রামধনু – ১

হুমায়ুন কবীর

অফিস থেকে আজ একটু আগেভাগেই বাড়ি ফিরেছে সুমন্ত রায়, ভেবেছিল অনেকদিন মেয়েটাকে পড়ানো হয়নি, ওর পড়াশোনা নিয়ে বসবে একটু। এখনকার পড়ার প্যাটার্নে অনেক পরিবর্তন এলেও মেয়েটা পড়াশোনা করছে কিনা সেটা বুঝতে অসুবিধা হবে না সুমন্তর, হাজার হোক এক সময়ে ডাকসাইটে ছাত্র ছিল সে। মাধ্যমিক আর উচ্চ মাধ্যমিকে স্টার পেয়ে ফিজ়িক্স অনার্স নিয়ে প্রেসিডেন্সিতে পড়েছে। অনার্স পাশ করেই ডব্লুবিসিএস দিয়ে ঢুকে গেল চাকরিতে, ট্রেনিং শেষ করেই বিডিও রেজিনগর। বছর দুই রেজিনগরে কাটিয়ে বহরমপুরে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট, বিডিও বেলডাঙা প্রায় বছর তিনেক, আবার বহরমপুরে আরটিও প্রায় চার বছর। তার পরেই এসডিও কল্যাণী বছর তিন, আর ওখান থেকেই এক নেতার নেকনজরে পড়ায় সরাসরি জয়েন্ট সেক্রেটারি ট্রান্সপোর্ট ডিপার্টমেন্টে, তা-ও বছর দেড়েক। বেশ জমিয়ে বসেছে সুমন্ত, অফিসও বেশ জমজমাট, সকলেই বেশ মান্যগণ্য করে, তাই বেশ কর্তৃত্ব নিয়ে কাজ করে উপরওয়ালাদেরও নেকনজরে। চাকরির জায়গায় বেশ সন্তুষ্টি এলেও, বাড়িতে তেমন শান্তি নেই। তার কারণ আরতি, ওর সতেরো বছরের বিয়ে করা বউ।

অফিস থেকে সন্ধে সাতটায় আজ বেশ ফুরফুরে মেজাজেই বাড়ি ফিরছিল সুমন্ত। মেয়েটার প্রতি বেশ একটা দায়িত্ববোধও মনে পড়ছিল পরিবহন ভবন থেকে সেডানের নিশ্চিন্ত নরম আর ঠান্ডার আমেজে ফেরার সময়, কিন্তু বাড়ি পৌঁছেই বিগড়ে গেল সব প্ল্যান। আরতি ওকে দেখেই চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করল, “এই যে বাড়ি ফিরেছেন শিবঠাকুর!”

নানা তির্যক মন্তব্যে কান ঝালাপালা হয়ে ওঠে সুমন্তর, কোনওরকমে জামাকাপড় খুলে টয়লেটে ঢুকে পড়ে খানিকটা নিশ্চিন্ত হয়, অনেকটা সময় নিয়ে স্নান করে আরতির মেজাজ শান্ত হওয়ার অপেক্ষায়, অবশ্য টুকরো টুকরো চিৎকার বাথরুমের ভিতর থেকেই শুনতে পায় সে।

ট্র্যাক প্যান্টস আর টি-শার্ট পরে বাথরুম থেকে বেরিয়েই দ্বিতীয় দফায় এ কে ফর্টি সেভেনের মুখে পড়ে সুমন্ত। “বাথরুমে কি ঘুমিয়ে পড়েছিলে? স্বপ্ন দেখছিলে ক্যাটরিনার? বাড়ির কাজকর্মগুলো কে দেখবে শুনি? সংসার কি আমার একার?”

এসব কথার উত্তর হয় না, মাথাটা চিড়িক চিড়িক করলেও প্রতিবাদ করতে নেই এসব কথার, তাহলে পরিবেশ আরও ঘেঁটে যাবে। সুমন্ত তাই চুপ করে বোঝার চেষ্টা করে আসলে আরতির ক্ষোভের কারণটা কী? নাহ্, প্রায় মিনিট দুই অপেক্ষা করেও বুঝতে পারে না সুমন্ত। আস্তে করে ঢুকে যায় সৃজিতার কামরায়। সৃজিতা হইহই করে চেয়ার ছেড়ে উঠে গলা জড়িয়ে ধরে সুমন্তর, ওর পিঠ কয়েকবার চাপড়ে দেয় সুমন্ত, সৃজিতার হাত ছাড়িয়ে চোখ নাচিয়ে জিজ্ঞাসা করে, “ব্যাপারটা কী রে?”

“গত রোববার বড়মাসির বাড়ি গিয়েছিলাম না আমরা, ফিরে এসে কানের টপ দুটো মা ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারে রেখেছিল, আজ মনে পড়তে আলমারিতে তুলবে বলে দুপুর থেকে খুঁজছে, পাচ্ছে না। তার উপর আজ আবার ডাইনিং টেবিলে রাখা ক্রিস্টালের ফুলদানিটা কাজের মাসি বেবি পরিষ্কার করতে গিয়ে ভেঙে ফেলেছে,” সৃজিতা আস্তে আস্তে চোখ-মুখ ঘুরিয়ে বলে বাবাকে।

“এই সর্বনাশ, ওটা তো আমাকে কল্যাণী থেকে ফেয়ারওয়েলে দিয়েছিল, বেশ দামি ফ্লাওয়ার ভাস,” সুমন্ত চাপা গলায় বলে।

“কী আর করবে বলো? ওটা বেবি মাসি নামিয়ে রেখেছিল সিঙ্কের নীচে, পরে ভুলে গিয়ে পা দিয়ে উলটে দেয়। একটা কোণা ভেঙেছিল শুধু, মা বলল, ফেলে দে, কাচের ভাঙা জিনিস বাড়িতে রাখতে নেই, এমনিতেই অশান্তির শেষ নেই!”

“অ্যাই চুপ কর, কানে গেলে দুপুরের দুঃখ আবার উথলে উঠবে, ঝাড়টা আমার উপরেই পড়বে আবার!” সুমন্ত চুপ করিয়ে দেয় মেয়েকে।

বাবা আর মেয়ে চুপ করলে কী হবে, আরতি চুপ করেনি, ধাক্কা দিয়ে দরজা খুলে ঢুকল সৃজিতার ঘরে, “এখানে বসে ফুসুর ফুসুর করছ আর বাড়ির জিনিসপত্র যে সব চুরি হয়ে যাচ্ছে, তার খোঁজ রাখো?”

এটা ডাইরেক্ট অ্যাটাক, এর রিঅ্যাকশন দিতে হবে, নইলে আরও তুলকালাম বাধবে, তাই মিনমিন করে জিজ্ঞাসা করে, “আবার কী চুরি হল?”

“তুমি জানো না? সৃজি বলেনি?” চোখ-মুখ আরও ভয়ংকর দেখায় আরতির।

“ওহ্, কানের দুল? ও কোথায় রেখেছ দেখো ঠিক পেয়ে যাবে পরে,” শান্তভাবে বলে সুমন্ত।

“হ্যাঁ, ওটা আমার আলমারিতে গুছিয়ে রেখে দিয়েছে তোমার পেয়ারের কাজের মেয়ে বেবি!” মুখঝামটা দেয় আরতি।

এটা বাউন্সার, ছাড়বে নাকি হুক করবে ভাবতে-ভাবতেই মাথায় এল মেয়ের সামনে এটা বলেছে, ডাক করলে মেয়ে অন্যরকম ভাবতে পারে, তাই ঠান্ডা গলায় বলে, “বেবিকে আয়া সেন্টার থেকে খুঁজে-খুঁজে তুমিই লাগিয়েছ, তা আমার প্রিয়-অপ্রিয় হওয়ার প্রশ্ন আসছে কোত্থেকে?”

সুমন্ত হালকা হুক করছে দেখে আরতি একটু থতমত খায়। সামলে নিয়ে বলে, “পেয়ারের নয় তো ওর নামে এফআইআর করে তা প্রমাণ কর।”

“প্রয়োজন হলে এফআইআর করব। তবে তার আগে তোমাকে শিয়োর হতে হবে ওটা তোমার কোনও গোপন কুঠুরিতে নেই!”

“ওহ্‌! আমার কথায় বিশ্বাস হচ্ছে না? আমি কি পাগল?” আরতি চোখ পাকিয়ে আরও কিছু বলার উপক্রম করতেই সুমন্ত সুড়ুৎ করে দরজা দিয়ে বেরিয়ে তিন-চার লাফে ছাদে যাওয়ার সিঁড়ির হাফ ল্যান্ডিং-এ চলে আসে। হাতে সিগারেট আর ম্যাচবক্স ডাইনিং টেবিল থেকে খুব দ্রুত তুলে নিয়েছে। ওফ্‌! বাকি সিঁড়ি আস্তে-আস্তে হেঁটে উঠে আসে ছাদে। এই এক বিরাট স্বস্তি।

মিন্টো পার্কের এই হাউসিং মধ্য কলকাতার আকাশ দেখার জন্য আদর্শ। সামনেই ভিক্টোরিয়া, আলোতে মোহময় বিদ্যাসাগর সেতু আর ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া গাছে রহস্যময় কলকাতার ময়দান। অক্টোবরের শেষ, বাতাসে শীতল ছোঁয়া, গঙ্গার বাতাসে মুছে যায় আরতির আছড়ে পড়া চিৎকার। সুমন্ত নিঃশব্দে ঘুরে নেয় ছাদে। কয়েক পাক পরেই স্বস্তির সিগারেট ধরায়, প্যারাপেটের উপর হেলান দিয়ে ধোঁয়া উড়িয়ে দেয় আকাশের দিকে। সুমন্ত সাধারণত সিগারেট খায় না। খুব টেনশনে, কিংবা আয়েস করে খায় মাঝেমাঝে। ধোঁয়া ছাড়তে-ছাড়তেই লক্ষ করে আকাশ ঘোলাটে, অল্প কয়েকটা তারা চিকমিক করে জ্বলছে। তখনই মনে পড়ে হুগলি ধনেখালির কথা। ওখানেই ওদের আদি বাড়ি, বছর আট পর্যন্ত ওর শৈশব কেটেছে ওখানেই। ছোটবেলায় দেখা আকাশের কথা মনে পড়ে যায়। ঠাকুরমার কোলে বসে আকাশ আর ফুলের মতো ফুটে থাকা অজস্র তারাদের গল্প শুনত সুমন্ত। ওই ঝকঝকে আকাশের স্মৃতি মনের মধ্যে কোথাও যেন গেঁথে আছে। আকাশ ছাড়াও দেখত অজস্র জোনাকি, সারাবছরই সন্ধেবেলায়, পড়ার ফাঁকে-ফাঁকে, হালকা মুঠোর মধ্যে আলোর জ্বলে ওঠা, আবার সঙ্গে-সঙ্গে নিভে যাওয়া। শসার মাচার কাছে বর্ষাকালে অজস্র জোনাকি জ্বলত, হ্যারিকেনের আলোর কাছেও চলে আসত দল বেঁধে। খাতা গোল করে মুড়ে, মাদুরের উপর রেখে জোনাকি ফেলে দিত কুয়োয় ফেলার মতো করে। জোনাকির কথা মনে পড়তেই ভাবতে থাকে শেষ কবে ও জোনাকি দেখেছে! নাহ্, মনে পড়ছে না! তবে বেশ কয়েক বছর ও জোনাকি দেখেনি।

আমার একলা আকাশ থমকে গেছে…

তোমার কাছে এসে, দিনগুলো সব রং চিনেছে

তোমায় ভালবেসে…

এখন আবার কার ফোন এল? পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করে স্ক্রিনের দিকে তাকায়। মৈনাক। হঠাৎ মৈনাক, কয়েক মাস পর? ফোনটা রিসিভ করে বলে, “হ্যালো মৈনাক, বল।”

“হ্যাঁ, হ্যালো। নভেম্বরের নয় থেকে বারো নোট করে রাখ, সুন্দরবন যাব লঞ্চে করে। সঙ্গে ওনলি গার্লফ্রেন্ড। নো বউ, নো বাচ্চা-কাচ্চা। অ্যাডাল্ট রক পার্টি রোজ সন্ধ্যায়। তোকে হিসেবে ধরেছি, মাত্র পাঁচ-ছ’টা কাপল। খুব ক্লোজ় ক’জন আর সিক্রেট, বুঝলি কিছু? আমি অর্গ্যানাইজ় করছি,” মৈনাক রগুড়ে গলায় বলে।

“আচ্ছা তুই বল, এই সময় সুন্দরবনের সন্ধ্যায় জোনাকি পাওয়া যাবে?” মুখ ফসকে জোনাকির কথাটা বেরিয়ে গেল সুমন্তর।

“আরে সুন্দরবনে জোনাকি থেকে মারমেড সবই পাবি গুরু। এই চারটে দিনের ধামাকার সুযোগ বারবার পাবি না। চল তাহলে ছুটি নে, আর কোন গার্লফ্রেন্ড সঙ্গে নিবি ঠিক করে নে। কালকের মধ্যে কনফার্ম করবি। গার্লফ্রেন্ডের নাম কেউ জানতে চাইবে না, কাজ চালাবার জন্য টেম্পোরারিলি চম্পা, পুষ্পা, রোজ়ি, শেফালি যা হোক একটা নাম দিয়ে দিস,” ফিচেল হাসি হেসে বলে, “সবাই রাজি থাকলে রোটেশন পদ্ধতিও চলতে পারে। ব্যপারটা মনে-মনে ভেবে নে আর মশগুল থাক। কালকে কনফার্ম করিস কিন্তু। এবার ছাড়ছি, বাই, টেক কেয়ার,” দুড়দাড় করে কথা বলা ওর স্বভাব। ছ’মাসে-ন’মাসে গার্লফ্রেন্ড বদল করে। তবে প্রাণবন্ত ছেলে এই মৈনাক।

গার্লফ্রেন্ড! কোন গার্লফ্রেন্ড নিবি ঠিক করে নে… বাপ রে, যেন ওর মতো পাঁচ-সাতটা সবসময় থাকে আর কি! আচ্ছা, নাজ়িয়া সুলতানাকে কি ওর গার্লফ্রেন্ড বলা যাবে? নাহ্, একেবারেই নয়। ভাল বন্ধু আর প্রেমিকা বরং বলা যেতে পারে। একই ডিপার্টমেন্টে ওর নীচের র‌্যাঙ্কে, অ্যাসিস্টেন্ট সেক্রেটারি। ওর উপর ভরসা করতে করতেই ভালবাসা-বাসি, এই যা। একবার দিল্লিতে ট্রান্সপোর্ট ডিপার্টমেন্টের সেমিনার পড়ল। ওখানে সুমন্তর যাওয়াটা কনফার্ম ছিলই, নাজ়িয়ার নামটা অনেকটা প্রভাব খাটিয়ে সুমন্তই অ্যাপ্রুভ করিয়ে নিয়েছিল। বঙ্গভবনে পাশাপাশি দুটো রুম, তিনটে রাত্রি দারুণ কেটেছিল। সুমন্তর সব সময় মনে হয়, প্রেমের ব্যপারে নাজ়িয়ার উৎসাহই বেশি। দিল্লির ওই ঘটনার পর বার দুয়েক রায়চক আর একবার বোলপুরে একসঙ্গে থেকেছে। অফিসে ওরা খুব কাছাকাছি আসে না, তবে হোয়াট্‌সঅ্যাপে মনের ভাব আদানপ্রদান হয় নিয়মিত। অফিসে প্রচুর স্টাফ। কোনওরকম গন্ধ পেলেই ঢি-ঢি পড়ে যেত একেবারে, আর ওর কানে ঘুরপথে আসতই কথাটা। বছরখানেকের এই জমে ওঠা প্রেম ফাঁস হলে অবশ্য ওরই বিপদ।

নাজ়িয়া অবশ্য ঝাড়া হাত-পা। একবার বিয়ে হয়েছিল পার্ক সার্কাসের এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে। তবে ওর সঙ্গে বছর চারেক ঘর করে নাজ়িয়া একেবারে হাঁফিয়ে উঠেছিল। ওর হাজ়ব্যান্ড শেষের ছ’মাস কথায়-কথায় হাত তুলত ওর গায়ে। শেষদিন অবশ্য নাজ়িয়াই শাড়ি টাঙাবার হ্যাঙার দিয়ে প্রচুর পিটিয়েছিল ওর হাজ়ব্যান্ডকে। এর পরই ও হাজ়ব্যান্ডের ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসে বাবা-মায়ের ফ্ল্যাটে। তারপর থেকে ওর বাবা-মায়ের সঙ্গেই থাকে। ছোটবোনের বিয়ে দেওয়ার পর ওর বাবা-মা-ও ওর উপরই বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। এসব পর্ব ওর মিটে গেছে বছর দুই আগেই, মানে সুমন্তর ট্রান্সপোর্ট ডিপার্টমেন্টে জয়েন করার মাস ছয়েক আগেই। এইসব কথা নাজ়িয়াই ওকে জানিয়েছে। তবে হাজ়ব্যান্ডের সঙ্গে ডিভোর্স হয়েছে কিনা তা নাজ়িয়া বলেনি, তাই সুমন্তও আর জিজ্ঞাসা করেনি। ওদের মধ্যে ভাল আন্ডারস্ট্যান্ডিং আছে, অফিসের কাজে দু’জনেই দু’জনের অ্যান্টি, যাতে অফিসের লোকেরা বুঝতে না পারে। ওদের অফিসে যা কিছু প্রেম সবই হোয়াট্সঅ্যাপে, ভুলেও এসএমএস নয়, সুমন্ত সাবধান করে দিয়েছে নাজ়িয়াকে বারবার। পুলিশ চাইলে বা ডিপার্টমেন্টের উপরমহল চাইলেই ঘোটালা ঘেঁটে ঘোল বানিয়ে দেবে একেবারে। মজা হল হোয়াট্সঅ্যাপের রেকর্ড থাকে না, অফিস থেকে বেরোবার সময় রুটিন করে মুছে দিলেই হল।

এটিআই-তে ট্রেনিং-এর সময় এক সিনিয়র ডব্লুবিসিএস অফিসার বলেছিলেন, “এই চাকরিতে ইমোশনটা কন্ট্রোল করতে হবে, আর অন্যায় যা কিছু ‘শতং বদ মা লিখ’, ভুল করেও কোথাও রেকর্ড রাখবে না।”

তাই সাবধানী সুমন্ত। নাজ়িয়া উৎসাহ ভরে অনেক কিছু লিখলেও সুমন্ত ফাঁপরে পড়ার মতো বেফাঁস কথা কখনও লেখে না। নাজ়িয়া ওদের প্রেমের ব্যাপারটা কাউকে ফাঁস করেছে বলে মনে হয় না। গত ইদে নেমন্তন্ন করল হোয়াট্সঅ্যাপে, দুপুরবেলায়। ইদে ওদের রিপন স্ট্রিটের ফ্ল্যাটে গেল ট্যাক্সি করে, গাড়ির ড্রাইভার আর গার্ডকে এড়াতে। বিরিয়ানি খেতে বসল ডাইনিং টেবিলে, নাজ়িয়া আর ওর মা-বাবা, চারজন একসঙ্গে। ওর মায়ের সুমন্তর প্রতি প্রাথমিক আগ্রহ ছিল একেবারে জামাই আদরের মতো। খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে সব জিজ্ঞাসা করছিল আর জোর করে আরও বিরিয়ানি আর কাবাব খেতে একরকম বাধ্যই করছিল। একসময় যখন জানল সুমন্ত বিবাহিত এবং বছর পনেরোর মেয়ে আছে, তখন দৃষ্টিকটুভাবে উৎসাহে যেন ঠান্ডা জল ঢালা হয়ে গেল। তাই অত ভাল বিরিয়ানি খেয়েও মনে-মনে অপরাধী হয়েই সুমন্ত ফিরে এল নিজের ফ্ল্যাটে। নাজ়িয়ার চোখ এড়ায়নি ব্যপারটা। পরের দিন অফিসে এসেই মেসেজ পেল, “সরি, মা হয়তো ভুল করে ভেবে বসেছে তুমি আমার প্রেমিক। হয়তো আমার উৎসাহ দেখে মা এইসব ভেবেছে। মায়ের ভুল ভাঙতে তাই মানসিকভাবে হয়তো ভিতরে-ভিতরে বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছিল।” “সরি অ্যাগেন, আসলে তুমি তো আমার প্রেমিক নও… আমিই যেচে-যেচে… গায়ে পড়ি।” এই সেনটেন্সটা এল মিনিট পনেরো বাদে। এই গ্যাপে নাজ়িয়া নিশ্চয়ই আশা করছিল সুমন্ত কিছু লিখবে। আসলে ও তো প্রেমিকই, বিয়ে করতে অপারগ এক প্রেমিক!

এর পরও সুমন্ত কোনও উত্তর দেয়নি। প্রতি পাঁচ মিনিটে অন্তত একটা মেসেজ করা নাজ়িয়া কেমন যেন গুম মেরে গেল। সারাদিন কোনও মেসেজই আর করল না।

সুমন্ত বুঝল নাজ়িয়া অন্তত প্রেমিকার স্বীকৃতি চায় সুমন্তর কাছে। পৌনে ছ’টায় বেল বাজিয়ে আর্দালিকে ডেকে বলল, নাজ়িয়াকে ডেকে দিতে। নাজ়িয়া এল মুখ নিচু করে, ওর চোখের পাতা ভারী। বেশি ঘাঁটালেই বৃষ্টি নামবে। তাই শান্ত গলায় সুমন্ত বলল, “আমি তোমার লাভার ঠিকই, কিন্তু এর পরিণতি কী সত্যিই আমি জানি না।”

কোনও উত্তর নেই, নাজ়িয়া চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে মাথা নিচু করে। এই নিঃস্তব্ধতা খুব বিচলিত করে তোলে সুমন্তকে। অফিসের কেউ এইভাবে দেখে ফেললে বিরাট কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। তাই খুব ভালভাবে, চটচটে সহানুভূতি মাখানো গলায় বলে, “তুমি যাও, ভাল করে ভাবো, যেভাবে আমাকে চাইবে আমাকে পাবে, তবে আমি বিবাহিত।”

যেমন মুখ নিচু করে এসেছিল, তেমনই মুখ নিচু করে ফিরে গেল নাজ়িয়া। সুমন্ত ভাবতে বসে, এটা কি আদৌ প্রেম? নাকি শুধুই লম্পট পুরুষের কামনা? ও কি নাজ়িয়ার আগে-পিছে ঘুরে-ঘুরে প্রেম নিবেদন করেছে? ঘূর্ণির মতো না হোক, ওর চোখে কি কোনওদিন প্রেমের ভাষা ছিল? যদি না থাকে, তাহলে নাজ়িয়া কাছে এল কীভাবে? তবে সুমন্ত নিজের কাছে অস্বীকার করতে পারে না যে, নাজ়িয়ার প্রতি কামনার আগুন টিমটিম করে জ্বলছিলই, আর ওর চোখের ভাষায় কিছু না কিছু ছিলই, তবেই না নাজ়িয়া ওর ভাষা পড়ে কাছে এল। নাজ়িয়াকে দেখার পরই সেই কাকভোর থেকে সুমন্ত অপেক্ষা করে থাকে কখন ওকে দেখতে পাবে অফিসে এসে, ওর ঘ্রাণ নেবে। প্রথম-প্রথম ছিল শুধুই দর্শকাম, পরে বুঝল ওকে ছোঁয়ার এক তীব্র বাসনা। তারপর ওকে স্পর্শ করল, আর ওকে পাওয়ার এক তীব্র বাসনা ওকে প্রায় কামোন্মাদ করে তুলেছিল দিল্লি যাওয়ার দিন পর্যন্ত।

দিল্লি থেকে ফিরে এসে অপরাধবোধেও ভুগত খুব। আরতিকে ঠকাচ্ছে, ওকে নিশ্চয়ই চিট বলা যায়? কেন এমন হল? আরতিকে কি ও ভালবাসে না? আলবাত বাসে, নাজ়িয়ার থেকে একটু হলেও বেশি ভালবাসে। আসলে শারীরিক মিলনটা ওর সঙ্গে রুটিন কাজের মতো হয়ে গিয়েছিল, প্রায় উত্তেজনাবিহীন এক জৈবিক প্রক্রিয়া। আরতিকে বিয়ে করার পর ওর প্রতিও তীব্র আকর্ষণ অনুভব করত সুমন্ত। আরতির ছিল বেশ চটকদার আকর্ষক চেহারা। সৃজিতা হওয়ার পর থেকেই নিজের প্রতি যত্ন নেওয়া বন্ধ করে দিল আরতি, সময়ের অভাব, এই অজুহাতে। সুমন্ত বুঝত, আসলে আলস্য আর মাতৃত্বের পরিপূর্ণতা ওকে স্যাচুরেটেড করে দিয়েছিল, জীবনের অনেকটা আকাঙ্ক্ষা পূর্ণতা পেয়েছিল ততদিনে। তার উপর আবার আরতি নারীবাদী। একদিন সুমন্ত মিলনের তীব্রতায় কাতর, অথচ আরতি এগিয়ে এল অত্যন্ত নিস্পৃহভাবে, দায়সারা ভাবে এগিয়ে দিল নিজেকে।

সুমন্তকে বিরক্তির চরম সীমায় পৌঁছে দিয়ে বলল, “তোমার ঘুমের ওষুধ আমার শরীর, তাই না?”

বিরক্ত হয়ে নিভে গেল সুমন্ত। বলল, “ওই তো তোমার পুরনো কাঁথার মতো ঝোলা তলপেট আর পায়ে শুয়োরের মতো লোম। তা আবার ঘুমের ওষুধ হবে কীভাবে? কিছু ব্যায়াম তো করতেই পারো। বিউটিপার্লার অলিতে-গলিতে, তাহলে ওয়াক্সিং করাও না কেন?”

“ইল্লি, পোয়া বারো তোমার বলো? কাঁথার মতো তলপেট কার জন্য শুনি?”

সুমন্ত মোটেই ঝগড়ার মুডে ছিল না, তাই চুপ করে থাকে। তবে বিরক্তিতে মনটা ভরে যায় সুমন্তর।

আরতি তখন নাছোড়, তসলিমার ভাষায় বলে, যদি তলপেটের মেদ, পায়ের লোম কায়দা করে লুকাতে হয়, তবে তোমার সঙ্গে অন্য কিছু, প্রেম নয় আমার!

আমার যা কিছু এলোমেলো,

যা কিছু খুঁত, যা কিছু ভুল ভাল,

অসুন্দর থাক, সামনে দাঁড়াবো, তুমি ভালোবাসবে…

সুমন্তর খুব বলতে ইচ্ছে করে, যেদিন চলে যাব দূরে কোথাও, প্রেমটাকে বাঁচিয়ে রেখে, আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো।

অধ্যায় ১ / ১৫

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন