১.২১ সরকারি কর্মচারির চাকরি

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

সরকারি কর্মচারির চাকরি চব্বিশ ঘণ্টার চাকরি। অফিসের ডিউটি আট ঘণ্টা হলেও বাকি সময়টায় অন্য কোনো বৃত্তিমূলক কাজে নিযুক্ত থাকা যায় না। প্রতাপ এই নিয়মটা অক্ষরে অক্ষরে মানেন। সন্ধের পর দু’একটি পার্ট টাইম চাকরির প্রস্তাব পেয়েও তা প্রত্যাখ্যান করেছেন তিনি। অথচ প্রতাপের এখন টাকার টানাটানি চলছে।

প্রতাপদের সার্ভিসেই একজন খ্যাতনামা লোক আছেন, তাঁর নাম অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত। প্রতাপের থেকে অনেক সিনিয়র তিনি। প্রতাপ একদিন এক চায়ের নিমন্ত্রণের আসরে অচিন্ত্যবাবুকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, স্যার, আপনি যে এত সব লেখেন-টেখেন, তাতে টাকা পান নিশ্চয়ই, এতে গভর্নমেন্টের অবজেকশান নেই?

অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত এককালে অশ্লীল গল্প-উপন্যাস লেখক হিসেবে পরিচিত ছিলেন, ইদানীং তিনি শ্রীরামকৃষ্ণের আধ্যাত্মিক রসে ভরা জীবনী লিখছেন। তাঁর চোখে পুরু লেন্সের চশমা, কণ্ঠস্বর গমগমে। প্রতাপের প্রশ্ন শুনে তিনি ঈষৎ হাস্যে বললেন, আমার সহকর্মীরা আমার কোনো গল্প-উপন্যাস নিয়ে কিছু বলেন না, লিখে আমি কত টাকা পাই তা নিয়েই সকলের কৌতূহল!

প্রতাপ লজ্জা পেয়ে গেলেন। নভেল-নাটক পড়ার অভ্যেস নেই তাঁর। অচিন্ত্যবাবুর বিশেষ কোনো লেখা তিনি পড়েননি। একজন লেখকের সঙ্গে তাঁর সাহিত্য রচনা সম্পর্কে আলোচনা করার বদলে শুধু টাকা পয়সা নিয়ে প্রশ্ন করা যে রুচিহীনতার পরিচায়ক তা তিনি সেই মুহূর্তে বুঝলেন এবং ক্ষমাপ্রার্থী চোখে তাকালেন।

অচিন্ত্যকুমার বললেন, সরকারি কর্মচারির পক্ষে কোনো ক্রিয়েটিভ কাজে, যেমন গান গাওয়া, ছবি আঁকা বা সাহিত্য রচনা করার নিষেধ নেই। তবে পারমিশান নিতে হয়। এর থেকে টাকা রোজগার করলে ব্রিটিশ আমলে ফিফটি পারসেন্ট সরকারকে দিয়ে দেওয়ার নিয়ম ছিল। অবশ্য অ্যাপিল করলে এক্সজেম্পশানও পাওয়া যেত। অন্নদাশঙ্কর রায়ের নাম শুনেছেন নিশ্চয়ই? তিনি তো আমাদের থেকেও অনেক বড় সরকারি কর্মচারি, আই সি এস, তাঁকেও পারমিশান নিতে হয়েছে বোধহয়!

প্রতাপ একটু হতাশ হয়েছিলেন। সেরকম কোনো ক্রিয়েটিভ ফ্যাকাল্টি তাঁর নেই, সুতরাং চাকরির মাইনে ছাড়া আইনসঙ্গতভাবে উপার্জন বাড়াবার ক্ষমতাও নেই। এদিকে দেশের সম্পত্তি সব গেছে। উপরন্তু সংসারের বোঝা বেড়েছে।

অনেক ভেবেচিন্তে তিনি একটা উপায় বার করলেন। তাঁর বন্ধু বিমানবিহারী একটি পুস্তক প্রকাশনালয়ের মালিক। সেখান থেকে বিজ্ঞান, আইন, ডাক্তারি শাস্ত্রের বই-এর বাংলা অনুবাদ বেরুচ্ছে নিয়মিত। প্রতাপ নিজে বই লিখতে পারবেন না। কিন্তু ঐ সব বই-এর অনুবাদের কাজ করতে পারেন অনায়াসে। তিনি ইংরেজিটা ভালো জানেন, ম্যাট্রিক পরীক্ষাতে সংস্কৃততে লেটার পেয়েছিলেন। বাংলা লিখতে পারেন নির্ভুল বানানে। বিমানবিহারী এই প্রস্তাব শোনা মাত্র মহা বিস্ময়ের ভাণ করে বলেছিলেন, তুমি কী করে আমার মনের কথাটা জানলে? কদিন ধরে আমি এই কথাই ভাবছিলুম। ব্যবসা বড় হয়ে যাচ্ছে। সব দিক আমি সামলাতে পারছি না। তুমি সন্ধের দিকে এসে আমার অফিসের কাজকর্ম দেখে দাও!

প্রতাপ বলেছিলেন, না ভাই, সে কাজ নিতে পারবো না, সেটা বে-আইনি, তবে বই অনুবাদ করতে পারি।

যথারীতি বিভাগীয় অনুমতি নিয়ে প্রতাপ শুরু করলেন অনুবাদের কাজ। প্রথম প্রথম উৎসাহের চোটে লিখে ফেললেন ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ পৃষ্ঠা, তারপর আর মন বসে না। অল্প বয়েস থেকেই যাদের লেখার ঝোঁক নেই, তাদের পক্ষে পরিণত বয়েসে যে-কোনো কিছুই পাতার পর পাতা লিখে যাওয়া একটা ভীতিকর ব্যাপার! অনেক সময় সামান্য চিঠিপত্র লিখতেই কলম সরে না, আলস্য লাগে। প্রতাপের অবশ্য আদালতের মামলার রায় লেখার অভ্যেস আছে। কিন্তু অধিকাংশ রায়ের বয়ানই ছক বাঁধা, তাছাড়া সেই রায় লেখা তো চাকরির অঙ্গ। অচিন্ত্যবাবু দীর্ঘকাল হাকিমী করেও কী করে অতগুলি বই লিখেছেন তা ভেবে প্রতাপ এখন হতবাক্ হয়ে যান।

বিকেলের দিকে আদালতের কাজ শেষ হবার সময়টাতেই প্রতাপের গায়ে যেন জ্বর আসে। বাড়ি ফিরেই অনুবাদকর্ম নিয়ে বসতে হবে। নিজেই এই কাজ নিয়েছেন, সুতরাং ছুটি নেবার উপায় নেই। তবু তিনি মাঝে মাঝে দেরি করে বাড়ি ফেরেন, নিজের কাছেই ফাঁকি মারার এই অছিলা খোঁজেন।

একদিন শিয়ালদা থেকে বেরিয়ে তিনি ভাবলেন, অনেকদিন সত্যেনদের খবর নেওয়া হয়নি, তালতলা ঘুরে আসা যাক। ফাঁইলপত্র দিয়ে আদালিকে তিনি বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন। নিজে হাঁটতে শুরু করলেন মৌলালির দিকে। অল্প অল্প বৃষ্টি পড়ছে, প্রতাপের সঙ্গে ছাতা নেই, কিন্তু তাঁর ভালোই লাগছে। মনে বেশ একটা হালকা হালকা ভাব। একটা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি এক প্যাকেট প্লেয়ার্স নাম্বার থ্রি কিনে ফেললেন দুম করে। ইদানীং খরচ কমাবার জন্য তিনি মেপোল ধরেছেন। কিন্তু ভালো সিগারেট খাওয়া তাঁর এক বিলাসিতা। ছাত্র বয়েসে তিনি প্রথম সিগারেট টানা শেখার সময় প্লেয়ার্স নাম্বার থ্রি কিনতেন, তখন তিনি ছিলেন মালখানগরের এক সচ্ছল পরিবারের সন্তান। মালখানগরের বোসেদের বাড়ির একটি ছেলেই তাঁকে প্রথম সিগারেট ধরায়।

সাদা রঙের চৌকো প্যাকেট, খোলার পর প্রতাপ প্রথমে ঘ্রাণ নিলেন। হ্যাঁ, বেশ টাটকা, এর গন্ধেই একটা মাদকতা আছে। একটা সিগারেট বার করে ধরাতেই প্রতাপ যেন ফিরে গেলেন ছাত্র বয়েসে।

বসবার ঘরে পাঁচ ছ’জন লোক, সেখানে বসে আছেন ত্রিদিব। সুলেখা নেই। লোকগুলি প্রতাপের অপরিচিত। তাই প্রতাপ একটু দ্বিধান্বিতভাবে দাঁড়ালেন দরজার কাছে।

ত্রিদিব বললেন, সুলেখার একটু জ্বর হয়েছে, আপনি যান, ওপরে যান। আমি একটু পরে আসছি।

প্রতাপ এ বাড়ির জামাই, সুতরাং বসবার ঘরে তাঁর বসরার কথা নয়। সুলেখার জ্বর হয়েছে শুনে তিনি যেন একটু অবাক হলেন। সুলেখার মতন নারীদের সঙ্গে যেন অসুখ-বিসুখের কোনো সম্পর্ক থাকার কথা নয়।

সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে প্রতাপ নতুন রঙের গন্ধ পেলেন। দেয়ালগুলিতে সদ্য কলি ফেরানো হয়েছে। জানলা-দরজায় নতুন রঙ। প্রতাপ অনেকদিন এ বাড়িতে আসেননি।

এ বাড়িতে কয়েকজন আশ্রিত-পরিজন রয়েছে, তারা সবাই থাকে নিচের তলায়। দোতলাটি বলতে গেলে ফাঁকা। কয়েকটি ঘর তালাবন্ধ, তার মধ্যে একটি ঘর মমতার, সেখানে মমতার কুমারী জীবনের কিছু কিছু জিনিসপত্র এখনো রয়ে গেছে। যুদ্ধের সময় প্রতাপ কিছুদিন এসে এখানে ছিলেন, তাঁর মেয়ে মুন্নির জন্মও হয়েছিল এখানে। শুধু মুন্নি কেন, পিকলুর জন্মের সময়েও তো মমতা এসে বাড়িতে ছিলেন, তখন মমতার মা বেঁচে। একমাত্র বাবলুর জন্ম হয়েছিল মালখানগরে।

দোতলায় এসে প্রতাপ একটা ঘরের সামনে এসে ডাকলেন, সুলেখা! সুলেখা!

একজন দাসী বেরিয়ে এসে বললো, ও জাঁইবাবু? অ বৌদি, বড়জাঁইবাবু এয়েচেন!

প্রতাপ বললেন, বৌদি শুয়ে আছেন নাকি?

দাসী বললো, হ্যাঁ। যান না!

প্রতাপ ভেতরে ঢুকবার আগেই সুলেখা দরজার কাছে এসে জোড়া ভুরু তুলে ক্লাসিক্যাল বিস্ময়ের ছবি হয়ে বললেন, ও, প্রতাপদা! কী আশ্চর্য! পথ ভুলে নাকি?

প্রতাপ চুপ করে কয়েক মুহূর্ত অপলক ভাবে চেয়ে রইলেন। তিনি গান গাইতে পারেন না। ছবি আঁকেন না। কবিতা রচনা করতে পারেন না, তবু সৌন্দর্যের তরঙ্গ তাঁর হৃদয়ে একটা আলোড়ন তোলে। সুলেখা কোনোরকম সাজগোজ করেননি। একটা গোলাপি ডুরে শাড়ি পরা, চুল খোলা পিঠের ওপর। চোখ দুটো ঈষৎ ছলছলে। তাঁর অস্তিত্বের মধ্যেই একটা মাধুর্য আছে।

প্রতাপ আস্তে আস্তে বললেন, তোমার জ্বর?

–সেই খবর পেয়েই এলেন নাকি? এই সব ক্ষেত্রে মিথ্যেটাই নিদোষ মধুর। প্রতাপ মাথা নেড়ে বললেন, কী করে যেন টের পেয়ে গেলাম!

এগিয়ে এসে তিনি সুলেখার কপালে হাত দিয়ে বললেন, কই, টেম্পারেচার নেই তো!

ঝনঝন করে হেসে সুলেখা বললেন, আপনি এলেন তো, অমনি কমে গেল বোধ হয়! আসুন, ভেতরে আসুন! আপনার দিদি কেমন আছেন? বাচ্চারা?

সবে মাত্র দেয়াল রং করা শেষ হয়েছে বলে ঘরের মধ্যে জিনিসপত্র সব অগোছালো ভাবে ডাঁই করা। একটা হাতলওয়ালা চেয়ারের মিহি ধুলো ঝাড়ন দিয়ে পরিষ্কার করে সুলেখা বললেন, বসুন, এখানে বসুন! সত্যিই কাল আমার জ্বর এসেছিল। বোধ হয় এই ধুলোর জন্যই!!

প্রতাপ বললেন, এত সব ধুলোবালি তোমার সহ্য হবে কেন? গোটা বাড়িটাই রং করা হলো বুঝি?

সুলেখা বললেন, হ্যাঁ। অনেকদিন হয়নি তো। তাছাড়া বিনতারা আসছে জানেন তো? এখানেই থাকবে!

প্রতাপের ছোট শ্যালিকা বিনতা বিয়ের পর থেকেই ইন্দোরে আছে, অনেকদিন তার সঙ্গে দেখা হয়নি। তার আসার খবরে প্রতাপ উৎফুল্ল হলেও পরের মুহূর্তেই যেন মনের মধ্যে একটা কাঁটা বোধ করলেন। বিনতার স্বামী খুব বড় চাকরি করে, তাছাড়া তাদের বর্ধমানে সম্পত্তি আছে। ত্রিদিবের অবস্থা বেশ ভালো, সেই তুলনায় প্রতাপেরই এখন টানাটানির সংসার। কয়েক বছর আগেও প্রতাপ যে-কোনো পারিবারিক সম্মিলনে অন্যদের একটা পয়সাও খরচ করতে দেননি। কিন্তু এখন আর তাঁর সে সামর্থ্য নেই। বিনতারা আসবে, তাদের জন্য নেমন্তন্ন, বেড়ানো, উপহার … । প্রতাপ জোর করে মন থেকে এই চিন্তাটা মুছে দিলেন। আজ সন্ধেবেলা এসব কথা থাক।

সুলেখা বললেন, বিনতারা আসছে, আপনারাও ক’দিন এসে এখানে থাকুন না! বেশ মজা হবে!

প্রতাপ হাসলেন। শ্বশুরবাড়িতে এসে থাকার কি আর বয়েস আছে তাঁর? ছেলেমেয়েদের সঙ্গে মমতাকে কয়েকদিনের জন্য পাঠিয়ে দেওয়া যেতে পারে।

–তুমি বসো, সুলেখা। তোমার সঙ্গে একটু কথা বলি! তোমার কতাকে তো দেখলাম। খুব ব্যস্ত!

সুলেখা খাটের ওপর বসে পড়ে বললেন, আপনারা দেওঘরে গিসলেন, সেই গল্পই তো শোনা হলো না। অবশ্য পিকলু এসেছিল পরশুদিন…

প্রতাপ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, পিকলু এসেছিল?

–হ্যাঁ। ও তো আসে মাঝে মাঝে। ওর মামার লাইব্রেরি ঘর থেকে বই নিয়ে যায়। ঠিক মামার মতনই ওর বই পড়ার নেশা, হয়েছে।

–আমি তো জানি না যে পিকলু আসে এখানে।

–জানবেন কী করে? ছেলের সঙ্গে কথা বলার সময় পান? শুনলুম, খুব নাকি ব্যস্ত আপনি আজকাল? পিকলু আসবে না কেন? বড় হয়েছে, ট্রামবাসে একা একা চলাফেরা করতে পারে! আপনি কী খাবেন?

–কিচ্ছু না!

–বা, কোর্ট থেকে আসছেন তো, খিদে পেয়েছে নিশ্চয়ই। বসুন, আমি আসছি!

–না, এখন যেও না! একটু বসো।

প্রতাপ পকেট থেকে প্যাকেটটি বার করে আর একটি সিগারেট ধরালেন। সুলেখার সঙ্গে যে বিশেষ কিছু কথা আছে তাঁর, তা নয়। এই সিগারেটটাই হচ্ছে ভালো মুডের প্রতীক, সুলেখার সঙ্গে তিনি কিছুক্ষণ ভালো সময় কাটাতে চান।

দাসীকে ডেকে সুলেখা চা-জলখাবার আনার নির্দেশ দিলেন। তারপর বললেন, আচ্ছা, প্রতাপদা, আমি যদি চাকরি করি, তাতে আপনার আপত্তি আছে?

–চাকরি, কী চাকরি?

–সারা দুপুর তো বাড়িতেই বসে থাকি। একলা একলা সময় কাটে না। খবরের কাগজে একটা বিজ্ঞাপন দেখে চিঠি লিখে দিলুম, তাতেই ওরা ডেকেছে। এখন ইচ্ছে করলেই জয়েন করতে পারি। ওকে কিন্তু এখনো কিছু বলিনি, চিঠিটা আজই এসেছে।

–কী চাকরি, সেটা বলো?

–বেথুন কলেজে, ইংরিজির লেকচারার।

আজ প্রতাপের মনে পড়লো, সুলেখা ইংরিজিতে খুব ভালো ছাত্রী ছিল। এম এ-তে ফাস্ট ক্লাস পেয়েছে, বিয়ের আগে তার বিলেতে গিয়ে আরও পড়বার কথা ছিল, শেষ মুহূর্তে আর যায়নি। রূপ ও গুণের এমন সমন্বয় দেখা যায় না।

এ দেশের মেয়েরা আজকাল লেখাপড়া শিখছে হঠাৎ বিধবা হলে বিপদে না পড়ার জন্য। স্বাভাবিক, সুখী বিবাহিত জীবন হলে লেখাপড়ার আর কোনো মূল্য নেই।

প্রতাপ জিজ্ঞেস করলেন, তুমি চাকরি করবে …..সে রকম দরকার তো কিছু নেই চাকরি করতে তোমার কষ্ট হবে না?

–কষ্ট আবার কী? ওয়েলিংটন থেকে এক ট্রামে যাবো। এক ট্রামে ফিরবো।

–তবু প্রত্যেকদিন যাওয়া—

–শুধু শুধু বাড়িতে বসে থাকার চেয়ে সেটা ভালো নয়?

–ত্রিদিবদাকে এখনো জিজ্ঞেস করোনি?

–বললুম না, আজই চিঠি এসেছে। আপনি বলুন না, আপনার কী মত? আপনার আপত্তি আছে?

–আমার কেন আপত্তি থাকবে? আমার মত জিজ্ঞেস করলে আমি হ্যাঁ-ই বলবো, কলেজের চাকরি, হালকা কাজ, প্রায়ই ছুটিছাটা থাকে!

সুলেখার মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। খাট থেকে নেমে এসে প্রতাপের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, আমি ঠিক যা ভাবি, আপনি সেইরকম। এই যে আপনি হ্যাঁ বললেন, এতে আমার সব দোনামোনা কেটে গেল। এবার ওকে বুঝিয়ে বলা মোটেই শক্ত হবে না।

প্রতাপ সুলেখার একটা হাত ধরে বললেন, ইস, আমার ইচ্ছে করছে তোমার ছাত্র হতে!

প্রতাপের মনটা খুশীতে ভরে গেছে। সুলেখা যে তাঁর মতামতকে এতখানি গুরুত্ব দিয়েছে, এতে তাঁর পৌরুষ উদ্দীপিত হয়। আজ তাঁর এখানে এসে পড়া আকস্মিক। কিন্তু প্রতাপের মনে হলো, নিয়তি নির্ধারিত। সুলেখার চাকরি নেওয়া একটা বড় ঘটনা–এতে তাঁকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে হলো।

চা-জলখাবার খেতে খেতে ঐ চাকরি বিষয়ে আরও খুঁটিনাটি জিজ্ঞেস করতে লাগলেন প্রতাপ। তার আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে কোনো নারী এখনো চাকরি করে না। সুলেখা চাকরি করতে যাচ্ছে প্রয়োজনে নয় শখে, তবু এর মধ্যে যে একটা রীতি ভাঙার ব্যাপার আছে, সেটাই প্রতাপের পছন্দ হলো।

একটু বাদে বাইরে থেকে কে যেন একজন নাটকীয়ভাবে ডাকলো, মাগো, মা জননী!

প্রতাপ ভুরু কোঁচকালেন। সুলেখা উঠে গিয়ে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বললেন, এ কী? আজ আবার এসব কী নিয়ে এসেছেন?

প্রতাপ ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন, একজন রুখু দাড়িওয়ালা, লম্বা ধ্যাড়েঙ্গা চেহারার লোক হাতে এক ছড়া কলা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। লোকটা কী ফেরিওয়ালা? তা হলে সরাসরি ওপরে আসবে কী করে?

সুলেখা পরিচয় করিয়ে দিলেন, ইনি হারীত মণ্ডল।

সেই নাম শুনে তৎক্ষণাৎ প্রতাপের মনে কোনো রেখাপাত করলো না। এই ফেরিওয়ালা শ্রেণীর লোকটি ঠিক এই মুহূর্তে বিঘ্ন ঘটাতে এসেছে বলে তিনি অপ্রসন্ন হলেন।

সুলেখা আবার বললেন, কী যে করেন আপনি, এতগুলো কলা নিয়ে এসেছেন কেন? হারীত মণ্ডল বললো, মা জননী, আমরা গরিব হইতে পারি, কিন্তু ভিখারী তো না? আমাগোও তো মাঝে মাঝে কিছু দিতে ইচ্ছা করে?

এই উটকো লোকটির মা জননী ডাক প্রতাপ খুবই অপছন্দ করলেন। সুলেখার প্রতি ঐ সম্বোধন যেন একেবারেই বেমানান। কিন্তু তিনি আপত্তি করতে পারলেন না, কারণ তাঁর মনে হলো, ঐ লোকটির প্রতি সুলেখার বেশ প্রশ্রয় আছে! এই উপদ্রব থেকে এখন সরে পড়াই ভালো।

প্রতাপ উঠে পড়ে বললেন, সুলেখা, আমি এখন চলি,বাড়িতে কাজ আছে। নিচে ত্রিদিবদার সঙ্গে কথা বলে যাচ্ছি!

হারীত মণ্ডলের প্রতি ভূক্ষেপ মাত্র না করে প্রতাপ নেমে গেলেন নিচে।

বাড়ি ফিরে পোশাক বদলেই প্রতাপ বই-খাতা-কলম খুলে বসলেন। তাঁর কাজে নতুন উৎসাহ এসেছে। সুলেখাই আজকের প্রেরণা। ঐ যে সুলেখা তাঁর জীবনের একটা বড় ব্যাপারে প্রতাপের মতামতকে এতটা মূল্য দিয়েছেন, তাতেই প্রতাপের অহমিকা অনেক চাঙ্গা হয়ে গেছে। মমতাকে তিনি সংক্ষেপে বিনতা আসার খবর জানিয়েছেন, বাকি কথা রাত্তিরে বিছানায় হবে। বিনতা আসছে বলেই প্রথম অনুবাদের কাজটা তাঁর তাড়াতাড়ি শেষ করা দরকার।

লিখতে লিখতে একটা ইংরিজি শব্দতে আটকে গেলেন প্রতাপ। অভিধান দেখা দরকার। তিনি উঠে এলেন পাশের ঘরে।

বাবলু আর পিকলুর সঙ্গে আজ মুন্নিও বসেছে, একটা টেবিলের তিন পাশে তারা পড়ছে তিন রকম পড়া। বাবলু বাবাকে দেখেই একটা বই লুকিয়ে ফেলো। মুন্নি খাতায় ছবি আঁকছিল। খাতা বন্ধ করলো। আর পিকলু মন দিয়ে অঙ্ক কষছিল। করেই যেতে লাগলো, খেয়াল করলো না বাবার উপস্থিতি।

প্রতাপ জিজ্ঞেস করলেন, ইংলিশ ডিকশনারিটা কোথায় রে, পিকলু?

পিকলু মাথা তুলে বাবাকে দেখলো। যেন তার ঘোর কাটতে সময় লাগলো খানিকটা। তারপর সে অভিধানটা খুঁজে বাবাকে দেবার আগে বললো, তুমি কোন্ ওয়ার্ড খুঁজছো বাবা?

প্রতাপ বললেন, সোলেসিজম!

পিকলু জিজ্ঞেস করলো, বানানটা বলো, আমি দেখে দিচ্ছি।

প্রতাপ হাতের কাগজ দেখে বললেন, এস ও এল ই সি আই এস এম!

পিকলু অভিধানের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে এস আসবার আগেই বললো, ও, সোলইসিজম? ওর মানে হচ্ছে ব্যাকরণের ভুল। বা উল্টোপাল্টা ব্যবহার। এটা গ্রীক শব্দ, বাবা। সোলি বলে একটা জায়গা ছিল, সেখানে ভুল গ্রীক বলা হতো!

প্রতাপ চমৎকৃত হলেন পিকলুর দ্বিধাহীনভাব দেখে। একটা ইংরিজি শব্দের মানে তিনি জানেন না, তাঁর ছেলে জানে, এ তো হতেই পারে। কিন্তু অভিধান হাতে নিয়েও ঠিক পাতাটা খোলার আগে পিকলু কী রকম আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে কথাটা বললো?

প্রতাপ অভিধানটা নিয়ে তবু মিলিয়ে দেখলেন, পিকলু ঠিকই বলেছে। পিকলু বিজ্ঞানের ছাত্র, তবু সে ইংরিজি ভাষা সম্পর্কেও এত জানে?

প্রতাপ জিজ্ঞেস করলেন, তুই এটা জানলি কী করে রে, পিকলু?

পিকলু বললো, আমি মাঝে মাঝেই এনসাইক্লোপিডিয়া পড়ি। আমার খুব ভালো লাগে।

প্রতাপ উচ্ছ্বাসপ্রবণ নন। ছেলেমেয়েদের নিয়ে তিনি প্রকাশ্যে বাড়াবাড়ি করেন না কখনো। তবু আজ তিনি ভাবলেন, এ ছেলেটা জিনিয়াস! ভবিষ্যতে পিকলু সাঙ্ঘাতিক বড় একটা কিছু করবে!

সকল অধ্যায়

১. ১.০১ একটা ঘোড়ার গাড়ি ডাকা হয়েছে
২. ১.০২ বৈদ্যনাথধাম স্টেশনে দাঁড়িয়ে
৩. ১.০৩ ভবদেব মজুমদারের আমলে
৪. ১.০৪ বাড়ির দারোয়ানের সঙ্গে তুতুলকে
৫. ১.০৫ দেশ বিভাগের পর দুটি নতুন দেশ
৬. ১.০৬ ছাত্র বয়েসে প্রতাপের ঘনিষ্ঠ বন্ধু
৭. ১.০৭ মেঘনা নদী পার হয়ে দায়ুদকান্দি
৮. ১.০৮ মালখানগরে প্রতাপদের বাড়ির সামনে
৯. ১.০৯ সত্যেন ভাদুড়ীর গায়ের পাঞ্জাবী
১০. ১.১০ দুটো সাইকেল ভাড়া করা হয়েছে
১১. ১.১২ জেল থেকে ফেরার পর
১২. ১.১১ দুপুরবেলা নানা গল্পের মধ্যে
১৩. ১.১৩ বাগানে নতুন গোলাপ চারা
১৪. ১.১৪ ওপরতলায় নিজেদের অংশটায়
১৫. ১.১৫ ঐ ছেলেটা মুসলমান বুঝি
১৬. ১.১৬ বন্যা হবার দরকার হয় না
১৭. ১.১৮ বিমানবিহারীদের আদি বাড়ি
১৮. ১.১৭ কলকাতার তালতলা অঞ্চল
১৯. ১.১৯ পিকলু আর বাবলু এক স্কুলে পড়তো
২০. ১.২০ তুতুল বাগবাজারের একটি স্কুলে
২১. ১.৪৩ পাড়ার কয়েকটি ছেলে ধরাধরি করে
২২. ১.৪৪ আর্মানিটোলার পিকচার প্যালেস
২৩. ১.৪৫ পাড়াটির নাম বাগবাজার
২৪. ১.৪৬ একটা নড়বড়ে কাঠের টেবিল
২৫. ১.৪৭ আগের দিনই খবর দিয়ে
২৬. ১.৪৮ নতুন বাড়ি ঠিক হলো কালীঘাটে
২৭. ১.২১ সরকারি কর্মচারির চাকরি
২৮. ১.২২ বঙ্কুবিহারীর স্ত্রী এলিজাবেথ
২৯. ১.২৩ একটা মোটরবাইক চেপে হাজির
৩০. ১.২৪ হারীত মণ্ডলকে নিয়ে ত্রিদিব
৩১. ১.২৫ বাড়িতে অসময়ে কোনো অতিথি এসে
৩২. ১.২৬ প্রতাপ সিগারেট খেতে খেতে
৩৩. ১.২৭ ভোর রাতে ঘুম ভেঙে গেল প্রতাপের
৩৪. ১.২৮ কলকাতার ভদ্রলোকদের বাড়িতে ঝি-চাকর
৩৫. ১.২৯ প্রীতিলতার হাঁপানির টান বেড়েছে
৩৬. ১.৩০ ট্রেনে আসবার সময়ে
৩৭. ১.৩১ স্বাধীনতার কয়েক বছর পর
৩৮. ১.৩২ ঢাকার সেগুনবাগানে মামুনের এক দিদির বাড়ি
৩৯. ১.৩৩ বেশ তাড়াতাড়িই শীত পড়ে গেছে
৪০. ১.৩৪ দেওঘরে প্রতাপকে থেকে যেতে হলো
৪১. ১.৩৫ মোহনবাগান লেনে চন্দ্রাদের বাড়ি
৪২. ১.৩৬ মোটর বাইকের গর্জনে পাড়া কাঁপিয়ে
৪৩. ১.৩৭ অল ওয়েভ রেডিও
৪৪. ১.৩৮ কানু যে ব্যাঙ্কে কাজ করে
৪৫. ১.৩৯ কলেজের গেট দিয়ে বেরিয়ে
৪৬. ১.৪০ দেওঘরে এসে উপস্থিত হলেন সত্যেন
৪৭. ১.৪১ পাতিপুকুরের বাড়ির ভিত তৈরির কাজ
৪৮. ১.৪২ কানুর বাড়ির ছাদের আলসেতে
৪৯. ২.০২ শেষ পরীক্ষার শেষ ঘণ্টা
৫০. ২.০৩ দুপুরবেলা প্রবল ঝড় হয়ে গেছে
৫১. ২.০৪ বাড়ির সামনে যে গেট ছিল
৫২. ২.০৬ খবরের কাগজ পড়ে যাচ্ছেন প্রতাপ
৫৩. ২.০৫ বাবুল বুঝতে পারেনি
৫৪. ২.০৭ পাতিপুকুর স্টপে বাস থেকে নেমে
৫৫. ২.০৮ গাড়ি ভাড়া করেছে আলতাফ
৫৬. ২.০৯ প্রেসিডেন্সি কলেজের গেট দিয়ে
৫৭. ২.১০ কেমিস্ট্রিতে ফার্স্ট ক্লাস
৫৮. ২.১১ রেল লাইনের ধারে
৫৯. ২.১২ টেলিফোনটা নামিয়ে রেখে
৬০. ২.১৩ সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে
৬১. ২.১৪ কয়েকদিন এড়িয়ে এড়িয়ে চলার পর
৬২. ২.১৫ মুড়ি ও তেলেভাজা খাওয়া
৬৩. ২.১৭ টেবিলের ওপর জোর একটা চাপড় মেরে
৬৪. ২.১৬ অসুখ-বিসুখের ব্যাপার
৬৫. ২.১৮ কফি হাউসে ঢোকার মুখে
৬৬. ২.১৯ তিন তিনটে সাধারণ নির্বাচন
৬৭. ২.২০ ভিত নেই তবু বাসস্থান গড়ে উঠেছে
৬৮. ২.২১ বৃষ্টির ছাঁট আসছে খুব
৬৯. ২.২২ আদালতে প্রতাপ
৭০. ২.২৩ সীট রিজার্ভেশানের সুযোগ
৭১. ২.২৪ লোদি গার্ডেনসে ত্রিদিব আর সুলেখা
৭২. ২.২৫ পত্রিকার নাম নিয়ে আলাপ-আলোচনা
৭৩. ২.২৬ নোয়াখালিতে বসিরের বাড়ি
৭৪. ২.২৭ থার্ড ইয়ার থেকে ফোর্থ ইয়ারে
৭৫. ২.২৮ কবি জসিমউদ্দিনের বাড়িতে
৭৬. ২.২৯ অতীনদের স্টাডি সার্কল
৭৭. ২.৩০ আজকালকার যুদ্ধে
৭৮. ২.৩১ রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে
৭৯. ২.৩২ কলেজ স্ট্রিটের কফি হাউস
৮০. ২.৩৩ টালিগঞ্জ ট্রাম ডিপোর কাছে
৮১. ২.৩৫ নোয়াখালিতে সিরাজুল
৮২. ২.৩৪ মেডিক্যাল কলেজ থেকে বাড়ি
৮৩. ২.৩৬ স্টাডি সার্কল থেকে
৮৪. ২.৩৭ তিনতলার এই ঘরখানি
৮৫. ২.৩৮ আলপথ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে
৮৬. ২.৩৯ কয়েকদিনের জ্বরেই একেবারে কাবু
৮৭. ২.৪০ একটা ভিড়ের বাসে চেপে
৮৮. ২.৪১ পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ এলাকা ছাড়িয়ে
৮৯. ২.৪২ মামুনের মেজাজ খারাপ
৯০. ২.৪৩ তুতুল একা একা
৯১. ২.৪৪ ঝোঁকের মাথায় প্রতাপ
৯২. ২.৪৫ সন্ধ্যারতির সময় ভক্ত ও দর্শক
৯৩. ২.৪৬ দোতলা থেকে কল্যাণী ডাকছেন
৯৪. ২.৪৭ অ্যালুমিনিয়ামের বাটি
৯৫. ২.৪৮ বড় তেঁতুল গাছ
৯৬. ২.৪৯ স্টাডি সার্কেল শেষ হয়ে যাওয়ার পর
৯৭. ২.৫০ জানলায় পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে
৯৮. ২.৫২ আকাশে জোরে বিদ্যুৎ চমকালে
৯৯. ২.৫১ চায়ের কাপ তুলে একটা চুমুক
১০০. ২.৫৩ দিনের পর দিন কেটে যায়
১০১. ২.৫৪ করোনেশান ব্রীজের কাছে
১০২. ২.৫৫ তিনবার সিটি দিয়ে থেমে গেল ট্রেনটা
১০৩. ২.৫৬ সিনেমা হল থেকে বেরিয়ে
১০৪. ২.৫৭ তুতুলের খুব অস্বস্তি হয়
১০৫. ২.৫৮ বছরের প্রথম দিনটি
১০৬. ২.৫৯ পুরোনো গাড়িটার বদলে
১০৭. ২.৬০ অকস্মাৎ মামুনকে গ্রেফতার
১০৮. ২.৬২ সারারাত ঘুমোতে পারেনি তুতুল
১০৯. ২.৬১ লণ্ডন শহরে পা দিয়ে
১১০. ২.৬৩ ট্রাম ধর্মঘট মিটলো
১১১. ২.৬৪ ট্রেন সাড়ে চার ঘণ্টা লেট
১১২. ২.৬৫ শহরের সমস্ত লোক
১১৩. ২.৬৬ সিঁড়ির মুখে ল্যান্ডলেডি
১১৪. ২.৬৭ তুতুল যে সার্জারিতে কাজ করে
১১৫. ২.৬৮ পমপম একটা রেডিও রেখে গেছে

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন