা খেয়ে নিই।

অতীন বাড়ি ফিরতে চায়, সে বুঝতে পারছে তার পায়ের কাটা জায়গাটায় একটা কিছু ওষুধ লাগানো দরকার। যদি সেপটিক হয়, কিংবা টিটেনাস?

সে বললো, এখানে না, পমপমদের বাড়িতে গিয়ে চা খাবো!

কৌশিক বললো, আয় না, একটু বসে যাই, অনেকটা হেঁটেছি। চায়ের দোকানের গল্পে অনেক রকম মালমশলা পাওয়া যায়।

কৌশিক অতীনের হাত ধরে টানলো। অতীন অন্য হাত থেকে চটি জোড়া ফেলে দিয়ে বাঁ পাটা তুলতে গেল, এবারে কৌশিককে বলতেই হবে।

তখনই চায়ের দোকান থেকে ছুটে এলো সুশোভন, তার হাতে একটা খবরের কাগজ। সে বন্ধুদের দেখতে পেয়েছে। সে ওদের নাম ধরে ডাকছে।

উত্তেজিতভাবে সে বললো, এই তোরা খবর শুনেছিস? কাল আমরা কিছু টেরই পায়নি, যদি একবার রেডিও নিউজটাও শুনতুম।

কৌশিক ভুরু তুলে বললো, কী হয়েছে?

–তোরা এখনও জানিস না? এটা কালকের কাগজ…ঘটনাটা ঘটেছে পশু রাত্তিরে, ইন্ডিয়ার প্রাইম মিনিস্টার মারা গেছে…লালবাহাদুর শাস্ত্রী তাসকেন্টে…

ভারতের প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে কৌশিক বা অতীনের কোনো ভাব-ভালোবাসা নেই, তবু খবরটির আকস্মিকতায় একটু বিহ্বল হয়ে গেল। মানুষটি তো জলজ্যান্ত সুস্থ ছিলেন। রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী কোসিগিনের পেড়াপেড়িতে লালবাহাদুর আর আইয়ুব খাঁ গেলেন তাসখেন্টে কাশ্মীর নিয়ে দরাদরি করতে। কৌশিকরা কলকাতা ছাড়ার দিনেও জেনে এসেছিল যে আলোচনা ভেস্তে যাচ্ছে, লালবাহাদুর ফিরে আসবেন খালি হাতে। রাশিয়া চায় আমেরিকার খপ্পর থেকে পাকিস্তানকে টেনে আনতে, কিন্তু ওদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভুট্টো অতি ধুরন্ধর।

কৌশিক কাগজটা টেনে নিল।

সুশোভন অতীনকে বলল, আমি মর্নিংওয়াকে বেরিয়ে ছিলুম, বুঝলি, রাস্তায় একজন বললো এদিকে একটা চায়ের দোকান আছে,…ভেতরে ঢুকে কাগজটার দিকে চোখ পড়তেই…শেষ পর্যন্ত আইয়ুব আর লালবাহাদুর হাতে হাত মিলিয়েছিল, একটা যুক্ত বিবৃতি দিয়েছে। এরপর লালবাহাদুরের তো খুশী থাকারই কথা, যুদ্ধ বিরতি হয়ে গেল, তারপর ভোজ সভাতেও লালবাহাদুর ভালোই ছিল…শুতে যাবার পর রাত একটা পঁচিশে বুকে ব্যথা, সাত মিনিটের মধ্যেই শেষ। একটু চিকিৎসারও সময় পেল না।

কৌশিক খবরের কাগজে দ্রুত চোখ ছোটাতে ছোটাতে বললো, যুক্ত বিবৃতি না ছাই! গোঁজা মিল! কাশ্মীর নিয়ে কোনো সুরাহা হলো না, অনাক্রমণ চুক্তির কথাও নেই, শুধু কিছু মিষ্টি মিষ্টি কথা। লালবাহাদুর নিশ্চয়ই ভয় পেয়ে গিয়েছিল, বুঝেছিল দেশে ফিরলে মার খেতে হবে, পার্লামেন্টে তার নিজের পার্টির লোকই চ্যাঁচাবে! এই দ্যাখ না, মৃত্যুর একটু আগে লালবাহাদুর তার বউ ললিতা দেবীকে ফোনে বলেছিল, দেশের খবরের কাগজগুলোর রি-অ্যাকশন তাকে জানাতে।

সুশোভন বললো, ইস, লোকটা ভালো করে প্রধানমন্ত্রিত্বগিরি করার চান্সই পেল না। আমরা জন্ম থেকে নেহরুর নাম শুনে আসছি। নেহরু মরবার পর লালবাহাদুর এলো, তখন ভাবলুম, এই লালবাহাদুর এখন আবার অন্তত পনেরো কুড়ি বছর রাজত্ব চালাবে, এদেশে তো না মরলে। কেউ জায়গা ছাড়ে না!…এই, আমার চা ফেলে এসেছি, চল, চা খাবি?

অতীন বললো, তোরা গিয়ে বোস, আমি একটু বাড়িতে যাচ্ছি।

দুপুরবেলা পমপমদের বাড়ির পেছনে আমবাগানে ওদের মিটিং বসলো। গতকাল মানিকদার এসে পৌঁছোবার কথা ছিল, তিনি আসেননি, নিশ্চয়ই লালবাহাদুর শাস্ত্রীর মৃত্যুর কারণেই। এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তাদের স্ট্র্যাটেজি ঠিক করতে হবে।

বাগানটি বেশ বড়, তাতে নানা রকম কলমের গাছ। এখানে বসবার ব্যবস্থা আগে থেকেই করা আছে, একটা ফাঁকা জায়গায় কয়েকটা শাল কাঠের গুঁড়ির বেঞ্চ। বেশ জাঁকিয়ে পড়েছে শীত, রোদে গা দিতে বেশ আরাম। দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর শীত বেশি লাগে, সবাই এসেছে চাঁদর মুড়ি দিয়ে। খিচুড়ি খাওয়া হয়েছে আজ, তারপর কারুর কারুর মুখে সুপুরির টুকরো কিংবা সিগারেট।

পমপম বললো, আমাদের বাড়ির রেডিওটা খারাপ। মেমারিতে যে দুটো খবরের কাগজ আসে, তাতে ট্র্যাস লেখে। মনে কর, আজই যদি সারা দেশে একটা আর্মড রেভলিউশন শুরু হয়ে যায়, আমরা তার খবরই পাবো না।

কৌশিক এক টুকরো হাসি ছুঁড়ে দিয়ে বললো, আর্মড রেভলিউশন? তুই কোন দেশের কথা বলছিস রে, পমপম!

পমপম হাসে না, সে সকলের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে বললো, তোরা ভেবে দ্যাখ, এইটাই কি ঠিক প্রপার টাইমিং নয়? দেশের প্রধানমন্ত্রী মারা গেছে বিদেশে, কংগ্রেসের টপ লেভেল নেতারা পাজলড, কারুর হাতেই বিশেষ ক্ষমতা নেই, চ্যবন আর শরণ সিং-ও বাইরে, ক্ষমতা দখলের এইটাই তো উপযুক্ত সময়। উই হ্যাভ এনাফ অফ ডেমোক্রেসি। দেশের মানুষকে এখন বিপ্লবের ডাক দিলে সবাই সাড়া দেবে।

কৌশিক বললো, বিপ্লব বুঝি হাতের মোয়া? কৃষক ফ্রন্টে কতটা সংগঠনের কাজ হয়েছে? কৃষক-শ্রমিক ঐক্য কতটুকু এগিয়েছে? একবার গ্রামে ঘুরে জিজ্ঞেস করে আয় না, কটা লোক বিপ্লব কথাটার মানে জানে? তোরা যা বলছিস…

অতীন কোনো কথা বলছে না। পমপমদের বাড়িতে কোনো ওষুধ পাওয়া যায়নি, খানিকটা চুন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে তার ক্ষত স্থানে। পমপম বলেছিল, শীতকালে ও এমনি সেরে যায়। কিন্তু অতীনের মন মানেনি। পায়ের ক্ষতের চেয়েও তার মনটা খচখচ করছে বেশি। টিটেনাসের সময় এখনও পেরিয়ে যায়নি। অন্যরা কেউ বলছে না বলেই সে ডাক্তার দেখাবার কথাটা নিজে তুলতে পারছে না।

যদি টিটেনাস হয়ে এখানে সে হঠাৎ মরে যায়? তা হলে তার মা, বাবামা কি পাররে সহ্য করতে? মায়ের আর একটাও ছেলে থাকবে না। অতীন যেন বারবার দেখতে পাচ্ছে তার মাকে, নাঃ, মায়ের জন্যই তার এখন মরা চলবে না।

অলি বসে আছে পমপমের পাশে। অলিকে তার পায়ের ক্ষতটা এখনও দেখায়নি অতীন। অলি বড় বড় চোখ মেলে চেয়ে আছে তার দিকে, সেই দৃষ্টির মধ্যে যেন একটা প্রশ্ন রয়েছে। সন্তর্পণে অতীন নিজের বাঁ পাটাকে আদর করতে লাগলো। মনের জোর দিয়ে কি টিটেনাস সারানো যায়?

সুশোভন বললো, আমিও পমপমের সঙ্গে একটা ব্যাপারে এক মত। এই রকম একটা অবস্থার সুযোগ নিয়ে আমর্ড রেভলিউশন ছাড়া আর কোনো পথ নেই। পালামেন্টারি প্রসেসে আগামী পঞ্চাশ বছরেও কংগ্রেসের ঘুঘুর বাসা ভাঙা যাবে না, ক্ষমতা দখল তো দূরের কথা।

কৌশিক বললো, তোরা যা বলছিস, তার প্লেইন অ্যান্ড সিমপল মানে হলো আর্মিকে প্রশ্রয় দেওয়া। শ্রমিক কৃষকদের মধ্যে কোনো লিডারশিপ নেই। আমরা বামপন্থীরা দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করছি, এখন বিপ্লবের একটা হুজুগ তুললে কোনো একজন আর্মি জেনারেল ক্ষমতা দখল করে নেবে। পাশের দেশ পাকিস্তানে যা হয়েছে। এখন তবু যা কিছু ডেমোক্রেটিক রাইটস আছে, সেগুলোও সব যাবে!

পমপম বললো, তবু একটা কিছু হোক। এই পচা-গলা ডেমোক্রেসি আর আমাদের সহ্য হচ্ছে না।

অলি হঠাৎ নরম ভাবে বললো, আচ্ছা, আমাদের স্টাডি সার্কলের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর জন্য শোক প্রস্তাব নেওয়া উচিত না?

যেন এরকম একটা অদ্ভুত কথা আগে শোনেনি, এই ভাবে বিস্মিত হয়ে পমপম বললো, শোক প্রস্তাব? আমরা নেব? কেন, যে শ্রেণী শত্রু, সে মরলে শোকের কী আছে?

অন্য একজন বললো, মানিকদাকে জিজ্ঞেস না করে…

অলি নিজেই একা উঠে দাঁড়ালো।

আরও একটি মেয়ে সেই সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে জোর দিয়ে বললো, নিশ্চয়ই এক মিনিট নীরবতা পালন করা উচিত।

এর পরেও আলোচনা চললো প্রায় দু’ ঘণ্টা ধরে। অতীনকে কয়েকবার খুঁচিয়েও তার মুখ দিয়ে কথা বার করা গেল না। তার পায়ের তলায় একটা চিড়িক চিড়িক ব্যথা শুরু হয়েছে, এটা নতুন রকম ব্যথা, এটাই কি টিটেনাসের শুরু? এ কথা কারুকে জিজ্ঞেস করাও যায় না। এরই মধ্যে একবার সে ভাবলো, এই আমবাগানে বসে এমন সীরিয়াস সুরে মিটিং চলেছে যেন ভারতে সশস্ত্র বিপ্লব এখনই শুরু হবে কি না তা নির্ভর করছে এই সভার সিদ্ধান্তের ওপর।

সে রকম কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো না বটে, কিন্তু সকলেই ঠিক করলো, এখন যে-কোন মুহূর্তে দেশে একটা বড় রকম পরিবর্তন ঘটতে পারে, এই সময় গ্রামে বসে থাকা ঠিক হবে না। মানিকদা যদি আজ সন্ধের মধ্যেও না আসেন, তা হলে কাল সকালের ট্রেনেই সবাই চলে যাবে কলকাতায়।

অতীন এই কথায় খুশী হলো। প্রথমবারের পক্ষে তার যথেষ্ট গ্রাম দেখা হয়েছে, সে এখন নিজের বাড়িতে যেতে চায়। কলেজে ভর্তি হবার পর থেকে সে আর কখনো এতখানি নিজের বাড়ির প্রতি টান অনুভব করেনি।

অলি অসহায় ভাবে চিবুক তুলে বললো, কিন্তু আমার যে কৃষ্ণনগরে যাবার কথা?

পমপম বললো, তোমাকে আমরা নবদ্বীপের ট্রেনে তুলে দেবো, তুমি যেতে পারবে না?

উত্তরের অপেক্ষা না করে সে নিজেই আবার বললো, না, তুমি পারবে না, একা যেতে পারবে। ঠিক আছে। অতীন তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসবে।

যেন তার এই আদেশের ওপর আর কোনো বাদ প্রতিবাদ চলে না, এই ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ালো পমপম।

এই মনোরম শীতকালে দল মিলে গ্রামে বেড়াতে আসার মধ্যে একটা চমৎকার উপভোগ্য দিক ছিল, কিন্তু ব্যাপারটা যেন পিকনিক পার্টির মতন হয়ে না যায়, সেদিকে ছিল পমপমের কড়া নজর। এক জায়গায় বেশিক্ষণ আড্ডা বা গান পমপমের পছন্দ নয়। খাওয়া নিয়েও কোনোরকম বাড়াবাড়ি চলবে না। পমপমদের বাড়ির অবস্থা বেশ সচ্ছল, দুটি বেশ বড় বড় ধানের গোলা, অনেক রকম ফলের গাছ, পমপমের ঠাকুর্দা এখন অসুস্থ অবস্থায় শয্যাশায়ী হলেও তিনি তাঁর নাতনীর বন্ধুদের সেবাযত্নের জন্য ঢালাও অডার দিয়েছেন। তবু পমপম প্রথম দিনই জানিয়ে দিয়েছিল, এই দলের কারুরই তাদের বাড়িতে দু’বেলা খাওয়া চলবে না, হাটে বাজারে ঘুরে একবেলার খাওয়া নিজেদের জোগাড় করতে হবে। কৌতুকবর্জিত সুরে সে বলেছিল, আমাদের বাড়িতে নেমন্তন্ন খাওয়াবার জন্য তো কারুকে ডেকে আনিনি। এ বাড়িটা শুধু একটা সেন্টার।

মানিকদা এসে পৌঁছোবার আগে পর্যন্ত নির্দিষ্ট কোনো প্রোগ্রাম ছিল না, শুধু গ্রামের জীবনযাত্রার সঙ্গে পরিচিত হওয়া। এমনকি গ্রামের চাষী বা সাধারণ মানুষদের সঙ্গে রাজনৈতিক কথাবার্তা বলাও নিষিদ্ধ ছিল। এই সব ব্যাপারে এগোতে হয় নির্দিষ্ট, সুপরিকল্পিত কার্যসূচি নিয়ে। মানিকদা এলেন না, এর মধ্যে লালবাহাদুর শাস্ত্রীর মৃত্যুর মতন ঘটনা না ঘটলে ওরা অনেকেই আর কয়েকদিন থেকে যেত, দশ বারোদিন তো থাকার কথা ছিলই। ভোরবেলা খেজুরের রস, নতুন চালের ফ্যানা ভাত, গাছ থেকে সদ্য ছিঁড়ে আনা বেগুনের টুকরো ভাজা, পুকুর থেকে তুলে আনা মাছের স্বাদ, এই সব আকর্ষণ ছাড়াও ধুলো মাখা রাস্তা, গোরুর গাড়ির চাকার আওয়াজ, খড়ের গন্ধ, মানুষজনের সাদাসিধে কথাবার্তা, এইসবও ভালো লেগে যাচ্ছিল। জমিদারের বদলে গ্রামে গ্রামে গজিয়ে উঠছে জোতদার শ্রেণী, তাদেরও চেনা যাচ্ছিল একটু একটু। দিগন্ত বিস্তৃত মাঠের প্রান্তে দাঁড়ালে বেশ একটা দেশ দেশ ভাব মনের মধ্যে জাগে, শহরে এমন মনে হয় না, শহর যেন কারুর দেশ নয়।

পমপমই ফিরে যাবার জন্য সবচেয়ে বেশি ব্যস্ত। তার ধারণা, কলকাতায়-দিল্লিতে বিরোধী পক্ষগুলির সঙ্গে কংগ্রেসীদের মারামারি কাটাকাটি শুরু হয়ে গেছে। বিদেশে প্রধানমন্ত্রীর মৃত্যুতে যে আকস্মিক শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে, এই সুযোগে কংগ্রেসের মৌরসিপাট্টা ভাঙার চেষ্টা অন্যরা করবেই। এ সময়ে দূরে থাকা চলে না।

কথা ছিল, অলিকে কৃষ্ণনগরে পৌঁছে দেবে পমপম। সে দায়িত্ব সে এখন অতীনের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছে। অলিকে এখানে একটু বেশি খাতির করা হয়েছে, সে বিশেষ গ্রামে ঘুরতে যায়নি, একদিনও সে অন্য বাড়িতে রাত কাটায়নি, সকলে ধরেই নিয়েছিল অলি কষ্ট সহ্য করতে পারবে না। সে বড়লোকের মেয়ে, হঠাৎ তার গা থেকে বুর্জোয়া গন্ধ মুছে ফেলা যাবে না। তার নিজের যদি আন্তরিকতা থাকে তবে সে নিজেই একদিন ডিক্লাসড হবে, ব্যস্ততার কিছু নেই।

অতীন একবারও অলিকে তার নিজের সঙ্গে নিয়ে বেরোয়নি। দু’জন দু’জনের যে দল করা হয়েছিল, তার কোনো দলেই একটি ছেলে আর একটি মেয়ে ছিল না, এ রকম কোনো নির্দেশ দেওয়া হয়নি, সে রকম কেউ চায়ওনি। অতীন বরং অলিকে একটু এড়িয়ে এড়িয়েই চলেছে, অলিকে সে একবারও নিভৃতে তার কাছে আসার সুযোগ দেয়নি, বরং অলির প্রতি তার কথাবার্তা কিছুটা রুক্ষ। পমপমকে সে বলেছিল, তোরা ঐ মেয়েটাকে তুলোয় মুড়ে রাখতে চাইছিস কেন রে, তা হলে গ্রামে নিয়ে এলি কেন? ও কি মেমসাহেব নাকি? অলির প্রতি অতীনের এই ব্যবহার ছদ্ম কিংবা আরোপিত নয়। অলির সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা দেখলে অন্যরা রঙ্গরসিকতা করতে পারে, অতীন সে সম্ভাবনাকেও গ্রাহ্য করে না। তার ভয় নিজেকে।

অলিকে কৃষ্ণনগরে পৌঁছোবার দায়িত্ব তার কাঁধে চাপিয়ে দেওয়ায় অতীন প্রথমে প্রতিবাদ করবে ভেবেছিল। কিন্তু মুখে কিছু বলেনি, তখন তার পা নিয়ে সে খুবই চিন্তিত। যখন তার ধনুষ্টঙ্কার শুরু হবে, তখন অন্য সবাই বুঝবে ঠ্যালা। লাল বাহাদুর শাস্ত্রী মারা গেছেন শুনে সবাই অন্য কথায় এমন মেতে উঠেছে যে এদিকে যে অতীন মজুমদার মরতে বসেছে সেদিকে কারুর হুঁশ নেই। বিকেলের মধ্যেই তার পা-টা ফুলে উঠলো অনেকখানি, আর সন্ধের পর তার জ্বর এলো।

পরদিন সকালে অতীনের ঘুম ভাঙলো সকলের আগে এবং ভোরের স্নিগ্ধ আলোর মতন একটা খুশীতে ভরে গেল তার মন। প্রায় চব্বিশ ঘণ্টা কেটে গেছে, আর টিটেনাসের ভয় নেই। তা হলে সে বেঁচে গেছে! অতীন ঘর থেকে বেরিয়ে উঠোনে খানিকটা ঘুরে বেড়াতে গেল, পায়ে অসহ্য ব্যথা। কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না। টিটেনাস তো হয়নি! এখন বাকি রইলো সেপটিক হওয়া। সেটাও এমন কিছু না, একটা ক্ষত সেপটিক হলে কেউ প্রাণে মরে না, বড় জোর অপারেশন করার পর বাকি জীবনটা একটু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে হবে। তাতে বরং খানিকটা ব্যক্তিত্ব আসে। ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে সে অপূর্ব দত্তকে দেখেছে, ডিবেট করার সময় তিনি যখন গ্যালারিতে ওঠেন, তখনই বোঝা যায় এই মানুষটি অন্যদের থেকে একেবারে আলাদা। কৌশিক অবশ্য বলে, খবরদার অপূর্ব দত্তর বক্তৃতা শুনবি না, ওরা হচ্ছে হেরেটিক। ওরা চমৎকার ধারালো কুযুক্তি দিতে জানে।

সকাল আটটার মধ্যেই সবাই তৈরি হয়ে নিল। এরই মধ্যে গুজব শোনা গেছে যে ট্রেনের কী যেন গণ্ডগোল হচ্ছে, কলকাতা থেকে ফাস্ট ট্রেন আসেনি। তাতেই পমপমের আরও ধারণা হলো যে কলকাতায় সাঙ্ঘাতিক একটা কিছু শুরু হয়ে গেছে। ট্রেন বন্ধ থাকলে বাস বদল করে করে যেতেই হবে। একটুও সময় নষ্ট করার কোনো মানে হয় না।

পমপমদের বাড়িতে গোরুর গাড়ি আছে, এ বাড়ির মানুষ স্টেশনে পৌঁছোবার জন্য ঐ গাড়িই ব্যবহার করে। কিন্তু এক গাড়িতে সবাইকে ধরবে না, তাছাড়া গোরুর গাড়ির ঢিকুস চিকুস চলা এখন সহ্য হবে না। তার চেয়ে হেঁটে অনেক আগে যাওয়া যাবে। পমপম অতীনকে বললো, তুই আর অলি ইচ্ছে করলে গো-গাড়ি নিতে পারিস, তোরা তো উল্টোদিকে যাবি, একটু দেরি হলেও ক্ষতি নেই।

অতীন রাজি হলো না। সে দুখানা রুমাল দিয়ে তার বাঁ পা ভালো করে বেঁধে নিয়েছে। তারা সবাই একসঙ্গেই মেমারি স্টেশন পর্যন্ত যাবে।

অতীনকে খোঁড়াতে দেখে অলি কাছে এসে সরল বিস্ময়ের সঙ্গে বললো, বাবলুদা, তোমার পায়ে কী হয়েছে?

অতীন শ্লেষের সঙ্গে বললো, মহারানীর এতক্ষণে নজরে এলো। কাল সারাদিন একবারও দেখিসনি?

–না দেখিনি তো। কী হয়েছে, কাঁটা ফুটেছে?

–কিছু হয়নি। চল্।

অতীন একটু পেছিয়ে পড়েছে। অলি তার বাহু ছুঁয়ে কাতর গলায় জিজ্ঞেস করলো, বাবলুদা, তুমি সব সময় আমার ওপর রাগ রাগ করে কথা বল কেন? আমি কী দোষ করেছি?

তারপর সে বললো, এ কি, তোমার গা গরম। জ্বর হয়েছে?

অতীন ধমক দিয়ে বললো, চুপ কর। জ্বর হয়েছে তো কী হয়েছে? এ নিয়ে চ্যাঁচামেচি করতে হবে না। তাড়াতাড়ি চল।

গলা চড়িয়ে সে কৌশিককে কাছে ডাকলো একটা সিগারেট চাইবার জন্য।

মেমারিতে পৌঁছেই একটা ট্রেন পেয়ে পমপমরা উঠে পড়লো, অতীন আর অলিকে বসে থাকতে হলো উল্টোদিকের প্ল্যাটফর্মে।

কৌশিকের কাছ থেকে প্যাকেটটা নিয়েছে অতীন, পায়ের ব্যথা ভোলার জন্য সে ঘন ঘন সিগারেট টানছে। একসময় সে বললো, আমি তোকে কৃষ্ণনগর স্টেশনে পৌঁছে দেবো, সেখান থেকে তুই সাইকেল রিকশা নিয়ে বাড়ি যেতে পারবি নিশ্চয়ই। আমি কিন্তু তোদের বাড়িতে যাব না।

অলি বললো, কেন, আমাদের বাড়িতে গেলে কী হয়? একটা দিন থেকে যেতে পারো না?

–না। কলকাতায় আমার তাড়াতাড়ি ফেরা দরকার। তাছাড়া মাসি-পিসি মামা-মামীর ভিড়, ঐ সব নেটিপেটি ব্যাপার আমার বিচ্ছিরি লাগে!

–তোমার পা-টা এতখানি ফুলেছে, আমার পিসেমশাইকে একবার দেখিয়ে নিতে পারো। আমার পিসেমশাই ওখানকার নাম করা ডাক্তার।

–আরে যা যা, মফস্বলের হাতুড়ে ডাক্তার দেখিয়ে আমার পা-টা হারাই আর কি! কেন, কলকাতায় ডাক্তারের অভাব? আমার নিজের বাড়িতেই দিদি আছে। আমি থাকতে-টাকতে পারব না। ওখানে গিয়ে আমার ওপর জোর করবি না বলছি!

-–ঠিক আছে, থাকতে হবে না।

অলি অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বসে রইলো। অতীন কিন্তু অলিকেই দেখছে, কখনো অলির পা, কখনো তার ঘাড়, কখনো তার ঊরুর ওপর মেলে রাখা করতল। অতীনের বুক কাঁপছে।

একটুবাদে অলি বললো, এই যে গ্রামে তোমরা সবাই মিলে এলে, এতে তোমাদের কী লাভ হচ্ছে?

অতীন বললো, লাভ আবার কী? অনেক কিছু দেখা হলো, তার মধ্য থেকেই কিছু কিছু শেখা যায়। এই যে নিরপদ দাসের বাড়িতে আমি আর কৌশিক রইলাম চব্বিশ ঘণ্টা, এই নিরাপদ দাস মাত্র তেরো বিঘে জমির মালিক। তেরো বিঘেতে কতটা ফসল হয় তুই জানিস? তাতে অত বড় একটা সংসার সারা বছর চলে না। ওদের প্রত্যেক বছর ধার করতে হয়। সেই ধার শোধ করার জন্য মহাজনের কাছে বেগার খাটতে হয়, প্রায় বণ্ডেড লেবারেরই মতন।

–কী রকম যেন মুখস্ত করা কথার মতন শোনাচ্ছে।

–মুখস্ত কথা মানে? আমি নিজের চোখে দেখলাম।

–তবুও। এসব কৌশিক, তোমাকে বলেছে। তুমি নিজে উপলব্ধি করোনি। শেখানো বাবলুদা। তোমরা যেভাবে এগোতে চাইছো, আমার মনে হচ্ছে সেটা অ্যামেচারিস!

–তোমরা তোমরা বলছিস যে! তুই নিজেও তো স্টাডি সার্কলের মেম্বার। তুই নিজে জোর করে এখানে এসেছিস।

–হ্যাঁ। এখানে এসেই আমি বুঝলুম, তোমরা যেভাবে দেশটাকে বদলাতে চাইছো, সে পদ্ধতিটা ঠিক বা ভুল যাই-ই হোক, তাতে আমি বিশেষ কিছু করতে পারবো না। আমার পক্ষে গ্রামে গ্রামে চাষীদের বাড়ি ঘোরা সম্ভব নয়। আমি নিজের লিমিটেশন জানি। যা আমি পারবো না, তা স্বীকার করতে লজ্জা নেই।

–তুই স্টাডি সার্কেল ছেড়ে দিবি?

–যদি আমাকে দিয়ে শহরে বসে কোনো কাজ করানো সম্ভব হয়, তা হলে থাকতে পারি। কিংবা তোমরা যদি বাদ দিতে চাও…

-–থাক, ও কথা থাক এখন।

-–দুঃখের বিষয়, আমাদের দেশের বেশিরভাগ লোকই নিজের লিমিটেশন বোঝে না। আমি বলছি না, মানুষ সীমাবদ্ধ প্রাণী। মানুষ তার সীমানা ছাড়াতে পারে, তার আগে সীমানাটা চেনা দরকার ভালো করে, বুঝতে হয় কোথায় কোথায় তার অক্ষমতা আর কোথায় কোথায় তার ক্ষমতাকে একটু কাজে লাগানো হয়নি।

–বলছি না। এখন থাক ওসব কথা।

অতীনের মাথাটা খুব ভারী লাগছে। তার ইচ্ছে করছে শুয়ে পড়তে। স্টেশানে এত লোক, হলে যদি অলির কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়া যেত। অলির কোলটাকে তার মনে হচ্ছে অগাধ সমুদ্রের মধ্যে একটা সবুজ দ্বীপ। এক টুকরো রোদ এসে পড়েছে অলির গায়ে। সেই রোদটা যেন অতীনের হৃদয়।

সে নিজেকে একটা ঝাড়া দিয়ে সোজা হয়ে বসে আবার সিগারেট টানতে লাগলো। একটুক্ষণ সে অন্যমনস্ক হয়ে গেল, চোখ অনেক সুদূরে। অলি তার পায়ে হাত রাখতেই সে চমকে উঠলো।

অলি জিজ্ঞেস করলো, খুব ব্যথা?

অতীন অলির চোখের দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে বললো, ট্রেনের দেখা নেই। কলকাতা থেকে আজ সারাদিনই যদি ট্রেন না আসে?

অলি কোনো উত্তর দিল না।

সমস্ত সকালের মধ্যে এই প্রথম অতীন একটু হেসে বললো, কৃষ্ণনগরে যে যেতেই হবে তার কি কোনো মানে আছে? অলি, তুই আর আমি যদি এখন নিরুদ্দেশে চলে যাই তা হলে কেমন হয়?

সকল অধ্যায়

১. ১.০১ একটা ঘোড়ার গাড়ি ডাকা হয়েছে
২. ১.০২ বৈদ্যনাথধাম স্টেশনে দাঁড়িয়ে
৩. ১.০৩ ভবদেব মজুমদারের আমলে
৪. ১.০৪ বাড়ির দারোয়ানের সঙ্গে তুতুলকে
৫. ১.০৫ দেশ বিভাগের পর দুটি নতুন দেশ
৬. ১.০৬ ছাত্র বয়েসে প্রতাপের ঘনিষ্ঠ বন্ধু
৭. ১.০৭ মেঘনা নদী পার হয়ে দায়ুদকান্দি
৮. ১.০৮ মালখানগরে প্রতাপদের বাড়ির সামনে
৯. ১.০৯ সত্যেন ভাদুড়ীর গায়ের পাঞ্জাবী
১০. ১.১০ দুটো সাইকেল ভাড়া করা হয়েছে
১১. ১.১২ জেল থেকে ফেরার পর
১২. ১.১১ দুপুরবেলা নানা গল্পের মধ্যে
১৩. ১.১৩ বাগানে নতুন গোলাপ চারা
১৪. ১.১৪ ওপরতলায় নিজেদের অংশটায়
১৫. ১.১৫ ঐ ছেলেটা মুসলমান বুঝি
১৬. ১.১৬ বন্যা হবার দরকার হয় না
১৭. ১.১৮ বিমানবিহারীদের আদি বাড়ি
১৮. ১.১৭ কলকাতার তালতলা অঞ্চল
১৯. ১.১৯ পিকলু আর বাবলু এক স্কুলে পড়তো
২০. ১.২০ তুতুল বাগবাজারের একটি স্কুলে
২১. ১.৪৩ পাড়ার কয়েকটি ছেলে ধরাধরি করে
২২. ১.৪৪ আর্মানিটোলার পিকচার প্যালেস
২৩. ১.৪৫ পাড়াটির নাম বাগবাজার
২৪. ১.৪৬ একটা নড়বড়ে কাঠের টেবিল
২৫. ১.৪৭ আগের দিনই খবর দিয়ে
২৬. ১.৪৮ নতুন বাড়ি ঠিক হলো কালীঘাটে
২৭. ১.২১ সরকারি কর্মচারির চাকরি
২৮. ১.২২ বঙ্কুবিহারীর স্ত্রী এলিজাবেথ
২৯. ১.২৩ একটা মোটরবাইক চেপে হাজির
৩০. ১.২৪ হারীত মণ্ডলকে নিয়ে ত্রিদিব
৩১. ১.২৫ বাড়িতে অসময়ে কোনো অতিথি এসে
৩২. ১.২৬ প্রতাপ সিগারেট খেতে খেতে
৩৩. ১.২৭ ভোর রাতে ঘুম ভেঙে গেল প্রতাপের
৩৪. ১.২৮ কলকাতার ভদ্রলোকদের বাড়িতে ঝি-চাকর
৩৫. ১.২৯ প্রীতিলতার হাঁপানির টান বেড়েছে
৩৬. ১.৩০ ট্রেনে আসবার সময়ে
৩৭. ১.৩১ স্বাধীনতার কয়েক বছর পর
৩৮. ১.৩২ ঢাকার সেগুনবাগানে মামুনের এক দিদির বাড়ি
৩৯. ১.৩৩ বেশ তাড়াতাড়িই শীত পড়ে গেছে
৪০. ১.৩৪ দেওঘরে প্রতাপকে থেকে যেতে হলো
৪১. ১.৩৫ মোহনবাগান লেনে চন্দ্রাদের বাড়ি
৪২. ১.৩৬ মোটর বাইকের গর্জনে পাড়া কাঁপিয়ে
৪৩. ১.৩৭ অল ওয়েভ রেডিও
৪৪. ১.৩৮ কানু যে ব্যাঙ্কে কাজ করে
৪৫. ১.৩৯ কলেজের গেট দিয়ে বেরিয়ে
৪৬. ১.৪০ দেওঘরে এসে উপস্থিত হলেন সত্যেন
৪৭. ১.৪১ পাতিপুকুরের বাড়ির ভিত তৈরির কাজ
৪৮. ১.৪২ কানুর বাড়ির ছাদের আলসেতে
৪৯. ২.০২ শেষ পরীক্ষার শেষ ঘণ্টা
৫০. ২.০৩ দুপুরবেলা প্রবল ঝড় হয়ে গেছে
৫১. ২.০৪ বাড়ির সামনে যে গেট ছিল
৫২. ২.০৬ খবরের কাগজ পড়ে যাচ্ছেন প্রতাপ
৫৩. ২.০৫ বাবুল বুঝতে পারেনি
৫৪. ২.০৭ পাতিপুকুর স্টপে বাস থেকে নেমে
৫৫. ২.০৮ গাড়ি ভাড়া করেছে আলতাফ
৫৬. ২.০৯ প্রেসিডেন্সি কলেজের গেট দিয়ে
৫৭. ২.১০ কেমিস্ট্রিতে ফার্স্ট ক্লাস
৫৮. ২.১১ রেল লাইনের ধারে
৫৯. ২.১২ টেলিফোনটা নামিয়ে রেখে
৬০. ২.১৩ সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে
৬১. ২.১৪ কয়েকদিন এড়িয়ে এড়িয়ে চলার পর
৬২. ২.১৫ মুড়ি ও তেলেভাজা খাওয়া
৬৩. ২.১৭ টেবিলের ওপর জোর একটা চাপড় মেরে
৬৪. ২.১৬ অসুখ-বিসুখের ব্যাপার
৬৫. ২.১৮ কফি হাউসে ঢোকার মুখে
৬৬. ২.১৯ তিন তিনটে সাধারণ নির্বাচন
৬৭. ২.২০ ভিত নেই তবু বাসস্থান গড়ে উঠেছে
৬৮. ২.২১ বৃষ্টির ছাঁট আসছে খুব
৬৯. ২.২২ আদালতে প্রতাপ
৭০. ২.২৩ সীট রিজার্ভেশানের সুযোগ
৭১. ২.২৪ লোদি গার্ডেনসে ত্রিদিব আর সুলেখা
৭২. ২.২৫ পত্রিকার নাম নিয়ে আলাপ-আলোচনা
৭৩. ২.২৬ নোয়াখালিতে বসিরের বাড়ি
৭৪. ২.২৭ থার্ড ইয়ার থেকে ফোর্থ ইয়ারে
৭৫. ২.২৮ কবি জসিমউদ্দিনের বাড়িতে
৭৬. ২.২৯ অতীনদের স্টাডি সার্কল
৭৭. ২.৩০ আজকালকার যুদ্ধে
৭৮. ২.৩১ রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে
৭৯. ২.৩২ কলেজ স্ট্রিটের কফি হাউস
৮০. ২.৩৩ টালিগঞ্জ ট্রাম ডিপোর কাছে
৮১. ২.৩৫ নোয়াখালিতে সিরাজুল
৮২. ২.৩৪ মেডিক্যাল কলেজ থেকে বাড়ি
৮৩. ২.৩৬ স্টাডি সার্কল থেকে
৮৪. ২.৩৭ তিনতলার এই ঘরখানি
৮৫. ২.৩৮ আলপথ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে
৮৬. ২.৩৯ কয়েকদিনের জ্বরেই একেবারে কাবু
৮৭. ২.৪০ একটা ভিড়ের বাসে চেপে
৮৮. ২.৪১ পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ এলাকা ছাড়িয়ে
৮৯. ২.৪২ মামুনের মেজাজ খারাপ
৯০. ২.৪৩ তুতুল একা একা
৯১. ২.৪৪ ঝোঁকের মাথায় প্রতাপ
৯২. ২.৪৫ সন্ধ্যারতির সময় ভক্ত ও দর্শক
৯৩. ২.৪৬ দোতলা থেকে কল্যাণী ডাকছেন
৯৪. ২.৪৭ অ্যালুমিনিয়ামের বাটি
৯৫. ২.৪৮ বড় তেঁতুল গাছ
৯৬. ২.৪৯ স্টাডি সার্কেল শেষ হয়ে যাওয়ার পর
৯৭. ২.৫০ জানলায় পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে
৯৮. ২.৫২ আকাশে জোরে বিদ্যুৎ চমকালে
৯৯. ২.৫১ চায়ের কাপ তুলে একটা চুমুক
১০০. ২.৫৩ দিনের পর দিন কেটে যায়
১০১. ২.৫৪ করোনেশান ব্রীজের কাছে
১০২. ২.৫৫ তিনবার সিটি দিয়ে থেমে গেল ট্রেনটা
১০৩. ২.৫৬ সিনেমা হল থেকে বেরিয়ে
১০৪. ২.৫৭ তুতুলের খুব অস্বস্তি হয়
১০৫. ২.৫৮ বছরের প্রথম দিনটি
১০৬. ২.৫৯ পুরোনো গাড়িটার বদলে
১০৭. ২.৬০ অকস্মাৎ মামুনকে গ্রেফতার
১০৮. ২.৬২ সারারাত ঘুমোতে পারেনি তুতুল
১০৯. ২.৬১ লণ্ডন শহরে পা দিয়ে
১১০. ২.৬৩ ট্রাম ধর্মঘট মিটলো
১১১. ২.৬৪ ট্রেন সাড়ে চার ঘণ্টা লেট
১১২. ২.৬৫ শহরের সমস্ত লোক
১১৩. ২.৬৬ সিঁড়ির মুখে ল্যান্ডলেডি
১১৪. ২.৬৭ তুতুল যে সার্জারিতে কাজ করে
১১৫. ২.৬৮ পমপম একটা রেডিও রেখে গেছে

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন