ছোটলোক – শচীন দাশ

ইমদাদুল হক মিলন

ছোটলোক – শচীন দাশ

ভরদুপুরে গলাটা আবারও সাপের মতো হিসিয়ে উঠল, কী রে মাগি দরজাটা খুলবি?

বনানী তখনো বুম্বার পাশে, কাত হয়ে শুয়ে একটু চোখ বুজেছে, চিৎকারের শব্দে ঘুমটা হঠাৎ ভেঙে গেল; চোখ দুটো তো খুললই, তাকিয়ে দেখে বুম্বাও পিটপিট করে চোখ খুলে দরজার দিকে মুখ ঘুরিয়েছে।

বনানী বিরক্ত হয়।

দরজাটা বন্ধ হওয়া দরকার। হলে আর এভাবে চিৎকারটা ঘরের ভেতরে এসে আছড়ে পড়বে না। তবে হাওয়াটা বন্ধ হয়ে যাবে। তা হয় হোক, বুম্বাকে না হয় হাত পাখা চালিয়েই ঠাণ্ডা করবে সে, তবু তো ছেলেটা বাঁচবে।

বনানী উঠে বসে। কাঁধের ওপরে আঁচলটা ফেলে এগিয়েও যায়। কিন্তু দরজায় হাত রাখতে গিয়েই আবার থমকে দাঁড়ায়। একটা কুৎসিত গালাগাল দমকা বাতাসে ঠিক কঁচা নর্দমার পচা পাঁকের মতোই দুর্গন্ধ তুলে হঠাৎ মিলিয়ে গেল। আর তার পরেপরেই আবারও সেই পুরুষ গর্জন। সেই চেঁচামেচি।

আশ্চর্য—সেই কোন সকালে শুরু হয়েছে; মাঝখানে থেমে গিয়ে বেলা দশটায় একবার জ্বলে উঠেছিল, সেও সামান্য সময়, বোধহয় ঠিক সুবিধেও হয়নি, এখন সুদে আসলে সেটা আবার পুষিয়ে নিচ্ছে।

বনানী অবাক হয়।

করে কী লোকটা–! চাকরিবাকরি নেই নাকি? নাকি সারাদিনই ঘরে বসে বউয়ের সঙ্গে গলাবাজি। হইচই আর চিৎকার। পুরুষ মানুষ—! একটু আধটু চিৎকার চেঁচামেচি হতেই পারে; কিন্তু তাই বলে সারাদিন সারারাত। আর বউটাও তেমনি। হাঁটু অবধি শাড়ি তুলে গলার শির ফুলিয়ে চেঁচাচ্ছে। কে জানে একটু পরে আবার হাতাহাতি হবে কি না–!

বনানী সরে আসে।

মনে মনে অজয়ের ওপর রাগই হয়। খুঁজে খুঁজে একটা বাড়িও জোগাড় করেছে বটে। একে বস্তি, পরপর লাগোয়া ঘর, তার ওপর কল বাথরুম সব একসঙ্গে। পরপর দশ ঘরের চানটান আর মলমূত্র ত্যাগের জায়গা; কেন আর কোথাও কী কোনো ঘর পাওয়া যাচ্ছিল না। না হয় আর দুটোদিন দেরিই হত। চোখ কান ঝুঁজে না হয় আর কয়েকটা দিন ঐ বেলগাছিয়ার বাড়িতেই কাটিয়ে দিত বনানীরা। অবশ্য ভাবলেও বনানী জানে, সে আর পারছিল না; সহ্য করতে করতে সহ্যের একেবারে শেষ সীমায় গিয়ে পৌঁছেছিল। এরপরেও ওখানে থাকা মানে কিছু একটা ঘটে যাওয়া। আর সেটা যে বনানীর ওপর দিয়েই যেত তাতে কোনো সন্দেহ নেই। হয় ছেলেটার কিছু হত, না হয় বনানী নিজেই একদিন গলায় দড়ি দিয়ে বসত। অজয় টের পেয়েই তাই হুটপাট করেছে। বস্তি হলেও এমন জায়গায় এসে সংসারটা পেতেছে–। সময় পেলে কী জানি হয়ত অন্য কোথাও এর চেয়ে একটা ভালো ঘরই পেত অজয়।

অবশ্য পায়নি যে একেবারে তা নয়; দু একটা গোটা বাড়িরই খবর পেয়েছিল। কিন্তু টাকার অংক শুনেই আর এগোয়নি। এগাবে কী, কটাকাই বা মাইনে পায়…মাস গেলে সব মিলিয়ে ওই সাতশ। তা এই সামান্য আয়ের সিংহভাগই যদি বাড়ির পেছনে চলে যায়, তাহলে আর সংসার চলে কী করে! নিজেরা না হয় কষ্টেসৃষ্টে কাটাল, কিন্তু কচি একটা ছেলে…তা ওই ছেলের পেছনে কি খরচ নেই নাকি–!

বিরোধ তো এই নিয়েই বাধল।

একান্নবর্তী সংসার। তাও ভাড়াবাড়ির বাসিন্দা। মাস গেলে ভাড়াবাবদ ছ শো টাকা গুণে গেথে দিতে হয়। তার ওপর ইলেকট্রিক আলাদা। গ্যাস আলাদা। ঝি চাকরের মাইনেও আলাদা আলাদা। বড় আর সেজোর বক্তব্য—চার ভাই যখন, সংসারের সুযোগ সুবিধেও যখন চারজনেরই প্রাপ্য, তখন খরচ খরচাটাও চার ভাগেই ভাগ হোক ছোটর এতে আপত্তি নেই, কেননা বড় আর সেজোর মতো বাঁ হাতের পয়সা না থাকলেও সে চাকরিটা ভালো করে, তাই আপত্তি ওঠার প্রশ্ন নেই; কিন্তু অসুবিধেটা যত দেখা দিল ওই মেজকে নিয়ে। সামান্য গ্রিল কারখানার চাকরি। মাস গেলে ওই সামান্য টাকা কটাই যা ভরসা। কিন্তু সংসারের ভাগাভাগিতে যা পড়ল তা তার এই মাস মাইনের চেয়েও প্রায় শ’দেড়েক বেশি। অত কোত্থেকে দেবে অজয়!

দিতে পারায়ই তাই জ্বলল আগুন। বড় আর সেজোর মুখে দেখা দিল অসন্তোষ। ছোটর মুখে অবজ্ঞা। আর দুই বউয়ের তো রীতিমতো মুখ টেপাটেপি, হাসাহাসি।

চাকরি যার এরকম, মাইনে যার এত কম তার আবার বিয়ের শখ কেন! তাও কী না আবার দেখেশুনে, প্রেম করে–! নাও এখন, ওই সুন্দরী বউ ধুয়েই জল খাও। পরের পয়সায় আর ভালোমন্দ খাওয়া কেন–!

পরের পয়সা–।

বনানী মনে মনে অবাক। হেসেও ছিল ভেতরে ভেতরে কথাটা বলল চমৎকার–পরের পয়সা। যেন তারা কিছুই দেয় না, কিছুই করে না, অমনি বসে। বসেই খায়। কিন্তু যতই বলুক, বনানী তো জানে সবটা না দিতে পারলেও অন্তত শ পাঁচেক টাকা মাস গেলে ও সংসারে ধরে দিত অজয়। অথচ সে টাকাটা যেন টাকাই নয়; ঘেন্না আর লজ্জায় বনানীর নিজের মাথাই এক একসময় হেঁট হয়ে আসত; দুপুরে খেতে বসতেই এক একদিন ভয় হত। কী করা, পেট বলে কথা অন্তত পেটের আগুন নেভাবার জন্যই তো কিছু পেটে দেওয়া দরকার; অতএব বসত। কিন্তু ঐ শাশুড়ি বা দুই বউয়ের সঙ্গে নয়। বসত সবার অলক্ষ্যে, সবার শেষে। কিন্তু তাতেও কি রেহাই আছে?

এক দিনের কথা।

ভাত নিয়ে সবে বসেছে বনানী। এমন সময় কানে এল বড় বউয়ের গলা। ওকি শুনিয়ে শুনিয়েই সেজোকে বলছে, ওর আবার সবার সঙ্গে বসতে ভীষণ আপত্তি…দেখতে ভালো কিনা তাই প্রেস্টিজে লাগে—

হুঁ–প্রেস্টিজ না ছাই….

বড় বউয়ের খোঁচায় এবারে যেন সেজোও এক ধাপ এগিয়ে, দেখো গিয়ে মুছোটা কাটাটা জোগাড় করে ঠিক জমিয়ে বসেছে–

বনানী আর পারে নি। ভাত ফেলে রেখেই উঠে পড়ে ছিল সেদিন।

ভাত তো নয়, প্রায় শুকনো কড়কড়ে দুমুঠো তলানি। সঙ্গে একটু ডাল কিংবা তরকারি। বনানী তবু কিছু বলত না; তবে বুকটা মুচড়ে উঠত যখন কারখানায় বেরোবার সময় অজয়কেও ওরকম খেয়ে যেতে দেখত। এ পর্যন্ত তবুও মেনে নিচ্ছিল, কিন্তু পারল না একদিন, বুম্বার জন্য বরাদ্দ দুধটুকুন যেদিন হাওয়া হল।

সেদিন বনানী ঝরঝর করে কেঁদে ফেলেছিল। অজয়ও টের পেয়ে আগুন। মাথাটা সু গরম করে নি। তবে সেই মুহূর্তেই ঠিক করেছিল, ওখানে আর নয় কাল থেকেই সে বাড়ি খুঁজবে। যেখানে হোক যেমন খুশি হোক, ছোট খাটো একটা ঘর হলেই চলবে; আর পেলেই সে বউ ছেলে নিয়ে আলাদা হবে। যার যেমন আয় তেমনি তার থাকা উচিত। তা ছাড়া হতে পারে সে একজন ওয়েল্ডার, হতে পারে একজন সামান্য মাইনের শ্রমিক, কিন্তু তাই বলে এতটা ছোট আর নীচ সে নয়। তারও একটা মান আছে মর্যাদা আছে। কাজেই এখানে থেকে, এ বাড়ির এক কোণে পড়ে থেকে নিজের মর্যাদাকে সে ধুলোয় লুটোতে দেবে কেন! বাড়ি তাই দেখতেই হবে একটা। পাল্টাতেই হবে তাকে এ পরিবেশ।

কিন্তু সেই পরিবেশ পাল্টাতে গিয়েই সে এমন একটা জায়গায় এনে তুলবে তা কে জানত। বনানী নিজেও কি কল্পনা করতে পেরেছিল? যতসব হাড়-হাভাতে আর ছোট লোকের দল। দেখেই বনানীর মুখ শুকিয়ে গিয়েছিল কাল; তবু কিছু বলে নি। প্রথমে বিরক্ত হলেও পরে ভেবেছিল হোক বস্তি, ঘরগুলো না হয় পরপর লাগানোই হল, একসঙ্গে কলবাথরুমের অসুবিধেটাও না হয় মানিয়ে নেবে আস্তে আস্তে, তবু তো সে আলাদা, বু তো সে স্বাধীন, ওই বেলগাছিয়ার বাড়ির মতো প্রতি পদে পদে তো আর হেনস্থা হতে হবে না তাকে। তাই কিছু বলে নি; বলবেও না ভেবেছিল। কিন্তু চমকে উঠল আজ সকালে উঠেই। বনানী উঠে কলবাথরুম সেরে সবে চায়ের জলটা চাপিয়েছে সেই সময়েই চিৎকার প্রথমে বোঝেনি, জলটা নামিয়েই তাই ছুটে গিয়েছিল। তবে গিয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে যে দৃশ্য দেখে তাতে বনানীর দেখা

তো দূরে থাক, কানে আঙুল দেওয়ারই কথা। তবুও দেখল, বাথরুমের কাছাকাছি কোণের দিকের যে ঘরটা, সেই ঘরের সামনে নীল-শার্ট-প্যান্ট পরা, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি একটা লোক দাঁড়িয়ে সমানে কাকে দাবড়াচ্ছে, আর উল্টোদিকে ঝাটা হাতে কোমরে হাত দিয়ে একজন; মুখে অনর্গল খিস্তি-খেউর।

শুনে বনানী আর দাঁড়াতে পারে নি। দরজাটা বন্ধ রেখেই উঠে এসেছিল। ও বলেনি। ঘুমন্ত অজয়কে ডেকে জানাবারও প্রয়োজন মনে করে নি।

এরপর বেলা বেড়েছে। চানটান করে খেয়েদেয়েই বেরিয়ে গেছে অজয়। বুকে খাইয়ে নিজেও একসময় কিছু খেয়ে নিয়েছে…তবুও বলবে বলে কিছু ভাবে নি। ভেবেছে, স্বামী-স্ত্রী-ঝগড়াঝাটি হয়েছে নিশ্চয়ই। তাই এমন চিৎকার-চেঁচামেচি, একটু পরেই আবার ঠিক হয়ে যাবে; কিন্তু ঠিক তো হলই না, বেলা বাড়তে চিৎকারও তাই শুরু হল নতুন করে। বনানী তখন রীতিমতো বিরক্ত, ক্ষুব্ধ। তার সেই ক্ষোভটাই ফেটে পড়ল এখন ভরদুপুরে মাতাল হয়ে এসে যখন লোকটা আবার খিস্তি-খেউর শুরু করল।

না : বাড়ি একটা অন্য কোথায়ও দেখতেই হবে। আজ আসুক অজয়—সে এলেই ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলবে বনানী।

যেমন শুয়েছিল তেমনিই এসে আবার বুম্বার পাশে শুয়ে পড়ে বনানী; আলতো করে ছেলের গায়ে হাতটা একসময় তুলে দেয়। পরে চেয়ে থাকে নিঃশব্দে।

.

এগলিতে দিন যেমন রাতও তেমনি। কী সকাল কী দুপুর, কী বিকেল কী রাত্রি-—এ ঘরে ও ঘরে শুধু কথা কাটাকাটি আর ঝগড়া, চুলোচুলি আর হাতাহাতি, খিস্তি খাস্তা আর গালাগাল।

সন্ধের পর যখন ওদিকটায় থেমে গিয়ে আবার এদিকে শুরু হয়েছে ঠিক সে সময়ে এল অজয়।

কী ব্যাপার! কী হয়েছে কী? ভর-সন্ধেয় এমন ঝগড়া

শুধু কী সন্ধে বনানীর চাপা গলায় ধার, ফর্সা মুখটা টকটকে হয়ে উঠেছে রাগে, শুরু তো হয়েছে সেই কোন সকালে

সকালে–!

হ্যাঁ সকালেই। বলব বলব করে তোমাকে বলি নি। ঘুম ভাঙিয়ে জাগাই নি। ভেবেছি সামান্য ঝগড়া। ও থেমে যাবে। কিন্তু তুমিও গেলে, শুরু হল ভয়ংকর কাণ্ড। দুপুরের দিকে তো—

কী হয়েছে দুপুরে শার্ট খুলে লুঙিটা গলিয়ে প্যান্ট খুলতে খুলতেই জিজ্ঞেস করে অজয়।

বনানী বলে, ওই যে ওই কোণের দিকের ঘরের লোকটা..দুপুরের দিকে কী সব ভস্ম খেয়ে এসে দরজায় এমন লাথি মারতে শুরু করল যে আমি ভয়ে কেঁপে মরি আর কী! আর বউটাও বাবা তেমনি…কী সব বিশ্রি গালাগাল—তা আশেপাশের কোনো ঘরের কেউ কিছু বলছিল না।

কে বলবে..দরজাটা বন্ধ করতে গিয়েই যা দেখলাম, আশেপাশে বাচ্চাকাচ্চার ভিড়…দু চারজন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মজা দেখছে

তাহলে–!

তাহলে কী…তুমি কাল থেকেই আর কোথাও বাড়ি খুঁজতে থাকে। এখানে থাকলে এ পরিবেশে ছেলেটা বড় হবে ঠিকই কিন্তু মানুষ আর হবে না–

কিন্তু–

অজয়ের চোখেমুখে হতাশার ছায়া। আলনায় প্যান্টটা রেখে, বাইরের দড়ি থেকে গামছাটা টেনে নিয়ে এসে বলল, কিন্তু এ টাকায় আর ঘর কোথায় পাব বল তো! দেখলে তো, কী খোজাটাই না খুঁজলাম…যেখানেই যাই প্রচুর সেলামি আর অ্যাডভান্স। তার ওপর ভাড়াও তো চারশ পাঁচশর নিচে কথা বলে না।

আহা আমি কি তোমাকে চারশ টাকার ঘরের কথা বলছি।

বনানী এবারে সংযত; অজয়ের জন্য স্টোভে চায়ের জলটা চাপিয়েই জবাব দেয়, বলছি এই ভাড়ায়ই অন্য কোথাও ঘর দেখার কথা…দেখতেই হবে তোমাকে, না হলে–

না হলে—তুমি তো বলেই খালাস…

কিন্তু পেলে তবে তো! সব জায়গারই এক হাল…আসলে এত কম টাকায় আর এখন ভালো পরিবেশ পাওয়া যায় না।

যায় না তো বিয়ে করেছিলে কেন?

হঠাৎ স্টোভটা দপ করে জ্বলে উঠল। জল বসানো কেতলির চারপাশ দিয়ে আগুনের শিখা উঠল লকলক করে।  

বনানী ছুটে গেল। এ স্টোভটা এমনই। মাঝে মাধ্যই এমনি দপ করে মাথার ওপরে আগুন উঠে আসে; আবার নেমেও যায়, চটপট গিয়ে ফিতেটা নামালে ওটালে। এখনও তাই হল। বনানী গিয়ে ফিতেটা একটু নামিয়ে আগুনটা ঠিক করতেই মনে হল নাহ ব্যাপারটা বোধহয় একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেল। কী দরকার ছিল এমন করে বলার…এ গলিতে পা দিয়ে এ ঘরগুলোর ছোঁয়া কি ওর গায়েও এসে লাগল!

একটু যেন লজ্জাই পেয়ে যায় নানী। মুখ তুলে ভালো করে তাকাতেও পারে না। বুম্বাটা একটা ছরি বই নিয়ে এতক্ষণ মেঝেতে হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল; বনানীর কঠিন গলার আওয়াজে এদিকে মুখ ফেরাতেই নিজেকে হালকা করার চেষ্টা করল বনানী, কই রে বুম্বা এবারে সুজিটা খেয়ে নিবি..বায়না তো ধরেছিলি বাবা না এলে খাবি না?

বলেই আড়চোখে একবার অজয়ের দিকে তাকিয়ে পরে বলে, যাও হাত মুখটা ধুয়ে এস..আমি ততক্ষণে চা-টা ঘেঁকে ফেলি।

সে রাতে আর ঘুম এল না বনানীর চোখে। একটা যন্ত্রণা সেই থেকেই মাথার ভের হাতুড়ি পিটিয়ে যাচ্ছিল। কী দরকার ছিল ও কথাটা বলার! এই চার বছরের বিবাহিত জীবনে অন্তত এক আধটু মনোমালিন্য মান-অভিমান হলেও এ ধরনের কথা তো দুজনের কেউ বলে নি। অথচ আজ…

অজয় অবশ্য ভুলেই গিয়েছিল; কথাটা আর সেভাবে গায়েও মাখে নি। বুম্বা ঘুমিয়ে পড়লে তাই শোবার আগেই বনানীকে কাছে টেনে নিয়েছিল। বনানী প্রথমে একটু অস্বস্তিতে থাকলেও পরে আস্তে আস্তে অবশ্য অজয়ের উত্তাপে গলে যেতে ভুল করে নি; বরং বেলগাছিয়ার বাড়িতে যে ভয়-ভয় টুকু ছিল সেটুকু কাটিয়ে উঠেও সে হয়ে উঠেছিল বল্গাহীন…কিন্তু তবুও, প্রায় ঘন্টাখানেক পরে সম্ভোগের ক্লান্তিতে অজয় ঘুমিয়ে পড়লেও বনানীর চোখে আর ঘুম আসে নি; দেহ ক্লান্তিতে ভেঙে এলেও মাথাটা যন্ত্রণায় ছিঁড়ে পড়ছিল; বনানীর ভয় হচ্ছিল এখানে এসেই এমন, শেষে না

জানি একদিন কখন সবার অজান্তে এদেরই মতো একজন হয়ে উঠবে। দিন রাত তখন অজয়ের সঙ্গে ঝগড়াঝাটি হাতাহাতি। ইস কী কুৎসিত…না বাবা তার চেয়ে জায়গাটা পাল্টানোর দরকার…অন্য কোথাও বাড়ি একটা দেখতে হবে। এখানে থাকলে…

বনানী চমকে ওঠে।

একটা গানের সুর যেন ভেসে আসছে। মনে তো হচ্ছে ওই কোণের ঘরটা থেকে…তার মানে তো সকালের দেখা সেই ঝাটা হাতে বউটি। বাব্বা—অমন রণ রঙ্গিনীর গলায় আবার এমন সুরেলা গান। কিন্তু কাকে শোনাচ্ছে…নাকি নিজেই গাইছে! কিন্তু রাত বারটায় নিজেকে গান শোনাবে?

পাশ ফিরেই বনানী এবার চোখ বোজে। যন্ত্রণাটা সরিয়ে দিয়ে মাথার জায়গাটার এখন দখল নেয় একটা সুর। বনানী আস্তে আস্তে সেই সুরের ভেতরে ডুবতে থাকে।

.

সকালে অজয় কারখানায় যাবে বনানী বলল, বাড়ির খোঁজটা নিও কিন্তু

অজয় বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ আমি আজই গিয়ে পাত্তা লাগাচ্ছি…তুমি ঠিকই বলেছ…এখানে এভাবে ছেলেকে মানুষ করা যায় না।–

হালকা পায়ে অজয় বেরিয়ে যায়। বনানীর মুখে তৃপ্তির হাসি। অন্তত কাল বল্গাহীন সম্ভোগের পরে যতটা তৃপ্তি পেয়েছিল, এ তৃপ্তি যেন তার চেয়েও বেশি। বনানীর মনে একটা খুশির আলো ছড়িয়ে পড়ে। বুম্বা কী করছিল, ওকে টেনে এনে মাথার হাত বুলিয়ে বলে, চল বুম্বা তোকে চান করিয়ে দি..দশটা তো বাজতে চলল—

সাবান-গামছাবালতি ও মগ নিয়ে বাথরুমে ঢুকেছে কী ঢোকেনি, পেছন থেকে একটা মিহি গলা ভেসে এল।

তোমার সঙ্গে এখনো কিন্তু আলাপই হলনা ভাই–

বনানী চমকে উঠল। থমকে দাঁড়াতেই দেখে কোণের ঘরের সেই বউটি; নামটাও আজ সকালেও জেনেছে সে–তরঙ্গ।

তা রঙ্গের মতোই চেহারা; অন্তত প্রথম দর্শনেই সবাই মুগ্ধ, বিস্মিত হয়ে যাবে। তবে হ্যা—এক সময়ে রূপ ছিল। রঙটা এখনো থাকলেও রূপের নদীতে পড়েছে ভঁটা; অথচ গলা শুনলে কে না বলবে যুবতী–।

বনানী তাকাল। মুখে সামান্য হাসি; যতটা না দেখালেই নয়।

বলল, কারুর সঙ্গেই আমার আলাপ হয়নি এখনো। আর..আর এই আমার সঙ্গেই বোধহয় প্রথম হল, তাই না? ঐ ছেলেটি বুঝি—

বনানী চুপ।

এসো না…ভেতরে এস

না না, এখন কোথায় যাব…ওকে চান করাতে নিয়ে যাচ্ছি যে—

একটু বোকার মতো হেসে বনানী এগিয়ে যায়। বউটিও চুপ; কোনো কথা বলে না। মনে মনে নিজের ভুমিকায় নিজেই খুশি হয় বনানী; যাক অন্তত এ যাত্রায় এড়াতে পেরেছে।

কিন্তু যেমন গায়ে পড়া স্বভাব, বনানী জানে এড়াতে চাইলেও ওকে এড়ানো যাবে না। ঠিক পাশাপাশি না হলেও কাছাকাছি তো বটে। সকালে-সন্ধ্যায় দু’বেলা দেখা তো হবেই..আর কিছু না হলেও অন্তত কলবাথরুমে তো আসতে হবে।

দিন দুই বাদেই বনানী আবার ধরা পড়ল। এই যে…এই বনানী একবারটি এসো ভাই—

বনানী তখন সদ্য চান করে, গায়ে সাবানের সুগন্ধ নিয়ে বেরোচ্ছে; তরঙ্গের ডাকে থমকে দাঁড়াল; এই রিং-টা কিছুতেই কানে লাগাতে পারছি না…যদি একটু লাগিয়ে দাও–

বনানী ইতস্তত করে। একে ভেজা শাড়ি, জল শপ শপ করছে, তার ওপর ওই নীল শার্ট-প্যান্ট যে কখন এসে পড়ে ঠিক কী—! অথচ এত সামান্য ব্যাপার যে না বলতেও খারাপ লাগে। জানাল, কিন্তু শাড়িটা ছেড়েই না হয় শাড়ি ছেড়ে আসবে..আচ্ছা তাই এসো না হয়…তবে বল তো আমিও যেতে পারি…তুমি না হয় ততক্ষণে গিয়ে শাড়ি ব্লাউজটা বদলে ফেল—

ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানায় বনানী।

কিন্তু ঘরে এসেও আবার কাঠ; একটা ভারী পায়ের শব্দ ততক্ষণে গলি পেরিয়ে কোণের দিকে মিলিয়ে যাচ্ছে আর তারপরেই দরজায় একটা দড়াম করে শব্দ, এই মাগি…এই তরঙ্গ কই, দরজাটা খুলবি।

বনানীর বুক কাঁপে। ভাগ্যিস সে মায়নি তখন। গেলে নিশ্চয়ই এতক্ষণে সে লোকটার মুখোমুখি পড়ত। আর লোকটাও এসে গেছে যখন, এটা নিশ্চিত যে তরঙ্গ আর আসবে না; এলও না।

ঘুমন্ত বুম্বাকে খানিকক্ষণ হাওয়া করে খেতে বসার মুখেই বনানী টের পেল ও প্রান্তে রঙ্গ ক্ষেপেছে। প্রচণ্ড গর্জনে ছিন্ন ভিন্ন করে ফেলবে এবার দুপুরের নৈঃশব্দ্যকে।

বনানীর ভুরু কুঁচকে ওঠে। ভাতের থালা রেখেই দৌড়ে গিয়ে সে দরজাটা চেপে ধরে।

.

সন্ধের পরে অজয় ফিরল মুখ গম্ভীর করে।

বুম্বা ছুটে গিয়ে পা দুটো জড়িয়ে ধরে, বাবা–ও বাবা আমার দন্নে লদেন এনেছো?

হ্যাঁ, দিনরাত শুধু লদেন আর দেন—অজয় চেঁচিয়ে উঠল, এরপর পেটভর্তি ক্রিমির বাসা বানাও আর আমি ছুটি ডাক্তারের কাছে।

বুম্বা পা ছেড়ে দিল; মুখ কালো করে এসে পরে বনানীর কোল ঘেঁষেই বসে পড়ল।

বনানী বলল, তা অমন দাঁতমুখ খিঁচিয়ে কেন ভালো করে বলতে পারো না–

না পারি না…পারবও না। দিনরাত গাধার মতো খাটব, তারপর এখানে যাও ওখানে যাও….বাড়ি খোঁজ…লজেন্স আনো

তা খুঁজো না…কে তোমাকে খুঁজতে বলেছে। এখানে থেকে তোমার ছেলে গুণ্ডা হোক বদমাস হোক আমার কী!

বনানী গম্ভীর গলায় বলে, লোকে তোমার নাম করেই আঙুল দেখাবে ওই তো অমুকের ছেলে… আর তুমিও তখন পার পাবে বলে ভেবো না

আমি আবার কী ভাবব…আমার তো জীবন নষ্টই হয়ে গেছে!

তাহলে আর কী—প্যান্টটা খুলে অজয় একটা পাজামা পরে; পরে আধ-ময়লা পাঞ্জাবিটা টেনে নিয়ে মাথার ভেতরে গলিয়েই জানায়, নষ্ট যাতে আর না হয় সেই চেষ্টাই কর না…বাপের বাড়িতে চলে যাও। দিব্যি দুধে ভাতে থাকবে

বলে দুদ্দাড় করে বেরিয়ে যায় অজয়। বনানী পেছন থেকে ডাকে, কী হল চা খেয়ে গেলে না?

বাইরে থেকে কোনো উত্তর আসে না; তবে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আলোটা নিভে যায়। লোডশেডিং। বুম্বা ভয়ে চেঁচিয়ে ওঠে। বনানী আন্দাজে হাত বাড়িয়ে বুম্বাকে কোলে নেয়; তারপর অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে দেশলাই খুঁজে হ্যারিকেনটা জ্বালাতে গিয়েই টের পায় তার চোখের কোল ভরে উঠেছে জলে; তবে যত না জল তার চেয়ে অনেক বেশি কান্না এসে আটকে আছে গলার মাঝখানে। আশ্চর্য! আজ এক সপ্তাহের ওপর এখানে এসেছে, কোনোদিনও এমন ব্যবহার দেখেনি অজয়ের। দু-দিন ধরে একটু অন্যমনস্ক লাগছিল ঠিকই, কিন্তু কথাবার্তায় কোনো বিচ্ছিরি আচরণ ধরা পড়েনি। অথচ আজ,…বনানীর কথা তো ছেড়েই দিল, বুম্বার সঙ্গে যা ব্যবহার করল তা অজয় চরিত্রের একদম বিপরীত। কী হল কী মানুষটার? এক অজানা আশঙ্কায় বনানীর বুকটা থিরথির করে কাঁপতে থাকে।

রাত বাড়ে। দূরের রাস্তার দু একটা বাসের হর্ণ, চাকার শব্দ, রেল ইয়ার্ডের ইঞ্জিনের শান্টিং-এর আওয়াজের পাশাপাশি এ গলির ট্রাঞ্জিস্টারের বিজ্ঞাপন, হইচই এর শব্দ আর ঝগড়া মিলেমিশে রাত আরও ঘন হয়; তুবও অজয় ফিরে আসে না। সে ফেরে বুম্বা ঘুমোলে, বুম্বাকে ঘুম পাড়িয়ে মশারি টানিয়ে বনানী যখন দরজার মুখে এসে দাঁড়িয়েছে ঠিক তখুনি ঘরে ঢোকে অজয়।

হ্যারিকেনটা তুলে নিয়ে মশারির কাছে গিয়ে বুম্বাকে একবার দেখে বনানীর হাতে দুটো টফি তুলে দেয়।

রেখে দাও…কাল সকালে উঠলে দিও। শুধু শুধু ছেলেটাকে বকলাম—

সাহস পেয়ে বনানী জিজ্ঞেস করে, তোমার কী হয়েছে বল তো..দুদিন ধরে দেখছি কেমন অন্যমনস্ক–

অজয় চুপ। তবু কিছু বলে না। বলল একবারে সেই খেতে বসে। কাল থেকে কী হবে কিছুই বুঝতে পারছি না বনানী–!

 বনানীর বুকটা ধড়াস করে ওঠে।

রুটি ছিঁড়ে তরকারির একটা আলু নিয়ে রুটির টুকরোটা মুখে পুরে বলে অজয়, কাল থেকে কারখানা বন্ধ। সন্তোষ শালা পাঁচ জ ফ্ল্যাটের কিছু মাল ঝেড়ে দিয়েছিল…ম্যানেজারের চোখে পড়েছে..তাইতেই শালার চাকরি গেছে। মালিক তাকে রাখবে না। এদিকে ইউনিয়ন চেপে ধরেছে ছাঁটাই করা চলবে না…বাস—তাতেই বনধ!

তাহলে-মুখের গ্লাসটা তুলেও আবার বনানী নামিয়ে নেয়। ফ্যাল ফ্যাল করে অজয়ের দিকেই তাকিয়ে থাকে। অজয় বলে, তাহলে আর কী! মীমাংসা হওয়া না পর্যন্ত মালিক কারখানা খুলবে না…তার সাফ জবাব চুরি যখন একবার করেছে তখন আর তাকে সে কিছুতেই রাখবে না—

সে রাতটা একরকম কেটে যায়। কিন্তু পরের দিন থেকে অজয়কে আর সময় মতো বেরোতে না দেখে ব্যাপারটা কী করে একদিন জানাজানি হয়ে যায়। এ গলিতে ছড়িয়ে পড়ে, অজয়ের আর কারখানা নেই এখন.কারখানায় স্ট্রাইক!

সকালের দিকে বালতি নিয়ে জল ধরতে যাচ্ছিল, কানে এল নানীর। বাব্বা..আসতে না আসতেই কারখানায় গণেশ ওল্টালো..! চাকরি বাকরি সত্যিই করে তো না কী!

বনানীর মাথার আগুন জ্বলে। যতসব ছোটলোক আর ইতরের দল–! আলোচনার মতো মুখরোচক একটা কিছু পেলেই হল। দাঁতে দাঁত চেপে ভারী বালতিটা তুলে নিয়েই বনানী ফিরে আসে।

বিকেলে অজয় কোথায় বেরিয়েছিল, উল্টোদিকের ঘরের মিনতি এসে দাঁড়াল পায়ে পায়ে। আলাপ হয়েছিল একদিন…ওই তারপর থেকেই সামান্য টুকটাক কথাবার্তা; ঘনিষ্ঠতার পর্যায়ে যায়নি কোনোদিনই। বনানীও চায়নি–। অথচ আজ সেই পরিচয়ের সূত্র ধরেই প্রতিবেশী হিসেবে একদম ঘরে এসেই ঢুকল।

বৌদি-না জানিয়েই ঢুকে পড়লাম…

হাসি আসে না, তু জোর করেই মুখ হাসি টেনে বলে বনানী, ও মা উল্টোদিকেই থাকো, তা এ ঘরে আসতে হলে আবার জানান দিতে হবে নাকি?

হা সে ভরসাতেই তো এলাম। বুম্বা কোথায়…দেখছি না?

বাবার সঙ্গে বেরিয়েছে–

তা হ্যাঁ বৌদি, দাদার নাকি কারখানার ধর্মঘট চলছে…

হ্যাঁ ভাই।

বনানী রুটি বেলছিল; বেলা হয়ে গেলে বেলুন চাকিটা তুলে রেখে গরম চাটুতে রুটিগুলো বিছিয়ে দিতে দিতে বলল, এই তো আজ সাতদিন…কবে খুলবে কে জানে—

তবে তো আপনার খুবই অসুবিধে হবে এখন…যা দিনকাল পড়েছে—

মুখ তুলল বনানী। মেয়েটা কী তাকে জরিপ করতে এসেছে! একটু যেন রাগই হল তার। পরের ঘর, পরের ঘরের কোথায় কী সমস্যা—তা যেন ভালো করে না জানলে এদের পেটের ভাতই হজম হয় না। কই সে তো যায় না কোথাও। কোন ঘরে কী হচ্ছে তা তো জানার চেষ্টা করো না।

বলল, না—তেমন অবশ্য অসুবিধে হবে না এক-দেড় বছর…তবে তারপরে অবশ্য ভাবতে হবে–

বলল বটে তবে মনে মনে জানে বনানী এই সাতদিনেই পুঁজি যা ছিল সব শেষ। কাল থেকেই অন্যব্যবস্থা দেখতে হবে। কানের একজোড়া দুল আছে, বিয়েতে পাওয়া এ ছাড়া শাশুড়ির দেওয়া একটা সরু চেনের হার। দরকার মতো তাই ভাঙিয়ে খেতে হবে। কিন্তু তারপর? তারপর…তারপরেও কী আর কারখানাটা খুলবে না? ততদিনে নিশ্চয়ই অজয় আবার বেরোতে শুরু করবে আবার আগের মতোই কারখানাটা চালু থাকবে। ভাবতে ভাবতে একরকম ভাবনার ভেতরেই ডুবে যায় বনানী।

অবশেষে তাই হল। সেই দুল জোড়াই দিতে হল। এরপর সেই সরু চেনটা। তাতেও সংসারের ক্ষিদে মেটে না। উপায় না দেখে যখন বুম্বার আংটিটার কথাও বলেছে অজয় তখন বনানীর চোখ ফেটে প্রায় জল গড়িয়ে পড়ে আর কী!

অজয় বললে, ভেঙে পড় না..শুনছি তো এবারে খুলবে, তা খুললে আমি আবার এধ্ব তোমাদের বানিয়ে দেব; এখন তো আগে বাঁচি! এ আংটির টাকায় তো কদিন চলুক।

তাও চলল। শেষে একদিন একদম শূন্য। মাটির একটা ভাড়ে লুকিয়ে চুরিয়ে দুচার পয়সা করে জমিয়ে রাখত কনানী। এক দুপুরে হাতে নিয়ে দেখে কোনো শব্দই হচ্ছে না তাতে। বনানী বু দু চারবার কানের কাছে নিয়ে ভাড়টা নাড়ায়; কিন্তু শব্দ বুও হয় না তাতে। বরং প্রচণ্ড ধাক্কায় ভাড়টাই একসময় হাত থেকে ছিটকে মাটিতে পড়ে যায়।

একটা শব্দ। সেই সঙ্গে ঘরের ভেতরেও একটা মৃদু আওয়াজ এসে ঢোকে।

মিনতি যাচ্ছিল। শব্দ পেয়ে সেই দৌড়ে আসে, কী হল বৌদি? শব্দ কিরে!

বলে মেঝের দিকে চোখ পড়তেই দেখে পোড়া মাটির ভাড়ের টুকরো; বনানীর চোখের জলটুকুও তার নজর এড়ায় না; দেখে তক্তোপোশে একগাল খোঁচা খোঁচা দাড়ি নিয়ে অজয় শুয়ে শূন্য দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে, পাশে ছেলেটা ঘুমন্ত। মুখের ভেতরে আঙুল চোষার শব্দ হচ্ছে চুকচুক…

নিঃশব্দে, কোনো উত্তরের আশা না করেই মিনতি বেরিয়ে যায়।

অজয় বলে, তার চেয়ে এক কাজ করলে হয় না। তুমি রং বুম্বাকে নিয়ে এ সময়ে ক দিন দমদম থেকে ঘুরে এস—

দমদম–! বনানী মনে মনে হাসে। দমদমে যাবেই বা কার কাছে। মা নেই বাবা নেই। ভাইদের সংসারেও চির অনটন। নুন আনতেই পান্তা ফুরিয়ে যায়। বু এরই ভেতরে যে এক আধবার যায়নি বনানী তা নয়; কিন্তু যেদিন গেছে সেদিনই ফিরে এসেছে। দাদারা থাকার কথা বলেনি, সে নিজেও থাকতে চায়নি, বরং ইচ্ছেটা প্রকাশ করে ফেলতে পারে ভেবে—দাদা বউদিরা আগে ভাগেই জিজ্ঞেস করে নিয়েছে সে কখন ফিরছে। কাজেই এ অবস্থায় দমদমে বাপের বাড়িতে গিয়ে ক’দিন থাকেই বা কী করে। তাছাড়া নিজের পছন্দের বিয়ে, দাদারা আপত্তি করেনি বটে তবে নিজে বনানী এগিয়ে এসে অজয়কে ভালবেসে বিয়ে করাতে দাদাদের দায়িত্বও যেন অনেকটা কমে গেছে। এখন বনানীর আপদ বিপদের সময়, সে খুব ভালো করেই জানে, সাহায্য তত দূরে থাক, বললেই দাদারা আকারে-ইঙ্গিতে বুঝিতে দেবে বিয়ে যখন সে নিজে করেছে, দায়িত্বও তার নিজেরই…

তাই বলল, দুর ওখানে গিয়ে কী হবে..ওখানে কি একবেলাও বুম্বাকে নিয়ে আমি টিকতে পারব ভেবেছো!

না—তা পারবে কেন। তুমি কোথাও টিকতে পারবে না—অজয় হঠাৎ বিশ্রিভাবে চেঁচিয়ে ওঠে, বেলগাছিয়ায় পারলে না, এখানে পারছ না, দমদমেও পারবে না…তবে পারবেটা কী শুনি?

এতক্ষণ চুপচাপ ছিল এবারে বনানীর মাথাও আগুন জ্বলল; চাপা গলায় ধমকে উঠল অজয়কে, কী হচ্ছে কী! অমন ষাঁড়ের মত চেঁচাচ্ছ কেন?

বেশ করছি-চেঁচাচ্ছি। বিপদে আপদে যদি শ্বশুরবাড়ির লোকেরা না দেখে তো দেখবে কে!

কে আবার দেখবে বনানীর চাপাগলাটা ধারালো; নতুন খোলা ব্লেডের মতোই ঝকঝকে, দেখতে হবে নিজেদের…বিয়ের সময়ই তো বড় গলায় বলেছিলে আমাদের নিজেদেরটা আমরা নিজেরাই বুঝব

অজয় চুপ একটু দম নিয়েই কী বলতে যাচ্ছিল। এমন সময় বাইরে থেকে কে ডেকে উঠল, বুম্বা..এই বুম্বা?

শাড়ির আঁচলটা গায়ে টেনেই বনানী এগিয়ে যায়। আর দরজার মুখে গিয়েই দেখে ওই কোণের ঘর। তরঙ্গ এসে দাঁড়িয়েছে। হাতে একটা স্টিলের বাটি।

এ কী আপনি!

কেন আসতে নেই…

না-না তা বলি নি। আসুন না—

নাহ্ ভেতরে যাবো না। একটা কথা বলতে এলাম কিছু মনে করবে না বল–

না বলুন না–

এটা রাখো…একটা নতুন জিনিস রান্না করেছিলাম..বুম্বার কথা মনে হল তাই নিয়ে এলাম। আমার নিজের তো

মুখে না নেওয়ার কথাই এসে যাচ্ছিল, শেষের কথাটায় রাখতে হল। বনানী জানে রঙ্গের সম্ভন নেই; বাচ্চাকাচ্চা দেখলে তাই ছটফট করে। দু মিনিটেই তাদের সঙ্গে ভাব জমিয়ে ফেলে। বুম্বাকেও জয় করে ফেলেছে ইতিমধ্যে।

তরঙ্গ চলে যায়। ঢাকনা খুলে বনানী দেখে অনেকগুলো নারকেলের পিঠে। এত যে বুম্বা একা খেতে পারবে না সেটা তরঙ্গ-ও জানে। তবে নানী বুঝল বুম্বার নাম। করে তরঙ্গ তাদের দুজনের জন্য কিছু পাঠিয়েছে। ব্যাপারটার মধ্যে যে যথেষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে এটা ধরতে আর বনানীর অসুবিধে হল না। ঘরে তাদের উনুন জ্বলে না, আজ। কদিন হল ভাতের হাঁড়িও চড়ে না ঠিকমতো, বুম্বাটা যে সময়ে-অসময়ে খিদের জন্য কাঁদে তা তরঙ্গ কেন, এ গলিতে সবার কাছেই স্পষ্ট। মুখে কেউ কিছু বলে না, তা। আকারে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দেয়।

বিকেলের দিকে লুঙির ওপরে পাঞ্জাবিটা গলিয়েই বেরোল অজয়। কিন্তু মিনিট কুড়িও গেল না হুড়োহুড়ি করেই আবার ফিরে এল। সঙ্গে তখন একটি নতুন মুখ। ঝকঝমে তকতকে। নিখুঁত করে কামানো গাল। চোখে দশমা। গায়ের পাঞ্জাবিতে ভুরভুর সেন্টের গন্ধ।

অজয় হইচই বাঁধিয়ে তুলল, কই—কোথায় বনানী। দেখ এসে কে এসেছে…

কে–বনানী বেরিয়ে কী দেখে আবার শামুকের মতো খোলসের বেতরে গুটিয়ে যায়।

আমার বন্ধু। একসঙ্গেই স্কুলে পড়তাম।…তোমার অবশ্য ওকে দেখার কথা নয়। আমাদের বিয়ের আগেই ও বোম্বে চলে যায়। ওখানেই বড় চাকরি করে কমলেন্দু…

কমল, কমলেন্দুর চোখ ততক্ষণে বনানীর শরীরে। আরশোলার শুড়ের মতো ঘুরছে দারিদ্র্যের ফাঁক-ফোকর দিয়ে যৌবনকে টেনে এনে কামের নিক্তিতে মাপছে।

অজয় চেঁচিয়ে উঠল, নাও-চটপট এখন চা বসাও তো…অনেকদিন আড্ডা মারি ..আজ একটু জমিয়ে আড্ডা মারব। আয় কমল—ভেতরে আয়।

কমল ভেতরে ঢুকল। সঙ্গে সঙ্গে একটা গন্ধ ছড়াল। কিন্তু আর কেউ না কাপুক, সে গন্ধে ভয়ংকর কেপে উঠল বনানী। ঘরে চিনি নেই। চা-ও যা আছে তাতে একজনেরও হবে না…এ অবস্থায়…

উপায় না দেখে বনানী পা বাড়ল।

তরঙ্গদি–!

কে–তরঙ্গ বেরিয়ে এল। বনানীকে দেখেই খুশি, এস-এস এস ভাইনা বসব। ওর এক বন্ধু এসেছে…ঘরে এক ফোঁটাও চিনি—

নেই তো…তাতে কী আছে দাঁড়াও একটু বলে ভেতরে গিয়েই আবার একটু পরে চলে আসে অঙ্গ। হাতে এক বাটি চিনি; সেই সঙ্গে একটা কাগজের মোড়ক

এটা বনানী তাকাতেই তরঙ্গ হাসে, ভাল চা এনেছিলেন উনি..ওই তারই একটু-দেখ না ভালো হবে বানালে—

বনানীর চোখ ফেটে জল নামে নতুন বন্ধু উচ্ছ্বসিত।

চমৎকার আপনার চায়ের হাত কিন্তু। আমি অনেক জায়গায়ই ঘুরি, কিন্তু এমন চা…

বনানীর শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠল; চোখ তো নয় যেন লালায় মাখানো জিভ।

সর্বাঙ্গে শুধু চাটছে।

বনানী আঁচলটা টানে আর সেই সময়েই বন্ধু বলে কই আপনার ছেলের এত কথা শুনলাম—অথচ দেখলাম না তো এখনো…।

জবাবটা অজয়ই দেয়, বিকেল তো…হয়ত এদিকে ওদিকে কোথাও আছে—

ঝপ করে পকেট থেকে খয়েরি রঙের একটা পারস্ টেনে আনে। টাকার খোপটায় আঙুল ঢুকিয়েই একটা দশটাকার নোট বের করে। তারপর নানীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, ছেলের জন্য কিছু আনা উচিত ছিল। কিন্তু এমন আচমকা দেখা হয়ে গেল..যা গে টাকাটা দিয়ে ওকে মিষ্টিমুখ করাবেন

যেমন এসেছিল তেমনিই আবার বেরিয়ে গেল। কিন্তু যাবার মুখে রেখে গেল একটা লোলুপ চাহনি। একটা বুককাঁপানো হাসি। আর টাটকা গোলাপের মতো কিছু মিষ্টি কথাবার্তা।

এ গলিতে চাপা হাসি উঠল। তবে হাসিটা আর দেখল না—বনানী ভাবছিল, কতক্ষণে অজয় ফিরবে। দশটা টাকা-! তার মানে দুদিন অন্তত নিশ্চিন্ত…অন্তত খানিকটা নিষ্কৃতি পাওয়া যাবে!

কিন্তু এত সহজে যে পাওয়া যায় না বনানী অন্তত সেটা জানত না। পরের দিন, দুপুরের দিকে বনানী সবে চান করে এসে ঘরে ঢুকে কাপড় ছাড়ছে এমন সময় সে এসে হাজির–।

অজয় আছিস নাকি?

গলার স্বরেই বনানী চমকে ওঠে। কোনোরকমে শাড়িটা পরেই ছুটে যায়। দরজা খুলে বলে, ও তো নেই…বেরিয়েছে একটু–

বেরিয়েছে—! কাল বলছিল একটা চাকরির কথা…কারখানা নাকি বন্ধ হয়ে পড়ে আছে…তা ব্যবস্থা একটা মোটামুটি করতে পেরেছি–

আসুন না ভেতের আসুন—

একরাশ গন্ধ নিয়েই সে ভেতরে ঢুকল।—ঐ বুঝি ছেলে?

হ্যাঁ—

নাম কি তোমার?

–বুম্বা, নাম বল–।

একটা কাগজের প্যাকেট নিয়ে খেলছিল এতক্ষণ সেটা সরিয়েই বুম্বা নামটা বলল। সে খুশি : বাহ বেশ নাম–

এবং খুশির সঙ্গে সঙ্গেই পকেটে হাত ঢোকাল। একটা টফির বাক্স বের করে এনে বুম্বার হাতে দিয়ে বলল, নাও…এটা কি বল তো?

ত….ফি! বুম্বার মুখ হাসিতে ভরে উঠল। বনানী মৃদু ক্ষোভ জানায়, আবার এসব আনতে গেলেন কেন বলুন তো…আমাদের ঘরে এসব মানায়—তাতে কী হয়েছে মানুষটি বলল, কাল এসে দেখা পাইনি—তা আজ দেখা হবে জেনেও কী খালি হাতে আসব নাকি!..যাক্ গে, এক গেলাস জল দিন তো দেখি—

বনানী বলে, চা খাবেন কি?

নানা এখন নয়…আরেক দিন বলে ঠোঁটের কোণে আচমকা এক বিচিত্র হাসি ফুটে ওঠে তার।

বনানীর বুকের রক্ত হিম হয়ে যায়। চটপট জল এনে দিতেই সে খেয়ে বলে, ঠিক আছে…তাহলে চলি…অজয়কে বলবেন যেন কালই দেখা করে।

বুম্বাকে বলে হাত নেড়ে মানুষটি উঠল।

হাসতে ইচ্ছে করে না বুও যেন জোর করেই হাসল বনানী; নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধেও যেন দরজা পর্যন্ত তাকে এগিয়ে দিল।

গলিতে আবারও আজ মুখ টেপাটেপি। চাপা হাসি।

.

বনানী দাঁড়িয়েছিল।

শেষ বেলার দিকে এ গলিতে যখন হুল্লোড়, চেঁচামেচি, ঠিক সে সময়ে অজয় ফিরল চুল উস্কোখুস্কো। সারা মুখে চকচকে ঘাম।

কী ব্যাপার…কোথায় গিয়েছিলে বল তা? আমি তো সেই থেকেই চিন্তায় মরি—

না না চিন্তার কিছু ছিল না—অজয়ের মুখে খুশির ঝিলিক, কাল বড়োমুখ করে কমলকে বলেছিলাম একটা চাকরির কথা…তো ও আজই একটা খবর নিয়ে এসেছে। বাড়ি ফিরছি, এমন সময় দেখা হয়ে গেল। বলল, এখানে এসেছিল..খানিকক্ষণ বসেছিল।

হ্যাঁ—আমি চা খেতেও বলেছিলাম…কিন্তু হুটপাট করে চলে গেল—

হাত তুলে জামা খুলতে খুলতে বলল অজয়, তো এই কমলই টেনে নিয়ে গেল রাস্তা থেকে। চাকরিটা যেখানে ঠিক করেছে একদম সেখানেই নিয়ে গেল–

কিসের চাকরি গো! বনানীর চোখেও খুশির ছোঁয়া; অজয়ের হাত থেকে ঘামে ভেজা জামাটা নিয়ে দেওয়ালের হুকে টানিয়ে দিয়ে বলল, আগের মতোই ওয়েল্ডারের চাকরি–

আরে না–না—! লুঙি গুটিয়ে ভেতরের মেঝেতে ততক্ষণে টান টান হয়ে পড়েছে অজয়; জানাল, এক কন্ট্রক্টারের কাজ দেখাশোনা করার কাজ। মাইনে কিন্তু মন্দ দেবে না…মাস গেলে এখন ছ শ করে…পরে বাড়াবে; তবে কমল বলছিল, কিছুদিন কর না তারপর আমি ভালো কিছু একটা করে দেব—

উঠে বসে অজয় একটা বিড়ি ধরায়। এক রাশ ধোঁয়া ছেড়ে বলে সত্যি ও না থাকলে আজ পথে বসতে হত। যা উপকার করল না আজ।

তা সত্যি বনানী সমর্থন জানায়, তবে তোমার বন্ধুটির একটু দোষ আছে। বড়ো বেশি গায়েপড়া স্বভাব….

ঠিক তা নয়—অজয় বিড়িতে টান মারে, বড়লোকের ছেলে..একটু বেশি খোলামেলা। আমি তো ভাবছি প্রথম মাইনে পেয়েই ওকে একদিন খেতে বলব…

একটা চিরুনি নিয়ে বসেছিল বনানী। চুল আঁচড়ে সেই চুলই ফিতে দিয়ে বাঁধতে অনেকদিন পর আজ মনের আকাশ থেকে খানিকটা মেঘ কেটে গেছে। মনটাও তাই সদ্য ওঠা রোদের মতোই ঝলমলে;

হঠাৎ খেয়াল হয় অজয়ের।—ভালো কথা বুম্বা কোথায় গেছে?

ঐ তো ও ঘরের মিনতি এসে নিয়ে গেল…

এই মেয়েটাকে আমি একদম সহ্য করতে পারি না—অজয়ের গলায় ঘেন্নার সুর-এরই মধ্যে দুদুবার পেট খসিয়েছে জানো–

বনানী চমকে ওঠে। শব্দটা খুচ করে গিয়ে ওর মাথার ভেতরে বসে যায়; এদিকে ওদিকে তাকিয়ে বলে, আঃ কী হচ্ছে কী-I কে কী করছে তা তোমার কী দরকার—

দাঁড়াও না একটু ঠিকঠাক হয়ে বসি তোমাদের নিয়ে আমি অন্য কোথাও উঠব। এই নরককুণ্ডে মানুষ থাকে–!

গামছাটা টেনে নিয়ে বনানী উঠল। অনেকদিন পর আজ একটু ভালো করে গা ধাবে।

বেরিয়ে যাচ্ছিল, অজয় বলল তাড়াতাড়ি এসো আমি যাব এরপর–

বনানী বেরোয়। গলার ভেতরে একটা গুনগুন আওয়াজ। চোখ জোড়া হাসছে। তরঙ্গের তা নজর এড়ায় না। কাছাকাছি আসতেই জিজ্ঞেস করে, কী ব্যাপার আজ এত খুশির জোয়ার…

ওর একটা চাকরি হয়েছে তরঙ্গদি–

তরঙ্গ হাসে, বাঃ ভালো হয়েছে…খুব ভালো…পুরুষমানুষ কী বসে থাকতে পারে—

এক ঝলক হেসে বনানী এগিয়ে যায়। পরের দিন, এ গলিতে যখন আবার হুল্লোড় আর চেঁচামেচি, ঝগড়া আর কথাবার্তা, বিকেলের দিকে ঠিক সেসময়ে প্রায় বিনা নোটিশেই এ গলিতে এসে ঢুকল কমল; তারপরই সরাসরি একদম ঘরের ভেতরে।

যা আছিস তাহলে…

অজয় চমকে ও তারপর পিছনে ফিরে হেসে ফেলে।

–বাব্বা ভয় পাইয়ে দিয়েছিলি মাইরি–

এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম, ভাবলাম যাই একবার মনে করিয়ে দিয়ে আসিকাল তো চাকরির প্রথমদিন; সময় মতোই যেন হাজির হয় সেখানে…

বলে এদিকে ওদিকে কী খোঁজে কমল; কই তোর বউ ছেলেকে দেখছি না?

অজয় বলে, আছে…ছেলের হাত মুখ ধোয়াতে গেছে—ঐ তো…

বলতে না বলতেই বনানী ভেতরে ঢোকে, ও মা আপনি? কখন এলেন—

এই তো…সবে বসেছি।

চা খাবেন তো?

আরে নিশ্চয়ই। তবে আজ আর শুধু চা নয়, সঙ্গে টা-ও চাই–

পাঞ্জাবির পকেটে হাত গলিয়ে ব্যাগটা টেনে আনে কমলেন্দু। অজয় লাফিয়ে ওঠে, আরে না-না। তুই কী দিবি

দিলেই বা।

না-না-অজয় তক্তাপোশ থেকে নামে। পাঞ্জাবিটা গায়ে চড়ায় ইশারায় একবার বনানীকে ডাকে, বনানী বারান্দায় এলে বলে কী করি বল তো? আমার কাছে তো একটা টাকা মাত্র পড়ে আছে।

বনানী আঁচলের খুট খোলে। সেদিনের দশটাকার সবটা খরচ করেনি। এখনো গোটা চারেক সরিয়ে রেখেছে সেটাই এখন অজয়ের হাতে তুলে দিয়ে বলে, এটা নিয়ে যাও–

অজয়ের মুখে হাসি ফোটে। তাহলে বুম্বাকেও নিয়ে যাই। একটু ঘুরেও আসতে পারবে। বুম্বাবুম্বা আ আয় আমার সঙ্গে…

বুম্বা বেরিয়ে আসে। অজয় গলা তোলে, তুই বোস কমল..আমি আসছি—

দেশলাইটা ফস করে জ্বালিয়ে বনানী স্টোভ ধরায়।

কমল হাসে, আজ যে এত সেজেছেন বৌঠান—

শব্দটা পুরোনো; কিন্তু বলল নতুন কায়দায়; বনানীর বুকের ভেতরে সিরসির কাঁপন ধরে। বলল, সাজলাম আবার কোথায়! একটু ভালো করে চুল বেঁধেছি আর সিঁদুর পরে শাড়িটা গুছিয়ে গায়ে তুলেছি–

এতেই হল। এই পোশাকেই বাঙালি রমণীদের আমার ভীষণ ভালো লাগে…

বনানীর বুক দুর দুর কর। কেমন একটা ভয়।

নিজেকে আপনি আয়নায় দেখেছে বৌঠান…আমি পারা লাগানো আয়নার কথা বলছি না..পরপুরুষের মুগ্ধ চোখের আয়নার সামনে কখনো দাঁড়িয়েছেন কি?

বনানী চমকে ওঠে। পেছনে যেন একটা আবছা অবয়ব; বনানী ভয়েই উঠে দাঁড়ায়। আর সেই সময়ই ওর পিঠে একটা হাত পড়ে।

এ কি! এ কি করছেন আপনি ছাড়ুন…ছেড়ে দিন না–

হাত দিয়েই পিঠের হাতটা সরাতে যায় বনানী; কিন্তু তার আগেই দুটো চওড়া হাত সবলে তাকে আকর্ষণ করে। বনানী চেঁচিয়ে ওঠে; আর তারপরেই ঘুরে দাঁড়ায়, যান—এক্ষুনি আপনি বেরিয়ে যান…ছোটলোক, ইতর কোথাকার—

শাদা পাঞ্জাবি মুহূর্তেই ঘোরে; আর মুহূর্তে বেরিয়ে যায়।

বনানী হাঁপাতে থাকে।

কী হল—! কী হয়েছে বনানী.কমলটা ওভাবে বেরিয়ে গেল যে–

কেন গেল, সেটা তাকেই জিজ্ঞেস করলে না কেন? বনানী কঠিন; অজয়ের দিকে তাকিয়ে তার চোখ জোড়া জ্বলছে।

অজয় বলল, এত ডাকলাম…এত চেঁচালাম–

তবুও ফিরে তাকাল না। তাকাবে কীবনানী দাঁতে দাঁত চাপে, সুযোগ নিতে এসেছিল যে

মানে–! অজয় বলতেই বনানী জানায়, জানো কতবড় সাহস-ও আমার গায়ে হাত দিয়েছে…

কিন্তু তাই বলে—চোয়াল ফুলিয়ে অজয় বলল, তুমি ওকে তাড়িয়ে দিলে …তুমি কী সর্বনাশ করলে তুমি জানো না বনানী–

বনানী স্থির, কী বলছ তুমি…একটা জানোয়ার–

হ্যাঁ জানোয়ারই তো…ঐ জানোয়ারটাই তো বিপদের দিনে কাছে এসে দাঁড়িয়েছিল…কী এমন ক্ষতি হত গায়ে একটু হাত দিলে—এরপরেই কী চাকরিটা কাল পাব ভেবেছো

একটা সুতীব্র স্বরে অজয় চেঁচিয়ে উঠল, ধুতোর…শালা নিকুচি করি এ সংসারের–

আর তারপরেই দড়াম করে একটা শব্দ। স্টোভ ওল্টালো। কেলিটা ছিঠকে পড়ল; সেই সঙ্গে থালাবাটি-হাতা-খুন্তি থেকে মায় ভাতের হাঁড়িটা পর্যন্ত। একটা উন্মত্ত পশু যেন সবেগে ঘরে ঢুকে একটা ভয়ংকর তাণ্ডব বাঁধিয়ে চলে গেল।

এতক্ষণ তাকিয়েছিল, এবার আর পারল না। তক্তাপোশে, বিছানার ভেতরেই মুখ গুঁজে দিল বনানী। দেহটা তখন ফুলে ফুলে উঠছে, কঁপছে অব্যক্ত যন্ত্রণায়।

গলিতে খর গেল, গলিটা ভেঙে পড়ল; কিন্তু ভেতরে আর ঢুকল না কেউ। যে ঢুকল সে তরঙ্গ। বনানীর মাথায় হাত রেখে বলল, ওঠ বনানী…উঠে পড়—সবারই এমন ভাঙে আবার জোড়াও লেগে যায়

বনানী তবু ওঠে না, তবে চোখ মেলে সামান্য। কান্না ভাঙা গলায়ই বলে, সব গিয়েও এটুকুই ছিল রঙ্গ দি…আজ তাও গেল—

তরঙ্গ হাত বোলায়, পিঠের ওপরে হাত রেখে বলে, তবু উঠতে হয়, তবু বাঁচতে হয়—আমরা উঠিনি…

কান্না এবারে দ্বিগুণ; দেহটা ফুলে ফুলে একটানা ফুঁপিয়ে শুধু কেঁদেই চলেছে।

কাঁদুক…মেয়েটা কাঁদুক…উঠবে তো নিশ্চয়ই…তবে তার আগে যতটা পারে কেঁদে হালকা হয়ে নিক—

পিঠের ওপর থেকে হাতটা তুলতে গিয়েও তোলে না তরঙ্গ। স্তব্ধ বিস্ময়ে সেদিকেই তাকিয়ে থাকে।

সকল অধ্যায়

১. মণিবালার প্রথম ও পঞ্চম বাবু – শঙ্করলাল ভট্টাচার্য
২. জনৈক কাপুরুষের কাহিনী – প্রেমেন্দ্র মিত্র
৩. নুরবানু – অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত
৪. আমি একটা মানুষ নই – আশাপূর্ণা দেবী
৫. ঠগের ঘর – সুবোধ ঘোষ
৬. হরপার্বতী সংবাদ – প্রবোধকুমার সান্যাল
৭. চীনেমাটি – সন্তোষকুমার ঘোষ
৮. বালির ঝড় – সমরেশ বসু
৯. আত্মজা – বিমল কর
১০. সন্ধ্যেবেলা রক্তপাত – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
১১. কীট – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
১২. আর একবার – প্রফুল্ল রায়
১৩. রাগ অনুরাগ – শক্তিপদ রাজগুরু
১৪. পূর্বক্ষণ – ননী ভৌমিক
১৫. রাজার টুপি – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়
১৬. ফাঁদ – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ
১৭. জারিনার প্রেম – তারাপদ রায়
১৮. বলিছে সোনার ঘড়ি – বরেন গঙ্গোপাধ্যায়
১৯. আঁধার ঘর – সঙ্কর্ষণ রায়
২০. টেককা টেককি – কণা বসুমিত্র
২১. মিসেস মেলনির গল্প – সুকুমার ভট্টাচার্য
২২. অঙ্কুর – ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়
২৩. ছায়া গোধূলি – উত্তম ঘোষ
২৪. রোদ বৃষ্টি কুয়াশা – বামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়
২৫. দাম্পত্য – অনিশা দত্ত
২৬. বাতাসের রং নেই – কল্যাণ মৈত্র
২৭. বালির ঘর – দিলীপকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়
২৮. শ্বশুরবাড়ি নয়— ক্লাব হাউস – বৈদ্যনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়
২৯. হেনস্থা – তপনকুমার দাস
৩০. লজ্জা – রবিন দে
৩১. দাম্পত্য কলহ ও নেকলেস – শ্রীজয়দেব রায়
৩২. দাম্পত্য স্মৃতি – লক্ষ্মীদেবী চক্রবর্তী
৩৩. সংঘাত প্রশান্ত – বর্মন রায়
৩৪. শেষের সে বিচার – ডাঃ অরুণকুমার দত্ত
৩৫. আলট্রা মডার্ণ – অসীমানন্দ মহারাজ
৩৬. তুমি আমি দুজনেই – আবদুল জব্বার
৩৭. লোকটা – আশিস সান্যাল
৩৮. ক্ষত ও নিরাময় – তৃণাঞ্জন গঙ্গোপাধ্যায়
৩৯. নতুন বইয়ের গন্ধ – শুভমানস ঘোষ
৪০. ভুবন চৌধুরী – অলোককৃষ্ণ চক্রবর্তী
৪১. পদ্মাকাঁটা – গৌর মিত্র
৪২. মালাবৌদি – ডাঃ মহাদেব বন্দ্যোপাধ্যায়
৪৩. ধূসর কণ্ঠস্বর – শান্তিরঞ্জন চট্টোপাধ্যায়
৪৪. দাম্পত্য কলহকথা – স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায়
৪৫. বাদশা-বেগম ঝমঝমাঝম – সৌমিত্ৰশংকর দাশগুপ্ত
৪৬. দাম্পত্য – সুব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়
৪৭. বন্ধ্যা – তমাল লাহা
৪৮. অণুবীক্ষণ – কুণালকিশোর ঘোষ
৪৯. শিউলি বনে গন্ধরাজ – গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়
৫০. বাঁশফুল – শিবতোষ ঘোষ
৫১. ছোটলোক – শচীন দাশ
৫২. পঞ্চম রিপু – শৈলেন রায়
৫৩. শুধু সমুদ্রের চিত্রনাট্য – অরূপরতন ঘোষ
৫৪. আশ্রয় – নীলাঞ্জন চট্টোপাধ্যায়
৫৫. কুমারী মাটি – পুলককুমার বন্দ্যোপাধ্যায়
৫৬. দাম্পত্য কলহের অন্তরালে – বরুণ মজুমদার
৫৭. জলপরী, সুবিমল ও একটি ধর্ষণের গল্প – জগন্নাথ প্রামাণিক
৫৮. পরকীয়া – প্রণব সেন
৫৯. সম্পর্ক – চিন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়
৬০. কালার টি.ভি. – সুদীপ্ত বন্দ্যোপাধ্যায়
৬১. বন্ধন – ভাগ্যধর হাজারী
৬২. পরকীয়া প্রেম – উজ্জ্বল কুমার দাস
৬৩. অনিকেত – সঞ্জয় ব্রহ্ম
৬৪. ভূমিকা – পঞ্চানন মালাকর
৬৫. বিষাক্ত মদ – পরেশ সরকার
৬৬. দূরের গাড়ি – অগ্নি বসু
৬৭. ধারাবাহিক – মৃণাল বসুচৌধুরী
৬৮. বুমেরাং – তপন বন্দ্যোপাধ্যায়
৬৯. বকম বকম – প্রদীপ আচার্য
৭০. কুয়োতলার কাব্য – অশোককুমার কুণ্ডু
৭১. ধরিত্রী – জীবন সরকার
৭২. পৃথিবী শস্যশালিনী – শৈবাল মিত্র
৭৩. রবিবার ছুটির দিন – আফসার আমেদ (আফসার আহমেদ)
৭৪. চিতা – চণ্ডী মণ্ডল
৭৫. মেঘাবৃত চাঁদ – আবু রুশদ
৭৬. প্রতিষেধক – আবু ইসহাক
৭৭. ফাঁদ – আবুল খায়ের মুসলেহউদ্দিন
৭৮. পরী – আলাউদ্দিন আল আজাদ
৭৯. প্রেমের গপ্পো – আখতারুজ্জামান ইলিয়াস
৮০. পানকৌড়ির রক্ত – আল মাহমুদ
৮১. অস্থির অশ্বক্ষুর – আবদুল মান্নান সৈয়দ
৮২. ফুলের বাগানে সাপ – ইমদাদুল হক মিলন
৮৩. আজীবন দিন-রাত্রি – জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত
৮৪. পথ, হে পথ – নাসরীন জাহান
৮৫. ধূসর – বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর
৮৬. বেলী – বুলবুল চৌধুরী
৮৭. অস্পষ্ট মুখ – মঈনুল আহসান সাবের
৮৮. যৌথ একাকিত্ব – মঞ্জু সরকার
৮৯. লা পেরুজের সূর্যাস্ত – রাবেয়া খাতুন
৯০. হে আনন্দ – রাহাত খান
৯১. খাঁচার ভিতর সুচিন পাখি কমনে বাঁইচে রয় – শওকত আলী
৯২. অষুধ – শহীদ আখন্দ
৯৩. মানব-মানবী – শিহাব সরকার
৯৪. মতিনউদ্দিনের প্রেম – সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ
৯৫. গন্তব্য, অশোক – সৈয়দ শামসুল হক
৯৬. প্রহসনের মতো – সাইয়িদ আতীকুল্লাহ
৯৭. দুর্নীতি – সেলিনা হোসেন
৯৮. জননী – হাসান আজিজুল হক
৯৯. নিশিকাব্য – হুমায়ূন আহমেদ

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন