মণিবালার প্রথম ও পঞ্চম বাবু – শঙ্করলাল ভট্টাচার্য

ইমদাদুল হক মিলন

মণিবালার প্রথম ও পঞ্চম বাবু

আর পাঁচটা দিনের মতো আজকের কাগজও একরাশ যুদ্ধের খবর নিয়ে এল। মিত্রশক্তির সাফল্য ও ব্যর্থতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ব্যারিস্টার বরদাকান্তের রক্তচাপ বাড়ে কিংবা কমে। একেক দিন ভোরের আলোয়ও তিনি গাঢ় অন্ধকার দেখেন, যখন কাগজ বলে ইউরোপ কি আফ্রিকার কোনো নগর, প্রান্তর জঙ্গল কী মরুভূমিতে অক্ষশক্তির দখল কায়েম হল। তখন কাগজ থেকে চোখ না উঠিয়েই হাঁক পাড়েন, অবনি, রেডিয়োটা ধরো।

রেডিয়ো ধরার অর্থ আরেকটু এগিয়ে পড়া খবর ধরা, তাতে অন্তত যদি নতুন কোনো পরিস্থিতির আভা মেলে। রেডিয়ো ধরো মানেই আবার বিবিসি ধরা কারণ সাহবদের ওই রেডিয়ো নাকি গভীর সংকটে পড়েও সহসা মিথ্যে রটায় না। মিত্রশক্তির হেনস্থার বার্তায় খুব দমে যান বরদাকান্ত, কিন্তু তারই মধ্যে ওই অন্ধকারে, কিছুটা সমীহে আক্রান্ত হন জার্মানদের প্রতি। কী প্রবল প্রতিভা এই একটি দেশের। তখন ভাই চপলাকে বলেন, জানিস চপল, জার্মানরা দিনে আঠারো ঘণ্টা পড়াশুনো করে। না, তুই মূখ, তুই এটা ভাবতেও পারবি না।

ভাই চপলাকান্ত কোনো অর্থেই মূখ নন, যদি অকৃতদার থাকাটা কোনোভাবে মূখামির ইঙ্গিতবহ না হয়, কিন্তু তিনি দাদার এই নিত্যভৎসনার প্রতিবাদ করারও কারণ দেখেন না। প্রতিবাদ না করেও দাদাকে উসকে দেওয়ার রাস্তা তাঁর জানা আছে, তাতে দিব্যি জ্ঞান লাভ হয়। তিনি সেই পথই ধরলেন। বললেন, যারা সারাক্ষণ যুদ্ধ করে বেড়ায় তারা আঠারো ঘণ্টা সময়টা পায় কোত্থেকে?

আর যায় কোথায়! দপ পরে জ্বলে উঠে বরদা বললেন, এবার বোঝ, কেন তোকে আমি সারাক্ষণ মুখ বলি।

চপলা মিটিমিটি হেসে বললেন, বুঝলাম।

বরদাকান্ত আরও খেপে উঠে বললেন, কোথায় বুঝলি? তুই জানিস আজকালকার যুদ্ধে একটা সামান্য ইনফ্যান্ট্রিম্যানকেও কতখানি বিদ্যে ধরতে হয়? বারো আনা যুদ্ধ কেবল ম্যাপের উপর ছক কষে জেতা হয়ে যায়, জানিস? জার্মান সেনাদের বস্তা ঘাঁটলে দু-চারটে দর্শন কি অঙ্কের বই বেরিয়ে পড়বে দেখিস।

চপলা আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করলেন, আর ব্রিটিশদের?

কীরকম চোখ বুজে আসছিল বরদাকান্তের। স্মৃতিতে ভারী হয়ে আসা চোখ দুটোকে কোনোমতে মেলে ধরে কী এক আবেগের সঙ্গে বললেন, ও-ও এক অপূর্ব জাত, চপল। মেধা আর শ্রম মিশে ভয়ানক সাত্ত্বিক জাত। এই যুদ্ধে ওরা আমার অর্জুন।

চপলা প্রশ্ন করলেন, আর জার্মানরা?

প্রায় অন্যমনস্কভাবে বরদা বললেন, আমার কর্ণ।

আজকের কাগজে মিত্রশক্তির ফ্রান্সের নর্ম্যাণ্ডি তটে অবতরণের বিস্তৃত খবর। এতে বরদাকান্তের হৃদয়ে ব্যাপক উত্তেজনা ঘটার কথা, কিন্তু ভদ্রালোক কীরকম ব্যথায় ও বিভ্রান্তিতে ঝিম মেরে আছেন। এক অন্য যুদ্ধের উত্তেজনা একটু একটু করে লয়ে বাড়ছে তাঁর শরীরের তাবৎ তন্ত্রীতে। কাগজ চোখের সামনে মেলে ধরেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্যে তিনি ঢুকতে পারছেন না। কাল রাতের ঘটনার সামান্য আভাসই তাঁকে ভিতরে ভিতরে পেড়ে ফেলেছে। চায়ের কাপে প্রথম চুমুকটা দিয়েই তাঁর মনে হল এক্ষুণিই হারামজাদা ভাগনে ন্যাপাকে ধরে খড়মপেটা করা দরকার। শুধু মার নয়, একেবারে তুলোধোনা।

এমনটা ভাবতেই পায়ের খড়ম নাচানো শুরু হয়ে গেল বরদাকান্তের। তিনি ফের এক চুমুক চা খেয়ে একটা থ্রি ক্যাসলস ধরিয়ে চেষ্টা চালালেন বিশ্বযুদ্ধে ঢাকার; কিন্তু তাতে ভিতরের যুদ্ধটা আরও বাড়ল। ন্যাপা শেষকালে কিনা বায়োস্কোপের মাগ ধরেছে। বরদাকান্ত ‘ধুত্তোর’ বলে একই সঙ্গে কাগজ আর সিগারেট ছুড়ে ফেলে কলতলার দিকে হাঁটা দিলেন।

দাদার ছুড়ে ফেলা কাগজটা কুড়িয়ে নিয়ে এবার সেটার হেডলাইন নজর বোলাতে লাগলেন চপলা। কিন্তু তাঁরও মনে উত্তেজনা ন্যাপাকে নিয়ে, শেষমেষ কী যে হয় কোথেকে কে জানে। তিনি ডাক দিলেন, অবনী!

কিন্তু ড্রাইভার অবনীর সঙ্গে জুটে গেল দাদার সেরেস্তার ছোকরা গৌরও। দু-জনাই যেন মুখিয়ে ছিল মুখ খোলার জন্য। বেশ চাপা স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, কাল রাতে ব্যাপারটা কী ঘটেছে বলত অবনী?

অবনীর আগেই মুখ খুলল গৌর, আর বললেন না মেজোবাবু, ন্যাপাদার যা কান্ড! মুখে আনা যায় না।

চপলা দ্রুত চালে কিন্তু সেই চাপা স্বরে বললেন, না বলার কী আছে! ন্যাপা মেয়েছেলে ধরে এনেছে তো? সে তো কদিন ধরেই শুনছিলাম, সে আর নতুন কথা কী।

গৌর এবার চপলার কানের কাছে মুখ ঝুঁকিয়ে নীচু গলায় বললে, শুধু ধরেনি মেজোবাবু, বিয়ে করেছ।

চপলা চমকে উঠলেন রেডিয়োর তারে শক খাওয়ার মতন, অ্যাঁ। বিয়ে করেছে? সে মেয়ে কে?

এবার অবনী বলল, বায়োস্কোপের মণিবালা।

বায়োস্কোপের মণিবালা! তাকে বিয়ে করে পাশের বাড়িতে তুলেছে ন্যাপায় এক পয়সা আয় নেই, দাদার টাকায় ওপেনহুড হাম্বার গাড়ি কিনে বসেছে, আর এখন বিয়েটাও সেরে ফেললে ছোকরা! চপলাকান্তের পায়ের খড়ম আপনা থেকে নাচতে শুরু করল। গোটা সমাচার দাদার কানে গেলে যে দক্ষযক্ষ বাধবে তার আশঙ্কাতেই বাঁ-হাতটা মড়মড় করতে লাগল চপলার। তিনিও কাগজ ফেলে মাথায় তেল ছুইয়ে কলতলায় ছুটলেন। লোকে আপিস কাটে, চপলাকান্ত বেগতিক দেখলে বাড়ি কেটে অপিস পালান।

কিন্তু কলতলায় পড়বি তো পড় সাক্ষাৎ দাদার সামনে। কলতলায় চাতলাজুড়ে দাদা বসে, তাঁর মাথায় বালতির পর বালতি জল ঢালছে বড়ঠাকুর। ভাইকে দেখে বরদা বললেন, শুনেছিস? চপলা বললেন, হুঁ।

-কী শুনেছিস?

–কাল কী সব গোলমাল করেছে ন্যাপা।

–ও কি ড্রিঙ্ক করে?

–বোধ হয়।

–আর?

—বোধ হয় একটা বিয়েও করেছে।

-বিয়ে! বিস্ময়ে বিস্ফোরিত হয়ে মেঝে থেকে এক ঝটকায় উঠে দাঁড়ালেন বরদাকান্ত। ন্যাপা বিয়ে করেছে? তোয়ালে দিয়ে গা মোছানোর জন্য পিছু পিছু ছুটছে বড়োঠাকুর, বরদাকান্ত ভিজে কাপড়ে, ভিজে গায়ে হন হন করে চলতে লাগলেন ঘরের দিকে। মুখে কোনো কথা নেই।

খাবার টেবিলে টোস্ট, অমলেট, কফি রাখা হল, বরদাকান্ত সেদিকে দৃকপাতও করলেন । গ্যালিজ দেওয়া প্যান্ট পরে গলায় টাই গলালেন, আনমনাভাবে বুরুশ দিয়ে কোঁকড়া চুলগুলোকে সামান্য বশে এনে কোট চাপালেন, তারপর সাদা মোজামোড়া পা দুটো কালো পাম্পশুয়ে গলিয়ে হাঁক দিলেন, অবনী!

অবনী তখনও ঘরে পৌঁছেছে কি পৌঁছোয়নি; শুনতে পেল বড়োবাবু বলছেন, গাড়ি বার কর, আমি বেরুব।

অবনী অবাক হল দেওয়ালের ঘড়ি দেখে, মোটে তো পৌনে সাতটা। এখন আবার কোর্ট কীসের। কিন্তু বড়োবাবুকে প্রশ্ন করবে সে কলজে কার! ও ‘আসছি’ বলেই পরনের লুঙি ছেড়ে পায়জামা গলাতে গেল। বরদাকান্ত টেবিল থেকে বেছে বেছে দুটো ফাইল তুলে নিয়ে বাড়ির বাইরে রওনা হলেন। চপলাকান্ত স্নান সেরে যখন ঘরে এলেন তখন বেজায় আওয়াজ করে দাদার গাড়ি গেট থেকে রওনা দিল। সাতসকালে কোথায় যে গেলেন দাদা ঈশ্বর জানেন। টেবিলে পড়ে থাকা দাদার না-খাওয়া ব্রেকফাস্ট দেখে প্রথমে খিদে উবে গেল চপলার, পরমুহূর্তে সেই খিদেটাই যেন সবেগে ফিরে এল, তিনি ‘ইস, দাদাটা খেলও না!’ বলতে বলতে দাদার খাবারটা খাওয়া ধরলেন। আর তারপর দাদার কফিতে চুমুক দিতে দিতে চোখের সামনে ভাসতে দেখলেন ন্যাপার তরুণ, সুদর্শন, অসহায়, পাপী-নিস্পাপ মুখ। পাশ থেকে শুবলেন বউদি বলছেন, ঠাকুরপো, তুমি ন্যাপাকে ও বাড়ি থেকে এক্ষুণি পার করে এসো। না হলে দাদা ফিরলে লঙ্কাকান্ড বাধবে।

ধুতির উপর সাদা শার্ট চড়ানো হয়ে গেছে। চপলাকান্তের। পায়ে সাইডকাট পাম্পশু। ওর অফিস ড্রেস। কিন্তু অফিসে যাওয়াটাই আজ সমস্যার হবে। সাইড পকেটে মানিব্যাগ খুঁজতে খুঁজতে চপলা বললেন, তুমি এসব কবে শুনলে বউদি? মালিনী বললেন, সেই যবে ঘটছে।

—সে কী! অথচ আমাদের কিছু বললে না?

–বলে কী হত? ভেবেছিলাম রস মিটলে আপনা-আপনি চুকে যাবে। তো…

–তো?

–কই আর মিটল?

–তোমাকে এসব কে বলল?

—কেন, ন্যাপা নিজে।

–ন্যাপা নিজে?

-হ্যাঁ ও-ই। এসে বললে, মামি, তোমার জন্য বউ এনেছি। বায়োস্কোপের হিরোইন। পছন্দ? বললাম, তোর কি মাথাটা গেল শেষে? এ বাড়িতে বায়োস্কোপের হিরোইন। ও কীরকম গোমড়া মুখ করে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ ; তারপর কিছু না বলে চলে গেল। কিন্তু সত্যি বলছি ঠাকুরপো, ভীষণ লোভ হয়েছিল একবারটি ঢু মেরে দেখে আসি। বায়োস্কোপের নায়িকা বলে কথা। আর মোটে তো পাশের বাড়ি।

-তাই গেলে?

-একদিন দুপুরে গেলাম বই কী। কাউকে না জানিয়ে। আর গিয়ে কড়া নাড়তে দোর খুলল কে জানো?

—সেই নায়িকাই, আবার কে?

—হ্যাঁ, সেই নায়িকাই। মণিবালা। দুর্গাদাস, প্রমথেশের মণিবালা। আমি অবাক হয়ে নায়িকাকে দেখছি, আর সে দেখছে আমাকে। হঠাৎ পিছন থেকে ন্যাপা বললে মণি, এটা মামি। তখন মাথায় ঘোমটা টেনে প্রণাম করতে নীচু হল মণিবালা। কিন্তু ওর প্রণাম আমি নিতে পারিনি; কেন নেব? কতদিন সিনেমার পর্দায় ওকে দেখে দেখে বড়ো বড়ো নিঃশ্বাস ফেলেছি। ওর ডিজাইনে চুলে খোঁপা দিয়েছি। কানের ঝুমকো কাটিয়েছি। তা বলে বাড়ির বউ করব তো ভাবিনি। তাও ন্যাপার…

-ন্যাপার থেকে কত বড়ো হবে মহিলা?

—তা বছর সাতেক তো বটে।

—অপূর্ব। তা কেমন দেখলে মহিলাকে?

–বড় সুন্দরী রে।

–কেমন মানায় তোমার ভাগনের সঙ্গে?

—কী আবার মানাবে হাঁটুর বয়েসি ছেলের সঙ্গে। ওই প্রমথেশ, দুর্গাদাসের সঙ্গেই ঠিক আছে। এবার খুব গম্ভীর হয়ে উঠল চপলাকান্তের গলা। বললেন, তা এখন কী করতে বলো বউদি?

মালিনী অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে শেষে স্বগতোক্তির মতো বললেন, আসলে বিয়ে হয়ে গেছে তো। হিন্দু নারী বলে কথা…

মালিনী তাঁর কথার সমর্থন খোঁজার জন্য ঠাকুরপোর দিকে মাথা ঘোরালেন। কিন্তু কোথায় ঠাকুরপো? বউদির কথার মাঝখানেই পকেট চিরুনিতে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে ঘর থেকে বেরিয়ে উদাসভাবে কোথায় যে যেতে শুরু করেছেন চপলাকান্ত তা তিনি নিজেও জানেন না।

২.

বেলা দেড়টা নাগাদ চপলাকান্ত যখন এসে কড়া নাড়লেন গুপ্তবাড়ির একতলার ফ্ল্যাটে, ন্যাপা তখন সবে আড়ামোড়া ভাঙছে। মণিবালা কাজের মেয়েটাকে দিয়ে ডাল ভাত আলুসেদ্ধ আর ডিমের ডালনা করিয়ে রেখেছে, কিন্তু কর্তাটিকে ডাকার চেষ্টা করেনি। কাল সারাটা রাত যা গেছে বাবুর।

ন্যাপার আর সাহসে কুলোচ্ছিল না ঘড়ির দিকে চাওয়ার। ছি! ছি! ছি! কী যে একটা রাত গেল। কখন যে কীভাবে বিছানায় পড়ে জ্ঞান হারিয়েছে মনেও পড়ে না। কাঁথার ভিতর হাত চালিয়ে আণ্ডারওয়ারটার পরিস্থিতি যাচাই করতে গিয়ে আঁতকে উঠল ন্যাপা। ও মা, ও যে কাঁথার নীচে দিব্যি দিগম্বর!

সঙ্গে সঙ্গে বিছানা থেকে লাভ মেরে উঠে আলনা থেকে ফরসা পাজামাটা নিয়ে তাতে পা গলিয়ে ফেলল ন্যাপা। হ্যাঁ, মনে পড়ল, এই ছিল কাল রাতের সমস্যা। পাজামার দড়ি নেই। ফলে পাজামা রেখে আণ্ডারওয়ার চড়াতে গিয়ে শুনল মণিবালা বলছে, দোহাই তোমার, ওই ছাড়া আণ্ডারওয়ার পরে শুয়ো না। তার চেয়ে ওই ধুতিটাই লুঙ্গি করে নাও। ঢের ভালো।

ন্যাপা তখন সবে লুচি-মাংস শেষ করে নাইটক্যাপ হিসেবে এক পেগ ব্র্যাণ্ডি নিয়ে বসেছে, সে বললে, মণি, জন্মেও শুনেছে কেউ আণ্ডারপ্যান্টে ব্র্যাণ্ডি খাচ্ছে! ও তোমাদের বায়োস্কোপের গবেটরা করে। তার চেয়ে আমি ন্যাংটা শিব হবে ব্রাণ্ডি খাব।

ছোকরা বরের কায়দাকানুনের বেশ একটা ধারণা হয়েছে মণিবালার এই ক-দিনে। যেটা বেশি বারণ করা যায় সেটাই সে আগে করবে। তাই চোপা না করে মণিবালা একটা কারের জোগাড়ে গেল পাশের ঘরে। আর ন্যাপা উদোম দেহে বিছানায় গ্যাট হয়ে বসে ব্র্যাণ্ডিতে চুমুক দিতে দিতে গান ধরলে জ্ঞান গোঁসাইয়ের ‘শূন্য এ বুকে পাখি মোর ফিরে আয়।

ন্যাপার গলাটা মন্দ না, সিনেমার গান ভালোই তোলে। তবে বড়োমামা দু-চার কলি গাইতে বললে সবসময় রাগপ্রধান ধরে। বিশেষ করে জ্ঞান গোঁসাই বা কেষ্টবাবুর গান ধরলে আবেশে মামার চোখ বুজে আসে। এখন যেমন বুজে আসছে ওর নিজের চোখই।

মণিবালা বাস্তবিকই কোত্থেকে একটা কার জোগাড় করে পাজামায় পরিয়ে নিয়ে এল বরের কাছে—এই নাও পাজামা। চটপট গলিয়ে ফেলো তো।

হাতে গেলাস নিয়ে চোখ বুজে সুর লাগাচ্ছিল ন্যাপা—’তুই ফিরে এলে ওরে উন্মাদ, পান্ডুর হবে আকাশের চাঁদ’, সেই অবস্থায় এই ব্যাঘাতে সে গান থামিয়ে বলে উঠল, রাখো তো তোমার পাজামা! এই ন্যাংটা আমি কি দেখতে খারাপ? তুমি বরং বসো, আমার গান শোনো।

ন্যাপা পাজামাটা ছুড়ে ফেললে মেঝেতে আর শুরু হল ওর গান। মণিবালা পাজামাটা মাটি থেকে তুলে বসল স্বামীর পায়ের কাছে। বরং যাতে গানে ডুবে যায় মণিবালা ততই ধরে ধরে পাজামা গলায় পা বেয়ে। শেষে কোমর অবধি এসে গেছে যখন পরিধানটা তখন জ্ঞানবাবুর রেকর্ডের ধারায় ‘শূন্য’ বলে একটা তান মেরে খপাৎ করে বাগিয়ে ধরল বউকে। আর ধরা মানে সে কী ধরা! রাগের পকড় যেন। ধরেই বউকে চিত করে ফেললে কোলের উপর,

তারপর সুরাপানের মতো করে তার ঠোঁটের জুস পান করা শুরু করলে। কয়েক মুহূর্ত আগে ব্র্যাণ্ডির চাইতেও ঢের আগুন মণিবালার ঠোঁটে। তারপর পটপট করে খুলে ফেললে তার বুকের ব্লাউজ। আলতো করে হাত বোলাল ধবধবে ফরসা দু-টি স্তনে। আর বললে, মণি, প্রমথেশ-দুর্গাদাসের সাধ্যি নেই এইরকম আনন্দ দেয়।

ন্যাপা এবার হাত বুলোনো চুলোয় দিয়ে হিংস্র ক্রীড়া শুরু করল মণিবালার শরীরের উপর। সদ্য কেনা আমকাঠের পলকা পালঙ্ক থড়বড় করে কাঁপতে লাগল, ন্যাপার তরতাজা খেলুড়ে শরীরের তলে চিড়েচ্যাপটা হতে হতে মণিবালার কেবলই মনে হতে থাকল—এ সুখের স্বাদই আলাদা।

আর ঠিক তক্ষুণি দড়াম দড়াম ধাক্কা পড়ল ফ্ল্যাটের দরজায়। চমকে উঠেছিল ন্যাপা, মণি দু-জনাই— সত্যিই তো, এত রাতে কোন আপদ ভর করলে। ন্যাপা যেমনটি পড়েছিল বউয়ের উপর ঠিক তেমনিই পড়ে রইল। চিড়েচ্যাপটা মণিবালা মস্ত মস্ত শ্বাস ফেলে ফেলে পড়ে রইল বরের তলায় যেমনকে তেমন। আর ওই দুমদাম চলতেই রইল।

শেষে বউয়ের মুখের উপর থেকে মুখ তুলে ন্যাপা বললে, না মণি, এ তো ভূত নয়।

বরের কথায় এই ঘোর বিপত্তিতেও হেসে ফেলল মণিবালা। বলল, তা হলে তুমি এই ভয়েই এতক্ষণ মুখ লুকুচ্ছিলে?

মুখ লুকোচ্ছিলাম। আমি? কলকাতার ফাস্টরেট স্কাউড্রেল, দি ওয়ান অ্যাণ্ড ওনলি নৃপেন ব্যানার্জি। হাজব্যাণ্ড অব দি গ্রেটেস্ট বেঙ্গলি হিরোইন মণিবালা দাসী! ভাগনে অব দি ওয়ান অ্যাণ্ড ওনলি ব্যারিস্টার বরদাকান্ত চ্যাটার্জি! আমি মুখ…

ন্যাপা আর কথা শেষ করতে পারেনি, বিছানার নীচে পড়ে থাকা পাজামাটা কোনোমতে গলাতে গলাতে দরজার দিকে ছুটে গেল! মণিবালা প্রমাদ গুনল সর্বনাশ। ঘর বলতে তো এই একটিই, সেখানে ভদ্দরলোককে বসানো যায়। দৈবাৎ এ যদি ওর মামাবাড়ির কেউ হয়। ও কোনো মতে নগ্ন শরীরটাকে শাড়ির আলগা আলগা প্যাঁচে ঢাকতে ঢাকতে পাশের ঘরটায় গিয়ে লাইট না জ্বালিয়েই চুপচাপ দাঁড়িয়ে পড়ল।

আর ন্যাপা খিল তুলে দরজা খুলতেই ধড়াস করে মাটিতে গড়িয়ে পড়ল এক বিশাল বড়ো পুরুষ। ধুতি, পাঞ্জাবি, নিউকাট পাম্পশু, মাঝখান থেকে সিধেকাটা চুল আর হাতের সিগারেট টিন নিয়ে যেন এইমাত্র নেমে এলে থিয়েটারের স্টেজ থেকে। আর পড়বি তো পড় একেবারে আধাউদোম ন্যাপাকে সঙ্গে নিয়ে।

আর ওই পড়তে পড়তে ন্যাপা হাঁকলে, এই রাত-বিরেতে তুমি কে হে! আরে ছোঁঃ মদের ডিস্টিলারি উপড়ে এনেছে কোথেকে।

আগন্তুক ন্যাপাকে শোয়া অবস্থায় জাপটে ধরে বললে, বল শালা আমার মণিবালা কই!

ন্যাপা ওর হাত ছাড়াতে ছাড়াতে বললে, খবরদার, ওই নাম ফের মুখে এনেছ কি…! আগন্তুক কোনো মতে সোজা হয়ে দেওয়াল ঠেস দিয়ে বসে বললে, ছোকরা বলে কী! আমার মণিমালার নাম আমি করতে পারব না?

ন্যাপা বলল, এখানে যিনি থাকেন তিনি মণিবালা, মণিমালা নয়।

লোকটা বলল, ওই হল। যা মালা তাই বালা। গলায় মালা, হাতে বালা। এই তো।

ন্যাপা চ্যাঁচাল, চোপ! দূর হ, মাতাল কোথাকার।

সে লোক বললে, আমার মণিমালা দে, দূর হয়ে যাই।

আর তখন পাজামা সামলাতে সামলাতে ন্যাপা লোকটার কোমরে ক্যাত করে দুই লাথি ঝাড়লে।

লাথি দুটো হজম করলে খুব হাসি হাসি মুখে মানুষটা, তারপরই যাত্রা ভিলেনের মতো ‘তবে রে শালা!’ বলে হুংকার দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে ঝাঁপ দিয়ে পড়ল ন্যাপার উপর। অত বড়ো বপু যে ওইভাবে উড়ে আসতে পারে তা ন্যাপার হিসেবে ছিল না। ও টাল সামলাতে না পেরে ছিটকে গিয়ে পড়ল শোওয়ার ঘরের সামনে ছোট্ট, চৌকো, লাল মেঝেতে। লোকটা ততক্ষণে তার নিউকাটের এক পার্টি খুলে ফেলেছে, সেই হাত তেড়ে এল ন্যাপার উপর। কিন্তু নীচু হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বীকে জুতোপেটা করতে গিয়ে নিজেও গড়িয়ে পড়ল মাটিতে। ন্যাপা মনে মনে ভাবল, আচ্ছা হারামির পাল্লায় পড়া গেল তো! তাই পড়া অবস্থাতেই জিজ্যেস করল, তুই কে রে আপদ?

লোকটা ওই পড়ে থাকা অবস্থায় উত্তর করল, তোর মণিমালার গলার মালা! প্রথম মালা। মুরারি দত্ত!

শোওয়ার ঘর থেকে কিছুটা আলো এসে পড়েছিল জায়গাটায়, সেই আলোয় ন্যাপা ভালো করে দেখার চেষ্ট করল মুরারি দত্তর মুখটা। বুকের মধ্যে তখন শুরু হয়েছে টিপটপুনি মুরারি দত্ত! বলে কী! নাটকপাড়ার কিংবদন্তী মুরারি দত্ত এই রাতে, এইভাবে, এখানে।

ন্যাপা তখনও ভিতরে ভিতরে ঝিমুচ্ছে অদ্ভুত অদ্ভুত চিন্তার যখন শুনল মুরারি ওই শোয়া অবস্থায় কৌটো থেকে সিগারেট বার করে বলেছে, এই নে, একটা ধরা। আর ওই মাগিটাকে বার করে দে, আমি নিয়ে যাই।

ন্যাপা সোজা হয়ে বসে ফাইভ ফিফটি ফাইভ ধরাল মুরারির রুপোর লাইটারে, তারপর লাইটার ফেরত দিতে দিতে বলল, খবরদার মাগি বলবি না মণিবালাকে! ও আমার বিয়ে করা বউ।

অন্ধকার মেঝেতে বসে সিগারেটে মোটা টান দিয়ে মুরারি বলে, মেরেছে। আমার মাগি তোর বউ হয় কী করে বল দিকিনি? দেড় মাস ধরে হ্যাপিত্যেশ করে খুঁজে মরিচি কি আর সাধে? ওকে বাজারে আনলে কে? কোতায় ছিল জানিস ষোলো বছর আগে? কোন গলতায়?

ঠিক তখন আলনা আর তোরঙ্গের ছোট্ট কুঠুরি থেকে লাইট জ্বেলে বেরিয়ে এল মণিবালা। ঘরের আলো পড়ল ন্যাপা আর মুরারির উপর। ন্যাপা দেখল মণির চোখ দুটো জ্বলছে, কিছু কিছু রাগি দুর্গাপ্রতিমার মতো। আঁচলের চাবির গোছা দিয়ে এক বাড়ি মারল মুরারির পিঠে। আর গর্জে উঠল, কোন জন্ম থেকে হাড়মাস চুষে খাচ্ছ, তাতে রস মেটেনি? ফের আমার সুখের সংসারে আগুন ঢালতে এলে?

চাবির পিটুনিতে বেশ সুখ হয়েছে মনে হল মুরারির। চোখ বুজে সিগারেটে দম দিতে গিয়ে বলল, তোর সুখ তো আমার কোঁচায় বাঁধা, মণি। যেখানে আমি, সেখানে তুই। এরা কোখেকে আসে? বলে সামনে বসা ন্যাপাকে নিউকাটমুক্ত খালি পাটা দিয়ে এক লাথি মারল মুরারি।

এ পর্যন্ত সব ঠিকঠাক ছিল, মদের উপর মারামারিতে ন্যাপাও অভ্যস্ত আছে বহুদিন। তা বলে নতুন বউ নিয়ে নোংরা কথা। তার সামনে লাথি। ন্যাপা ‘ধুত্তোর!’ বলে সদ্য ধরানো সিগারেট ছুড়ে ফেলে ঝাঁপিয়ে পড়ল মুরারির উপর। দু-টানে ওর মিহি আদ্দির পাঞ্জাবি ফেঁড়ে ফেলে কোমরে ধুতির গিট ধরে হ্যাঁচকা টান দিল। মুরারি ওঠার চেষ্টা করতেই পিঠে দুটো কিল। প্রৌঢ় মুরারি ‘অফ’! ‘অফ!’ করে সে কিল হজম করলে, কিন্তু ঠেলে উঠলে ঠিক।

ধুতি খুলে খুলে মাটিতে গড়াচ্ছে, গায়ের জামা রথের গায়ে কাগজের পতাকার মতো পতপত করে উড়ছে, মুরারি এক পায়ে নিউকাট নিয়ে শোওয়ার ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, এই তোর সাধের সংসার, মণি? আমার বারটেণ্ডার গোমেসও তো এর চেয়ে ভালো পালঙ্কে শোয়! তোর ও ছোকরা করেটা কী?

মুরারি ধপাস করে বসে পড়ল খাটে। তারপর পাশের টিপয়ে ব্র্যাণ্ডির পাঁইট দেখে উৎফুল্ল হয়ে বলে উঠল, ওরে এ তো তৈরি ছেলে বাপ, মালঝালও খায়। তা হলে বোস এখানে, খা আমার সঙ্গে দু-পাত্তর, বুঝবি মণিমালার বাবু হতে কী লাগে।

ন্যাপার ভয়ানক ইচ্ছে হচ্ছিল খাটের নীচের চপ্পলটা বার করে ফের প্রহার শুরু করে, কিন্তু মণিবালার প্রথম বাবুর কেরামতির কিছু জানার প্রবল বাসনারই জয় হল। ও চোখের ইশারায় বউকে অন্য ঘরে যেতে বলে দুটো ব্র্যাণ্ডির পেগ সাজিয়ে মুরারি দত্তর পাশে এসে বসল।

মুরারি প্রথম চুমুকটা দিয়েই বলল, শুনে রাখ, আমি প্রথম, তুই দুইও নস, তিনও নস, চারও নস, একেবারে পঞ্চম। পঞ্চম বাবু।

ন্যাপা মুরারির কৌটো থেকে একটা সিগারেট বার করে ধরিয়ে বলল, তোরা বাবু, আমি বাবু নই। স্বামী।

এবার মুরারি টান দিল সিগারেটে, ওই হল। বাবু আর স্বামীর ফারাক ডিকশনারি বলবে, আমি পারিনে, একটু সিঁদুর মাখালেই যদি…

হঠাৎ হাউ হাউ কেঁদে উঠল মুরারি দত্ত। ন্যাপ ভাবলে এ আবার কী শুরু করল মাতালটা। কাঁদতে কাঁদতে মুরারি বলল, ওই সিঁদুর সিঁদুর করেই তো মলো এই মেয়েছেলেগুলো। আর যাকে সত্যি সত্যি সিঁদুর মাখিয়ে বউ করে ঘরে তুলেছিলাম সেই হেমন্তবালা তো গলায় দড়ি দিয়ে কবেই মরে গেল।

ফের হাউ হাউ কান্না জুড়ল মুরারি ; ধৈর্যের বাঁধ ভাঙছিল ন্যাপার। সে ওর মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে সান্ত্বনা দেওয়ার সুরে বলল, এত গন্ডা মাগ রাখলে বাপ বউ তো গলায় দড়ি দেবেই।

তখন মুহূর্তের জন্য কান্না থামিয়ে মুরারি বলল, তুই বলছিস? ন্যাপ মাথা দুলিয়ে বোঝাল ‘হ্যাঁ।

সঙ্গে সঙ্গে ন্যাপার হাত দুটো চেপে ধরে কান্নার সুরেই মুরারি বলল, তা হলে বাপ তুই মণিমালাটাকে ছেড়ে দে, ওকে আজ সিঁদুর পরিয়ে বিয়ে করেই নিয়ে যাব।

এরকম একটা আবদার যে কোনো মানুষ কারও বউকে নিয়ে করতে পারে এটাই ন্যাপার কল্পনার বাইরে। ও কয়েক মুহূর্ত চুপ মেরে রইল তারপর সেই বিস্ময়ে বিহ্বলকণ্ঠে বলল, তুই আমার বউকে বিয়ে করে নিয়ে যাবি? এটা হয়?

কান্নাটাকে একটু সামলে নিয়ে মুরারি বলল, কেন হবে না? তুই ওকে ছেড়ে দিলেই হবে। ন্যাপা কিছু বলার আগে ঘরে ঢুকে এসেছে মণিবালা। কোমরে হাত রেখে মুরারিকে বলল, শয়তান মিনসে, তুমি জানো সিঁদুরের কী মূল্য। ভেবেছ আমায় সিঁদুর মাখিয়ে তোমার বাগানবাড়িতে নিয়ে ফিরবে? বেরোও। না হলে আমি পুলিশ ডাকব। বেরোও।

ন্যাপার হঠাৎ সংবিৎ ফিরেছে, ও বলল, পুলিশের কী দরকার। আমিই মেরে ভাগাচ্ছি। বলেই ন্যাপা দাঁড়িয়ে মুরারির ঘাড় ধরল।

মুরারি গর্জাল, খবরদার। গলা ধরবিনি।

ন্যাপা খিঁচিয়ে উঠল, গলা ধরব কীরে! ঘাড় মটকাব। ভালো চাস তো মানে মানে বের হ। মুরারি গেলাস রেখে উঠে দাঁড়াতে ন্যাপা হাতটা সরিয়ে নিল ওর ঘাড় থেকে। আর তক্ষুণি বাইরে গাড়ির হর্ন বাজা শুরু হল। মুরারি প্রচন্ড খেপে খিঁচিয়ে উঠল, হারামির বাচ্চা ড্রাইভার হর্ন দিয়ে ডাকছে। এত বড়ো স্পর্ধা! আমি দেকছি…

বলতে বলতে সিগারেট কেসটা তুলে নিয়ে ঘরের বাইরে পা দিল মুরারি। ওর পকেট গলে এক বাণ্ডিল একশো টাকার নোট পড়ে গিয়েছিল খাটে, সেদিকে চোখ পড়তে মণিবালা বলল, দাঁড়াও। ওই টাকা তোললা, তারপর যাও। এ বাড়িতে কারও ভিক্ষে নেওয়া হয় না। লোকের বাড়িতে এইরকম টাকার টোপ ফেলার কায়দা আমার জানা আছে।

মুরারি থমকে দাঁড়িয়ে, তারপর ঘুরে ওই টাকার দিকে চেয়ে ছদ্ম বিস্ময়ে বলল, আমার টাকাগুলো উপচে পড়ে গেছে বুঝি। ন্যাপা তোড়াটা ওর হাতে তুলে দিতে দিতে বলল, আজ্ঞে হ্যাঁ, বাবুমশায়। এখন ফেরত নিয়ে ধন্য করেন।

মুরারি টাকাটা হাতে নিয়ে কী ভাবল এক দন্ড, তারপর সেটা মণিবালার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললে, নতুন বে হল তোর। এটা না হয় আমার উপহারই রইল। নেমতন্ন তো করলিনি…

আর তখনই চটাস করে চড়টা কষাল মণিবালা। কিন্তু এবারে মারটা আর আমোদর সঙ্গে হজম করতে পারল না মুরারি। ও রীতিমতো হকচকিয়ে গেল। ন্যাপাও দেখল প্রৌঢ়ের মুখের রসিক ভাবটা দপ করে নিভে গেল। গালে হাত বুলোতে বুলোতে মুরারি বললে, তুই আমার মারলি, মণি?

মণিবালা কথাটার আমল না দিয়ে নতুন বরের দিকে তাকিয়ে হুকুম জারি করল, ওকে গাড়িতে তুলে দিয়ে এসো। আর এক মুহূর্তও আমি এসব সহ্য করব না।

মুরারি টাকাগুলো পকেটে ভরতে ভরতে বলল, তার দরকার হবে না। আমি নিজেই যেতে পারব।

বলেই ঘরের বাইরে পা রাখল মুরারি এবং চৌকাঠে হোঁচট খেয়ে দড়াম করে পড়ল মেঝেতে। ন্যাপা ওকে ধরে তুলতে যাচ্ছিল, চোখের ইশারায় নিষেধ করল মণিবালা। মুখে বলল, ছেড়ে দাও, ও নিজেই যাবে।

মুরারি দ্বিতীয়বার পড়ল ফ্ল্যাটের দরজায়, তারপর অন্ধকার গলির মাঝমধ্যিখানে। গাড়ির ড্রাইভার দৌড়ে এসে বাবুকে তুলে নিয়ে বসাল যখন পেল্লায় আর্মস্ট্রং-সিডলিতে ততক্ষণে পাড়ার বেশ কিছু জানলার খড়খড়ি ফাঁক হয়ে একরাশ জোড়া চোখ ঘটনার মাপজোক নেওয়া শুরু করেছে।

ফ্ল্যাটের দরজা থেকে লজ্জা আর উত্নষ্ঠার সঙ্গে সব দেখলে ন্যাপা, ওর মনের চোখের সামনে ভাসছে তখন মামা বরদাকান্তের মুখটা। কী সম্মান লোকটার গোটা পাড়ায়। আর কী স্নেহ তাঁর অপদার্থ ভাগনেটির প্রতি। আর তাঁরই বসতিভিটের পাশেই এইসব ঘটিয়ে ফেলল ও।

একটা বিকট ধাক্কার আওয়াজ এল গলির মুখ থেকে। ন্যাপা বুঝতে পারল মুরারির গাড়ি বোধ হয় ব্যাক করতে গিয়ে সপাটে ভেড়াল ওর সদ্য হাজার টাকায় কেনা সেকেণ্ড হাম্বার হকের বনেটে। কিন্তু গলির মুখে যাওয়ার এতটুকু সাহসও আর টিকে নেই। অর্ধেক পাড়া গোয়েন্দাগিরিতে নেমে পড়েছে।

ন্যাপা তাড়াতাড়ি ঘরে এসে ব্র্যাণ্ডির গেলাসে ঢালা মদগুলোকে চোঁ চোঁ করে মেরে দিলে। মণিবালা করছ কী!’ করছ কী!’ বলার মধ্যেই শেষ। মণিবালা মদের পাঁইটটা চট করে হাতিয়ে নিয়ে পাশের ঘরে ছুটে গেল জায়গা মতন সেটাকে সরিয়ে আসতে।

তারপর ফিরে এসে দেখে উলুঢুলু অবস্থার বরটা বিছানায় পড়ে অকাতরে ঘুমুচ্ছে। মণিবালা একবার ভাবল, সত্যিই ঘুমিয়ে পড়ল ছোকরা? কাছে গিয়ে আস্তে ঠেলা মারল, কোথায় কে। দেখল ওর পাজামাটা বিশ্রীভাবে নেমে গিয়ে ফের সেই দিগম্বর দশা। ও চেষ্টা করল সেটাকে তুলে কোমর অবধি আনার, কিন্তু উপায় কী, মড়া মাতলের ওজন নাকি লোহার সমান। মণিবালা সে-চেষ্টা ত্যাগ করে গায়ের চাদর দিয়ে বরকে ঢেকে দিয়ে, লাইট নিভিয়ে এসে সেই চাদরের তলায়ই সেঁধিয়ে গেল। চুমু দিল বরের ঠোঁটে, গালে, কপালে, চোখের পাতার উপর। তারপর দু-বাহুতে তাকে আঁকড়ে ধরে উবুড় হয়ে শুয়ে পড়ল তার বুকের উপর।

কিছুক্ষণ এভাবে থাকার পর মণিবালার মনে হল, কে জানে, এভাবে বুকের উপর শুলে ওর লাগছে হয়তো। বুক থেকে সরে পাশে শুল মণিবালা, কিন্তু আলিঙ্গন মুক্ত করল না। এত ঝড়ঝাপটার পর এত সুন্দর মনের মানুষটাকে পাওয়ায় হঠাৎ কেন জানি না এক অজানা আশঙ্কা তোলপাড় করছে ওর মন। ওর ভয় হচ্ছে পৃথিবী যেন কেড়ে নিতে চাইছে ওর বুকভরা সামান্য সুখ।

অন্ধকারের মধ্যে ফের চোখের জলে বরের মুখে চুমু ছড়াতে শুরু করল মণিবালা। যার কিছুই জানতে পারল না ঘুমে অচেতন ন্যাপা।

ন্যাপার সেই অচেতন ঘুম শেষ হয়েও যেন শেষ হয় না। ও আড়মোড়া ভাঙছিল। লজ্জায় মনটা কুঁকড়ে আছে, বউয়ের দিকেও চাইতে ইতস্তত করছিল, যখন ফ্ল্যাটের দরজায় এসে কড়া নাড়লেন ছোটোমামা চপলাকান্ত।

৩.

বরদাকান্ত বাস্তবিকই সাতসকালে অবনীকে নিয়ে রওনা দিয়েছিলেন কোর্টে যাবেন বলে নয়, কোর্টের একটু অদূরে, গঙ্গার পাড়ের দিকে যাবেন বলে। গঙ্গার পাড়ে এসে অবনী গাড়ি ভেড়াতেই তিনি বললেন, অবনী, একটু চায়ের ব্যবস্থা করো তো।

অবনী জানে বড়োবাবুর কিছু খাওয়া হয়নি সকালে। তাই নীচু গলায় জিজ্ঞাসা করল, শুধু শুধু চা খাবেন? খাবার কিছু আনব?

বরদাকান্ত বেশ দৃঢ়ভাবে বললেন, না। শুধু চা।

অবনী চায়ের খোঁজে বেরোতেই বরদাকান্ত ওঁর পাশের দরজাটা খুলে দিয়ে কোটের পকেট থেকে থ্রি ক্যাসলসের টিন বার করলেন। তারপর তার থেকে একটা সিগারেট ঠুকে ঠুকে বার করে ধরালেন। গঙ্গার ধারে সকালের নির্মল হাওয়ায় এক বুক ধোঁয়া টেনে আস্তে আস্তে সেটা বার করতে লাগলেন। গঙ্গার দিকে চোখ মেলতে, নীল আকাশের দিকে দৃষ্টি যেতে, নদীর মাঝখানে নোঙর করা মালবাহী ব্রিটিশ জাহাজ এস এস রসিটারের উপর চোখ পড়তে হঠাৎ তাঁর বড় সুখ আর আনন্দ হল। সকালের গঙ্গাদর্শন ওঁর ছেলেবেলার নানা স্মৃতি ভেসে উঠল খুলনা শহরের। যখন সূর্যোদয়ের আগে রূপসা নদীর পাড়ে বসে ওপারের সবুজ খেত আর জলের উপর পালতোলা নৌকার মিছিল দেখে বড় আহ্লাদ হত। একবার কী মনে করে বেরিয়েও পড়েছিলেন অমন এক নৌকায় উজানের দিকে। আর কত কত সকাল যে স্নানে কেটেছে রূপসার জলে। কী তরতাজা, পবিত্র লাগত নিজেকে ওই সব স্নানের পর।

আজও তেমনই এক পবিত্রতার ছোঁয়া লাগছে বরদাকান্তের বুকে। বেশ তাজাও বোধ করছেন; কিন্তু গালে এক অলক্ষ্য অস্বস্তি। রাগের মাথায় নাপিত দেবেনকে ডেকে দাড়িটা কাটানো হয়নি। আর রোজ সকালে দাড়িটায় শেফিল্ড খুরের পোঁচ না পড়লে বরদাকান্তের মনেই হয় না দিনটা শুরু হয়েছে বলে।

সিগারেটে একটা লম্বা টান দিয়ে তিনি গালে হাত বুলোলেন একটু, তারপর নিবিষ্ট চিত্তে নদী দেখতে লাগলেন। একটা মাঝারি সাইজের লঞ্চ তরতর করে ছুটে গেল ‘ভোঁ’ তুলে। কয়েকটি ছোকরা সাঁতারের জন্য ঝপঝপ করে লাফ মারল জলে। একটা চিল ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে গেল কী একটা পাড়ের নৌকার ছই থেকে। কোথেকে কখন একটা ভিখিরি এসে হাত পাতল, বাবু! বরদাকান্ত পকেট থেকে দুটো সিকি বার করে হাতে দিতে যেতে সে হাত সরিয়ে নিল। না বাবু, ভিক্ষে চাই না। একটা সিগারেট খাওয়ান।

বরদাকান্ত চমকে উঠলেন, সিগারেট। বলি, কিছু খাওয়া হয়েছে?

ভিখিরি তাপ-উত্তাপহীনভাবে বলল, না, বাবু।

বরদাকান্ত উম্মার সঙ্গে বললেন, তা হলে খাবার না চেয়ে সিগারেট চাইছ কেন?

ভিখিরি সেই পূর্বের ধরনেই বলল, তা হলে দিন।

বরদাকান্ত ডেকে সিকি দুটো দিলেন, তারপর দুটো থ্রি ক্যাসলস সিগারেট দিয়ে বললেন, এই সিগারেটের দাম কত জানো?

ভিখিরি বলল, না বাবু। কত?

বরদাকান্ত দামটা বলতে গিয়ে কী বুঝলেন, থমকে গেলেন। শুধু বললেন, ঠিক আছে, তুমি যাও।

আর তখনই একটা আধসেরি ভাঁড়ে গরম চা নিয়ে ফিরল অবনী। চায়ে চুমুক দিয়ে বড় তৃপ্তি হল বরদাকান্তর, জিজ্ঞেস করলেন অবনীকে, তোর চা কই?

অবনী বলল, আমি তো বড়োবাবু একবারই চা খাই, ওই ভোরে।

বরদাকান্ত বললেন, হুঁ।

চায়ে ফের চুমুক দিয়ে বললেন, তা তুই বাইরে দাঁড়িয়ে রইলি কেন?

অবনী বিব্রত মুখে আমতা আমতা করা শুরু করল। আসলে … আপনি তো বসে তো… চা খাচ্ছেন…

ওর কথার মধ্যেই বরদাকান্ত হঠাৎ জিজ্ঞেস করে বসলেন, কাল রাতে কী হয়েছিলরে

ন্যাপার ওখানে?

অবনীর পা থেকে মাথা অবধি কারেন্ট খেলে গেল। বড়োবাবু ওকে জিজ্ঞেস করছেন কাল রাতের হুজ্জোতির উপর! কী বলতে কী বলে ফেলবে ভেবে ও কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। কান চুলকোল, ঘাড়ের কাছে হাত বুলোল। শুনাল, ফের জিজ্ঞেস করছেন বড়োবাবু; বললি না, কী হল কালকে?

অবনী একটু কেশে নিয়ে বলল, বাবু, ওই ন্যাপাদার যে বউ তার আগের বর নাকি এসে খুব হুজ্জোতি করেছে।

সংবাদে গুম মেরে গেলেন বরদাকান্ত। শেষ চুমুকটা দিয়ে ফের একটা লম্বা টান দিলেন সিগারেটে আর নদীর দিকে মুখ ঘুরিয়ে রসিটার জাহাজের বিশাল বিশাল চিমনিগুলো দেখতে লাগলেন।

অবনীর মনে হল যতটা সম্ভব ন্যাপাদাকে বাঁচানো গেছে, কিন্তু ও মা! ওভাবে জাহাজ দেখতে দেখতে বড়োবাবু ফের জিজ্ঞেস করলেন, তা হলে মেয়েটার আগেও বিয়ে ছিল?

অবনী বলল, তাই তো শুনেছি। বড়োবাবু।

-বয়সেও তো ন্যাপার চেয়ে বড়ো?

—তাও শুনেছি।

–হুম! আর কী শুনেছিস?

কান চুলকোতে চুলকোতে অবনী বলল, শুনেছি বউ নাকি দেখতে খুব সুন্দর।

বরদাকান্ত মুখে একটা বিরক্তিকর ধ্বনি তুলে সিগারেটটা ছুড়ে দিলেন বাইরে আর বললেন, নে চল।

গাড়ি স্টার্ট দিয়ে অবনী বলল, কোথায় বড়োবাবু?

বরদাকান্ত বললেন গ্রেট ইস্টার্নে। ব্রেকফাস্ট করব।

অবনী গাড়ি ছোটাতে বরদাকান্ত ওঁর গ্ল্যাডস্টোন ব্যাগ থেকে দিনের কাগজটা বার করে পড়া শুরু করলেন।

দরজা খুলেছিল মণিবালা। চপলাকান্ত মণিবালাকে দেখে দু-দন্ড স্থির হয়ে দাঁড়ালেন। আহা রে, সেই চোখ, সেই চাহনি, সেই স্নিগ্ধ হাসির ছোঁয়া ঠোঁটে, গালে সেই টোল। ঘোমটা-টানা নত মুখে মণিবালা যখন নিম্নস্বরে বলল ‘আসুন!’ চপলাকান্ত তখনও মণিবালার মধ্যে মঞ্চ ও রুপোলি পর্দার সেই নায়িকাকেই দেখছিলেন। মনে পড়ল বন্ধু রঘুনাথের সঙ্গে ‘সীতা’ আর ‘ষোড়শী’ নাটকে মণিবালাকে দেখে কী মুগ্ধই না হয়ে পড়েছিলেন দু-জনে। তারপর কার মুখে শুনলেন ‘মিশরকুমারী’ নাটকেও আবনের কন্যার ভূমিকায় মণিবালা নাকি শ্বাসরুদ্ধকর কাজ করেছে। ব্যাচেলর চপলাকান্তের মুখে মণিবালার রূপ ও অভিনয়ের প্রশংসা শুনে তাস খেলতে খেলতে আনমনে বরাদাকান্ত একদিন বলে বসেছিলেন, কার কথা এত বলছিস রে চপলা ক-দিন যাবৎ?

লজ্জায় পড়ে চপলাকান্ত যেন প্রসঙ্গান্তরে চলে গিয়েছিলেন।

আর আজ সেই মণিবালা সাক্ষাৎ ওঁর সামনে দাঁড়িয়ে। ঘোমটা টেনে একেবারে বাড়ির বউটি। বউদিও হয়তে এইভাবেই দেখেছিল ওকে, সবাইকে লুকিয়ে যখন ভাগনের নায়িকা। বউ দেখতে আসে।

চপলাকান্ত কিন্তু কোনো উত্তর করলেন না। মণিবালাকে পাশ কাটিয়ে ওদের শোওয়ার ঘরে ঢুকে দেখলেন শ্রীমান সবে ঘুম থেকে চড়ে পাজামার গিট বাঁধতে বাঁধতে খাট ছাড়ছেন। ছোটোমামাকে দেখেই বলল, তুমি?

খাটে বসতে বসতে চপলা বললেন, অগত্যা।

ন্যাপার মুখটা শুকিয়ে গেল। কোনো মতে উগরোতে পারল, বড়োমামা জানেন?

চপলাকান্ত এ প্রশ্নের কোনো উত্তর দিলেন না। পরিবর্তে কিছুটা খেদের সঙ্গে জিজ্ঞেস করলেন, তুই যে এখানে এসে উঠেছিস সেটা জানাবারও প্রয়োজন বোধ করলি না?

ন্যাপা গুটি গুটি ছোটোমামার পাশে এসে ওঁর হাতে দুটো হাত চাপা দিয়ে নীচু গলায় বলল, বিশ্বাস করো ছোটোমামা, কোথাও একটা দু-কামরার ফ্ল্যাট খুঁজে পাচ্ছিলাম না। একজায়গায় তো একমাসের ভাড়া আগাম দিয়ে উঠেও পড়েছিলাম। একদিন বাদে টাকা ফেরত করে বাড়িওলা বললে, আপনারা বায়োস্কোপের লোক আগে জানাননি। আমাদের অসুবিধা আছে। স্রেফ বড়োমামার কথা ভেবে এই বাড়িওলা ঘর দিয়েছে। না হলে কোথায় যেতুম বলো তো?

চপলাকান্ত এক টিপ নস্যি নিলেন। কী সব আকাশ-পাতাল ভাবলেন। শেষে নৈঃশব্দ্য ভাঙলেন, তা এখন কোথায় যাবি ভাবছিস?

ন্যাপার চোখ ফেটে জল এল। ও জোরে জোরো মাথা ঝাঁকাতে লাগল। আমি সত্যিই জানি না, ছোটোমামা। যে দিকে দু-চোখ যায় চলে যাব। বউ নিয়ে তো আর বড়োমামার ওখানে উঠতে পারব না।

চপলাকান্ত বললেন, সে যেখানে যাবি যাস। তার আগে দাদার সঙ্গে একবারটি দেখা করিস। বেচারা বড় দুঃখ পেয়েছে।

ন্যাপা বলল, সে কি আর আমি জানি না মামা?

–জেনে লাভ তো কিছু হল না দেখছি!

–আমার কপাল।

চপলাকান্ত খাট থেকে উঠতে উঠতে বললেন, তোর কপাল না দাদার কপাল। এমন গুণধর ভাগনে ক-জনার কপালে জোটে?

বিব্রত স্বরে ন্যাপা বলল, যা বলেছ।

চপলাকান্ত বুক পকেটের লুকোনো গর্ত থেকে একটা একশো টাকার নোট বার করে ন্যাপার হাতে দিয়ে বললেন, দৈবাৎ নতুন বউয়ের মুখ দেখে ফেলেছি। এটা তোর বউকে দিস।

ন্যাপা একটু পিছিয়ে গিয়ে বলল, সে কী! যে বউকে ঘরে তোলা যাবে না তার মুখ দেখে…

চপলাকান্ত ঘরের বাইরে পা বাড়াতে বাড়াতে বললেন, সে তুই বোঝ।

.

সন্ধ্যের তাসখেলাটা আর কিছুতেই জমছে না বরদাকান্তর। ভালো ডিল পেলেন পর পর দু-বার, কিন্তু খেলা সাজতে পারলেন না। শেষে দুই জুনিয়র শরদিন্দু আর মৃগেনকে বললেন, তোমরা আজ যাও। তাসে মন বসছে না। দেখি চপলার সঙ্গে একটা দাবা চলে কি না।

দাবাটাও যে খুব খেলতে ইচ্ছে করছে বরদাকান্তর তাও নয়। তবে শরদিন্দু, মৃগেনরা গেলে দাবার ছকে মুখোমুখি বসে কিছু প্রশ্ন তলব করা যায় চপলাকে।

মন্ত্রীর সামনের বোড়েকে এক ঘর বাড়িয়ে বরদাকান্ত ভাইকে জিজ্ঞেস করছিলাম ন্যাপার কথা।

চপলাকান্তও ওঁর মন্ত্রীর বোড়ে বাড়াতে বাড়াতে বললেন, কী আর করবে দাদা? এরকম রাসকেল ভাগনেরা তো সমস্যা হয়ই।

বরদাকান্তও ওঁর ঘোড়াকে বার করতে করতে উত্তেজিত স্বরে বললেন, তার মানে। চোখের সামনে ভাগনেটা উচ্ছন্নে যাবে আর মামা হয়ে আমি সেইটা অ্যাপ্রুভ করব?

চপলাকান্ত আরেকটা বোড়ে বার করলেন। কিন্তু দাদা, তোমার অন্য ভাগনেটি—নিতু– সে তো মানুষ হচ্ছে।

ও! নিতু পড়াশুনো চালিয়ে যাচ্ছে বলে ন্যাপাকে স্কাউজ্জ্বেল হয়ে উঠতে হবে?

ঠিক তা নয়… চপলাকান্ত ছকের দিকে গভীর মনোনিবেশ তাকিয়ে থাকতে থাকতে বললেন, হাতের সব আঙুল তো আর সমান হয় না।

বরদাকান্ত বললেন, তা বলে অন্যের অপোগন্ড ছেলে মানুষ করার সব দায়িত্ব তো একা আমার হতে পারে না। আমি সুমিত্রাকে বলেছিলাম তোমার ছেলেদের আমি মানুষ করে দেব, কিন্তু তাদেরও চেষ্টা করতে হবে মানুষ হওয়ার জন্য। মানুষ হওয়ার এই লক্ষণ। এক পয়সা রোজগার নেই, ছেলে বিয়ে করে বসলে! তাও কিনা …

বরদাকান্তর কথা আটকে গেল। চপলাকান্ত মৃদুভাবে ফের ন্যাপার হয়ে কিছু বলার চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু থেমে পড়লেন দাদার সশব্দ দীর্ঘশ্বাসে। বরদাকান্ত হঠাৎ ফের উত্তেজিত হতে শুরু করলেন ভিতরে ভিতরে, ওঁর চাহনি এড়ানোর জন্য চপলাকান্ত মাথা নীচু করে ছক দেখতে লাগলেন। আর একসময় চমকে উঠলেন দাদার ভৎসনায়ও যে ব্যাবসা করার নামে টাকা নিয়ে গাড়ি কিনেছে তাও তুই আমায় বলিসনি।

দাবার চেয়েও জটিল প্যাঁচে পড়ে গেছেন বুঝে চপলাকান্ত মনে মনে যুক্তির খুঁটি সাজানো শুরু করলেন। প্রথমে আলতো কয়েকটা প্রশ্ন বাড়ালেন, একথা কে বললে তোমায়?

কিন্তু বরদাকান্ত ছাড়বার পাত্র নন। বললেন, সে তোমার জেনে কাজ নেই। কথাটা তো সত্যি।

চপলা একটা বোডের ছেড়ে যাওয়া ফাঁকা ঘরে গজ চালতে চালতে বললেন, তা সত্যি।

আড়াই ঘরের লাফে ঘোড়াকে ছকের মাঝমধ্যিখানে প্রতিষ্ঠিত করে বরদাকান্ত বললেন, এই সত্যি কথাটাই বাড়ির সবাই জানল এক আমি ছাড়া। যদিও গাড়ি কেনার গোটা টাকাটা গেল আমার তহবিল থেকে। এই তো?

চপলা আত্মপক্ষ সমর্থনে বললেন, ব্যাবসার নামে ন্যাপা যখন টাকা চেয়েছিল তখনই তো আমি তোমায় বারণ করেছিলাম দাদা।

বরদাকান্ত আরও উত্তেজিত হলেন—বারণ করেছিলাম মানে? একটা ছেলে ব্যাবসার জন্য টাকা চাইলে আমি তাকে রিফিউজ করব? হোয়াটস রং উইথ স্টার্টিং আ বিজনেস? তোর যেটা বলা উচিত ছিল আমাকে তা হল ন্যাপা ব্যাবসা করছিল না। ব্যাবসার নামে বদমায়েশি করে বেড়াচ্ছিল। যেটা তুই জানতিস, কিন্তু সেটা আমাকে বলিসনি।

চপলাকান্ত টের পেলেন দাদার ভিতর একটা আগ্নেয়গিরি সবে জ্বালামুখ ভেদ করে অগ্নিবর্ষণে মাতব মাতব করছে। তাই কথা না বাড়িয়ে পর পর কিছু জটিল চালে খেলাটাকে অন্য বাঁকে নিয়ে ফেললেন। তবে এতে সহসা উদবিগ্ন হওয়ার মানুষ বরদাকান্ত নন। বর্তমান খেলাটিতে তিনি ওঁর প্রিয়তম দাবাড় রাউল কাপাব্লাঙ্কার উদ্ভাবিত ভেরিয়শনের সুযোগ দিলেন। তিনিও আর কথার মধ্যে না গিয়ে খেলাটিকে কবজা করার মতো চাল ঠুকতে লাগলেন।

অনেকক্ষণ নীরবে খেলা চলল দু-ভাইয়ে। চপলাকান্ত একটা বিশ্রী ভুল চাল দিয়ে ফেলেছিলেন, বরদাকান্ত খিঁচিয়ে উঠলেন, ওটা কী চাল হল চপলা। রাজাকে এক্সপোজ করে ওটা কোন ধ্যাষ্টামি। তা হলে তো আর ছটা চালে কাত হয়ে পড়বি।

চপলাকান্ত লজ্জায় জিভ কেটে দাদার ঘোড়া ফেরত করে নিজের নৌকা বাঁচালেন। তাতে রাজাকে পাহারা দেওয়া ক্যাসলটা রক্ষা পেল, খেলাটারও পরমায়ু বৃদ্ধি হল।

বরদাকান্ত নতুন এক শ্রেণির চাল ভাবতে ভাবতে বললেন, ন্যাপা বউ নিয়ে কী করবে?

-সে তো আমিও বুঝে পাচ্ছি না।

সুমিত্রার ওখানে তো ঘর হওয়ার নয়। ফ্ল্যাট তো কোথাও নিতেই হবে। তবে পাশের বাড়ি ওকে ছাড়তে হবে।

—সে তো একশো বার। তুমি কী বলো দাদা?

বরদাকান্ত একটা জটিল কিস্তির বন্দোবস্ত করতে করতে বললেন, দ্যাখ চপলা, ন্যাপার জন্য কিছু টাকা স্পেয়ার করতে আমায় আপত্তি নেই। হাজার হোক, আমার বাড়িতেই তো এতদিন বড়ো হয়েছে। কিন্তু এখন যেখানে গিয়ে ও দাঁড়িয়েছে সেই পরিস্থিতিতে ওর প্রতি কোনো সমর্থনই আমার নেই। টাকা যা দেওয়ার আমি দিয়ে দেব, বাট হি মাস্ট ভ্যানিস আউট অব সাইট। চোখের সামনে বায়োস্কোপের নায়িকা নিয়ে নেচে বেড়াবে, এ আমি সহ্য করব না।

এবার আস্তে আস্তে ফের মুখ খুললেন চপলাকান্ত—আমিও ঠিক এই কথাটাই ওকে বলেছি।

বরদাকান্তের দু-চোখের দুটো ভুরুই লাফিয়ে উঠল, ওকে বলেছি মানে। রাসকেলটার সঙ্গে তোর কথা হয়েছে?

—হ্যাঁ, জানতে গিয়েছিলাম কালকের ঘটনাটা কী ছিল।

–কী বলল আহাম্মকটা?

–বলল খুব ভুল করে ফেলেছে। দূরে কোথাও ফ্ল্যাট জোগাড় করতে পারেনি, তাই…

-বাঃ! বাঃ! অপূর্ব! একটা জলজ্যান্ত মেয়েমানুষ জোগাড় হয়ে গেল, কিন্তু একটা ঘর পেলেন না বাবু!

কিস্তির মুখে পড়ে চপলা ফের নীরব হয়ে গেলেন। ছকে ভাইয়ের করুণ দশা দেখে দাদা বললেন, তোরও নড়ার মতো ঘর দেখতে পাচ্ছিনে। রিজাইন কর আর ভিতরে গিয়ে বড়োঠাকুরকে বল দু-কাপ কফি বানাতে।

চপলাকান্ত একটা চাল দিলেন বটে, কিন্তু ফের এক কিস্তির মুখে পড়লেন অচিরে। বরদাকান্ত একটা সিগারেট ধরিয়ে আরামের সঙ্গে টান দিতে দিতে চোখ বন্ধ করে ফেললেন। মাত হওয়া এড়ানো যাচ্ছে না দেখে ফরাস ছেড়ে উঠে চপলাকান্ত ভিতরে গেলেন কফির অর্ডার দিতে।

আর ঠিক তক্ষুণি ঘরে ঢুকল ন্যাপা। বরদাকান্ত তখনও চোখ বুজে থ্রি ক্যাসলসের দম নিচ্ছিলেন, পায়ে একটা হাতের ছোঁয়া পেয়ে চোখ খুলে ন্যাপাকে দেখলেন। আর দেখামাত্র মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে প্রায় স্বগতোক্তির মতো বললেন, কী চাই?

ন্যাপা বলল, শুধু প্রণাম করতে এয়েচি আপনাকে।

নিষ্কম্প কণ্ঠে বরদাকান্ত জিজ্ঞেস করলেন, প্রণাম? কোন ফন্দিতে?

—বড়োমামা, আপনাকে প্রণাম করতে কি কারণ দরকার হয়?

—কারণ বলিনি। বলেছি ফন্দি।

ন্যাপা চুপ মেরে রইল। একটু পরে বরদাকান্ত বললেন, তুমি আসতে পারো।

ন্যাপা সেই আগের মতোই দাঁড়িয়ে রইল। অনিচ্ছা সত্ত্বেও বরদাকান্ত ওর দিকে একবারটি চেয়েই ভিতরে ভিতরে জ্বলে উঠলেন। সারাদেহে ছোকরার বিশ্রী কাপ্তেনির ছাপ। গিলে-করা ফিনফিনে আদ্দির পাঞ্জাবি, সঙ্গে চুনোট করা ধুতি। পাঞ্জাবিতে সোনার বোতাম, তার তলা থেকে ফুটে বেরুচ্ছে দামি জালি গেঞ্জি। ছোকরার আঙুলেও খান তিনেক আংটি। চোখে ক্রুকসের নীল শেডের চশমা। ছেলেটা যে বেকার কে বলবে! এর উপর সংসারে একটা বউ চাপিয়েছে। বরদাকান্ত ভিতরে ভিতরে প্রবল অস্বস্তি বোধ করতে লাগলেন। মুখে বললেন, এর পর কী করবে ঠিক করেছ কিছু?

ন্যাপা আমতা আমতা করে বললে, কালই ওই ফ্ল্যাট ছেড়ে উঠে যাচ্ছি আমরা। বরদাকান্ত শুধু একটা আওয়াজ করলেন, হুম! তারপর প্রশ্ন করলেন, কোথায় যাবে ভাবছ?

ন্যাপা কাঁপা কাঁপা গলায় বললে, এখনও ঠিক জানি না।

আর অমনি সারাদিনের চেপে চেপে রাখা রাগটা বারুদের মতো ফাটল—আহাম্মক! স্কাউন্ট্রেল। বিয়ে করে একটা মেয়েকে নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরবে। মামার মুখে আরও চুনকালি ঘষবে? কাল সকালে গিয়ে যেখানে পারো ঘর খুঁজে এসো। যা টাকা লাগে চপলাকে এসে জানিয়ে যেও। পরে একসময় নিয়ে যেও। আর এখন চোখের সামনে থেকে যাও।

তবু নড়ে না ন্যাপা। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বরদাকান্ত মুখ তুলে বললেন, নৃপেন তোমাকে আমি চলে যেতে বলেছি। তুমি শুনতে পাওনি?

ন্যাপা হঠাৎ ফরাসে বসে পড়ে বড়োমামার পা চেপে ধরল, মামা, আমি আপনার টাকা চাই না। শুধু এই ভুলটা ক্ষমা করুন।

মাথায় রক্ত চড়ে গেল বরদাকান্তর, টাকা চায় না মানে কী? একটা ফুটো কড়ি আয় নেই আর মুখে এত বড়ো কথা! তিনি লাফ দিয়ে ফরাস থেকে নেমে নিজের এক পার্টি খড়ম তুলে দমাদ্দম কয়েক ঘা বসালেন ন্যাপার পিঠে–বেরোও আমার সামনে থেকে, আহাম্মক কোথাকার।

এই একটি গর্জনই যথেষ্ট ছিল। বাড়ির চারধার থেকে সবাই ছুটে আসতে শুরু করল হলঘরের দিকে। আর প্রবল গর্জনের সঙ্গে বরদাকান্তের খড়মপেটাও চলছে ভাগনের পিঠে। ন্যাপা কেবল কাতরায় আর বলে, মামা আমি তোমায় অসম্মান করতে চাইনি মামা। তোমার টাকা নিতে এখন আমার লজ্জা করছে।

মারের চোটে ন্যাপা বাড়ির বাইরে ছুটছে আর তার পিছন পিছন খালি পায়ে বরদাকান্ত। তাঁর টাকা নিতে ন্যাপার দ্বিধা জেনে রাগে মাথা হারিয়ে বসেছেন বরদাকান্ত। বাড়ির বাইরে রাস্তায় নেমে ন্যাপা একমুহূর্ত ভাবনা দিচ্ছিল কোন মুখো হবে, ততক্ষণে বরদাকান্ত ফের এসে চড়াও হলেন ওর উপর। ফের দু-ঘা খড়ম-বাড়ি। গ্যাসবাতির অন্ধকার রাস্তায় একটু একটু করে জানালার আলো ঠিকরোতে লাগল। পড়শিরা নতুন নাটক দেখার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। আর জানলা খুলে বিস্ফারিত চোখে দেখছে নাটকের কুশীলবের একজন আজ পাড়ার সবচেয়ে মান্যগণ্য মানুষ বরদাকান্ত চট্টোপাধ্যায়মশাই। সবাই যাঁকে একটাই নামে চেনে, ডাকে—বড়োবাবু।

ন্যাপা বেগতিক দেখে রাস্তার মুখে ওর সদ্য কেনা হাম্বার হকের মধ্যে গিয়ে ঢুকল। গাড়িটা দেখে আরেকবার রাগ চড়ল বরদাকান্তের। তিনি ছুটে গিয়ে গাড়ির বনেটে কয়েক ঘা খড়মের বাড়ি মেরে ভিতরে সিটে বসে কাঁপতে থাকা ন্যাপাকে বললেন, এই তোমার লোহার ব্যবসায়ে নামা? এই তোমার নিজের পায়ে দাঁড়ানো। বেয়াদপ কোথাকার।

সহসা পায়ে একটা বিদ্যুতের স্পর্শ অনুভব করলেন বরদাকান্ত। নীচে চোখ নামিয়ে দেখেন ওর পায়ে হাত ছুঁইয়ে বসে এক নববধূ। হঠাৎ হাতের মুঠি আলগা হয়ে খড়মটা পড়ে গেল বরদাকান্তর। তিনি একটু পিছিয়ে এসে বললেন, তু…তু…তুমি কে?

পরমাসুন্দরী মুখখানি তুলে মহিলা বললে, উনি আমার স্বামী। আপনার পায়ে পড়ি। বড়োমামা, ওকে ক্ষমা করে দিন। আমরা কাল ভোরে এখান থেকে চলে যাব।

মণিবালা সেভাবেই গাড়ির পাশে উবু হয়ে বসে। গাড়ির মধ্যে বসে কাঁদছে ন্যাপা। বরদাকান্তর মাথার মধ্যে সব কিছু তালগোল পাকিয়ে গেল। ওঁর কথা বন্ধ হল, হাত দুটো কাঁপা শুরু হল, প্রেসার বাড়লে যেমনটি হয় বরাবর। কোনো মতে ‘এক্সকিউজ মি!’ ‘আই অ্যাম সরি।’ ইত্যাদি বিড়বিড় করে বলতে বলতে বাড়ির দিকে হেঁটে গেলেন তিনি।

সিঁড়ি দিয়ে উঠতে যেতে মাথাটা চক্কর খেয়ে গেল। হয়তো পড়েই যেতেন, ঠিকসময় দু ধার থেকে ওঁকে ধরে নিলেন চপলাকান্ত আর বড়োঠাকুর। দাদার মাথাটা নিজের কাঁধে শোয়াতে শোয়াতে চপলকান্ত বললেন, কী যে করো না তুমি দাদা।

৪.

পরদিন সকালে বড়োমামাকে প্রণাম করতে গেল ন্যাপা। দেখল হলঘরের ফরাসে টানটান হয়ে শোয়া বড়োমামা। কাল রাতে প্রেসারে কোল্যাপস করেছিলেন মামা। বড়োঠাকুর বলছিল, বড়ো ফাঁড়া কাটল তোমার মামার, ন্যাপাদা।

সামন্ত ডাক্তার এসে ঘুমের ওষুধ দিয়ে গেছে বড়োমামাকে। ন্যাপা মামার পদধূলি মাথায় নিয়ে বাইরে এসে ওর হাম্বার হকের স্টিয়ারিঙে বসল। পাশের বাকেট সিটে বসে অঝোরে কেঁদে যাচ্ছে মণিবালা। স্টিয়ারিঙে বসে ন্যাপা জিজ্ঞেস করল, কিছু ভাবলে মণি? কোথায় যাব?

মণিবালা কোনো উত্তর করল না। ন্যাপা গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে রওনা হল বুঝি দিকশূন্যপুরের দিকেই। গাড়ি চলছে তো চলছে। ন্যাপ ফের জিজ্ঞেস করল, মার কাছে যাব? মা কিন্তু যেতেই বলেছে। বাড়ি ছোটো, থাকার একটু অসুবিধে হবে, এই যা।

প্রথমে মাথা ঝাঁকিয়ে, তারপর স্পষ্ট করে মুখেই বলল মণিবালা-না।

কলকাতায় খামখেয়ালি করে গাড়ি চালালে গাড়ি একসময় পৌঁছে যায় গঙ্গার ধারেই। পাড়ের কাছে গাড়ি ভিড়িয়ে স্টেট এক্সপ্রেসের কৌটো খুলে একটা সিগারেট বার করে ধরাল ন্যাপা। মণিবালাই এই সিগারেটটা ওকে কিনে দিয়েছে ক-দিন আগে। কৌটোটা পেয়ে ন্যাপা বেজায় খুশিতে বলেছিল, এটা বড়োমামা খায়। দারুণ সিগারেট। আমি মাঝে মাঝে দু-চারটে ঝাড়ি ওখান থেকে।

এত মনের দুঃখেও সিগারেটটা খেতে ন্যাপার খারাপ লাগছিল না। ও সিগারেট টানতে টানতে আপন মনেই বলল, তা হলে তোমার মা-র কাছেই যাই চলো। অন্তত দিনকয়েকের জন্য। তারপর দেখা যাবে।

মণিবালা নিরাপদ কণ্ঠে বলল, না। ওখানে যাওয়া নেই।

-কেন?

–মা তোমাকে থাকতে দেবেন না।

—তাঁর জামাই জেনেও?

মণিবালা ফোঁস করে উঠল, জামাই! জামাইয়ের মুখে ঝাঁটা। বউরাখার মুরোদ নেই। মামার টাকায় পকেট গরম। তোমার লজ্জা করে না?

ন্যাপা কোনো মতে নিজেকে সংযত রাখল। বলল, এসব কথায় সমস্যা মিটবে না মণি। অন্তত সাতদিনের জন্য কোথায় থাকা যায় বলো। তেমন মনে করলে আমার এই আংটিগুলো বেচে ক-দিন হোটেলে ওঠা যায়। তুমি যেমন বলো।

কাল সন্ধ্যে থেকে একটু আগে অবধি সমানে কেঁদে এইমাত্র মণিবালার চোখ শুকিয়ে গেছে। চোখ দুটো বেজায় ফোলা আর লাল, কিন্তু হঠাৎই একদম নিরস্তু। ও ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে একটা পাফ বার করে চোখের কোণে, গালে, থুতনিতে, কপালে বোলাতে বোলাতে বলল মুরারির ওখানে।

‘মুরারির ওখানে!’ শব্দ দুটো বিশাল দুই মেঘখন্ডের মতো দিনটাকে অন্ধকার করে দিল ন্যাপার। ওর মনে হল গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে দেয় নদীর দিকে। স্টিয়ারিঙে মাথা ঠোকারও প্রচন্ড বাসনা হল। কিন্তু বাস্তবে এর কিছুই করল না ন্যাপা। ও শুধু গাড়ি স্টার্ট করে গুটিগুটি রওনা দিল শহরের উত্তর পল্লির দিকে। বউকে বলল, মুরারির বাগানবাড়ি আমি চিনিনে। রাস্তা বলে যাও।

কম অনুরোধ-উপরোধ করেনি মণিবালা। বলেছে, আমাদের বার করে দেওয়ার লোক মুরারি নয়। তুমি থাকো আমার সঙ্গে। আমায় বায়োস্কোপ করতে দাও, এ ঝড় কেটে যাবে।

মুরারি বললে, শোনো নৃপেন, এ বাড়ি আমার। কোনো শালাও তোমায় এখানে থেকে হঠাতে পারবে না। তুমি থাকো এখানে যদ্দিন খুশি মণিমালাকে নিয়ে। এ তোমাদের সুখের সংসার হবে। আমি মাঝে মাঝে আসব, তোমাদের সুবিধে-অসুবিধে দেখব, তোমার সঙ্গে দু পাত্তর না হয় খাবও। তুমি কিন্তু ভায়া যেও না। কোথাও যেও না। আমার বাগান ফাঁকা হয়ে যাবে।

চোখ ফেটে জল আসছিল ন্যাপার। অশেষ চেষ্টায় তা সামলে মুরারিকে বলল, না। আপনার বাগান ফাঁকা হবে না। আপনার মণিমালা রইল। আমি যাই।

বেরিয়ে এসে গাড়িতে স্টার্ট দিতেই কান্নাটা ঠিকরে বেরিয়ে এল। গাড়ি নিয়ে কোথায় যাবে জানে না, তবু গাড়ি চলছে। মণির দেওয়া পান্নার আংটিটা একবার দেখল। একবার ভাবল ছুড়ে ফেলে দেবে, পরমুহূর্তে মনে হল—না থাক, এই একটু স্মৃতিই তো। যত স্বল্পমেয়াদের জন্যই হোক, মণিবালার স্বামীই তো।

একটা মোড়ে এসে আটকে পড়ল গাড়ি। মণিবালার দেওয়া সিগারেটের ফের একটা ধারাল ন্যাপা। ভাবল, স্বামী। দুর দুর নিকুচি করেছে স্বামী। হঠাৎ করে নায়িকার প্রথম স্বামী থেকে পঞ্চম বাবুতে নেমে এসেছে ও।

জ্যাম কাটতে ন্যাপ স্পিড ওঠাল মল্লিকবাজারের দিকে যাবে বলে। গাড়িটা বেচতে পারলে মামার টাকার অন্তত কিছুটা শোধ হয়। মা-র ওখানে চিলেকোঠার ঘরটা যেন ইশারায় ‘আয়! আয় করে ডাকছে। মল্লিকবাজারে গাড়িটা ছেড়ে ন্যাপা স্টপে গিয়ে দাঁড়াল ট্রাম ধরবে বলে। আর ভীষণ একলা একলা লাগল নিজেকে। মাত্র ক-দিনের অভ্যেস, তাতেই কী একটা ঘটে গেছে যেন কোথায়।

অধ্যায় ১ / ৯৯

সকল অধ্যায়

১. মণিবালার প্রথম ও পঞ্চম বাবু – শঙ্করলাল ভট্টাচার্য
২. জনৈক কাপুরুষের কাহিনী – প্রেমেন্দ্র মিত্র
৩. নুরবানু – অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত
৪. আমি একটা মানুষ নই – আশাপূর্ণা দেবী
৫. ঠগের ঘর – সুবোধ ঘোষ
৬. হরপার্বতী সংবাদ – প্রবোধকুমার সান্যাল
৭. চীনেমাটি – সন্তোষকুমার ঘোষ
৮. বালির ঝড় – সমরেশ বসু
৯. আত্মজা – বিমল কর
১০. সন্ধ্যেবেলা রক্তপাত – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
১১. কীট – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
১২. আর একবার – প্রফুল্ল রায়
১৩. রাগ অনুরাগ – শক্তিপদ রাজগুরু
১৪. পূর্বক্ষণ – ননী ভৌমিক
১৫. রাজার টুপি – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়
১৬. ফাঁদ – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ
১৭. জারিনার প্রেম – তারাপদ রায়
১৮. বলিছে সোনার ঘড়ি – বরেন গঙ্গোপাধ্যায়
১৯. আঁধার ঘর – সঙ্কর্ষণ রায়
২০. টেককা টেককি – কণা বসুমিত্র
২১. মিসেস মেলনির গল্প – সুকুমার ভট্টাচার্য
২২. অঙ্কুর – ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়
২৩. ছায়া গোধূলি – উত্তম ঘোষ
২৪. রোদ বৃষ্টি কুয়াশা – বামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়
২৫. দাম্পত্য – অনিশা দত্ত
২৬. বাতাসের রং নেই – কল্যাণ মৈত্র
২৭. বালির ঘর – দিলীপকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়
২৮. শ্বশুরবাড়ি নয়— ক্লাব হাউস – বৈদ্যনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়
২৯. হেনস্থা – তপনকুমার দাস
৩০. লজ্জা – রবিন দে
৩১. দাম্পত্য কলহ ও নেকলেস – শ্রীজয়দেব রায়
৩২. দাম্পত্য স্মৃতি – লক্ষ্মীদেবী চক্রবর্তী
৩৩. সংঘাত প্রশান্ত – বর্মন রায়
৩৪. শেষের সে বিচার – ডাঃ অরুণকুমার দত্ত
৩৫. আলট্রা মডার্ণ – অসীমানন্দ মহারাজ
৩৬. তুমি আমি দুজনেই – আবদুল জব্বার
৩৭. লোকটা – আশিস সান্যাল
৩৮. ক্ষত ও নিরাময় – তৃণাঞ্জন গঙ্গোপাধ্যায়
৩৯. নতুন বইয়ের গন্ধ – শুভমানস ঘোষ
৪০. ভুবন চৌধুরী – অলোককৃষ্ণ চক্রবর্তী
৪১. পদ্মাকাঁটা – গৌর মিত্র
৪২. মালাবৌদি – ডাঃ মহাদেব বন্দ্যোপাধ্যায়
৪৩. ধূসর কণ্ঠস্বর – শান্তিরঞ্জন চট্টোপাধ্যায়
৪৪. দাম্পত্য কলহকথা – স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায়
৪৫. বাদশা-বেগম ঝমঝমাঝম – সৌমিত্ৰশংকর দাশগুপ্ত
৪৬. দাম্পত্য – সুব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়
৪৭. বন্ধ্যা – তমাল লাহা
৪৮. অণুবীক্ষণ – কুণালকিশোর ঘোষ
৪৯. শিউলি বনে গন্ধরাজ – গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়
৫০. বাঁশফুল – শিবতোষ ঘোষ
৫১. ছোটলোক – শচীন দাশ
৫২. পঞ্চম রিপু – শৈলেন রায়
৫৩. শুধু সমুদ্রের চিত্রনাট্য – অরূপরতন ঘোষ
৫৪. আশ্রয় – নীলাঞ্জন চট্টোপাধ্যায়
৫৫. কুমারী মাটি – পুলককুমার বন্দ্যোপাধ্যায়
৫৬. দাম্পত্য কলহের অন্তরালে – বরুণ মজুমদার
৫৭. জলপরী, সুবিমল ও একটি ধর্ষণের গল্প – জগন্নাথ প্রামাণিক
৫৮. পরকীয়া – প্রণব সেন
৫৯. সম্পর্ক – চিন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়
৬০. কালার টি.ভি. – সুদীপ্ত বন্দ্যোপাধ্যায়
৬১. বন্ধন – ভাগ্যধর হাজারী
৬২. পরকীয়া প্রেম – উজ্জ্বল কুমার দাস
৬৩. অনিকেত – সঞ্জয় ব্রহ্ম
৬৪. ভূমিকা – পঞ্চানন মালাকর
৬৫. বিষাক্ত মদ – পরেশ সরকার
৬৬. দূরের গাড়ি – অগ্নি বসু
৬৭. ধারাবাহিক – মৃণাল বসুচৌধুরী
৬৮. বুমেরাং – তপন বন্দ্যোপাধ্যায়
৬৯. বকম বকম – প্রদীপ আচার্য
৭০. কুয়োতলার কাব্য – অশোককুমার কুণ্ডু
৭১. ধরিত্রী – জীবন সরকার
৭২. পৃথিবী শস্যশালিনী – শৈবাল মিত্র
৭৩. রবিবার ছুটির দিন – আফসার আমেদ (আফসার আহমেদ)
৭৪. চিতা – চণ্ডী মণ্ডল
৭৫. মেঘাবৃত চাঁদ – আবু রুশদ
৭৬. প্রতিষেধক – আবু ইসহাক
৭৭. ফাঁদ – আবুল খায়ের মুসলেহউদ্দিন
৭৮. পরী – আলাউদ্দিন আল আজাদ
৭৯. প্রেমের গপ্পো – আখতারুজ্জামান ইলিয়াস
৮০. পানকৌড়ির রক্ত – আল মাহমুদ
৮১. অস্থির অশ্বক্ষুর – আবদুল মান্নান সৈয়দ
৮২. ফুলের বাগানে সাপ – ইমদাদুল হক মিলন
৮৩. আজীবন দিন-রাত্রি – জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত
৮৪. পথ, হে পথ – নাসরীন জাহান
৮৫. ধূসর – বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর
৮৬. বেলী – বুলবুল চৌধুরী
৮৭. অস্পষ্ট মুখ – মঈনুল আহসান সাবের
৮৮. যৌথ একাকিত্ব – মঞ্জু সরকার
৮৯. লা পেরুজের সূর্যাস্ত – রাবেয়া খাতুন
৯০. হে আনন্দ – রাহাত খান
৯১. খাঁচার ভিতর সুচিন পাখি কমনে বাঁইচে রয় – শওকত আলী
৯২. অষুধ – শহীদ আখন্দ
৯৩. মানব-মানবী – শিহাব সরকার
৯৪. মতিনউদ্দিনের প্রেম – সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ
৯৫. গন্তব্য, অশোক – সৈয়দ শামসুল হক
৯৬. প্রহসনের মতো – সাইয়িদ আতীকুল্লাহ
৯৭. দুর্নীতি – সেলিনা হোসেন
৯৮. জননী – হাসান আজিজুল হক
৯৯. নিশিকাব্য – হুমায়ূন আহমেদ

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন